আত্মার আগলে পর্ব ৪৪
সানজিদা আক্তার মুন্নী
চারপাশে ফজরের আযান ধ্বনিত হচ্ছে। ভোরের আবছা আলোয় আলোকিত হতে শুরু করেছে আকাশ। সেই আলোর ছায়ায় এহসান মেহনূরকে নিয়ে রওনা হয়েছে বাড়ির দিকে।
এক হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং, অন্য হাতে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে মেহনূরকে। যেন সে তার হৃদয়ের গহীনে আগলে রেখেছে ভালোবাসার নামহীন আকুতি।
আর মেহনূর? রাগে, ঘৃণায় এহসানের কলার চেপে ধরে রেখেছে । তার চোখদুটোয় হিংস্র বাঘিনীর দৃষ্টির মতো আগুন—চোখে ঘৃণা, মনে দুঃসহ যন্ত্রণা।
সে ছটফট করে, নিজেকে ছাড়াতে চায়। কিন্তু এহসান কি তাকে ছাড়বে?
না, সে আঁকড়ে আছে—একদম নিঃশেষ হয়ে যাওয়া মানুষটার মতো। মেহনূরের স্পর্শে, তার শরীরের উত্তাপে একটু শান্তি খুঁজে বেড়াচ্ছে।
তার ভিতরটা আর্তনাদ করে উঠছে। বারবার কানে বাজছে—
“পাপিষ্ঠদের ভালোবাসা যায় না। তাদের ভালোবাসলে পুড়তে হয়, পুড়তে হয় নরকের তাপে।”
কিন্তু প্রশ্ন জাগে মনে—
“মেহনূর যদি তাকে ভালোবাসে, তবে কি এমন ক্ষতি হবে? কেন ভালোবাসা পাপ হবে?”
সেই তো—সবাই পাপ দেখে, পাপী দেখে, কিন্তু কেউ কি পাপিষ্ঠ দের ভালোবাসা দেখে না
তার নারীও বুঝল না দেখল না তাই তো এত সহজেই বলল– আমি ভালোবাসি না আপনায়
এহসানেরর ভেতর টা শূন্য হয়ে আসে! বুকটা ধুকধুকিয়ে উঠে!
মেহনূর আর চেষ্টা করে না নিজেকে ছাড়াতে। সে মাথা রাখে এহসানের বুকে। পাপিষ্ঠ হলেও, এই বুকই তো তার একমাত্র আশ্রয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তার বুক ফেটে যাচ্ছে—ভালোবাসার এই নির্মম যন্ত্রণায়।
ভালোবাসার যন্ত্রণা এতটা গভীর, এমন ভেবেছিল কখনো?
মুখে বলেছিল, “আমি আপনাকে ভালোবাসি না।”
কিন্তু কি এত সস্তা ভালোবাসা? বললেই শেষ? না, সে এখনো ভালোবাসে।
চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে মেহনূরের। নিঃশব্দ কান্নায় তার বুক কাপছে। এহসানের পাঞ্জাবি ভিজে যাচ্ছে সেই কান্নায়।
সে তো মাফ করে দিয়েছিল! মন থেকে ভালোবেসেছিল।
তবে কেন আজ এমন শাস্তি?
শূন্য হয়ে গেছে তার ভেতর। যাকে নিয়ে জান্নাতের স্বপ্ন দেখেছিল, সে-ই আজ এক পাপিষ্ঠ!
তবুও ঘৃণা করতে পারে না। মন মানে না, হৃদয় মানে না।
কিন্তু তখনই সেই দৃশ্যগুলো আবার সামনে ভেসে ওঠে… অন্তর কেঁপে ওঠে।
মেহনূর ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। কান্নায় শুধু একটাই সুর—আফসোস…
শত শত আফসোস…
নিজের পাপিষ্ঠ পুরুষকে ঘৃণা না করতে পারার আফসোস।
তার প্রতি মৃদু অনুভব থাকার আফসোস।
এই কেমন আফসোস!
মেহনূরের কান্না দেখে এহসানের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে।
তার নারী, তার জন্য এতটুকু আর্তনাদ করছে!
সে তো ভাবেছিল—মেহনূর তাকে ভালোবাসে। তাই এসেছিল প্রমাণ নিতে।
কিন্তু আজ সে নিচ্ছে ঘৃণা।
আর সেই ঘৃণার ভিতরেও যে রয়েছে বুকভরা কান্না, নিঃশব্দ ভালোবাসা।
এহসানের হাত কেঁপে ওঠে। সে মেহনূরকে আরও জড়িয়ে ধরে।
অসহায় গলায় ফিসফিস করে বলে—
— “বেগম… এভাবে কেঁদো না।
এই পাপিষ্ঠ… তোমার কষ্টে আরও অধম হয়ে যায়।”
মেহনূর দুই হাতে এহসানের পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরে।
ওর বুকেই মুখ লুকিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে—
— “ছাড়ুন না… এই পাপের অস্তিত্বকে ঝেড়ে ফেলুন।
এই ভয়ংকর পাপকে ছুঁড়ে ফেলুন না!”
