আত্মার আগলে পর্ব ৪৮

আত্মার আগলে পর্ব ৪৮
সানজিদা আক্তার মুন্নী

—বিকেল যেন অসহ্য ক্লান্তির ভারে নুয়ে পড়েছিল।
মেহরাজ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়ছিল ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে। সারাদিনের টানা অপারেশন শেষে শরীরটা ভেঙে পড়ছিল প্রায়। ফ্রেশ হওয়ারও সময় পায়নি, শুধু এক মুহূর্ত শান্তির আশায় বেরিয়ে এসেছে।
কিন্তু পিছু ছাড়েনি এশা।
ফোনের স্ক্রিনে একই নাম বারবার জ্বলজ্বল করছে।
এশা কলিং…
পাঁচ মিনিট পরপর ফোন দিচ্ছে।
বারবার।

মেহরাজ বিরক্ত চোখে আকাশের দিকে তাকায়।
তারপর ক্লান্ত পায়ে গেটের দিকে এগিয়ে যায়।
ঠিক তখনই চোখে পড়ে—হট্টগোল।
হাসপাতালের সামনে একটা অস্থির দৃশ্য।
কিছু কর্মী আর কয়েকজন মহিলা অস্থিরভাবে একজন মেয়েকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসছে ভেতরে। মেয়েটির পরনের পোশাক ভেজা—না, ভেজা নয়, রক্তাক্ত।
এক মুহূর্তের জন্য মেহরাজ পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইছিল।
অজস্র রুগী আসে যায়, সব দেখা সম্ভব নয়।
তবে ঠিক তখনই—চোখ আটকে গেল।
মেয়েটির কনিষ্ঠ আঙুলে বাঁধা ঘড়িটা যেন চিৎকার করে উঠল!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চোখ একবার পিটপিট করে চেয়ে দেখে মেহরাজ। তারপর এক লাফে কয়েক কদম এগিয়ে যায়।
এই ঘড়ি… এইটা তো মেহরুবের!কণ্ঠ যেন গলা শুকিয়ে আসে।
সকালের সেই দৃশ্যটা স্পষ্ট ভেসে ওঠে মনের পর্দায়—
গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মেহরুব তার নূরির হাতে ঘড়ি পরিয়ে দিচ্ছিল।
নরম গলায় বলছিল,
—“সময় দেখে ঠিকমতো পরীক্ষা দিবি। সাহস হারাবি না, ঠিক আছে?”
মেহরাজের শরীর কেঁপে ওঠে।বুকের ভেতর ধুকধুক শব্দ তীব্র হয়।
ওর পা দুটো আপনাতেই পিছিয়ে যায়।
কিন্তু হৃদয়টা সামনে ছুটে যেতে চায়।
রক্ত টপটপ করে পরছে।
আঙুল বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মেয়েটির পড়নের বোরখা, নিকাব, হাতমোজা—সব ভিজে গেছে লালচে দাগে।
আর সেই রক্তাক্ত দেহটা…

নূরি!
তার ছোট বোন…
মেহরাজ চোখের সামনে দেখে, কিন্তু স্পর্শ করে না।
ধরার অধিকার নেই ওর।
এখন সে শুধুই একজন ভাই। একজন পুরুষ।
অন্য কোনো পরিচয় এখানে মানায় না।
ওর বুকটা যেন চুরমার হয়ে যায়।
ধরতে পারে না, কিছু বলতে পারে না, কিছু করতেও পারে না।
শুধু ঝড়ের মতো কাঁপতে থাকে ওর কণ্ঠ।
নার্সের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে ওঠে—
—“তাড়াতাড়ি… একজন মহিলা ডাক্তার ডাকুন… প্লিজ।
আর শোনেন…ও আমার বোন।কোনো পুরুষ ওকে ছোঁবেন না।ওর পবিত্রতা নষ্ট হবে… প্লিজ…”
নার্সের চোখও খানিক ভিজে ওঠে।দ্রুত ছুটে যায় সে।
একজন মহিলা ডাক্তার এসে দ্রুত অবস্থা বুঝে ফেলে।
সঙ্গে সঙ্গে নূরিকে আইসিইউ-তে নেওয়ার ব্যবস্থা হয়।
মেহরাজ তখনো দাঁড়িয়ে, পাথরের মতো স্থির।
স্রেফ তাকিয়ে থাকে আইসিইউ-র দিকটায়।তারপর যেন হুঁশ ফিরে আসে।
পকেট থেকে ফোন বের করে কল দেয় বাড়িতে।

