আত্মার আগলে পর্ব ৪৬+৪৭
সানজিদা আক্তার মুন্নী
“আমার ভাইজানকে ছেড়ে দিন। আমি তো আপনার দাসী হয়েই আছি এ জীবনে। এবং আমি আপনাকে কথা দিলাম, প্রয়োজনে আপনার পাপিষ্ঠ অস্তিত্বও বইব এ বাকি জীবন, তাও ছেড়ে দিন আমার ভাইকে। আমার ভাইজানের সুন্দর একটা জীবন পড়ে আছে, তার জন্য তার স্ত্রী অপেক্ষা করছে। ছেড়ে দিন এহসান, ছেড়ে দিন… মাফ করুন আমাদের, দয়া করুন একটু।”
মেহনূর কান্না করতে করতে এহসানের পায়ে পড়ে এই আহাজারি করতে থাকে।
তার সামনেই মেহরুবকে বেঁধে রাখা হয়েছে মৃত্যুর জন্য!
মেহনূরের এই আর্তনাদ দেখে এহসান দাঁতে দাঁত চেপে মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় হাত, আর বলে—
— “পা ছাড়ো আমার। তোমার ঠাঁই আমার পায়ে নয়। উঠো।”
কিন্তু মেহনূর ছাড়ে না। জড়িয়ে ধরে রাখে আর ঢোক গিলে বলে—
— “মাফ করে দিন… দয়া করুন… আমি এমন ভুল কখনোই করব না, সত্যি করব না।”
এহসান দাঁত চেপে বলে—
— “বেয়াদব নারী, বেয়াদবি করিস না। ছাড় পা।”
মেহনূর ছাড়ে না। হু হু করে কেঁদে উঠে বলে—
— “আপনি আমায় মেরে ফেলুন… দয়া করে আমার ভাইজানকে ছেড়ে দিন… উনার কোনো দোষ নেই।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মেহনূর জানে, এহসান ফেরার নয়। ওর ভেতর যা জন্মেছে, তা শুধুই নৃশংসতা। তবু ভেতরে কোথাও একটা আশার আলো রেখেছিল—ভুল ভেবেছিল।
মেহনূর তাকে ভালোবাসে। আর ভালোবাসা মানে এই নয় যে, সে তার অন্যায়ের পাশে দাঁড়াবে। বরং ভালোবাসা মানে—তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা।
এ কারণে সে এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এহসানের সব অন্ধকার দিকগুলো সে বলেছে মেহরুবকে—না, মেহরাজকে বলেনি।
মেহরাজ এশার স্বামী, যতই হোক—তার এখনো কিছু দায়িত্ব থেকে যায়। কিন্তু মেহরুব?
সে সাহসী, বুদ্ধিমান—তাকে সে বলেছিল, যেন খুঁজে বের করে কোথায় চলছে এই নরকযন্ত্রণা।
যেখানে নিরীহ মানুষদের আটকে রাখা হয়, যেখানে অন্ধকার গিলে ফেলে আলোর সমস্ত আশা—সেই জায়গার খোঁজে নেমে পড়েছিল মেহরুব।
মেহরুব এসেছিল, চুপিচুপি। প্রমাণ জোগাড় করতে।
না, সে পুলিশ ডাকার পক্ষে না। আগে সে নিজ চোখে দেখে নিতে চেয়েছিল—এই নরকের আসল চেহারা।
কিন্তু সে জানত না, এহসান এতটা আগে থেকে সব আঁচ করে ফেলেছে।
এহসান নিজের ফোনেই পেয়েছে সেই ছিঁচকে ষড়যন্ত্রের ছাপ—কল রেকর্ড, মেসেজ, ঠিকানা…
সবই তার হাতের মুঠোয়। মেহনূর যে তার ফোন দিয়েই এসব কর্ম করেছে তার অগোচরে
মেহরুব ধরা পড়ে যায়। এহসানের লোকেরা তাকে ধরে আনে, আর তুলে দেয় সেই কোলনির উঠোনে রাখা একটা পুরনো লোহার চেয়ারে।
হাত-পা বাঁধা। চোখে শীতল ভয়। মুখে নির্ভীক চাহনি।
এহসান তখন মেহনূরের কো নিয়ে আসে উঠোনে।
তার চোখে হিংস্র আগুন, মুখে অদ্ভুত ঠান্ডা হাসি।
সে চায়, মেহনূরের সামনেই মেহরুবকে শেষ করতে।
শুধু একটা কোপ… আর তার পর সব শেষ।
কিন্তু মেহনূর?
সে ভেঙে পড়ছে না। সে কাঁদছে না। সে কেবল বলছে—
“না! প্লিজ… না… কিছু করবেন না!”
তার চোখে জল, কণ্ঠে আর্তি—
-“মাফ করে দিন মাফ”
এই আর্তিতে কেঁপে ওঠে এহসানের ভেতরের সেই পুরোনো মানুষটা।
হ্যাঁ, পাপিষ্ঠ সে।
কিন্তু এখন এই একটুকু কণ্ঠস্বর তার হৃদয়ের সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় আঘাত হানে।
সে থেমে যায়।
মেহনূরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
তারপর নিঃশব্দে পেছনে সরে যায়।
আকাশজুড়ে তখনও স্তব্ধতা।
আর উঠোনে, সেই বন্দি চেয়ারটার সামনে দাঁড়িয়ে এহসান।
যার চোখে ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছে দ্বন্দ্ব।
মেহনূরের ভালোবাসা কি তাহলে সত্যিই তার অন্তরের নরককে পুড়িয়ে ফেলতে পারবে?
