আত্মার আগলে পর্ব ৪৩

আত্মার আগলে পর্ব ৪৩
সানজিদা আক্তার মুন্নী

ঘরটা যেন নরকের এক টুকরো অংশ।
চারপাশে থমথমে নীরবতা, কিন্তু সেই নীরবতার মাঝেও যেন শোনা যাচ্ছে অস্পষ্ট চিৎকার…
কান্না… আহাজারি… মৃত্যুর আগের করুণ আর্তনাদ!
মেহনূর থমকে দাঁড়ায়।
বুকের ভেতর ধুকপুক করতে থাকা হৃদপিণ্ড হঠাৎ থেমে গেল কিনা, বুঝতে পারে না।গলা শুকিয়ে আসে।
মেহনূরের দৃষ্টির সামনে যে দৃশ্য…তার চোখের পাতা ফেলতেও ভয় লাগছে!দেয়ালের দিকে তাকাতেই তার নিঃশ্বাস আটকে যায়!

সেখানে— ঝুলছে মেয়েদের লাশ!বুকের মাঝখানে বিশাল পেরেক ঠুকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে তাদের!
পেরেকগুলো এত মোটা, এত ভয়ানক মনে হচ্ছে কোনো পিশাচের হাতের অস্ত্র!
কিন্তু…সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার…
তাদের শরীরে কোনো চামড়া নেই!মেহনূরের পায়ের নিচ থেকে পৃথিবী সরে যাচ্ছিল!
মেহনূরের চোখ ঘোলাটে হয়ে আসছিল!
কিছুক্ষণ কিছুই বুঝতে পারছিল না,তারপর ধীরে ধীরে…
মেঝের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারে, চামড়াগুলো ওখানেই পড়ে আছে!
চামড়ার স্তূপ!
শরীর থেকে ছিলে নেওয়া মাংস,
রক্তে ভিজে চটচটে হয়ে থাকা চামড়াগুলো ঘরের চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে!
এক জায়গায় পচা রক্ত থকথকে হয়ে জমাট বেঁধেছে,সেই রক্তের গন্ধে নিঃশ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না!
একটা অসহ্য গন্ধ!গলে যাওয়া মাংসের গন্ধ!পচা মানুষের শরীরের গন্ধ!
মেহনূর আর ঠিক থাকতে পারছিল না!চারপাশ ধীরে ধীরে দুলতে লাগল তার চোখে…
আরও ভালো করে তাকাতেই বুঝতে পারে—
ওখানে তরতাজা লাশও আছে!সাথে অনেকদিনের আগেরও,
যেগুলোর শরীরে ইতিমধ্যেই পোকা ধরে গেছে!মেহনূর মুখে হাত চাপা দেয়!
এটা কি স্বপ্ন?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

না, স্বপ্ন না…
এটা বাস্তব!আরও সামনে তাকাতেই তার পা থমকে যায়।
মাটিতে কয়েকজন পুরুষের দেহ পড়ে আছে!
তাদের শরীরেও চামড়া নেই! কোথাও আধ-খাওয়া মাংসের দাগ! কোথাও খুলে নেওয়া চামড়া গুটিয়ে রাখা!
এই ঘরটায় মানুষ খাওয়া হয়!এই ঘরটায় মৃত্যু নাচে!
মেহনূরের পায়ের নিচের মাটিটা যেন ধসে গেল!
কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল!
তার কানে এখনও মানুষের চিৎকার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল!
চারপাশে সেই বিভীষিকা যখন একে একে তার সামনে খুলে যাচ্ছে,
তখনই—
একটা প্রচণ্ড ধাক্কা অনুভব করে সে!পৃথিবী যেন পেঁচিয়ে উঠল চারপাশে!
তারপর…
সে মাটিতে একিবারে এলিয়ে যাচ্ছিল!
কিন্তু…
ঠিক তখনই—একটা শক্ত হাত তার দেহ টেনে নেয়!
— “চলো এখান থেকে!”
এহসান!সে এক ঝটকায় মেহনূরকে নিজের বাহুতে তুলে নেয়,তারপর দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে!

