আত্মার আগলে পর্ব ৩৮
সানজিদা আক্তার মুন্নী
এশা ঘুমিয়ে আছে তার অপ্রিয়, অথচ সবচেয়ে আপন পুরুষের গলায় মুখ গুঁজে—তার মেহরাজের আগলে।
বিড়ালের মতো ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে এশা, মেহরাজের বুকে মাথা রেখে।
মেহরাজ ওর চুলে আলতো হাতে বিলি কাটছে, নিরবে অনুভব করছে নিজের শ্যামবতীর উষ্ণতা।
এশাকে জোর করেই নিজের বুকে রেখেছিল মেহরাজ। বলেছিল—
“যদি আমার বুকে না ঘুমাও, তবে তোমার বুকে আমি ঘুমাব।”
এটা শুনে এশা কিছুক্ষণ মেহরাজকে গালাগাল করেছিল, রাগে ওর থুতনি চেপেও ধরেছিল। কিন্তু শেষমেশ মেহরাজের এক কথা—
“তুমি যতক্ষণ না আমার বুকে মাথা রাখবে, ততক্ষণ আমি তোমায় যন্ত্রণা দেব।”
অনেক রাগারাগির পর অবশেষে এশা মেহরাজের বুকে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ে।
কিন্তু মেহরাজের চোখে ঘুম নেই। এশার বুকে মাথা না রাখলে ঘুম হয় না, একদমই হয় না। যেন এক ভয়ংকর রোগ হয়েছে তার।
ধীরে ধীরে এশাকে পাশে শুইয়ে দিয়ে মেহরাজ এবার আলগোছে মাথা রাখল ওর বুকে।
এশা আলতো নড়ে উঠতেই মেহরাজের বুক ধক করে উঠে—এবার না এশা সত্যিই ওকে উষ্টা মেরে নিচে ফেলে দেয়!
কিন্তু না, কিছুক্ষণ পরেই এশা ঘুমের মধ্যেই ওর মাথায় হাত রাখে। এই যে টান, এই যে অনুভব—সেই তাড়নাতেই হয়তো ঘুমন্ত এশা নিজের অজান্তেই মেহরাজের প্রশান্তির কারণ হয়ে উঠেছে।
মেহরাজের এতক্ষণ অশান্ত লাগছিল, কিন্তু এখন শান্তি লাগছে। ভীষণ শান্তি। চোখ বুজে নেয় সে।
—
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নূরির চোখ খুলতেই চমকে ওঠে।
তার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে মেহরুব!
একি! তার মেহরুব ভাই এখানে? এত রাতে তার ঘরে?
চারপাশে তাকিয়ে ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে নূরির। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। সবাই এতক্ষণে হয়তো জেনেই গেছে যে, মেহরুব খেতে যায়নি।
লজ্জায় নিজের ঠোঁট কামড়ে হেসে ওঠে নূরি। এখন হাসছে, আবার মনে পড়তেই মন খারাপ হচ্ছে—সকালে সবাইকে কীভাবে মুখ দেখাবে!
নিচু চোখে মেহরুবের দিকে তাকায় সে। ঘুমন্ত পুরুষটিকে যেন এক স্নিগ্ধ ফুলের মতো লাগছে। চোখ আটকে যায় আপন পুরুষের পানে।
আলতো হাতে মেহরুবের মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতে ডাক দেয়—
“মেহরুব ভাই, উঠুন। ঘরে যান।”
কয়েকবার ডাকতেই মেহরুব চোখ খুলে তাকায় নূরির দিকে। বিস্মিত নয়, বরং একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এক মুহূর্ত… দুই মুহূর্ত… কয়েক মুহূর্ত কেটে যায়, কিন্তু সে নূরির পানে তাকিয়েই থাকে।
নূরি বলে—
“মেহরুব ভাই, অনেক রাত হয়েছে, নিজের ঘরে যান।”
মেহরুব ধীরে বলে—
“কেন? আমি তোর ঘরে থাকলে সমস্যা বুঝি?”
নূরি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে—
“সমস্যা নেই, কিন্তু সবাই কী ভাববে?”
মেহরুব চোখ বুজে বলে—
“তোকে নিয়ে যদি সারাদিনও এখানে পড়ে থাকি, তাও কেউ কিছু বলবে না।”
নূরির চোখ কপালে!
“এ—এ—এসব কী বলছেন?”