—“আব্বা…”
কণ্ঠ থেমে যায়।
—“আব্বা… নূরি… এক্সিডেন্ট… আমি হাসপাতালে আছি… দোয়া করেন… আপনারা চলে আসেন …”
কথাগুলো শেষ হতেই ওর গলা কেঁপে ওঠে।
হাসপাতালের শীতল আলোয় মেহরাজের মুখটা আরও বেশি ক্লান্ত, আরও বেশি বিধ্বস্ত দেখায়।
ভেতরে ভেতরে সে ছটফট করে।
এই একটা মেয়েই তো ছিল… যাকে দেখে প্রতিদিন সাহস পেত সে।
এই নূরি… আজ রক্তে ভেজা।ওকে ছুঁতেও পারল না ও।
মেহরাজ চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে বলে—
—“আমার ভাইয়ের কি হবে?

রাত ঠিক নয়টা।
হাসপাতালের করিডোর এখন অনেকটাই ফাঁকা।
চিকিৎসার কোলাহল, দৌঁড়ঝাঁপ — সব কেমন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এসেছে।শুধু এক কোণায় নিঃশব্দে বসে আছে মেহনূর।
হাত দুটো কোলে রেখে বসে আছে সে, চোখ যেন ফাঁকা বাতাসে আটকে আছে।চোখে পানি নেই, কান্নাও নেই।
নেই কোনো আহাজারি।একটা সময় ছিল যখন সে এমন অবস্থায় ছুটে এসে গলা ছেঁড়ে কেঁদে উঠত।
কিন্তু এখন?
এগুলো যেন তার নিত্যদিনের দৃশ্য।
প্রতিদিন একটা করে মৃত্যু। প্রতিদিন একটা করে কান্না।
প্রতিদিন কেউ না কেউ হারিয়ে যাচ্ছে।আর সে, একা একা সেসব দেখে দেখে একপ্রকার মানসিক মৃত্যুতে ঢুকে পড়েছে।
তার ভেতরে কেবল একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—
“কেন হচ্ছে এসব? কারা করে এসব? এত নিষ্ঠুরতা কেনো?”

মেহরুব…
তাকে তো কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না।
সে যেন আর মানুষ নেই—একটা পাগল হয়ে গেছে।
নূরির অপারেশনের সময় সে চোখের জলে ভিজিয়ে ফেলেছিল পুরো করিডোর।
সবাই তাকে বাধা দিয়েছিল, ডাক্তাররাও তাকে থামাতে চেয়েছিল।কিন্তু সে থামেনি।।
একটাই কথা বলেছিল—
“আমার নূরি ফুল, আমার চোখের তারা। আমি ওর পাশে থাকবো, ওকে দেখবো!”
ডাক্তারের ঘর ভর্তি ছিল মহিলাদের দিয়ে।
কিন্তু তাতে কিছু আসে যায়নি তার।নিজেও একজন ডাক্তার হয়েও সে ভুলে গিয়েছিল পেশাদারিত্ব—
কারণ সেই মুহূর্তে সে কেবল একজন স্বামী, একজন পাগল প্রেমিক।

নূরির অবস্থা ভালো না।
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার জীবন এখন ভীষণ ঝুঁকিতে।
ডাক্তাররাও নিরুত্তর, চোখে কেবল ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তার ছায়া।
মেহনূর মেহরাজ অনেক চেষ্টায় মেহরুবকে ধরে রেখেছে।
মেহনূর!
তাকে বোঝাতে বোঝাতে নিজের বুকের ব্যথা আবারও অনুভব করেছে।
কারণ সেও তো একদিন নিজের জীবন নিয়ে এই হাসপাতালের এক কোণায় বসে কেঁদেছিল।তাদের চোখে চোখ পড়তেই দুইটা বিষাদভরা আত্মা একে অপরকে চিনে নেয়—
ব্যথা চেনার জন্য রক্তের সম্পর্ক লাগে না। একটুকু অনুভবই যথেষ্ট।

