আত্মার আগলে পর্ব ১৪
সানজিদা আক্তার মুন্নী
মেহনূর আয়াত খানা পড়ে কিছু সময় নীরব থাকে, ফের আরেক খানা আয়াত তেলাওয়াত শুরু করার জন্য নিজের অন্তরকে প্রস্তুত করবে! তখনই ওর মনে হয়, এহসান হয়তো ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, কারণ সে এহসানের শরীরের ঘ্রাণ পাচ্ছে!
তার মস্তিষ্ক তাকে জানিয়ে দিচ্ছে, এহসান আশেপাশেই আছে—এহসানের শরীরের এই ঘ্রাণ এ কয়দিনে মেহনূরের আত্মার সাথে মিশে গেছে! এহসানের শরীরে এই ঘ্রাণ—এত ঘৃণার! এই এত ঘৃণা, এত বিষাক্ততার মধ্যেও তাকে কেমন মাতোয়ারা করে তোলে! তাই এখন এহসানের উপস্থিতি মেহনূর মুহূর্তেই বুঝে যায়!
মেহনূর ধীরে ধীরে পিছনে ঘুরে দাঁড়ায়! তার ধারণাই সঠিক হয়—এহসান দাঁড়িয়ে আছে তার পিছনে আর সেই বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছে তারই পানে! মেহনূর বিরক্তি নিয়ে এহসানের পানে তাকায়, তারপর দাঁত চেপে বলে—
—গজব পড়ুক এই চোখে! গজব! যে চোখ দিয়ে সবসময় বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকেন আপনি আমার পানে!
এহসান কোনো উত্তর দেয় না। ঠোঁট কেটে হেসে সে মেহনূরের দিকে আলতো করে এগোতে এগোতে বলে—
—গজব পড়ুক! সত্যি গজব পড়ুক! ঝলসে যাক এই চোখ! তাহলে অন্তত তোমায় দেখার তৃষ্ণা আর জাগবে না এই ব্যাকুল হৃদয়ে!
এ বলেই এক পলকেই এহসান মেহনূরের একদম কাছে চলে আসে!
মেহনূর যেই না সরতে যাবে, ওমনি এহসান নিজের হাত বাড়িয়ে মেহনূরের কোমর জড়িয়ে নিজের বক্ষস্থলের নিকট টেনে নেয়!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ব্যস, মেহনূরের সব শক্তি ফুরিয়ে যায়! সে এহসানের এতটা কাছে এসে গেছে যে, এহসানের শরীরের ঘ্রাণ তীব্রভাবে পাগল করে দিচ্ছে মেহনূরকে! নড়াচড়া করতে পারছে না মেহনূর! শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল বাতাসের স্রোত বয়ে যাচ্ছে, প্রাণটা বারবার কেঁপে উঠছে!
এহসান কিছু মুহূর্ত মেহনূরের আবেদনময়ী মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে! মেহনূর নামাজের সাদা হিজাব পরে আছে, যার জন্য এহসানের কাছে মেহনূরকে কবুতরের বাচ্চার মতো মনে হচ্ছে! খুব বেশি আবেদনময়ী মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে তার নারীকে নিজের কাছে! এহসান তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে মেহনূরের পানে তাকিয়ে আফসোসের সুরে বলে—
—তোমায় মন ভরে দেখলাম! প্রাণভরে দেখলাম! তোমার এই মায়াময়ী মুখের দিকে প্রহর পর প্রহর নিষ্পলক তাকিয়ে রইলাম! কিন্তু… তাও নিজের চোখের তৃষ্ণা মিটাতে পারলাম না!
মেহনূর ভয়ে ভয়ে এহসানের পানে তাকায়, তারপর নির্বিকারভাবে বলে—
—কিসের তৃষ্ণা?
এহসান কোনো উত্তর না দিয়ে মেহনূরের কপালে গভীরভাবে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করায়, তারপর মলিন গলায় বলে—
—তোমায়! এই আমার তুমি কে —দেখার তৃষ্ণা! ভালোবাসার দৃষ্টিতে চেয়ে থাকার তৃষ্ণা!
