আত্মার আগলে পর্ব ৩০

আত্মার আগলে পর্ব ২৮+২৯
সানজিদা আক্তার মুন্নী

মেহনূর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাসপাতালে!
কারও একজনের লাশের সামনে মেহনূর কথা বলছে না, শুধু একপানে তাকিয়ে আছে লাশের মুখশ্রীর দিকে। আহা! কী স্নিগ্ধ তাহার মুখখানা! মমতায় ছেয়ে যাওয়া সেই সুন্দর চেহারা! মেহনূর আজ কাঁদছে না। কাঁদবে কীভাবে? কাঁদার জন্য যে এক কষ্টের অনুভূতি অনুভব করতে হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে সে সেই অনুভূতিটাই অনুভব করতে পারছে না। কেমন যেন লাগছে—একদম পাথরের মতো লাগছে নিজেকে!
এত ঝড়ঝাপটা সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত হয়ে গেছে মেহনূরের ছোট্ট অন্তরটা। আর যে সইতে পারে না! মেহনূর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে—হাসপাতালের সাদা বিছানায় সুন্দরভাবে শান্তি নিয়ে শুয়ে আছেন একজন মহিলা। উনি আর কেউ নন—উনি তার সবচেয়ে আপনজন, তার মা! যে মা তাকে জন্ম দিয়েছেন, যার শরীরের অংশ সে! অথচ আজ সেই মা-ই মৃত পড়ে আছেন।

মেহনূর মন ভরে দেখছে তার মাকে। ছোটবেলায় সে শুনেছে, মা-গড়া মেয়েরা ভাগ্যবতী। তাহলে তার ভাগ্য তাকে এমন নির্মম পরিস্থিতিতে ফেলল কেন?
জীবনে কখনো জন্মদাত্রী জননীর মুখ দেখেনি, শুনেনি তার কথা। আর এখন যখন দেখার, জানার, বোঝার সুযোগ হলো—তখন সেই মা-ই নেই! আচ্ছা, কী এমন হতো যদি সে একবার হলেও মাকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পেত? কিন্তু না, তার রব নিশ্চয়ই চাননি। তাই সে দেখার সুযোগ পায়নি!
মেহনূর নিজের মায়ের মৃতদেহের পানে তাকিয়ে এক নাগাড়ে এসব ভাবতেই থাকে।
মাঝখানে কেটে গেছে বেশ কয়েক দিন। এই দিনগুলো সে এহসানের বুকে বন্দিনী হয়েই কাটিয়েছে। তিক্ত হয়ে গেছে তার অন্তরটা। এহসানের প্রতি ঘৃণা, অভিযোগ, অভিমান সব যেন দলা পাকিয়ে উঠেছে! সে আর বলেনি এহসানকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কারণ সে ভালো করেই জানে—এহসান যা বলে, তাই করে। তাই কাঠের পুতুলের মতো বন্দী হয়ে থেকেছে সে।
কিন্তু আজ সকালেই এহসান তাকে নিয়ে হাসপাতালে আসে, আর এসে এই দৃশ্য দেখতে পায়! বুকটা আজ কাঁপছে না, কারণ আজ বুকের ভেতর কোনো অনুভূতি নেই—সব নিঃশেষ!
আজ আর হাত-পা কাঁপছে না, কারণ আজ কলিজা পর্যন্ত অবশ হয়ে গেছে!
তার সামনে বসে তার বড় ভাইজান অঝোরে কাঁদছে, আর মৃত মায়ের লাশে চুমু খাচ্ছে!
ইস! তার ভাইজান কত ভাগ্যবান! কারণ সে তার মাকে জীবিত থাকতে দেখেছে, চিনেছে, অনুভব করেছে! মেহনূর মেহরাজের পাগলামি দেখে বুঝে গেছে—মেহরাজ তার মাকে ভালোভাবেই জানে। কিন্তু আফসোস! সে নিজে না পারল জানতে, না পারল দেখতে!
এহসান হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে,

—”কি হলো? এমন করছো কেন, মেহনূর?”
এহসানের কথায় মেহনূর তার পানে তাকায়, তারপর নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
—”মাকে দেখছি, আমার মাকে দেখছি! মন ভরে দেখছি! কত সুন্দর আমার মা! নিশ্চয়ই আমার মায়ের মনটাও অনেক সুন্দর ছিল, তাই না, এহসান চাচা?”
মেহনূরের কথায় এহসান বুঝতে পারে—সে নিজের মধ্যে নেই, উল্টোপাল্টা বকছে!
এহসান মেহনূরের হাত ধরে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলে,
—”হুম, চল। এখানে এসে বসো।”
মেহনূর অসহায় গলায় বলে,
—”না! দেখি না একটু মন ভরে! আমি আমার মাকে একটু পরেই তো হারিয়ে ফেলব! চলে যাবে আপন বাড়ি—কবরে!”
মেহনূরের কথা শুনে তীব্র কষ্ট লাগে এহসানের। তার ইচ্ছে ছিল একদিন মেহনূরকে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করাবে, কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল!
মেহরাজ মেহনূরের দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলে,

—”আমায় মাফ করে দিস রে! মায়ের আর তোর সাথে এ দুনিয়ায় দেখা হলো না! আমি বলতে চেয়েছিলাম তোকে সব, কিন্তু তুই সব সামলাতে পারবি কিনা—”
মেহনূর তাকে কিছু বলতে দেয় না। এক দৌড়ে ভাইজানের কাছে গিয়ে তার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে,
—”না, তুমি কেঁদো না! আমি বুঝি, তুমি কেন বলনি!”
এহসান ভেবেছিল—মেহনূর মেহরাজের ওপর রাগ করবে। কিন্তু হলো উল্টো!
মনে মনে বলল এহসান,
—”সবাইকে বুঝতে পারলি বোকা নারী, শুধু এই পাপিষ্ঠ আমার ভালোবাসাটাই বুঝলি না!”
মেহরাজ বসে থেকে মেহনূরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে! মেহনূর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিজের কান্না চেপে রাখতে চায়।
কারণ এখন তার কান্না আসছে।
এখন অনুভব হচ্ছে—তার মা আর দুনিয়ায় নেই!
মেহনূর কান্না গলায় চেপে বলে,

—”তুমি কেঁদো না ভাইজান। এতে আমাদের মায়ের কষ্ট হবে। আমাদের মা কত কষ্ট করেছে এই দুনিয়ায়, অন্তত মৃত্যুর পর শান্তিতে থাকুক!”
এ কথা বলে মেহনূর মেহরাজের থেকে সরে এসে একদম নিজের মৃত মায়ের মুখের সামনে ঝুঁকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তারপর এক পলক মেহরাজকে দেখে বলে,
—”ভাইজান, আমি একদম মায়ের মতো হয়েছি! তুমি নিশ্চয়ই আমাদের বাবার মতো হয়েছো, তাই না? দেখ, মায়ের মতো একদম! আমি হুবহু! কী সুন্দর না, ভাইজান?”
মেহনূর নিজের মধ্যে নেই। যা মনে আসছে, তাই বকছে। আর এহসান এই দুই ভাই-বোনের পাগলামির সাক্ষী হচ্ছে!
মেহনূর নিজের নিকাব খুলে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ায় মায়ের কপালে, গালে, সর্বাঙ্গে। তারপর ফিসফিস করে বলে,
—”আপনার সাথে দেখা তো আর হলো না এই জাহানে! তবে চিন্তা করবেন না! এই দুনিয়া আর কয়দিনের! অতি শীঘ্রই দেখা হবে—কাল হাশরের মাঠে! আমাদের ইনশাআল্লাহ!”