নূরির বাবা শুরুতে ভীষণ শক্ত ছিলেন।সবার সামনে নিজেকে ধরে রেখেছিলেন।
কিন্তু যখন মাগরিবের নামাজে দাঁড়ালেন, মোনাজাতে মেয়ের নাম উচ্চারণ করলেন,তখন আর পারেননি।
“হে আল্লাহ, আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে দাও…
একবার শুধু চোখ মেলে তাকাক সে…”
এই দোয়ার মাঝেই হঠাৎ মসজিদের ভেতরেই পড়ে যান তিনি।
প্রেশার বেড়ে অজ্ঞান হয়ে যান—
আর মসজিদের নিরবতা যেন থমকে যায় কান্নার শব্দে।

নূরির মা তো ভেঙেই পড়েছেন।সন্তানের যন্ত্রণা কোনো মা সহ্য করতে পারে না।
তার কান্না যেন বাতাস কাঁপিয়ে দেয়।
আর দাদাজান-দাদিজান চোখে হাত দিয়ে চুপ করে বসে আছেন—
চোখে শুধুই স্মৃতি, শুধুই প্রিয় মুখখানা ভেসে ওঠা…

আর মেহরুব?সে কেবল এক কথাই বলে যাচ্ছে, বারবার,
পাথরের মতো মুখে, ফাটা কণ্ঠে—
— “আমার নূরি ফুলের যদি কিছু হয়ে যায়… আমি ধ্বংস হয়ে যাব…আমি আর থাকবো না এই পৃথিবীতে…”
সে মেহনূরের পাশে বসে আছে,চোখে আগুন আর পানি একসাথে ঝরছে।
চোখের সামনে ভেসে উঠছে তার নূরি ফুলের সেই মুচকি হাসি,
যেটা একসময় তার সমস্ত অন্ধকার মুছে দিয়েছিল।
আর এখন?
সেই মুখটাই রক্তে ভেজা, নিস্তেজ, নিঃস্পন্দ।

মেহনূর মাথা তুলে তাকায় ভাইয়ের দিকে।একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়।
ভেতরে ভেতরে ভাবে——
“পুরুষদেরুরুষদের ভালোবাসা এত ভয়ংকর হয় বুঝি?
যারা রাস্তায় রক্তপাত দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়,
তারা প্রিয়তমার এক ফোঁটা কষ্টে সব ভেঙে পড়ে!”
সে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে,,,,,,!
মেহরুবের গাল বেয়ে নেমে আসা অশ্রু মুছে দেয়।
নরম, অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলে—
— “চিন্তা করো না ভাইজান…
তোমার নূরি ফুল তোমারই থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ আছেন তো!তুমি কি জানো না, তিনি আমাদের কখনো ভুলে যান না?”
— তুমি কি ভুলে গেছো সেই আয়াত? যেখানে রব বলেছেন –إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا যার অর্থ হলো নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি।”

মেহরুব কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই করিডোরে হেঁটে আসে এহসান।
হাঁটার ভঙ্গিতে ছিল অস্থিরতা, চোখে জ্বলন্ত আগুন।
সে এসেই উচ্চস্বরে গর্জে ওঠে—
— “যে নূরিকে এমন করেছে, তাকে খুঁজে পেয়েছি আমি!
এবার বলো, বিচার কে করবে— ওর বাপ?
নাকি ওর স্বামী?”
মেহরুব যেন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
তার চোখ দুটো রক্তবর্ণ হয়ে গেছে রাগে।
সে গর্জে ওঠে—