মেহরুব চোখ বন্ধ করেই বলে—
“বাস্তব কথা বললাম, নূরি ফুল।”
নূরি হেসে ওঠে। মেহরুব তাকে “নূরি ফুল” বলেছে!
সে জিজ্ঞেস করে—
“খাবার খাবেন না?”
“হুঁ, খিদে পেয়েছে।”
“আচ্ছা, তাহলে চলুন, নিচে যাই। আমারও অনেক ক্ষুধা লেগেছে।”
কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে মেহরুব ধীরে উঠে বসে।
নূরি পা সটান করে বসে। এতক্ষণ বসে থাকায় পা অবস হয়ে গেছে।
মেহরুব বলে—
“কী রে? কষ্ট হচ্ছে?”
নূরি হেসে বলে—
“না তো, এমনি বসেছি। চলুন, খাবার খেতে হবে তো!”
বলে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবারও বসে পড়ে।
মেহরুব কাঁধে হাত রেখে বলে—
“তুই ঠিক আছিস তো? বস, আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
নূরি অবাক হয়ে তাকায়। তার মেহরুব ভাই রান্নাঘরে যাবে? তার জন্য খাবার আনবে?
নূরি হেসে মেহরুব এর বাহু তে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে—
“আপনি জানেন রান্নাঘরে খাবারের প্লেট কোথায় রাখা আছে?”
মেহরুব বুঝতে পারে, নূরি মজা করছে। সে নূরির পানে তাকিয়ে বলে—
“তুই মজা করিস না, আমি ঠিকই নিয়ে আসব!”
নূরি হাসতে হাসতে বলে—
“আচ্ছা, প্রয়োজন নেই! আমার সাথে চলুন, একা যেতে ভয় লাগছে।”
মেহরুব উঠে লুঙ্গি ঠিক করতে করতে বলে—
“হুম, চল।”
দুজন একসাথে রান্নাঘরে যায়।
অনেক বছর পর মেহরুব রান্নাঘরে ঢুকল। তার তো রান্নাঘরে আসার প্রয়োজনই পড়ে না।
একটা চেয়ার টেনে বসে নূরিকে দেখছে। ওকে দেখতে তার খুব ভালো লাগে। মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
নূরি খাবার গরম করে প্লেটে তুলে এনে বলে—
“আমি খাইয়ে দিই?”
মেহরুব হাসে—
“দে।”
নূরি খুশি হয়ে ধীর হাতে খাবার মেখে বিসমিল্লাহ বলে তুলে দেয় মেহরুবের মুখে।
মেহরুবও বলে—
“বিসমিল্লাহি ওয়ালা বারাকা তিল্লাহ।”
প্রিয় নারীর হাতের খাবার বলে কথা—ভালো না লেগে যায় কোথায়!
ফজরের আযান ভেসে আসছে দূর থেকে। গভীর রাতের প্রশান্তি ভেঙে এখন যেন নতুন দিনের বার্তা দিচ্ছে চারপাশ।
এশার ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎ করেই।
চোখ খুলতেই নিজের বুকের ওপর ভারী কিছু অনুভব করে। মৃদু আলোয় দেখতে পায়— মেহরাজ। ওর কপালটা রাখা এশার বুকের ওপর, নিঃশ্বাসের গরম বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে এশার গলা। এ দৃশ্য নতুন কিছু নয়। বরং এখন এটা অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই বিরক্তি লাগে না, তবুও একরকম চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক চিরে।
চোখ রাখে মেহরাজের চুলে। আস্তে আস্তে ওর নরম চুলের ওপর আঙুল চালিয়ে দিতে দিতে ফিসফিসিয়ে বলে,
— আমিও চাইতাম আমার হালাল পুরুষ আমার সাথে এমনই থাকুক, আমাকে ভালোবাসুক, আমার সাথে খুনসুটি করুক, আমায় আপন করে নিক… জানো? আমার চাওয়াটা পূরণ হয়েছে ঠিকই, তবে…
কথা শেষ না করেই থেমে যায়। এক দীর্ঘশ্বাস বুক চিরে উঠে আসে।
— তবে আমাদের সম্পর্কের শুরু হলো এক বিশ্রী অধ্যায় দিয়ে! এমন অধ্যায়, যেখানে শুধু কলঙ্কের ছোঁয়া।
গলার স্বর ভারী হয়ে আসে।
— তুমি হয়তো আমার চেয়ে উত্তম কাউকে পেতে পারতে। আমি হয়তো তোমার যোগ্যই নই। তোমার মতো সুদর্শন পুরুষের পাশে বেগম হিসেবে হয়তো আমায় মানাবে না…
কথাগুলো বলার পরই নিজেকে সংবরণ করে নেয়।
— কিন্তু তুমি বোকামি করেছিলে, বুঝেছো? আমার ছোট সিংহটার সাথে টক্কর দিতে গিয়েছিলে!
