আত্মার আগলে পর্ব ৩৯

আত্মার আগলে পর্ব ৩৯
সানজিদা আক্তার মুন্নী

নূরির সামনে বসে আছে মেহরুব, বই খুলে ধরা, গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিন্তু ও ভালো করেই জানে—এটা কেবল বাহানা, ওর পড়া ধরার নামে মেহরুবের আসল উদ্দেশ্য নূরি ফুলকে দেখা।
সকালে সবার সামনে মেহরুব বলেই দিয়েছে,
— “নূরিকে এখন থেকে আমি পড়াবো। ওর পড়াশোনার কোনো আগ্রহ নেই, তাই ওকে মনোযোগী করতে হবে।”
বাড়ির লোক আর কী বলবে? সবাই রাজি হয়ে গেছে।
কিন্তু নূরি চায় না মেহরুব তাকে পড়াক। সে জানে, মেহরুব পড়ালে থাপ্পড় খেতে খেতে মরতে হবে! আর ওর অভিমান? সেটা তো আকাশ ছুঁয়েছে। ওর সাথে আর কথা বলবে না, সামনে যাবে না—এটাই ওর সিদ্ধান্ত।
কেন কথা বলবে?
সেদিন সকালে বড় আব্বা মেহরুবের কাছে তাদের বিয়ের কথা তুলেছিলেন, আর মেহরুব কী বলেছিল?

— “আমার আরও কিছু দিন সময় চাই, মাত্র কয়েক দিন, তারপর আমি ভেবে দেখব।”
মাজহারুল সাহেব রেগে গিয়ে বলেছিলেন,
— “সময় নাও! এমন সময় নাও, যাতে এর মধ্যেই নূরির বিয়ে দিয়ে দিই। তারপর যখন নূরির সন্তান তোমাকে মামা ডাকবে, তখন বুঝবে সময় কী জিনিস!”
কিন্তু তৌফিক তালুকদার আর তাজিম তালুকদার অনেক বুঝিয়ে মেহরুবকে সময় দিয়েছিলেন।
নূরি সেদিনের পর একবারের জন্যও মেহরুবের দিকে তাকায়নি, আর কথা বলা তো অনেক দূরের কথা! তবে সে মেহরুবকে দেখত, কিন্তু আড়াল থেকে।
মেহরুব অফিসে গেলে নূরি তার সব গুছিয়ে রাখত, কিন্তু সামনে পড়ত না। মেহরুব বাড়িতে থাকলে সে দরজা বন্ধ করে বসে থাকত। মেহরুব কতবার সামিকে দিয়ে চা চেয়েছে, এটা-ওটা চেয়েছে—শুধু একবার নূরির দেখা পাওয়ার জন্য! কিন্তু নূরি? ওকে সামনে পড়তে দেয়নি।
এমনকি, সকালে খাবার দিতেও সামনে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল! অজুহাত?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— “পরীক্ষা সামনে, তাই সকালেই বেশি পড়তে হবে।”
কিন্তু এখন?
মেহরুব হতাশ হয়ে বসে আছে। এ মেয়ে কিছুই পারে না! একটা প্রশ্ন করলে আরেকটা উত্তর দেয়!
সে বিরক্ত হয়ে বলল,
— “কি রে, তুই পড়ছিস না কেন?”
নূরি এবারো বইয়ের দিকেই তাকিয়ে বলল,
— “আমি মনে মনে পড়ছি।”
মেহরুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
— “সব দিক দিয়ে তো তুই মায়াবতী, গুণবতী, রূপবতী আর পড়াশোনার দিক দিয়ে তো দেখি আনডাবতী হয়ে বসে আছিস!”
নূরি মুখ শক্ত করে বলল,

— “আমার পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না।”
মেহরুব চোখ রাঙিয়ে বলল,
— “তাহলে কী করতে ভালো লাগে? সংসার করতে?”
নূরি এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল।
— “আমি কি বলেছি সেটা?”
মেহরুব চোখ ছোট করে বলল,
— “তোর আচার-আচরণ তো তাই বলে!”
নূরি মুখ ভার করে আবারও বইয়ের দিকে তাকাল।
— “আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন, আমি আর পড়ব না।”
মেহরুব টেবিলের উপর স্কেলের একটা জোরে বাড়ি দিল।
নূরি হালকা কেঁপে উঠল।
— “বেয়াদবের বেয়াদব! এত সাহস তোর হয় কী করে!”

