আত্মার আগলে পর্ব ২০

আত্মার আগলে পর্ব ২০
সানজিদা আক্তার মুন্নী

— “আমাকে সত্যি ভালোবাসেন আপনি?”
মুখে ভাতের শেষ ক’টা লোকমা গিলতে গিলতে মেহনূর এহসানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে। ওর গলা কাঁপছে চোখের কোণে জমে থাকা জল নড়েচড়ে উঠছে।
এহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কয়েক মুহূর্ত ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে বলে—
— “বলেছি তো একবার, আর বলবও হাজারো বার। তোকে আমি ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি!”
মেহনূর এহসানের চোখের দিকে তাকায়। ওর কথাগুলো সত্যি কিনা, তা বোঝার চেষ্টা করে। বুকের গভীর থেকে একটা সাহস জড়ো করে বলে—

— “তাহলে একটি বার আমায় নিয়ে যান হাসপাতালে।”
কিন্তু এহসান ওর কথায় পাত্তা দেয় না। বরং এক গ্লাস পানি হাতে তুলে নেয়, মেহনূরের ঠোঁটে ঠেকিয়ে দেয়। তারপর নিজের হাতে ওর মুখ মুছে দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে—
— “আমি গোসল করে আসছি, এর মধ্যে তৈরি হয়ে নে।”
মেহনূরের চোখে এক মুহূর্তের জন্য আশার আলো জ্বলে ওঠে। এহসান কি তবে সত্যিই ওকে নিয়ে যাবে? সত্যিই পরিবারের কাছে ফিরতে দেবে?
কিন্তু তখনই এহসান দাঁত চেপে ওর দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলে—
— “ভাবিস না ভালোবেসে নিয়ে যাচ্ছি! তোকে জন্মের দেখানো দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি, বেয়াদব বান্দি!”
এহসানের তীক্ষ্ণ ধমকটা এবার আর আগের মতো ওর গায়ে লাগে না। বরং একটা স্বস্তি আসে বুকের গভীর থেকে। কারণ, এবার অন্তত আপনজনদের দেখা তো মিলবে!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এহসান কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে, হাতে খাবারের ট্রে। উদ্দেশ্য, নিচে রেখে আসা। খানিকটা হলেও মনে প্রশান্তি এসেছে—অন্তত মেহনূর এবার কিছুটা শান্ত হল। সারাদিন ধরে এই নারী ওকে পাগল করে ছেড়েছে! ভেতরটা শুধু খাবলিয়েছে, আর ওর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে একটাই চিন্তা—এই বেয়াদব নারী নিশ্চয়ই কান্না করতে করতে নিজের অবস্থা কাহিল করে ফেলেছে! একটুতেই তো কাঁদতে কাঁদতে পৃথিবী ভাসিয়ে দেয়!
সভায় যাওয়া জরুরি ছিল, তাই না গিয়েও উপায় ছিল না। নাহলে সেই সময়ই নিয়ে যেত হাসপাতালে। তবুও ভেবেছিল, ফিরে এসে দেখবে, যদি মেহনূর বেশি ব্যাকুল হয় উঠে, তখন নিয়ে যাবে। কিন্তু ফিরে এসে যা দেখল…!
মেহনূর একদম বিধ্বস্ত! যেন শরীরের সমস্ত শক্তি ফুরিয়ে গেছে। পানিশূন্য, নিস্তেজ, একদমই প্রাণহীন লাগছে ওকে! এহসানের বুকটা ধক করে উঠেছে। মাথার ভেতর তখন একটাই ভাবনা—আর এক মুহূর্তও দেরি করা যাবে না!এই বেয়াদ্দব নারী কে এখনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে “! নয়তো কাঁদবে এই বেয়াদ্দব বান্দি আর কষ্ট হবে নিজের বুকে “”!
হাসপাতালে যাওয়ার পথে

এহসান মেহনূরকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে রওনা দেয়। শহর থেকে গ্রাম বেশি দূরে নয়, কিন্তু মেহনূরের মনে হচ্ছে যেন এই পথটুকুই অনন্তকাল। সে চুপচাপ বসে আছে, চোখের জল টুপটুপ করে পড়ছে। নিকাবের নিচে চাপা কান্নার শব্দ এহসানের কানে আসতেই ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
গাড়ির স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে মৃদু স্বরে বলে—
— “আচ্ছা, তোর চোখের আড়ালে কি কোনো সাগর লুকিয়ে রেখেছিস?”
মেহনূর হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাকায়। তবে কিছু বলে না ঘৃনা লাগছে ঘৃনা ‘!
এহসান মৃদু হাসে, এক ঝলক ওর দিকে তাকিয়ে আবার রাস্তার দিকে মনোযোগ দিয়ে বলে।
— “মানে, যখনি দেখি তখনি তো চোখ ভাসিয়ে দিস। এত পানি আসে কোথা থেকে?”
একহাতে স্টিয়ারিং সামলে অন্য হাত দিয়ে নিজের রুমালটা বের করে ওর দিকে বাড়িয়ে দেয়।
— “এই নে, বেয়াদব বান্দি! চোখ মুছ এবার।”