এক মুহূর্ত চুপ থেকে নিঃশ্বাস ফেলে।
— হয়তো তোমার ধারণাও নেই, আমার ভাই ঠিক কতটা হিংস্র হতে পারে! সেদিন যদি তোমায় বাঁচানোর জন্য মিথ্যা না বলতাম, তাহলে তুমি হয়তো আজ আমার বুকে না, বরং মাটির বুকে শুয়ে থাকতে!
এশার চোখে পানি চিকচিক করে ওঠে।
— তোমায় জীবিত পেতে গিয়ে আজ আমি কলঙ্কিত!
কণ্ঠটা যেন কেঁপে ওঠে।
— আমি সত্যি মানতে পারছি না! এর মধ্যে তোমার এই বাচ্চাদের মতো আচরণ… যেখানে তুমি সামলাবে আমায়, সেখানে আমায় তোমাকে সামলাতে হয়! এ কেমন পরিস্থিতি? কাকে বলব আমার কষ্টের কথা? কাকে বলব? আমার রব ছাড়া তো কেউ বোঝে না আমার অন্তরের অবস্থা!
ঠিক তখনই ফজরের আযান শুরু হয়। তাদের মসজিদে
আযানের শব্দ কানে আসতেই এশার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে।
— আছেন, আমার একজন আছেন… আমার সবচেয়ে আপন, আমার রব। আমার আল্লাহ। আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট। আর কেউ লাগবে না আমার। সবাই নিজের কষ্টের কথা আপনজনকে বলে, আমি না হয় আপনজনের চেয়েও আপনজন, আমার রবকে বলব। সিজদায় গিয়ে বলব… প্রাণ ভরে সব খুলে বলব… আর এর বিনিময়ে প্রশান্তি পাবো।
এশা হঠাৎ মেহরাজকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
— উঠো, নামাজের সময় হয়ে গেছে!
কয়েকবার ডাকতেই মেহরাজ ঘুমের ঘোরে চোখ মেলে।
কিছু মুহূর্ত চুপচাপ তাকিয়ে থাকে এশার দিকে।
তারপর আধো ঘুমের কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে,
— এত স্নিগ্ধ রূপ নিও না আমার সামনে… নিজেকে সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়বে আমার পক্ষে!
এশা মুখ কুঁচকে ওর বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলে,
— ঘুমের ঘোরে যা মনে আসে, তা বকছো! একেবারে নেশাখোরদের মতো!
মেহরাজ হেসে ফেলে।
— হুম, আমি নেশাখোর! তোমার নেশায় নেশাগ্রস্ত! তোমার চোখের নেশায়!
এশা বিরক্ত হয়ে ওকে সরিয়ে দিতে গিয়ে বলে,
— এই পাগল তো দেখি ঘুমের মধ্যেও ছাগলামি করে!
মেহরাজ একটুও ভ্রুক্ষেপ না করে এশার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
তারপর বলে,
— একবার ঠোঁট ডুবিয়ে দেই?
এশা বিস্মিত হয়ে তাকায় ওর দিকে।
— কোথায়?!
মেহরাজ হাসে।
— তুমি যেখানে বলবে, সেখানেই!
কথাটা শেষ হতেই এশার হাত ঝাঁপটে ওঠে।
“টাশ!”
একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয় ওর গালে!
মেহরাজ গালে হাত দিয়ে অবুঝ চোখে তাকিয়ে থাকে এশার দিকে।
এশা দাঁত চেপে ওর গেঞ্জির কলার চেপে ধরে বলে,
— ঘুমের মধ্যেও ফালতু কথা বকিস?! এটা নামাজের সময়! এ সময় নামাজের জন্য, তোর এসব নাটকের জন্য নয়!
মেহরাজ থাপ্পড় খেয়েও হেসে ফেলে।
মনে মনে বলে,
— যা বাবা মেহরাজ, তোর ভাগ্য ভালো! শুধু বউয়ের হাতে থাপ্পড় খেয়েছিস, অন্তত পায়ের উষ্ঠা তো খাসনি!
