আত্মার আগলে পর্ব ৩২
সানজিদা আক্তার মুন্নী
রিসোর্টের যে কক্ষে এশাকে নিয়ে উঠেছিল মেহরাজ, সেই কক্ষের অন্য একটি চাবি দিয়ে প্রবল রাগে ফেটে পড়ে প্রবেশ করে এহসান।
কক্ষে ঢুকেই মেহরাজকে দেখে যেন রক্ত টগবগ করে ফুটতে শুরু করে তার শরীরে! তার আদরের ছোট বোন, তার কলিজার টুকরো—যে কিনা কোনো হারাম পুরুষ এর সামনে কখনো মুখ প্রদর্শন করেনি, আজ এক পরপুরুষর তার বুকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে!
এহসানের দেহে যেন আগুন ছড়িয়ে পড়ে, শিরদাঁড়ায় বরফ গলতে শুরু করল ক্ষোভের তাপে।
এক মুহূর্তও দেরি না করে বজ্রকণ্ঠে গর্জে উঠে সে—
—-“কুত্তার বাচ্চা! তোর সাহস হয় কী করে?!”
এই দুনিয়া কাঁপানো চিৎকার শুনে এশার চোখ মুহূর্তেই খুলে যায়!
সেও যেন তন্দ্রা থেকে বেরিয়ে আসে, যদিও পুরোপুরি জেগে উঠতে পারছে না। চোখের পাতা ভারী লাগছে, মাথাটা দুলছে—ঠিক যেন ঘোরের মধ্যে আছে! তার নিজের ইচ্ছেতে চোখ বন্ধ হয়নি, বরং তাকে জোর করেই এই অবস্থায় রাখা হয়েছে ।তার দেহ অবশ, কারণ তাকে অজ্ঞান করে রাখা হয়েছিল। তবুও, এই চিৎকারে সে কিছুটা সংবিৎ ফিরে পেলো।
অন্যদিকে, মেহরাজ তখনো এশার বুকেই মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে। কিন্তু সে জেগে আছে, সব শুনছে, সব বুঝছে! তবু সে নড়ছে না, কিছু বলছেও না। বরং আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে এশাকে, যেন মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তাকে ছাড়বে না!
এহসান মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেও তাতে কিছু যায় আসে না। সে কি বেঁচে থাকতে অন্য কোনো হারান পুরুষ তার বোনের শরীর স্পর্শ করবে?!
অসম্ভব!
ক্ষোভ আর ঘৃণার বিস্ফোরণে মেহরাজের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে এহসান।
নিজের শক্তিশালী বাহুতে মেহরাজের ঘাড় চেপে ধরে, একটানে টেনে বের করে আনল এশার শরীর থেকে!
এশা ছিটকে গিয়ে কাঁপতে লাগে।
সে ভয়ে কাঁপছে না, কাঁপছে আতঙ্কে! এহসান যদি সত্যিই মেহরাজকে মেরে ফেলে?!
সে জানে, মেহরাজ খারাপ নয়, মেহরাজ এসব করেছে নিজের বোনের জন্য, শুধু মেহনূরের জন্য! সে জানে, মেহনূরের দুই ভাই নিজেদের বোনের জন্য কতটা পাগল, কতটা উন্মাদ হতে পারে!
এহসান রাগের জ্বালায় অগ্নিশর্মা হয়ে আছে!
সে এক ঝটকায় মেহরাজকে ছিটকে সরিয়ে দিল, তারপর এশার দিকে তাকিয়ে দেখে—তার গায়ে ওড়না নেই!
তার রাগ তখন চরমে পৌঁছে যায়!
নিজের শরীর থেকে চাদর খুলে এক ঝটকায় এশার গায়ে জড়িয়ে নেয়।
তারপর রক্তাভ চোখে মেহরাজের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠে বলে—
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—-“তুই আমার কলিজায় হাত দিয়েছিস! এই সাহস পেলি কোথা থেকে?!”
এবার আর সহ্য করতে পারল না এহসান “! মেহরাজের দিকে তেড়ে যেতে নিল, কিন্তু ঠিক তখনই এশা পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে তার কোমর জড়িয়ে ধরে!
এশা বিছানায় বসে কাঁদতে কাঁদতে নিজের শেষ শক্তি দিয়ে এহসানের কোমর জড়িয়ে ধরে।বলে
—-“ভাইজান, আল্লাহর ওয়াস্তে ওকে ছেড়ে দাও! ও খারাপ কিছু করেনি! নিজের বোনের জন্যই এসব করেছে! দয়া করে এমন কিছু করো না, যাতে তোমার মেহনূর তোমায় চিরকাল ঘৃণা করে!”
মেহরাজ বিস্মিত হয়ে গেল!
এই মেয়ে… এটা কী বলছে?!
সে কি সত্যিই তার জন্য প্রাণপণ আকুতি জানাচ্ছে?!
এহসানও থমকে গেল, কিন্তু এত সহজে শান্ত হওয়ার মানুষ সে নয়।
সে এশার হাত সরিয়ে দিয়ে বিছানায় বসে এশার সামনে, তারপর এশার মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে গভীর, আদুরে গলায় বলল—
—-“কাদিস না… তোর ভাইজান এখনো বেঁচে আছে! বল, তোর সাথে কিছু খারাপ করেছে? বল, তোর ভাইজান আছে তোর জন্য!”
এহসান এশার গাল থেকে অশ্রু মুছে দিতে দিতে বলল—
—–“কাঁদবি না! কেঁদে নিজেকে দুর্বল করবি না! তুই এহসান তালুকদারের বোন—ভেঙে পড়া তোর জন্য নয়! প্রয়োজনে তুই নিজে ওকে কুপাবি, আমার বদলে!”
এ কথা শুনেই এশা আঁতকে উঠে!
সে এহসানের দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়িয়ে বলে।
+—–“না ভাইজান! ওকে তুমি মারবে না! ও কিছু করেনি আমার সাথে! আমি… আমি ওর সাথেই থাকব!”
এবার এহসান ক্রোধে জ্বলতে জ্বলতে মেহরাজের দিকে তাকিয়ে বলল
—-“তুই কি ভয় দেখিয়েছিস আমার বোনকে? বল!”
মেহরাজ তার চোখ ছোট করে তাকিয়ে বলল—
“—-ভয়? আর তোমার বোন? অসম্ভব কথা বলছো, এহসান তালুকদার!”
এহসান গর্জে উঠে!
সে তেড়ে গেল মেহরাজের দিকে, কিন্তু এশা আর সহ্য করতে পারল না।
সে চিৎকার করে উঠে বলে—
—-“ভাইজান! ও তোমার মেহনূরের একমাত্র আপন! তুমি যদি ওকে মেরে ফেলো, তবে তোমার মেহনূর তোমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না!”
এই কথায় থমকে গেলো এহসান। কিন্তু তবুও সে কঠিন গলায় বলল,
— “আমার নারীর আপন শুধু আমি! এর মরাতে কিছু যায় আসে না!”
পরপর কয়েকটা চড় বসিয়ে দিলো মেহরাজের গালে! কিন্তু মেহরাজ একটাও ফিরিয়ে দিলো না!
এহসান যখন ঘুষি মারতে গেলো, তখনই মেহরাজ ঠোঁটের রক্ত মুছে বলে উঠে
—-“এহসান তালুকদার! যদি আমার কিছু হয়, তবে তোর বোন সারাজীবন কলঙ্কিত হয়ে থাকবে!”
এই কথা শুনেই এহসান আর সহ্য করতে পারল না।
সে এত জোরে ঘুষি মারল যে মেহরাজের ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরতে লাগল!
এশা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গিয়ে এহসানের বাহু চেপে ধরে বলে।
—-“ভাইজান, দয়া করে ছেড়ে দাও! দয়া করে!”
মেহরাজ নিজের ঠোঁটের রক্ত মুছে নিল নিজের বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে , তারপর এক ঝটকায় এশাকে নিজের বাহুর মধ্যে নিয়ে বলল—
—–“এত নাটক কেন করছিস, এহসান তালুকদার?! তুই আমার বোনকে জোর করে বিয়ে করেছিস, আমিও তোর বোনকে জোর করে বিয়ে করেছি! এবার তুই নিজের বোনকে চাইলে, আমার বোনকে আমায় দিয়ে দে!”
এহসান গর্জে উঠে বলে—
—-“নয়তো কী?! কোন বাল ছিঁড়বি তুই?!”
মেহরাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল—
—–“তোর বোন যখন অজ্ঞান ছিল, তখন আমি ওর সুন্দর কিছু ছবি তুলেছি… সেগুলো এমন জায়গায় রাখা, যেখানে দু’দিনের মধ্যে না ঢুকলে সব পাবলিক হয়ে যাবে! এবার বুঝ!”
