আত্মার আগলে পর্ব ৪

আত্মার আগলে পর্ব ৪
সানজিদা আক্তার মুন্নী

“এনিসা বেগম আর এমরানের বেগম আমেনা, এনামের বেগম আয়শা আর এশা—সবাই এক প্রকারে ছুটে যায় এহসানের কক্ষের দিকে! গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ে। এহসান এসে দরজা খুলে দিতেই হুরর করে সবাই কক্ষে প্রবেশ করেন। এনিসা বেগম গিয়ে অবচেতন মেহনূরের পাশে বসেন। মেহনূরের এমন অবস্থা দেখে এনিসা বেগম রেগে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,
— বিয়ে করেছিস বলে মাথা খেয়ে নিয়েছিস, তাই না? এখন যা ইচ্ছে তাই করবি তুই! মেরে ফেলবি পরের মেয়ে? কী করে পারলি এমন অবস্থা করতে ওর?
এহসান মায়ের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— ও পরের মেয়ে আগে ছিল, এখন ও আমার আপন অর্ধাঙ্গিনী। আর রইল এমন অবস্থার কথা, এটার জন্য সে নিজেই দায়ী! পালাতে যাচ্ছিল ফাঁকি দিয়ে। আর তোমরা কোথায় ছিলে, শুনি? আস্ত একটা মানুষ এত বড় মহল থেকে বেরিয়ে গেলো আর তোমরা খবরও পেলে না! নাকি ইচ্ছে করেই ওকে পালাতে দিয়েছো? কোনটা শুনি?
এ বলে বেরিয়ে যেতে নেয়, ফের ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
— এই অসভ্য বেয়াদবের জ্ঞান ফিরাও আর কিছু খাওয়াও। আমি আসছি।
এ বলে বেরিয়ে আসে নিজ কক্ষ থেকে। নিচে এসে দেখে সোফায় ওর বাবা বসে আছেন আর মেঝো ভাই এনাম। তাদের নিকট গিয়ে বসে এহসান বলে,
— আব্বা, এখন আপনি তোমার ছোট ভাইরে ফোন দিবেন।
মুস্তফা সাহেব শান্ত সুরে বলেন,
— কেন?
এহসান নিজের চাদর ঠিক করতে করতে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— আর বলবেন যে উত্তরের মাঠে আসতে। যদি ওরা ওদের মেয়েকে ফিরত চায়, জমির কাগজ নিয়ে আসতে। ওদের সাথে কিছু বুঝাপড়া বাকি আছে আমার এখনও।
এনাম এতে বলে উঠে,
— কী হয়েছে তোর? উল্টো পাল্টা বলছিস! তুই এখন ওকে বিয়ে করে আবার ফিরত দিবি? পাগল হয়ে গেছিস?
এহসান আলতো হেসে বলে,
— পাগল আমি হইনি, পাগল করব আমি ওদের। আব্বা, আপনাকে যা বললাম, শুধু এতটুকু করুন।
এদিকে মেহনূরের জ্ঞান আসে। কিন্তু মেহনূর একদম নিস্তেজ হয়ে গেছে। শুধু অঝোরে কাঁদছে, এনিসা বেগমকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরছে বারবার। এনিসা বেগম মেহনূরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর শান্ত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এতেও কিছু হচ্ছে না। তখনই আবারও এহসান কক্ষে আসে। এসে মেহনূরকে সজ্ঞানে দেখে একটু স্বস্তি পায়। অতঃপর গম্ভীর গলায় বলে,

— আম্মা, সবাইকে সকালের খাবার দিতে হবে, তোমরা ভুলে গেছো।
এ কথায় সবাই বুঝে যান, এহসান তাদের এখান থেকে যেতে বলেছে। কিন্তু মেহনূর চিৎকার করে কান্না শুরু করে দেয় আর এনিসা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— দাদু, দাদু, তুমি যাবে না। তোমার ছেলে আমায় মেরে ফেলবে। দাদু, যাবে না তুমি!
এনিসা বেগম ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,
— কিচ্ছু করবে না তোর সাথে এহসান। আর আমায় তো যেতে হবে। সবাইকে নাস্তা দিতে হবে।
অনেক কষ্টে এনিসা বেগম নিজেকে মেহনূরের থেকে ছাড়িয়ে সবাইকে নিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান।
ওরা যেতেই এহসান টাশ করে কক্ষের দরজা লাগিয়ে দেয়। এমন পরিস্থিতি দেখে মেহনূরের ভয় দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এহসান ওর দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে। একসময় এহসান মেহনূরের একদম নিকটে চলে আসে। মেহনূর ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে দুই হাত দিয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরে। মেহনূরকে কাঁদতে দেখে এহসান হো হো করে হেসে উঠে আর বলে,