এবার আর কিছু না বলে মেহরাজ এশাকে টেনে নেয় নিজের কাছে।
হঠাৎ করেই ওর ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় এশার ঠোঁটে!
আঁকড়ে ধরে ওকে নিজের মতো করে!
মুহূর্তের পর মুহূর্ত কেটে যায়…
কিন্তু মেহরাজ ছাড়ে না!
এশার গলা, মুখমণ্ডল, কপাল— একের পর এক ছুঁয়ে যেতে থাকে নিজের ঠোঁট দিয়ে।
এশা চোখ বন্ধ করে বিছানার চাদর খামচে ধরে।
সব সহ্য করে…
কিন্তু ওর মনে চলছে অন্য পরিকল্পনা!
মেহরাজ ওকে ছাড়লেই… আজ ওকে লাতি মেরে বিছানার নিচে ফেলে দেবে!
এশা অপেক্ষায় থাকে…
নিজের স্বাদ মিটিয়ে নিতে দিক ও!
তারপর…
এবার ওর পালা!
ফজরের নামাজের পর মেহনূর বেলকনির সোফায় বসে, কোলে বালিশ রেখে, চোখের সামনে মেলে ধরে সেই পবিত্র কোরআন শরীফ, যা এনিসা বেগমের দেওয়া—যার পাতায় পাতায় লেগে আছে প্রজন্মের ঐতিহ্য, রহমত আর ভালোবাসা। নরম সকালের হাওয়া তার চুল উড়িয়ে দেয়, আর কোরআনের আয়াত তার ঠোঁট ছুঁয়ে মাখন মতো গলে যায় বাতাসে।
আর এহসান?
সে বসে আছে ঠিক মেহনূরের বিপরীতে, কিন্তু তার দৃষ্টি যেন অন্য কোথাও। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিজের বেগমের দিকে—একদিকে চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে অন্তরের প্রশান্তি খুঁজে নিচ্ছে সেই মোহনীয় তেলাওয়াতে।
“إِذَا وَقَعَتِ الْوَاقِعَةُ…”
সুরা ওয়াকিয়াহর প্রথম আয়াত উচ্চারিত হতেই মেহনূরের গলা কেঁপে ওঠে। কেন যেন এই সূরা পড়লেই বুকের ভেতর কেমন জানি করে, মনে হয় যেন কিয়ামত তার চোখের সামনেই নেমে আসছে। সমস্ত দৃশ্য যেন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।
لَآكِلونَ مِن شَجَرٍ مِن زَقّومٍ
তোমরা অবশ্যই যাক্কূম গাছ থেকে খাবে,
[:৫২] আল ওয়াক্বিয়াহ্
فَشارِبونَ عَلَيهِ مِنَ الحَميمِ
তদুপরি পান করবে প্রচন্ড উত্তপ্ত পানি।
[৫৪] আল ওয়াক্বিয়াহ্
মেহনূরের ঠোঁট কাঁপতে থাকে, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে।
এহসান তখনও তাকিয়ে আছে, কিন্তু এবার তার চোখেও ভয় ফুটে ওঠে।
মেহনূর এ আয়াত পড়ে আর গলা দিয়ে আনতে পারে না একটাও শব্দ, ভিতর ফেটে কান্না আসছে। এর মধ্যেই এহসান মেহনূরের সামনে বসে কাঁদতেও পারছে না!
মেহনূর নিজেকে সামলাতে পারে না হাউমাউ করে ডুকরে কেঁদে উঠে কোরআন খানা মুখে গুঁজে বলে—
“আমি গুনাহগার, আমার কী হবে? আমাদের কি হবে? আমাদেরও কি… খাদ্য হবে যাক্কুম ফল? আমার রব যদি দয়া না করেন, তো আমি শেষ! আমি শেষ! আমার আর… জান্নাত দেখা হবে না!”
“আমি তো শেষ! আমার কী হবে? আমাদের কী হবে? আমরাও কি জাহান্নামের যাক্কুম গাছের খাদ্য হবো?”