এহসান চিৎকার করে উঠে বলে—
—–“হাসিব! নিয়ে আয়!”
হাসিব কক্ষের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল এহসানের আদেশ শুনেই কয়েকজন মেয়ে গার্ডদের ইশারা করে “! সে নিজে যেতে পারবে না সে কক্ষে এশা আছে “!
মুহূর্তের মধ্যে কয়েকজন মহিলা গার্ড কক্ষে প্রবেশ করে।
মেহরাজ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা তাকে একপ্রকার শূন্যে ধরে নিয়ে কক্ষে রাখে চেয়ারে বসিয়ে লোহার তার দিয়ে বেঁধে ফেলল!
এশা স্পষ্ট দেখতে পেল—তার চোখের সামনে মেহরাজের মৃত্যু লেখা হয়ে গেছে!
এহসানের হাতে একখানা ছুরি একজন এগিয়ে তুলে দিল এহসান তা হাতে নিয়ে।
রক্তচক্ষু নিয়ে বলল—
“—-এবার তোর দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার পালা!”
এবলে এহসান মেহরাজ এর দিকে এগোতে থাকে
এশা জানে—আজ যদি এহসান মেহরাজকে মেরে ফেলে, তবে সব শেষ হয়ে যাবে।
মেহনূর কখনোই এহসানকে ক্ষমা করবে না, আর সে নিজের জীবনে আবারও দ্বিতীয় পুরুষের স্পর্শ পাবে। দুই পরিবারের রক্তাক্ত খেলা শুরু হবে, বিশ্রীভাবে একজন আরেকজনকে মারবে, শেষ করে দেবে!
সবকিছু ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।
এশাকে যেকোনো মূল্যে এহসানকে বুঝাতে হবে, তাকে থামাতে হবে।
প্রয়োজনে সারাজীবন মেহরাজের সঙ্গে থাকতে হলেও সে রাজি!
তবু আজ এহসানকে এই ভুল করতে দেবে না!
এশা এক মুহূর্তও দেরি না করে সোজা এহসানের পা জড়িয়ে ধরল।
গভীর আর্তনাদে কেঁপে উঠল পুরো কক্ষ।
—-“ভাইজান! ওকে মেরো না! আল্লাহর ওয়াস্তে তোমার বোনকে বিধবা কোরো না! ভাইজান, আমি ওকে মাফ করে দিয়েছি, মন থেকে মাফ করে দিয়েছি! আমি চাই না আমার জীবনে দ্বিতীয় পুরুষ আসুক! প্রয়োজনে সারাজীবন ওর সাথেই থাকব, তবু ওকে ছেড়ে দাও!”
এশার কান্নায় কক্ষের পরিবেশ যেন ভারী হয়ে উঠে।
এহসান স্থির দাঁড়িয়ে থাকল, একটুও নড়ে না।
কোন ভাই তার বোনের এমন আর্তনাদ উপেক্ষা করতে পারে?
সে পারে না।সে পারছে না!
তার রক্তাক্ত রাগের ঢেউ ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে লাগে।
এহসান ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসে এশাকে টেনে তুলল, শক্ত করে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরল।
তারপর রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকাল মেহরাজের দিকে।
একটা দহন, একটা তীক্ষ্ণ বিদ্বেষ, একটা প্রগাঢ় হুমকি—তার দৃষ্টিতে সব ফুটে উঠল।
—-“তুই কি চাস, বোন? স্পষ্ট করে বল! তোর যা চাওয়া, তাই হবে! তোর সিদ্ধান্তই শেষ সিদ্ধান্ত!”
এশা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলে।
“—আমি চাই… তুমি ওকে ছেড়ে দাও!”
এহসান তিক্ত গলায় হেসে উঠল।
—-“ও তোকে দেখে নিয়েছে, খারাপভাবে! তবুও ওকে ছেড়ে দিলে আমি শান্তিতে বাঁচব না!”
এশা এবার শক্ত হলো।
সে জানে, আজ যদি সে নিজেকে দুর্বল দেখায়, তবে কিছুই রক্ষা করা যাবে না!
গভীর শ্বাস নিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলে—
—-“আমায় হালালভাবে দেখেছে, তাই এটা খারাপ হবে না, ভাইজান! আমি ওর স্ত্রী… আমার ওপর ওর অধিকার থাকতে পারে, তাই না?”
এহসান থমকে গেল।
তার ছোট্ট বোন, যার চোখের পানিও সে সহ্য করতে পারে না, সে আজ এমন কথা বলছে!
সে এশার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলে—
—“তুই সত্যিই ওকে স্বামী মানছিস?”
এশা জানে, সে মিথ্যে বলছে, কিন্তু আজ এই মিথ্যেই সত্য হয়ে যাবে যদি তা জীবন বাঁচাতে পারে!
সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল—
“—–হ্যাঁ ভাইজান, আমি ওকে স্বামী মানি! বিশ্বাস করো, আমার অনুমতি ছাড়া ও আমায় ছোঁয়নি! আমি অনুমতি দিয়েছি বলেই ছুঁয়েছে… দয়া করে ওকে মেরো না!”
এহসানের চোখমুখ কঠিন হলো।
রাগের সাগরে একফোঁটা শান্তির জোয়ার বইল যেন।
অন্যদিকে, মেহরাজ স্তব্ধ হয়ে এশা কে দেখছে !
একজন নারী চাইলে ছলনা করে কাউকে চিরতরে ধ্বংস করে দিতে পারে।
আবার সেই একই নারী চাইলে ছলনা করে কাউকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতেও পারে।
এশা আজ সেটা প্রমাণ করল!এশার প্রতিটি কথা মেহরাজের মনে বাজছে।
তার নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে!
এশার মতো একটা মেয়েকে সে এত কুৎসিতভাবে ফাঁসিয়েছে!
কী করে পারল?!কী করে এতটা নিচে নেমে গিয়েছিল সে?!
এহসান এবার মেহরাজের দিকে তাকাল।
তার চোখে আগুন, তার দৃষ্টিতে হুমকি, কিন্তু তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তারই বোন।
এহসান রক্তচক্ষু নিয়ে মেহরাজের দিকে তাকিয়ে বলে—
“—কী রে কাপুরুষের বাচ্চা? পারবি তো আমার বোনকে সুখে রাখতে?”
মেহরাজ চমকে উঠল।
কিন্তু নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে আগের মতোই গম্ভীর কণ্ঠে বলল—
—-“তোমার বোনকে সামলানোর ক্ষমতা আমার আছে। তাই নিশ্চিন্তে ওকে আমার হাতে তুলে দাও!”
এহসান গভীর শ্বাস নিল।
তার মুখে কিছুই বলা ছিল না, কিন্তু তার দৃষ্টি একটাই কথা বলছিল—
—-“যদি একটুও কষ্ট দিস, তবে তোকে শেষ করে দেব!”
মেহরাজ চুপচাপ বসে থাকে।
এশা এহসানের বুক থেকে মাথা তুলে এক পলক তাকায় একবার এহসানের দিকে, একবার মেহরাজের দিকে।
তার হৃদয় তখনো কাঁপছে, কিন্তু অন্তত আজকার দিন শেষ হলো রক্তপাত ছাড়া!
এই মুহূর্তে এটুকুই তার বিজয়!
এহসান এশাকে ছেড়ে দিয়ে কঠোর স্বরে বলল—
“—–যা, তৈরি হয়ে নে। বাড়ি যাব। আব্বার অনুমতি নিয়ে তোর আবার বিয়ে দেব!”
তারপর মেহরাজের দিকে ফিরে তাচ্ছিল্যের হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলল—
—-“কাপুরুষের বাচ্চা, তুইও প্রস্তুত হয়ে যা নিজের দায়িত্বের জন্য!”
এ বলেই এহসান নারী গার্ডদের ইশারা করল, তারা এসে কক্ষের পাহারা নিল।
এহসানের শরীর তখনো রাগে জ্বলছে।
মন চাচ্ছিল মেহরাজকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে!
কিন্তু আফসোস, জীবনের প্রথম ভুল করেও কেউ বেঁচে গেল!
এহসান বেরিয়ে যেতেই এশা ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল, হাঁপাতে লাগল।
কত মিথ্যা বলেছে!শুধু পরিস্থিতি ঠিক রাখার জন্য!
“ছিঃ ছিঃ!”
কিন্তু সবই হয়েছে আল্লাহর হুকুমে!