— “ওর স্বামী আমি!ওই হারামির বিচার আমি করব!নিজের হাতে করব, আমি তার জীবন শেষ করে দিবো!”
—তার কণ্ঠস্বর বজ্রপাতের মতো গর্জে ওঠে। চারপাশ মুহূর্তে নিস্তব্ধ।
এহসান ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসে। পাশে বসে থাকা মেহনূর মাথা নিচু করে নীরব, নিথর। যেন দুঃখের ভারে চুপসে যাওয়া এক ফুল, যার ওপর ঝড় বয়ে গেছে, অথচ সে কাঁদছে না।
এহসান মেহরুবের সামনে এসে থামে। ধীরে তার কাঁধে হাত রাখে। মেহরুব ঘাড় ঘুরিয়ে হাতটার দিকে তাকায়—চোখে আগুন, নিঃশ্বাসে আগুন।
— মারতে হলে ভয়ংকরভাবে মারতে হবে,— এহসানের গলায় দৃঢ়তা।
— নয়তো তার দায়িত্ব আমার লোকজন নেবে। আমরা শিকার করি নিঃশব্দে, কিন্তু ছায়া লেপ্টে থাকে শরীরজুড়ে।
মেহরুবের কপালের রগ ফুলে ওঠে, দাঁত কিড়মিড় করে সে বলে,
— ভয়ংকরের চেয়েও ভয়াবহ রূপ নিতে রাজি আমি, । আমার হাতেই চাই বিচার!
এহসানের ঠোঁটে এক রহস্যময় মুচকি হাসি খেলে যায়।

— তাহলে তৈরি হ,। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই আমরা রওনা হবো… রক্ত মুছে ফেলবো সম্মানের।
এরপর তার চোখ স্থির হয় এক কোণে—চুপচাপ বসে থাকা মেহনূর। তার পাশ থেকে কিছুটা দূরে বসে আছে এশা।
এহসান ধীরে হাঁটতে থাকে বোনের দিকে। এশার পাশে মেহরাজ বসে আছে, কোনো এক ফাইল নিয়ে ব্যস্ত। হয়তো জগতের কোনো হিসাব, কিন্তু এই মুহূর্তে এহসানের কাছে সবকিছুই মিথ্যে।
এশার সামনে যেতেই সে উঠে দাঁড়ায়, মাথা নিচু করে সালাম দেয়।
— আসসালামু আলাইকুম, ভাইজান।
তীক্ষ্ণ চাহনিতে কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে এহসান। তার ছোট্ট এশা… আজ কত বড় হয়ে গেছে। সংসার হয়েছে, জীবন হয়েছে, কিন্তু ভাইয়ের চোখে সে আজও সেই ছোট্ট মেয়ে, যার মাথায় বেণি ছিল, চোখে স্বপ্ন ছিল।
এহসান হাত বাড়িয়ে দেয়, আর এশা ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাইয়ের বুকে। কতদিন পর দেখা! কতদিন পর এই আপন ছোঁয়া!
কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায় এহসান, বলে,

— ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছিস?
এশার ঠোঁটে কষ্ট লুকানো এক হাসি,
— এই তো, একরকম আছি। আলহামদুলিল্লাহ। ভালো থাকার চেষ্টায় আছি।
ভাইজান… নূরি তো এখন ফুল নয়, শুকনো একটা পাতার মতো পড়ে আছে।
এহসানের বুক চেপে আসে। সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
— বুঝতে পারছি… আমার বেগম আজ নীরব। আল্লাহ হয়তো বুঝ দিয়ে দিয়েছেন তাকে। নাহলে কান্নার ঢেউতে হয়তো আজ আমার নিঃশ্বাস থাকত না ।
এশা চোখ নামিয়ে ফেলে, বলে,

— না ভাইজান, বুঝ দেয়নি কেউ। ও পাথর হয়ে গেছে… তাই এমন নিরব।
তুমি যাও, ওর কাছে যাও। আজ ও শুধু তোমার ছায়া চায়।
এহসান এক মুহূর্ত নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে তার বোনের মুখে। তারপর আলতো করে মাথায় হাত রাখে, বুকের মধ্যে টেনে নেয়—ভাইয়ের স্নেহ, ভাইয়ের ভয়, ভাইয়ের আশ্রয় হয়ে।
এহসান এশা কে ছেড়ে মেহনূরের দিকে এগিয়ে আসে ধীর পায়ে!
মেহরুব ধীরে উঠে দাঁড়ায়,
এহসানকে আসতে দেখে নিজে থেকেই জায়গা ছেড়ে দেয়।
সে জানে—