মেহনূর বোকার মতো চাহনি দিয়ে এহসানের পানে তাকায়, তারপর ফিসফিস করে বলে—
—কিন্তু এই ভালোবাসা যে কলঙ্কের!
মেহনূরের এমন কথা শুনে এক নিমিষেই মেহনূরকে নিজের বক্ষস্থলে শক্ত করে জড়িয়ে নেয় এহসান! অতঃপর ব্যাকুল গলায় বলে—
—তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা যদি কলঙ্কের হয়, তাবে এই কলঙ্কই আমার জন্য চিরন্তন!
মেহনূর একটা শব্দও করে না! চুপচাপ এহসানের বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে থাকে! এই পাপিষ্ঠ পুরুষকে সে এত ঘৃণা করে! এত ঘৃণা! কিন্তু কেন জানি আজ এই পাপিষ্ঠ পুরুষের বুকে মাথা রাখতে ঘৃণা করছে না! কিন্তু কেন? কেন ঘৃণা করছে না? অস্থির হয়ে ওঠে মেহনূরের ভেতরটা! সে আলতো করে মাথা নাড়ায়, এতে এহসান মেহনূরকে ছেড়ে দেয়।
মেহনূর দ্রুত বলে—
—নি… নিচে যেতে হবে! রাতের…
এহসান মেহনূরের অবস্থা উপলব্ধি করতে পেরে মৃদু হেসে বলে—
—হুম, যাও।
—
মেহনূর নিচে রান্নাঘরে চলে আসে। এখানে রাতের খাবার তৈরি করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে! এশার নামাজের পর সবাই খেয়ে ঘুমিয়ে যান!
এনিসা বেগম মেহনূরকে রান্নাঘরে দেখে মুচকি হেসে বলেন—
—কোনো প্রয়োজন, মেহনূর?
মেহনূর সংকোচ নিয়ে বলে—
—ঐ… ঐ… ভাবলাম যদি তোমাদের কোনো সাহায্য করতে পারি… যদি…
এনিসা বেগম মেহনূরের কথা শুনে মেহনূরের দিকে এগিয়ে গিয়ে মেহনূরের মাথায় আলতো করে হাত রেখে বলেন—
—তা তো করবে, যদি নিজ ইচ্ছায় চাও! আর যদি এহসানের কথায় এসে থাকো, তাহলে নিজের অনিচ্ছায় কাজ করতে হবে না, মেহনূর!
মেহনূর কাঁপা গলায় বলে—
—না… চ… না মানে… উনি বলেননি, আমি নিজেই এসেছি! কিছু যদি করি, ভালো লাগবে!
এনিসা বেগম হেসে বলেন—
—তাহলে যাও, ওখানে ডিম সিদ্ধ রাখা আছে! এহসানের জন্য ডিম ভর্তা আর মাছ ভর্তাটা তৈরি করে নাও!
মেহনূর মাথা নাড়ায়, তারপর কাজে লেগে পড়ে! তবে সাথে টুকটাক সবার সাথেই গল্প করছে!
সবকিছু তৈরি হয়ে গেলে সবাই একে একে বড় রাজকীয় টেবিলে খাবার পরিবেশন করেন!
নয় থেকে দশটা খাবারের তরকারি টেবিলে থাকতেই হবে—এটাই নিয়ম। আর আগে বাচ্চারা খাবে “!
পরে বাড়ির পুরুষরা খাবেন, এবং তাদের বেগমরা পাশে থাকবেন—কিছু লাগবে কি না তা দেখার জন্য। পুরুষদের খাওয়া শেষে মহিলারা খাবেন!
বাড়ির সব পুরুষ টেবিলে উপস্থিত, শুধু এহসান ছাড়া! এনিসা বেগম মেহনূরকে উদ্দেশ্য করে বলেন—
— এহসান কোথায়, মেহনূর?
