আত্মার আগলে পর্ব ২১+২২
সানজিদা আক্তার মুন্নী
এহসান মেহনূরের কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে—
—শুনো, এখন এত নাটক না করে চলে এসো। এই সময়ে তোমার বেশি জেদ করা উচিত নয়। আমার বাচ্চার আম্মা, তাড়াতাড়ি আমার বুকে চলে এসো।
তখন মেহরাজ বলে উঠল—
—পাগল ভেবেছো? দুদিন হলো না বিয়ে করেছি, আর বাচ্চা আসবে কোথা থেকে?
এহসান মেহরাজের কথা শুনে মুচকি হেসে বলল—
—বাবা মেহরাজ, তোমার বোনের বাচ্চার বাপের পুরুষত্ব একটু বেশিই ফাস্ট, বুঝলে?
এহসানের এমন কথায় মেহনূরের কান গলে যাচ্ছে “! ছিঃ এতটা নির্লজ্জ এই পুরুষ এহসান আর কিছু বলতে যাবে, তখনই মেহনূর নিজের দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরে চিৎকার করে উঠল—
—ছিঃ ছিঃ! বন্ধ করুন! বন্ধ করুন! এমন নির্লজ্জ কথাবার্তা!
মেহনূরকে মেহরুব নিজের বা হাত দিয়ে বুকে আগলে ধরে কাঠ গলায় বলে—
—বাচ্চা হলে হোক! আমার বোন আমাদের সাথেই থাকবে।
এহসান অবাক হয়ে বিকৃত গলায় বলল—
—বাচ্চার বাপ আমি, বাচ্চা আমার, বাচ্চার মা-ও আমার। আর ওরা থাকবে কি না, তোদের আওতায়? এ কেমন যুক্তি শুনালি বাবা মেহরুব, তুই আমায়…
মেহনূর এহসানের এমন মিথ্যা নির্লজ্জ কথা শুনে দাঁত চেপে বলে—
—যাব না আমি আপনার সাথে! যাব না তো, যাব না!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মেহনূরের এমন ত্যাড়া কথা শুনে —এহসানের চোখে রাগ জ্বলে উঠল। এক ঝটকায় পাঞ্জাবির ভেতর থেকে পিস্তল বের করে সে মেহরাজের মাথার দিকে সোজা তাক করে। এমন পরিস্থিতি দেখে মেহনূর চিৎকার করতে গিয়েও আতঙ্কে শব্দ বের করতে পারল না।
তখনি এহসান পিস্তলের ট্রিগারে আঙুল রেখে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
— চালিয়ে দেই?
তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে আরও গভীর এক হাসি দিয়ে বলে,
—যদি এখন না আসিস আমার বুকে, তাহলে তোর ভাইদের রক্ত দিয়ে গোসল করাব আমি, এহসান তোকে!
এহসানের কথায় মেহনূর দিশেহারা হয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় মিনতি সুরে বলে,
— ভাইজানদের কিছু করবেন না, দয়া করে…
কিন্তু মেহনূর বাক্য শেষ করার আগেই মেহরুব নিজের পিস্তল বের করে এহসানের দিকে তাক করে। দাঁত চেপে বলে
— আমার বোনকে ত্যাগ করে দে, এহসান! নাহলে তোর রক্তে গোসল করাব আমি মেহরুব !
এহসান অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলে।
— বাহ! গুলি খাওয়ার খুব শখ বুঝি? তাহলে পিছনে একবার তাকিয়ে দেখ, বাবা!
এহসানের এমন কথায়, মেহরুব আর মেহনূর একসঙ্গে পিছনে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে মেহনূরের নিঃশ্বাস আটকে আসে। তিনজন কালো পোশাক পরিহিত নারী দেহরক্ষী স্নাইপার রাইফেল তাক করে রেখেছে তার দুই ভাইয়ের দিকে!
আল্লাহ! এখন কী হবে? যদি ওরা গুলি চালিয়ে দেয়? না! এমন হতে দেওয়া যাবে না!
মেহনূর আর দেরি না করে এক ঝটকায় এহসানের কাছে চলে আসে। কাঁপা গলায় মিনতি করতে থাকে,
— সব সরান, আমি যাচ্ছি। দয়া করে পিস্তল নামান।
এহসান মুচকি হেসে পিস্তল পকেটে রেখে দিল। মেহরুব হেরে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, পিস্তল নামিয়ে নেয়। এতক্ষণ চুপ থাকা মেহরাজ তখন বলে উঠে,
— আমার মেহনূর কোথাও যাবে না! মেহনূর, তুই ফিরে আয়!
কিন্তু এহসান ওর কথায় কর্ণপাত করল না। এক ঝটকায় মেহনূরকে কোলে তুলে নিল এবং গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
— আমার মৃত্যুর আগ অবধি এই নারী থাকবে শুধু আমার অধীনে”! এই নারী গেঁধে রয়েছে এই এহসান তালুকদারের আত্মার আগলে ‘!
এহসান ওদের এমন হুমকি দিয়ে মেহনূরকে বুকে চেপে ধরে হাঁটতে শুরু করে। আর মেহনূর একবার, দু’বার করে অনেক কষ্টে এহসানের বুকে থেকে উঁকি দিয়ে পিছন ফিরে তাকায়। তার ভাইজান দের পানে বুক টা ছিঁড়ে যাচ্ছে কিন্তু আফসোস কিছু করতে পারছে না “!