নূরির চোখ ছলছল করছিল। এতদিনের অভিমান একসাথে হু হু করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। নিজেকে আটকানোর চেষ্টা করলেও পারল না—চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
মেহরুব হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
এই প্রথম সে নূরিকে কাঁদতে দেখল। বড় হওয়ার পর থেকে এমন দৃশ্য দেখা হয়নি। বুকের ভেতর ধক করে উঠল।
নূরি দ্রুত নিজের চোখের পানি মুছে ফেলল, মাথা নিচু করে রইল।
মেহরুব চেয়ারের সাথে টেনে ওকে নিজের সামনে ঘুরিয়ে আনল, কিন্তু নূরি মাথা নিচু করেই রইল।
মেহরুব হাত বাড়িয়ে নূরির চোখের কোনে জমে থাকা অশ্রুটা আলতো করে মুছে দিয়ে ব্যাকুল গলায় বলল,
— “কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন?”
নূরি নিচু গলায় বলল,

— “হঠাৎ ভয় পেলাম, তাই চোখে পানি এসে গেছে।”
মেহরুব মেকি হাসল।
— “এটা ভয়ের কান্না নয়, এটা অভিমানের কান্না।”
নূরি মলিন কণ্ঠে বলল,
— “কার উপর অভিমান করব? কে আছে আমার অভিমান করার মতো?”
মেহরুব এবার গভীরভাবে তাকাল ওর দিকে, নরম স্বরে বলল,
— “কেন? আমার উপর তোর আপন পুরুষের উপর?”
নূরি কিছু বলে না, শুধু মনে মনে বলে—
“হু, এসেছেন নাটকবাজ! আপন পুরুষ? যখন বিয়ের কথা ওঠে, তখন কি নাটক করে?”
মেহরুব নূরির চেয়ারের হাতলে নিজের দুই হাত রাখে, ওর দিকে হালকা ঝুঁকে আসে। কণ্ঠস্বরে মৃদু শাসন আর গভীর মায়া মিশিয়ে বলে—

— “আজ চারদিন ধরে আমার সামনে আসলি না কেন? আমার কষ্ট হয়, বুঝিস না? কেন এলি না, বল! আমার ভেতরটা ক্ষয়ে যাচ্ছিল তোকে না দেখে… তুই কি তা বুঝিসনি? আমি তোর নেশায় বাঁচি, তোকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকি। সেটা জেনেও তুই কী করে আমার থেকে আড়ালে থাকলি, বল?”
নূরি তার কথায় চোখ তোলে, একপলক তাকিয়ে ফের অন্য দিকে মুখ ঘোরায়। ঠোঁট কাঁপে, তবু গলায় অভিমান ঝরে পড়ে—
— “আমি কি কোনো জোকার নাকি? যে আপনি আমায় দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকবেন? এত নাটকের কথা কেন বলছেন, মেহরুব ভাই?”
মেহরুব মুচকি হাসে, বুঝতে পারে তার নূরি ফুল অভিমান জমিয়ে রেখেছে।

— “খুব অভিমান হয়েছে বুঝি, নূরি ফুল আমার উপর?”
নূরি মুখ গোমড়া করে উত্তর দেয়—
— “কে আপনি? আপনার উপর অভিমান করব আমি? আমি কে আপনার?”
মেহরুব আলতো হাত বাড়িয়ে নূরির গালে ছুঁয়ে দেয়। মুচকি হেসে বলে—
— “তুই আমার নূরি ফুল… আমার ফুল… আমার ব্যক্তিগত ফুল!”
নূরি চট করে মেহরুবের হাত সরিয়ে দেয়। কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে—
— “এসব মিথ্যা কথা বলবেন না, মেহরুব ভাই। আমি জানি…”
মেহরুব এবার নূরির দুই গাল আলতোভাবে ধরে, চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করে—
— “কি জানিস? বল।”
নূরি মেহরুবের চোখের গভীরে তাকিয়ে ফিসফিস করে—