মেহনূর কিছুটা লজ্জায় পড়ে যায়, কিন্তু এখন লজ্জার সময় নয়। তাই আমতা আমতা করে বলে—
— ঐ ঘরেই তো দেখে এলাম।
আয়শা বেগম বলেন—
— তাহলে একটু ডেকে নিয়ে এসো।
মেহনূর মাথা নাড়ায় দু’দিকে, তারপর পা বাড়ায় যাওয়ার জন্য। তখন আমেনা বেগম বলেন—
— ঘরে না পেলে ছাদে দেখো।
মেহনূর উনার দিকে একপলক তাকিয়ে নিম্ন গলায় বলে—
— আচ্ছা।
মেহনূর কক্ষে আসে, কিন্তু এহসানকে পায় না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে এবং ছাদের দিকে রওনা হয়! তিন তলা পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে, একদম ছাদের দরজার কিনারায় এসে থমকে যায় মেহনূর! কারণ ওর কানে স্পষ্ট একটা সুন্দর কন্ঠ আসছে।
মেহনূর ধীর পায়ে নিশ্চুপ হয়ে ছাঁদের দরজা বরাবর দাঁড়ায়। সামনে থাকাতেই দেখতে পায়—এহসান অন্য দিকে মুখ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা নাশিদ পড়ছে। নাশিদটা মেহনূরের কানে স্পষ্ট ভেসে আসছে—খুব সুন্দর করে উচ্চারণ করছে এহসান!
طَوِيلُ الشَّوْقِ يَبْقَى فِي اغْتِرَابِ
فَقِيرٌ فِي الحَيَاةِ مِنَ الصِّحَابِ
وَمَنْ يَأْمَنُكَ يَا دُنْيَا الدَّوَاهِي
تَدُوسِينَ الصَّحَابَ فِي التُّرَابِ
وَأَعْجَبُ مِنْ مُرِيدِكَ وَهُوَ يَدْرِي
بِأَنَّكَ فِي الْوَرَى أُمُّ الْعُجَابِ
وَلَوْلَا أَنَّ لِي مَعْنًى جَمِيلًا
لَنُفِّقَ النَّفْسَ فِيهَا بِالذَّهَابِ
মেহনূর মুগ্ধ হয়ে শুনছে। নিজ দুনিয়ায় নেই সে, ডুবে গেছে এহসানের কণ্ঠে, এই নাশিদে! এত সুন্দর মনে হচ্ছে, যেন নাশিদটা নিজেই গেয়েছে এহসান— অথচ তা নয়! এই নাশিদ মেহনূরের ভীষণ প্রিয় একটি নাশিদ!
এহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিছনে ঘুরে। মনটা একটু হালকা হলো—আল্লাহর হুকুমে!
পিছনে ঘুরে থমকে যায় এহসান!
মেহনূর দাঁড়িয়ে আছে—তার প্রাণ দাঁড়িয়ে আছে! আর তার প্রাণ তারই দিকে তাকিয়ে আছে—তাও ঘৃণাহীন দৃষ্টিতে!
এই পাপিষ্ঠ জীবনে এটাই তার পাওয়া সবচেয়ে বড় উপহার—তার নারী তার দিকে ঘৃণাহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে”!
এহসান এক নজর পরখ করে নিজের আপন নারীকে!
আজ তার প্রেম-প্রেয়সীকে বেশিই সুন্দর লাগছে! পড়নে খয়েরি থ্রি-পিস, দুধে-আলতা ফর্সা গায়ের সঙ্গে এই রঙটা বেশি মানিয়ে গেছে! তাই তো এত সুন্দর লাগছে! ভয়ংকর সুন্দর লাগছে—ভয়ংকর! হৃদয় ছেদ করছে বারবার এই সৌন্দর্য!
চাঁদের আলো চকচক করছে তার নারীর সৌন্দর্যে!