তবুও সেই ঘরের ভেতরকার চিৎকার যেন বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
এহসান মেহনূরকে উঠনের একটি বেঞ্চে বসিয়ে দেয়।মেহনূরের হাত-পা বরফ হয়ে গেছে।
সে কিছুই বলতে পারছে না!
সে শুধু কাঁপছে…
একবার…
দুইবার…
তিনবার…তার ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ!
মেহনূর কথা বলার চেষ্টা করছে,কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দই বের হচ্ছিল না!
এহসান দ্রুত তার নিকাব খুলে ফেলে!
নিকাবেই বমি লেগে গেছে!তারপর নিজের রুমাল বের করে মেহনূরের মুখ মুছে দেয়।
কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না!মেহনূর পাথরের মতো ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চারদিকে,
তারপর কাপা হাতে সেই ঘরের দিকে আঙুল তুলে ফিসফিস করে বলে,
— “ও… ওগুলো কি?”
গলা এতটাই কাঁপছে যে শব্দ ঠিকমতো বেরোচ্ছে না।
কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই…
সে চিৎকার করে ওঠে!

— “ওগুলো কি!!! কি!!! কি!!!”
তারপর নিজের সব শক্তি দিয়ে কেঁদে ওঠে!ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে!কাঁপা গলায় এহসানের দিকে তাকিয়ে বলে,
— “আপ… আপন…”
আর বলতে পারে না!
তার মুখ বন্ধ হয়ে আসে, গলা শুকিয়ে কাঠ!তার পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে।
তার কানে এখনও সেই ঘরের ভয়ংকর চিৎকার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে!
সে ঢোঁক গিলে বলে,
— “আপনি… আপনি… করেছেন…?”
এহসান মুচকি হাসে।
চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়।তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,
— “হ্যাঁ, এগুলো আমিই করেছি। আর এগুলো করাই ঠিক!”
মেহনূর স্তব্ধ হয়ে যায়।তার ভেতরটা যেন হিম হয়ে গেল!
সে যা শুনল…এটা কি সত্যি?
নিজের কানেই বিশ্বাস হচ্ছে না!এহসান… এই ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে?
না, এটা ভুল…

এটা স্বপ্ন…
কিন্তু না!
এই গন্ধ, এই রক্ত, এই লাশ…
সব সত্যি!
তার চারপাশের পৃথিবী যেন হঠাৎ করেই উল্টে গেছে।
মেহনূর কিছু বলতে পারছে না।তার গলা শুকিয়ে গেছে।কান ঝাঁ ঝাঁ করছে।
এক হৃদয়বিদারক চিৎকার যেন চারদিক কাঁপিয়ে দিচ্ছে!
মেহনূর উঠে দাঁড়ায়।
নিরলস পায়ে সামনে এগোতে থাকে…যেন এই পৃথিবীতে সে নতুন এসেছে,
সবকিছু তাকে অচেনা লাগছে!এই দুনিয়া এত ভয়ংকর?
এহসান এত ভয়ংকর?সে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে।
তার কানে সেই চিৎকার আরও জোরে বাজতে থাকে!
আরও… আরও…
চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুটি ঘর।তার পা থেমে যায়।
তারপর…
সে যা দেখে, তা কোনো দুঃস্বপ্নের থেকেও ভয়ানক!
ডান পাশের ঘর:
কয়েকজন কালো পোশাক পরা লোক দাঁড়িয়ে আছে।

তাদের সামনে ঝুলছে একটি ছেলে, জীবন্ত!তার শরীরের চামড়া আস্তে আস্তে ছিলে ফেলা হচ্ছে!
রক্ত টপটপ করে মাটিতে পড়ছে!ছেলেটি ভয়ংকর চিৎকার করছে!
আরে আল্লাহ! এই চিৎকার কেন থামছে না!মেহনূর নিজের কান বন্ধ করে ফেলে!
কিন্তু তবুও সেই আর্তনাদ যেন মাথার ভেতরে গেঁথে বসে!
বাম পাশের ঘর:
তিন-চারটি মেয়ে উল্টো করে ঝুলে আছে!
তাদের শরীরের রগ কেটে ফেলা হচ্ছে!কয়েকজন নারী সেই চামড়া টেনে তুলছে! একটু টান দিলেই চামড়া উঠে যাচ্ছে, তারপর চাকু দিয়ে কেটে তা ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে!
মাংস আর রক্তে ভেসে যাচ্ছে সব!টইটম্বুর হয়ে গেছে পুরো ঘর!
মেহনূরের দৃষ্টির সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসে।তার কান্না আটকে যায় গলায়।
তার মাথা চক্কর দিচ্ছে!তার দম বন্ধ হয়ে আসছে!
তারপর…
মেহনূর নিজের চোখ দুটো শক্ত করে চেপে ধরে!
আর নিজের সব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে ওঠে!