মেহনূর চুপচাপ রুমালটা নেয়। চোখের উপর থাকা হালকা কালো পর্দাটা সরিয়ে চোখ মুছতে শুরু করে।
এহসান ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বুকের ধুকপুকানি টের পায়। নিকাবের নিচে লুকিয়ে থাকা সেই মায়াবী চোখজোড়া এখন সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, যেন এক টুকরো রাতের আকাশ। গাড়ি চালানো ভুলে যেতে ইচ্ছে করছে এহসানের, শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে মনে চাচ্ছে।
মেহনূর যখন চোখ মুছে আবার পর্দাটা লাগানোর জন্য হাত বাড়ায়, তখনি এহসান গম্ভীর স্বরে বলে—
— “এখন লাগাবি না। আমি তৃষ্ণা মেটাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছিস না?”
মেহনূর দাঁত চেপে রাগী চোখে তাকায়, কিন্তু কিছু বলে না। শুধু চুপচাপ বসে থাকে।
এহসান আবার বলে—
— “হাসপাতালে পৌঁছালেই লাগাস। এখন রেখে দে হাতে।”
গাড়ি দ্রুত টাউনের দিকে এগিয়ে চলে। বেশি দেরি হয় না, মিনিট পনেরোর মধ্যেই হাসপাতালের সামনে এসে পৌঁছায় ওরা।

হাসপাতালের সামনে এসে এহসান গাড়ি থেকে নেমে আসে। নিজের গায়ের চাদরখানা অর্ধেকটা টেনে নেয়, যাতে তার মুখটা বেশি দেখা না যায়। মিডিয়ার সামনে ধরা পড়া মানেই বিশৃঙ্খলা, আর এই মুহূর্তে কোনো বিশৃঙ্খলা সে চায় না। তার থেকেও বড় কথা, মেহনূরকে কেউ দেখে ফেলুক, সেটা সে একদমই বরদাশত করবে না।
মেহনূর নিজের চোখের উপরের পর্দাটা ঠিকঠাক করে নেয়, তখনই এহসান ওর পাশে এসে দরজা খুলে দেয়।
গাড়ি থেকে নামতেই ঠান্ডা বাতাস মেহনূরের মুখ ছুঁয়ে যায়, কিন্তু তার মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। পায়ের নিচের মাটিটা যেন কাঁপছে, তার বাড়ির মানুষজন কেমন আছে! দাদীজানের কী অবস্থা! আব্বা! বড় ভাইজান! ভাবতে ভাবতে সে এক পা ফেলে, তখনই এহসান ওর এক হাত শক্ত করে ধরে ফেলে।
মেহনূর বিস্ময়ে তাকায়, কিন্তু এহসান কোনো কথা না বলে ওর হাত ধরে এগিয়ে যেতে থাকে। হাসপাতালের দরজার সামনে কিছু লোক একটু দূরত্ব রেখে হাঁটছে, তাদের চোখ এহসানের দিকে নিবদ্ধ। একজন শান্ত গলায় বলে—

— সাহেব, আপনি যেমন বলেছেন, আমরা তেমনটাই করেছি।
এহসান ওদের এক পলক দেখে নিয়ে বলে—
— সেদিকে যদি একটা লোকও দেখি, তাহলে বুঝে নিস আমি কী করতে পারি।
একজন সঙ্গে সঙ্গে বলে—
— না সাহেব, কেউ আসবে না। দুই পাশে চারজন পাহারায় আছে, আর হাসপাতালের অনুমতি তো আছে আর এটার ৪০ অনুপাতে তো আপনিই মালিক!
এহসান আর কিছু না বলে মেহনূরকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।
মেহনূরের মন এসবের ধারেকাছেও নেই। তার মন পড়ে আছে তার পরিবারের দিকে। তারা কেমন আছে? দাদীজান কীভাবে আছেন? বড় ভাইজান এখন কী করছেন?সে কি জানে এসবের ব্যাপারে? এসব চিন্তা ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে? মন চাচ্ছে এহসান যেমন মানুষের কলিজা ছিঁড়ে আনে তেমনি এহসানের কলিজাও ছিঁড়ে নিতে “!
কিন্তু সে কিছু করতে পারবে না “! কারণ এই এহসান তালুকদারের আওতায় তার পরিবার “! বেশি কিছু করলে না জানি কি করো বসে এই পাষাণ টা “!

এহসান ওকে নিয়ে হাসপাতালের এক করিডোরে নিয়ে আসে, যেখানে ওর বাবা-চাচারা আছেন।
মেহনূর অবাক হয়ে যায়! এই করিডোরের চারদিকে একটাও সাধারণ মানুষও নেই! অথচ হাসপাতাল তো সবসময় ভিড়ে ঠাসা থাকার কথা! কিন্তু এখানে একেবারে নিস্তব্ধতা… যেন কেউ ইচ্ছে করেই পুরো করিডোর ফাঁকা করে রেখেছে।
এই নিরবতা তার কেমন অস্বস্তিকর লাগতে থাকে।
তখনই ডান পাশের একটা কক্ষ থেকে এক পরিচিত মুখ বেরিয়ে আসে—
সে আর কেউ না ওর ছোট ভাইজান মেহরুব!
মাথায় ব্যান্ডেজ, পায়ে ব্যান্ডেজ, মুখেও ক্লান্তির ছাপ! মনে হচ্ছে, প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে সে নিজেই নিজেকে ভর দিয়ে হাঁটছে।
কান্না জড়িত কণ্ঠে ডাক দেয় মেহনূর।