এত কিছুর পরও এহসানের মেহনূরের উপর তীব্র রাগ হচ্ছে না। এ কেমন যন্ত্রণা! সে কেনো রাগ করতে পারছে না এই নারীর উপর? সামান্য বিরক্তিটুকুও আসে না… আর রাগ তো বিলাসিতা।
এহসান চোখ খুলে মেহনূরের বাহু আলতো করে ধরে তুলে দাঁড় করায়। মেহনূর কাঁপছে… দাঁত অব্দি কাঁপছে। ধরা পড়ে গেছে সে। এমন অবস্থা হবে তা ভাবেনি কখনো।
মেহনূরকে ভয়ে কাঁপতে দেখে এহসান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে—
— “স্বার্থপর নারী! এত যখন ভয় পাও আমায়, তখন নিজ স্বার্থ কেন খুঁজো বারবার?”
মেহনূর কাঁপতে থাকে, হাত-পা ভয়ে আসাড় হয়ে আসছে। একটাই ভয় — ভাইজানের মৃত্যুর কারণ হওয়ার ভয়।
মেহরুব তখন চিৎকার করে বলে—
— “মেহনূর! খবরদার, তুই এই পশুর কাছে মাফ চাইবি না! আমি যদি মারাও যাই, তাতেও না! মনে রাখিস, তুই সঠিক… তুই সঠিক!”
মেহরুবের কথায় এহসানের গা জ্বলে ওঠে, যেন গায়ে লংকা দিল কেউ। সারা শরীর জ্বলে পুড়ে ওঠে। মেহনূরকে এক টানে সরিয়ে দিয়ে, এহসান অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় মেহরুবের দিকে—
— “স***রের বাচ্চা, উওম মধ্যাম খাসনি এখনও! আমার হাতের দিব দু-একটা।”
এ বলেই এহসান মেহরুবের দিকে এগিয়ে যেতে নেয়।
মেহনূরের মনে হয় আত্মা বেরিয়ে যাচ্ছে। সে পাগলের মতো এহসানের বাহু টেনে ধরে চিৎকার করে—
— “না! না না! কিছু করবেন না! না!”
এহসান থেমে যায়। চোখ তুলে তাকায় মেহনূরের দিকে। কলিজা খচ করে ওঠে। মেহনূরের নিকাবের চোখের উপরের অংশ ভিজে গেছে।
সে বলে—
— “ছাড়ো আমায় মেহনূর।”
মেহনূর ছেড়ে দিয়ে মুহূর্তেই ঝাপটে ধরে এহসানকে, আর কাঁদতে কাঁদতে বলে—
— “ছেড়ে দিন আমায়… মাফ করে দিন… দয়া করুন আমায়… আমার ভাইটাকে মাফ করে দিন…”
এহসান অবাক হয়। এই নারীর এমন স্বার্থ দেখেও সে তাকে ভালোবাসে! স্বার্থপর? হোক! সে ভালোবাসে এই স্বার্থপর নারীকেই। নিঃস্বার্থ হলেও, স্বার্থপর হলেও তার… সেই তো তার মেহনূর।
এহসান মেহনূরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে—
— “কেঁদো না… কিছু করব না আমি, মেহনূর।”
মেহনূর সুস্থির শ্বাস ফেলে। কিন্তু তাও এহসানকে আঁকড়ে ধরে রাখে।
তার এমন ভয় দেখে এহসান আবার তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে—
— “নিজের বুঝ তো খুব ভালোই বুঝো প্রিয়তমা! নিজের বাবা, নিজের ভাই, নিজের চাচা—সব! সবার দোষ জেনেও তাদের এত ভালোবাসো। কিন্তু আমি? এত ভালোবাসার পরও আমার পাপের জন্য আমায় এত ঘৃণা করো? এত?”
মেহনূর নির্বাক হয়ে যায়। হ্যাঁ, সত্যিই তো! সে তো শুধু নিজের বুঝি বুঝে… কিন্তু এইসব তো সে এহসানকে নিয়ে একটা সুন্দর জীবন পার করার জন্যই করছে।
মেহনূর এহসানের পাঞ্জাবির পিঠের অংশ আঁকড়ে ধরে বলে—
— “ভালোবাসেন… এত কিছুর পরও আমায়?”
এহসান হতবাক এই প্রশ্নে। এই নারীকে কীভাবে সে বোঝাবে? যে তার প্রাণ পর্যন্ত এ নারীর হাতে সঁপে দিতে রাজি সে।
এহসান মেহনূরের কানের কাছে মুখ এনে বলে—
— “তোমার প্রতি ভালোবাসা আমার এই জীবন কি পরজীবনেও শেষ হবে না… মনে রেখো প্রিয়তমা।
মেহনূর মনে করেছিল, এহসান হয়তো মেহরুবের সাথে তাকেও জিন্দা কবর দেবে। একটা সময় পর্যন্ত এই পুরুষটাকে সে এক নিষ্ঠুর দানব বলে ভেবেছিল—যে ক্ষুধার্ত প্রতিহিংসায় পুড়ে ছাই করে দেবে সবকিছু। অথচ…
এই পুরুষ তো সম্পূর্ণ তার ভাবনার বিপরীত!
সে তো ভালোবাসে… গভীর, নিঃশর্ত আর জ্বলন্ত ভালোবাসায়!