— “আল্লাহ! মাবুদ!”
মেহনূর দিশেহারা হয়ে যায়!এখান থেকে পালাতে হবে!কিন্তু পা চলছে না!শরীর অসাড় হয়ে আসছে!সে কি করবে বুঝতে পারছে না!
পাগল হয়ে যাবে!
মেহনূর ছুটে গিয়ে এহসানের পেছনে লুকিয়ে যায়!তার পুরো শরীর কাঁপছে।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে মেহনূর!
মেহনূরের হাত এহসানের কাঁধ আঁকড়ে ধরে!
ভেঙে পড়া কণ্ঠে বলে,
— “এগুলো কি? এগুলো কেন হচ্ছে? থামান এগুলো!”
কিন্তু এহসান…সে এক অদ্ভুত ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহনূরের দিকে।
তার ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি…যেন এই নরকটাই তার সৃষ্টি…এবং সে এতে গর্বিত!
এহসান ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে মেহনূরের দিকে তাকায়।তার ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত নিষ্ঠুরতা খেলা করছে।
এহসান এর কণ্ঠে কোনো অনুশোচনা নেই, বরং এক ধরনের গর্ব লেগে আছে।
— “এগুলো থামবে না, প্রিয়তমা। এগুলো চলমান…”
মেহনূর থমকে যায়।
মেহনূরের রক্ত যেন হিম হয়ে আসে।
এহসানের ঠাণ্ডা অথচ ভয়ংকর কণ্ঠে সে বুঝতে পারে, এ দুঃস্বপ্নের শেষ নেই।এই বিভীষিকা চিরকাল চলবে…
তার পা কাঁপতে থাকে।
হাত-পা যেন অসাড় হয়ে আসছে, কিন্তু সে বসে পড়তে পারে না।
তার ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে,
তবুও সে এক ঝটকায় এগিয়ে গিয়ে এহসানের পা জড়িয়ে ধরে!
কান্নায় গলা ভেঙে গেছে, চিৎকার করে বলে—
— “দয়া করুন! আল্লাহকে ভয় করুন! ছেড়ে দিন! ছেড়ে দিন! ছেড়ে দিন!”
মেহনূর কাঁদছে, গড়াগড়ি খাচ্ছে…তার কলিজা ফেটে যাচ্ছে এই ভয়ংকর দৃশ্য দেখে।
সে বুক ফেটে চিৎকার করে ওঠে—

— “থামান! থামান এগুলো! থামান!”
কিন্তু এহসান?
সে নির্বাক!একটুও নড়ে না, একটুও দয়াপ্রবণ হয় না!
সে স্থির দাঁড়িয়ে আছে,কোনো প্রতিক্রিয়া নেই!
মেহনূর বুক ফাটিয়ে কাঁদছে,তবু কোনো সাড়া নেই!
সে এহসানের পায়ের কাছে পড়ে থাকে, আঁকড়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে—
— “এগুলো থামান! ছেলেগুলোকে ছেড়ে দিন! মেয়েগুলোকে ছেড়ে দিন!”
কিন্তু…এহসান ধীরে ধীরে তার পা ছাড়িয়ে নেয়!
মেহনূর আর ধরে রাখতে পারে না!সে শক্তিহীন হয়ে পড়ে যায় মাটিতে।
নিজের কপালে হাত চাপড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে!
— “কি দেখলাম আমি! মানুষ এত ভয়ংকর হয়?!”
তার বুকের ভেতর ফেটে যাচ্ছে!
এই পুরুষ…এই এহসান…
সে কি আসলেই ভালোবেসেছিল?
না, এই নিকৃষ্ট পুরুষকে কেউ ভালোবাসতে পারে না!
ভালোবাসা তো পবিত্র…
কিন্তু এই এহসান?সে তো এক পাপিষ্ঠ…এক অন্ধকার
এহসান ধীরে ধীরে এসে বসে মেহনূরের সামনে।
ওর চোখে এক গভীর রহস্য খেলা করছে।তার ঠোঁটের কোণে এক উদ্ভট হাসি।সে হাত বাড়িয়ে মেহনূরের কাঁধে রাখে।
তারপর নিচু গলায় বলে—