এহসান বসবে ওর প্রিয় মেহনূরের পাশে।
এহসান ধীর পায়ে এগিয়ে আসে।
তার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ,কাঁধে যেন হাজার যুদ্ধে ফিরে আসা কোনো বীরের ভার।
একবার মেহরুবের দিকে শান্ত চোখে তাকায় সে,তারপর নিঃশব্দে বসে পড়ে মেহনূরের পাশে।
মেহনূর এক ঝলক তাকায় এহসানের দিকে।
হৃদয়ের গভীর থেকে কেমন একটা অচেনা বেদনা বয়ে যায়।
ক্লান্ত চুল, অগোছালো চোখ, নিঃসাড় নীরবতা এহসানকে যেন ভীষণ ক্লান্ত দেখায় আজ।
চোখ নামিয়ে নেয় সে,
তবুও…

হাত বাড়িয়ে দেয়, ছুঁয়ে দেয় এহসানের চুলগুলো।
এহসান চোখ বুজে নেয়।এ এক ক্ষণিকের শান্তি,যেখানে না আছে রক্ত, না আছে হিংস্রতা,শুধু আছে তাদের দুজনের নিঃশব্দ ভালোবাসা।
মেহনূর ফিসফিস করে বলে,
— “এমন অবস্থা কেনো…?”
এহসান চোখ মেলে চেয়ে থাকে মেহনূরের চোখে,
একটা বাঁকা হাসি ঠোঁটে এনে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
— “তুমি কাঁদছো না যে আজ…”
মেহনূর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে।
চোখ দুটো যেন আকাশের মতো বিস্তৃত হয়ে যায় যন্ত্রণায়।
— “কি আর করবো…এগুলো এখন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে গেছে।প্রতিদিন নতুন রক্ত, নতুন কান্না…আর আমি…প্রতিদিন নতুন করে মরি, জানেন?”

এই কথা শুনে এহসান হালকা মুচকি হেসে আবার নিঃশ্বাস ছাড়ে।
— “এ দুনিয়া যুদ্ধক্ষেত্র, প্রিয়তমা।এখানে টিকে থাকতে হলে যুদ্ধ করতেই হয়…”
মেহনূর কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকে।
চোখে ভাসে আয়ান, রক্ত, মেহরুবের গর্জন—সব।
তারপর আবার এহসানের দিকে তাকিয়ে ধীরে জিজ্ঞেস করে,
— “আপনি কিছু খেয়েছেন?”
এহসান সামনের দিকে তাকিয়ে, গলার স্বর নরম করে উত্তর দেয়,
— “হুম…”
শব্দটা ছোট, কিন্তু গলায় একটা ক্লান্তি মিশে থাকে।
এই ছোট্ট মুহূর্তটা ছিল তাদের দুজনের,যেখানে মৃত্যু, প্রতিহিংসা, রক্তের মধ্যেও এক চিলতে ভালোবাসা টিকে ছিল… নিঃশব্দে।

এহসান-এর লোকজন অনেক খোঁজখবরের পর অবশেষে আয়ানকে ধরে এনেছে।
তার জন্য সাজানো হয়েছিলো এক জাহান্নাম—
শহরের উপকণ্ঠে পড়ে থাকা পুরনো একটা গোডাউন।
দেয়ালে স্যাঁতসেঁতে শেওলা, মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা মরিচা ধরা যন্ত্রপাতি, আর অদ্ভুত একটা শীতল গন্ধ।
মাঝখানে কাঠের একটা চেয়ার।
সেই চেয়ারে গুঁজে বসানো আয়ান।
না, শুধু বসানো নয়—
আটকে রাখা হয়েছে নিষ্ঠুরভাবে।
তার দুই হাত উপরে টানা, প্রতিটি আঙুলে মোটা সুতলি প্যাঁচানো, সেগুলো আবার রশির মাধ্যমে বাঁধা হয়েছে গোডাউনের চার কোণে।
এক এক করে টানতে টানতে আঙুলের হাড় আলাদা হয়ে যাচ্ছে…
রক্ত কুঁচকে যাচ্ছে আঙুলের গাঁটে,
চামড়া ছিঁড়ে মাংস ফেটে বেরিয়ে আসছে।
তবুও মুখে একটাই কথা:
— “নূরি ফুল… শুধু আমার…”
চোখে ভয় নেই,
আছে উন্মাদ ভালোবাসার দাবানল।