এর মধ্যে মাথার ওড়নাটা মাথা থেকে সরে গেছে, এতে আধখোলা খোঁপা করা চুল দেখা যাচ্ছে। সামনের দিকের কিছু চুল কপালে এসে পড়েছে—মোহময়ী লাগছে! তার বেয়াদব নারীকে আজ আরও বেশি মোহময়ী লাগছে! সৌন্দর্য উপচে পড়ছে!আর সেই মায়াবী আঁখি…
আজ সেই আঁখিতে কোনো ঘৃণা নেই, কোনো অভিযোগ নেই, শুধু আছে একরাশ মুগ্ধতা!
তাই তো এই আঁখিজোড়া এহসানকে মাতোয়ারা করে তুলছে!
এহসান মেহনূরের দিক থেকে চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে—
— ইয়া রাব্বে কারীম! আপনি আমায় নিজেকে সামলানোর অসীম ক্ষমতা দান করুন! আপনি দয়াময়, আপনি দয়া করুন আমায়! আমার প্রাণপ্রিয় নারীকে যে সৌন্দর্য দিয়েছেন আপনি, নয়তো তাতে ডুবে যাবো আমি! আমাকে ধৈর্য দান করুন, মাবুদ! আপনি তো সব জানেন, সব!
মেহনূর উপলব্ধি করে—তার ওড়নাটা মাথায় নেই!
তাড়াতাড়ি মাথায় ওড়না টেনে নেয়। কারণ শয়তান বলে—
“যে নারীর মাথায় কাপড় থাকে না, সে আমার স্ত্রী!”
আর এমনিতেই এক ইবলিশের বউ হয়ে বসে আছে—আর চায় না আরেক ইবলিশের স্ত্রী হতে!
তাই দ্রুত ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে নেয়! অতঃপর আলতো পায়ে এহসানের সামনে এসে দাঁড়ায়। নিচের দিকে তাকিয়ে বলে—
— চলুন, খাবার খেতে হবে।
এহসান মেহনূরের কথায় আবার ওর দিকে তাকায়।
এহসান লক্ষ্য করলো—মেহনূর কাঁপছে!কারণ প্রচুর ঠান্ডা, আর ওর গায়ে কোনো চাদরও নেই!
এহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের গায়ের চাদর হাতে নিয়ে নেয়। তারপর দু’দিকে ধরে অতি যত্নে মেহনূরের গায়ে জড়িয়ে দেয়!
মেহনূর কিছু টা ভরকে যায় তারপর বুঝতে পারে এহসান ওর ঠান্ডা লাগছে বেপার টা বুঝতে পেরেছে “!
অতঃপর মেহনূরকে বলে—
— হুম, চলো।
এহসান আর মেহনূর একসাথে ছাঁদের দরজা পার হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। তবে মেহনূর বারবারই এহসানের দিকে তাকাচ্ছে! কিন্তু কেন তাকাচ্ছে, কী জন্য তাকাচ্ছে—তা সে নিজেও জানে না! সে শুধু এই মুহূর্তে এটুকুই জানে—
এখন তার এহসানকে দেখা উচিত!
তাই বারবারই নিজের দৃষ্টি এহসানের পানে নিক্ষেপ করছে!
এক সময় মেহনূর এহসানের দিকে তাকানোর চক্করে সিঁড়িতে উষ্টা খেয়ে পড়ে যেতে নেয়! মেহনূর এতটা গভীর ভাবনায় চলে গেছে এহসানকে নিয়ে যে, উষ্টা খেয়ে পড়ে যাচ্ছে তাও ঐ আগের মতো এহসানের পানে তাকিয়ে আছে।
কিন্তু মেহনূর পড়ে যায় না, ঠিক সময় এহসান সামনে হাত নিয়ে আগলে নেয় মেহনূরকে! মেহনূর নিজ দুনিয়ায় ফিরে আসে। সে যে একটা আস্ত বেকুব, তা সে নিজেও জানে। আবুলের মতো, যে দিকে মন যায়, সে দিকেই মন পড়ে যায়। এখন সবটা বুঝে ভীষণ লজ্জায় পড়ে যায় মেহনূর, ছিঃ ছিঃ, কি হলো?