— “আমি জানি, আপনি অন্য কাউকে পছন্দ করেন… তাই তো আমায় মেনে নিতে এত হেয়ালি করেন?”
এ বলেই নূরির চোখ দিয়ে টুপটাপ অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সে নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলে—
— “আপনি আপনার প্রিয় নারীর সাথে সংসার শুরু করতে পারেন, আমি অনুমতি দিলাম… তাও আমায় তালাক দেবেন না, মেহরুব ভাই।”
তালাকের কথা শুনে মেহরুবের বুক ধক করে ওঠে। কী বলছে এই মেয়ে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে নূরির গাল মুছে দিয়ে বলে—
— “তোর মনে হয় আমি তোকে তালাক দেব? তোর মনে হয় আমি এমন পুরুষ যে হারাম নারীর প্রতি মনে অনুভূতি রাখব?”
নূরি এবার শব্দ করে কেঁদে ফেলে। এত বছর ধরে তার ছোট্ট মনে জমে থাকা অভিমান যেন কান্না হয়ে গলে পড়ছে। এত কষ্ট করার পরও সে নিজেকে সামলাতে পারছে না।
নূরি নিজের দুই হাত দিয়ে মেহরুবের থেকে মুখ সরিয়ে নেয়, মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে ওঠে—

— “আমার কাছে আপনি শ্রেষ্ঠ একজন পুরুষ… কিন্তু আপনার ব্যবহার তো আমায় তা বলে না! আপনার আচরণ তো বলে আপনি অন্য কাউকে চান, আমায় নয়!”
মেহরুব মুচকি হেসে নূরির থুতনি ধরে নিজের দিকে ফেরায়। গভীর চোখে চেয়ে বলে—
— “আবার বিয়ে করবি আমায়? কবুল পড়বি আরেকবার আমার নামে?”
নূরি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। ঠোঁট কাঁপছে, চোখের জল শুকিয়ে আসছে। কাপা কাপা গলায় বলে—
— “আপনি তো করবেন না…”
মেহরুব হাসে—
— “আমি যদি বলি, আজই তোর নামে আবার কবুল পড়ব, তুই রাজি থাকবি?”
নূরি নিস্পলক তাকিয়ে থাকে। কয়েক মুহূর্ত পর অস্ফুট স্বরে ফিসফিস করে—

— “মজা করছেন… মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছেন?”
মেহরুব নূরির হাত ধরে টান দেয়—
— “চল, তাহলে বাড়ির সবার সামনে গিয়ে বলি।”
নূরি চমকে যায়, লজ্জায় তড়িঘড়ি করে মেহরুবের হাত আঁকড়ে ধরে বসিয়ে দেয়—
— “ছিঃ ছিঃ! কী করছেন? এসব লাগবে না!”
মেহরুব হাসে, আবার চেয়ারে বসে। হাত বাড়িয়ে নূরির গাল টেনে আদুরে গলায় বলে—
— “ওরে আমার টুনির মা রে! এত লজ্জা তুই কোথায় পাস রে?”
নূরি লজ্জায় গুটিয়ে যায়। এই পুরুষের সামান্য ভালোবাসাতেই সে শেষ হয়ে যায়, তাহলে বাকি জীবন কী করবে? লজ্জা পেতে পেতে কি মরে যাবে?
নূরি হাত কচলাতে কচলাতে বলে—
— “কী যে বলেন না, মেহরুব ভাই!”
মেহরুব মুচকি হেসে চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে থাকে, অতঃপর নূরির গালে আলতো টুকা মেরে তারপর বলে—
— “টুনির মা, তোর টুনির বাপ হব আমি… তাই অন্তত ভাই বলা টা বাদ দে!”
নূরি শিউরে ওঠে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কাঁপছে। লজ্জায় কান গরম, মনে হচ্ছে ধোঁয়া বেরুচ্ছে! হাসি পাচ্ছে, কিন্তু হাসতেও পারছে না।
কাচুমাচু হয়ে বলে—

— “এসব বলবেন না, কেমন লাগে!”
মেহরুব হেসে নূরির গালে ঠক করে টোকা মারে—
— “লজ্জা পেতে পেতে হার্ট অ্যাটাক করে নিস না! তুই যদি আ্যাটাক করিস, তাহলে আমার টুনির বাপ হওয়া আর হবে না!”
নূরির মনে হচ্ছে, সত্যিই সে লজ্জায় মরে যাবে!