— ব্যস, এই শেষ! তোমার সাহস, ওহে আমার সাহসী নারী! গেল কোথায় তোমার এত সাহস?
এ বলে আরেকটু ঝুঁকে এহসান মেহনূরের দিকে। এতে মেহনূর চিৎকার করে বলে,
— আমার কাছে আসবেন না। আপনি একটা পাপ, আপনি অপবিত্র! একটা কলঙ্ক “!
এহসান মেহনূরের ঠোঁটে আলতো করে নিজের শাহাদাত আঙুল রেখে ফিসফিসিয়ে বলে,
— হ্যাঁ, আমি পাপ, আমি অপবিত্র, আমি কলঙ্ক, কিন্তু আমার এত পাপ, এত অপবিত্রতা, এত কলঙ্কের মাঝেও তুই আছিস, তো আমার এক পবিত্র অস্তিত্ব”!
মেহনূর ভয়ে কিছু বলতে পারছে না, আর না পারছে নিজের থেকে এহসান কে সরাতে! এহসান নিজেই মেহনূরের থেকে হাত সরিয়ে নেয়, আর হুমকির সুরে বলে,
— “এর পর এমন কিছু করেছিস তো, এই আমি আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি তোর অস্তিত্ব এই দুনিয়া থেকে ঝেড়ে ফেলব!”
মেহনূর নিজের কান্না ঠোঁট কামড়ে থামানোর চেষ্টা করে বলে,

— “কেনো তুলে আনলেন আমায়, ওভাবে ছেড়ে দিতেন, মরে যেতাম এতক্ষণে!”
এহসান মেহনূরের সামনে বসে, ওর গাল বেয়ে অঝোর ধারায় যে চোখের জল ঝড়ছে তা মুছতে মুছতে বলে,
— “তোকে এত সহজে মরতে কি রে দেই? তোকে যে আমার দোহনে তিলে তিলে পুড়ে মরতে হবে সারাজীবন!”
মেহনূর ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিয়ে বলে,
— “আমায় স্পর্শ করবেন না, আপনার স্পর্শ যে আমার জন্য এক ভয়ংকর কলঙ্ক, আল্লাহর ওয়াস্তে আমায় স্পর্শ করবেন না, আমার পবিত্রতা নষ্ট করবেন না!”
এহসান মেহনূরের গাল আলতো করে ধরে বলে,
— “”আমার অপবিত্রতা শুধু তোমার শরীর নয়, স্পর্শ করবে তোমার অন্তরও। এই কলঙ্কের ছোঁয়াই তোমার পবিত্রতা কে করবে কলঙ্কিত।”
মেহনূর স্তব্ধ হয়ে যায়! মুখে দিয়ে আর কথা বের হচ্ছে না, শুধু আঁখি দিয়ে জল গড়াচ্ছে তার! এহসান আবারও অতি আদলে মেহনূরের চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,
— “এতটুকুই, এত কাঁদলে হবে! তোমায় যে সারাজীবন কাঁদতে হবে!”
মেহনূর কান্না চেপে গলায় বলে,
— “কেনো বিয়ে করছেন? কেন আপনি আপনার পাপের সাথে আমায় জড়িয়েছেন?”
আচমকা এহসান মেহনূরের মাথা নিজের বলিষ্ঠ বক্ষস্থলে জড়িয়ে ধরে আর ফিসফিসিয়ে বলে,

