আত্মার আগলে পর্ব ৫১+৫২
সানজিদা আক্তার মুন্নী
তালুকদার বাড়ির উঠোন যেন আর উঠোন নয়—এ এক রক্তস্নাত যুদ্ধক্ষেত্র।রোদ পড়েছে মাথার ওপর, কিন্তু চারদিক কেমন গা ছমছমে।
আকাশ পর্যন্ত যেন থমকে গেছে।সেই আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে তালুকদার পরিবারের নারীরা আজ এক ভয়াল নাটকের দর্শক।
বড় তালুকদার বাড়ি, আবারও আজ তার রঙ লাল,পুরুষদের রক্তে লাল।
মেহনূর দাঁড়িয়ে আছে বেলকনিতে,পর্দার ফাঁক গলে দেখছে সবকিছু।চোখ স্থির, ঠোঁট নিঃশব্দ,পা যেন মাটি হয়ে গেছে ওর।
এই বাড়ির প্রতিটি ইট, প্রতিটি দেয়াল আজ সাক্ষী এক ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের।
তিনজন পুরুষ,জসিম জমিদার এবং তার দুই ভাই সহ ওদের,উঠোনে বাঁধা খুঁটির সঙ্গে—মুখে গামছা গোঁজা,
শরীর কাঁপছে, চোখে আতঙ্ক।
তারা এসেছিল তিনদিন আগে—ভেবেছিল শেষবার দেশে এসে।সব বিক্রি করে পালাবে।ভাবেনি যে,এহসান অপেক্ষা করে আছে,রক্ত চক্ষু নিয়ে,এক ভয়ংকর শাস্তি হাতে।
তাদের ভাই, এরিক,যার মৃত্যুতে ভেঙে গিয়েছিল এহসানের সব কিছু,সে ছিল শুধুই ছুতো,আসল আগুন জমে ছিল অনেক আগে তার বোনের ধর্ষণ, তার মা-বোনদের আত্মঘাতী আর্তনাদ—সেই যন্ত্রণা আজ উগরে দিচ্ছে এহসান।
প্লাস দিয়ে একে একে তুলে নিচ্ছে ওদের হাতের নোখ,
কোনো তাড়াহুড়া নেই,একেকটা চিৎকার যেন একেকটা শ্লোক প্রতিশোধের।
জসিম আর তার ভাইরা গর্জন করছে যন্ত্রণায়—কিন্তু এই চিৎকারেই তৃপ্তি এহসানের ঠোঁটে।সে হেসে বলে—
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—“আরও কর!সেদিন আমার বোনেরা করেছিল এমন চিৎকার,আমার ভাই করেছিল,আর তোরাই ছিলি তার কারণ।”
এনাম গর্জে উঠে—
“তোর মেয়ের সামনেই তোকে মারব!
যেমন তুই করেছিলি আমার ভাইয়ের সামনে আব্বার সাথে!”
তাদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে এলি,
জসিমের মেয়ে, এরিকের বোন—বাঁধা, কাঁপছে পুরো শরীর,চোখ জলে ভিজে উঠছে,মুখে আতঙ্ক জমে বরফ।
এহসানের বাবা, মনিরুল সাহেব,চোখে প্রশান্তির রেখা—আজ তার ছোট ছেলেকে দেখে বুক ভরে উঠেছে।তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছেন—এই নরকনাট্য যেন তাঁর রক্তের প্রতিশোধ।
চামড়া তুলে ফেলা হচ্ছে—শরীরের অর্ধেকটা নয়,ধীরে ধীরে টেনে তোলা হচ্ছে যেন যন্ত্রণার প্রতিটি বিন্দু উপভোগ করা যায়।
চিৎকার করছে জসিম,কিন্তু চারপাশের বাতাস চুপ।
চোখ উপড়ে ফেলা হয়।দেখার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।
কলিজা ছিঁড়ে আনা হয়।রক্তে ডুবে যায় উঠোন।
তবুও থেমে নেই এহসান—শেষ অপমানটা বাকি—
তাদের পুরুষত্ব কেটে ফেলা হয়।কেন?কারণ তারা ছিল ধর্ষক।
এলি, এতক্ষণে মুখে বমি নিয়েঅচেতন হয়ে পড়ে যায় মাটিতে।দু-একজন মহিলা ওকে তুলে নিয়ে ছুটে চলে যায় হাসপাতালের দিকে।
আর বাড়ির অন্য মহিলারা?তারা চুপ।আড়াল থেকে দেখছে সব।ভয়ে নয়, লজ্জায় নয়—বিচারে তৃপ্তি নিয়ে দেখছে।
মেহনূরের মুখ আজো খিঁচে আছে,কিন্তু চোখে এক বিন্দু পানিও নেই।
এই রক্তাক্ত দুপুরে,
তালুকদার বাড়ির আকাশে আজ একটাই সুরপ্রতিশোধ, রক্ত, ন্যায্যতা।
চারদিকে রক্তের গন্ধ, কান পাতলেই ভেসে আসে অস্পষ্ট আর্তনাদ।আর সেই আর্তনাদের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে—
এহসান ।
তার চোখে তৃপ্তি,মুখে বিষাক্ত প্রশান্তি।হাতের তালুতে ধরে আছে রক্তমাখা তিনটি কলিজা—জসিম ও তার দুই ভাইয়ের।
তাদের বুক ছিঁড়ে, হৃদয় উপড়ে এনে..সে দাঁড় করিয়েছে তিনটি রক্তাক্ত টুকরো ঠিক নিজের বাবার সামনে।
এক হাতে সে চিপে ধরছে শরীরের রক্তমাখা অংশ,
রক্ত টপ টপ করে ঝরছে এক বড় বালতিতে।পাত্র যেন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠছে প্রতিশোধের রক্তে।
এহসান হাঁটু গেঁড়ে বসে, বালতি তুলে ধরে নিজের বাবার সামনে।চোখে কান্না, ঠোঁটে রাগ।
নরম কিন্তু কাঁপা কণ্ঠে বলে—
—“আব্বা… দেখুন… দেখুন কত রক্ত!এটা ওদের রক্ত, ওদের কলিজা—যাদের জন্য আমাদের রক্তে গোসল করতে হয়েছে।আপনজনদের রক্তে ভিজে যেতে হয়েছে বারবার।যাদের জন্য আমাদের মরতে হয়েছে প্রতিটি মুহূর্তে…আফসোসে আর আফসোসে।”
মনিরুল সাহেব এক নিঃশ্বাসে দম ছাড়েন।তার চোখে অশ্রু—কিন্তু সেটা ব্যথার নয়,প্রশান্তির।
তিনি হাত রাখেন এহসানের কাঁধে,গলায় গভীর কণ্ঠের ধ্বনি—
“ধন্যবাদ বাবা…আমার মনের ক্ষোভ পূর্ণ করেছিস।আজ আমি হালকা হয়েছি।”
এহসান চুপচাপ দাঁড়িয়ে, হাত থেকে কলিজার টুকরোগুলো ফেলে দেয় রক্তাক্ত মাটিতে।রক্তমাখা হাত নিজের সাদা পাঞ্জাবিতে মুছে ফেলে,তারপর বাবার হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে,
চোখ নামিয়ে, ঠোঁট ছুঁয়ে বলে—
“এটা আমার কর্তব্য আব্বা…এতে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই।”
মনিরুল সাহেব নিজের কাঁপা হাত বুলিয়ে দেন এহসানের মাথায়।এই হাত ছিল অনেক বছরের চাপা কান্নার প্রশান্তি।
তারপর,এক নিঃশ্বাসে দাঁড়িয়ে উঠে পড়ে এহসান।
পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই ভাই—এনাম ও এমরান,
যারা আজ পর্যন্ত বুক চেপে রেখেছিল যন্ত্রণা,এহসান ছুটে গিয়ে শক্ত করে তাদের জড়িয়ে ধরে।
তিন ভাই—রক্তে মাখা মুখ,রক্তে ভিজে যাওয়া জামাকাপড়,আর ভাঙা ভাঙা কান্নায় এক হয়ে যায়।
এহসান গর্জে ওঠে কান্নার ভিতরেও—
“আমরা পারছি ভাই…আমরা পেরেছি!আমরা আমাদের ভাইদের রক্তের প্রতিশোধ নিতে।পেরেছি!আমরা পারছি!!”