তার দুই ভাই স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চোখে নীরব কষ্ট।
করিডর পেরিয়ে এহসান ওকে নিচু গলায় বলল,
— মুখের উপর নিকাব টেনে নে।
মেহনূর ক্ষীণস্বরে বলে,
— নিকাব ওখানে কোথাও পড়ে গেছে।
এহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— তাহলে আমার গলায় মুখ গুঁজে মুখ লুকিয়ে নে। এখানে অনেক হারাম পুরুষ আছে।
মেহনূরের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। এই পুরুষের বুকেই তাকে মুখ লুকাতে হলো? তাও এই মুহুর্তে “! কিন্তু এখন কিছু করার নেই। সে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে এহসানের গলা জড়িয়ে ধরল এবং নিজের মুখ গুঁজে দিল এহসানের উষ্ণ ঘাঁড়ে।
এহসান চোখ বন্ধ করে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। যেন নিজের নারীর উষ্ণতা অনুভব করতে পারে। তারপর ধীর পায়ে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
এদিকে মেহনূর আতঙ্কে, ক্ষোভে, ঘৃণায় কুঁকড়ে উঠছে। অথচ এর মাঝেও এহসানের শরীর থেকে বেরোনো এক অদ্ভুত মাতাল করা গন্ধ তার মনে অস্থিরতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
এই গন্ধ… পাগল করে দিচ্ছে তাকে!
এহসানের গলায় মুখ লুকিয়ে থাকে মেহনূর, আর এহসান ইচ্ছে করেই ধীর পায়ে এগিয়ে যায়— যেন এই উষ্ণতা ধরে রাখতে পারে আরও কিছুক্ষণ।
তার শক্ত বাহুতে আবদ্ধ মেহনূর, দুঃসহ পরিস্থিতির ভারে জর্জরিত, তবু বাধ্য হয়েই পড়ে আছে তার বুকে।
সময়ের মতো পথও ফুরিয়ে আসে।
এহসানের নিজের নারীর উষ্ণতা পাওয়ার মুহূর্ত শেষ হয়ে যায়, ঠিক তেমনই মেহনূরের সামান্যতম স্বস্তির সময়ও শেষ হয়।
এহসান অতি যত্নে মেহনূরকে গাড়ির ভেতরে বসিয়ে দরজা আটকে দেয়। তারপর ধীরে ধীরে নিজেও উঠে বসে পাশে।
গাড়ির ইঞ্জিন চালু হওয়ার শব্দ কানে আসতেই এক পলক মেহনূরের দিকে তাকায় এহসান।
তার পাশে বসে থাকা মেহনূর নিস্তব্ধ, অনড়।
চোখের দৃষ্টি গাড়ির সামনে স্থির হয়ে আছে, যেন হারিয়ে গেছে অন্য কোথাও— হয়তো তার ফেলে আসা আপনজনদের কাছে, হয়তো এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গভীরে…
গাড়ি স্টার্ট দিতেই এহসান মৃদু হেসে বলে,
— “আজ যেই কান্ড ঘটিয়েছিস, এরপর আর আমায় কিছু বলিস আর কিছু চাস আমার কাছে, তখন দেখবি কি করি তোর আমি,
মেহনূর দাঁত চেপে এহসানের দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,
— “আপনার মতো মানুষের কাছ থেকে আমি কোনোদিন কিছু চাইব? এতটা খারাপ দিন আমার জীবনে না আসুক!”
এহসান হাসে না, রেগেও যায় না। বরং একহাত স্টিয়ারিংয়ে রেখে অন্য হাতে গাড়ির একপাশে থাকা প্যাকেট থেকে একটা জুসের বোতল বের করে মেহনূরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
— “এই নে, খেয়ে নে! আর প্রস্তুত থাক, কথা না রাখার শাস্তির জন্য, বেয়াদ্দব নারী!”
মেহনূর অবাক হয়ে যায়। এখন তার সত্যিই প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেয়েছে, ভেবেছিল পানি চাইবে, কিন্তু এই পুরুষ কীভাবে বুঝল? সে কোনো কথা না বলে এহসানের হাত থেকে জুসের বোতল নিয়ে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে কয়েক চুমুক নেয়।
জুস শেষ করেই একরাশ তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে,
— “এখন কী শাস্তি দেবেন? নিশ্চয়ই নিকৃষ্টভাবে মেরে ফেলবেন?”
এহসান একপলক তাকায়, ফের গাড়ির দিকে মনোযোগ দিয়ে বলে,
— “মেরে ফেলব কি না, খেয়ে ফেলব—তা বাড়ি গিয়েই দেখতে পারবি, বেয়াদ্দব বান্দি!”
মেহনূর এবার চুপ হয়ে যায়, মনে মনে আল্লাহর নাম নিচ্ছে। সে জানে না, এহসান আর কী কী করতে পারে! নিজের বাপ-ভাইয়ের কঠোর মুখগুলোর কথা মনে পড়ছে, ইচ্ছে করছে এক দৌড়ে ভাইজানদের বুকে মাথা গুঁজে কাঁদতে। কিন্তু জানে, সেটা আর কখনো সম্ভব নয়!
হঠাৎ এহসান গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়, মেহনূর আতঙ্কে চিৎকার করে বলে,
— “আপনি কী করছেন! মেরে ফেলবেন নাকি এক্সিডেন্ট করে?”
এহসান মুচকি হেসে বলে,
— “তোর সাহসের সাথে গলাও তো বেশ বড় হয়ে গেছে! দাঁড়া, একবার বাড়ি যাই!”
এহসানের কথায় মেহনূর ক্ষেপে উঠে বলে,
— ” বাড়ি গিয়ে কি করবেন? এত নাটক করেছেন যে!”
এহসান এবার গাড়ির গতি কমিয়ে মৃদু হাসে, তারপর ঠান্ডা কণ্ঠে বলে,
— ” বাড়ি গিয়ে তোকে মা বানানোর প্রস্তুতি নেব! আমার সন্তানের জননী হবি তুই! এই এহসান তালুকদারের সন্তানের জন্মদাত্রী জননী!”
এহসানের কথায় এবার মেহনূর আর ভয় পায় না, উল্টো তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
— “স্বপ্ন দেখতে থাকুন, স্বপ্ন!”
এহসান একবার মেহনূরের দিকে তাকিয়ে, আবার গাড়ির পেছনে এক ঝলক দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বলে,
— “তাহলে প্রস্তুতি বাড়িতে না নিয়ে গাড়িতেই নিয়ে নিব নাকি? বল, বেয়াদ্দব নারী!”