— ছোট ভাইজান!
ওর ডাক শুনে মেহরুব থমকে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে সামনে তাকায়।
আর যখন দেখে তার ছোট্ট পরীটাকে এহসান নিয়ে এসেছে, তখন তার মুখটা আনন্দে ভরে যায়।
কিন্তু তার পরক্ষণেই চোখ স্থির হয়ে যায় এক জায়গায়—
মেহনূরের নিষ্পাপ হাতখানি এহসান শক্ত করে ধরে আছে!
বুকের ভেতর তীব্র জ্বালা অনুভব করে মেহরুব।
ওর প্রিয় পরীটাকে এক পাপিষ্ঠ পুরুষের হাতের মুঠোয় দেখে সে আর নিজেকে সামলাতে পারে না। খুব কষ্ট হয় এটা দেখে যে তার পরী টা আজ এক পাপিষ্ঠ পুরুষের আগলে ‘!
মেহনূর এহসানের পানে তাকিয়ে দ্রুত বলে ওঠে—

— আমার হাতটা ছেড়ে দিন, দয়া করে! একবার শুধু ভাইজানের কাছে যাই…
এহসান তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ মেহনূরের চোখ পানে। তারপর ধীরে ধীরে মেহনূরের হাত ছেড়ে দেয়।
হাত ছাড়া পেতেই মেহনূর ছুটে গিয়ে মেহরুবকে জড়িয়ে ধরে!
মেহরুবও ওকে বুকের মাঝে চেপে ধরে। যেন তার সমস্ত কষ্ট নিমেষে উধাও হয়ে যায়!নিজের বোন কে বুকে পেয়ে “! রত্ন পাওয়ার মতো আগলে নেয় আপন বুকে নিজে বোন কে “!
মেহনূর কান্না করতে করতে বলে
— ভাইজান, তুমি ঠিক আছ তো? আব্বার কী হয়েছে?
মেহনূর আর কিছু বলতে পারে না, কান্নায় গলা আটকে আসে।
মেহরুব ওর কপালে চুমু খেয়ে বলে—
— হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি, আপ্পি! আর আব্বাও ঠিক আছে, তুই কাদিস না, প্লিজ! কলিজা, তুই ঠিক আছিস তো?
মেহনূর চোখের জল মুছে বলে—
— হ্যাঁ, ঠিক আছি। ওরা অযত্নে রাখেনি আমায়।
মেহনূর আর কিছু বলে না “!! নিজ ভাইজান এর বুকে মাথা রেখে হু হু করে কাঁদতে থাকে আর বলতে থাকে
— ভাইজান ঐ পশু টা কে আমি কত বার বলেছি তোমাদের বাঁচাতে কিন্তু সে কিছু করেনি ‘! সে খুব নিকৃষ্ট ভাইজান খুব নিকৃষ্ট ‘!
মেহরুব মেহনূরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে

— তোর সাথে কিছু করেছে বল তোকে মেরেছে বল? তোর সাথে কোনো অমানুষিক কাজ করেছে বল? আমায় বল? আমি ওকে কেটে ফেলব তুই শুধু বল? কিছু করেছে তোর সাথে? বল? ভাইজান কে বল?
মেহনূর মেহরুব এর বুক থেকে মাথা তুলে “! মেহরুব এর চোখের জল মুছে দিতে দিতে কান্না আঁটকে গলায় বলে
— না, না ভাইজান কিছু করেনি আমার সাথে কিছু করেনি! তুমি কোনো চিন্তা করো না ‘!
ঠিক তখনই কেবিনের দরজা খুলে একজন ডাক্তার বেরিয়ে আসেন।
মেহনূর একপলক তাকিয়ে দেখে সে দিকে … তারপর হতভম্ব হয়ে বলে ওঠে—
— বড় ভাইজান!
মেহরাজ!
ওর বড় ভাই মেহরাজ ওদের দিকে তাকায়, চোখ বড় বড় হয়ে যায়। কিছু মুহুর্ত একে অপরের দিকে থমকে তাকিয়ে থাকে ‘!
তারপর বিস্ময় কাটলে মুহূর্তের মধ্যেই সে ছুটে আসে, মেহনূরকে জড়িয়ে ধরে”!
আজ মেহরাজ নিজেকে আটকে রাখতে পারল না।পুরুষরা সহজে কাঁদে না, কিন্তু আজ মেহরাজ আর নিজেকে সামলাতে পারে না।নিজের কলিজার টুকরো বোনকে বুকের মাঝে টেনে নিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে! মেহনূরের কপালে অসংখ্যবার চুমু খেতে খেতে ফিসফিস করে বলে,