এহসান হেসে ওঠে—একটা তিক্ত, বিষাদময় হাসি।
তার উত্তর হয় সংযত অথচ ভয়ংকর সত্যের মতো—
— “আমি তো বলেছি…
আমি আমার পাপি অস্তিত্ব আর পবিত্র আত্মা—দু’টো নিয়েই বাঁচতে চাই।”
মেহনূর স্তব্ধ।
সে কাকে কি বলছিল এতক্ষণ?
এই পাপীকে?
না, আর কিছু বলবে না সে।
এহসানের মন বিষাদে ভরে যায়। তার বুকের গভীরে এখনও একটা কথার জন্য হাহাকার—
একবার শুধু শুনতে চায়…
“আপনি পাপিষ্ঠ হলেও আমি আপনাকে ভালোবাসি।”
সে ফিসফিসিয়ে বলে—
— “প্রিয়তমা… বলো না একটা বার।
বলো না—আপনি নিকৃষ্ট হলেও আমি আপনাকে ভালোবাসি!”
মেহনূর মাথা রাখে তার বুকেই। চোখ বুঁজে বলে—
— “এত নিকৃষ্ট পুরুষকে… আমার পক্ষে ভালোবাসা সম্ভব নয়।”
এহসান শুধু মলিন হাসে।
ভালোবাসলে কি এমন হতো?
কি এমন ক্ষতি হতো?
শেষবারের মতো চেয়ে বলে—
— “যদি পরের জন্ম বলে কিছু থাকত…
তবে সেই জন্মে আমি পবিত্র আত্মা হয়ে জন্ম নিতাম…
আর তোমার ভালোবাসার যোগ্য হয়ে উঠতাম!”
মেহনূর কিছু বলে না। শুধু লেপ্টে থাকে এহসানের বুকে।
যার প্রতি এত ঘৃণা—তার বুকেই এত শান্তি?
এ কেমন অনুভূতি?
নামাজ শেষ করে জায়নামাজে বসে আছে নূরি। চারপাশে এক প্রশান্ত নীরবতা। একটু আগে শেষ হওয়া নামাজের রেশ এখনো ওর মন জুড়ে।
এই সময়েই মেহরুব মসজিদ থেকে ফিরে ঘরে প্রবেশ করল। তার মুখে শান্ত প্রশান্তি।
নূরিকে বসে থাকতে দেখে নিজের টুপি খুলে জায়গামতো রাখতে রাখতে মেহরুব বলে—
— “নূরি ফুল, এক কাপ চা কি পাব?”
নূরি মাথা ঘুরিয়ে মেহরুবের দিকে তাকায়। চোখে প্রশান্তির দীপ্তি। তারপর এক গাল হেসে বলে—
— “আচ্ছা, দিচ্ছি।”
মেহরুব বিছানায় বসতে বসতে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নূরির মুখের দিকে। তার কণ্ঠে মুগ্ধতা মাখা কাঁপা কাঁপা সুর—
— “কথায় কথায় এত হাসা লাগে নাকি? তুই জানিস না, তোর এই হাসি আমার অন্তর অব্দি উতলা করে দেয়।”
নূরি ওর কথায় হঠাৎ মুখটা মলিন করে নেয়। হাসির আভা মিলিয়ে যায় মুখ থেকে। জায়নামাজ ভাঁজ করতে করতে বলে—
— “এত বাজে আমার হাসি?”
মেহরুব দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে, এক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। তার চোখে তখন গভীরতা—
— “নূরি ফুল রে, তোর হাসি যে কতটা মারাত্মক সুন্দর, তা আমি ব্যাখা দিয়ে শেষ করতে পারব না।”
এই প্রশংসার মধ্যে নূরি যেন হারিয়ে যায়। তার মনে খুশির ঢেউ ওঠে। গোপনে সে যেন নিজের মুখের হাসিকে আর ধরে রাখতে পারে না।
আরও একবার মুচকি হেসে ওঠে সে, আর সেই হাসির লাজে গাল দুটো লাল হয়ে যায়।
মেহরুব ওর লজ্জা মাখা মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলে—
— “নূরি, এদিকে আয় তো।”
নূরি মাথা নিচু করে, ধীরে ধীরে আলতো পায়ে এগিয়ে আসে মেহরুবের দিকে।
মেহরুবের সামনে এসে মাথা নিচু করে বলে—
— “জ্বি, বলুন।”
মেহরুব ওর হাত ধরে টেনে নেয়, বিছানায় বসায়।
নূরি হঠাৎ চমকে উঠে বলে—
— “এমন করছেন কেনো?”