ধীর পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে এশা এগিয়ে এসে মেহরাজের বাঁধন খুলে দিল।
তারপর চোখের পানি মুছে ঠান্ডা স্বরে বলল—
“—-আল্লাহর হুকুমে বেঁচে গেলি রে কাপুরুষ! নয়তো এখন উপরে থাকতি!”
এশা কোনো দিকে না তাকিয়ে কক্ষের ওয়াশরুমের দিকে এগোতেই নিল।
কিন্তু…
মেহরাজ ছাড়া পেয়েই হুট করে এশার হাত ধরে টেনে নিয়ে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল!
এশা হতভম্ব হয়ে গেল!তার শরীর কাঁপছে!
মনে হচ্ছিল—সব শেষ হয়ে যাচ্ছে!
মেহরাজ তার কোমর শক্ত করে ধরে এশার মুখের সামনে তাকিয়ে বলল—
—-“সংসার করবে আমার সাথে? সারাজীবন থাকবে এই কলঙ্কিত সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে?”
এশার ভেতরে যেন দপ করে আগুন জ্বলে উঠল!
সে দাঁত পিষে বলল—
—-“তোকে শুধু বাঁচানোর জন্য এসব আবোল-তাবোল বকেছি! নয়তো তোর মতো নিচ মানুষকে নিজের নামের সাথে জুড়তে চাইনি আমি!”
মেহরাজ তার হাতের বাঁধন আরও শক্ত করে নিল।
চোখ গভীর, স্থির, দৃঢ় এনে বলল
—-“তাহলে বাঁচালে কেনো? মরতে দিতে পারতে তোমার ভাইয়ের হাতে!”
এশা দাঁত চেপে বলে—
“—;তুই মেহনূরের ভাই বলে! নয়তো সত্যি বলছি, নিজ হাতে তোকে কোপাতাম!”
মেহরাজ হালকা হেসে উঠে
তবে ঠোঁট ফাটা থাকার কারণে সেই হাসিটা ঠিক জমল না!
এশার চোখের কোনে লেপ্টে তাকা পানি মুছে দিতে দিতে বলে।
মৃদু স্বরে বলল—
—তোমার হাতে একবার নয়, বারবার কোপ খেতেও রাজি, প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী!”
এশা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল—
;—–“মেহরাজ, ভালো চাস তো ছেড়ে দে! এভাবে ধরেছিস কেনো? বুঝতে পারছিস না, কষ্ট হচ্ছে!”
মেহরাজ ধীরে ধীরে তার বাঁধন শিথিল করে।
তারপর ঠোঁট কামড়ে কৌতুকভরা কণ্ঠে বলল—
—-“ইসস! যদি ঠোঁটখানা ফাটা না থাকতো, তাহলে আমি এখন অন্য জগতে থাকতাম!”
এশা রাগে গজগজ করতে করতে বলল—
—-“ঠোঁটসহ গালও ফাটবে এখন! আর যদি একটা কথা বলেছিস তো!” মরনের ভয় করে না তোর? এই তো মরতে মরতে বেঁচেছিস
মেহরাজ তাচ্ছিল্য করে বলে
— যখন তোমায় নিজের করার নিয়ত করেছি তখন থেকেই মরেনর ভয় ভুলে গেছি “!
এশা আর কিছু বলে না মেহরাজ কে ধাক্কা দিয়ে সে দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেল!
এশা বোরকা পরে তৈরি হয়ে এসে দেখল, এহসান কক্ষে বসে অপেক্ষা করছে।
তার পাশে মেহরাজ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে, মুখ শক্ত, ভাবলেশহীন।
কোনো কথা নেই, কোনো অনুভূতি নেই ছয়শুধু অপেক্ষা।
এশা বেরিয়ে আসতেই এহসান এক পলক তার দিকে তাকাল, তারপর ঠান্ডা গলায় বলল—
“চলো।”
তারপর দুজনকে নিয়ে রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে পড়ল।
গন্তব্য—তালুকদার বাড়ি!
সেখানে ছোট তালুকদারকেও এনে বসিয়ে রাখা হয়েছে!
এই রাতের আগুন নেভানোর জন্য নতুন ঝড় অপেক্ষা করছে!
ঘরের এক কোণে জায়নামাজে বসে আছে মেহনূর।
তার সাদা কামিজ এখন চোখের পানিতে ভিজে প্রায় ধূসর হয়ে গেছে।
তার দু’হাত কাঁপছে, বুক ধকধক করছে।
—-“হে আল্লাহ! আমার ভাইজানকে বাঁচিয়ে দাও! আমার ভাইজানকে তুমি হেফাজত করো!”
বারবার, একের পর এক সালাতুল হাজত এর নামাজ আদায় করছে সে।
প্রতি রাকাতে, প্রতি সিজদায়, গলে-পড়া পানির মতো গলছে তার দোয়া!
কান্না করতে করতে মিলিয়ে যাচ্ছে সে।আখিরা যেন সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে!
আর কাঁদবেই বা না কেনো?
সে তো জানে—
এহসান কতটা অমানুষ হতে পারে!
একটা সামান্য কথার জন্য রাসেলের জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিল!
তাহলে ভাইজানের জন্য কী করবে?”
শরীর শিউরে উঠল মেহনূরের!সে কাঁপতে কাঁপতে ভেতর থেকে গুটিয়ে গেল!ভাইজান কি আর বাঁচবে?
নাকি এবারও তাকে একটা লাশের দেখা পেতে হবে?
শরীরে আর রক্ত নেই, প্রাণ নেই, তবু সে হাত তুলে মোনাজাত শুরু করল—
—-“হে আল্লাহ! আমি পাপী হতে পারি, কিন্তু তুমি তো দয়ালু! তুমি আমার ভাইজানকে রক্ষা করো! যদি সত্যিই তার জন্য এহসানের হাত উঠে তো তুমি এহসানের মনে মায়া দয়া জন্মাও”!
মেহনূরের কান্না থামে না!
—-“হে রব! তুমি আমার ভাইজান এর গুনাহ মাফ করে দাও! তুমি তাকে ক্ষমা করো! সে যদি অন্যায় করেও থাকে, তবে তুমি তার প্রতি দয়া করো!”
মোনাজাত করতে করতে তার পুরো শরীর একরকম অসাড় হয়ে যাচ্ছে মেহনূরের !
তার ভাইজান এর এই বোকামি কি নিয়ে আসবে?নাকি আরও অন্ধকার নামবে তার নিজের জীবনে?
তালুকদার বাড়িতে
তালুকদার বাড়ির বিশাল ড্রইংরুমে বসে আছেন পরিবারের সকল অভিভাবক।
সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছেন মনিরুল সাহেব, মুস্তফা সাহেব, এমরান, এনাম, তৌফিক তালুকদার, তাজিম তালুকদার, মাজহারুল সাহেব, আর এহসান।
ঘরজুড়ে একটা থমথমে পরিবেশ।
কেউ উচ্চস্বরে কথা বলছে না, কিন্তু প্রতিটি শব্দই যেন ভারী পাথরের মতো আছড়ে পড়ছে চারপাশে।
সব শুনে প্রথম মুখ খুললেন মুস্তফা সাহেব।
— “আমার নাতি যেহেতু বিয়ে করেই ফেলেছে, আর এশাও তাকে মেনে নিয়েছে, তাহলে এতে আর সমস্যা থাকার কথা নয়।”
তার কথায় কেউ দ্বিমত করল না, তবে এহসানের বাবা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— “সমস্যা থাকার কথা না তো বুঝলাম, কিন্তু তোমার নাতি কি আমার মেয়েকে সুখে রাখতে পারবে? তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে পারবে?”
এবার মুখ খুললেন মাজহারুল সাহেব।।
— “কেন পারবে না? আপনি তো জানেন, আমরা তালুকদাররা যতটা হিংস্র হই না কেন, নিজেদের অর্ধাঙ্গিনীর ক্ষেত্রে ততটাই কোমল। আর মেহরাজ তো তালুকদার বাড়িরই অংশ।”
সবাই চুপচাপ শুনছিল, তখনই এমরান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— “আমার বোন যদি অশান্তিতে থাকে?”
মুস্তফা সাহেব দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
— “আজ অব্দি কোনো নারী তালুকদার বাড়ির স্ত্রী হয়ে অশান্তিতে ছিল না। আর এশার জন্য যদি আলাদা কিছু হয়, তবে আমি কথা দিচ্ছি, এশা মেহরাজের স্ত্রী হয়ে সারাজীবন শান্তিতেই থাকবে, যদি আল্লাহর হুকুম হয়, ইনশাআল্লাহ।”
সবাই একটু নড়েচড়ে বসল।
এবার মনিরুল সাহেব বললেন,
— “তাহলে আর দেরি কেন? আবার বিয়ের ব্যবস্থা হোক।”
প্রথম থেকে নীরব এহসান এবার মুখ খুলল।
তার কণ্ঠে ছিল কঠিন শীতলতা।
— “কাজি রেডি আছে। তাই দেরি না করে তাড়াতাড়ি বিয়ে পড়ানো হোক।”
সবাই একে একে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।
কিন্তু এই পুরো সময় একজন কিছু বলছিল না—মেহরাজ!