নির্বাচনের দিন
অতঃপর আজ সেই কাঙ্ক্ষিত দিন—নির্বাচনের দিন!
সকাল থেকেই এহসান এবং তার লোকজন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। নির্বাচন মানেই উত্তেজনা, দায়িত্ব আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মিশেল।
। সুবেহ সাদিকের পর এহসান তার বাপ ভাই সবাই বেরিয়ে পড়েছেন তার দলবল নিয়ে। একের পর এক ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করছে সে, নিশ্চিত করছে সব কিছু যেন ঠিকঠাক থাকে। তার সাথে রয়েছে বিশ্বস্ত সহকর্মী, কর্মী ও সমর্থকরা।
কেন্দ্রে পৌঁছেই সে পোলিং এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়—
— “ভোটার তালিকা ঠিকভাবে মিলিয়ে দেখবে। কোনো অনিয়ম দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে জানাবে!”
বাইরে তার দলের কর্মীরা ব্যস্ত। কেউ ভোটারদের নামের স্লিপ দিচ্ছে, কেউ বৃদ্ধদের হাত ধরে কেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছে। ভোট যেন নির্ভয়ে দিতে পারে সবাই, সেই ব্যবস্থা করছে তারা।
এহসান তার লোকজনকে বারবার সতর্ক করছে—

— “কাউকে যেন ভয় দেখানো না হয়, কোনো বিশৃঙ্খলা চাই না!”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সাথেও সে কথা বলে, যেন নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়। সাংবাদিকরা যখন ছবি তুলতে আসে, সে আত্মবিশ্বাসী হাসি দিয়ে বলে—
— “আমরা স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচনের জন্য কাজ করছি। আমাদের লক্ষ্য মানুষের সেবা করা।”
সমস্ত দিনজুড়ে কেন্দ্র থেকে কেন্দ্রে ছুটে বেড়াচ্ছে এহসান ও তার দল। কোথাও কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, তা নজরে রাখছে। চারদিকে শুধু একটাই আলোচনা—এই নির্বাচন কার বিজয়ের দ্বার খুলে দেবে?
এদিকে বাড়িতে এহসানের পরিবার উৎকণ্ঠায় ডুবে আছে। সালাতুল হাজত পড়ছে একের পর এক। আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করছে—
— “হে আল্লাহ, আমাদের এহসানকে বিজয় দাও!”
তবে মেহনূর এই দোয়ার মাঝে নেই। সে চায় না এহসান জয়ী হোক।
সে জানে, এহসানের ক্ষমতা বাড়লে তার আত্মতৃপ্তির আগুন আরও দাউদাউ করে জ্বলবে। আরও ক্ষমতালিপ্সু হবে, আরও ন্যায়-অন্যায়ের সীমারেখা মুছে দেবে।
মেহনূর চায় না তার ভালোবাসার মানুষটি পাপের অন্ধকারে ডুবে থাকুক। সে চায়, এহসান ফিরে আসুক, ক্ষমতার নেশা ভুলে একটা পবিত্র জীবন বেছে নিক।
তার চোখে কান্না জমে, মনে হাজারো দোটানা। একদিকে স্বামী, অন্যদিকে সত্যের পথ—