মেহনূরের গা ঘৃণায় গুলিয়ে ওঠে। একদিকে তার বাবা হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন, আর অন্যদিকে পরিবারের সবাই অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছে।
আর এখানে সে, এই দানবের পাশে বসে, এমন কথা শুনছে!এক নিমেষে কান্না আসছে, কিন্তু সে কাঁদতে পারবে না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শক্ত করে নিয়ে বলে,
— “এই পাপিষ্ঠ আপনার উপর আল্লাহর গজব পড়ুক!গজব! ধ্বংস হয়ে যান আপনি!”ধ্বংস
এহসান মুচকি হেসে বলে,
— “ওহে বোকা নারী! একবার তো বলেছি, ধ্বংস হয়েছি আমি—তবে পাপে নয়, তোর প্রেমে!”
মেহনূর এহসানের দিকে তাকিয়ে থাকে, চোখে ঘৃণায় ঝলসে ওঠে। দাঁত চেপে বলে,
— “ঘৃণা করি আপনাকে! শুধু ঘৃণা!”
এহসান যেন এই কথার জন্যই অপেক্ষা করছিল। সে মুচকি হেসে বলে,
— “ঠিকই বলেছিস! আমি ঘৃণারই যোগ্য। তাই ঘৃণাই করিস, বেয়াদ্দব নারী!”
মেহনূর এবার চুপসে যায়। তার আর কিছু বলার নেই। কিই বা বলবে? কিছু বলার মতো আছে? না নেই এই পুরুষ কে যাই বলবে এ-ই পুরুষ তা নিয়েই মজা করবে!
মেহরুব ফুঁপিয়ে কাঁদছে, কিন্তু মেহরাজ কাঁদছে না। বরং ধীরস্থির গলায় মেহরুব কে বলে,
— “আমাদের বোনকে আমাদেরই করতে হবে! কিন্তু কিছুদিন ধৈর্য ধরতে হবে, ঠান্ডা মাথায় খেলতে হবে!”
মেহরুব হতভম্ব হয়ে তাকায়, মেহরাজের চোখ যেন শীতল বরফ!
— “তুই কী মনে করলি মেহরুব , এহসান তালুকদার শুধু বদমেজাজি? না, সে খুবই তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন! তাই ওর সাথে ওর মতো করেই খেলতে হবে!”
মেহরুব চোখ মুছে ফেলে। মেহরাজের কণ্ঠে যে আত্মবিশ্বাস, সেটা শুনে এবার সে একটু হলেও শান্ত হয়।
🌺🌸🌼
একসময় পথ ফুরিয়ে আসে। ওরা এসে পৌঁছায় তালুকদার বাড়িতে।
বাড়ির গেটে শুধু দারোয়ানই ছিলেন, আর পুরো বাড়ি ঘিরে ছিল নিস্তব্ধতা।
সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, অথচ এখনো সবে সাড়ে দশটা বাজে!
বাড়ির প্রতিটি কোণা যেন গভীর রাতে তলিয়ে গেছে—এক রহস্যময় নীরবতা ছড়িয়ে আছে চারপাশে।
এহসান মেহনূরকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে।
মেহনূর একবার চোখ বুলিয়ে নেয় পুরো ঘরে। সবকিছু এলোমেলো।
এটা সে নিজেই করেছে, রাগের মাথায়। এখন গুছিয়ে নেওয়াটাও তারই দায়িত্ব।
এহসান বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজের চাদর শরীর থেকে সরিয়ে রাখে।
তার কণ্ঠে ব্যঙ্গের ছোঁয়া—
— “বেয়াদব বান্দি, ঘর পরিষ্কার কর। কী অবস্থা করেছিস দেখ ঘরের !”
মেহনূর একপলক তাকায় তার দিকে।
তারপর বিরক্তি আর ঘৃণায় চোখ সরিয়ে নেয়।
কোনো জবাব না দিয়ে কাপড় রাখার কক্ষে চলে যায়। উদ্দেশ্য, নিজের বোরখা খুলে সবকিছু গোছানো।
সে ধীরস্থিরভাবে বোরখা, হাত মোজা, পা মোজা খুলে নেয়।
তারপর ওড়না জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।নিজেকে একেবারে অসহায় মনে হচ্ছে তার!
কী পরিস্থিতিতে এসে পড়েছে সে!কিন্তু আর কিছু করার নেই। এখানেই থাকতে হবে।
নিজের মনের কষ্ট চেপে ধরে ধীর ধীরে সবকিছু গুছাতে শুরু করে।
এহসান আয়েশ করে বিছানায় বসে মেহনূরের কার্যক্রম লক্ষ্য করছে।
কার্যক্রম না বলে বরং বলা যায়—সে তো তার নারীকে দেখছে!
মন ভরে, প্রাণ ভরে, এক অপার তৃষ্ণা নিয়ে।
মেহনূর নিখুঁতভাবে সব গুছিয়ে নেয়, শুধু মেঝে ঝাড়ু দেওয়া আর বিছানা ঠিক করা বাকি।সে ক্লান্ত চোখে বিছানার দিকে এগিয়ে আসে।এহসান কে বেহায়ার মতে নিজের পানে তাকিয়ে থাকতে দেখে
দাঁত চেপে বলে—
— “উঠুন!”
এহসান মেহনূরের পানে ঠান্ডা চোখে তাকায়।তারপর একচিলতে হাসি টেনে বলে—
— “সুন্দর করে কথা বললে কি মুখে ফুসকা পড়ে যাবে?”
মেহনূর রাগে চোখ বড় করে তাকায়।
— “হ্যাঁ, পড়বে! গজবও পড়বে!”
এহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা থেকে নেমে যেতে যেতে বলে—
— “ইয়া রাব্বে কারীম! এমন এক বেয়াদ্দব বান্দি জুটাইলে তুমি আমার কপালে? যার জবান দিয়ে কি না নিমপাতার তেতো রস ঝরে প্রতি মুহূর্তে মুহুর্তে !”