মেহরুব মুখে এক চিলতে মুচকি হাসি ফুটিয়ে কোনো উত্তর না দিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসে।
নূরি এবার লজ্জায় কুঁকড়ে যায়, তার বুক ধুকপুক করে উঠছে।
মেহরুব ওর দুই গাল আলতো করে নিজের হাতে ধরে, নূরির লাজে ঝুঁকে পড়া মুখশ্রী খানা তুলে ধরে।
নূরি চোখ বুঁজে ফেলে। লজ্জায় তার সমস্ত দেহ কেঁপে উঠছে। যেন নিজের জায়গা থেকে পালাতে চায়, কিন্তু পারছে না।
মেহরুব তার গালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়।
নূরির শরীর এক মুহূর্তে বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আসে।
সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে, দম বন্ধ হয়ে আসছে তার।
মেহরুব এবার ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়।
আস্তে আস্তে আঁকড়ে ধরে আপন নারকে, ভালোবাসা আর অধিকার নিয়ে।
নূরি ভয়ে, অভ্যাসের বাইরে প্রথম স্পর্শে চমকে যায়, মেহরুবের পাঞ্জাবি দুই হাতে খামচে ধরে ফেলে।
মেহরুব সে খামচে ধরা হাত দুটোর মধ্যেই নিজের আপনতা খুঁজে পায়,
আরও গভীর করে জড়িয়ে ধরে তার নূরি ফুলকে।
এদিকে এশার শরীরটা যেন হঠাৎই ভেঙে পড়েছে। এশার এই জন্মগত সমস্যা—শরীর একটু চট পেলেই জ্বর, মাথা ধরা, দুর্বলতা একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আর আজ তো শরীরটা সে নিজেই কিছুটা অবহেলায় রেখে এসেছে। তাই এশার এ অবস্থা হওয়াটা সময়ের ব্যাপারই ছিল।
এশা বিছানায় আধশোয়া হয়ে, মাথাটা বিছানার ঢারে ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে আছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে, গাল কিছুটা রক্তশূন্য।
মেহরাজ এক পাশে বসে, ধৈর্যের সাথে চামচে করে সুপ তুলে ওর মুখে দিচ্ছে।
এশা অনিচ্ছায় মুখে তুলে নিচ্ছে সুপটা। মুখ কুঁচকে যাচ্ছে। বিরক্তি ফুটে উঠছে চোখের কোণে।
এভাবে দেখে মেহরাজ বলে উঠে—
— “এ কেমন অবস্থা? খেতেই হবে। না খেলে ওষুধ খাবে কেমন করে?”
মেহরাজের কথায় এশা চোখ মেলে তাকায় তার দিকে। কণ্ঠে রাগ-ঝাঁজ-ভালবাসা মিলিয়ে বলে—
— “এত জ্ঞান দিও না! এসব নাটের গুরু তো তুমি! তোমার জন্যই আজ আমার এ অবস্থা।”
মেহরাজ মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঠোঁটের কোণে কৌতুক ভরা করুণ হাসি ফুটে ওঠে।
— “আল্লাহ মাবুদ! এ কেমন বিপদে পড়লাম! বউয়ের লজ্জার মাগফিরাত করতে গিয়ে দেখি আমার আত্মার মাগফিরাত হয়ে যাচ্ছে!”
সুপ তুলে দিতে দিতে আবার বলে—
— “সাইক্লোনে যদি এমন অবস্থা হয়, তো বাকি গুলোতে কি হবে তোমার?”
এশা এক ঝটকায় মেহরাজের বাহুতে চিমটি কাটে। মুখে কড়া সুরে বলে—
— “এত বাড়িস না। জুতা বিছানার নিচে রাখা আছে!”
মেহরাজ হেসে উঠে, চোখ টিপে বলে—
— “আগে গালাগালি করতে কারণ আমায় স্বামী হিসেবে মানতে পারতে না। কিন্তু এখন এত কিছু হওয়ার পরও আমায় গালাগালি করছো কেন?”
এশা এক দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে, মুখে দৃঢ়তা—
— “এত কিছু কি! তুমি যদি আমার চার বাচ্চার বাপও হয়ে যাও, তাও তোমায় গালাগালি করব—যে করবই!”
মেহরাজ মুচকি হেসে গালে আঙুল ঠেকায়, যেন স্বপ্নের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে।
— “মানে, তুমি আমার চার বাচ্চার মা হওয়ার জন্য প্রস্তুত! তুমি চাইলে, কিন্তু আমি তো দু’বছরে চারটা বা…—”
এশা এবার দাঁত চেপে, রাগে গরগর করে উঠে—
— “চুপ! আর একটা কথা মুখ দিয়ে বেরোলে উষ্টা খাবে, উষ্টা!”