সে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল।
কোনো প্রতিবাদ নেই, কোনো উচ্ছ্বাস নেই।
শুধু যেন একটা বোবা প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সময়ের সামনে।
অন্যদিকে…
এশা নিজের ঘরে বসে আছে।
চারপাশে ব্যস্ততা চলছে, কিন্তু সে যেন সব অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছে।
আমেনা বেগম, আয়েশা বেগম কাঁদতে কাঁদতে তার লাগেজ গুছিয়ে দিচ্ছেন।
একটা একটা করে শাড়ি, গহনা, ছোট ছোট স্মৃতির টুকরো ভরে দিচ্ছেন ব্যাগে।
কিন্তু তাদের চোখের পানি কিছুতেই বাঁধ মানছে না!
“কীভাবে এমন হলো? এত হুট করে! তাদের প্রিয় বোনটা এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে?”
এনিসা বেগমও নিজের ঘোমটা দিয়ে মুখ চাপা দিয়ে বসে আছেন।
তার কলিজার টুকরো মেয়ে আজ এভাবে চলে যাবে? তাও এভাবে “!
কী করে সহ্য করবেন তিনি?কিন্তু এশা?সে তো কিছু বলছে না!
সে তো একদম পাথর হয়ে গেছে!
সে কারও দিকে তাকাচ্ছে না।তার নিজেরই তো অভিযোগ করার সুযোগ নেই!
সে নিজেই তো সব মেনে নিয়েছে, নিজের হাতেই সব শেষ করে দিয়েছে!
এই জীবন সে কীভাবে কাটাবে?
নতুন জীবনের পথে পা রাখার আগেই কেন যেন মনে হচ্ছে সব কিছু শেষ হয়ে গেছে!
কোনো অভিযোগ করার রাস্তাও রাখেনি নিজ হাতে সব গুছিয়ে নিয়েছে!
নূরি নিজের কক্ষে ব্যস্ত, কিন্তু হঠাৎ ওর ভাই সামি এসে খবর দেয়—
— “ছোট আপ্পি! ছোট ভাইজান বলছে, উনার জন্য লুঙ্গি টিশার্ট আর মিসওয়াক নিয়ে যেতে পুকুরে!”
এ কথা বলেই সে ছোট্ট পায়ের তাল দিয়ে দৌড়ে চলে যায়, যেন ওর কাজ শেষ।
নূরির বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। এদিকে চারপাশে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে—সবাই জেনে গেছে, এশাকে মেহরাজ বিয়ে করে নিয়েছে। এ নিয়ে ঘরের বাতাসও যেন ভারী হয়ে উঠেছে। চিন্তার ভারে দম বন্ধ হয়ে আসছে নূরির। এবার কার রক্তে কে গোসল করবে? কে জানে!
তবে জনাবের আদেশ তো আদেশই! নূরি একটুও বিরক্ত নয়। ধীর পায়ে নিজ কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। মেহরুবের কক্ষে প্রবেশ করে, একখানা লুঙ্গি একটা টিশার্ট আর মিসওয়াক হাতে নেয়, তারপর পুকুরঘাটের উদ্দেশ্য পা বাড়ায়।
পুকুরঘাটে এসে দেখে, মেহরুব বৈঠকখানায় বসে আছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন পুকুরের স্থির জলে। মনে হচ্ছে কোনো গভীর চিন্তায় নিমগ্ন।
নূরি সামনের দিকে গিয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর, মাটির দিকে দৃষ্টি নামিয়ে নরম স্বরে বলে—
— “এই নিন ভাইজান…”
তবে সে মেহরুবের দিকে তাকায় না। কেননা, মেহরুবের গায়ে তখন কেবল লুঙ্গি! যদিও এ দৃশ্য সে আগেও দেখেছে, তবু কেন যেন আজও লজ্জার শিহরণ বয়ে যায় সারা শরীরে।
মেহরুব হাত বাড়িয়ে মিসওয়াক নিয়ে নেয়। তবে টিশার্ট আর লুঙ্গির জন্য বলে—
— “এগুলো তোর কাছেই রাখ।”
নূরি বিস্মিত হয়। মুখ তোলে তাকায় মেহরুবের দিকে।আর বলে
— “এখানে রেখে যাই?”
মেহরুব দাঁড়িয়ে গিয়ে নরম কণ্ঠে বলে—
— “কেন চলে যাবি? বস, আমি গোসল সেরে নিই।”
নূরি অবাক হয়, কিন্তু কিছু বলে না। সুযোগ তো পাওয়া গেল—একমনে মেহরুবকে দেখার! তাই মাথা নাড়িয়ে বলে—
— “আচ্ছা, আপনি গোসল করে নিন। আমি আপনার কাপড় ধুয়ে নিয়ে যাব।”
মেহরুব মৃদু হেসে বলে—
— “তুই শুধু বসলেই হবে।”
নূরি নিজের হাতে থাকা নিজের প্রিয় পুরুষ এর টিশার্ট আর লুঙ্গিখানা কোলে নিয়ে বৈঠকখানায় বসে পড়ে। মেহরুব তখন পুকুরের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। মিসওয়াক করতে করতে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে।
নূরি তখন নিজের মাহরামকে একদৃষ্টিতে দেখছে। কী এক অদ্ভুত প্রশান্তি কাজ করছে ভেতরে! হঠাৎই সে প্রশ্ন করে—
— “আচ্ছা মেহরুব ভাই, ভাইজান কি সত্যি এশা ফুফুর সঙ্গে সংসার করবে?”
মেহরুব গায়ে সাবান মাখতে মাখতে তাকায় নূরির দিকে।
— “অবশ্যই করবে, কেন করবে না?”
নূরি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
— “না মানে, সে তো বদলা নিতে বিয়ে করেছে… তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
মেহরুব মুচকি হেসে বলে—
— “বিয়ে যার কারণেই হোক না কেন, এখন এশা ভাইজানের বেগম। আর তালুকদার বংশের মেয়েরা সব সংসারি।”
নূরি মনে মনে ভাবে, ‘যদি আমিও মেহরুব ভাইয়ের স্ত্রী হতে পারতাম… যদি আমিও মুত্তাকী জীবন গড়তে পারতাম ওর সঙ্গে…’
কিন্তু সে কিছুই বলে না।
নূরি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে—
— “আচ্ছা, মেহরুব ভাই, একটা কথা বলি? রাগ করবেন না তো?”
মেহরুব তখন সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে উপরে তাকায়। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে নূরির দিকে।
— “বল।”
নূরি একটু হাসে। তারপর বলে—
— “ভাইজান তো বেগমের অধিকারী হয়ে গেলেন… আপনি কি বিয়ে করবেন না?”
মেহরুব মৃদু হাসে।
— “ভাইজানের আগে আমি বিয়ে করেছি, আমি বেগমের অধিকারীও হয়েছি। আমার বেগম আমার সামনেই বসে আছে।”
নূরি বিস্ময়ে হা করে তাকিয়ে থাকে!
সে? সে-ই কি মেহরুবের বেগম?
এই কথায় তার বুকের ভেতর যেন এক ঝলক সুখের বাতাস বইতে শুরু করে। চুপচাপ বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মুচকি হেসে নেয় এক গভীর শ্বাস।
মেহরুব পুকুরে ডুব দিয়ে ওঠে। নূরি দ্রুত কয়েক ধাপ নেমে তার দিকে লুঙ্গি এগিয়ে দেয়।
মেহরুব চুলের পানি ঝেড়ে ফেলে, আর সেই পানি এসে পড়ে নূরির মুখে।
নূরি চোখ বন্ধ করে ফেলে সাথে সাথে আর মুখ কুঁচকে বলে
— “মেহরুব ভাই! দেখে চুল ঝারুন!”