এ কথা বলে মেহনূর ডুকরে কেঁদে উঠে!
এহসান আর দাঁড়িয়ে থাকে না। দ্রুত এগিয়ে এসে মেহনূরকে ধরে নিয়ে যেতে চায়।
মেহনূর যেতে চায় না!
এহসান না পারতে ধমক দিয়ে বলে,
—”তুই পাগল হয়ে গেছিস! জানিস না, মৃতদের জন্য কাঁদতে নেই?”
এহসান মেহনূরকে অনেক কষ্টে ক্যাবিনের বাইরে নিয়ে আসে, যেখানে মেহনূরের পরিবারের সবাই অপেক্ষা করছেন।
তারা কেউ ভেতরে যাননি। যতই হোক, গায়রত বলে কিছু আছে—মেহনূরের মা তাদের জন্য হারাম, তাই উনার লাশও তাদের দেখা হারাম। আর বাড়ির মহিলারাও এখনো ভেতরে যাননি, কারণ এতক্ষণ এহসান সেখানে ছিলেন। যদিও তারা পর্দার আড়ালে ছিলেন, তবুও এহসান মেহনূরকে নিয়ে আসার পর সবাই সামনে এসে দাঁড়ান।
মেহনূর বাইরে আসতেই মেহরুব একপ্রকার দৌড়ে এসে তাকে নিজের কাছে টেনে নেয়, শক্ত করে আগলে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে,

— তুই একদম কাঁদবি না, কষ্ট পাবি না! আমরা আছি তো! আমরা আছি না?
মেহনূর মেহরুবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
— ভাইজান, আমি আর নিতে পারছি না… আমি মরে যাব… আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে!
ঠিক তখনই পাশ থেকে ওর বাবা বলে ওঠেন,
— আম্মা, তুমি কেঁদো না। তোমার কান্নায় মানায় না।
কত দিন পর ‘আম্মা’ ডাক শুনল মেহনূর! নিজের বাবার মুখ থেকে! কিছুক্ষণের জন্য একদম স্তব্ধ হয়ে যায় সে।
অতঃপর মেহরুবকে ছেড়ে এসে নিজের আব্বাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। মাজহারুল সাহেব কিছু বলেন না, চুপচাপ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন।
তখনই এহসান বলে ওঠে,
— মেহরুব, আমি মেহরাজকে বের করে আনছি। তুই ওকে সামলাস, আর তাড়াতাড়ি জানাজার ব্যবস্থা কর।
মেহরুব এহসানের কথায় মাজহারুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে,

— আব্বা, জানাজা কোথায় হবে? বাড়িতে নিয়ে যাবেন না খালাকে?
এহসান স্পষ্ট কণ্ঠে বলে,
— এখানেই গোসল দিয়ে রাতে আমরা যারা আছি, তারাই জানাজা পড়িয়ে সোজা কবরস্থানে নিয়ে গিয়ে দাফন করব।
এহসানের কথায় মেহরুব, মাজহারুল সাহেব এবং অন্য ভাইরা সহমত প্রকাশ করেন।
এহসান ভেতরে গিয়ে মেহরাজকে নিয়ে আসে। মেহরাজ তখনো কান্নায় ভেঙে পড়েছে।
অতঃপর মেহনূরকে আগলে নিয়ে একটি বেঞ্চে বসায়। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ওর কী অবস্থা হয়েছে! কান্না করতে করতে যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে।
এহসান নিজের পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে ওর চোখ-মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলে,

— তুমি এভাবে কেঁদো না। এতে মেহরাজ আরও ভেঙে পড়বে। নিজেকে শক্ত করো। তুমি কি জানো না…
কথা শেষ না হতেই মেহনূর এক দৃষ্টিতে এহসানের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এই মানুষটা যতই খারাপ হোক না কেন, তার খারাপ সময়ে সবকিছু ভুলে সে পাশে দাঁড়ায়!
পরক্ষণেই মেহনূর হঠাৎ এহসানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে বলে
— আমি আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য কাঁদছি না… আমি কাঁদছি কারণ আমি আমার মায়ের জীবিত মুখখানা কখনো দেখতে পাইনি!
এহসান মেহনূরের মাথায় আর পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনার সুরে বলে,
— তো কী হয়েছে? এই দুনিয়ায় দেখতে পাওনি, তো কী হয়েছে? চিরস্থায়ী পরকালে নিশ্চয়ই দেখতে পাবে!
কিন্তু মেহনূর শান্ত হয় না। আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে এহসানকে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে…
অবশেষে মাটির কোলে শোয়ানো হলো মেহনূরের মাকে। কান্নার স্রোত ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এল, অথচ শূন্যতার দহন যেন আরও প্রবল হলো।

এহসান জানাজা থেকে ফিরে ছোট তালুকদার বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।
আজ কত বছর পর এ বাড়িতে পা রাখছে, সে নিজেই জানে না। তার চোখে কোনো আবেগ নেই, কেবল এক অদ্ভুত স্থিরতা।
বাড়িতে ঢুকেই সে দেখে মেহনূর মাটিতে বসে আছে, যেন ভেঙে পড়েছে সমগ্র অস্তিত্ব। তার মাথা রাখা এহসানের আপন খালার কোলে—এনিফা বেগমের কোলে।
কত বছর পর যে নিজের মায়ের বোন খালাকে দেখলো তার হিসেব নেই এহসানের”!
এহসান কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে কাশি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে বলল।