— কেমন আছিস, প্রাণ আমার?
মেহনূর ওর বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে ফিসফিস করে বলে
— ভালো নেই ভাইজান! একটুও ভালো নেই আমি! আমি যে কলঙ্কে কলঙ্কিত হয়ে গেছি! আমি তোমাদের আগলে আর নেই! আমি সেই পাপিষ্ঠ পুরুষের হাতে বন্দি হয়ে গেছি!
মেহনূরের এমন আহাজারি শুনে মেহরাজ দিশেহারা হয়ে যায়।
সে ধরা গলায় বলে—
— সব ঠিক হয়ে যাবে, সব! আমি এসে গেছি! আমি সব ঠিক করে দেব!
এই বলে মেহনূর কে নিজের বুক থেকে একটু সরিয়ে “! করিডোরে নিশ্চিন্তে বসে থাকা এহসানের দিকে চোখ ঘুরিয়ে ফেলে।
দাঁতে দাঁত চেপে বলে—
— তোকে ওর হাত থেকে আমি ছিনিয়ে আনব! ছিনিয়ে আনব!ছিনিয়ে
মেহনূর আঁতকে উঠে ওর মুখ চেপে ধরে। বলে
— এমন কথা বলো না ভাইজান! যদি উনি শুনে ফেলেন? উনি তোমায় মেরে ফেলবেন! তুমি জানো না, তোমাদের ধারণার বাইরে এই এহসান তালুকদার কতটা ভয়ংকর! উনার অন্তরে নেই দয়া-মায়া! আছে শুধু পাপ আর নিষ্ঠুরতা!
মেহরাজের গা জ্বলে যায়!

— ওর থেকে তোকে আমি ছিনিয়ে আনব! আমি…
মেহনূর দু’হাতে মেহরাজের বাহু ধরে অসহায় কণ্ঠে বলে উঠল,
— ভাইজান, আব্বাহ কই? আমি আব্বারে দেখব!
কথাটা বলেই সে মেহরাজের হাত ছেড়ে ক্যাবিনের দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু মেহরাজ মুহূর্তেই ওর পথ রোধ করে, দু’হাতে ওর কাঁধ চেপে ধরে নরম স্বরে বলল,
— এখন দেখবি না, মেহনূর। এখনও জ্ঞান ফেরেনি, আমি এইমাত্র চেক করে এসেছি।
কিন্তু মেহনূর মানতে চায় না, জেদ চেপে বলে,
— না! আমি একটাবার দেখব, ভাইজান… শুধু একটাবার!
এইবার মেহরুব সামনে এসে ওর মাথায় হাত রেখে শান্ত স্বরে বলল,

— এত জেদ করিস না, মেহনূর। আব্বা’কে তুই অবশ্যই দেখবি, কিন্তু এখন ওনার অবস্থা এমন যে দেখা সম্ভব নয়।
মেহনূর ধীর হাতে নিকাব খুলে নেয়। সে ভালো করেই জানে, এহসান হারাম পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে, তাই এখানে নিশ্চিন্তে নিকাব খোলা যায়। চোখের জল হাতের কব্জি দিয়ে মুছে ফেলে সে, তারপর ফিসফিসিয়ে বলে,
— কে বলেছে দেখতে পারব না? আমি দেখবই!
মেহরুব তখন মলিন গলায় মেহরাজের দিকে ইশারা করে বলল,
— ঐ তো আমাদের ডাক্তার সাহেব! দেখ, ডাক্তার সাহেব সামান্য চট লেগেছে বলে আমাকেও অজ্ঞান করে চিকিৎসা দিয়ে দিয়েছেন!
মেহরাজ একধাপ এগিয়ে এসে মেহরুবের থুতনি ধরে মেহনূরের দিকে দেখিয়ে বলল,
— এটা সামান্য চট বলছিস? আরে, ও তো একটা আস্ত অমানুষ! কত কষ্ট করে আমি ওকে বুঝিয়ে ব্যান্ডেজ করিয়েছি, তুই যদি জানতি, মেহনূর…
মেহনূর এবার ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মেহরাজ আর মেহরুবের হাত নিজের দু’হাতে নেয়, ছলছল চোখে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

— দাদাজান কি করছে? চাচারা কোথায়? বাড়ির সবাই কেমন আছে?
মেহরাজ আর মেহরুব এক পলক পরস্পরের দিকে তাকায়, তারপর মেহনূরের দিকে ফিরে ওকে আশ্বস্ত করে,
— দাদাজান বাড়িতেই আছেন। চাচারা সবাই হাসপাতালে, নিজ নিজ ক্যাবিনে। আর তুই চিন্তা করিস না, সবাই ভালো আছে।
মেহরাজ এবার খুব যত্নে মেহনূরের গালে হাত রাখল। গলায় এক অসহ্য কষ্ট জমে আছে যেন।
— কতদিন পর তোর নিষ্পাপ মুখ দেখলাম রে, আপ্পি! জানিস, প্রাণটা বেরিয়ে যাচ্ছিল তোকে দেখার জন্য!
মেহনূর ধীরে মেহরাজের হাত সরিয়ে নিজের হাতে নিল, তারপর চোখ বুজে ওর হাতে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। অজান্তেই গড়িয়ে পড়ল চোখের জল।
— জানো, যখন তোমাদের কথা মনে পড়ত, আমার দুই কলিজার টুকরো ভাইয়ের কথা মনে পড়ত, কলিজাটা ছিঁড়ে যেত… কিন্তু কিছুই করতে পারতাম না… কিছুই না!
মেহরুব এবার মেহনূরের মাথায় হাত রেখে দৃঢ় স্বরে বলল,
— এখন থেকে আর কষ্ট পেতে হবে না, কারণ এখান থেকে তুই সোজা আমাদের সাথে যাবি।
ঠিক তখনই এহসান বেঞ্চ থেকে উঠে পকেটে ফোন রেখে ওদের দিকে এগিয়ে এল। হাঁটতে হাঁটতে গম্ভীর স্বরে বলল,