— “জড়াইনি, জড়িয়ে গেছিস! তোর প্রতি অনুভূতি নিজ থেকে তৈরি হয়নি! ভালোবাসতে চাইনি, তাও ভালোবেসে ফেলেছি! তোর মায়ায় ডুবতে চাইনি, তাও ডুবে গেছি! নিজের অজান্তেই তোকে নিজের #আত্মার_আগলে আঁকড়ে ফেলেছি!”
মেহনূর এখন বাক্যহীন, কখনো কোনো পুরুষের এতটা সংস্পর্শে আসাতো দূরের কথা, বুঝ হবার পর থেকে নিজের বাড়ির পুরুষ ছাড়া অন্য পুরুষের সামনেও পড়েনি! অথচ আজ তাকে একজন পাপিষ্ঠ পুরুষ নিজ বক্ষস্থলে এভাবে জড়িয়ে ধরেছে, যদিও সে তার জন্য হালাল, তবে মন থেকে তো সে হারাম! সারা শরীর বরফের ন্যায় জমে গেছে পুরুষালী স্পর্শে! ভয়ে কলিজা ফেটে যাচ্ছে! ঢোক গিলতেও পারছে না, কষ্ট হচ্ছে! এর মধ্যে এহসানের গায়ের সেই অদ্ভুত সুগন্ধির ঘ্রাণ এতকিছুর মধ্যেও, এই ঘ্রাণটা মেহনূরকে আরও অস্থির করে তুলছে, মনে হচ্ছে আরও ভালো করে নাক দিয়ে শুকতে এই। ঘ্রাণটা কিন্তু তা কখনোই নিজের পক্ষে সম্ভব নয়, এটা করলে নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা আসবে!
এহসান অনবরত নিজের হাত দিয়ে মেহনূরের চুলে হাত বুলাচ্ছে! নিজ মন আজ এতটা খুশি সে যে কি বলবে? বারবার আলহামদুলিল্লাহ পড়ছে মনে মনে, যে এতটা সৌভাগ্য, যে নিজের প্রাণপ্রিয় নারীকে, স্বপ্নের নারীকে এভাবে হালালভাবে জড়িয়ে ধরার তকদীর হয়েছে তার! কয় পুরুষেরি বা এমন কলঙ্কিত ভালোবাসা পূর্ণতা পায়? তাইতো এত খুশিতে একখানা কোরআন খতম মেনেছে, আর দুইটা গরু কোরবানি করার নিয়ত করেছে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য!

টানা পাঁচ মিনিট মেহনূরকে নিজের বক্ষস্থলে লেপ্টে রাখার পর, এহসান মেহনূরের দুই হাতের বাহু আলতো করে ধরে, নিজের বক্ষস্থল থেকে আলাদা করে! মেহনূর যদি পারত, তাহলে ছিটকে দূরে সরে যেত, কিন্তু তা যে সম্ভব নয়, এহসান তার বাহু ঠিকই জড়িয়ে ধরে আছে!
মেহনূর এবার আর কাঁদে না, নিজের ভিতরের দুর্বলতা, ভয়কে একপ্রকার চাপা দিয়ে, এহসানের চোখে চোখ রাখে, কিন্তু এতেও ভিতর কাপছে, অন্তর, তাও যথেষ্ট নরম কন্ঠে বলে,
— “কেনো বার-বার নিজের অপবিত্র স্পর্শ দ্বারা আমায় স্পর্শ করছেন?”
এহসান মৃদু হেসে ডান হাতে মেহনূরের গাল স্পর্শ করে বলে,
— “বলেছি তো একবার, আমার অপবিত্র স্পর্শ তোর পবিত্রতা কে আলিঙ্গন করবে হাজারোবার!”
তখনি এশা দরজার বাহিরে থেকে ডাক দেয়, এহসান গিয়ে দরজা খুলে দিলে, এশা এহসানের হাতে একটা ট্রে ধরিয়ে দেয় যাতে এক বাটি সুপ আর কিছু ফল ছিল! এশা বলে,

— “এগুলো মেহনূরের!”
এহসান বলে,
— “হুম, তুই যা!”
এশা চলে যায়, এহসান খাবার নিয়ে মেহনূরের সামনে এসে বসে আর বলে,
— “তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, তোকে তোর বাপ চাচার সাথে দেখা করতে যেতে হবে!”
মেহনূর এমন কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
— “বাচ্চা না আমি!”
এহসান গম্ভীর গলায় বলে,
— “জানি, তুই বাচ্চা না, আমার ভবিষ্যৎ বাচ্চার মা, এটা বলতে হবে না!”
মেহনূর ঘৃণার চোখে তাকিয়ে বলে,
— “একটু লজ্জা করে না, একটুও করে না এমন বাণী মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে!”
এহসান এক চামচ সুপ বাটি থেকে নিতে নিতে বলে,
— “নাহ, লজ্জা করে না! আগেই তো বলেছি, কাপুরুষদের বউয়ের সামনে লজ্জা করে, পুরুষদের নয়!
মেহনূর দাঁত চেপে কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে, তখনই এহসান মেহনূরের মুখে সুপের চামচ ঢুকিয়ে দেয় আর হুমকির সুরে বলে,