— “মেহনূর, চলো। যেতে হবে।”
তার কণ্ঠে আদেশের সুর।
এনিফা বেগম চোখ তুলে তাকালেন। ক্ষিপ্ত দৃষ্টি! যেন মুহূর্তেই চুরমার করে দেবেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে। তার বুকের ভেতর রাগ আর ঘৃণার এক সুনামী বয়ে চলেছে। মনে মনে বললেন, “একটা পশু জন্ম দিয়েছিল আমার বোন, যে আজ আমার ফুলকে কলঙ্কিত করে ছাড়ল!”
এহসানের কণ্ঠ শুনে মেহনূর যেন নিজ জগতে ফিরে আসে। ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াতে চেষ্টা করল।
পাশে বসে থাকা মেহরাজ দাঁড়িয়ে গেল রাগে ফেটে পড়ে বলে।
— “মেহনূর কোথাও যাবে না!”
এহসান এক পলক তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলে,
— “চুপ থাক! এত কথা বলিস না। দেখছিস না, আমার বেগম নিজেই যেতে রাজি!”
মেহনূর ধীর পায়ে মেহরাজের কাছে গিয়ে শান্ত গলায় বলল,
— “থাক ভাইজান, আর ঝগড়া কোরো না। দিনশেষে আমি উনারই, তাই যেতেই হবে। তুমি আমার জন্য দুশ্চিন্তা কোরো না।”

তারপর এহসানের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
— “আমি আসছি, বোরকা পরে।”
এই বলে ধীর পায়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল সে।
এনিফা বেগম এতক্ষণ ঘৃণার আগুনে জ্বলছিলেন, চুপ ছিলেন, কিন্তু আর সহ্য করতে পারলেন না। শক্ত গলায় বললেন,
— “তুই শেষমেশ নিজের কলঙ্কে আমার ফুলকেও কলঙ্কিত করে ছাড়লি!”
এহসান বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলল,
— “তোমার ফুল তো আমারই, তাই আমার কলঙ্কেই কলঙ্কিত হবে!”
এনিফা বেগম কোনো উত্তর দিলেন না, শুধু দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন।
ঘরের ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে এল। মেহরাজ চুপচাপ বসে রইল সোফায়। কারও কাছে যেন কিছু বলার নেই।
অল্পক্ষণ পর মেহনূর বোরকা পরে বেরিয়ে আসে
ঠিক তখনই দরজায় দেখা গেল মাজহারুল সাহেব, মনসুর তালুকদার আর ছোট দুই ভাইকে।
তারা বুঝে গেলেন, এহসান আজ মেহনূরকে নিয়ে যাবে।
মেহরুব ক্ষিপ্ত হয়ে ধেয়ে আসতে চায়, কিন্তু মাজহারুল সাহেব হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন। তারপর এহসানের সামনে এসে শান্ত গলায় বললেন,

— “কিছু দিনের জন্য আমার মেয়েকে রেখে যা। পরে আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসব।”
এহসান ভ্রু কুঁচকে বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলে।
— “আমি রেখে যাই, আর তোমরা ওকে নিয়ে অন্য দেশে পালিয়ে যাও, তাই তো?”
মাজহারুল সাহেব ধীরস্থির কণ্ঠে বললেন,
— “আমি কথা দিচ্ছি, এমন কিছু হবে না।”
এহসান এক পলক মেহনূরের দিকে তাকাল। তারপর দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
— “আমার বউ আমার সাথেই যাবে। এটাই আমার শেষ কথা!”
মেহনূর সামনে এসে দাঁড়ায়। তার কণ্ঠ স্পষ্ট, অথচ বেদনায় ভারী।
— “আব্বা, আপনি আমার জন্য কারো কাছে মাথা নত করবেন না। আজ থেকে ধরে নিন, আপনার কোনো মেয়েই নেই। আপনি শুধু দুই ছেলের পিতা!”

মাজহারুল সাহেব চোখ বন্ধ করলেন। তার মেয়ের কণ্ঠে যে পরিমাণ যন্ত্রণা, তা সহ্য করা অসম্ভব।
মেহরুব রাগে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে উঠে বলে
— “আমার বোন আমাদের সাথেই থাকবে! দেখি তুই কীভাবে নিয়ে যাস!”
এহসান মেহনূরের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল
— “নিয়ে তো যেতে চেয়েছিলাম কোলে করে। এবার দেখি, তোর বোন কীভাবে যেতে চায়—হেঁটে, নাকি কোলে করে?”
মনসুর তালুকদার বজ্রকণ্ঠে গর্জে উঠলেন,
— “আর একটা কথা বললে জিভ ছিঁড়ে ফেলব! আমার ভাতিজি আমাদের সাথেই থাকবে!”
এহসান ঠান্ডা গলায় বলল,
— “সাবধানে কথা বল, মনসুর তালুকদার। ভুলে যাস না, আমি এহসান তালুকদার! যা বলি, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করি!”

তারপর এক ঝটকায় মেহনূরের হাত ধরে কাছে টেনে নিল।
মেহরুব কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মেহনূর মিনতি করে বলল,
— “দয়া করে আমায় আটকিও না। কত কিছু করলে, পারলে কি আমায় বাঁচাতে? তাই অনুগ্রহ করে বাধা দিয়ো না!”
চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কেউ কিছু বলল না।
এহসান বিজয়ের হাসি নিয়ে বেরিয়ে এল, হাত ধরে টেনে নিল মেহনূরকে। তালুকদার বাড়ির দরজা পেরিয়ে তাদের ছায়া মিলিয়ে গেল রাতের আঁধারে।

মেহনূর বসে আছে ঘরের এক কোণে, তবে বড় তালুকদার বাড়িতে নয়, সেই বন্দী খানায়। তাঁর চোখে এক ধরনের স্থিরতা, যেন তিনি অন্য কোথাও হারিয়ে গেছেন। এহসান আবার তাকে এখানে নিয়ে এসেছে, তবে মেহনূর একটুও জেদ করছে না। তার ভেতর কোনো প্রতিরোধ নেই, সে শুধু নিরব হয়ে বসে আছে, পাথরের মতো নিঃশব্দ। চোখের সামনে ভাসছে তার জন্মদায়ী মায়ের লাশ। সেই দৃশ্য, সেই যন্ত্রণা, যেন তার শরীরের মধ্যে ক্ষত হয়ে গিয়েছে।
এহসান তাকে কিছু বলছে না। সে চুপচাপ বসে, শুধু মেহনূরকে লক্ষ করছে। সে জানে, এই মুহূর্তে মেহনূরকে সময় দেওয়ার প্রয়োজন, তাকে নিজেকে সামলানোর সুযোগ দেওয়া দরকার।
এহসান আলতো পায়ে বিছানা থেকে উঠে যায়। তারপর বাথরুম থেকে রুমাল নিয়ে পানি দিয়ে ভিজিয়ে আনে। মেহনূরের কাছে এসে, তার হাত-মুখ মুছিয়ে দেয়, চুলগুলো ঠিকঠাক গুছিয়ে দেয়। প্রতিটি ছোট কাজ যেন এক ধরনের শান্তির চেষ্টা, কিন্তু মেহনূরের ভাবান্তর নেই। তার চেহারায় কোনো পরিবর্তন নেই, সে যেন নিজের ভেতরেই কোথাও হারিয়ে গেছে।