কোন পথে যাবে সে?
এহসান কি বুঝতে পারবে, ক্ষমতা নয়—তার জন্য অপেক্ষা করছে ভালোবাসার এক নতুন সকাল?
বিকেল তিনটা।
সূর্য তখনো পশ্চিম আকাশে ঝুলছে, আলো নরম হতে শুরু করেছে।
এহসান ধীর পায়ে এগিয়ে আসে ভোটকেন্দ্রের দিকে।
ভোট প্রায় শেষের পথে, হাতে গোনা দু-একজন ভোটার বাকি। কেন্দ্রের কর্মীরা ক্লান্ত, চারপাশ নির্জন হয়ে এসেছে।
এহসান সঙ্গে এনেছে শুধু হাসিবকে।
তার অন্যসব কর্মী ছড়িয়ে রয়েছে অন্য কেন্দ্রে, পাহারায়।
সে জানে, রাকিব কিছু একটা করবেই।এখন যে কোনো মুহূর্তে আঘাত আসতে পারে।
তবু সে এসেছে।
অন্য প্রান্তে…

কেন্দ্রের সামনের দালানে বসে আছে ওঁৎ পেতে এরিক।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে সুযোগ এসেছে।
তার হাতে ধরা স্নাইপার রাইফেল, স্ট্যান্ডে সেট করা।
এক হাতে রাইফেলের ট্রিগার স্পর্শ করছে, অন্য হাতে একটা ছোট রিমোট।
সেই রিমোটের লাল বোতামের দিকে তাকিয়ে তার ঠোঁটের কোণে বিকৃত হাসি ফুটে ওঠে।
তার ব্রাউন চোখ দুটো ক্রোধে জ্বলছে।
একটি চাপ… আর এক মুহূর্তে ধ্বংস!এরিক চোখ বন্ধ করে রিমোটের বোতামে চাপ দেয়।
“টাশ!”
একটা তীব্র শব্দ, মাটিতে কেঁপে ওঠে!
বিস্ফোরণ!
এহসান আর হাসিব স্থির হয়ে যায়।
তারা তখন ভোটকেন্দ্রের এক পাশে দাঁড়িয়ে অন্য একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছিল।
তাই প্রাণে বেঁচে যায়।

কিন্তু কেন্দ্রে ভেতরে থাকা মানুষগুলো?রক্ত, ধ্বংস আর মানুষের চিৎকার!
চারদিকে মানুষের চিৎকার, কান্না, হাহাকার।পোড়া মাংসের গন্ধ বাতাসে মিশে গেছে।
এহসানের চোখ ছুটে যায় সামনে।
সেখানে একটা দুঃস্বপ্নের দৃশ্য।চারপাশে ছিন্নভিন্ন লাশ।
কেউ হাত হারিয়েছে, কেউ পা।এইমাত্র যারা ছিল, কথা বলছিল, ভোট দিচ্ছিল—
তারা কেউ নেই!
এহসান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
শরীর শক্ত হয়ে আসে, রাগ, যন্ত্রণা আর হতাশা মিশে এক ধরণের শূন্যতা তৈরি হয় বুকের ভেতর।
কীভাবে এটা হলো?
এত নিরাপত্তার মাঝে?
এই কয়েক মুহূর্ত আগেও তো সব ঠিক ছিল!এটাই তো ভয় পেয়েছিল সে!
এটাই হলো!
সে থমকে এসব দেখছে
বোমা ওত তীব্র না হওয়ায় আশেপাশে ওত ক্ষতি হয়নি কেন্দ্রের দালান ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু উঠনে থাকা মানুষগুলো

তারা সবাই উড়ে গেছে!
হাসিব তাকিয়ে আছে নির্বাক চোখে।তার মুখ থেকে একটা কথাও বেরোচ্ছে না।
এহসান সামনে পা ফেলে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ধ্বংসস্তূপের দিকে।
তার চোখে একটা প্রতিজ্ঞা জ্বলছে।এই রক্তের প্রতিশোধ সে নেবেই।
তখনি
বিকট শব্দে বাতাস কেঁপে ওঠে।
গুলির শব্দ!
ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে আসা ধাতব বিস্ফোরণটা এহসানের বুক ভেদ করে যায়!
তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে, নাক-মুখ কুঁচকে ওঠে তীব্র যন্ত্রণায়। বুকের বাম পাশে হাত চলে যায় আপনাআপনি, যেন গুলিটা হাত দিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে চায়!
কিন্তু কিছুই থামানো যায় না।

শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
ফুসফুসের ভেতর কোথাও একটা ছিঁড়ে গেছে যেন, বুকের গভীর থেকে আসা এক অনাহুত যন্ত্রণা তাকে নুইয়ে ফেলতে চায়।
সে দাঁতে দাঁত চেপে রাখে, কিন্তু ব্যথার তীব্রতায় শরীর আর সায় দিচ্ছে না।
ধপ!
পা টলতে থাকে, শরীরের ভার ধরে রাখতে পারে না।
সে পড়ে যেতে থাকে মাটির দিকে।
“ভা-ভা-ভাইজান!”
এক চিৎকার করে দৌড়ে আসে হাসিব।
দৃশ্যটা তার চোখের সামনে ধোঁয়ার মতো দুলতে থাকে—

এহসানের সাদা পোশাক লাল হয়ে গেছে, তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে।
হাসিব ছুটে এসে তার ভাইয়ের শরীর ধরে ফেলে, যেন কোনোভাবেই মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেবে না!
কিন্তু আরও একটি গুলি!শব্দটা যেন পুরো বিশ্বটাকে স্তব্ধ করে দেয়।
এহসানের বাহুতে এসে বিঁধে তীক্ষ্ণ ধাতব টুকরো।
সে আর ধরে রাখতে পারে না নিজেকে—
লুটিয়ে পড়ে মাটিতে!
অসহায় হাতে এক দলা মাটি আঁকড়ে ধরে এহসান, আঙুলগুলো রক্তে মাখামাখি হয়ে যায়।
সে কাঁপছে!
তবুও কিছু বলার চেষ্টা করছে।
বুকের নিচ থেকে উঠে আসা কষ্টগুলো গলায় এসে আটকে যাচ্ছে।
সে চেষ্টা করছে কালেমা পড়তে।কিন্তু কিছুতেই পারে না!
গলা দিয়ে শুধু একটা চাপা শব্দ বেরোয়, আর সাথে এক গাল রক্ত!
রক্তের সাথে যেন সব কিছু বেরিয়ে আসছে—

বেঁচে থাকার আকুতি, আপনজনের মুখ, হারিয়ে যাওয়া শৈশবের দিন, প্রাণের মানুষদের হাসিমাখা মুখ…
সব একসাথে মিলে মিশে যাচ্ছে রক্তের গাঢ় লাল স্রোতের সাথে।
এহসান তীব্রভাবে চোখের পাতা ফেলে, মাটির সাথে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে হাত—
এতক্ষণ ধরে জীবনটা যে ধরে রেখেছিল, এখন যেন সেটা হাত ফসকে যাচ্ছে।
হাসিবের চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছে—
“ভাই… ভাইজান!”
এহসানের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। শরীর নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।সে চেষ্টা করছে কালেমা পড়তে।
— “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ…”
কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হয় না!
বরং এক গাল রক্ত উঠে আসে মুখ দিয়ে।তার সামনে যেন আজরাইল দাঁড়িয়ে আছেন।
চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক মায়াবী মুখ—স্নিগ্ধ, কোমল, আশ্রয়দায়ী। মেহনূর!
তার কানে বেজে ওঠে সেই ভয়ংকর আয়াত—

لا تَجأَرُوا اليَومَ إِنَّكُم مِنّا لا تُنصَرونَ
আজ তোমরা সজোরে আর্তনাদ করো না। নিশ্চয় তোমরা আমার পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না।
[৬৫] আল মুমিনূন
সে ভয়ে আবার চেষ্টা করে।
— “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ…
না! গলা দিয়ে আর কালেমা বের হয় না”! বের হয় রক্ত !
, হাত দিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরে, যেন শেষবারের মতো কিছু বলতে পারে।

আত্মার আগলে পর্ব ৩৮

কিন্তু পারে না।
তার চারপাশ ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসে।একটি দীর্ঘশ্বাসের সাথে এহসানের শরীর নিথর হয়ে যায়।
হয়তো চলে যেতে নেয় দুনিয়া ছেড়ে “!

আত্মার আগলে পর্ব ৪০