এহসান ধীরে ধীরে মেহনূরের হাত ছাড়িয়ে নেয়। তারপর মেহরুবের দিকে এগিয়ে যেতে নেয়।
কিন্তু মেহনূর আবারও চমকে উঠে তার হাত আঁকড়ে ধরে।
— “না… না… কিছু করবেন না!”
মেহনূরের গলা কাঁপছে, চোখে আতঙ্ক জমে আছে।
এহসান থমকে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসে। তার ঠোঁটের কোণে এক ধরণের শান্ত দাহ জ্বলে ওঠে। সে মেহনূরের চোখে চোখ রেখে ধীরে বলে—
— “আস্থা রাখো… পাপিষ্ঠ হতে পারি, কিন্তু কথার খেলাফ করি না। কিছু করব না, শুধু কথা বলব।”
মেহনূর নিঃশ্বাস চেপে ধরে। তারপর ধীরে ধীরে কাঁপতে কাঁপতে তার হাতটা ছেড়ে দেয়।
এহসান তখন সামনে এগিয়ে যায়। মেহরুবের সামনে গিয়ে চেয়ারের হাতলে দুই হাত ভর দিয়ে শরীরটা একটু ঝুঁকিয়ে আনে। কণ্ঠটা গভীর, চোখে ভয়াবহ তীক্ষ্ণতা।
— “তুই আমার প্রিয়তমার প্রিয়জন না হতি… তবে তোর কবর নিজ হাতে খুঁড়তাম আজ আমি, এহসান!”
মেহরুব চোখে চোখ রেখে তাকায়। কোনো ভয় নেই, বরং তীব্র অবজ্ঞায় ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে—
— “তোর মতো পাপির যোগ্যতা নেই আমার বোনকে ‘প্রিয়তমা’ বলার। তাই এটা বলবি না।”
এহসান তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। ঠোঁটের কোণে এক বাঁকা ক্ষত ঝুলে থাকে—
— “তোর বোনের আত্মার আগলে অব্দি এই পাপি বিরাজ করে… আর তুই এসব আবোল-তাবোল বকছিস!”
মেহরুব হেসে ওঠে—কিন্তু সেই হাসিতে ব্যঙ্গ, গ্লানি আর অপমান গলে গলে ঝরে পড়ে।
— “আমার বোন বোকা… তাই তোকে ভালোবেসেছে!”
এই কথা শুনে হঠাৎই আগুন ছুটে ওঠে এহসানের চোখে।
সে গর্জে ওঠে—
— “শুকরিয়া আদায় কর রবের প্রতি… যে বেঁচে গেছিস প্রাণে!”
কথা শেষ করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর পিছিয়ে আসে। চোখ নামিয়ে হুকুম দেয় তার লোকদের
— “এই কীটটাকে মুক্তি দিয়ে দে।”
সবাই হতবাক! মুহূর্তেই মেহরুবের বাঁধন খুলে যায়।
এহসান এবার ধীরে ধীরে ফিরে আসে মেহনূরের সামনে। তার চোখে অদ্ভুত কোমলতা—যা আগুনের ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসা কোনো শান্তির ছায়া মনে হয়।
সে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসে। তারপর কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই মেহনূরকে তুলে নেয় কোলে।
মেহনূর তড়িঘড়ি করে বুকে লেপ্টে পড়ে। আজ সে ক্লান্ত, ভীত, আর… ভীষণ অপরাধবোধে পুড়ে যাচ্ছে।
এহসান কানে কানে বলে—
— “চলো… আপন পাপিষ্ঠ রাজ্যে আবারও।”
মেহনূর চুপচাপ চোখ বন্ধ করে রাখে। নিরলসভাবে লেপ্টে থাকে আপন পুরুষের বুকে। সেই বুক—যেখানে সব পাপ আর সব দহন মিলেও ভালোবাসাকে দাবিয়ে রাখতে পারে না।
তার মনে হতে থাকে—
“আমি কি আদৌ এ ভালোবাসার যোগ্য? এত ভালোবাসা পেয়ে আমি কি তার যোগ্য হয়েছি কখনো?”
তবু সে জড়িয়ে ধরে রাখে…
কারণ ভালোবাসা প্রাপ্য দিয়ে মাপা যায় না—
ভালোবাসা শুধু অনুভব করা যায়।
তুমি যতই স্বার্থপর হও, আমি সেই স্বার্থপর নারীকেই ভালোবাসি। তুমি যদি বিশ্বাসঘাতক হও, তবে আমি সেই বিশ্বাসঘাতক নারীর প্রেমেই অন্ধ!”
এহসান আজ অদ্ভুত আচরণ করছে। নিজের হাতে রাতের খাবার খাচ্ছে— এমনটা আগে কখনো হয়নি।
বিয়ের পর যতদিন রাতে একা খেত, ততদিনও মেহনূরের হাত থেকেই খেত।
কিন্তু আজ?