চারদিকে শুধু তাদের কণ্ঠ—
তালুকদার বাড়ির দেয়ালগুলো যেন সেই গর্জন ফিরিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছে—
“আমরা পেরেছি!”
এই ভয়ংকর দিনটায়,প্রতিশোধ পূর্ণ হলো—কিন্তু হৃদয়ের রক্তঝরা আখ্যান শুরু হলো নতুন করে।
এহসান ঘরে আসে। গোসল করে পবিত্র হয়ে—আজ তার সাধনা পূর্ণ হলো, ক্ষোভ মিটে গেছে।
দীর্ঘ একটা চাপা অভিমান, অসহায় রাগ, যন্ত্রণায় ছেঁড়া বুক—সব যেন ধুয়ে-মুছে এক পবিত্র সান্ত্বনায় মিলিয়ে গেছে।
ঘরে এসে দেখে, মেহনূর পেট ধরে ধীরে ধীরে হাঁটছে।
ওর মুখে একরাশ ক্লান্তি, তবুও এক অপার মমতা মিশে আছে চোখের পাতায়।
এহসানের বুকের ভেতরটা নরম হয়ে যায়। অদ্ভুত এক শান্তি ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে।
সে এগিয়ে আসে ধীরে ধীরে মেহনূরের দিকে, যেন কোনো অপরাধী আসছে তার প্রিয় বিচারকের সামনে।
কিন্তু মেহনূর ওকে দেখেই কেমন এড়িয়ে চলে। মুখ ঘুরিয়ে নেয়, গন্তব্যে এগোয়।
এহসান থমকে দাঁড়ায়, তার চোখে খানিকটা আক্ষেপ, খানিকটা বোঝার চেষ্টা।
সে আলতো করে মেহনূরের হাত ধরে, যেন ছায়া ছুঁয়ে দেয়—
তবে হাতের স্পর্শে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, যাতে মেহনূর আর এগোতে না পারে।
মেহনূর বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। চোখে-মুখে বিরক্তি আর রাগের রেখা স্পষ্ট।
তারপর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ তুলে তাকায় এহসানের চোখে।
— “কি হলো?”
শব্দগুলো মুখ থেকে বেরোলেও, চোখের ভাষায় ছিল গাঢ় ক্ষোভ।
এহসান হালকা বাকা চোখে তাকায়, ঠোঁটের কোণে চাপা এক অভিমান আর কৌতুকের রেখা।
— “আমার তো কিছু হয়নি, তোমার কি হলো? এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছো কেনো?”
মেহনূর ভ্রু কুঁচকে, কপালের মাঝখানে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বলে—
— “অদ্ভুত! আমি এড়িয়ে যাব কেনো? আপনায়? আমি নিচে যাচ্ছি।”
তার গলায় ছিল জেদ আর ঠান্ডা প্রতিরোধ।
এহসান ওর হাতটা আরেকটু চেপে ধরতে চায়, যেন এক অসহায় আকুতি জমে আছে আঙুলের ফাঁকে,
কিন্তু মাঝপথেই থেমে যায়।
নিজেই সামনে চলে আসে, চোখে ছিল কিছুটা সঙ্কোচ, কিছুটা স্নেহ।
মেহনূর এটা দেখে ক্ষুব্ধ হেসে ওঠে—একধরনের তিক্ত বিদ্রুপ সেই হাসিতে।
— “দিন, আরও জোরে হাত টান দিন!