— “ভালোবাসো আমায়? বলো, ভালোবাসো?”
মেহনূর থমকে যায়।
ধীরে ধীরে সে মাথা তুলে এহসানের চোখের দিকে তাকায়।এই চোখ একদিন কত মায়ার ছিল!
কিন্তু আজ…আজ এই চোখ নরকের শিখায় দাউ দাউ করে জ্বলছে!
অন্য সময় হলে হয়তো সে এহসানের গলা জড়িয়ে ধরে বলত—
“হ্যাঁ, বাসি! ভীষণ ভালোবাসি!”
কিন্তু এখন?এখন এই পুরুষ ভালোবাসার যোগ্য নয়!
মেহনূর ডুকরে কেঁদে ওঠে,তার মাথা দুলিয়ে বলে—
— “না… না… না… আমি ভালোবাসি না আপনাকে!”
— “পাপিষ্ঠ! এত নিকৃষ্টকে ভালোবাসা যায় না! এটা কলঙ্কের চেয়েও বড় কলঙ্ক!”
মেহনূরের এ কথা এহসানের কলিজায় বিদ্ধ হয়!
সে তো এটাই হবে জানত, তবুও কেন যেন এক মুহূর্তের জন্য বুকের ভেতর মোচড় দেয়।
সে দেখতে চেয়েছিল… তার নারী কতটুকু ভালোবাসতে পারে?
কতটা নিকৃষ্টতা সে মেনে নিতে পারে?তার নারী নিজেই তো বলেছিল—
“আপনি পাপিষ্ঠ হলেও আমি আপনাকে ভালোবাসব!”
“আপনি নিকৃষ্ট হলেও আমি আপনাকে ভালোবাসব!”
তাহলে?
এত অল্পতেই শেষ?এত অল্প ভালোবাসা?

এহসান এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে।তার ঠোঁটে এক আত্মা-হারানো মলিন হাসি ফুটে ওঠে।
সে আলতোভাবে মেহনূরের চোখের পানি মুছে দেয়।
তারপর ফিসফিস করে বলে—
— “তুমি আবারও প্রমাণ করে দিলে, প্রিয়তমা…পাপিষ্ঠরা ভালোবাসার যোগ্য হয় না…! তারা শুধু নিছক ঘৃনা আর ঘৃনারি যোগ্য হয়!
মেহনূর কেঁপে ওঠে।নিজের হাত দিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরে।মেহনূরের চোখ দিয়ে টলটল করে পানি গড়িয়ে পড়ে।
তার কণ্ঠ ফেটে যায়…
— “পাপিষ্ঠদের ভালোবাসতে নেই! পাপিষ্ঠ দের ভালোবাসালে, তাদের পাপের তাপে পুড়তে হয় অন্তত প্রহর!
তারপর সে ঠোঁট চেপে কেঁদে ওঠে…
—তাদের ঘৃনা করতে হয় তারা ঘৃনারি যোগ্য শুধু ঘৃণার”!
— “আর আমি ভুল করেছি…”
— “আমি এক পাপিষ্ঠ পুরুষকে ভালোবেসেছি…
— “এক নিকৃষ্ট প্রাণকে নিজের অস্তিত্ব ভেবেছি!”
মেহনূরের কথা শুনে এহসান শুধু হাসে…শুধু হাসে…
এই হাসিতে মিশে আছে এক আকাশ আফসোস।একটাই আফসোস—তার নারীর ভালোবাসা না পাওয়ার আফসোস।
মেহনূর এহসানের কলার চেপে ধরে! তার চোখের সামনে যেন নরকের দরজা খুলে গেছে।
তার কান ঝাঁ ঝাঁ করছে না আর সেই চিৎকারে…