বাড়ি ফিরে মেহনূরকে ডাকার প্রয়োজনও মনে করল না।
নিচে এসে চুপচাপ টেবিলে বসে গেল।
মেহনূর থমকে যায়।
মনটা কেমন করে ওঠে।
সব কিছু কেমন এলোমেলো লাগে হঠাৎ।
এহসান টেবিলে বসেছে— এটা তো শুধুই বসা নয়, একটা বদলে যাওয়া অভ্যাসের নাম, একটা অদৃশ্য দুরত্বের আভাস।
এহসান গম্ভীর গলায় বলে,
— “খাবার দাও।”
শব্দটা যেন বিষের মতো ঘুরে ফিরে বাজে মেহনূরের কানে।
তার হৃদয়ে কাঁপন ধরে।
রাগ নয়, ব্যথা হয়।
খাবার এনে টেবিলে রাখে সে, ধীরে।
হাত কাঁপে না, তবু মন কাঁপে।
আজ এহসান একটিও কথা বলে না।
চুপচাপ খেতে থাকে।
মেহনূর পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, ঠিক আগের মতো, কিন্তু আগের মতো কিছুই যেন নেই।
প্রতিদিন এই সময় এহসান কত গল্প করে, হাসায়, অভিমানে ভরিয়ে আবার মুহূর্তে ভেঙে দেয়।
মেহনূর সেইসব কথায় হেসে হেসে কখনো কেঁদেও ফেলেছে— ভালোবাসায়, প্রশ্রয়ে।
আর এহসান?
চুপচাপ তাকিয়ে থেকেছে মুগ্ধ চোখে, যেন এই হাসিই তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
আজ নেই কিছুই।
আজ এহসান যেন দূরের কেউ।
অচেনা, নীরব, কঠিন।
মেহনূরের বুকের মধ্যে জমে ওঠে কান্না।
সে জানে— এহসান রাগ করেছে।
কিন্তু এমন করে?এমন নিরবতায় ভরিয়ে দেবে তাকে?
সে মুখ ফিরিয়ে চলে যায় রান্নাঘরে।
চোখের পানি আর আটকে রাখা যায় না।চুপিচুপি চোখ মুছে ফেলে।
তার ভেতর পুড়ে যাচ্ছে এহসান এর এমন অবহেলায়! সে নিতে পারছে না আর’!
পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা এহসান মুচকি হেসে ফেলে।
নিজেকেই বলে,
— “আমি তো তোমার রাগ-অভিমান ভাঙাতেই ন্যস্ত। আজ নাহয় তুমি একটু সহ্য করো।”
তার কণ্ঠে ক্লান্তি, কিন্তু ভালোবাসা ঝরে পড়ে।
চোখে এক ধরনের বিষণ্নতা—
যা একজন ভালোবাসার মানুষের নিষ্পাপ রাগকে দেখেও সয়ে নেয়।
নিজেকেই বলল,
— “বোকা নারী, তোমার এহসান ভীষণ বেকুব। দেখো, একটু কথা না বলাতেই কাঁদছে। অথচ যখন বলি, তখন তো শুনতেই চায় না!”
খাবার শেষ করে উঠে দাঁড়ায়,
— “আমার শেষ, তুমি খেয়ে নিও।”
মেহনূর যেন তার নাম শুনেই প্রাণ ফিরে পায়।
তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বেরিয়ে আসে।
চুপচাপ খাবার গুছাতে শুরু করে।
এহসান বলে,
— “খাবে না? সব রেখে দিচ্ছো যে!”
মেহনূর থমকে যায়।
কী করে বলবে— গলা দিয়ে কিছু নামছে না!
তবু ওড়নাটা ঠিক করতে করতে বলে,
— “খাব, খাব। রান্নাঘরেই বসে খাব।”
এহসান কিছু না বলে চলে যায় ওপরে।
পায়ের শব্দ যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় দূরে, যেমন করে মাঝে মাঝে মানুষ দূরে সরে যায় মনের ভেতর থেকেও।
মেহনূর একা বসে থাকে রান্নাঘরে।
চোখের কোনে জমা জল ফোটে না, ঝরে পড়ে। মেহনূর সব গুছিয়ে “!
তারপর যায় ঘরে। ঘরে গিয়ে দেখে ঘরটা ফাঁকা।মনটাও।এহসান নেই।
মেহনূর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বাথরুমে প্রবেশ করে ওযু করার জন্য “!
এহসান ঘরে নেই, বেলকনিতে দাঁড়িয়ে। মন বিষাদে ভরে গেছে।
মেহনূরের এমন ব্যবহারে সে অসহায়।
মেহনূর বাথরুম থেকে এসে এহসান কে না দেখে ঘরে আর থাকতে পারে না।অভিমান ভুলে অনুশোচনায় ভরে ওঠে মন।
সে জানে— সে ঠিক ছিল, কিন্তু এমন ব্যবহারেরও তো একটা সীমা আছে!তাকে বুঝতে হবে, মানাতে হবে।
কিন্তু মস্তিষ্ক বলে—
“তুমি ঠিক, তুমি পাপ করোনি। কেন তুমি আগে এগোবে?”
অন্তর বলে—
“সে যদি পাপীও হয়, তবুও সে তো তোমার। তার প্রাণ তো তুমি। অবহেলায় কিভাবে থাকবে তুমি?”