আমরাও কি তদুপরি পান করবে প্রচন্ড উত্তপ্ত পানি খেতে হবে
এ বলেই মেহনূর মুখ গুঁজে দেয় কোরআনের ভাঁজে, হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
এহসান শিউরে ওঠে, তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। এই আয়াতগুলোর অর্থ যখন মনে গেঁথে যায়, তখন সত্যিই বুক কেঁপে ওঠে। মেহনূরের প্রতিটি শব্দ যেন তার নিজের আত্মাকেও কাঁপিয়ে তোলে।
মেহনূর নিজেকে সামলে আবারও পড়তে শুরু করে, চোখের জল শুকিয়ে আসে, তবুও হৃদয়ের গাঢ় ব্যথাটা থেকে যায়। পড়া শেষ করে সে কোরআন শরীফ রেখে আসে যথাস্থানে, তারপর ফিরে এসে দাঁড়ায় এহসানের সামনে।
— “আপনার জন্য চা নিয়ে আসবো, নাকি নিচে গিয়ে খাবেন?”
এহসান এবারও চুপচাপ তাকিয়ে থাকে, যেন এই মুহূর্তে তার চারপাশের সব শব্দ নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। তারপর আস্তে করে বলে,
— “এদিকে আসো।”
মেহনূর ধীর পায়ে এগিয়ে এসে তার সামনে বসে।
— “আরও কাছে এসো।”
— “কেন?”
— “তুমি আমার কাছে থাকলে আমি শান্তি অনুভব করি।”
একগাল মিষ্টি হাসি দিয়ে মেহনূর একটু এগিয়ে আসে, আর তখনই এহসান তার গাল দুটো আলতো হাতে ছুঁয়ে নেয়। তারপর গভীর ভালোবাসায় কপালে, গালে, চোখের পাতায় একে একে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ায়, যেন প্রতিটি ছোঁয়ায় মেহনূরকে আশ্বস্ত করছে—”আমি আছি, আমি থাকবো।”
মেহনূর চোখ বন্ধ করে ফেলে। এখন আর তার এই ছোঁয়া খারাপ লাগে না, এখন আর এতে কোনো ঘৃণা জন্মায় না। বরং সে এতে আশ্রয় খুঁজে পায়, নিরাপত্তা খুঁজে পায়, ভয়ংকর এক ভালোবাসা খুঁজে পায়!
এহসান তাকে ছেড়ে দিলে মেহনূর আস্তে করে বলে,
— “একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
— “হুম, করো।”
মেহনূর এহসানের হাত নিজের হাতে মুঠোবন্দি করে ফেলে।
— “এর উত্তর কিন্তু আমার চাইই চাই!”
এহসান হেসে বলে,
— “কদিন পর তুমি আমার বাচ্চার মা হবে, আর এখন তোমার বাচ্চাদের মতো এভাবে জেদ করলে চলবে?”
মেহনূর ভ্রূ কুঁচকে বিরক্ত হয়।
— “বাড়ি ভর্তি বাচ্চা তাও শুধু বাচ্চা বাচ্চা করেন কেনো আপনি?”
এহসান চোখ টিপে হেসে বলে,
— “বাড়ি ভর্তি বাচ্চা হলে কি হবে, ঘর ভর্তি তো নেই! আমার ঘর ভর্তি বাচ্চা-কাচ্চা চাই।”
মেহনূর এবার চটে যায়।
— “আমি অত বাচ্চা নিতে পারবো না! যান, আরও তিনটে বিয়ে করে নিন গিয়ে তারপর ঘর ভর্তি বাচ্চার পিতা হওয়ায় সপ্ন পূর্ন করুন!”
এহসান তৎক্ষণাৎ তার ঠোঁটে নিজের শাহাদাত আঙুল চেপে ধরে বলে,
— “হুস! এমন কথা আর কখনো বলো না। যে সন্তানের জননী তুমি নয় সে সন্তানের পিতা আমি হতে চাই না!”
মেহনূর এবার মিটিমিটি হাসে।
— “আপনার এত ভালোবাসা আমার জন্য?”
এহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
— “শুধু আমার ভালোবাসা নয় বেগম, এই পুরো আমিটাই… শুধু তোমার জন্য।”
মেহনূর কিছুক্ষণ চুপ থেকে একদৃষ্টিতে এহসানের দিকে তাকিয়ে বলে,
— “একটা সত্যি কথা বলি?”
— “হুম, বলো।”
— “জানেন, আমি না মাতোয়ারা হয়ে যাই আপনার শরীরের গন্ধে! যখন আপনাকে একদম সহ্য করতে পারতাম না, তখনও এই গন্ধটা আমার খুব ভালো লাগতো… আপনার শরীরের ঘ্রাণ, এটা শুধু আমার… একান্ত প্রিয়।”
এহসান মুচকি হেসে বলে,
— “তাহলে, অনুভব করে নাও।”
এই বলেই নিজের বাহু বাড়িয়ে দেয় মেহনূরের দিকে। অনুমতি পেয়েই মেহনূর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার বুকে, শক্ত করে আঁকড়ে ধরে এহসানকে, নাক ডুবিয়ে নেয় তার বুকের কাছে, প্রাণ ভরে শোঁকে আপন পুরুষের শরীরের সেই গভীর পরিচিত ঘ্রাণ!