মেহরুব নূরির বাচ্চাদের মতো মুখ বানানো দেখে মৃদু হাসে। তারপর হাত বাড়িয়ে লুঙ্গি নিয়ে পড়ে নেয়। নূরি তখনও চোখ বুঁজে রাখে, যতক্ষণ না নিশ্চিত হয় যে মেহরুব কাপড় পরে নিয়েছে।
মেহরুব লুঙ্গি পড়ে বলে
— “টিশার্ট টা দে।”
নূরি এগিয়ে দিতে গিয়েও থেমে যায়। মেহরুবের চুল তখনো ভেজা। সে যদি এখন টিশার্ট পড়ে, তাহলে সেটাও ভিজে যাবে। নূরি বিরক্তি নিয়ে বলে—
— “মেহরুব ভাই, আপনি এমন করেন সবসময়। চুল ভেজা রাখেন, আর তাই কাশি লেগে থাকে!”
এ বলে সে নিজের ওড়নার এক পাশ এগিয়ে দিয়ে বলে।
— “নিন, মাথা মুছে নিন। তারপর টিশার্ট পড়ুন।”
মেহরুব এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর মাথা নিচু করে নেয় নূরির ওড়না। ধীরে ধীরে মাথা মুছে নেয়।
নূরির হাত-পা কাঁপছে। নিজের মাহরাম এতটা কাছে! কিন্তু সে স্থির থাকার চেষ্টা করে।
মেহরুবের হাতে টিশার্ট টা দিয়ে নূরি মেহরুবের কাপড় গুলো ধুয়ে নেয় “! মেহরুব কাপড় পড়ে এক দূষ্টিতে তাকিয়ে নূরি কে দেখতে থাকে ‘!
তারপর নিজেও একটু নেমে ওযু করে নেয় “! নূরি কাপড় ধুয়ে উঠে যাবে তখন মেহরুব বলে
— “ওযু করবি না? মাগরিবের আযান হয়ে যাচ্ছে!”
— “হুম, মিসওয়াক নিয়ে আসি ঘর থেকে।”
মেহরুব তখন তার নিজের মিসওয়াকটা দেখিয়ে বলে—
— “আমারটা দিয়ে কর, অসুবিধে নেই।”
নূরি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। এ কী! নিজের মিসওয়াক পর্যন্ত ওকে দিয়ে দিচ্ছে! কি হয়েছে তার মেহরুব ভাই এর এমন করছে কেনো
নূরি কে চুপ থাকতে দেখে মেহরুব বলে
— “কি রে, করবি না?”
নূরি নিজের ধ্যান থেকে বেরিয়ে আসে বলে
—– হ্যা হ্যা করব কেনো করব না
এ বলে মেহরুব এর হাতে তার ধুয়া কাপড় গুলো দিয়ে “! সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়
নূরি কোনো দ্বিধা ছাড়াই নেয় মেহরুবের মিসওয়াক নিজের মুখে তুলে নেয়।
এবার ওযুর জন্য প্রস্তুত হয় সে। আর মেহরুব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
কেন জানি আজকাল এই মেয়েটার সঙ্গে সময় কাটাতে তার ভীষণ ভালো লাগে…! একদিন এ মুখ না দেখলে বুকের ভেতরটা শূন্য শূন্য লাগে…
এশার পর🌙🌔
এশা আর মেহরাজের দ্বিতীয় বারের মতো বিয়ে হয়ে গেছে। এখন সে ছোট তালুকদার বাড়ির নববধূ, মেহরাজের কক্ষে বসে আছে নিঃশব্দে।
এদিকে, সবাই মেহনূরকে দেখতে চায়, কিন্তু এহসান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে—
“যেদিন তোমাদের মেয়ে আমায় মেনে নেবে, সেদিনই তোমরা ওর সাক্ষাৎ পাবে। আর তোমাদের মেয়ে তো আমার হাতে তুলে দিয়েছো, এখন কোনো ক্যাচাল পাকিয়ো না।”
মেহনূরের অবস্থা শোচনীয়। কী করবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
সারাদিন জায়নামাজে বসে কেঁদেছে। কান্নায় ভিজেছে তার সাদা ওড়না, ভিজেছে জায়নামাজের প্রান্তও। নামাজ শেষে যখনো শান্তি পেল না, তখন চুপচাপ ছাদে চলে এসেছে।
এই ছাদটা খুব ছোট। একদিকে দেয়াল ভাঙা, অন্যদিকে পুরনো গাছের শেওড়া এসে ঢেকে রেখেছে ছাদের এক কোণ। শীতল বাতাসে পাতাগুলো নড়ে, ফিসফিস করে যেন কিছু বলতে চায়। তবুও, এই ছাদটা তার খুব প্রিয়।
মেহনূর ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে—
“আল্লাহ, আপনি আমার ভাইজানকে রক্ষা করুন… রক্ষা করুন…”
এশাকে বিদায় দিয়ে নিজের নারীর খোঁজে রওনা হয় সে।
সে জানে, মেহনূর নিশ্চয়ই নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে চিন্তায়। মেয়েটার কোমল হৃদয়, সব কষ্ট নিজের মাঝে চেপে রাখে, আর কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে যায় “! এ মেয়ে কাঁদলে যে তার ভেতরটিও কেঁদে উঠে”!
সকাল বেলা এহসানের ঘুম ভাঙ্গার পর রান্নাঘরে যায় গিয়ে দেখে মেহনূর কাঁপছে ঠোঁট মুখ শুকিয়ে আসছে ওর “!
হঠাৎ এমন অবস্থা মেহনূর কে দেখে সে জিজ্ঞেস করেছিল
— “কি হয়েছে এমন করছিস কেন?”
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মেহনূর সরে যেতে চাইল এহসানের এমন কথায়, কিন্তু শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটিকে উপেক্ষা করা এত সহজ নয়। তার ঠোঁট কাঁপছিল, গলার স্বর ভেঙে আসছে মেহনূর ভয়ের তাড়নায় বলে ফেলে—
— “আ…আপনি… আমার ভাইজান কে কিছু করবেন না! এশা কে ভাইজান বিয়ে করে নিয়েছে…!”
এহসান কোনো উত্তর দিল না। চোখ সরু করে শুধু মেহনূরের দিকে তাকিয়ে থাকল, যেন ওর প্রতিটি অনুভূতি বিশ্লেষণ করছে। ঠিক তখনই তার ফোন বেজে উঠল। মেহনূর নিজের হাতে থাকা এহসানের ফোন কাঁপা হাতে ওর দিকে এগিয়ে দিল “! এহসান কিছু টা অবাক হয়ে ফোনটা হাতে নেয়”! ফোন হাতে নিয়েই সে দেখতে পায়
— “জয়নাল!” ফোন দিয়েছে
ফোন কানে দিতেই ওপাশ থেকে জয়নাল একনাগাড়ে সব বলে গেল— মেহরাজ কিভাবে এশাকে তুলে নিয়ে গেছে, কোন রিসোর্টে উঠেছে, কি পরিকল্পনা করছে সব!
এহসানের চোখে আগুন জ্বলে উঠে সাথে সাথে । সে এক মুহূর্তও দেরি করে না। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বিছানা থেকে
নিজের গাঢ় কালো চাদরখানা জড়িয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ল…! উদ্দেশ্য সেই রিসোর্ট
এরপর থেকেই মেহনূরের এমন অবস্থা তার মাথায় একটা কথাই আসছে এহসান বাচিয়ে রাখবে তো তার ভাইজান কে”!
—
বাগানবাড়ির গেট খুলে ঢুকে এহসান প্রথমেই পুকুরের দিকে তাকায়। বুক ধক করে উঠল।
— “মেহনূর এখানে নেই?”
সাধারণত পুকুরপাড়ে বসে থাকাই ছিল ওর অভ্যাস। কিন্তু আজ কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অস্থিরতা গ্রাস করল এহসানকে।
সে দ্রুত ঘরে ঢুকে পড়ল। শূন্য বিছানা, নিস্তব্ধ পরিবেশ। বাথরুম, রান্নাঘর—সব জায়গায় খুঁজে দেখল, কিন্তু মেহনূর নেই!
এহসানের কপালে ঘাম জমে উঠে। গলার ভেতর শুষ্ক হয়ে আসছে, ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। পা বাড়াল ছাঁদের দিকে।
সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই একটা মিষ্টি, কান্না মাখা সুর কানে এলো। যেন কারও গভীর আবেগ মিশে আছে সেই সুরে।
—-নাশিদ
এহসান থমকে দাঁড়ায়। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক প্রশান্তি নেমে এলো। আলতো পায়ে ছাঁদে উঠতেই স্পষ্ট দেখতে পেল—
মেহনূর শেওড়া গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ বন্ধ, গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, আর সে নাশিদ গাইছে।
এহসান ধীরে ধীরে সামনে এসে দাঁড়ায়। গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকাল ওর দিকে। তারপর হালকা শ্বাস ফেলে বলল—
— “তুমি এখানে?”