এটা বলতে বলতেই সে চলে যায় বেলকনির দিকে।
উদ্দেশ্য, রাতের আকাশের নিচে বসে সূরা আর-রাহমান তেলাওয়াত করা।
এদিকে এহসান চলে যাওয়ার পর মেহনূর বিছানার সব বালিশগুলো সোফায় রেখে দেয়।
তারপর সে বিছানার চাদর এক টানে তুলে নিল, যেন তা সুন্দর করে বিছাতে পারে। চাদরটা টানতেই, হঠাৎ খট শব্দে কিছু একটা পড়ে যায়।
মেহনূরের অসহায়ভাবে হাত-পা কাঁপতে থাকে। তার মনে হয়, হয়তো এহসানের মোবাইল সে ফেলে দিয়েছে। কারণ তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কোনোদিকে না দেখে চাদর খানা টেনে তুলেছে “!
যদি সত্যি ফোন পড়ে থাকে, তবে কী হবে? তার সারা শরীরে এক ধরনের অজানা ভয় ছড়িয়ে পড়ে। সে কোনো কিছুই খেয়াল করতে পারে না, শুধুমাত্র ভয়ের সাথে চাদরটা টান দেয়ার পর যেটা হল,
সেটাই তার সমস্ত মনোযোগ আকর্ষণ করছে।এহসান না জানি কি করে এখন “!
সে ধীর পায়ে মেঝেতে বসে যায়। একটু থমকে গিয়ে বিছানার চাদরটা সরিয়ে নেয়।
ততক্ষণে তার শ্বাস কিছুটা স্বাভাবিক হয়, কারণ তার ধারণা ভুল ছিল। এটা মোবাইল নয়, বরং একটা আতরের বোতল। এবং সৌভাগ্যবশত, এটি ভাঙেনি—আল্লাহর হুকুমে!
একটু সস্তির শ্বাস ফেলে সে বুকের ওপর হাত রেখে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। এরপর সেদিকে তার দৃষ্টি পড়ে, আর সে আতরের বোতলটি হাতে নেয়।
বোতলটি অত্যন্ত সুন্দর, সোনালী ধাতব আবরণে মুড়ে দেওয়া আর স্বচ্ছ কাঁচের মিশ্রণ। তাই মেহনূর এটি কৌতূহল নিয়েই হাতে তুলে নেয়”!
বোতলটা হাতে নিতেই মেহনূর সেই চিরচেনা, পাপিষ্ঠ পুরুষের শরীরের ঘ্রাণ অনুভব করে।
সে তৎক্ষণাৎ বোতলটি নাকের কাছে ধরে। নাকের কাছে নিতেই তার অবচেতনে মনে হয় সে এহসানের বুকে নাক ডুবিয়ে দিয়েছে ।
মেহনূর স্পষ্টভাবে অনুভব করে, এটাই এহসানের সেই মন মাতোয়ারা করে তোলা সুগন্ধি। মেহনূর তার হাতে থাকা আতরের বোতলটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। স্পষ্টভাবে বোতলের গায়ে লেখা থাকে Al Haramain Musk Oud।
বোতলটি দেখে মেহনূর বুঝতে পারে, এতে রয়েছে অ্যাম্বার, মস্ক, এবং উডের সমাহার , যা আমাদের প্রিয় রাসুলুল্লাহ (সা:) এরও অত্যন্ত পছন্দের সুগন্ধি।
মেহনূর দ্রুত বোতলটা রেখে আসে কাপড় রাখার কক্ষে।
তারপর তাড়াতাড়ি বিছানা গুছিয়ে নেয়।
এশার নামাজের সময় হয়ে গেছে!সে কাপড় নিয়ে গোসল করতে বাথরুমে প্রবেশ করে।
গোসল শেষে ওযু করে বেরিয়ে আসে।তারপর বেলকনির দিকে এগিয়ে যায়, উদ্দেশ্য—ভেজা চুলের টাওয়াল মেলে দেওয়া।
বেলকনিতে আসতেই তার চোখ পড়ে এহসানের দিকে।
সে একটি চেয়ারে বসে আছে।শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।আকাশের নক্ষত্রেরা কি তার মতোই একা?
মেহনূর একপলক তাকায় তার দিকে।তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে টাওয়ালটা রেলিংয়ে মেলে দেয়।
মেহনূরকে গোসল করতে দেখে এহসান মেহনূরের পানে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলে
— এখন আর কেন করলি গোসল, একটু পরি তোর করতে হবে আবারও ফরজ গোসল!
এহসানের এমন কথায় মেহনূর কঠোরভাবে তাকায় ওর পানে, কিন্তু কিছু বলে না। এটা নামাজের সময়!
আর কিছু বললেই আবার তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যাবে, তার এই মুহূর্তে তর্কাতর্কি একদম ভালো লাগছে না। নিজের বাবা নিয়ে চিন্তায় বিষণ্ন হয়ে আছে অন্তর-আত্মা।
মেহনূর চুপচাপ ঘরে এসে নামাজে দাঁড়ায়। নামাজ শেষে মেহনূর জায়নামাজে অনেকক্ষণ বসে দোয়া-দুরুদ পড়ে, ফের দুই হাত তুলে এই পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন যিনি, তাঁর দরবারে দুই হাত তুলে মোনাজাত শুরু করে:
“اللهم إني أسالك برحمتك التي وسعت كل شيء أن تفرج همي وتيسر أمري”
ইয়া রব, আপনি ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ, আমাকে আপনার সাহায্যে রক্ষা করুন।
“رَبِّ لا تَذَرْنِي فَرْدًا وَأَنتَ خَيْرُ الْوَارِثِينَ”
**”হে রব, আপনি ছাড়া আমার আর কেউ নেই, আপনিই আমার সবকিছু। আমাদের অন্তরের কষ্টগুলো আপনি তো তা জানেন, আমাদের চাওয়া-পাওয়া আপনি তো তা বোঝেন! আমি আপনাকে খুব করে চাই, আমার মন কেবল আপনার কাছে ছুটে যেতে চায়। এখানে আমি ভালোভাবে থাকতে পারছি না, আমার হৃদয় কাঁদছে, এবং কেবল আপনি ছাড়া আমার এই কষ্টের কোনো শেষ নেই। আপনি কি আমার এই দুঃখ শুনছেন? আমি আপনার রহমত কামনা করি, আপনি আমার উপর মেহেরবানী করুন। আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি, আপনিই ছাড়া আমার কোনো গতি নেই মাবুদ! আমার পরিবারকে রক্ষা করুন মাবুদ, আপনি! আমার আব্বাকে সুস্থতা দান করুন!”