মেহরাজ হাসতে হাসতে পানি এগিয়ে দেয় ওর দিকে।
— “আগে উঠে বসো। যদি বসতে পারো, তাহলে উষ্টা, লাত্থি, থাপ্পড়—যা ইচ্ছে দিও, তুমি আমার প্রিয় উষ্টাবতী।”
বলে ওর কপাল থেকে ঘাম মুছে দেয়। একটুখানি থেমে, গভীর ভালোবাসায় এশার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় কয়েকবার—ধীর, মমতায় ভরা স্পর্শে।
এশা চোখ বন্ধ করে দেয়। এতটা শান্তি, এতটা গভীরতায় ও হারিয়ে যায়। এই স্পর্শ যেন ওর সমস্ত যন্ত্রণার ওষুধ।
মেহরাজ আস্তে করে দূরে সরে আসে, কিন্তু হাতটা রেখে দেয় ওর গালে।
তর্জনীটা দিয়ে আলতো করে এশার ঠোঁটের ওপর বুলিয়ে দিতে দিতে ফিসফিসিয়ে বলে—
— “এই অধরখানা একান্তই আমার, শুধু আমার। তুমি, পুরো তুমিটাই আমার।”
তারপর উঠে দাঁড়ায়। দরজার দিকে পা বাড়ায়, ফিরে তাকিয়ে বলে—
— “আজ রেডি থেকো সিডরের জন্য। আজ রাতে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরব কিন্তু।”
এশা মুখ বাকিয়ে বলে—
— “আমার দিকে হাত এগোনোর চেষ্টা করো আজ তো দেখবে কি করি!”
মেহরাজ হেসে ওঠে—
— “কি আর করবে? কাল রাত যেভাবে কেঁদে কেটে শেষ হয়েছিলে, তেমনই কিছু করবে?”
এশা দাঁত চেপে বলে—
— “হ্যাঁ, করব! চিৎকার করে পুরো বাড়ির মানুষজন জড়ো করব!”
মেহরাজ হাসতে হাসতে পেছন ফিরে যায়—
— “কাল রাত তো অনেক করলে, কই কেউ তো জড়ো হলো না!”
এ কথায় এশা থতমত খেয়ে যায়। সত্যিই তো! কিছুই হয়নি, কেউ আসেওনি।শুনেই নি হয়তো কেউ
লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয় নিচের দিকে। ওর গাল লাল হয়ে যায়।
মেহরাজ এশার লজ্জা দেখে বলে—
— “এ দুঃখ আমি কই রাখব মাবুদ? বউয়ের লজ্জার মাগফিরাত করার পরও, বউ আমার লজ্জা পায়!”
বাড়ির সবাই এসে এশা কে দেখে গেছেন আর একটা কথাই উনাদের মুখে!
— হঠাৎ এত জ্বর আসল কই থেকে
কেউ জানুক আর না জানুক এশা আর মেহরাজ তো জানে কোথা থেকে এলো এত জ্বর!
—বাড়ি ফেরার পর সবাই একসুরে প্রশ্ন করলো—
“তোমরা কোথায় ছিলে?”
এহসান এক চিলতে হাসি হেসে খুব সহজে উত্তর দেয়,
— “ঘুরতে গিয়েছিলাম… রাতের সিলেট শহর দেখতে।”
শব্দগুলো এতটাই স্বাভাবিক যে কেউ বুঝতেও পারলো না, এই ‘রাত’ আর ‘ঘোরা’ শব্দের ভেতর লুকিয়ে আছে কতটা দহন, কতটা জ্বালা।
মেহনূর তখন নিজের ঘরে, গোসল সেরে চুপচাপ বসে আছে বিছানায়। গা থেকে এখনও পানি টপটপ করে ঝরছে, কিন্তু সে যেন কিছু টের পায় না। দুচোখ স্থির, বুকের গভীরে জ্বলে আগুনের শিখা।
অন্যদিকে এহসান গোসল সেরে কাপড় পরে নিচ্ছে, যেন সবকিছুই স্বাভাবিক, যেন পৃথিবীর কোনো দুঃখ তাকে ছুঁতে পারে না।
কিন্তু মেহনূরের ভেতরে চলছে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। তপ্ত শ্বাস ফেটে আসছে বুকের কোণে কোণে।
কীভাবে সহ্য করবে সে এই পাপিষ্ঠ পুরুষের সান্নিধ্য?
একই ছাদের নিচে, একই ঘরে, একই বিছানায়?
যার বুক ছাড়া ঘুম আসে না, আজ তাকেই ঘৃণায় দেখতে পারছে না সে।
কী করে বাঁচবে এমন পাপের সঙ্গে?
কী করে বাঁচবে এমন একজন মানুষের পাশে, যার উপস্থিতি নিকৃষ্টতর হয়ে উঠেছে তার কাছে?
হাসফাঁস করে উঠছে মেহনূর।
মনে হচ্ছে, যদি পারত, এ জীবনটাই ছুঁড়ে ফেলে দিত।
যেখানে ছিল, সেখানেও তার কোনো অস্তিত্ব নেই আজ।
যেখানে ছিল শান্তি, সেখানেও আছে শুধুই নিকৃষ্টতার গন্ধ।
“এত কষ্ট… এত যন্ত্রণা… কিসের প্রাপ্য এটা?”