এহসান ঠোঁট কেটে হেসে বলে,
——- “তোরই আছি আমি, তৃপ্তি ভরে দেখবি আমায়, সমস্যা নেই, কিন্তু এখন আমার দিকে না তাকিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে একটু হাঁট পরে, তুই পড়ে গিয়ে নিজের কিছু করলে আমার হবে কি?”
মেহনূর এমন কথায় লজ্জায় পড়ে যায়, তারপর লজ্জা কে গিলে এহসানকে মলিন গলায় বলে, ”
—-আপনি তো আমার দিকে সারাদিনই তাকিয়ে তাকেন, আর আমি একবার তাকিয়েছি বলে এমন করে বললেন?”
এহসান একটা শব্দও না করে মেহনূরকে কোলে তুলে নেয়, তারপর আলতো হেসে বলে, ”
—–এবার তাকাও, মনে ভরে তাকাও, মনে ভরে দেখো, এই আমি, শুধু তোমার, শুধু তোমার, শুধু তুমিই তাকাবে, আমি এহসানের পানে বারবার তাকাবে, আমার পানে বারবার।”
কিন্তু মেহনূর আর তাকায় না, লজ্জায়! এ জায়গায় মেহনূরের জায়গায় অন্য কেউ হলেও হয়তো এমন লজ্জায় মরে উঠতো। কি ভয়ংকর লজ্জার বিষয়! যাকে ঘৃণা করে তার দিকেই তাকিয়েছিল! আর এমন তাকানো তাকিয়েছিল যে তাকাতে তাকাতে উষ্টা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল! কি লজ্জার বিষয়! মেহনূরের কাছে এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কিছু নেই, কি লজ্জা! সব শেষ হয়ে গেছে লজ্জায়! মেহনূর চুপচাপ নিজের গাল এহসানের বুকের সাথে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়!
এহসান ধীর পায়ে নিজ প্রাণপ্রিয় নারীকে নিয়ে এগিয়ে যেতে তাকে।
এহসান মেহনূরকে এনে দ্বিতীয় তলার সিঁড়িতে এসে ধীরে ধীরে নামিয়ে দেয়! তারপর দুজন ধীর পায়ে নিচে নামে।
এতক্ষণে সবার অর্ধেক খাওয়া শেষ হয়ে গেছে, বলতে গেলে। এহসান গিয়ে চুপচাপ নিজের চেয়ারে বসে। মেহনূর কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। এটা দেখে মনিরুল সাহেব বলেন—
— এহসানকে খাবার বেড়ে দাও, এখন থেকে সারাজীবন এটাই তোমার দায়িত্ব, মেহনূর!
এই কথায় মেহনূরের কলিজা খঁচ করে ওঠে। সারাজীবন তাকে এই পুরুষের কলঙ্কের ছায়ায় থাকতে হবে? এই পাপিষ্ঠ পুরুষের খেদমত করতে হবে? সত্যিই কি এতটা নিকৃষ্ট জীবন তাকে পার করতে হবে? না, এমন কিছু কখনোই হতে পারে না! এটা ঠিক নয়! এসব সমাজের চোখে নোংরামি, এসব ঠিক নয়, এসব পাপ, কলঙ্ক!
এসব ভাবতে ভাবতে মেহনূরের মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
তখনই এহসান মেহনূরের পানে শান্ত চোখে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে—
— মেহনূর।
এহসানের ডাকে নিজের জগৎ থেকে ফিরে আসে মেহনূর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীর পায়ে টেবিলের কাছে এগিয়ে আসে। তারপর টেবিল থেকে ভাতের বাটি নিয়ে এহসানের প্লেটে তুলে দেয়। এরপর একঝলক এহসানের দিকে তাকায়। এহসান তখন প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহনূর নিম্ন গলায় বলে—
— কি নিবেন?