— মেহনূর, এদিকে আয়।
এহসানের ডাকে মেহনূরের বুক ধক করে উঠল। সে জানে না এবার এই মানুষটা কি বলবে, কি করবে! ভাইজানরাই বা কি বলবে?
পিছনে ফিরে কিছু বলতে যাবে, তখনই মেহরুব বলে উঠল,
— মেহনূর, চল, আব্বাকে দেখবি!
মেহনূর দ্বিধায় পড়ে গেল। কার কথা শুনবে সে? একবার তাকায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এহসানের দিকে, আরেকবার ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের ভাইদের দিকে।
তার তো আব্বাকে দেখা উচিত… কিন্তু যদি সে এখন এহসানের কথা না শুনে, তাহলে কি হবে? এই আজাজিল এবার কি করবে— একমাত্র আল্লাহই জানেন!
কিন্তু আল্লাহ ঠিকই ওকে সাহায্য করলেন। মেহরাজ মেহরুবের কাঁধে হাত রেখে বলল মেহরুব কে চুপ করিয়ে৷ মেহনূর কে ইশারা করে বলে ,
— তুই শুনে আয়।

মেহনূর নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকিয়ে এহসানের দিকে এগিয়ে গেল।
ও যেতেই এহসান ওর হাত ধরে একটু দূরে নিয়ে এল, তারপর সামনে দাঁড়িয়ে গভীর চোখে তাকিয়ে বলল,
— আমি এক’ঘণ্টার মধ্যে আসছি। এই এক’ঘণ্টায় যা দেখার জন্মের মতো দেখে নে, নিজের বাপ-ভাইদের!
মেহনূর হতবাক হয়ে এহসানের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু বলতে গিয়ে কিছু বলল না “!
এহসান তার এমন তাকানো দেখে কিছু বলে না। বরং নিজের পাঞ্জাবির পকেট থেকে আরেক খানা রুমাল বের করে মেহনূরের থুতনি আলতো করে ধরে, তারপর তার স্মুথ চামড়ার উপর দিয়ে রুমাল বুলিয়ে দেয়। বলে
— এবার চোখের জল মুছে দিলাম আর যেন মুছতে না হয়
মেহনূর নিঃশ্বাস আটকে যায়। এহসানের চোখে গভীর কিছু খুঁজে পায়, কিন্তু সেটা কী, সে বুঝতে পারে না…
মেহনূর শুধু ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এহসানের দিকে। যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে এক ভয়াবহ দৃশ্য—নিজের আব্বার নিথর দেহ। বুকের ভেতর যেন একটা আগুন জ্বলছে, হাতটা উসখুস করছে এহসানের গালে কয়েকটা চপেটাঘাত বসিয়ে দিতে। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু পারছে না।

এহসান গভীর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মেহনূরের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে তার মুখটা কাছে নিয়ে আসে।
মেহনূর সঙ্গে সঙ্গে মুখ কুঁচকে নেয়, চোখেমুখে স্পষ্ট ঘৃণার ছাপ ফুটে ওঠে।
এহসান হঠাৎ করেই তার নরম গালের ওপর নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়।
মেহনূরের পুরো শরীর রাগে জ্বলে ওঠে। বুকের ভেতর যেন আগ্নেয়গিরি ধূমায়িত হচ্ছে।
তবে সে নিজেকে সামলে নেয়, দাঁতে দাঁত চেপে, দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে।
এহসান সরে যেতে যেতে হুমকির সুরে বলে,
–+”কোনো চালাকি করতে যাস না! আশেপাশে সব আমার লোক! আমি এক ঘণ্টার মধ্যে আসছি!”
তারপর ধীর পায়ে করিডর দিয়ে চলে যায়।
এহসানের চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ নিথর দাঁড়িয়ে থাকে মেহনূর, তারপর ধীর পায়ে ভাইদের দিকে এগিয়ে আসে।
মেহনূর আসতেই মেহরুব মুখে তীব্র ক্ষোভ নিয়ে বলে,

-+++”কি বলেছে ঐ কুত্তার বাচ্চা?”
মেহনূর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চোখেমুখে বিষন্নতা এনে শান্ত কণ্ঠে বলে,
—“এক ঘণ্টার জন্য তোমাদের কাছে রেখে গেছে।”
মেহরাজের কপালের রগ ফুলে ওঠে। ঠান্ডা অথচ দৃঢ় গলায় বলে,
—“এক ঘণ্টা নয়, মনে করো সারাজীবনের জন্য রেখে গেছে!”
মেহনূর অবাক হয়ে বড় ভাইয়ের দিকে তাকায়। গলা ধরে আসে তার। অসহায় স্বরে বলে,
—“ভাইজান, একটা কথা বলি তোমাদের?”
মেহরুব বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে,
—-“একটা কেন? হাজারটা বল!”
মেহনূর মেহরুবের হাত শক্ত করে ধরে, নিজের হাতের মুঠোয় পুরে ফিসফিস করে বলে,
—-“ভাইজান, আমি আর ঐ বাড়িতে যেতে চাই না! আমি তোমাদের সাথে যেতে চাই। পারবে আমায় নিয়ে যেতে?”
নিজের ছোট্ট বোনের এমন আকুতি শুনে দুই ভাইয়ের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। মেহরাজ ও মেহরুব ওকে নিজেদের দুই হাতে আগলে ধরে বলে,
—-“হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুই আমাদের সাথেই যাবি! আর যেতে হবে না ঐ পশুর কাছে! ইনশাআল্লাহ তোকে আমরা নিয়ে যাব!”