মেহনূর মুনাজাত শেষ করে নিজের চোখের পানি নামাজের হিজাব দিয়ে মুছে নেয়। অতঃপর জায়নামাজ থেকে উঠে যায়, জায়নামাজ গুছিয়ে কাপড় রাখার কক্ষে রেখে আসে।
তখনি এহসান ঘরে প্রবেশ করে। মেহনূরের নামাজ শেষ হতে দেখে এহসান ঘরে প্রবেশ করে, সে বেলকনির দরজার সামনে বসে থেকে এতক্ষণ মেহনূরকে দেখছিল।
এহসান মেহনূরের দিকে এগোতে এগোতে বলে
— কি রে আল্লাহর কাছে আমার নামে বদদোয়া দিলি নাকি?
মেহনূর এহসানের পানে ঘৃণার চোখে তাকিয়ে বলে
— আমার এতটাও খারাপ দিন আসেনি যে আমি আপনার মতো পাপিষ্ঠ পুরুষকে আমার মোনাজাতের মধ্যে টানব।
এহসান মেহনূরের এমন কথা শুনে মৃদু হেসে এক ঝটকায় মেহনূরের সামনে চলে আসে আর বলে
— একদিন আসবে, এমন এক দিন যেদিন তুই নিজের রবের দরবারে এই পাপিষ্ঠ পুরুষের জন্য দুই হাত তুলে কাঁদবি।
মেহনূর এহসানের এমন কথায় দাঁত চেপে বলে
— এমন দিন আমার জীবনে আসার বদলে আমার মৃত্যু আসুক।
এহসান মেহনূরের কথাগুলো শুনে এক পলকও না ভেঙে মেহনূরের খুব কাছে চলে আসে। এসেই মেহনূরের দিকে অল্প ঝুঁকে ওর ঠোঁটের ওপর নিজের শাহাদাত আঙুল রেখে, বলে
— “এমন বলো না, বোকা নরী। তুমি যদি মরে যাও, তাহলে আমি এহসান বাঁচব কী নিয়ে?”
মেহনূরের চোখে রাগের আগুন জ্বলছে। এক মুহূর্তের জন্য সে চুপ করে থাকে, তারপর নিজে থেকেই তার ঠোঁটের ওপর থেকে এহসানের হাত ঝাড়ি মেরে সরিয়ে দেয়। দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
–আপনার বাঁচার প্রয়োজন নেই এই সুন্দর দুনিয়ায়। আপনার মতো পাপিষ্ঠ আত্মার প্রয়োজন নেই এই পৃথিবীতে!”
এহসান মেহনূরের উত্তরে হাসলো না, বরং তার দুই হাত বাড়িয়ে মেহনূরের কোমর শক্ত করে চেপে ধরে। এক দমের মধ্যে মেহনূরকে নিজের বুকের কাছে নিয়ে আসে”! নিজের মাথা মেহনূরের দিকে ঝুঁকে গিয়ে আবার বলে, –“আমার প্রয়োজন আছে কি না, এই দুনিয়ার তা আমি জানি না।”
একটি দীর্ঘ নীরবতা, তারপর এহসান আরো বলতে শুরু করল, ”
—তবে, মেয়ে, মনে রাখিস, এই পাপিষ্ঠ পুরুষের তোর খুব প্রয়োজন। কারণ তুই, মেহনূর, এই পাপিষ্ঠ পুরুষের এক পবিত্র অস্তিত্ব।”
মেহনূর ক্ষোভে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তার গা গুলিয়ে উঠছে,এহসান, এই পাপিষ্ঠ পুরুষ, তাকে এত গভীরভাবে স্পর্শ করছে। চোখ ও মুখ চিপে, কষ্টে চিৎকার করে বলে,
— “ছাড়ুন আমায়! কষ্ট হচ্ছে!”
কিন্তু এহসান কি আর সে কথা শুনবে? সে আরও শক্ত করে মেহনূরকে নিজের কাছে টেনে নিল। তার চোখ দুটো মেহনূরের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে, “বলে
–কষ্টে হলে হোক, তোর দোহনে আমি পুড়িপ্রতি মুহূর্তে, তুই নাহয় পুড়লি, আমার দোহনে এই কয়েক মুহূর্ত।”
মেহনূর চিৎকার করে বলে
—আমার সাথে কেন এমন করছেন? ছাড়ুন, কষ্ট হচ্ছে! এভাবে ধরতে নেই!”
এহসান মেহনূরের দিকে আগের মতো, শীতলভাবে তাকিয়ে বলল, ”
—কেন জান? যখন আমার অবাধ্য হয়, তখন মনে থাকে না—এহসান তালুকদারের অবাধ্য হতে নেই।”
এ বলেই এহসান মেহনূরের কোমর থেকে এক হাত ছাড়িয়ে নেয়!
এবং মেহনূরের চুল আলতো করে ধরে! নিজের মুখ মেহনূরের দিকে এগিয়ে এনে তার অধর খানায় নিজের অধর ডুবিয়ে দেয়!
মেহনূর নিজেকে বাঁচানোর জন্য ছটফট করতে থাকে! কিন্তু এহসান ওর কোমর আরও শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে!
মেহনূর ভীষণ ভয় পেয়ে যায়, ভিতরে শুধু একটা কথাই বারবার উঁকি দেয়—এহসান যদি নিজের অধিকার তার উপর ফলিয়ে নেয়? সত্যি যদি তার সাথে কোনো কিছু করে নেয়!