নিজেকে প্রশ্ন করে বারবার।
জন্মের পর মা-বাবার ভালোবাসা পায়নি।
বাবাকে চোখে দেখেনি কখনও, আর মা… জীবিত থেকেও দেখা হয়নি।
বিয়েও হয়নি নিজের ইচ্ছেতে।
আর যখন সেই অনিচ্ছার স্বামীকে নিজের করে নিতে শুরু করল, তখনি সে বুঝল—
সে যে নিকৃষ্ট, ভয়াবহভাবে নিকৃষ্ট!
চোখে পানি আসে না, অথচ বুকটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।
কে বুঝবে এই কষ্ট?
কেউ না, একমাত্র তার রব ছাড়া।
ভাবনারা ঘূর্ণির মতো পাক খেতে খেতে যখন তাকে একেবারে নিঃশেষ করে ফেলছে, ঠিক তখনি এহসান এসে বিছানায় মাথা রাখে বালিশে।
মেহনূর এক পলকে তাকায়… হ্যাঁ, ওর মনে পড়ে—
এহসানের ক্ষতের জায়গায় আজও পানি তুলা দেয়নি সে।
প্রতিদিনই তো দেয়… আজ কেন নয়?
আজ এহসান পাঞ্জাবি-লুঙ্গি পরেই বিছানায় শুয়ে পড়েছে!
ইচ্ছে করেই…
হ্যাঁ, ও জানে— এটা ইচ্ছে করেই করেছে।
চায়, মেহনূর গিয়ে ওর যত্ন নিক।
কিন্তু না, মেহনূর যাবে না।
যে মানুষ চামড়া ছিঁড়ে নিতে পারে, তার শরীরের চামড়া সজীব থাক বা না থাক, তাতে কিছু যায় আসে না!
দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে মেহনূর।
একটাই সিদ্ধান্ত মাথায়—
এই নরক থেকে, এই পাপ থেকে, এহসানকে তাকে সরাতে হবেই।
নিজেকে এত সস্তা ভাবতে রাজি নয় সে।
যদি এহসান শোনে না, তবে… তাকে শেষ করেই নিজে মরবে।
প্রথমে হত্যা, তারপর আত্মহত্যা— এক নিখুঁত পরিকল্পনা, এক নিঃশেষ প্রতিজ্ঞা!
এদিকে এহসান মেহনূরের দিকে তাকিয়ে থাকে সেই চিরচেনা দুষ্ট দৃষ্টিতে।
আজও, এই নারী… এই মায়াবী মুখ… তাকে পুড়িয়ে মারছে।
কতটা ভালোবাসে, অথচ সে তা স্বীকার করে না!
এহসান চোখ বন্ধ করে নিজের হৃদয়কে বোঝাতে চায়—
“না, কোনো প্রয়োজন নেই তার ভালোবাসার।
আমি ভালোবাসলেই তো হলো।”
কিন্তু মন যে শোনে না…
বারবার কেঁদে ওঠে সেই এক প্রশ্নে—
“সে কি একটুও ভালোবাসে না আমাকে?”
পাগল যেমন এক কথা বুঝে না, বারবার একই প্রশ্ন করে—তেমনি আজ এহসানও যেন পাগল। একটা উত্তর তার চাই–ই চাই, যেভাবেই হোক।
তাই আবারও মেহনূরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
— ভালোবাসো আমায়?
চারদিকে যেন ঘন নীরবতার চাদর। হঠাৎই সেই প্রশ্নটা মেহনূরের কানে এসে বাজে। বুকটা কেঁপে উঠে!
সে কী বলবে? কীভাবে বলবে? সে তো এখনো ভালোবাসে এহসানকে… প্রতিটা নিঃশ্বাসে, প্রতিটা ভাবনায়। তবু মুখে সে কথা আনতে পারে না। সেই অনুভবের স্বীকৃতি দিতে গিয়ে নিজের জবানেই ঘেন্না ধরে যায়।
ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে একরাশ ঘৃণা নিয়ে তাকায় এহসানের চোখে।
ঠান্ডা অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে—
— আপনার মতো পাপি কে আমি ভালোবাসতে পারি না, এতে আমি পাপের অংশ হয়ে যাব।
মেহনূরের কথা যেন বিষের মতো ছড়িয়ে পড়ে এহসানের হৃদয়ে।
তবু সে ভাঙে না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, বলে—
— আমার পাপ দেখলে শুধু প্রিয়তমা? আর আমার ভালোবাসা, সেটা বুঝলে না?
মেহনূরের চোখের কোণে জমে ওঠে পানি। নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে মুছে ফেলে তা।
তারপর সংবরণ করা কণ্ঠে বলে—
— বুঝিছি… তাই তো আপনাকে আপন করে নিয়েছি। কিন্তু আপনি প্রমাণ করে দিলেন আপনি ভালোবাসার যোগ্য নয়।
এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে এহসান, কণ্ঠটা ক্লান্ত আর বিষণ্ণ—
— হ্যা, সেটাই তো… আমার মতো পাপি কেনো তোমার ভালোবাসার যোগ্য হবে, প্রিয় নারী? আমি তো শুধু তোমার ঘৃণারই যোগ্য!