মেহনূর ডুকরে কেঁদে ওঠে,
“—-ভাইজান! ওর আশেপাশে অনেক লোক! কিভাবে যাব আমি?”
মেহরুব দৃঢ় গলায় বলে,
—–“ওদের সামনেই যাবি! ও আসলে পরিষ্কার বলে দিবি যে তুই ওর সাথে যাবি না। বাকি আমরা সামলে নেব!”
ভাইদের কথায় কিছুটা আশ্বাস পায় মেহনূর। এরপর অস্ফুট স্বরে বলে,
—“আমি আব্বাকে দেখতে চাই!”
এইবার আর মেহরাজ বাধা দেয় না। ওকে নিয়ে ক্যাবিনে প্রবেশ করে।
ক্যাবিনে প্রবেশ করতেই মেহনূর স্পষ্ট দেখতে পায়—ওর আব্বার নিথর দেহ হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে। নিস্তেজ, জ্ঞানশূন্য, প্রাণহীন। বুকের ভেতর একরাশ কষ্ট দলা পাকিয়ে ওঠে।
ওর আব্বার হাতে স্যালাইনের ক্যানোলা লাগানো, মুখে অক্সিজেন মাস্ক। নিঃশ্বাস চলছে, কিন্তু প্রাণ যেন নেই!
মেহনূর চোখের পলক না ফেলেই আব্বার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর কোনোদিকে না তাকিয়ে দৌড়ে গিয়ে বিছানার পাশে বসে পড়ে। আব্বার হাত শক্ত করে ধরে ফেলে। গলা শুকিয়ে আসে, কিন্তু কান্নায় বাধ ভাঙে না।
হঠাৎ ওর কণ্ঠ ফেটে পড়ে—বলে

“—আব্বা! উঠুন! প্লিজ, একবার শুধু! আম্মাজান এসেছেন! আপনার আম্মাজান!”
—“একবার শুধু বলুন, আম্মা, আমায় একটা সূরা তেলাওয়াত করে শোনাও! শুধু একবার বলুন, আব্বা! আপনার আম্মাকে দেখুন, দেখুন তো! আপনাট আম্মাজান এসেছি, দয়া করে কথা বলুন , আব্বা!”
চোখ দিয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। হাত কাঁপছে।
“—আমার আব্বা, একটা কথা বলুন! খুব রাগ হলে রাগ করুন! শাস্তি দিন! কিন্তু কথা বলুন! আমি এই নীরবতা সহ্য করতে পারছি না!”
কিন্তু হাসপাতালের সাদা বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটা একদম নিস্তেজ। কোনো সাড়া নেই।
মেহনূর তখন কেঁদে ওঠে, বুক চাপড়ে বিলাপ করতে থাকে।
মেহরাজ আর মেহরুব অনেক কষ্টে ওকে ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। কারণ ওর মধ্যে কোনো হুশ নেই, সে এভাবে ভেঙে পড়লে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।
মেহরাজ শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে, কপালে চুমু খেয়ে শান্ত গলায় বলে,
—-“শান্ত হ, মেহনূর! আব্বা জ্ঞান হারিয়েছেন, কথা বলতে পারবেন না। আল্লাহ চাইলেই শুধু উনি কথা বলতে পারবেন!”

কিন্তু মেহনূর শান্ত হতে পারে না।
ও মেহরাজকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে,
—“সব হয়েছে ঐ অমানুষ এহসানের জন্য! কতটা নিকৃষ্ট, কতটা জানোয়ার সে! আমার নিজের উপর ঘৃণা লাগছে! ঘৃণা লাগছে যে আমি ঐ মানুষের অধীনে!”
ওর কণ্ঠ রাগ আর যন্ত্রণায় থরথর করছে।
—“ভাইজান! আমায় মেরে ফেলো! আমি এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না! আমি কলঙ্কিত হয়ে বাঁচতে চাই না! এই সুন্দর দুনিয়ায় আমি থাকতে চাই না!”
নিজের বোনের এমন অসহায় আহাজারি শুনে মেহরাজ আর মেহরুব নিজেদের কান্না ঠোঁট চেপে আটকে রাখে।
তাদের ছোট্ট পরী, যে কতটা ধৈর্যশীল, তা তারা জানে। অথচ আজ সেই ধৈর্য চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তাই এত আহাজারি করছে, এত কষ্টে ভেঙে পড়ছে।
মেহনূর আবার ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
–“আমি চাচাদের দেখতে চাই!”
মেহরুব ওর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে, তারপর বলে,
–“আচ্ছা, চল!”