— “আমি মজার মানুষ নই, তাই মজা করছি না, সত্যি তোকে তোর বাপ চাচার সাথে দেখা করতে যেতে হবে, তাই চুপচাপ খেয়ে নে!”
মেহনূর চুপচাপ খেয়ে নেয়, সত্যি বলতে সে খুদার যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না, তাই তো চুপ করে এহসান মুখে যা দেয়, বিষ মনে করেই খেয়ে নেন!
খাওয়া শেষ হলেই দরজায় আবারও কড়া নড়ে! এহসান হালকা করে দরজা খুলল, দেখলো হাসিব এসেছে, তার ডান হাত বাম হাত হাসিব! হাসিব এসে বলল,
— “ভাইজান, উত্তর মাঠে আপনার জন্য ছোট তালুকদার আর তার ছেলে নাতিরা অপেক্ষা করছেন!”
এহসান মুচকি হেসে বলে,

— “তুই গাড়ি রেডি কর, আমি আসছি!”
এ বলে দরজা লাগিয়ে মেহনূরের দিকে তাকায়! আর বলে,
— “তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে, যেতে হবে!”
মেহনূর সোজা উত্তর দেয়,
— “মেরে ফেলবেন নিয়ে আমায়!”
এহসান কাবাড থেকে নিজের পিস্তল পাঞ্জাবির পকেটে নিতে নিতে বলে,
— “বাপ চাচার মুখ সারাজীবনের মধ্যে যদি দেখতে চাস একবার, তো চল, নয়তো আর সুযোগ পাবি না!”
এ বলে ক্যাবিনিট থেকে একটা প্যাকেট ছুঁড়ে মারে মেহনূরের দিকে, আর বলে,
— “তাড়াতাড়ি বোরখা পড়ে তৈরি হয়ে নে!”
মেহনূর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, অতঃপর বোরখা পড়ে নেয়, হিজাব নিকাব একপ্রকার নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেকে নেয় মাথা থেকে পা অবধি!
এহসান মেহনূরের হাত ধরে বেরিয়ে যায় কক্ষ থেকে! আর মেহনূর কলিজা বারবার ফেটে পড়ছে, এই মনে হচ্ছে সে মুক্তি হবে, আবার এই মনে হচ্ছে তা কখনো সম্ভব নয়!
এহসান নিচে এসে তার মা কে ডাক দেয়,

— “আম্মা, আম্মা….”
এনিসা বেগম তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসেন! তিনি জানেন যে এখন তার ছেলে উত্তর মাঠে যাচ্ছে, তাই এহসান কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলেন,
— “যাচ্ছো তো বাবা, যাও তবে মাথায় রেখো, কোনো মায়ের বুক যাতে খালি না হয়!”
এহসান উত্তর বলে,
— “ইনশাআল্লাহ, আশা করি এমন কিছু হবে না!”
এ বলে মাকে আর বাবা কে সালাম দিয়ে সদর দরজা পাড় করে! গেটে অতিক্রম করতেই মেহনূরের চোখ থাক লেগে যায়।এক সারিতে পুরো দশটা গাড়ি! এহসান মাঝখানের একটা গাড়িতে ওকে নিয়ে প্রবেশ করে, অতঃপর গন্তব্য হয় উত্তরের মাঠ! এই মাঠ শুধু মাঠ নয়, একটা যুদ্ধক্ষেত্র—এই মাঠের মাটি যে কত রক্ত খেয়েছে, কত মানুষের মাংস নিজের বুকে চেপে রেখেছে, তা অজানা! এই মাঠে যে কত রক্তের ইতিহাসের সাক্ষী তা আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন “! তাইতো মেহনূরের কলিজা বেরিয়ে আসার উপক্রম।