এহসানও আঁকড়ে ধরে তাকে, এমনভাবে যেন আর কখনো ছাড়তে চাইবে না।
এটাই তো ভালোবাসা… এক ভয়ংকর ভালোবাসা!
এশা ফোনে কথা বলছে নিজের আম্মার সঙ্গে, আর ওদিকে মেহরাজ? সে তো ইচ্ছেমতো এশাকে অশান্তি দিচ্ছে!
এই ওর ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিচ্ছে, তো এই কানের লতিতে দাঁত বসিয়ে দিচ্ছে!
এশা কিছু বলতেও পারছে না, নিজেকে ছাড়িয়েও নিতে পারছে না!
ওদিকে ফোনের ওপাশে আম্মা, ভাবি, আব্বা— সবাই কথা বলছে, আর এদিকে মেহরাজ আপন মনে ওর ইচ্ছেমতো জ্বালিয়ে যাচ্ছে!
এশা অনেকক্ষণ ধরে কথা বলে, আর সেই পুরোটা সময় মেহরাজ আপন খেয়ালে ওকে বিরক্ত করে যায়!
অবশেষে ফোন শেষ হতেই এশা প্রচণ্ড রেগে যায়!
ওর মনে হচ্ছিল, হাতের ফোনটা ছুঁড়ে মেরে ভেঙে দেয়!
কিন্তু পরক্ষণেই দাঁতে দাঁত চেপে রাগটা সহ্য করে নেয়, কারণ এর আগেও একবার রাগের বশে একটা ফোন ভেঙে দিয়েছে!
এশার থমথমে মুখ দেখে মেহরাজ ওকে পেছন থেকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে বলে—
“জান, থেমে গেলে যে! আছাড় মেরে ভেঙে দেবে না?”
এশা ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়, তারপর কনুই দিয়ে মেহরাজের বুকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলে—
“ভালো চাইলে ছেড়ে দে মেহরাজ! না হলে আজ কিছু একটা হয়ে যাবে তোর সাথে আমার !”
মেহরাজ হাসতে হাসতে বলে—
“হ্যাঁ, আমিও চাই তোমার সঙ্গে আমার এমন কিছু হোক… যাতে তুমি আমার বাচ্চার মা হয়ে যাও!”
এশা দাঁত চেপে গলায় শক্তি এনে বলে—
“ছাড়! আমার কষ্ট হচ্ছে, বলছি ছাড়!”
মেহরাজ এবার নিজের বাঁধন একটু হালকা করে নিয়ে মুচকি হেসে বলে—
“সামান্য জড়িয়ে ধরাতেই যদি তোমার এই অবস্থা হয়, তাহলে ভাবছি আজ রাতে তোমার কী হবে! আগেভাগে হাসপাতালে একটা সিট খালি করে রাখবো নাকি, বউ?”
মেহরাজের কথা শুনে এশা প্রচণ্ড রেগে যায়!
নিজের শরীরের সব শক্তি এক করে ঘুরে দাঁড়িয়ে মেহরাজের কলার চেপে ধরে ফুঁসে ওঠে—
“তোর এসব অসভ্য কথার জন্য তুই একদিন আমার হাতে খুন হবি, খুন!”
মেহরাজ আগের মতোই হাসতে হাসতে বলে—
“জান, খুন তো করেই ফেলেছো! তোমার এই আগুনঝরা কথাগুলো দিয়েই তো আনি একদফা খুন হয়ে গেছি, আর নতুন করে কী করবে শুনি?”
এশা বিরক্ত হয়ে ওকে ছেড়ে দেয়!
আর ভালো লাগছে না এসব!
বিরক্তি চেপে ওর পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যায়!
মেহরাজ এবার আর বেশি কিছু বলে না, শুধুই হেসে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
তারপর ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়!
মেহরাজ দরজা খুলে ঘর থেকে বের হতেই করিডোরের মোড়ে মেহরুবের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।
মেহরুব মেহরাজকে দেখেই উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে সালাম দেয়—
“আসসালামু আলাইকুম ভাইজান, কী অবস্থা?”