এহসানের দাড়ির স্পর্শে মেহনূরের থুতনির নরম চামড়া ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে!
এহসান বারবার মেহনূরের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট আর দাঁত উভয় দ্বারা আঁকড়ে ধরেছে! যার জন্য মেহনূরের ঠোঁট জ্বালা করছে!
মুহূর্তের পর মুহূর্ত কেটে যায়, কিন্তু এহসান মেহনূর ছেড়ে দেয় না!
মেহনূর এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি মেরেই যাচ্ছে এহসানের বুকে, কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না!
একসময় কষ্টে, ঘৃণায়, ব্যথায় মেহনূরের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে! তার আর কিছু করার নেই, কান্না ছাড়া!
মেহনূরের চোখে পানি অনুভব করে এহসান ছেড়ে দেয় মেহনূরকে!
মেহনূরকে ছেড়ে দিতেই মেহনূর জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে! মনে হচ্ছে কেউ প্রাণটা ছিনিয়ে নিয়ে আবার ফেরত দিয়ে গেছে। এতটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে মেহনূর!
এহসান মৃদু হেসে মেহনূরের গালে আলতো করে হাত রেখে ওর চোখের জল মুছে দিতে দিতে বলে—
— জান, এটা তো একটা ছোট্ট ট্রেলার ছিল। এতেই কেঁদে দিলে? কিছু কান্না রেখে দাও, সামনে কাঁদার জন্য!
এহসানের এমন কথা শুনে মেহনূর জোরে জোরে কাঁদতে থাকে আর বলে—
— আপনি আমাকে সব দিক দিয়ে কলঙ্কিত করলেন। সব দিক দিয়ে অনন্ত। এখন আমার শরীরটাকে তো নিস্তার দিন!
এহসান মেহনূরকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলে—
— আমার কলঙ্কে কলঙ্কিত হবে তুমি! তোমার শরীর, এমনকি তোমার অন্তরও। তাই তুমি নিস্তার পাবে না, আমার বাচ্চার মা!
এ বলেই এহসান মেহনূরকে এক ঝটকায় নিজের কোলে তুলে নেয়! মেহনূরের তো ভয়ে গলা শুকিয়ে উঠে। আল্লাহ, এখন কি করবে এই পুরুষ? আল্লাহই জানেন!
এহসান ধীর পায়ে মেহনূরকে এনে বিছানায় শুয়ে দেয় অতি যত্ন সহকারে!
অতঃপর নিজেও বিছানায় উঠে যায়! মেহনূর ভয়ে জমে যাচ্ছে। আর জমবেই না কেন? এটা তার ইজ্জতের ব্যাপার, এটা তার সম্মানের ব্যাপার!
কিন্তু এহসান তার সাথে তেমন কিছুই করে না! শুধু ওকে নিজের বুকের পাশে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে—
— চিন্তা করো না, তোমার অনুমতি ছাড়া আমি তোমাতে মত্ত কখনোই হব না!
এহসানের এমন কথায় মেহনূর নিজের মধ্যে প্রাণ ফিরে পায়!
মেহনূর শুয়ে আছে এহসানের বুকের বা পাশে মাথা রেখে।
এহসান নিজের প্রাণপ্রিয় নারীকে বুকে আঁকড়ে ধরে ঠিকই শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে,
কিন্তু মেহনূর তার চোখে ঘুম নেই, আছে শুধু ভয় আর ভয়, নিজের বাবা নিয়ে ভয়, ভেতরে বারবার খাঁ খাঁ করে উঠছে। একটা কথা অন্তরে শুধু ভয় সৃষ্টি করছে, আর তা হলো তার আব্বার জ্ঞান ফিরছে তো? তার ভাইজানরা নিজেদের সামলিয়ে নিতে পেরেছে তো?
এসব ভাবতে ভাবতে প্রহর কেটে যাচ্ছে, কিন্তু মেহনূরের ভাবনার শেষ আর হচ্ছে না! রাত এখন বাজে একটা দশ, মেহনূরের চোখে ঘুম নেই!
মেহনূর মনে মনে ভাবছে, যদি একটা বার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারত, তার ছোট ভাইজান এর ফোন নাম্বার তো তার মুখস্থ রয়েছে!
মেহনূর অনেকক্ষণ ভেবে সিদ্ধান্ত নেয় সে এহসানের মোবাইল দিয়েই ফোন দিবে তার ভাইজানকে, কিন্তু কীভাবে দিবে, এটা ভেবে তো হাত-পা কাঁপছে, যদি এহসান বুঝে নেয় তো সে শেষ।
কিন্তু এটাই একমাত্র উপায় নিজের মনকে শান্ত করার, তাই সাত-পাঁচ না ভেবে! ধীরে ধীরে মাথা তুলে এহসানের বুক থেকে, অতঃপর অতি সাবধানে এহসানের হাত নিজের থেকে সরায় এবং বালিশের নিচে হাত প্রবেশ করে মোবাইল খুঁজতে থাকে, কিন্তু সে মোবাইল পায় না।
ভাবতে থাকে, হয়তো এহসানের পাঞ্জাবির পকেটে, তাই ধীরে ধীরে এহসানের পাঞ্জাবির পকেটে হাত প্রবেশ করে খুঁজতে থাকে মোবাইল। কিন্তু আফসোস, তা সে পায় না!
মেহনূর হতাশ হয় না, হাল না ছেড়ে এহসানের বুকের উপর দিয়ে উঁকি দিয়ে বালিশের ডান পাশে হাত দিয়ে ফোন খুঁজতে থাকে, আর ভাগ্যক্রমে মোবাইল পেয়ে যায়!
মোবাইল হাতে নিয়ে মেহনূর শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে! কিন্তু আবারও বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়, মোবাইল লক করা, এখন কী করবে!