এহসান মাথা তুলে তাকায়। মেহনূরের পানে তাকাতেই অদ্ভুতভাবে তার দৃষ্টি আটকে যায়—ওর ঠোঁটের নিচে মাঝ বরাবর থাকা তিলটায়! মেহনূর ওর দিকে ঝুঁকে থাকায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে উক্ত তিলটি এহসান “!
তিলটিতে চোখ পড়তেই বুকের ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি খেলে যায় এহসানের। মনে হচ্ছে কেউ বুকের অন্তস্থলে হাতুড়ি পেটা করছে! কি আজব অনুভূতি! আল্লাহ! এই নারীর সাক্ষাৎ পাওয়ার পর থেকে একেক দিন একেক রকম অনুভূতির সম্মুখীন হচ্ছে সে!
(মনে মনে এহসান)
মেহনূর আবার বলে—
— কি নিবেন?
এহসান নিজে জগতে ফিরে আসে। তারপর আমতা আমতা করে বলে—
— হুম… দিয়ে দাও যেকোনো একটা।
মেহনূর দাঁত চেপে একপলক এহসানের পানে তাকায়। তাকানোরই কথা, এহসান যে নির্লজ্জের মতো ওর দিকে তাকিয়ে ছিল! আর এটা দেখে উপস্থিত সবাই মিটমিট করে হাসছে। এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু হতে পারে?
লজ্জায় মরে যাবে সে! বর্তমানে এটাই ভাবছে মেহনূর!
অবশেষে মেহনূর ডিম ভর্তা তুলে দেয় এহসানের প্লেটে।
এহসান বিসমিল্লাহ বলে খাবার খেতে শুরু করে। কিন্তু আজকের ডিম ভর্তার স্বাদ যেন ভিন্ন! অন্যরকম লাগছে! খাবারটা খুব ভালো লাগছে!
এহসান নিজের আম্মাকে জিজ্ঞেস করে—
— আম্মা, এটা কে তৈরি করেছে? তুমি তো নও, কারণ এর স্বাদ ভিন্ন!
এনিসা বেগম মেহনূরের দিকে ইশারা করে বলেন—
— মেহনূর।
এহসান একপলক মেহনূরের দিকে তাকায়। তারপর আবার খাওয়া শুরু করে।
একে একে সবার খাওয়া শেষ হয়।
মেহনূর লক্ষ্য করে, এই বাড়িতেও তাদের বাড়ির মতো সবাই খাওয়া শেষে নিজ নিজ বেগমের আচলে হাত-মুখ মুছে।
ইয়া আল্লাহ! এখন যদি এহসানও তার সঙ্গে ওমন করে!
তখনই দেখে, এহসানের প্লেটে ভাত নেই। তাই তাড়াতাড়ি প্লেটে ভাত তুলে দেয়, সঙ্গে মাছ ভর্তাও।
এহসান খাবার শেষ করে উঠে বেসিনে গিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নেয়। অতঃপর ধীর পায়ে এসে দাঁড়ায়।
তাকিয়ে দেখে, মেহনূরের ওড়নার একপাশে নিজের হাত-মুখ মুছে নেয়!
মেহনূর একপলক এহসানের পানে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে এহসান মেহনূরের গালে ঠান্ডা হাত স্পর্শ করে!
মেহনূর কেঁপে ওঠে, আর সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে! ছিঃ! কেউ যদি এটা দেখে ফেলত?
তড়িঘড়ি চারপাশে তাকায় মেহনূর।
আশ্চর্যের ব্যাপার, এখানে কেউ নেই!এটা দেখে কিছুটা স্বস্তি পায় সে।
ঠিক তখনই এহসান ওর কানের কাছে এসে বলে—
— আহা! আমার লজ্জাবতী লতাপাতা রেহ…
মেহনূর কটমট করে তাকায় এহসানের দিকে। তবে এহসান পাত্তা না দিয়ে টেবিলের এক পাশে রাখা সুপারির থালা থেকে এক টুকরো সুপারি মুখে দেয়।
সুপারি সে খায় না, তবে খাবার খাওয়ার পর অল্প খেতে হয়, না হলে গলায় কেমন কেমন করে!