এহসান এগুলো করছে, কিন্তু মেহনূর এক মুহূর্তের জন্যও তার দিকে তাকাচ্ছে না, সে নিজের দুনিয়ায় হারিয়ে গেছে, এক বেদনার ভেতর ডুবে আছে।
মেহনূর এক পলক এহসানের দিকে তাকাল, চোখভরা ঘৃণা নিয়ে। মনে মনে ভাবতে লাগল—এতটুকু কি ক্ষতি হতো যদি অন্তত দুদিনের জন্য হলেও তাকে তার পরিবারের কাছে রেখে আসত?
কেনো বুঝতে পারে না এহসান তার কষ্ট? কেনো?
এহসান মেহনূরের সেই বিদ্ধ করা দৃষ্টির সামনে অসহায় হয়ে গেল। বুকটা ধক করে উঠল। সেই একই ঘৃণা, সেই আগের মতো তীব্র, ঝলসে দেওয়া ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার নারী। ভারী গলায় বলল এহসান
— বুকটা কেঁপে ওঠে যখন তোমার চোখের ঘৃণা আমায় বিদ্ধ করে…
মেহনূর কাঁপা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
— আপনি ঘৃণারই যোগ্য। আপনার মতো নিষ্ঠুর পুরুষকে ঘৃণা করা যায়, আর কিছু না! কেন এত নিষ্ঠুর আপনি? কেন এত?
এহসান মেহনূরের চোখে গভীর দৃষ্টি মেলে বলল,

— আমার পাপ, আমার নিষ্ঠুরতা, সেসবই তো তুমি দেখতে পাও! কিন্তু আমার ভালোবাসা? সেটা কি একবারও দেখলে না? একবারও বুঝলে না? অথচ, আমার এই পাপের তুলনায় তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা অসীম…
মেহনূর কোনো উত্তর দিল না। চোখ নামিয়ে নিল।
হ্যাঁ, এটা ঠিক… এহসান তাকে ভালোবাসে। কিছুটা হলেও সে বোঝে। কিন্তু এই ভালোবাসার চেয়ে সে তার নিকৃষ্টতাই বেশি দেখতে পায়, বেশি অনুভব করে।
এহসান এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে মেহনূরকে কোলে তুলে নেয়, উদ্দেশ্য—বিছানায় শুইয়ে দেওয়া।
মেহনূর অপ্রস্তুত হয়ে এহসানের গলা দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, মাথাটা ওর বুকে লেপ্টে দিল।
এহসান ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে কোমল কণ্ঠে বলল,

— দেখো, ঘুম আসে কি না। আমি খাবার নিয়ে আসছি।
বলে এহসান রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
হত রাতে খাবার যা মেহনূর তৈরি করেছিল, তা গরম করে। কিন্তু শুধু গরম করাই নয়, নিজ হাতে ভাতও রান্না করল। যদিও কাজটা সহজ ছিল না, অনেক কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত রান্না সম্পন্ন করে।
অতঃপর খাবার নিয়ে ফিরে এল মেহনূরের কাছে।
মেহনূর বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে ছিল। নিজের সাথে ঘটে যাওয়া সব অপ্রত্যাশিত ঘটনার হিসেব মেলাতে ব্যস্ত সে।
এহসান মেহনূর কে এ অবস্থা দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে খাবারের প্লেট নিয়ে ওর সামনে বসে। তারপর এক লোকমা ভাত তুলে মেহনূরের সামনে ধরল।
মেহনূর সেই লোকমাটার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। এই ভাত কোথা থেকে এলো? সে তো রান্না করেনি। তাহলে কি…?
চট করে চোখ তুলে তাকাল এহসানের দিকে, হতভম্ব হয়ে ফিসফিস করে বলল,

— আপনি…?
এহসান যত্ন সহকারে ওর মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল,
— হ্যাঁ, আমি রান্না করেছি। প্রতিদিন তো তুই আমায় খাওয়াস, আজ আমিই না হয় তোকে খাওয়ালাম।
মেহনূর বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।
এই পুরুষ… তার জন্য রান্না করেছে? কেন করল? ভালোবাসে বলে? তাই কি…?
মেহনূর এবার এহসানের হাতের দিকে দৃষ্টি দিল। গভীরভাবে পরখ করতে করতে বলল,
— হাতটাত পুড়াননি তো?
এহসান মৃদু হেসে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে উওর দেয় ,
— না, পুড়াইনি।
মেহনূর সূক্ষ্ম কণ্ঠে বলল,
— যদি পুড়ে যেত?
এহসান মৃদু হাসল। আবারও মেহনূরের মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল,

— পুড়লে পুড়ত। তোমার জন্য হাত নয়, অন্তরও যদি পুড়ে যায়, তাও কম হবে।
মেহনূর বিস্ময়ের সাগরে ডুবে গেল। আজ আর থেমে থাকতে পারল না, প্রশ্ন করেই ফেলল,
— আমি? আমি এমন কী, যার জন্য এত কিছু?
এহসান গভীর চোখে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে,
— আমার জীবনে তুমি ঠিক কী, তা হয়তো এই জীবনে বলে শেষ করতে পারব না। তাই থাক না কিছু না জানা প্রশ্ন…
মেহনূর আজ থামল না।
— আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি, উত্তর দিবেন?
এহসান ওর মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে বলে,
— হুম।
মেহনূর নিজেকে সামলে গলা পরিষ্কার করল। তারপর এক অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসলো,

— ঠিক পাঁচ বছর আগে, শায়ন মাসের তিন তারিখে… হ্যাঁ, তিন তারিখেই, আপনি যে একজনকে জবাই করেছিলেন, মনে আছে? তার নাম আলম?
এহসান এক মুহূর্ত চুপ করে গেল।
মেহনূর থেমে গেল না,
— তাকে কেন মারলেন? সে তো একজন নিষ্পাপ বাবা ছিল, যে নিজের সন্তানদের জন্য পরিশ্রম করত। সে তো ভালো মানুষ ছিল! তাহলে কেন তাকে আপনার নিকৃষ্টতার শিকার হতে হলো?
এহসান এক তপ্ত শ্বাস ফেলল। তারপর স্থির কণ্ঠে বলল,
— এটা জেনে রাখ, আলম এক বিষাক্ত কীট ছিল। তাই মরতে হয়েছে ওকে।
মেহনূর অসহায় গলায় বলল,
— কেন? বলুন!
এহসান ওর মুখে খাবার তুলে দিয়ে শান্ত গলায় বলল,
— সময় হলে সব বুঝবি, ঠিক আছে?
মেহনূর চুপ করে গেল।
কিন্তু এই নিরবতার মাঝেও ওর হৃদয়ে ঝড় বয়ে গেল…