মেহনূর কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে যায় বেলকনির দিকে।
হাত-পা কাঁপছে, বুক ধকধক করছে।
তবুও— এহসানের মুখোমুখি হতে চায়।শান্তি চায়।ভালোবাসা চায়।
নিশুতি রাতের স্নিগ্ধ বাতাসে পর্দা উড়ছে ধীরে ধীরে। আকাশে ঝরে পড়ছে নরম জ্যোৎস্না। সেই আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে মেহনূরের কাঁপতে থাকা হাত। বুকের ভিতর যেন আগুন জ্বলছে, কলিজা ধক ধক করছে, পা আর চলে না। তবু নিজেকে সামলে, মনের ভাঙা টুকরোগুলোকে জোড়া দিতে বেলকনির দিকে এগিয়ে যায় সে।
হাত-পা কাঁপছে, চোখে জল জমে আছে। কণ্ঠ রুদ্ধ, গলা শুকিয়ে কাঠ। তবুও সাহস করে এহসানের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় মেহনূর।
এহসান ধীরে মুখ ঘুরিয়ে তাকায় ওর দিকে। এক পলকেই বুঝে ফেলে সব। মেহনূরের মুখ শুকিয়ে এসেছে, ঠোঁট ফাটছে, চোখ লাল। এহসানের কপাল ভী কুঁচকে আসে। এমন অসহায় চেহারাটা সে দেখতে চায়নি।
ঠিক তখন—
মেহনূর হঠাৎ সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে, দু’হাতে এহসানের পা জড়িয়ে ধরে।
এহসান মুহূর্তেই হতবাক! সারা শরীর হিম হয়ে আসে।
মেহনূর হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে—
— “আমায় মাফ করে দিন, দয়া করে মাফ করে দিন”! বিশ্বাস করুন আমি আপনায় এসব থেকে সরিয়ে আনতে এসব করেছি”! মাফ করে দিন আমায়, আমি জানি আপনি আমার উপর রেগে আছেন! মাফ করে দিন আমায়! আমি ভুল করেছি! বোকামি করেছি! ভুল করেছি”! মাফ করে দিন আমায়, আমার সাথে কথা বলুন, একটা বার কথা বলুন, বাড়ি আসার পর কথা বলছেন না কেনো? আমি আপনার অবহেলা নিতে পারব না! দয়া করুন আমায়! মাফ করে দিন”
এহসান চোখে মুখে বিষ্ময় নিয়ে চেয়ে থাকে ওর দিকে। এমন বেকুবের মতো কান্ড! এমনভাবে ভেঙে পড়বে, এটা সে কল্পনাও করেনি। পা ছাড়ানোর চেষ্টা করে সে, কণ্ঠে তাড়াহুড়ো আর বিস্ময় মেশানো সুর—
— “উঠো কি করছ তুমি এই পাগলি এমন করছো কেনো উঠো”
কিন্তু মেহনূর তো নাছোড়বান্দা। পা ধরে আছে শক্ত করে। মাফ না পাওয়া পর্যন্ত উঠবে না ঠিক করেছে। কান্নায় গলা কাঁপে তার—
— “না আপনি মাফ করলেই উঠবো বলুন মাফ করছেন”
এহসানের বুকের ভেতর ঢেউ খেলে যায়। এমন অবুঝ পাগলামি… অথচ সে যদি জানত— এহসানের তার প্রতি অবহেলা তো দূরের কথা , সামান্য বিরক্তিও আসে না!
বুক ভার হয়ে আসে। অনেক কষ্টে মেহনূরকে ধরে দাঁড় করায় এহসান।
মেহনূর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, টুপটাপ করে কান্না গড়ায় ওর গাল বেয়ে। শিশুর মতো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে।
মাত্র এক ঘণ্টা কথা বলেনি সে, এই তার অবস্থা! অথচ এই মেয়েটাই— এই মেহনূরই, একসময় তার মৃত্যু কামনা করেছে! তখন তো বুঝে উঠতে পারেনি, এই পুরুষ ছাড়া সে নিশ্বাসও নিতে পারবে না!
এহসান আলতো করে ওর গাল ছুঁয়ে চোখের পানি মুছে দেয়। কণ্ঠ নরম হয় তার—
— “কাঁদছো কেন এভাবে বল কি হয়েছে”
মেহনূর এহসানের চোখে চোখ রাখে, কণ্ঠ ভার—
— “আপনার অবহেলায়… আমি আপনার পাপ তাপ সব সহ্য করতে পারব কিন্তু আমার প্রতি করা আপনারা অবহেলা আমি সহ্য করতে পারব না”!
নিজের ঠোঁট চেপে কান্না আটকে বলে—
— “কেনো বুঝেন না আপনি তা আমি মরে যাই তো মুহুর্তে মুহুর্তে”
এহসানের ঠোঁটে এক চিলতে মুচকি হাসি খেলে যায়। এক টানে প্রিয় নারীটিকে নিজের বুকে চেপে ধরে। যেন সে তার সমস্ত পৃথিবী।
মেহনূর আঁকড়ে ধরে এহসানকে, কাঁপা কাঁপা হাতে। এই পুরুষ ছাড়া সে বাঁচবে না— জানে সে। এই পুরুষ পাপী, তবুও তার ভালোবাসা ভয়ংকর। সেই ভালোবাসাতেই আজ এই মেয়েটা এত বাজেভাবে জড়িয়ে গেছে।
নীরবতায় ভরে যায় চারদিক। একপাশে রাতের বাতাস, আর অন্যপাশে বুকের ভেতর উথালপাথাল ভালোবাসা।
মেহনূর ফুপিয়ে উঠে বলে—
— “খুব রাগ করেছেন তাই না আপনি আমার উপর”
এহসান ফিসফিসিয়ে জবাব দেয়—
— “তোমার প্রতি আমার কোনোদিন কোনো রাগ অভিযোগ নেই….. প্রিয়তমা তোমার প্রতি আমার যা আছে তা হলো ভালোবাসা শুধু ভালোবাসা তীব্র ভালোবাসা!”