এহসানের অভিমানভরা কথায় মেহনূরের ভেতরটা ফেটে যায়। চোখে পানি আসে, গলায় উঠে কান্নার রেশ। তবুও নিজেকে সামলে কঠিন গলায় বলে—
— তাহলে বারবার কেনো জিজ্ঞেস করছেন,আমি আপনাকে ভালোবাসি কিনা?
চোখে এক নিরুত্তাপ দৃষ্টি নিয়ে এহসান বলে—
— আমার পাপ, তাপ মেনে আমায় ভালোবাসা যায় না, প্রিয়তমা?
মেহনূর চোখের জল গোপন করে মুখ ফিরিয়ে নেয়। শান্ত অথচ তীব্র কণ্ঠে বলে—
— না, যায় না।
— কেনো যায় না?
— নিকৃষ্টদের ভালোবাসতে নেই। তাদের ভালোবাসলে কলঙ্ক আর পাপের বোঝা বইতে হয় সারাজীবন।
প্রতিটি শব্দ যেন এহসানের কলিজায় গিয়ে ঘুষি মারে। তার কণ্ঠে অনুরোধের সুর—
— আমায় ভালোবেসে নাহয় কলঙ্কের বোঝা বইলে, তাতে কি এমন ক্ষতি হবে প্রিয়তমা?
একটু থেমে ধীরে বলে—
— সমস্যা নেই… তুমি আমায় নাই বাসো ভালো… কিন্তু আমি তো ভালোবাসি তোমায়। আর এতেই হবে আমাদের।
মেহনূর মুখ ঘুরিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। গলা নিঃসংগ, কিন্তু স্পষ্ট—
— নিকৃষ্টদের ভালোবাসা, ভালোবাসা নয়… এক অভিশাপ। ভয়ংকর অভিশাপ।
এহসান তখন ধীরে ধীরে মেহনূরের দিকে এগিয়ে আসে। চোখে সেই চিরচেনা তীব্রতা—
— হ্যা… আর এই অভিশাপেই অভিশপ্ত হতে হবে তোমায় চিরকাল।
এই বলে হঠাৎই মেহনূরের বাহু টেনে ওকে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে। ধপাস করে বিছানায় মাথা এলিয়ে দেয়।
মেহনূর চুপচাপ পড়ে থাকে। জানে, এহসান এখন ঘুমিয়ে পড়বে। আর এহসান যখন ঘুমায়, তখন যেকোনো পরিস্থিতিতেই মেহনূরকে তার বুক থেকে সরায় না। যেন সেখানেই তার আশ্রয়…
মেহনূর কাঠের পুতুলের মতো পড়ে থাকে। এই বুক, এই পাপিষ্ঠ বুকই এখনো তার শ্রেষ্ঠ আশ্রয়।
চোখ বুঁজে গেলে আবারও ভেসে ওঠে সেই স্তূপ… সেই ভয়ঙ্কর চামড়ার স্তূপ… বমি আসে!
কীভাবে পারল এহসান? এতটা নিকৃষ্ট কীভাবে হতে পারে একজন মানুষ?
এহসান তখন মেহনূরের মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে বলে—
— ঘুমিয়ে যাও, আমার পাপিষ্ঠ বুকে। এই পাপিষ্ঠ বুকই তোমার শ্রেষ্ঠ আশ্রয়।
মেহনূর হালকা নড়াচড়া করে, শূন্য চোখে তাকিয়ে মলিন কণ্ঠে বলে—
— এহসান, যদি নিজের পাপ ছাড়তে না পারেন, তো দয়া করে আমায় ছেড়ে দিন।
এহসান সেই একই কোমল ভঙ্গিতে বলে—
— আমি কাউকে ছাড়তে পারব না।
মেহনূর তাচ্ছিল্যভরা হাসি দিয়ে বলে—
— তাহলে এই বুকে আমায় আর বেশি সময় পাবেন না। হারিয়ে যাব আমি… তলিয়ে যাব। আর তার একমাত্র কারণ হবে আপনার পাপ।
এহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে—
— আমার থেকে হারানো এত সহজ নয় প্রিয়তমা… তোমায় আমি আঁকড়ে ধরেই বাঁচব… যতদিন বাঁচব…
— ইনশাআল্লাহ।
মেহনূর চুপ করে থাকে।
কানে আবারও ভেসে আসে সেই আত্মার চিৎকার। সেই ভয়াবহ দৃশ্য…
সে হঠাৎ কেঁদে ওঠে… এহসানের পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরে, ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলে—
— আমি পাপিষ্ঠের জন্য কাঁদছি না… আমি নিজের অস্তিত্বকে পাপে ডুবে যেতে দেখে কাঁদছি। আমার কী হবে… আমি কী নিয়ে বাঁচব?