সবার চোখের সামনে একরকম মেনে নেওয়া হয়েছে যে মেহনূর এখন থেকে এহসানের অধীনেই থাকবে। কিন্তু মেহরুব ও মেহরাজ… তারা কোনোভাবেই এই বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারছে না। তাদের কলিজার টুকরো, তাদের মেহনূর, কীভাবে এক কলঙ্কের সম্পর্কে আবদ্ধ থাকবে?
মেহরাজ আর মেহরুব এসব নিয়ে চিন্তিত হয়ে বসে আছে ছাঁদে সোফাতে
অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর মেহরাজ হঠাৎই বলে উঠে,
— মেহরুব, ঐ যে এহসানের একটা ছোট বোন আছে, ওর বিয়ে হয়ে গেছে?
মেহরুব প্রশ্ন শুনে খানিকটা চমকে গেল, তবুও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে উত্তর দিল,
— হ্যাঁ, আছে তো। আমাদের মেহনূরের সাথেই পড়ে। আর মনে হয় বিয়ে হয়নি, কারণ বিয়ে হলে তো এখানে থাকত না।
মেহরাজ ঠোঁটের কোণে এক শয়তানি হাসি ফুটিয়ে বলল,

— ও আচ্ছা…
মেহরুব ভ্রু কুঁচকে মেহরাজের দিকে তাকিয়ে বলে,
— এসব জানতে চাইছো কেন?
মেহরাজ তিক্ত হেসে বলল,
— বেশ প্রয়োজনেই জানতে চাইলাম।
ঠিক তখনই ছাদে আলতো পায়ে চা নিয়ে প্রবেশ করল নূরি। ওখানে রাখা টেবিলের ওপর চায়ের ট্রে নামিয়ে মেহরাজের দিকে তাকিয়ে বলল,
— বড় ভাইজান, আপনাদের চা।
মেহরাজ কোনো কথা না বলে নিজের কাপ তুলে নিলো, তারপর সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল। উদ্দেশ্য, এখান থেকে সরে গিয়ে মেহরুব ও নূরিকে কিছুটা সময় একা ছেড়ে দেওয়া।
চলে যেতে যেতে মেহরাজ একচিলতে হাসি দিয়ে বলল,

— নূরি, মেহরুবের মাথা নাকি খুব ধরেছে। যদি পারিস, তো একটু টিপে দিস।
মেহরুব মেহরাজের এই গজবি মিথ্যা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকাল, আর মেহরাজ মুচকি হেসে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল।
নূরি কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কী করা উচিত বুঝতে পারছিল না। তবু চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মেহরুব ধমক দিয়ে বলে
— কী রে? ভাইজান কি বলল, শুনিসনি?
নূরি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— ভাইজান বলেছে, আপনি বলেননি তো।
মেহরুব চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে,
— ভাইজান বলেছে, এখন আমিও বলছি। দে, মাথা টিপে।
নূরি কপাল কুঁচকে বলে
— আপনার সব কথা সবসময় শুনার প্রয়োজন মনে করি না।
মেহরুব এবার বেশ কড়া গলায় বলে
— বড়দের সঙ্গে এ কেমন আচরণ শুনি?
নূরি দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বলল,
— আচ্ছা, ঠিক আছে। দিচ্ছি।
তারপর আলতো পায়ে এগিয়ে এল মেহরুবের দিকে। মেহরুব সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল, মাথাটা এলিয়ে দিল।

নূরি খুব সাবধানে মেহরুবের মাথায় হাত রাখল। কিন্তু ওর এত কাছাকাছি আসতেই মেহরুবের নাকে এক অদ্ভুত মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে এল। সে চোখ না খুলেই জিজ্ঞেস করল,
— কী মেখেছিস রে গায়ে? এত সুন্দর ঘ্রাণ করছে।
নূরি চমকে গেল প্রশ্ন শুনে। একটু ইতস্তত করল, তারপর বলে,
— আতর।
মেহরুব আবারও প্রশ্ন করে
— নাম কী? কোথা থেকে নিলি?
নূরি হতবাক হয়ে গেল। এটা কী ধরনের প্রশ্ন? তবুও শান্ত গলায় বলে,
— নাম খেয়াল করিনি। তুর্কী থেকে আজিম ভাইরা এনেছেন।
নূরির কথা শেষ হতেই মেহরুব চট করে চোখ খুলে তাকাল। ওর দৃষ্টি আগুনের মতো জ্বলছিল। কড়া গলায় বলে,
— হারাম পুরুষের দেওয়া জিনিস ব্যবহার করছিস? লজ্জা করে না?
নূরির বুক কেঁপে উঠে, ওর চোখে কষ্টের ছায়া নেমে এল। মলিন কণ্ঠে বলে,
— তারা আমাকে দেননি, আম্মাকে দিয়েছেন। আমি শুধু একবার মেখেছি, সুন্দর ঘ্রাণ দেখে।
মেহরুব চোখ বন্ধ করে কঠিন কণ্ঠে বলে,

— এ প্রথম, তাই কিছু বললাম না। এরপর যদি দেখি, কোনোদিন কোনো হারাম পুরুষের দেওয়া কিছু নিয়েছিস, তো যে হাত দিয়ে নিবি, সেই হাত কেটে রেখে দেব!
নূরির হৃদয়ে একরাশ রাগ জমে উঠে, কিন্তু শান্ত স্বরে বলে,
— মেহরুব ভাই, আপনি চাচাতো ভাই। তাই এতটা অধিকার খাটায় না আমার ওপর, যতটা দেখানোর চেষ্টা করছেন।
মেহরুব চোখ বন্ধ রেখেই বলল,
— তোর ওপর যদি কারও সবচেয়ে বেশি অধিকার থাকে, তাহলে সেটা আমার। এরপর যদি এমন কথা বলিস, তাহলে আমার অধিকার আমি ঠায় ঠায় দেখিয়ে দেব।
নূরি এক মুহূর্ত মেহরুবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর চোখে একরাশ প্রশ্ন জমে ছিল, কিন্তু উত্তর খোঁজার শক্তি নেই। তাই চুপ করে গেল…