মেহনূর চমকে উঠে
শরীর কেঁপে উঠল ভয়ে। মনে হলো, এই বুঝি প্রাণ বেরিয়ে যাবে!
ধীরে ধীরে কাঁপতে কাঁপতে এহসানের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। চোখদুটো রক্তলাল, কাঁদতে কাঁদতে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।
এহসানের বুক মোচড় দিয়ে উঠল।
— “এতটা কষ্ট পেলি?”
মেহনূরের ঠোঁট কাঁপছে। ভাঙা কণ্ঠে বলল—
— “আমার ভাইজান কে মেরে ফেলেছেন…?”
এহসান মৃদু হাসল। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলল—
— “মেরে ফেলতাম… কিন্তু আজ শুধু আমার বোনকে বিধবা করতে চাইনি বলে মারলাম না।”
মেহনূরের চোখ চকচক করে উঠল।
— “তাহলে ভাইজান… বেঁচে আছে?”
এহসান ওর কোমরের কাছে হাত রেখে আরও কাছে টেনে নিল। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল—
— “হ্যাঁ, বেঁচে আছে। নতুন করে বিয়ে দিয়ে এলাম তোমার ভাই আর আমার বোনের।”
মেহনূরের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।
— “এশা… বিয়েতে রাজি ছিল?”
এহসান গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল—
— “হ্যাঁ, রাজি ছিল। এবং যখন আমি তোমার ভাইকে মারতে যাচ্ছিলাম, তখন সে নিজে হাতজোড় করে বলেছিল— ‘আমার স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা দিন’… তাই তোমার ভাই আজ বেঁচে গেল!”
মেহনূর হতবাক হয়ে গেল।
— “সত্যি? এশা ভাইজানকে মেনে নিয়েছে?”
এহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
— “সবাই তো তোমার মতো বোকা নয়, যে ভালোবাসা চিনতে পারবে না। এশা ঠিকই নিজের আসল ঠিকানা চিনে নিয়েছে। আর আমি জানি, তোমার ভাই আমার বোনকে সুখে রাখবে। সে সাদাসিধা মানুষ।”
মেহনূর কিছু বলল না। শুধু এহসানের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল।
এহসান কয়েক মুহূর্ত ওর দিকে চেয়ে রইল। তারপর আলতো করে ওর কপালে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। একবার, দুইবার… কয়েকবার।
— “এতদিন পর কি এবার বিশ্বাস করতে পারবি যে তোর জায়গা শুধু আমার কাছেই?”
মেহনূর চোখ বন্ধ করল। অশ্রু আবার গড়িয়ে পড়ল।
এহসানের হাত ওর কাঁধে শক্ত হলো।
— “আর কিছু না হোক, এই চোখের কান্না আমি আর দেখতে চাই না। এবার শান্ত হও।”
সন্ধ্যার হালকা বাতাস ছাঁদে বইছে আকাশে চাঁদের আলো।
মেহনূর এবার সত্যিই নির্ভার বোধ করে।
এহসান ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নেয়, মেহনূরের গালে আলতো করে হাত রেখে বলে,
— চিন্তা করো না, আমি এমন কিছু করব না, যা তোমার কষ্টের কারণ হবে।
মেহনূর এহসানের হাত নিজের হাতে চেপে ধরে মৃদু কণ্ঠে বলে,
— সত্যিই করবেন না তো?
এহসান মৃদু হেসে বলে
—- সেটা পরিস্থিতি বুঝে
মেহনূর এহসানের পানে তাকিয়ে বলে
— আচ্ছা সত্যি আপনি আমায় ভালোবাসেন সত্যি?
এহসান মূদু হেসে বলে
—- তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা এতটা ভয়ংকর গহীন যে, সেই গহীনে আমার ভয়ংকর পাপও আঁটকে পড়ে গেছে!
মেহনূর শুধু নিরলস চোখে তাকিয়ে থাকে এহসানের পানে!
এহসান কোনো কথা বলে না, শুধু নীরবে মেহনূরকে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নেয়, যেন তার স্পর্শেই সমস্ত আশ্বাস লুকিয়ে আছে। অতঃপর, এক মুহূর্তও দ্বিধা না করে মেহনূরকে কোলে তুলে নেয়।
মেহনূর নির্বিকার দৃষ্টিতে এহসানের পানে তাকিয়ে থাকে। ওর প্রতিটা শিরা-উপশিরায় স্নিগ্ধ ভালোবাসার ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। তার ভাইজান বেঁচে আছে, আবার সে নিজেও স্বামীর ভালোবাসা পেয়ে গেছে—এটাই তো পরম পাওয়া। মেহনূর মনে মনে আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া আদায় করে।
এহসান মেহনূর কে ঘরে এনে নামিয়ে দিয়ে আদেশের সুরে বলে,
— যাও, খাবার নিয়ে এসো।
মেহনূর রান্না করেই রেখেছে। কাঁদতে কাঁদতে রান্না করেছে, কারণ জানে, এহসান আসামাত্রই খাবার চাইবে। যদি না থাকে, হাজারো অসভ্য কথা বলবে। তাই আগেভাগেই সব তৈরি করে রেখেছে।
রান্নাঘরে গিয়ে প্লেটে খাবার তুলে নিয়ে আসে সে। এদিকে, এহসান ফ্রেশ হয়ে এসে ক্লান্ত দেহ নিয়ে বিছানায় বসে। শরীরে জ্বর, তবু দিনভর দৌড়ঝাঁপের পর এখন একটু প্রশান্তি লাগছে।
মেহনূর ধীরে ধীরে খাবার নিয়ে এসে এহসানের সামনে বসে আর খাবার তুলে ধরে এহসানের মুখের সামনে ।
এক হাতে ফোন ঘাঁটছে এহসান, অন্য হাতে বেগমের হাত থেকে খাবার নিচ্ছে। খাবার তোলার সময় কাঁচের চুড়ির টুংটাং শব্দ ঘরে এক নরম আবহ তৈরি করছে, যা এহসানের মনকে অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিচ্ছে।
হঠাৎ এহসান হেসে বলে,
— মেহনূর, চল আজ আমরা আমাদের বাসরটা সম্পূর্ণ করে নেই।
এমন কথা শুনে মেহনূর চোখ বড় বড় করে তাকায়। মুহূর্তেই তার গাল রাঙা হয়ে ওঠে, চোখেমুখে লজ্জার ছাপ স্পষ্ট। দাঁত চেপে বলে,
— স্বপ্ন আর বাস্তব এক নয়, তাই স্বপ্নের কথা স্বপ্নেই বলুন, বাস্তবে নয়।
এহসান ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখেই মুচকি হেসে বলে,
— এই স্বপ্ন একদিন এমন বাস্তব হবে যে দেখবি, তুই আমার তিন সন্তানের মা হয়ে গেছিস!
এ কথা শুনে মেহনূরের কান গরম হয়ে যায়। চোখ কপালে তুলে রাগি কণ্ঠে বলে,
— আর একটা অসভ্য কথা বললে, আমি এখনই ঘুমিয়ে যাব। নিজের খাবার নিজে খাবেন!
এহসান মেহনূরের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলে,
— আজ রাত ঘুমানোর জন্য নয়, জান। আজ রাত আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য।
মেহনূর ক্ষিপ্ত হয়ে এহসানের মুখে খাবারের টুকরো চেপে ধরে বলে,
— ছি! ছি! এত অসভ্য জবান!
এহসান নির্লিপ্ত হাসে
এশা মেহরাজের ঘরে রয়েছে, মেহরাজের বউ সেজে, ঠিক যেমন তার ভাবিরা মেহনূরকে সাজিয়েছিল। শাড়ি পরা, হাতে মেহেদী, মেকাপ করা, সবকিছুই ছিল। কিন্তু সে আজ কিছুই রাখেনি, সব ধুয়ে ফেলেছে। রাগে সমস্ত সাজগোজ মুছে ফেলেছে।
শাড়ি খুলেনি, পড়ে রয়েছে। তার লাগেজের চাবি আনতে ভুলে গেছে, বাড়ি ছেড়ে রেখে এসেছে।
এশা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে আর নিজের অন্ধকার ভাবছে ।
ঠিক তখনই কক্ষের দরজা খুলে মেহরাজ ভিতরে প্রবেশ করে। ঘরে ঢুকে মেহরাজ এশাকে দেখতে না পেয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। বেলকনির দিকে এগিয়ে যায়, সেখানে গিয়ে দেখে, এশা পিছন দিক দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চাঁদের আবছো আলোয় আরও আবেদনময়ী লাগছে তার বেগম কে।
মেহরাজ কিছু না বলেই, পিছন দিক দিয়ে এশাকে জড়িয়ে ধরে, ঘাড়ে ঠোঁট ঠেকিয়ে দেয়। এশা হঠাৎ এমনভাবে আঁকড়ে ধরা পড়ায় ঘাবড়ে যায়, তবে তার শরীর অবশ হয়ে যায়, কিছু করতে পারে না। মেহরাজের স্পর্শ তাকে স্তব্ধ করে দেশ
কিছু সময় পর নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করে এশা। এরপর নিজের কোমর থাকস মেহরাজের হাতটা শক্ত করে খামচে ধরে বলে, “
—-শয়তান, এত সাহস হয় কই থেকে আমায় জড়িয়ে ধরছিস?”