আবারও কেঁদে উঠে সে।
সে চায়… সে মরিয়া… কোনোভাবে যেন এহসান এই ভয়ঙ্করতা থেকে সরে আসে।
কিন্তু এহসান তো বদলায় না!
সেই একই অভিজাত, ভয়ঙ্কর, অথচ ভালোবাসায় অটল।
সেই পুরুষ… যার পাপ আছে, কিন্তু ভালোবাসাও অকৃত্রিম।
এহসান এখন একটি জনসভায় বসে আছে, শহরের মানুষ তার দিকে তাকিয়ে, অপেক্ষা করছে তার বক্তব্যের জন্য। কিন্তু তার মন অন্য কোথাও ডুবে। সকালে চোখ খুলতেই পার্টি অফিস থেকে ফোন এসেছিল। একে তো মেয়রের দায়িত্ব, তার উপর বাজেট নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তার শরীরও ভেঙে পড়েছে। কিন্তু এহসান তো জানত, এই বাজেট যদি সঠিকভাবে প্রণয়ন করতে পারে, তাহলে পুরো শহরের ভবিষ্যত বদলে যেতে পারে। তাই অসুস্থ অবস্থাতেও সে স্থির ছিল।
গত কয়েকদিন ধরে সে বাজেট কমিটির সদস্যদের নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছে। পরিকল্পনার প্রতিটি দিক নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করেছে। আজ সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ—সভার দিন। সবার উপস্থিতি একে অপরকে দেখলে মনে হতো যেন এক বিশাল যাত্রার প্রস্তুতি চলছে।
বাজেট কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন
অর্থনীতিবিদ, যে সব সময় সংখ্যার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সত্য খুঁজে পায়,
নগর পরিকল্পনাবিদ, যার চোখে থাকে ভবিষ্যতের শহর,
শিক্ষাবিদ, যাদের কাছে শহরের শিক্ষার অবস্থা নিয়ে সব ধরনের সুপারিশ ছিল।
এছাড়া ছিল নগর সচিব মুর্শিদ আলী, যিনি প্রশাসনিক তৎপরতা চালিয়ে চলেছেন, কাউন্সিলর সেলিম আহমেদ, তসলিমা বেগম, এবং রফিকুল ইসলাম, যাদের সঙ্গে কথা না বললে কোনো সিদ্ধান্ত পূর্ণতা পায় না।
প্রশাসনিক কর্মীদের মধ্যে শফিকুর রহমান এবং রিয়া সুলতানা, যারা প্রতিটি কাগজপত্র সঠিকভাবে সম্পাদনা করছিলেন। পুলিশ প্রধান আহমদ শরীফ ছিলেন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে। সামাজিক সেবা বিভাগের কর্মকর্তারা—জাহিদ হাসান এবং তানিয়া রহমান—ছিলেন শহরের মানুষের জন্য নানা ধরনের পরিষেবা নিয়ে।
নাগরিক প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলী এবং সুমাইয়া ইসলাম তাঁদের প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালন করছিলেন, যা একান্তভাবে শহরের নাগরিকদের সমস্যা তুলে ধরতে সহায়ক ছিল।
এহসান জানত, তাদের প্রত্যেকের কাছে আলাদা আলাদা দায়িত্ব ছিল, কিন্তু একত্রিত হয়ে তারা শহরের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকর বাজেট তৈরি করতে পারবে। তার লক্ষ্য ছিল একটি বাজেট তৈরি করা, যা শুধু শহরের অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, বরং মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে।
“সবাই প্রস্তুত তো?”—এহসান নিজের চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে বলল। কণ্ঠে এক ধরনের দৃঢ়তা, যা প্রতিটি সদস্যের মনে আশার সঞ্চার করছিল।
–“হ্যাঁ, মেয়র সাহেব, আমরা প্রস্তুত,”—সমবেত কণ্ঠে উত্তর এল।
এহসান জানত, তার সামনে একটি বিশাল দায়িত্ব। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যে কোনো পরিস্থিতিতে তাকে এগিয়ে যেতে হবে। এবারের বাজেট হতে হবে নির্ভুল, হতে হবে জনগণের কল্যাণে সমর্পিত।
এহসান গম্ভীর চোখে সবাইকে দেখে বলল,
—“এটা আমাদের শহরের জন্য নতুন সূচনা, আর এই সূচনা সফল করতে হলে আমাদের একসাথে কাজ করতে হবে।”
এহসান কে ডাকা হলো ব্যাক্তবের জন্য ‘!