দশ মিনিট পর উত্তরের বিশাল মাঠে গাড়িগুলো থামে একসাথে! সামনের গাড়ি থেকে কালো পোশাক পড়া বিশজনের মতো গার্ড বের হয়, অতঃপর পিছনের গাড়িগুলো থেকে এহসানের লোকেরা, যারা সাধারণ পোশাক পরা, তবে একেকজন শিকারীর চেয়ে ভয়ংকর! এরপর এহসানের গাড়ির দরজা খুলে দেয় হাসিব, কোনোরকম তাড়াহুড়ো না করে। এহসান গাড়ি থেকে নিজের দুই পা মাটিতে রাখে, অতঃপর গলায় ঝুলে থাকা চাদরখানা কাঁধে ফেলে! মেহনূরের দিকে হাত বাড়ায়! ভয়ে মেহনূরের সারা শরীর অসাড় হয়ে গেছে! হাত কাপছে, এই কলঙ্কিত হাতে হাত রাখতে, তবে উপায় যে নেই, তাই এহসানের হাতে হাত রাখে! এহসান তাকে গাড়ি থেকে নামায়।
গাড়ি থেকে নেমেই মেহনূরের চোখ পড়ে কিছুটা দূরে, নিজের আপনজনের দিকে—কিছুটা দূরে ওর বাবা আর ছয় চাচা-সহ আর একজন অচেনা পুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন! তাদের পিছনেও অনেক লোকজন রয়েছে!
এহসান ধীরে ধীরে মেহনূরের হাত ধরে এগিয়ে যায়, তাদের দিকে একপর্যায়ে এসে দাঁড়ায়!
মেহনূরের মেঝো চাচা কিছু বলতে যাবেন, কিন্তু মেহনূরের বাবা তাকে হাত দিয়ে থামিয়ে, নিজে এহসানের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,

— তোদের জমির ভাগ তোরা নিয়ে নে, আর আমার মেয়ে কে আমায় দিয়ে দে, এই নে দলিল।
এবলে দলিল এগিয়ে দেন এহসানের কাছে।
এহসান মেহনূরের হাত ছেড়ে দলিল হাতে নেয়, কিছু সময় এক নজরে দলিল পরখ করে নেয়। এদিকে মেহনূরের ঘৃণায় গা ঘিন ঘিন করছে, যে এতজন পুরুষের মধ্যে সে দাঁড়িয়ে আছে, ঘৃণায় চোখ ভিজে আসছে!
তখনই এহসান মেহনূরের বাবার মুখে উক্ত দলিল ছুড়ে মারে! এতে স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা পরিবেশ! মেহনূরের চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে, তার আব্বা, যে তার দুনিয়া, আর সেই আব্বা কে এত বড় অপমান করা হলো, তার জন্য কন্যা হিসেবে লজ্জিত সে! মেয়ে নামের কলঙ্ক সে!
তখন এহসান তাচ্ছিল্য করে বলে
— তোদের দলিল তোরা নে, তোদের জমি তোরা নে, চুক্তিতে রাজি হওয়ার সময় মনে ছিলো না এর পরিণতির কথা কাপুরুষের দল!
মেহনূরের বাবা নিজেকে যথাযথ শান্ত রেখে বলেন,

— আমার মেয়ে কে ছেড়ে দে, এহসান।
এহসান মেহনূরের হাত শক্ত করে ধরে, ওদের সামনে তুলে ধরে! আর বলে,
— এই হাত ধরেছি তো আর কখনো ছাড়ব না! তোদের মেয়ে এখন তোদের নয়, এখন ও শুধু আমার, আর এই কথা ভালো করে শুনে রাখ, যদি আর তোরা কোনো ধরনের ঝামেলা সৃষ্টি করেছিস, খোদার কসম দিয়ে বলছি, তোদের পরিবারে একটা প্রাণও থাকবে না!
তখনি সেই অচেনা পুরুষ বলে উঠে,
— যা ইচ্ছে তাই নাকি? দেশে আইন বলে কিছু আছে! আমিও দেখি কে আমার হবু স্ত্রী কে আমার থেকে ছিনিয়ে নেয়!
এ কথা শুনে মেহনূরের মনে পড়ে, তাহলে এই সেই রায়ান, যার সাথে আগামী শনিবার তার আকদ হওয়ার কথা!
এহসান রায়ানের এমন কথা শুনে বিশ্রী হেসে বলে,