রাত ১১টা।
মেহনূর শুয়ে আছে এহসানের বুকে। তবে আজ তার চোখে একটুও ঘুম নেই। ভিতরে এক অজানা অস্থিরতা, কিছুই ভালো লাগছে না। এরই মাঝে অনুভব করছে—এহসানের শরীরের অস্বাভাবিক তাপমাত্রা।
তার কপালটা ছুঁয়ে দেখে মেহনূর। চমকে ওঠে!
এহসানের শরীর এত গরম কেন? জ্বর আসবে নাকি?
চিন্তিত হয়ে সে আস্তে করে এহসানের বুক থেকে মাথা তুলে কপালে হাত রাখে। নরম হাতের স্পর্শে এহসান ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়।
মেহনূর স্পষ্ট বুঝতে পারে—এহসানের জ্বর উঠেছে!
সে আলতো করে কোমর থেকে এহসানের হাত সরাতে চায়, কিন্তু এহসান আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলে
— আমার বুকে শুয়ে থাক।
মেহনূর ওর হাত সরাতে সরাতে বলে,
— ছাড়ুন, আমি জলপট্টি নিয়ে আসি। দেখুন, কত জ্বর উঠেছে!
এহসান ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে বলে,
— না থাক, তোমার কষ্ট করার দরকার নেই। আমি ঠিক আছি।
মেহনূর বিরক্ত হয়ে এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
— সবসময় এত একরোখা কেন আপনি! ছাড়ুন, আমি জলপট্টি নিয়ে আসছি!
এহসান এবার আলতো করে ওকে ছেড়ে দেয়।

মেহনূর তাড়াতাড়ি উঠে যায়। ছোট্ট একটা তোয়ালে নিয়ে আসে, সঙ্গে এক বাটি ঠান্ডা জল।
চুপচাপ এহসানের পাশে বসে। যত্ন করে ওর কপালে জলপট্টি দেয়। স্পষ্ট দেখতে পায়—এহসানের নাক-মুখ লাল হয়ে গেছে, নাকের ডগা পর্যন্ত টকটকে লাল!
নিশ্চয়ই প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে উনার!
মেহনূর এবার এহসানের গলায় হাত রাখে। গা জ্বলে যাচ্ছে, শরীর আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
সে আস্তে করে উঠে গিয়ে আলমারি খুলে ঔষধের বাক্স থেকে একটা জ্বরের ঔষধ নিয়ে আসে। তারপর ঔষধ আর পানির গ্লাস টা এহসানের সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে,
— ঔষধটা খেয়ে নিন।
এহসান ধীরে ধীরে দু’হাত দিয়ে ভর করে উঠে বসে। ঔষধ টা আর পানি খেয়ে নেয়
আর ক্লান্ত, অবসন্ন কণ্ঠে বলে,

— মেহনূর, আমার পাশে এসে শুয়ে যাও। আমি তোমার বুকে মাথা রাখলে সব জ্বর চলে যাবে।
মেহনূর দীর্ঘশ্বাস ফেলে।বলে
— আচ্ছা।
সে পানি গ্লাস হাতে নিয়ে রেখে দেয় অতঃপর ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে এহসানের পাশে শুয়ে যায়।
এহসান ধীরে ধীরে মেহনূরের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নেয় “! এটাই শান্তি এর চেয়ে উওম কিছু হতে পারে না “!
মেহনূর কেঁপে ওঠে। সবসময় সে নিজেই এহসানের বুকে মাথা রাখে—কিন্তু আজ প্রথমবার এহসান ওর বুকে মাথা রাখল!
সে কাঁপা কাঁপা হাতে এহসানের মাথায় হাত রাখে, আলতো করে চুলে বিলি কাটে।
এহসান আয়েশে চোখ বুজে নেয়।
মেহনূর বুঝতে পারে, এহসানের অর্ধ শরীরের ওজন তার ওপর এসে পড়েছে। মনে হচ্ছে শরীর টা পিশে যাচ্ছে
এত বড়, সুঠাম দেহের একজন পুরুষ… তার অর্ধেক ভারও নেওয়া কঠিন! কিন্তু কেন জানি আজ নিজের কষ্টের কথা ভাবতে পারছে না মেহনূর।
কিন্তু মেহনূর কেন জানি নিজের কষ্টের দিকে অত পাত্তা দিচ্ছে না, সে বারবারই এহসানের কথা ভাবছে! আল্লাহই জানেন, কী থেকে কী হয়!

মেহনূরের জানে না আজ আর তার ঘুম আসবে না
সে চুপচাপ শুয়ে এহসানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
এই মানুষটাকে সে ঘৃণা করার কথা, অথচ তাকেই এভাবে বুকে আঁকড়ে ধরে আছে!
তার অন্তর একবারে মুচড়ে উঠছে…ও
এহসানের জ্বর যেন তার ভেতরেও মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে!
মেহনূরের চোখে এমনিতেই ঘুম নেই, আর এখন এহসানের এই অবস্থা! মেহনূর চেষ্টা করছে চোখ লাগাতে, কিন্তু এহসান বারবার নড়াচড়া করছে আর কেঁপে উঠছে। বোঝাই যাচ্ছে, ভীষণ জ্বর এসেছে!
এহসান বারবার নড়াচড়া করছে, কেঁপে উঠছে জ্বরের তীব্রতায়।মেহনূর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
এহসান অস্পষ্ট গলায় বলে
— মেহনূর, খুব ঠান্ডা লাগছে… আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধর আমায়…
এহসানের এমন কথায় মেহনূর আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ওকে। আর বলে
— আমি শক্ত করে ধরেছি, চিন্তা করবেন না।
এহসান এখন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে।
কিন্তু মেহনূর জেগে আছে, গুনছে নির্ঘুম রাতের প্রহর।

হঠাৎই এহসান গোঙিয়ে উঠে “! মেহনূর এখনও ঘুময়নি আগের মতোই এহসান কে বুকে জড়িয়ে তার চুলে পিঠে অতি যত্ন সহিত হাত বুলিয়ে দিচ্ছে
হঠাৎ এহসানের শব্দ শুনে মেহনূর আঁতকে উঠে সাথে সাথে মেহনূর বাহু আলগা করে দেয় যাতে এহসান উঠতে পারে। এহসান মেহনূরের বুক থেকে মাথা তুলে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে বলে,
— ভেতরে খুব অশান্তি করছে… বমি পাচ্ছে মেহনূর…
মেহনূর সঙ্গে সঙ্গে ওর গলা, ঘাড়ে হাত বুলায়। বুঝতে পারে, এহসানের শরীর ঘামছে!
সে তাড়াতাড়ি কম্বল সরিয়ে দেয়, তারপর এহসান কে ধরে উঠানোর চেষ্টা করে “! এহসান নিজেই উঠে বসে কারণ মেহনূরের পক্ষে সম্ভব নয় তাকে বসানোর
মেহনূর অশান্ত গলায় বলে,
— আপনি বসুন, আমি আসছি!
এ বলে বিছানা থেকে নেমে এক দৌড়ে গিয়ে বাথরুম থেকে একটা বালতি নিয়ে আসে।
বিছানার পাশে এনে বালতি রেখে এহসানকে আগলে ধরে, বালতির দিকে উদ্দেশ্য এহসান যাতে বালতিতেই বমি করে
ঠিক তখনই…