মেহরাজ এগিয়ে এসে মেহরুবের কাঁধে হাত রাখতে রাখতে বলে—
“ওয়ালাইকুমুস সালাম, এই তো আলহামদুলিল্লাহ। তোর কী খবর?”
মেহরুব হাসিমুখে জবাব দেয়—
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।”
মেহরাজ ওর কাঁধে হালকা চাপড় দিতে দিতে বলে—
“ভাই, মেহরুব! তুই তো দেখি আস্ত একটা পিঁপড়া হয়ে গেছিস!”
মেহরুব অবাক হয়ে মেহরাজের দিকে তাকিয়ে বলে—
“এ হঠাৎ এমন উপমা দিলেন কেন?”
মেহরাজ হাসতে হাসতে বলে—
“মানে, পিঁপড়ারা যেমন সারাক্ষণ মিষ্টির আশেপাশে ঘুরঘুর করে, তুইও দেখি ইদানীং আমার বোনের আশেপাশে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করিস !”
মেহরাজের কথা শুনে মেহরুব একগাল হেসে বলে—
“তা অবশ্য ঠিক! তবে ভাইজান, যদি আমি পিঁপড়া হই, তাহলে আপনি কিন্তু মাছি! মাছি যেমন খাবারের আশেপাশে সারাক্ষণ ভনভন করে, তুমিও কিন্তু সারাক্ষণ আমার ফুফুর আশেপাশেই ভনভন করো!”
মেহরাজ ভ্রু উঁচিয়ে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলে—
“ওরে বোকা, আমি তো তোর ভাবিকে ভালোবাসি বলেই ভনভন করি! কিন্তু তুই? তুই তো আমার বোনকে ভালোবাসিস না?
মেহরুব এবার মুচকি হেসে বলে—
“সেটা আমি কখন না বললাম?”
মেহরাজ এবার উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে—
“তা হলে তুই কি নূরিকে ভালোবাসিস?”
মেহরুব নির্দ্বিধায় বলে—
“হ্যাঁ, ভালোবাসি। ভালোবাসবো না কেন? ও আমার আপন বেগম!”
মেহরাজ এবার হেসে এক ঝটকায় মেহরুবের কাধ জড়িয়ে ধরে বলে—
“তাইলে আয় শালা! আজি তোর সঙ্গে আমার বোনের আবার বিয়ে দিমু!”
এ বলে মেহরাজ মেহরুবকে টেনে নিচের দিকে নিয়ে যেতে থাকে!
মেহরুব বারবার ছটফট করতে করতে বলে—
“ভাইজান, ছাড়ুন! ছাড়ুন তো!”
কিন্তু মেহরাজ কারো কথা শোনার পাত্র নয়!
সেই ছোটবেলা থেকে এমনটাই চলে আসছে— মেহরুব যখনই কোনো দোষ করে বা ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ত, তখন মেহরাজ ঠিক এভাবেই ওর ঘাড় চেপে ধরে বাড়িতে নিয়ে যেত!
মেহরুব হাসতে থাকে।
তার ভাইজান এমনি, সবসময় সবাইকে হাসিয়ে মাতিয়ে রাখে!
তার ভাইজান আর তার ভালোবাসা অমরত্ব পাক…
এই ভালোবাসা যেন আজীবন বেঁচে থাকে!
নাস্তা শেষে মেহনূর ঘর গুছিয়ে এহসানের সামনে সোফায় বসে আছে “! বসে থাকার কোনো কারণ নেই এমনিই বসে আছে এহসান বলেছে বসে থাকে তাই বসে আছে “!
এহসান মেহনূরের কানের কাছে গিয়ে দুষ্টামি করে বলে,
— জান, চলো না একবার অন্য জগৎ থেকে ঘুরে আসি।
মেহনূরের এহসানের এ কথা শুনেই চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সে এহসানকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
— আমি আর এক বছরের মধ্যেও আপনার কাছে যাব না।
এহসান অবাক হয়ে বলে,
— কেনো গো জান, আমি আবার কি দোষ করলাম?