মেহনূর আবারও কেঁদে ওঠে। এই পুরুষ এত ভয়ংকরভাবে ভালোবাসতে জানে! বিয়ের পর থেকে কত কষ্টই না দিয়েছে সে… তবুও ভালোবেসে গেছে তাকে… বিনিময়ে কিছু চায়নি…
এহসান মেহনূরের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে—
— “কাঁদো যত ইচ্ছে কাঁদতো মনে রেখো আমার এই বক্ষস্থল শুধু তোমার তাই এই বুকেই তোমার মনের সব ক্ষোভ কেঁদে বিসর্জন দাও”
মেহনূর ঢোক গিলে বলে—
— “আপনার প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই আপনার প্রতি….”
তবে বাকিটা আর বলতে পারে না। ঠোঁট কেঁপে ওঠে, গলা ভারী হয়ে আসে।
আবারও ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে সে।
ভালোবাসার কথা বলবে?
না, পারবে না— বললেই নিজের প্রতি ঘৃণা বেড়ে যাবে আরও…
রাতের নিরবতা এখনও ভেঙে যায়নি। জোৎস্না এখনও ছুঁয়ে যাচ্ছে বেলকনির কার্নিশ, বাতাসের শীতলতা হালকা কাঁপিয়ে দিচ্ছে মেহনূরের চুলের খোঁপা। দু’জনেই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে, একটানা হৃদয়বিহ্বলতার মধ্যে।
এহসান মুচকি হাসে, ঠোঁটের কোণে চিরচেনা সেই ব্যঙ্গরস—
— “যাকে এত ঘৃনা করো তার জন্য এত কান্না?”
তারপর মেহনূরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে—
— “পাপিষ্ঠ দের জন্য কাঁদতে হয় না প্রিয়তমা, তাদের ঘৃনা করতে হয়, ঘৃনা।”
এক পলক থেমে আবারো বলে—
— “তুমি নিজেই তো বলেছিলে, তাহলে এখন কেনো কাঁদছো? তুমি না আমায় ঘৃনা করো?”
মেহনূর আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে এহসানকে, যেন এই বুকই তার আশ্রয়, তার পরিত্রাণ।
— “আমি আপনায় আর আপনার নিকৃষ্টতা কে ভীষণ ঘৃনা করি, ভীষণ… কিন্তু আপনায় ছাড়া আমি নিঃশ্ব… তাই আপনায় আমার চাই।”
এহসান মুচকি হেসে মাথা নাড়ে, হালকা দৃষ্টিতে দেখে মেয়েটার চোখের গভীরতা।
— “যাকে ভালোবাসো না, তাকে আবার কেনো চাও, বেকুব নারী?”
মেহনূর সোজাসাপটা, নির্দ্বিধায় জবাব দেয়—
— “আমি এত কিছু জানি না, আমার শুধু আপনায় চাই। শুধু আপনায়।
আপনায় ঘৃনা করলেও আমি আপনায় চাই, ভালোবাসলেও চাই। আমার শুধু এহসান তালুকদার কেই চাই, শুধু তাকেই চাই। আমি মৃত্যু অব্দি তার আত্মার আগলে থেকে যেতে চাই।”
তার কথাগুলো যেন হাওয়ায় না ভেসে গিয়ে গেঁথে যায় এহসানের হৃদয়ের গভীরে।
এহসান মেহনূরের কোমরে নিজের দুই হাত রাখে। হঠাৎ স্পর্শে কেঁপে ওঠে মেহনূর।
এহসান নিজের হাত শক্ত করে বলে—
— “মাহজাবিন মেহনূর, আপনার আবদার মঞ্জুর হলো। আপনি এই পাপি এহসান তালুকদারের আত্মার আগলে ইহকালে, পরকাল অব্দি থেকে যাবেন।”
মেহনূর আলতো হেসে ওঠে।
এহসান আবার বলে—
— “এই এহসান তালুকদার শুধু মাহজাবিন মেহনূরের। শুধু তাঁহার। এই এহসান তালুকদার নিজের জীবন, নিজে ইচ্ছে সঁপে দিলেন তাঁহার বেগমের হাতে।”
মেহনূর তখনও এহসানের বুকে মাথা রেখে বলে—
— “তাহলে এই মাহজাবিন মেহনূরের জন্য ছাড়তে পারবেন আপনার সব পাপ?”
এহসান মুচকি হাসে। সে জানত, তার বেগম ঠিক এই প্রশ্নটাই করবে।
সে মেহনূরকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে, যেন আর কিছুতেই ছাড়বে না—
— “এই এহসান তালুকদার যতদিন বাঁচবে, ততদিন সে তার পাপ, পবিত্র—উভয় অস্তিত্ব নিয়েই বাঁচবে।”
মেহনূরের ভেতরটা শূন্য হয়ে আসে। কিন্তু তবুও, সে এহসানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
সে পরিশেষে এই বুকেই থাকতে চায়, এই বুকেই।
মেহনূর মাথা তুলে এহসানের বুক থেকে।
এহসান দুই হাতে যত্নে মুছে দেয় তার চোখের পানি।
তারপর মেহনূরের গালে হাত রেখে আদুরি গলায় বলে—
— “একটু হলেই এত কাঁদো কেনো? বারণ করেছি না একদিন না কাঁদতে?”