এহসান ওর ওপরই বমি করে দেয়!কিন্তু মেহনূর একটুও সরে যায় না। আর না ওর ঘৃনা লাগে “! মেহনূর উল্টো অস্থির হয়ে উঠে এহসানের এমন হঠাৎ এ অবস্থা দেখে!
এহসান মেহনূরের সারা শরীর ভরিয়ে দিয়েছে বমি করে কিন্তু মেহনূর এসব একটুও পাত্তা দিচ্ছে “!
না, তার মাথাতেই আসছে না যে, তার গায়ে বমি লেগেছে!
তার মন কেবল কেঁদে উঠছে… এহসানের এই কষ্ট দেখে!
মেহনূর অস্থির হয়ে এহসানের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়, সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
— ধীরে ধীরে, আল্লাহর নাম নিন। সব ঠিক হয়ে যাবে। সহজ হবে, আল্লাহর নাম নিন!
কিছুক্ষণ পর এহসান শান্ত হয়।
মেহনূর টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে ওর ঠোঁটে ঠেকিয়ে অশান্ত গলায় বলে।
— নিন, কুলি করুন।
এহসান একবার চোখ তুলে মেহনূরের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর মুখ কুলি করে পানি খেয়ে নেয়।
মেহনূর অল্প পানি হাতে নিয়ে ওর সম্পূর্ণ মুখ মুছে দিয়ে অশান্ত গলায় বলে ।
— আপনি বসুন, আমি আসছি।

এহসান মাথা নাড়িয়ে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দেয়। মেহনূর তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে অথচ সে নিজেই অশান্ত হয়ে কাজকর্ম করছে “! এহসান এ অবস্থায়ও মৃদু হাসে
মেহনূর এবার তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে নিজের শরীর পরিষ্কার করে নেয়। তার একটুও কেন জানি ঘেন্না লাগছে না তার এই পরিস্থিতিতে “!
তার মনে হচ্ছে—এ মুহূর্তে সে একটাই কাজ করতে চায়, এহসানের যত্ন নেওয়া
মেহনূর বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেই তাড়াতাড়ি মেঝে পরিষ্কার করে নেয়। এরপর অস্থিরভাবে আলমারি খুলে একটা কালো কুর্তি টেনে নেয় আর দ্রুত আবার বাথরুমে ঢুকে পড়ে।
এহসান নিঃশব্দে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। তার নারী ঠিক কতটা অশান্ত হয়ে উঠেছে! একজন মুত্তাকী স্ত্রীর এক ক্ষুদ্র অংশের ভূমিকা পালন করছে সে এই মুহূর্তে।
মেহনূরের এমন হন্তদন্ত হয়ে যাওয়া দেখে এহসানের মনে অদ্ভুত প্রশান্তি নামে। বেশ ভালো লাগছে তার!
কিন্তু হঠাৎই মেহনূর অস্বস্তিতে পড়ে যায়। তাড়াহুড়োর মধ্যে যে কুর্তিটা নিয়েছে, সেটা হাঁটু পর্যন্ত লম্বা! অথচ সে কখনোই হাঁটু বরাবর জামা পরে না। সবসময় হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে রাখাটাই তার অভ্যাস। কিছুক্ষণ দোটানায় পড়ে থাকে, তারপর নিজেকে বোঝায়—

“এখানে তো অন্য কেউ নেই, আর এহসানও এখন তার দিকে তাকানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না। আর তাকালেও কি? এই পুরুষের বুকেই তো সবসময় লেপ্টে থাকে সে! তাহলে এ সামান্য ব্যাপারটা লজ্জার হবে কেন?”
কিন্তু মন যেন মানতে চাইছে না!
একটু সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নেয় মেহনূর। অতঃপর গোসল সেরে বেরিয়ে আসে বাথরুম থেকে “!
এক পলক তাকায় এহসানের পানে যে কি না চোখ বুঁজে শুয়ে আছে বিছানায় “!
মেহনূর এটা দেখে শান্তির শ্বাস ফেলে আলতো এগিয়ে চুল থেকে তোয়ালেটা খুলে জানালার পাশে মেলে দেয়, তারপর মাথায় ওড়না টেনে নেয়।
এহসানের পাশে এসে দেখে, এহসান সেই আগের ন্যায় চুপচাপ শুয়ে আছে। কিন্তু তার দৃষ্টি… অপলকভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকেই!

মেহনূর গভীর শ্বাস ফেলে, ধীরে হাত বাড়িয়ে এহসানের চুলে কপালে হাত বুলিয়ে দেয়।আর বলে
— “আপনার শরীর মুছে দিই? ঘেমে গেছেন, মন শান্ত হবে।”
এহসান তেমনি চেয়ে থেকে মৃদু গলায় বলে,
— “না, প্রয়োজন নেই। তোকে কষ্ট করতে হবে না।”
মেহনূর ভ্রু কুঁচকে তাকায় আর বলে
— “বলেছি উঠুন, এত কথা বলার সময় নেই!”
এহসান এবার আর কিছু না বলে ধীরে ধীরে উঠে বসে, বালিশে হেলান দেয়।
মেহনূর ছোট্ট একটা তোয়ালে ভিজিয়ে আনে, এক মগ পানি নিয়ে আসে। বিছানার পাশে টেবিলে মগ রেখে আলতোভাবে এগিয়ে আসে এহসানের দিকে।
কাঁপা কাঁপা হাতে এহসানের টিশার্টের হাত রাখে, উদ্দেশ্য টিশার্টটা খোলা। কিন্তু হাতের কাঁপুনি বাড়তে থাকে। কেন জানি খুব লজ্জা আর অপ্রস্তুত লাগছে নিজেকে “!