ওরা মেহনূরের দুই হাত শক্ত করে ধরে চাচাদের ক্যাবিনের দরজার সামনে নিয়ে যায়। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে দেয় না।
মেহনূর অনেক অনুরোধ করে, আকুতি জানায়, কিন্তু মেহরাজ কঠোর থাকে। কারণ ও জানে, মেহনূর ভেতরে গেলে কান্নায় ভেঙে পড়বে, আর ওদের চাচারাও তখন ভেঙে পড়বেন। তখন সামলানো আরও কঠিন হয়ে যাবে।
হাসপাতালের বেঞ্চে নিথর হয়ে বসে আছে মেহনূর, আর তার দুই ভাই মেহরাজ ও মেহরুব মাথা রেখে বসে আছে ওর কাঁধে। দুজনেই টিপে টিপে চোখের জল ফেলছে, বুকের গভীরে জমে থাকা যন্ত্রণাকে চেপে ধরে আছে যেন একটা শব্দও বের না হয়।
মেহনূর ওদের গালে হাত রাখে, স্নেহভরে চোখের জল মুছে দিয়ে নরম গলায় বলে,
— “তোমরা কাঁদছো? আর আমায় বলছো না কাঁদতে? তোমরা কাঁদলে আমি কীভাবে নিজেকে ঠিক রাখব, বলো তো?”

মেহনূরের কথায় মেহরাজ আর মেহরুব এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কিন্তু কাঁধ থেকে মাথা সরায় না। যেন ওদের একমাত্র আশ্রয় এই মুহূর্তে ওদের বোনের উষ্ণতা।
একটু নড়েচড়ে বসে মেহনূর মেহরাজের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
— “ভাইজান, তুমি এখানে কীভাবে এলে? কবে এলে?”
মেহরাজ দম নিয়ে বলে,
— “শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছিল, হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। তখন সিনিয়র ডাক্তাররা আমাকে কয়েকদিনের ছুটি দিল। সুস্থ হতেই দেশে ফেরার টিকিট কাটলাম। কিন্তু দেখ, কেমন আজব ব্যাপার—বাড়ি যেতে পারলাম না! উল্টে হাসপাতালে ছুটতে হলো। এসে দেখি আব্বা আর চাচারা…!”আর এখানে এসে অনেক কষ্টে অনুমতি নিলাম হাসপাতালে কর্তৃপক্ষ থেকে” তারপর আব্বার চিকিৎসা শুরু করলাম “!
মেহনূর চোখের জল মুছে ফেলে। ওর ঠোঁট কাঁপে, কণ্ঠ কেঁপে যায়,

—“মনে আছে, ভাইজান? যেদিন তুমি বিদেশে গেলে, সেদিন আব্বা আর চাচারা বুক ফুলিয়ে বলেছিল— ‘নিজেদের এক ছেলেকে ডাক্তার বানাচ্ছি, যাতে রক্তাক্ত হলে নিজের ছেলের কাছ থেকে সেবা পাই!'”
মেহরাজের অন্তরটা আবেগে ভেসে যায়। বুকের ভেতর এক অজানা শূন্যতা, এক চাপা কষ্টের স্রোত বয়ে যায়। চোখের জল গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।
মেহরুব ক্লান্ত, ভীষণ ক্লান্ত। এত কিছু সহ্য করার মতো শক্তি যেন আর অবশিষ্ট নেই। নিজের বোনের কাঁধে মাথা রেখে অজান্তেই চোখ বুজে আসে।
মেহনূর এক পলক ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, তার নরম শ্বাসের ওঠানামা অনুভব করে। তারপর ধীরে ধীরে ডান হাতখানা মেহরুবের মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতে মেহরাজের দিকে তাকিয়ে বলে,
— “জানো ভাইজান, আমার ছোট ভাইজানকে ঐ পশুটা কত নির্মমভাবে মেরেছিল! ও চেয়েছিল আমি রাজি হই, ওর কুৎসিত খেলায় নিজেকে সঁপে দেই। তাই আমার ছোট ভাইজানের জানের বদলে আমাকে নিজের করে নিতে চেয়েছিল…”

বোনের কণ্ঠে এমন অসহায়তা শুনে মেহরাজ মেহনূরের বা হাত শক্ত করে ধরে ফেলে। গলায় কঠিন প্রতিজ্ঞার সুর—
— “এমন কিছু আর কখনো হবে না, ইনশাআল্লাহ। তোকে আমরা নিয়ে যাব আমাদের সাথে। আল্লাহ আমাদের উপর রহম করবেন।”
তারপরই করিডরে পায়ের শব্দ।
এহসান!
মেহনূর আতঙ্কে কেঁপে ওঠে। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ বাড়তে থাকে। এহসান এখানে এসে গেছে এখন সে জানে, এই লোকটা এক্ষুনি তার ভাইদের বুক থেকে তাকে ছিনিয়ে নেবে। কিন্তু সে যেতে চায় না! সে তার ভাইজানদের বুকেই আশ্রয় চায়!
এহসান ধীর পায় নিজের পড়নের চাদর খানা কাঁধে তুলে নিতে নিতে এগিয়ে এসে ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখে সেই ঠান্ডা, নির্মম দৃষ্টি। কণ্ঠেও বরফ শীতলতা—নিয়ে বলে
— “মেহনূর, চলে আয়। সময় ফুরিয়ে এসেছে।”
মেহনূর থমকে যায়। তার ঠোঁট শুকিয়ে আসে। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে।
কিন্তু কেউ কিছু বলে না।