এহসান তালুকদার ধীরে ধীরে মাইক্রোফোনের দিকে এগিয়ে গেল। সভার কক্ষে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। সব চোখ তাকিয়ে, শোনার অপেক্ষায়। সে জানত, আজকের দিনটা শুধু তার জন্য নয়, পুরো শহরের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। বাজেট শুধু হিসাব-নিকাশের খেলা নয়, এটি শহরের ভবিষ্যৎ—এটা মানুষের জীবনযাত্রার সাথে সম্পর্কিত, তাদের আশা, স্বপ্নের সাথে।
সে শ্বাস টানল, কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর তার কণ্ঠে উঠে এল গভীর গম্ভীরতা,
“আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।”
“প্রিয় সহযোগী বৃন্দ, সম্মানিত সদস্যগণ, আজ আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি শুধু কিছু সংখ্যার উপর আলোচনা করতে নয়, বরং আমাদের শহরের ভবিষ্যৎকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য, আমাদের নাগরিকদের জীবনযাত্রাকে সহজ, উন্নত ও সুখী করার জন্য। আজ আমরা একটি বাজেট প্রস্তুত করছি, যা শহরের প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছাবে, যা তাদের প্রতিদিনের জীবনে বাস্তব পরিবর্তন আনবে।”
সে কিছুক্ষণ থেমে, চোখ বন্ধ করে যেন প্রতিটি শব্দের গুরুত্ব অনুভব করতে চাইল।
“আমরা জানি, আমাদের শহর গত কয়েক বছর ধরে অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে গেছে। অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা—এসব ক্ষেত্রে আমরা বহু সংকটে পড়েছি। কিন্তু এই বাজেটের মাধ্যমে, আমি আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিতে চাই যে, আমরা শুধু খাতভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করব না, বরং প্রতিটি নাগরিকের জন্য এমন একটি পরিবেশ তৈরি করব, যেখানে তারা আত্মবিশ্বাসী হতে পারে, যেখানে তারা নিজের অবস্থান থেকে উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে।”
এহসান একবার সবাইকে চোখের সামনে দেখে নিল। সবার মুখে নানা রকম চিন্তা ও আশার রেখা ফুটে উঠেছে।
“এ বাজেট আমাদের উন্নয়ন, আমাদের অর্থনীতি, আমাদের শিক্ষা, আমাদের স্বাস্থ্য—সবকিছুতেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবে। আমার লক্ষ্য একটাই, শহরের প্রতিটি মানুষের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা। আমি জানি, বাজেটের এই সংখ্যা গুলো, এই খাতের হিসাব গুলো অনেকের কাছে শুষ্ক মনে হতে পারে, কিন্তু আমি জানি, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে আমাদের শহরের প্রতিটি কোণায় মানুষদের জন্য নতুন জীবন।”
এহসান আবারও গভীর শ্বাস নিল।
—“নগর উন্নয়ন, নতুন রাস্তাঘাট, পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ পরিষেবা—এগুলি যেমন জরুরি, তেমনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজসেবা—এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। আগামী বাজেটে আমরা স্বাস্থ্যখাতে বিশেষ বরাদ্দ বৃদ্ধি করব, যাতে আমাদের হাসপাতালগুলো আধুনিক ও দক্ষ হতে পারে। আমরা শহরের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের উন্নয়ন করব, যাতে নতুন প্রজন্ম এগিয়ে যেতে পারে। আর সমাজসেবা খাতে আমরা এমন একটি ব্যবস্থা চালু করব, যেখানে শহরের প্রতিটি নাগরিক, বিশেষত সাধারণ মানুষ, কোনো ধরনের সংকট বা দুর্দশার শিকার হলে দ্রুত সহায়তা পাবে।”
এহসান একটি হাসি দিয়ে আবারও বলল, “
—এখনকার এই বাজেট শুধু পরিসংখ্যানের খেলা নয়, এটি এক একটি প্রতিশ্রুতি, এক একটি দৃষ্টি—আমরা সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে থাকব, ইনশাআল্লাহ। শহরের উন্নয়ন করতে হলে আমাদের একে অপরকে সমর্থন করতে হবে, একে অপরের পাশে থাকতে হবে। এই বাজেট শুধু অর্থনৈতিক পরিবর্তন আনবে না, বরং এটি আমাদের মনোবলকেও শক্তিশালী করবে।”
সে একটু থেমে চোখ মেলল, সবদিকেই সহমতপূর্ণ দৃষ্টি।
আত্মার আগলে পর্ব ৪৩
“আমি চাই, আগামী দিনগুলোতে, আমাদের শহরের প্রতিটি বাসিন্দা যেন গর্ব করতে পারে যে তারা এই শহরের নাগরিক। তাদের জন্য এই বাজেট, তাদের ভবিষ্যতের জন্য—আমরা যা কিছু পরিকল্পনা করেছি, তা যেন তাদের জীবনে প্রতিফলিত হয়। আজকের এই বাজেট, শহরের জন্য একটি নতুন সূচনা হবে। আমি বিশ্বাস করি, আমরা একসাথে কাজ করলে সব বাধা কাটিয়ে উঠে শহরকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারব।”
এহসান শেষ কথা বলার পর একটি দীর্ঘ নীরবতা, তারপর সবাই একযোগে সম্মতি জানালো, যেন একে অপরের সাথে অঙ্গীকার করেছিল—এই বাজেট শহরের জন্য হবে এক নতুন যাত্রা, এক নতুন প্রভাত।