মোবাইলটা হাতে নিয়ে এ-পিট ও পিট দেখে, এটা যে অনেক দামি ফোন, তা মেহনূর ভালো করেই জানে, কারণ এই একই ফোন, মানে Samsung Galaxy S23 Ultra, তার ছোট মেহরুব ভাইজানও ব্যবহার করে!
মেহনূর ধীরে ধীরে এহসানের হাত ডান নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়, কিন্তু বারবারই ওর হাত কাঁপছে, নিজেকে অনেক কষ্টে সামলিয়ে, মেহনূর কাঁপা কাঁপা হাতে স্ক্রীনের নিচে ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানারে, এহসানের শাহাদাত আঙুল বারকয়েক বার ছুয়ায়,
এত বড় একটা সাহসের কাজ করতে গিয়ে কলিজার পানি শুকিয়ে আসছে ওর! মনে এটাই হচ্ছে, যদি এহসান বুঝে নেয় তো সে শেষ। তো যাইহোক, ওর কষ্ট সফল হয়, মোবাইল আনলক হয়।
মেহনূর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নেয়, অতঃপর এহসানের দিকে একপলক তাকিয়ে, ধীরে ধীরে ফোন নিয়ে বিছানা থেকে উঠে বেলকনিতে চলে আসে।
মেহনূর উঠে যেতেই এহসান চোখ খুলে, দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, নিজের ঠোঁট চেপে হাসতে থাকে!
বোকা মেহনূর কী করে বুঝবে, যখন সে এহসানের বুক থেকে মাথা তুলেছে, তখনই এহসানের ঘুম ভেঙে গেছে, সে তো মেহনূর ঠিক কী কী করতে পারে, সেটাই চোখ বুজে এতক্ষণ আঁচ করছিল!
এহসান মৃদু হাসতে হাসতে নিজেই নিজেকে বলে
, — এহসান তালুকদার, তুমি যতটা মারাত্মক চালাক, ঠিক ততোটা মারাত্মক বোকা তোমার নারী।
এহসান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, বেলকনির দিকে তাকিয়ে বলে, — তুমি ভীষণ বোকা, আমার প্রাণ, তুমি আমার বোকা ফুল, তুমি আমার স্নিগ্ধ বোকা ফুল!
এদিকে মেহনূর মেহরুবের ফোনে কয়েকবার ফোন করে, কিন্তু মেহরুব ফোন তোলে না।
তবে অনেকবার ফোন করার পর মেহরুব ফোন তোলে, ফোন তোলে, মেহরুব ভয়াবহ এক চিৎকার করে বলে
, — কী সমস্যা, ফোন কেটে দিচ্ছি তো, এত রাতে ফোন কেন বারবার দিচ্ছেন?
মেহনূর মেহরুবের এমন ধমক শুনে কিছুটা ভরকে যায়, তবে গিলে এসে আস্তে করে বলে
, — ভাইজান, আমি মেহনূর।
নিজের ছোট্ট পরীর গলা শুনে যেন নিজের মধ্যে প্রাণ ফিরে পায়, আর হাসি মাখা গলায় বলে,
— তুই ঠিক আছিস তো, ঐ কুত্তার বাচ্চা, তোর সাথে কিছু করেনি তো?
— হ্যা, হ্যা, আমি ঠিক আছি, ভাইজান, আব্বার জ্ঞান ফিরেছে তো?
মেহনূর ঠিক আছে শুনে মেহরুব একটু শান্তি পায়, আর বলে,
— হ্যা, হ্যা, আব্বার জ্ঞান ফিরেছে, আব্বা ভালো হয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ, তুই চিন্তা করিস না।
এই কথা শুনে মেহনূর নিজের মধ্যে প্রাণ ফিরে পায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে
— আচ্ছা ভাইজান তোমরা ভালো থেকে এই ফোন উনার ‘!আমি চুরি করে তোমার সাথে কথা বলতে “!
এ বলেই মেহনূর ফোন কেটে দেয়, অতঃপর মেবাইল থেকে মেহরুবের নাম্বার কেটে দেয়। আর কথা বলতে পারছে না সে ‘! ভয়ে হাঁটু কাঁপছে ‘!
মেহনূর ফোন শেষ করে এক শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে, আকাশের দিকে তাকিয়ে আবেগী গলায় বলে,
_____”ইয়া আল্লাহ, আপনি আমার আর্তনাদ শুনেছেন, তার জন্য লক্ষ কোটি শুকরিয়া! আপনার দরবারে মাবুদ, আপনি আমার আব্বাকে সুস্থ করে দিন, আমার পরিবারকে আপনার হেফাজতে নিয়ে নিন।”
অতঃপর, তপ্ত শান্তির শ্বাস ফেলে, মেহনূর ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করে। ঘরে প্রবেশ করে ধীর ধীর এসে বিছানায় উঠে যায়। একেবারে এহসানের নিকট চলে আসে এবং এহসানের মুখের উপর হাত নাড়ায়,
এটা পরীক্ষা করতে যে এহসান সজাগ কি না। কিন্তু, এহসান একটুও প্রতিক্রিয়া দেখায় না, কারণ সে তার বোকা ফুলের আরও বোকামি মন ভরে আঁচ করতে চায়।
এহসানের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে মেহনূর একটু সস্তি পায়। অতঃপর, আলগোছে এহসানের মোবাইলটা জায়গা মতো রেখে দেয় এবং নিজে অতি সাবধানে বিড়ালের মতো ঘাপটি মেরে এহসানের বুকে লেপ্টে যায়।
এহসানের হাত আলতো করে ধরে এনে নিজের পিঠে রাখে, যাতে এহসান কোনো কিছু টের না পায়।
এদিকে, এহসান তো বিশ্বাসই করতে পারছে না যে, তার নিজের নারী এভাবে বিড়ালের মতো ঘাপটি দিয়ে তার বক্ষস্থলে শুয়ে থাকবে।
মেহনূরের চোখে এখন ঘুম আসে। কথায় আছে, মন অশান্তি না থাকলে চোখেও নিদ্রার দেখা মেলে। তাই এতক্ষণ মেহনূরের ঘুম আসেনি, কিন্তু এখন, আল্লাহর হুকুমে, সে ঘুমাতে পারে।
মেহনূর ঘুমানোর খানিকক্ষণ পর, এহসান বুঝতে পারে যে তার নারী ঘুমিয়ে গেছে। তাই, নিজে তাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে, তার নারীকেও নিজের বক্ষস্থলে নিয়ে, সে নিজেও ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়।
সকালের বেলা🌸🌼
এহসান ফজরের নামাজ পড়ে এসে নিজের মা-কে সালাম দেয়, মায়ের সাথে কিছু সময় ভালো মন্দ কথা বলে অতঃপর জিজ্ঞেস করে,
“—আম্মা, মেহনূর এখনও নিচে আসেনি?”