কণ্ঠ নরম, কিন্তু সেই একই বিষম মায়াবী সুরে বলে—
— “পাপিষ্ঠ পুরুষ কে যখন চাও, তবে দহনে পুড়তেও শিখো। কারণ, পাপিষ্ঠ পুরুষ কে যে নারী ভালোবাসে, তাকে মুহুর্তে মুহুর্তে দহনে পড়তে হয়!”
মেহনূর তখন এহসানের দিকে এক দৃষ্টি ছুঁড়ে দেয়—দূষিত নয়, ভয়ংকর নয়, বরং এমন এক মায়াময় দৃষ্টি যা উল্টো এহসানকেই নিঃশ্বাস আটকে দেয়।
এহসানও তাকিয়ে থাকে তার আপন নারীর ওই ভয়ংকর সুন্দর আঁখি জোড়া পানে।
এই চোখ…
এই চোখের মায়া তাকে মুহুর্তে মুহুর্তে ঘায়েল করে ছাড়ে।
এহসান নিজের বুকের দিকে একবার তাকায়, যেন ঠিক করে নিচ্ছে নিজেকে। তারপর ফের মেহনূরের দিকে তাকিয়ে নিজের বুকের উপর আঙুল রেখে বলে—
— “তোমার এই চোখের চাহনি আমার এই পাপিষ্ঠ বুকের পাঁ পাশে যখন বিঁধে, তখন আমার দুনিয়া স্তব্ধ হয়ে উঠে। আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। আমি নিঃশ্ব হয়ে যাই তোমার আঁখি পানে…এ কেমন ভয়ংকর সুন্দর তোমার চাহনি!”
মেহনূর ধীরে পায়ের তালুতে ভর করে একটু উঁচু হয়ে এহসানের গলায় হাত জড়ায়।
এহসান মুচকি হেসে ভূ কুঁচকে তাকায় ওর পানে “! মেহনূর নেশাক্ত চোখে কিছু মুহুর্ত এহসান এর চোখের দিকে এক দূষ্টিতে তাকিয়ে থাকে “! অতঃপর মুখ এগিয়ে নিয়ে
প্রথমবারের মতো সে নিজে এহসানের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়।
এহসান চোখ বুঁজে নেয় সাথে সাথে “! হাত এগিয়ে মেহনূরের চুলের খোঁপা আঁকড়ে ধরে, তারপর আপন নারীর আপন অধরে নিজেও ডুবে যায়…
মেহরুবের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে নূরি। চোখে ঘুম নেই তার। ভেতরে ভেতরে আলোড়ন উঠছে একটার পর একটা।
মেহরুব সব খুলে বলেছে তাকে। এহসানের ভয়ংকরতা, আর সেই অন্ধকারেই যে তার আপন বোন, ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে—এসব ভাবতে ভাবতেই স্তব্ধ হয়ে গেছে নূরি। এতটা ভয়ংকর এক পরিস্থিতি… বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
মেহরুব নরম হাতে নূরির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কণ্ঠটা প্রশান্ত, কিন্তু সুরে লুকানো এক গভীর চিন্তা।
— “কাল থেকে তোর মাদ্রাসায় পরীক্ষা, নূরি। এসব নিয়ে এখন ভাবিস না। মনটা পড়ার দিকে রাখ।”
নূরি ধীরে মাথা তোলে, বড় বড় চোখে মেহরুবের দিকে তাকায়।
— “হুম… কিন্তু আমার আপ্পি? উনি কীভাবে থাকবেন এত পাপি এক মানুষের সাথে?”
মেহরুব নূরির মাথা নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। হাতটা তার চুলে চুলে ঘুরছে ধীরে।
— “চিন্তা করিস না। আমি জানি, এহসান তালুকদার যতই পাপ করুক, নিজের বেগমকে সে ভীষণ ভালোবাসে।”
নূরি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। চোখে তীব্র এক ক্লান্তি।
— “হুম… হয়তো তাই। তাইতো আপনাকে কিছু করেনি।”
মেহরুব এবার নূরিকে ধীরে বালিশে শুইয়ে দেয়। তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
— “তুই কি চাস, আমার কিছু হোক?”
ভেতরটা ধক করে ওঠে নূরির। এই পুরুষ! কী বলছে সে!
নূরি আর এক মুহূর্তও সহ্য করতে পারে না। ঝট করে উঠে মেহরুবকে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফেলে।
— “আমি স্বপ্নেও চাই না তা। আপনার যদি কিছু হয়, আপনার নূরি ফুল যে চিরতরে ঝড়ে যাবে…”
মেহরুব এবার হেসে ওঠে, ঠোঁটে শান্ত এক আশ্বাসের হাসি। নূরিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, কানে কানে ফিসফিস করে বলে,
— “আমার নূরি ফুল শুধু আমারই হয়ে থাকবে… সারাজীবন…”
নূরি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। সেই হাসিতে ঘরভর্তি হয়ে যায় এক রকম আলোয়।
মেহরুব মুখ তুলে মুচকি হাসে, তারপর নূরির থুতনিতে আলতো দাঁত বসিয়ে দেয়, যেন বলে ওঠে—”তুই শুধু আমার…”
—
মাদ্রাসা থেকে পরীক্ষাটা দিয়েই বেরিয়েছে নূরি।
চোখে ছিল আরাম ফিরে পাওয়ার মৃদু হাসি।
কিন্তু কে জানতো, সেই স্বস্তিই নিমেষে বদলে যাবে ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্নে?