মেহরাজ ধীরে ধীরে মেহনূরের হাত শক্ত করে ধরে, তারপর মেহনূরের কাঁধে শক্ত করে মাথা রেখে বসে থাকে। যেন কোনোভাবেই তাকে ছাড়বে না।
এহসান বিরক্ত হয়। এবার কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি—নিয়ে বলে
— “মেহনূর, এসব নাটক এখন ভালো লাগছে না। তাড়াতাড়ি উঠে আয়। বাড়ি যেতে হবে।”
মেহরাজ এবার আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারে না! সাপের ফণা তোলা রূপে উঠে দাঁড়ায়। চোখে আগুন, কণ্ঠে বজ্রধ্বনি—বলে
— “আমার বোন কোথাও যাবে না!”
এহসান মুচকি হাসে। সেই অদ্ভুত, তাচ্ছিল্যের হাসি—দিয়ে বলে
— “মেহরাজ বাবা, এত বোন-বোন করিস না। এখন সে শুধু আমার। আমি আমার নারীকে নিতে এসেছি।”
মেহনূরের ভেতর শিউরে ওঠে ভয়। আল্লাহই ভালো জানেন, এখন কী হতে যাচ্ছে! আল্লাহ না করুন, এই লোকটা তার ভাইজানদের কিছু করে বসে!
শব্দের অভিঘাতে মেহরুবের ঘুম ভেঙে যায়। সে ধীরে ধীরে মাথা তুলে উঠে দাঁড়ায়।
মেহরুবকে উঠে দাঁড়াতে দেখে মেহনূর আর দেরি করে না! সে তড়িঘড়ি করে মেহরুবের হাত জড়িয়ে ধরে ফেলে।
সে জানে, তার বড় ভাইজান ধৈর্যশীল। সে পরিস্থিতি বোঝে, তারপর কথা বলে। কিন্তু তার ছোট ভাইজান…
ও গরম মেজাজি!কখন কী করে বসে, নিজেও হয়তো জানে না!
মেহরাজ মাথা উঁচু করে, দৃঢ় কণ্ঠে উত্তরে বলে,

— “তোমার নারী তোমার সাথে যাবে না, এহসান তালুকদার। তাই ওর আশা তুমি ছেড়ে দাও।”
এহসান মেহরাজের কথায় মেহনূরের দিকে ছোট ছোট চোখে তাকায়, তারপর শান্ত গলায় বলে,
— “সত্যি কি তাই? তুমি, নাকি আমার সাথে যেতে চাও না, জান?”
“জান” এ কথা মেহনূরর কানে শূলের মতো বিঁধে যায়, এই পাপিষ্ঠ পুরুষের কথা। সে তার ভাইজানের সামনে এমনভাবে সম্মোধন করছে, যা তার সমস্ত অন্তরকে তছনছ করে দেয়।
মেহনূর, মেহরুবের পিঠের পিছনে আড়াল হয়ে ধীরে ধীরে বলে,
— “আমি যাব না, আপনার সাথে।”
এহসান এক তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলে,
— “তুইও তো হয়ে গেছিস, তোর বাপ চাচার মতো মীরজাফর! কই, হাসপাতাল আসার আগে তো বলেছিলি, আমাকে একবার এদের দেখাতে নিয়ে আসবি, যার জন্য তুই সারাজীবন আমার দাসী হয়ে থাকবি! এখন পাল্টি খাচ্ছিস?”

এহসান আবার মেহনূরের দিকে তাকিয়ে দাঁত চেপে বলে,
— “নিজের ভাইদেরও যদি বাপের মতো আধমরা অবস্থায় দেখতে না চাস, তো চুপচাপ চলে যাও, বেয়াদ্দব বান্দি!”
মেহনূর এহসানের এমন হুমকিতে ভয় তো পায়, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে মেহরুবের পিছন থেকে বেরিয়ে এসে জোর গলায় বলে,
— “আমি যাব না! আপনি কি করবেন, করে নিন! যাব না আমি!”
এহসান মৃদু হেসে বলে,
— “অনেক সাহস বেড়ে গেছে, না? এই কয়েক মুহূর্তেই!”
মেহরুব দাঁত চেপে বলে,
— “হ্যাঁ, বেড়ে গেছে! কী করবি তুই?”
এহসান রাগে চোখে আগুন নিয়ে মেহরুবের দিকে তাকিয়ে বলে,
— “বেয়াদবি করিস না, মেহরুব, চাচাহই আমি তোর,আর সাথে তোর বোনের হবু বাচ্চার বাপ! তাই চুপচাপ তোর বোনকে আমার হাতে তুলে দে!”

এহসান এমন কথা বলার সাথে সাথে মেহরাজ, মেহরুব, এবং মেহনূর তিনজনেরই দম বন্ধ হয়ে আসে, যেন আকাশ থেকে পড়ে যাচ্ছিল ওরা।
মেহরুব আর মেহরাজ একে অপরকে একে একে চেয়ে থাকে। গলায় কোনো শব্দ বের হয় না, যেন দুনিয়ার সমস্ত শান্তি হারিয়ে গেছে।
মেহরুব মেহনূরের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট গলায় বলে,

আত্মার আগলে পর্ব ১৮+১৯

— “তুই মা হতে…?”
মেহনূর থমকে যায়, একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে সে কী বলবে, কিছুই খুঁজে পায় না।
এহসান এত বড় মিথ্যা কীভাবে বলল, সে এখনও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছে না। গলায় শব্দ আটকে আসে, তবে সে নিঃশব্দে বলে,
— “এ… এই লোক এসব সব মিথ্যা বলছে, ভাইজান!”

আত্মার আগলে পর্ব ২১+২২