এমন সময়…
গোডাউনের ভারী লোহার দরজাটা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে এহসান।
তার ডানপাশে হেঁটে আসছে মেহরুব—
চোখ দুটো জ্বলছে রক্তের মতো লাল হয়ে।
দুজনে একসাথে সামনে এসে দাঁড়ায় আয়ানের।
আয়ান চেয়ে থাকে মেহরুবের দিকে।
চোখে একপেশে প্রেম, ঠোঁটে ক্ষত-বিক্ষত হাসি।
আর মেহরুব?
এক ঝটকায় গর্জে উঠে:
— “স*রের বাচ্চা!
তোর জন্য আমার নূরি ফুল আজ কান্নায় ভেঙে পড়েছে!”
এ বলেই বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে আয়ানের দিকে!
কিন্তু ঠিক তখন…

এহসান এক হাতে ঠেলে থামিয়ে দেয় ওকে।
— “থাম ভাতিজা! এত তাড়াহুড়ো করিস না।
ভয়ংকর মৃত্যুটা আমি দেখতে চাই।
ধীরে, পরিপাটি করে হোক শাস্তি।”
তারপর চোখের ইশারায় হাসিবকে ডাক দেয়।
হাসিব ছায়ার মতো এগিয়ে এসে হাতে একটা
তীক্ষ্ণ ছুরি তুলে দেয় এহসানের হাতে।
এহসান ছুরিটা একবার ঘুরিয়ে দেখে,
ধার পরীক্ষা করে, তারপর সেটা মেহরুবের হাতে তুলে দিয়ে বলে:
— “যা, তোর যেমনে ইচ্ছে কুপা!
আমি আছি, তুই শুধু খেল দেখাস।”

মেহরুব ছুরি হাতে নেয়।তার চোখে এখন আর মানুষ নেই—
একটা হিংস্র পশু দাঁড়িয়ে আছে সামনে।
এক রক্তপিপাসু হাসি দিয়ে সে এগিয়ে যায়।
তারপর—
একটা,
দুইটা,
তিনটা…
সাত আটটা ছুরির কোপ সোজা আয়ানের বুকের মাঝ বরাবর!
প্রতিটি কোপে তীব্র রক্তধারা উঠে এসে ছিটকে পড়ে মেহরুবের মুখে, জামায়।
সে তবুও থামে না।
— “তুই আমার স্ত্রীর দিকে হাত বাড়িয়েছিস!
তোর রক্ষা নেই!
আমি যতটা শান্ত, ততটাই ভয়ংকর!”
আয়ান তবুও মরে না।
বুক থেকে ঝরছে টলটলে গরম রক্ত,
তবুও মুখে হাসি।
গলগল রক্তে ভেজা ঠোঁট ফাঁক করে বলে:
— “নূরি ফুল কে ভালোবাসি আমি…
ভীষণ ভালোবাসি…”
এই কথা শুনে

মেহরুব পাগলের মতো তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।
চেয়ারসহ নিচে পড়ে যায় আয়ান,
আর তার সুতলি-প্যাঁচানো আঙুলগুলো
ধরফরিয়ে ছিঁড়ে যায়।
প্রতিটি আঙুল মেঝেতে পড়ে থাকে আলাদা আলাদা করে।
মেঝেতে একটার পর একটা রক্তাক্ত আঙুল।
এহসান দাঁড়িয়ে হালকা করে তাল চাপ দেয়, যেন নাটক চলছে।তার ঠোঁটে একপাশে বাঁকা হাসি।
— “এই শাস্তি ওর প্রাপ্য ছিলো।কারণ ও… অন্যের নারীর দিকে হাত বাড়িয়েছিলো।”