— তুই কি জানিস না রে কুত্ত** বাচ্চা, এই গ্রামের আইন শাসন কিছু চলে না! এই গ্রাম বড় তালুকদারের কথায় চলে! আর তোর মুখে যদি আর একবার আমার অর্ধাঙ্গিনীর নাম শুনি, তো এই উত্তরের মাঠ, তোর রক্তও হজম করে নিবে, স**র ***বাচ্চা!
এতটা বিবৎসা কথা শুনে ঘৃণায় মাটির নিচে চলে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে মেহনূরের!
রায়ান একবারে এহসানের মুখোমুখি হয়ে বলে,
— দেখুন, আমি জানি আপনার জমি প্রয়োজন, জমি নিয়ে নিন, আর আমার মেহনূর কে ছেড়ে দিন, সামনে আমাদের বি….
আর কিছু বলতে পারে না রায়ান, এহসান সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয় রায়ানের গাল বরাবর! থাপ্পড়টা এতটা জোরে মেরেছে যে, রায়ানের পুরুষালী ঠোঁট ফেটে তাজা রক্ত টলটলে ঝরে পড়ছে থুতনি বেয়ে! এহসান বাজখাঁই কন্ঠে বলে,

— সর***র *** বাচ্চা, তোকে বলেছিলাম না, আমার নারীর নাম তোর মুখে নিবি না!
এই সুযোগে মেহনূর এহসানের হাতে সজোরে কামড় বসিয়ে দেয়! এত হঠাৎ অল্প ব্যথা পেতেই এহসান মেহনূরের হাত ছেড়ে দেয়, আর এ সুযোগে মেহনূর এক দৌড়ে, নিজের বাবার পিছনে গিয়ে লুকিয়ে যায়! আকস্মিক এমন ঘটনায় এহসান স্তব্ধ হয়ে যায় কিছুটা! মেহনূর ওর বাবাকে পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
— আব্বা, আমায় বাড়ি নিয়ে যাও! এই লোক আমায় মেরে ফেলবে, আব্বা, এই লোক খুব ভয়ংকর! আজ সকালে আমায় পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছে! আব্বা, আব্বা, তুমি কিছু করো! ও আব্ব…
নিজের মেয়ের এমন আহাজারি শুনে অন্তর বিষাদ হয়ে উঠে মাজহারুল সাহেবের!
তখনই এহসান চিৎকার করে বলে,

— মেহনূর, চলে আয়, নয়তো এক খোদার কসম, তোর সামনে তোর জন্য তোর বাপ, চাচাদের দেহ থেকে রক্ত ঝড়বে, আর আমি এহসান, সেই রক্তেই তোকে গোসল করিয়ে! ওদের লাশের ওপর দিয়ে নিয়ে যাব!
মেহনূর এহসানের এমন কথা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠে! সে পা বাড়ায় যাওয়ার জন্য, কিন্তু তার ছোট চাচা ওর হাত শক্ত করে ধরে বলেন,
— আমিও দেখি, তুই কি করে আমাদের লাশের ওপর দিয়ে, আমার ভাতিজা কে নিয়ে যাস! আয় দেখি, কে কাকে রক্ত দিয়ে রঞ্জিত করে!
এহসান দেরি না করে পাঞ্জাবির পকেট থেকে পিস্তল বের করে, সোজা রায়ানের মাথা বরাবর ধরে, আর মেহনূরের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— তুই জানিস না কতটা ভয়ংকর আমি! আবারও বলছি, যদি রক্তে গোসল করতে না চাস, তাহলে চুপচাপ চলে আয়!
মেহনূর কোনো উপায় না পেয়ে, ছোট চাচার হাত ছেড়ে দেয়, এগিয়ে আসতে নিলে, ওর সেজো চাচা ওর হাত ধরে আঁটকে নিয়ে বলেন,