কারণ যারা চিৎকার করছিল, তারা আর চিৎকার করার জন্য এই দুনিয়াতে নেই!
মেহনূর এহসানের কলার শক্ত করে চেপে ধরে, কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে বলে—
— “কেন করছেন এগুলো? কেন? কেন এত নিকৃষ্ট হলেন?”
তার গলা কাঁপছে, শরীর কাঁপছে, পুরোটা এক ভয়াবহ কষ্টে মোড়ানো।
মেহনূর ঢোক গিলে ফিসফিস করে বলে—
— “ও এহসান! একটাবার বলুন না! কেন এত নিকৃষ্ট? আপনি কী জন্য এত ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠলেন? বলুন না! আমি শুনতে চাই!”একটা বার বলুন
— “কী এমন আছে এতে, যার জন্য আপনি এত ভয়ংকর হয়ে উঠলেন? বলুন!”না
এহসান মেহনূরের চোখের পানি নিজের এক হাতের বৃদ্ধ আঙুল দিয়ে মুছিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
তারপর সেই ঘরের দিকে তাকিয়ে ধীর কণ্ঠে বলে—
— “এখানে যাদের অবস্থা তুমি এত করুন দেখলে, তারা কেউই মানুষ না… মানুষ নামের কলঙ্ক একেকটা!”
মেহনূর স্থির হয়ে এহসানের পানে চেয়ে থাকে। যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটিকে সে নতুন করে চিনতে চাইছে।
এহসান আলতো হেসে ফিসফিস করে বলে—

— “জানো, জান? যে নারীদের চামড়া তুলে ফেলা হচ্ছে, তারা নারী নামের কলঙ্ক। তারা কিছু টাকার জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে, মানুষ ধরে রুমে নিয়ে যায়। নিজের স্বামীকে রেখে অন্য পুরুষকে মাতোয়ারা করে। হোটেল রুমে গিয়ে সামান্য টাকার জন্য নিজের সব বিলিয়ে দেয়। তারা পতিতালয়ে কাজ করে না, বরং রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাজ করে। রাস্তা-ঘাটকেই তারা পতিতালয় বানিয়ে ফেলেছে!”
মেহনূর ফিসফিস করে একটাই প্রশ্ন করে—
— “আপনি না নারীদের ভালোবাসেন? আপনি না তাদের সম্মান করেন? তাহলে সেই নারীদের এত কষ্ট দিচ্ছেন কেন?”
এহসান মাথা দুলিয়ে বলে—

— “হ্যাঁ, ভালোবাসি আমি নারীদের। তাদের সম্মান করি। তারা আল্লাহর রহমত। তাদের মর্যাদা দিতে হয়।”
একটু থেমে, এক নিঃশ্বাসে বলে—
— “তবে নষ্ট নারীদের আমি ভালোবাসি না, সম্মানও করি না। তাদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলি। তারা যেমন বিশ্রী পেশায় মগ্ন থাকে, তেমন আমিও তাদের বিশ্রীভাবেই শেষ করি!”
মেহনূর কান্না ভেঙে পড়ে, তার কণ্ঠ ফেটে যায়—
— “আরে! সবাই তো ইচ্ছে করে এসব করে না! পেটের দায়েই বাধ্য হয়!”
এহসান মুচকি হেসে বলে—
— “তুমি কী ভাবলে? আমি মানুষকে কারণ ছাড়া, মন চাইলেই মেরে ফেলি? বোকা নারী, তুই কখনো আমায় বুঝবি না! আমি এদের চারবার সাবধান করি। টাকা-পয়সাও দেই, সুযোগও দেই। অনেকেই ফিরে আসে, শুদ্ধ হয়। আর যাদের চামড়ায় হুমকি-ধমকি কাজ করে না, তাদের চামড়াই তুলে ফেলি!”
মেহনূরের কলিজা আঁতকে ওঠে! আবারও সেই ভয়ংকর দৃশ্য তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
এহসান আরও বলে—