মেহরাজ এশার শক্ত খামচির পর তাকে ছেড়ে দেয়। মুচকি হাসি দিয়ে বলে, “
—-আল্লাহ, এত ভয়ংকর মেয়ে মানুষ তুমি!”
এশা মেহরাজের দিকে এক টুকরো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মেহরাজের চোখে, মেহেদী রাঙানো হাতে, এলোমেলো চুলে, তার শ্যামবর্ণের মায়া মাখা মুখ এক অন্যরকম সুন্দর লাগছে, যে সৌন্দর্য তার আত্মাকে মুগ্ধ করে তুলছে।
মেহরাজ কিছু না বলেই, এশার গালে হাত রেখে বলে,
—- “বিশ্বাস করো, বউ, তোমার মতো এত সুন্দরী বউ আমি কখনো কল্পনাও করিনি।”
এশা মেহরাজের হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দেয়,
—- “তুই যে নেশা করে এসে এসব বলছিস, আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি। আমি সুন্দর না, আমি কালো।”
মেহরাজ এশার কোমর জড়িয়ে নিজেকে কাছে টেনে এনে, এক দূষ্টিতে বলে, “
—-তুমি শুধু সুন্দরী না, তুমি মায়াবতী রূপবতী, আর সাথে অসভ্যবতী, যে নিজের স্বামীকে গালাগালি করে।”
এশা দাঁত চেপে বলে,
—–“কিসের স্বামী! তুই তোর মতো এক ইবলিশ কে আমি আমার স্বামী হিসেবে মেনে নিব এ কথা ভাবছিস কি রে , তুই একটা কাপুরুষ, আর তোকে গালাগালি করলে মন শান্ত হবে, তুই গালি শোনার যোগ্য!”
মেহরাজ এশাকে আরো নিজের সঙ্গে টেনে ধরে বলে
—-“তাহলে চলো, পুরুষত্ব দেখিয়ে দেই। এত কাপুরুষ, কাপুরুষ যখন বলছো।”
এশা চিৎকার করে বলে, “
—-ছাড়! বলছি, কুত্তা, আমায় ছাড়!”
মেহরাজ মুচকি হেসে বলে
—- বউ এত গালাগালি করো না নয়তো তোমার ঠোঁটও আমার মতো ফাঁটা থাকবে
এশা রেগে হাত উঁচিয়ে মেহরাজের থুতনি চেপে ধরে বলে
—- তোর কে বাঁচানো টা আমার মারাত্মক ভুল হয়েছে এখন দেখছি তুই আমায় জ্বালিয়ে খাবি
মেহরাজ এশা হাত নিজের থেকে ছাড়িয়ে বলে
— হ্যা গো বউ তোমায় আমি একটু একটু করে সারাজীবন জ্বালিয়ে খাব সারাজীবন মনে রেখো “!
এশা মেহরাজ কে ধাক্কা দিয়ে বলে
— তোর মতো কাপুরুষের সাথে আমি সারাজীবন থাকলে তো”!
মেহরাজ এশার কথায় ঠোঁট কেটে হেসে বলে
—- এত করে কাপুরষ বলো না পরে দেখবে তিন চারটে বাচ্চার মা হয়ে গেছো এই আমি কাপুরুষের দ্বা…
মেহরাজ আর কিছু বলতে পারে না টাশ করে চড় বসিয়ে দেয় এশা মেহরাজের গালে ‘!
মেহরাজ এশার থাপ্পড় খেয়েও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না “! উল্টো এশা যে হাত দিয়ে থাপ্পড় মেরেছিল সেই হাত ধরে চুমু দিতে থাকে “!
এশা এবার বেশ বিপদে পড়ে যায় এ পুরুষ এত ঘাড় ত্যাড়া আর নির্লজ্জ হয় কি করে ‘!
মেহরাজ এশাকে ছেড়ে দেয়, কম দখল গেল আর তার উপর , তাই যন্ত্রণা আর দিয়ে লাভ নেই।
এশা মেহরাজের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে, এক মুহূর্তও সেখান দাঁড়িয়ে থাকে না, কক্ষে চলে এসে বিছানায় বসে যায়। মেহরাজও পিছু পিছু কক্ষে আসে।
এশা মেহরাজকে বলে, “
—-আমার লাগেজের তালা ভেঙে দে, আমি কাপড় বের করব।”
মেহরাজ এশার লাগেজের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
—-“শুধু লাগেজের কেন, তুমি বলতো, তোমার মনের তালাও আমি ভেঙে দিতে পারি।”
এশা ওর দিকে অগ্নি দূষ্টিতে তাকায় “! মেহরাজ এশার এই দূষ্টি দেখে চুপচাপ লাগেজের সামনে বসে পড়ে
মেহরাজ লাগেজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলে,
—-“এটা কাটার ছাড়া খুলা সম্ভব নয়, সকালেই খুলবো, কাটার এনে।”
এশা মেহরাজের দিকে তাকিয়ে বলে, “
—-কাজের কোনো বাল তো পারিস না, সব পারিস শুধু শয়তানি।”
মেহরাজ এর কথায় বেশ চটে যায়। মেয়েরা কেন এত গালাগালি করবে? কিন্তু তাও, রাগকে শান্ত করে, বাথরুমে গিয়ে ওযু করে বেরিয়ে আসে।
এশা তখন আগের মতো বিছানায় বসে আছে। মেহরাজ তাকে তেতে তুলতে এগিয়ে এসে, ঝুঁকে বলে, “
—-বউ, চলো বাসর করে ফেলি।”
এশা দাঁত চেপে মেহরাজের দিকে তাকিয়ে বলে, —“ইবলিশের ইবলিশ, তোর বাসর তুই কর।”
মেহরাজ টিটকারি হাসি দিয়ে বলে,
— “হ্যা, সে টা তো করব কিন্তু তার জন্য তো তোমায় প্রয়োজন।”
এশা মেহরাজের কথায় নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে, তারপর মেহরাজের দিকে ফিরে বলে, “
—ভাগ্য ভালো তোর, আমার পায়ে জুতো নেই, যদি আমার পায়ে জুতো থাকত, তো এখনই এই জুতো তোর গালে লাগত।”
মেহনূর আলমারি কাপড় গোছাচ্ছে আর এহসান বিছানায় বসে বসে তার নারীকেই পরখ করছে! মেহনূর বিরবির করে শুধু এহসানকে গালি দিচ্ছে।
— শয়তান লোক, খারাপ লোক, খবিস লোক! একবার ঘরে এলেই সারা ঘর ছানামাতা করে দেয়। মন তো চাচ্ছে, এই কাপড়গুলোও ওনার মুখে ছুড়ে পারি, ফেরতরে ফেরত।
এহসান মেহনূরকে বিরবির করতে দেখে, ওকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—- কি রে কবুতরের বাচ্চা, কি বিরবির করছিস?
মেহনূর বিরক্তি নিয়ে এহসানের দিকে বলে,
—- ঘরের কি অবস্থা করেছেন! এসব এদিকে, ওদিকে কাপড় সবসময় এমন করেন কেনো?
এহসান ভুঁ কুঁচকে বলে,
— বউ হস, তুই আমার। আর আমার যেমন মন চায়, তেমন ঘর কে অগোছালো করব, তুই আসিস তো গোছানোর জন্য।
মেহনূর রাগে ফুঁসে এহসানের দিকে তাকায়, ফের নিজের কাজে মনযোগ দিয়ে এহসানকে মনে মনে গালাগালি করতে থাকে!
মেহনূরকে রেগে যেতে দেখে, এহসান টিটকারি করে বলে,
—- ওগে বউ, রাগ করো না, রাগলে তোমায় যে আমার বাচ্চার মা লাগে!