ঠিক মাদ্রাসার গেট পেরোতেই কয়েকজন অচেনা মহিলা ঘিরে ধরে তাকে!বলার সুযোগও পায় না সে।
তার আগেই জোর করে একটা গাড়িতে গুঁজে ফেলা হয় তাকে।
চিৎকার করার আগেই… একধরনের গন্ধ!
চোখের সামনে সব কুয়াশা…
সব শব্দ মিলিয়ে গেল…
তাঁর জ্ঞান হারিয়ে গেল…
চোখ খোলে যখন, তখন নিজেকে আবিষ্কার করে একটা অন্ধকার ঘরের মাঝখানে,চেয়ারে বাঁধা অবস্থায়।চোখের পাতায় এখনো ভার।
সে গুঙিয়ে উঠে।
চারপাশটা অচেনা।ঘরের দেয়াল, ঘোলাটে বাতাস, গন্ধ—সবকিছুই নতুন, ভয়ংকর।
তার গলা শুকিয়ে আসে।ভয় এমনভাবে জমে উঠেছে শরীরে, যেন বুকের ভেতরটা পাথর হয়ে গেছে।
কে তাকে এখানে এনে ফেলল?কেনো আনল?তার মেহরুব ভাই কোথায়?
ঠিক তখনই দরজাটা খোলে।
একজন পুরুষ…ধীর পায়ে এগিয়ে আসে ঘরের ভেতরে।
নূরি আঁতকে উঠে!
ভয়ে সিঁটিয়ে যায়।সে চিৎকার করে ওঠে—
— কে! কে আছেন? কে আপনি?!
পুরুষটি এগিয়ে আসে ধীরে…
তার কণ্ঠে এক রহস্যময় ফিসফিস…সে নূরির একদম পেছনে দাঁড়িয়ে হেলে পড়ে, একটু দূরত্ব রেখে বলে—
— তোমার আয়ান, নূরি ফুল…
তোমার হতভাগা প্রেমিক… আয়ান আহনাফ।
নূরির গলার পানি শুকিয়ে যায়।
এই নাম… এই আতঙ্ক…এই আয়ান এখনো পিছু ছাড়েনি তার!
সে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চায়।
চিৎকার করে বলে—
— আপনি! আপনি আমায় এখানে কেনো এনেছেন?!
আয়ান একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।তার চোখে স্পষ্ট পুঞ্জীভূত পাগলামি।
সে বলে—
— শুনেছি তুমি এখন চুটিয়ে সংসার করছো… তোমার মেহরুব এর সাথে!
নূরির চোখ কাঁপে।গলাটা রুক্ষ হয়ে আসে—
— আপনি… আমায় কেনো এনেছেন এখানে?
আয়ান ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়—
— তোমায় বিয়ে করতে… নিজের করে নিতে।
নূরি কাঁপা কণ্ঠে বলে—
— দয়া করে… আমি এখন একজন পুরুষের আপন নারী।
আমায় যেতে দিন”! আমায় ভুলে যান…
আয়ান হেসে ওঠে।
একটা বিকৃত হাসি…তার ঠোঁটের কোণে পাগলামি ফুটে ওঠে—
— তুমি এক পুরুষের কী!শত পুরুষেরও হয়ে থাকো…
তবু আমার তোমাকেই চাই, নূরি ফুল।
নূরি চিৎকার করে ওঠে—
— খবরদার! এমন কথা মুখেও আনবি না, আয়ান!
তুই নমরুদ!আমি শুধু আমার স্বামীর।আমি শুধু আমার পুরুষের!
আয়ান তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়।
তার চোখে আগুনের শিখা—
— যা বলার বলো এখন…আর কিছুক্ষণ পরেই…বিয়ে করে তোমায় হালাল করে নেব।তোমার প্রতি ভালোবাসায় যে দহনে পুড়েছি এত বছর…সেই দহনেই এবার তোমায় পুড়িয়ে ছাই করে দেব।
নূরি কাঁপে, পুরো শরীরটা আতঙ্কে জমে যায়।
সে জানে, এটা সত্যি হলে তার বাঁচার আর কোনো পথ নেই।
শুধু আত্মহত্যা… সেই একমাত্র উপায়।
সে তো শুধুই এক পুরুষের…শুধু তার মেহরুব ভাইয়ের।
এই কলঙ্কের আগুনে সে নিজেকে পোড়াতে পারবে না!
তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায়।
সে করজোড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে—
— আমায় ছেড়ে দিন!আমি এক পুরুষের নামেই মরতে চাই…আমায় এত বড় কলঙ্কের রঙে রাঙাবেন না…
আয়ান এগিয়ে এসে নিচু গলায় বলে—
— কেঁদো না নূরি ফুল…তোমার চোখের পানি মুছে দেওয়ার অধিকার এখনো আমি পাইনি যে…
তারপর একটু থেমে বলে—
আত্মার আগলে পর্ব ৪৫
— তুমি আমার নামেই বাঁচবে।আয়ান আহনাফের কলঙ্কেই রাঙবে নূরি ফুল…
নূরি এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।
সে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে—
একটা আর্তনাদ…একটা আত্মা ছিঁড়ে ফেলার মতো কান্না…
নিজের ইজ্জত বাঁচানোর কান্না।নিজের অস্তিত্বকে আগুনের হাত থেকে রক্ষার আকুতি…
সে জানে না, এই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের শেষ কোথায়…
সে জানে না, আয়ানের এই পাগলামির থামা আছে কি না…
তবে সে জানে—
সে এক পুরুষেরশুধু তার মেহরুব ভাইয়ের।