— তুই কোথাও যাবি না, তুই বাড়ি যাবি! আমি তোকে এই কুত্তার (এহসানের দিকে তাকিয়ে) রক্ত দিয়ে গোসল করিয়ে, বাড়ি নিয়ে যাব!
তখন মেহনূরের বাবা শান্ত গলায় বলেন,
— তৌফিক, যেতে দে, আমার কলিজার টুকরো কে, নয়তো আমার নিশ্বপাপ, রায়ানের মায়ের বুক খালি হবে!
মেহনূর অচেতন পায়ে আবারও এহসানের কাছে এগিয়ে আসে! ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসছে, সব শেষ হয়ে গেছে মনে হচ্ছে! এহসান ঝাপটে, নিজের বক্ষস্থলে চেপে ধরে মেহনূর কে, আর হুমকির সুরে বলে,
— এর পর থেকে তোরা ভুলে যাবি, তোদের মেহনূর বলে কোনো মেয়ে আছে!
এ বলে মেহনূর কে নিয়ে যখন গাড়ির উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসবে, তখনি গুলির শব্দ কানে আসে! মেহনূর স্থবির হয়ে যায়, মনে হচ্ছে, এই হয়তো এক বিশ্রী যুদ্ধের সূচনা! মেহনূর দেখে, পিছন থেকে কেউ এহসানের একজন গার্ড কে বুক বরাবর গুলি করে দিয়েছে! গুলি লেগেই সেই লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে! মুহূর্তেই এহসান, নিজের পিস্তল বের করে! পিছনে ঘুরে যায়, উদ্দেশ্য যে গুলি করেছে, তাকে উড়িয়ে দেওয়া, তবে গার্ডদের আদেশ দেয় না কিছু করার জন্য, কারণ এখানে তার প্রাণপ্রিয় নারী উপস্থিত, তার কিছু হয়ে যেতে পারে!
এহসান মেহনূরের ছোট চাচার দিকে পিস্তল তাক করে, ট্রিগার চাপতে যাবে, মেহনূর পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে! সোজা এহসানের পা জড়িয়ে ধরে! এতে এহসান বিপাকে পড়ে যায়, মেহনূর কাঁদতে কাঁদতে বলে,

— আল্লাহর দোহাই লাগে, আমার চাচা কে মারবেন না! দয়া করে ছেড়ে দিন! আমি কসম খেয়ে বলছি, সারাজীবন আপনার দাসী হয়ে থাকব, কখনো পালাবো না! এর বিনিময়ে ভিক্ষা দিন, আমার চাচার জীবন! আমার চাচাতো ভাই-বোন গুলো এতিম হয়ে যাবে! ছেড়ে দিন!
এ বলে আবারও ডুকরে কেঁদে উঠে মেহনূর!
মেহনূরের আর্তনাদ এহসান কে কিছুটা শান্ত করে, এহসান পিস্তল রেখে মেহনূর কে দাঁড় করায়! আর ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,
— তোরা বেঁচে গেলি শুধু আমার বেগমের জন্য নয়, এখান আমি নিজে তোদের সবকটার কলিজা টেনে বের করে আনতাম!
এদিকে মেহনূরের সারা দুনিয়া ঘুরতে লাগলো, এমনিতেই পুকুরে পড়ার জন্য শরীর অসুস্থ, এর মধ্যে মানসিক এত চাপ! মেহনূর নিস্তেজ হয়ে এহসানের বক্ষস্থলে ঢলে পড়ে!
এহসান অতি আদলে মেহনূরের নিস্তেজ দেহখানা কোলে তুলে, গাড়িতে প্রবেশ করে! অতঃপর এক এক করে সব গাড়ি নিজ গন্তব্যে ফিরত যায়!
ওরা চলে যেতেই, মেহনূরের বাবা হাউমাউ করে কেঁদে, মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, আর নিজের বুকে দুই হাত দিয়ে চাপড়াতে চাপড়াতে বলেন,

আত্মার আগলে পর্ব ৩

— আমি আমার মেয়ে কে শেষ করে দিয়েছি! আমি যদি ওদের চুক্তিতে রাজি না হতাম, তাহলে আজ আমার আম্মাজান এত কষ্ট পেতো! ঐ কুত্তার বাচ্চা, অমানুষটা আমার আম্মা রে হয়তো তিলে তিলে মেরে দিবে! কি হবে বেঁচে থেকে? আমার প্রাণ তো ঐ কুত্তার বাচ্চা নিয়ে গেছে! আল্লাহ, তুমি আমায় মৃত্যু দান করো! ও মাবুদ, আমি বেঁচে থেকে কি করব? ইয়া রব, তুমি আমার সব পাপের শাস্তি এভাবে দিও না! ও মাবুদ, তুমি আমার ফুলের মতো মেয়েকে রক্ষা করো! মাবুদ, তুমি আমায় ধ্বংস করে দাও, তাও আমার মেয়ে কে মুক্তি দিয়ে দাও (আসমানের দিকে তাকিয়ে)
নিজের বড় ভাইয়ের এমন আহাজারি দেখে বাকি ভাইদেরও কলিজা ফেটে যাচ্ছে, তবে কিছুই করার নেই, তারা ভালো করেই জানেন! এহসান কি পরিমাণের ভয়ংকর এক কথায় আস্ত একটা নরপশু, এই এহসান তালুকদার!

আত্মার আগলে পর্ব ৫