মেহনূর পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে! আর মনে মনে গালি দিতে থাকে এহসানকে!
সব মহিলারা খেতে বসে যান। খাওয়া শেষে সব গুছিয়ে সবাই নিজ নিজ কক্ষে চলে যান।
মেহনূরও ধীর পায়ে আপন কক্ষে প্রবেশ করে।
কক্ষে এসে দেখে, এহসান লুঙ্গি আর টি-শার্ট পরে সুবহানাল্লাহ সুবহানাহু উচ্চারণ করতে করতে বের হচ্ছে। দেখে বোঝাই যাচ্ছে, এহসান অজু করে এসেছে।
মেহনূর এসব খেয়াল না করে এহসানের পাশ কাটিয়ে বাথরুমে প্রবেশ করে। উদ্দেশ্য, অজু করে এসে হাত-মুখ মুছে নেওয়া। তেমনটাই করে
অজু শেষ করে এসে বিছানার দিকে এগোয়। তখন দেখতে পাায়”!
এহসান আধশোয়া হয়ে বিছানায় বসে আছে।
এহসানকে বিছানায় দেখে মেহনূরের মন ভীষণ ভয় পেয়ে যায়!
যদি গত রাতের মতো ওকে জড়িয়ে ধরে?
না! সে কখনোই এহসানের পাপিষ্ঠ বুকে নিজের মাথা রাখবে না!
এই এহসানের জন্য তার বাবা-চাচাকে কুকুরের মতো আহাজারি করতে হয়েছে! এই এহসানের জন্য তার ভাইজান ক্ষতবিক্ষত হয়েছে!
না! সে এই পুরুষের বুকে আজ মাথা রাখবে না!
সে সোফায় ঘুমাবে!
মেহনূর এসব ভেবে ঠিক করে যে আজ সে সোফায় ঘুমাবে!
চুপচাপ একটা বালিশ নিয়ে উদ্দেশ্য সোফায় যাওয়া।
বালিশ নিয়ে যেই না পা বাড়াবে, তখনই এহসান বলে—
— কোথায় যাচ্ছিস?
মেহনূর দাঁত চেপে বলে—
— সোফায়।
এহসান রাগি গলায় ধমক দিয়ে বলে—
— বেশি বেয়াদবি করিস না! চুপচাপ এসে আমার বুকে শুয়ে যা!
মেহনূর অন্য দিকে তাকিয়ে বলে—
— আমি কোনো পাপীর পাপিষ্ঠ বুকে মাথা রাখতে পারব না! আমি সোফাতেই ঘুমাব!
এহসান নিজের উপর থেকে কম্বল সরিয়ে নিতে নিতে বলে—
— উঠব? উঠব আমি? যদি আমি এখন উঠে যাই, তোর সব বেয়াদবি এক মুহূর্তে ছাড়িয়ে নেব!
এহসানকে রেগে যেতে দেখে, মেহনূরের চোখে আগের ঘটনাগুলো ভেসে ওঠে। তাই আমতা আমতা করে বলে—
— না না! আমি আসছি, উঠতে হবে না!
এ বলে মেহনূর বিছানায় উঠে যায়।
এহসান বাতি বন্ধ করে দিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়ে।
— তাড়াতাড়ি মাথা রাখ।
মেহনূর জান বাঁচাতে ধীরে ধীরে এহসানের বুকে মাথা রাখে…অতঃপর নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে রয় ‘!