— “আর যে ছেলেরা মেয়েদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের ভোগ করে… তাদের যে কয়টার খোঁজ পাই, তাদের সব-কয়টাকে এমন হাল করি!”
মেহনূর চিৎকার করে ওঠে! তার কান্না আর থামে না। তার হৃদয় যেন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
এই পুরুষ…এই এহসান…
সে কি মানুষ?নাকি শয়তানের চেয়েও ভয়ংকর কিছু?
এহসান মলিন হেসে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে আবারও প্রশ্ন করে,
— ভালোবাসো আমায়? বল না, ভালোবাসো আমায়?
এহসানের মন একটা কথা শুনতে চায় তা হলো “আপনায় আমি ভীষণ ভালোবাসি, ভীষণ “! তাই তো বারবার একি প্রশ্ন করছে মেহনূর কে!
মেহনূর এহসানের পানে তাকিয়ে মুখ চেপে কান্না করে বলে,
— এত নিকৃষ্ট মানুষকে ভালোবাসা যায় না। এতে ভালোবাসা পাপে পরিণত হয়।
— আপনায় আমি ভালোবাসলে, আমাদের ভালোবাসা কলঙ্ক আর পাপে মোড়া হবে, শুধু পাপ!
এহসান মেহনূরের গাল ছুঁয়ে মৃদু স্বরে বলে,
— সব ভালোবাসাই তো থাকে পবিত্রতায় মোড়া! তাহলে থাকুক না তোমার আমার ভালোবাসা কলঙ্ক আর পাপে ঘেরা!
মেহনূর এহসানের হাত সরিয়ে দিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলে,

— আপনি না আমায় নিয়ে বাঁচতে চান? তাহলে এগুলো ছেড়ে দিন। যা করছেন, সব ছেড়ে দিন! আমি কথা দিচ্ছি, আজ যদি আপনি শুদ্ধ হয়ে যান, তো এ জীবন আমার গোটা জীবন আপনার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে কাটিয়ে দেব। আপনি তো বলেছিলেন, আপনার পবিত্র অস্তিত্ব আমি! তাহলে পাপী অস্তিত্ব ছেড়ে দিন না!
এহসান মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
— কিন্তু আমি যে আমার পাপ আর পবিত্রতা— দুই অস্তিত্ব নিয়েই বাঁচতে চাই!
মেহনূর এহসানের কথায় নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চোখেমুখে বিষাদ জমে ওঠে।
— তাহলে আমায় ছেড়ে দিন… তালাক দিন আমায়! আমি পারব না এত নিকৃষ্ট পুরুষের অধীনে থাকতে।
“তালাক!”
এই শব্দটা যেন এহসানের কলিজায় খচ করে বিঁধে যায়। সে তো চেয়েছিল মেহনূরের ভালোবাসার গভীরতা জানতে, অথচ পেল এমন নির্মম শব্দ!
তার দুনিয়া নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, অথচ মুখে মুচকি হাসি রেখেই বলে,

— আমার নামে কবুল যখন পড়েছ, তো মুক্তি তুমি আমার মৃত্যুর পরই পাবে!
মেহনূর ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু পড়ে যেতে থাকে। শরীরে আর শক্তি নেই।
সব শেষ হয়ে গেছে।
সব স্বপ্ন… প্রিয় পুরুষ নিমেষেই অপ্রিয় হয়ে গেছে।
ভালোবাসার বুননে দেখা সব স্বপ্ন অপূর্ণতার ছোঁয়া পাচ্ছে।
এহসান মেহনূরকে ধরে তুলে দাঁড় করায়, কিন্তু মেহনূর দ্রুত সরে যায় ওর হাত থেকে।
— কত আশা ছিল আমার! কত পাপ করছেন আপনি, অথচ আমি সব মাফ করে দিয়ে আপনাকে আপন করে নিয়েছিলাম। আপনার সাথে সুন্দর এক জীবন পার করার স্বপ্ন দেখেছিলাম। আর আপনি…! আপনি তো এক নিকৃষ্ট আত্মা! যার শুধু রক্ত লাগে, শুধু রক্ত!
এহসান মেহনূরের কোমর জড়িয়ে ধরে একদম কাছে টেনে নিয়ে চোখের পানিতে ডুবে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

— এগুলো কিছুই না, প্রিয়তমা… এগুলো তুচ্ছ পাপ আমার প্রকৃত পাপের তুলনায়!
— রক্তের নেশা ভয়ংকর, প্রিয়তমা! এ নেশায় মগ্ন থাকলে শুধু তলিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়!
মেহনূর আর কাঁদছে না। কান্নার অনুভূতিটাই যেন হারিয়ে গেছে।
সে পাথর হয়ে এহসানের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
— এগুলো করে কী লাভ? কেন করছেন এসব? কেন জাহান্নামের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন?
এহসান মেহনূরের গাল ছুঁয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
— রক্তের খেলায় মেতে ওঠা আমার শখ, প্রিয়তমা!
— আর লাভ ছাড়া এহসান তালুকদার এক পাও ফেলে না! জানো, এ দেহগুলো যতই নিকৃষ্ট হোক, কালো বাজারে এদের শরীরের অংশের কিন্তু খুব চড়া দাম!
মেহনূর থমকে যায়।
সে কী ভয়ংকর সত্য শুনছে!
এহসান শুধু মানুষ খুনই করে না, তাদের শরীরের অংশ বিক্রি করে দেয়! এতদিন সে এহসানের দেওয়া হারাম টাকা খেয়ে এসেছে!
মেহনূর ফিসফিসিয়ে বলে,