এনিসা বেগম এহসান-কে বলেন,
—“এসেছে বাবা, সে রান্নাঘরে কাজ করছে।”
এদিকে মেহনূর রান্নাঘরে আয়শা বেগম, আমেনা বেগম, এবং এশাকে কালকের সব ঘটনা খুলে বলছে আর এক ধারে কাঁদছে।
উনারাই প্রথমে এসব নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাই মেহনূর বাধ্য হয়ে এগুলো বলছে। এসব শুনে আয়শা বলেন,
—“ছোট ভাইজান বেশি করে ফেলেছে, এটা ঠিক নয়।”
এশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মেহনূরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
—-“কি করবি রে? এটাই চিরসত্য যে আমার ভাইজান তোকে কখনোই ছাড়বেন না, আর না তোর পরিবারের কাউকে শান্তিতে থাকতে দিবেন। এত ক্ষোভ উনার তোর বাপ, চাচার প্রতি, আল্লাহ মাফ করুন।”
তখনই এনিসা বেগম রান্নাঘরে প্রবেশ করতে করতে বলেন,
—“মেহনূর, তাড়াতাড়ি, তুমি চা বসাও এহসান তো বসে আছে চায়ের অপেক্ষায়!”
মেহনূর নিজের চোখের জল মুছে বলে,
—“কয় কাপ দিব? দাদা-কে, এনাম চাচা, এমরান চাচা-কে দিব না?”
চাচা-দাদা এখনও মেহনূর ওদের চাচা-দাদা বলে সম্মোধন করছে, তা শুনে সবাই অবাক হয়ে যান। এনিসা বেগম মেহনূর-কে বলেন,
—-“মেহনূর, তুমি তাকে দাদা নয়, আব্বা বলবে, আর ভাইজান বলে ডেকো। এখন আর তারা তোমার দাদা চাচা নয়। আর উনি আর ওরা দু’জন এখন বাড়িতে নেই, তাই শুধু এক কাপ চা দাও।”
মেহনূর কিছু বলে না, কীই বা বলবে? বলার ভাষা থাকলে তো বলতেও পারত, কিন্তু এরা তো অন্যায়কে ন্যায় হিসেবে মেনে নিয়েছে, তাই এদের বুঝানোর বা কিছু বলার সাধ্য তার নেই। তাই চুপচাপ চা তৈরি করতে মনোযোগ দেয়।
মেহনূর চা কাপে ঢেলে ট্রেতে নিয়ে বলে,
—-“চা তৈরি করে নিয়েছি।”
এদিকে সবাই সকালের নাস্তা তৈরি করতে ব্যস্ত, কেউ পিটে বানাচ্ছেন, কেউ রান্না করছেন, কেউ অন্য জাতের নাস্তা তৈরি করছেন! তাই এনিসা বেগম বলেন,
—“তুমি একটু কষ্ট করে দিয়ে আসো।”
মেহনূর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে, ট্রে নিয়ে বসার কক্ষের দিকে পা বাড়ায়।
গিয়ে দেখতে এহসান কিসের কতগুলো কাগজ নিয়ে খাটাখাটি করছে, আলতো পায়ে এগিয়ে গিয়ে তার সামনে রাখা ছোট্ট টেবিলের একপাশে চায়ের ট্রে রেখে বলে,
—“আপনার চা।”
মেহনূরের কথায় এহসান তাকায় মেহনূরের পানে একবার!
মেহনূরের স্নিগ্ধ মুখখানা দেখে অন্তর অব্দি ঠান্ডা হয়ে যায়। সে শান্তির শ্বাস ফেলে মেহনূর-কে বলে,
—“একটু এগিয়ে দাও।”
মেহনূর কোনো উত্তর না দিয়ে তার হাতে চায়ের কাপ তুলে দেয়।
মেহনূর যখন চলে যাবে…
তখনই আচমকা একজন মহিলা কোনোদিকে না তাকিয়ে পাগলের মতো ছুটে বাড়ির সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করেন।
তিনি হন্তদন্ত হয়ে এসে এহসানের পায়ের কাছে পড়ে যান একপ্রকার! সেই মহিলা জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
—–“ক্ষমা করবেন সাহেব, আপনাদের মহলে লুকিয়ে প্রবেশ করেছি, কিন্তু আমার আসাটা ভীষণ জরুরি ছিল, তাই…”
এ বলেই উনি হু হু করে কেঁদে উঠেন। উপস্থিত মেহনূর, এহসান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যান,!
আর এমন পরিস্থিতিতে তো সবাই ভয় পাবে, তবুও এহসান দাঁড়িয়ে, তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। মেহনূর-কে উদ্দেশ্য করে বলেন,
আত্মার আগলে পর্ব ২০
—-“মেহনূর, উনাকে ধরে সোফায় বসাও, আর পানি দাও।”
অতঃপর ঐ মহিলার দিকে তাকিয়ে বলেন,
—-“আপনি কাঁদবেন না, যা বলার নিঃসংকোচে বলুন।”
মেহনূর তাড়াতাড়ি মহিলাকে ধরে সামনের সোফায় বসায়, আর ঐ মহিলার মাথায় হাত দিয়ে বলে,
—-“আপনি এভাবে কাঁদবেন না, আমি পানি নিয়ে আসছি, আপনি শান্ত হন।”