মেহনূরের চোখ ধীরে ধীরে লেগে আসে! পাপিষ্ঠ পুরুষের বুকেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যায়। এহসান মেহনূর কে ঘুমিয়ে যেতে দেখে ওর কপাল বারবার কয়েকবার নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে বলে,
— তোকে এইভাবে কাছে পেতে আমি, এহসান, যে কত অপেক্ষার প্রহর গুনেছি, তা তুই যদি জানতি, তাহলে তুই নিজ ইচ্ছায় আমি এহসানের হয়ে যেতি।
তারপর নিজের দুই হাত দিয়ে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আপন প্রানপ্রিয় নারীকে! আপন নারীকে জড়িয়ে ধরে ঘুমের দেশে পাড়ি দেয় এহসান।
রাত তিনটা🌸🌸🌸
মেহনূরের ঘুম ভেঙে যায়, এ সময়টা তার সবসময় ঘুম ভেঙে যায়, কারণ এ সময় যে তাহাজ্জুদের সময়, এ সময় যে রবের নৈকট্য লাভ করার সময়!
মেহনূর ঘুম থেকে তো উঠে যায়, তবে উঠতে আর পারে না! উঠবে কীই বা করে? এহসান যে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে! মেহনূর অনেক নড়াচড়া করে,
কিন্তু এহসান ওকে ছাড়ছে না। কয়েকবার ডাকেও মেহনূর, কিন্তু এতে এহসান অল্প একটু নড়াচড়া করে ফের আবার মেহনূরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যায়।
মেহনূর এবার কিছু না পেয়ে এহসানের বুক বরু কামড়ে ধরে। এতে এহসানের ঘুম পুরোপুরি ছাড়ে!
তবে এহসানের ঘুম ভাঙার পরও সে মেহনূরকে ছাড়ে না। এতে মেহনূর চিৎকার করে উঠে বলে,
— সমস্যা কী আপনার? এভাবে জড়িয়ে ধরেছেন কেন? ছাড়ুন!
এহসান মেহনূরকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, ঘুমঘুম গলায় বলে,
— আর মাএ একটু, তারপর ছাড়ব।
মেহনূর বেজায় রেগে গিয়ে, ছোট বাচ্চারা মাটিতে পড়ে যেভাবে গড়াগড়ি খায়, এমনভাবে নড়তে থাকে সে! বেচারা এহসান এবার এই কান্ডে ছেড়েই দেয় মেহনূরকে!
এহসান মেহনূরকে ছেড়ে দিতেই মেহনূর তাড়াতাড়ি উঠে বসে, এতক্ষণ দম বন্ধ হয়ে আসছিল! পাশ থেকে ওড়নাটা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নেয়! তখনই এহসান শুয়ে থেকে উপরের দিকে তাকিয়ে বলে,
— ইয়া রাব্বে কারীম, আপনি এক জিনিস জুটিয়েছেন, আমার কপালে মন্দ নয়!
মেহনূর কটমট করে তাকিয়ে এহসানের পানে বলে উঠে,
— মন তো চাচ্ছে, থাপ্পড় দিয়ে এই অসভ্য জবান ভেঙে দিতে।
এহসান মেহনূরের দিকে চোখ রাঙিয়ে চেয়ে বলে,
— বেয়াদ্বব নারী, স্বামীর সাথে কেমন আচরণ করতে হয় সেটা জানিস না? থাপ্পড় বসিয়ে দেব, গাল বরাবর! দিব থাপ্পড়?
মেহনূর এমন কথা শুনে চুপচাপ বিছানা থেকে নেমে যায়, আর এখানেই তাকা যাবে নাহ!
মেহনূর উঠে গিয়ে ওযু করে এসে তাহাজ্জুদের নামাজে দাঁড়ায়। এহসানেরও ইচ্ছে করছে নামাজ পড়তে, তাই তাড়াতাড়ি বিছানার ছেড়ে উঠে যায়।
আত্মার আগলে পর্ব ১২+১৩
অতঃপর বাথরুম থেকে ওযু করে এসে একখানা জায়নামাজ নিয়ে মেহনূরের পাশে জায়নামাজে দাঁড়ায়! এতক্ষণ মেহনূর দু রাকাআত নামাজ পড়ে সালাম ফিরিয়ে নিয়েছে ‘! এহসান কে দেখে মেহনূর বলে,
— আমায় মিসওয়াক এনে দিবেন?
এহসান মেহনূরের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়,
— আচ্ছা, ঠিক আছে।