— এতদিন হারাম উপার্জনে আমি বেঁচে ছিলাম!
এহসান মুচকি হেসে বলে,
— না, তালুকদার বাড়িতে আমি কালো টাকা প্রবেশ করাই না। ওখানে যা আছে, সব আমার পরিশ্রমের বিনিময়ে উপার্জিত হালাল টাকা! তুমি যা পেয়েছ, খেয়েছ, সবই হালাল!
তারপর মলিন হেসে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে বলে,
— খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল, আমার নারী তার পাপিষ্ঠ পুরুষকে ঠিক কতটা নিকৃষ্ট অবস্থায় ভালোবাসতে পারে। কিন্তু আফসোস, তুমি আমায় ভালোবাসলে না…
— তুমি তো বলেছিলে, প্রিয়তমা, আমি নিকৃষ্ট হলেও তুমি ভালোবাসবে! তাহলে এখন কেন পারলে না? কেন ভালোবাসলে না?
মেহনূর এহসানের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ঘৃণায় আর কথা বেরোচ্ছে না, তবুও চিৎকার করে বলে,

— না! আমি ভালোবাসি না আপনাকে! আপনার সাথে থাকতে চাই না! আপনার অস্তিত্ব হয়ে বাঁচতে চাই না আমি!
এহসান আবারও শান্ত স্বরে বলে,
— তোমার চাওয়া পাওয়া দিয়ে কিছু যায় আসে না আমার , আমি শুধু এটাই চাই তোমায় আমার পবিত্র অস্তিত্ব হয়েই বাকি জীবন বাঁচতে হবে!
এহসান মেহনূরের দিকে তাকিয়ে আবারও বলে
— বলো না! ভালোবাসো আমায়, একটা বার শুধু বলো বলো আমার প্রিয় নারী তুমি আমায় ভালোবাসো, একটা বার বলো!
তারপর নিজের বুকের বা পাশে আঙুল ঠেকিয়ে দেখিয়ে বলে —
— এখানে যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে খুব কষ্ট হচ্ছে! বলো না আপনি নিকৃষ্ট হলেও আমি আপনায় ভালোবাসি বলো না!
মেহনূর চুপ….
কি বলবে,,,, সে কিছু বলার মতো পরিস্থিতি, তো এহসান রাখেনি,,,,,
এহসান পাগলের মতো ঝাপটে ধরে মেহনূর বুকে আর বলে।

— “তুমি তো বলেছিলে প্রিয়তমা আমি পাপিষ্ঠ হলেও আমি তোমার!
— “তাহলে এই অল্প নিকৃষ্টতা দেখে আমায় ত্যাগ করলে!
মেহনূর এহসানেরর থেকে নিজে কে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলে।
— ‘বলেছিলাম তাই বলে এত নিকৃষ্ট….এত নিকৃষ্ট!
এহসানের দুনিয়া শূন্য হয়ে আসে ” সে এখানে মেহনূর কে জীবনেও আনত না, কিন্তু এখানে এনেছে শুধু এটা জানতে তার নারী তাঁকে সত্যি কি ভালোবাসে পাপিষ্ঠ হিসেবে!
সে ভেবেছিল!

আত্মার আগলে পর্ব ৪২

হয়তো সবাই পাপিষ্ঠ পুরুষ দের ভালোবাসতে না পারলেও তার নারী বাসবে!….
কিন্তু আফসোস তার আপন নারী তাকে বুঝিয়ে দিল”!
পাপিষ্ঠ”রা ভালোবাসার যোগ্য হয় না তারা শুধু ঘৃনা আর ঘৃনারি যোগ্য হয় “!

আত্মার আগলে পর্ব ৪৪