এহসান মেহনূর অবস্থা বুঝে মৃদু তিক্ত হাসে, তারপর নিজেই ধীরে ধীরে টিশার্ট খুলে ফেলে।
টিশার্ট সরতেই মেহনূরের সামনে উন্মুক্ত হয় এহসানের সুঠাম শরীর। নিখুঁত ধবধবে ফর্সা ত্বকের মাঝে গভীর আকর্ষণ নিয়ে উঁকি দিচ্ছে বুকের মাঝখানে হালকা কালো কুচকুচে পশমের মধ্যে লুকানো ছোট্ট একটা তিল!
মেহনূর তাকিয়ে থাকে নিঃশ্বাস বন্ধ করে!
পরক্ষণেই মনে পড়ে—
“আল্লাহ! সে কি করছে! এভাবে তাকিয়ে থাকা একদম অনুচিত!”
চট করে চোখ নামিয়ে নেয়, তারপর আলতো হাতে তোয়ালেটা ছোঁয়ায় এহসানের শরীরে।
এহসান নীরবে মেহনূরের প্রতিটি আচরণ লক্ষ করছে। মেহনূরের হাত থরথর করছে, গাল রাঙা হয়ে আছে। সে স্পষ্টতই অপ্রস্তুত।
কিন্তু উপায়ও নেই। ধীরে ধীরে এহসানের গা মুছে দেয়, হাত-পা-মুখ পরিষ্কার করে দেয়। কাজ শেষ হলে উঠে দাঁড়ায়।

— “আপনি বসুন, আমি টিশার্ট আনছি।”
এহসান শুধু মাথা নাড়ায়। মেহনূর দ্রুত রান্নাঘরে যায়, উদ্দেশ্য এহসানের জন্য কিছু তৈরি করা।
এহসান ধীরে ধীরে টিশার্ট পরে আর নিজের মনে বিড়বিড় করে,
— “দেখেছো, এহসান? নারীর মন কতটা ভয়ংকর আর কতটা মায়াময় হতে পারে! আর তোমার নারী… তার তুলনাই হয় না!”

মেহনূর অনেক ভেবে এহসানের জন্য চুলায় সুপ বসায়। এক বাটি গরম গরম ধোঁয়া ওঠা সুপ নিয়ে এহসানের পাশে এসে বসে।
চামচ নাড়াতে নাড়াতে বলে,
— “নিন, খেয়ে নিন। ভালো লাগবে।”
এহসান চোখ ছোট করে তাকায়,
— “এত ভালোবাসা! আমার জন্য রাতের ঘুম হারাম করে দিচ্ছিস?”
মেহনূর এহসানের মুখের সামনে চামচ তুলে ধরে।
— “এটা ভালোবাসা নয়, এটা মনুষ্যত্ব। আর মনে রাখুন, এ জীবনে আপনার আর আমার ভালোবাসা পাওয়া হবে না।”
এহসান ম্লান হেসে ফিসফিসিয়ে বলে,
— “এটাই ভালোবাসা! আর পাওয়া লাগবে না, পেয়ে গেছি…”
মেহনূর দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

— “এখন তর্ক করার সময় নয়। খেয়ে নিন!”
এহসান সুপ খাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার দৃষ্টি মেহনূরের উপর স্থির। কালো পোশাকে মেহনূরকে যেন আরও অপার্থিব লাগছে। মনে হচ্ছে, তার সৌন্দর্য শতগুণ বেড়ে গেছে!
একদম মুগ্ধতা নিয়ে চেয়ে থাকে এহসান। আহা, যদি একটু কম সুন্দর হতো! তাহলে এতটা মোহগ্রস্ত হতে হতো না! এই নিষ্পাপ মুখ, এই গভীর আঁখি, থুতনির তিল, গোলাপি ঠোঁট—পাগল বানিয়ে দিয়েছে তাকে!
নেশাগ্রস্ত গলায় বলে,
— “মন চায় তাকিয়ে থাকি তোমার মুখশ্রী ন্যায় প্রহরের পর প্রহর…দেখি তোমায় প্রাণ ভরে তাও যদি মিটে অন্তত তোমায় দেখার তৃষ্ণা এই ব্যাকুল আমার”
মেহনূর বিরক্ত মুখে বলে,

— “ও কবি, আমার কবিতা ছেড়ে খেয়ে নিন বাবা!”
এহসান কপাল কুঁচকে বলে,
— “ও আমার বেয়াদব নারী! কবে ছাড়বি বেয়াদবি ?”
মেহনূর দাঁত চেপে এহসানের মুখে জোর করে সুপের চামচ পুড়ে দেয়!
এহসান নরম স্বরে বলে,
— “এদিকে একটু আয় তো।”
— “কেন?”
— “আরে আয় বলছি!”
মেহনূর বিরক্তি নিয়ে একটু এগিয়ে নেয় নিজেকে এহসানের পানে আর বলে,
— “বলুন!”
এহসান আর কিছু বলে না। হঠাৎ করেই মেহনূরকে আঁকড়ে ধরে তার ঠোঁটের উপর নিজের ঠোঁট চেপে ধরে!
মেহনূরের চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়! “আল্লাহ! এত বড় দো’কআ আগে জানলে, কখনো শুনতাম না এনার কথা!”
এহসান বারবার কয়েক বার মেহনূরের ঠোঁট মনে ভরে ছুঁইয়ে ওকে ছেড়ে দেয় “!
এহসান ওকে ছেড়ে দিয়ে মুচকি হেসে, নিজের ঠোঁটে বৃদ্ধাঙ্গুলি বুলিয়ে বলে,
— “এবার পেটও ভরে গেল, জ্বরও সেরে গেল!”
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে মেহনূর উঠে চলে যায়। বিরক্তিতে মন বিষিয়ে গেছে! এত মানসিক চাপ আর নিতে পারছে না সে!

আত্মার আগলে পর্ব ২৮+২৯

এহসানকে ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে মেহনূর ওযু করে আসে। তখনই এহসান বলে,
— “জান, মাথাটা টিপে দে। খুব ব্যথা করছে!”
মেহনূর একটু তাকিয়ে দেখে, তারপর নামাজের হিজাব জড়িয়ে নেয়। টেবিল থেকে কুরআন শরীফ তুলে নিয়ে এহসানের পাশে বসে।
— “আমার কোলে মাথা রাখুন।”
এহসান দেরি করে না। আলগোছে নিজের মাথা খানা তুলে আপন নারী কোলে রাখে
এহসান তার মাথা রাখতেই মেহনূর তার চুলে হাত বুলাতে থাকে আর অন্য হাতে কুরআন ধরে, তাউয-তাসমিয়া পড়ে অপ্রিয় পুরুষের জন্য প্রিয় সূরা মুলক শুরু করে…
١. تَبَارَكَ ٱلَّذِى بِيَدِهِ ٱلْمُلْكُ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍۢ قَدِيرٌۭ
٢. ٱلَّذِى خَلَقَ ٱلْمَوْتَ وَٱلْحَيَوٰةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًۭا ۚ وَهُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْغَفُورُ
٣. ٱلَّذِى خَلَقَ سَبْعَ سَمَٰوَٰتٍۢ طِبَاقًۭا ۖ مَّا تَرَىٰ فِى خَلْقِ ٱلرَّحْمَٰنِ مِن تَفَٰوُتٍۢ ۖ فَٱرْجِعِ ٱلْبَصَرَ هَلْ تَرَىٰ مِن فُطُورٍۢ

আত্মার আগলে পর্ব ৩১