এহসানের এমন লাইন ছাড়া উক্তি শুনে মেহনূর রেগে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
— বন্ধ করবেন না আপনি, না আমি গোছানো বন্ধ করে ঘুমিয়ে যাব।
এহসান নিজের হাত মাথার পিছনে নিতে নিতে বলে,
—- এত যে ঘুমানোর কথা বলছো, ঘুমাতে কি পারবে আজ আদৌও, কারণ তোমার স্বামী আজ পুরো স্বামী স্বমাী ভাবে আছি।
মেহনূর এহসানের দিকে এক পলক তাকিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে আসে এবং এহসানের কিছু টিশার্ট এগিয়ে দিয়ে বলে,
— এত অকাজের কথা না বলে, এই নিন টিশার্টগুলো ভালো করে বাজ করুন, কাজের কাজ করুন।
এহসান উঠে বসে, নিজের টিশার্টগুলো বাজ করতে করতে বলে,
— জানিস বউ, তোকে আজ পুরোপুরি বউ বউ লাগছে!
মেহনূর এহসানের দিকে এক পলক তাকিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে আসে, আর এহসানের সামনে বসে সেই টিশার্টগুলো বাজ করতে করতে বলে,
—– আপনার দ্বারা কোনো কাজ হবে না, হবে শুধু অকাজ আর অকাজ!
এহসান মেহনূরের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে,
—- আমার দ্বারা আর কিছু হবে কি না জানি না, কিন্তু আমার দ্বারা তুই কয়েক সন্তানের জননী ঠিকই হয়ে যাবি!
তারপর একটু থেমে বলে,
— ইনশাআল্লাহ।
মেহনূরের এবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, এহসানের দিকে তাকিয়ে দাঁত চেপে বলে,
—- মুখ ভেঙে দিব, আর একটা বেশি কথা বললে, খারাপ পুরুষ।
এহসান ঠোঁট কেটে হেসে বলে,
— এদিকে আয় না রে, একটু খারাপি তোর সাথে করি, খারাপ যখন বললি।
মেহনূর বিরক্তি নিয়ে এহসানের দিকে তাকিয়ে, হাতে টিশার্টগুলো নিয়ে উঠে যায়! অতঃপর আলমারিতে রেখে দেয় অতি যত্ন সহিত! আলমারি লাগিয়ে, এহসানের দিকে তাকিয়ে দাঁত চেপে বলে,
—- আর যদি দেখি আলমারির কাপড় এদিকে থেকে ওদিক হয়েছে, তো দেখবেন কি করি।
এহসান আবারও বিছানায় এলান দিতে দিতে বলে,
— তুই যাই দেখাস, আমায়! আগে কিন্তু তোর ঘাড়ের তিলটা দেখাতে হবে, আগে এই আমি বলে দিলাম।
মেহনূর আর সহ্য করতে পারে না, চিৎকার করে বলে,
— একটা অমানুষ, আপনি মানুষ হলেন না এখনও।
এ বলেই বাথরুমে প্রবেশ করে উদ্দেশ্য ওযু করা! ওযু করে বেরিয়ে এসে দেখে, এহসান তার পানেই তাকিয়ে আছে! এটা দেখে মেহনূর কিছু বলে না, কি বলবে, এ পুরুষের কাজি তো, এটা যখন সুযোগ হয় তখনি তার পানে তাকিয়ে থাকা।
মেহনূর আলমারি থেকে ঔষধের বাক্স থেকে একটা ঔষধ নিয়ে এসে, এহসানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
—- এই নিন ঔষধটা খেয়ে নিন, জ্বর এখনও কমেনি!
এ বলে, এহসানের হাত টেনে নিয়ে, এহসানের হাতের তালু ঔষধটা দিয়ে পাশের টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে, এহসানের দিকে এগিয়ে দেয়! এহসান শান্তভাবে খেয়ে নেয় তা!
মেহনূর বাতি বন্ধ করে এসে বিছানায় উঠে যায়! আজ আর এহসানের বুকে মাথা রাখে না, এহসান এমনিতেই অসুস্থ, তাই প্রয়োজন নেই, নিজের ভার ওর উপর ছেড়ে দেওয়ার, তাই বালিশেই মাথা রাখে।
মেহনূর বালিশে মাথা রাখার কিছু মুহূর্ত পর, এহসান এগিয়ে এসে, মেহনূরের বুকে নিজের মুখ বুঁজে দেয়!
মেহনূর দীর্ণ শ্বাস ফেলে, এহসানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে! এহসান আয়েশে চোখ বুঁজে নেয়।
কিন্তু এহসান কি শান্তি থাকার মানুষ, সে সবসময়ই মেহনূরকে লজ্জা ফেলার দান্দায় থাকে, মেহনূরের যা মনে হয়!
এই যে মেহনূরের বুকে শোয়ে আছে, তবে গত রাতের মতো শান্ত হয়ে নয়।
এই এদিকে নড়চে তো, ওদিক তো, নিজের মুখ তুলে মেহনূরের থুতনিতে থাকা তিলে, নিজের ঠোঁট ছুঁয়াচ্ছে, তো মেহনূরের গলায় নিজের মুখ বুঁজে দিচ্ছে, তো আবার বুকে, তো আবার ওর কানের লতি তে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিচ্ছে।
মেহনূর বিরক্ত হয়ে, রাগে ফেটে পড়ে বলে,
—- আমি এখন কান্না করে দিব, এমন করছেন কেনো, আপনার দাড়ি ত্বক স্পর্শ হলে খুব কষ্ট হয়, সরুন।
এহসান মেহনূরের গলায় মুখ বুঁজে বলে,
—- কাঁদলে কাঁদো, তোমার কান্না তীব্র থেকে তীব্র করে তুলবে, সমস্যা কি?
তারপর একটু থেমে বলে,
—- আমার দাঁড়ি ঠোঁট স্পর্শ করবে তোমার পুরো শরীর জুড়ে, মনে রেখো।
মেহনূর এহসানের কথায় বিরক্ত হয়ে যায়, যখন থেকে এসেছে এই পুরুষ, তখন থেকেই যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে, সারাটাদিন কেটেছে ভাইয়ের চিন্তায়, আর রাত কাটবে এই পুরুষের যন্ত্রণায় “!
এশা ঘুমিয়ে আছে ওর পাশেই শোয়ে আছে মেহরাজ “! যদিও এশা ঘুমানোর আগে সে সোফাতেই ছিল কিন্তু এশাকে ঘুমতো দেখেই এক লাফে চলে এসেছে বিছানায়!
এশা কে খুঁটিয়ে দেখছে মেহরাজ “! এশার পড়নের শাড়ী এলোমেলো হয়ে আছে “! তাই ওর শরীরের অবয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মেহরাজ ‘!
মেহরাজ এক দূষ্টিতে তাকিয়ে আছে এশার পানে শুধু তাকিয়ে আছে “! তার জীবনে কোনো নারীর আগমন ছিল না “! এ নারীই প্রথম আর সেই নারীই তার বেগম “!
তাকে অনেকেই পছন্দ করত “! দেশের বাইরে যাওয়ার পর কত নারীর থেকে যে সে প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছে “! তা নিজেরও জানা নেই “! কিন্তু এসবে সে পাত্তা দেইনি “! সে নিজের পড়াশোনা আর ল্যাব নিয়েই পড়ে ছিল “! আর সফলও হয়েছে যেমন পরিশ্রম করছে ‘!
কিন্তু এই জেদের বসে বিয়ে টা করে এই নারীতে আটকা পড়ে গেছে সে “! মেহরাজের ইচ্ছেই ছিল যদি কোনো নারী কে ভালোবাসে তো সেটা হবে তার বউ আর সেটাই হলো “! কিন্তু তার বউ তো আর বউ নয় আগুনের গোলা কথায় কথায় ছ্যাঁত করে উঠে আর কি গালাগালি “! মেহরাজ এর তো কানে তালা লেগে যায় “!
এসব ভাবছে মেহরাজ আর এক পানে তাকিয়ে আছে নিজের বেগমের পানে”!
এশার ঘুমের মধ্যেই মনে হয়”! কেউ ওকে দেখছে “! এশার ঘুমঘুম চোখে চোখ খুলে “! চোখ খুলেই মেহরাজ এভাবে নিজের এত কাছে দেখে এশার ‘! হুশ উড়ে যায় “! এশা চিৎকার করে বলে
—- এ কুত্তা তুই এখানে কি করছিস
আত্মার আগলে পর্ব ৩১
মেহরাজ মুচকি হেসে এশার গালে হাত দিয়ে বলে
— তোমার শাড়ী খুলে গেছে সেটাই দেখছি
এমন কথা শুনে এশা চোখ বড় বড় করে নিজের দিকে তাকায় “! নিজের এমন অবস্থা দেখে এশা চিৎকার করে উঠে বলে
—- ও কুত্তারে তোর জন্য আমি ঘুমিয়েও শান্তি পাই না “!