কিন্তু এখানেই শেষ নয়।
মেহরুব থামে না।
সে আয়ানের ওপর উঠে বসে যায়,দেখে নেয় কোথায় কোপ দিলে আয়ান বাঁচবে না আর…তবুও মারা যাবে ধীরে ধীরে, চিৎকার করতে করতে।
— “আমার প্রিয় ফুলের এই অবস্থা তোর জন্য!
তোর চোখ, তোর জিহ্বা, তোর শ্বাস—সব শেষ করে দেবো আমি!”
আর ছুরির কোপ একের পর এক পড়তে থাকে।
রক্ত গড়িয়ে গিয়ে গাধার মলিন মেঝেতেও এক প্রলেপ তৈরি করে।
এহসান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শ্বাস নেয়।রক্তের গন্ধ তীব্র হয়ে উঠেছে।
সে চোখ বন্ধ করে বলে:
— “রক্তের ঘ্রাণ… উফ্…শুধু নিজে না,অন্যকে রক্তে উল্লাস করতে দেখেও ভালো লাগে আজকাল।”

আয়ান মেঝেতে পড়ে আছে।
তার শরীর থেকে ছুটে যাওয়া আঙুলগুলো একটা একটা করে গড়িয়ে পড়ছে সিমেন্টের মেঝেতে।
চারপাশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
আয়ান কেঁপে উঠছে, চোখের পাতা খোলারও শক্তি নেই, কিন্তু ঠোঁটের কোণে একটা পাগলাটে হাসি লেগেই আছে—
— “নূরি ফুল শুধু আমার…”
মেহরুব ঝাঁপিয়ে পড়ে আবার, এবার বুক না—চোখের দিকে তাকিয়ে ছুরি চালায়।
— “তোর চোখ দিয়ে নূরি ফুলের দিকে তাকিয়েছিস না?!
আজ চোখ তুলে ফেলবো তোর!”
ছুরির কোপে আয়ানের চোখের পাতা ছিঁড়ে যায়, আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে গোডাউনের ইট-বালিতে।
একটা ইঁদুর ভয় পেয়ে দৌড়ে পালায়।
আর এহসান?

সে এক কোণে ঠান্ডা চোখে দাঁড়িয়ে রক্তমাখা দৃশ্যটা দেখছে।
তার চোখে কোনো ঘৃণা নেই।
আছে কেবল এক বিকৃত তৃপ্তি।
হাতের আঙুলে একটা সিগারেট, ঠোঁটের কোণে হালকা বাঁকা হাসি।
সে হঠাৎ হেঁটে যায় আয়ানের দিকে।
নিচু হয়ে মুখটা আয়ানের মুখের কাছে এনে বলে:
— “এই আয়ান…
মৃত্যু তো সবার হয়।
কিন্তু এমন করে মরার সৌভাগ্য কয়জনের হয় রে?”
তারপর সে আয়ানের গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
এহসান মেহরুব এর অবস্থা বুঝে সে হাসিবকে ডাকে:
— “হাসিব!গ্যাস আন, একটা আগুনের খেলা দেখি!”
হাসিব চলে যায় দ্রুত।মুহূর্ত পরে ফেরে গ্যাস সিলিন্ডার আর একটা ছোট্ট ফ্লেমথ্রোয়ার নিয়ে।
মেহরুব হাসে।ছুরি ফেলে দেয়।

আত্মার আগলে পর্ব ৪৬+৪৭

সে এখন শুধু রক্তে রঙিন নিজের জামা দেখে।
— “তুই মরার আগেও আমার ফুলের নাম নিচ্ছিস আয়ান?তাহলে… তোর জিহ্বাটাও আর না থাক!”
এবার সে হাঁটু গেঁড়ে বসে।
ছুরি দিয়ে আয়ানের মুখের ভিতর ঢুকে যায়…
একটা চিৎকার, একটা আর্তনাদ, আর তারপর স্তব্ধতা।
একটা জিহ্বা মেঝেতে পড়ে থাকে।
এহসান হালকা গলায় বলে:
— “গরম করো গোডাউনটা, অনেক ঠান্ডা লাগছে আজ।
একটু পোড়া মাংসের গন্ধ দরকার…”

আত্মার আগলে পর্ব ৪৯+৫০