মেহনূর চোখ ছোট ছোট করে বলে,
— কি করেছেন আপনি? সারা শরীর নাড়াতে পারছি না আপনার জন্য, আপনি তো নিজের মধ্যে থাকেন না, পাগল হয়ে যান! কাল সারারাত চোখ লাগাতে দেননি আমায় এক পলকের জন্যও।
এহসান ঠোঁট কেটে হেসে বলে,
— কি করব জান, বলো তো, তোমার স্বামীর কে আল্লাহ বেশিই দান করে দিয়েছেন।
মেহনূর কড়া গলায় বলে,
— তিন দিনে বিছানা থেকে উঠেছি, জ্বরে মরতে মরতে, আজ আবার মনে হয় উঠে যাবে। যা অবস্থা করছেন রাতে, এখন আবার বলছেন! এসব হবে না।
এহসান উঠে গিয়ে মেহনূরকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,
— হবে, হবে, সব হবে! এখন থেকে একটু বেশি কষ্ট সহ্য করে নিতে শিখো, কারণ এখনও আমি আমার পুরো অঙ্গিকার তোমার উপর চাপাইনি। কিন্তু এখন থেকে আর এসব হবে না।
এ বলেই এহসান মেহনূরকে বিছানায় শোয়ে দেয়।
মেহনূর উঠে বসে বলে,
— দেখুন, বাড়ির সবাই কী ভাববে, ছাড়ুন, রাতে পাবেন আপনার পাওনা। এখন নিচে যেতে হবে।
এহসান এসবে পাত্তা না দিয়ে মেহনূরের দিকে ঝুঁকতে ঝুঁকতে বলে,
— দোয়া পড়ো,
— اللهم جنبنا الشيطان وجنب الشيطان ما رزقتنا
মেহনূর আর কি করবে? যখন এ পুরুষ ধরেছো, তো ছাড়বেই না! কিন্তু ভয় করছে, এখন আবার জ্বর না চলে আসে, এখনও জ্বরের ঘোরে আছে। এর মধ্যে আবার যদি উঠে…
তাও এহসানের গলা জড়িয়ে ধরে উচ্চারণ করে,
اللهم جنبنا الشيطان وجنب الشيطان ما رزقتنا
[“হে আল্লাহ, আমাদেরকে শয়তান থেকে রক্ষা করুন এবং যে সন্তান আপনি আমাদের দান করবেন, তাকে শয়তান থেকে দূরে রাখুন।”]
এহসান মেহনূরের গলায় মুখে গুঁজে দিতে দিতে বলে,
— জান, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যদি বেশি করে ফেলি, তো দয়া করে বেশি চিৎকার করো না। মনে রেখো, এখন দিনের বেলা।
✨✨🌸
মেহনূর ঘড়ির কাঁটায় তাকিয়ে দেখে, আটটা বেজে গেছে! “অথচ এহসান তো বলেছিল, মাত্র এক ঘন্টা!”
মেহনূর এহসানকে ক্লান্ত গলায়, মলিন মুখে বলে,
— আপনি না বলেছিলেন এক ঘন্টা? দেখুন, আটটা বেজে গেছে, এবার তো ছাড়ুন।
এহসান মেহনূরের বুকে মাথা রেখেই বলে,
— আমার যাওয়ার সময় এগারোটা, তাই আটটা বাজলে বাজুক।
মেহনূরের চোখ বড় বড় হয়ে যায়, “নাহ, এমন হলে সে মরে যাবে! এই পুরুষ একদিনেই তার কিচ্ছা খতম করে দিবে! নাহ, এমন কিছু হলে হবে না!” মেহনূর রাগ নিয়ে বলে,
আত্মার আগলে পর্ব ৩৬+৩৭
— আপনার বেপরোয়া গিরি বেশি হয়ে যাচ্ছে ছাড়ুন নয়তো, তো দেখবেন আমি কি করি।
এহসান উত্তর দেয়,
— হ্যাঁ, দেখছি!
মেহনূর রেগে কিছু বলতে যাবে, এহসান মেহনূরের ঠোঁট আকড়ে ধরে!
মেহনূর এতে ছটফট করতে থাকে, এহসান তাকে ছেড়ে দিয়ে, তার গলায় মুখ গুঁজে দিতে দিতে শান্ত গলায় বলে,
— উমম, এত নড়াচড়া না, যত নড়াচড়া করবে, তত তোমার কষ্ট হবে!
এহসানের এমন ঠান্ডা গলায় গরম হুমকি শুনে মেহনূর চুপ হয়ে যায়, আর ছটফট করে না!
“এরিক প্রশান্তির হাসি হাসছে”! সে সফল আজ বেশ খুশি”! সে এবার এই খুশির কারণ কে বাস্তবে পালন করার অপেক্ষা “!