এখন তো দিবেন না, কারণ এখন যে আপনার সন্তানের কষ্ট হবে!তাই নয়তো—আমার হাত ধরে এদিকে এক হেঁচকা টান, ওদিকে আরেক হেঁচকা টান দিতেন—স্বার্থপর পুরুষ!”
তার কণ্ঠে বিষ মেশানো অভিমান।এক গর্ভবতী নারীর ভেতরের সমস্ত আবেগ যেন আছড়ে পড়ল সেই কয়েকটা বাক্যে।
এহসান মুচকি হেসে উঠে।সে জানে—তার এই মেয়েটা রেগে গেলে বানের জলের মতো সব ধুয়ে দেয়,যা মুখে আসে তাই বলে,তবুও সে রাগে যতটা ভয়ঙ্কর, ততটাই প্রেমে কোমল।
সে মেহনূরের ঠোঁটে নিজের শাহাদাত আঙুল ছুঁয়ে দেয়,
অন্য হাতটা আলতো করে রাখে মেহনূরের পেটে।
তার কণ্ঠে ছিল চাপা অনুরোধ আর একরাশ আদর—
— “হুসসস… এত রাগ করো না। সন্তানের সামনে বাপ-মায়ের ঝগড়া করা উচিত না।”
মেহনূর তার হাত সরিয়ে নেয় নিজের কাছ থেকে। মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুটা সে লুকোতে চায়,
তবুও গলার স্বর কাঁপে কিছুটা—
— “আমি কারো সাথে ঝগড়া করছি না।দাম আছে আমার কোনো কথার কারো কাছে—যে আমি তার সাথে করব ঝগড়া।”
তার কণ্ঠে ছিল আত্মসম্মান আর এক টুকরো দুঃখ।
এহসান মেহনূরের গাল টেনে বলে—
— “এত নাটক করিস না কবুতরের বাচ্চা…আমি জানি তুই রেগে আছিস আমার উপর।”
মেহনূর দাঁত চেপে বলে—
— “তাহলে এটাও তো জানেন, কেনো রেগে আছি!”
এহসান মেহনূরের গালে হাত রেখে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে ওর চোখে।
তার গলায় ছিল অনুতাপ, অনুরোধ, আর ভাঙা প্রতিজ্ঞার পুনর্গঠনের দৃঢ়তা—
— “এটাই শেষ।আর আমি এভাবে কাউকে মারব না, সত্যি।”
মেহনূর ধীরে ধীরে নিজের গাল সরিয়ে নেয়, যেন মন থেকে এখনো সরিয়ে ফেলতে পারেনি ক্ষোভটা।
সে ফিসফিস করে বলে—
— “মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিবেন না…”
এহসান শান্ত, দৃঢ় গলায় বলে—
— “এহসান তালুকদার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয় না।”
মেহনূর চোখ সরু করে তাকায়, ঠোঁটে একটা দ্বিধাময় হাসি, চোখে সঙ্কটের ঝড়—
— “আর যদি তা হয়?”
এহসান মুচকি হেসে বলে—
— “তুমি নিজ হাতে শাস্তি দিও।”
মেহনূর বিছানায় বসতে বসতে ঠান্ডা স্বরে বলে—
— “তার শাস্তি স্বরূপ আপনি আমায় হারিয়ে ফেলবেন…
চলে যাব আপনায় ছেড়ে।”
সেই এক বাক্যে যেন বজ্রাঘাত হয় এহসানের কলিজায়।
চোখের সামনে ঘন কালো হয়ে আসে, মাথার ভেতর টং করে বাজে একটা শব্দ—চলে যাওয়া?এই নারী?এত সহজ?
সে দমবন্ধ অনুভব করে। কষ্টে গলা শুকিয়ে আসে।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে মেহনূরের দিকে।তার পাশে বসে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে—
—“কিছু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে বলো আমায়…এতদিন ধরে তো ভালো মতো খাচ্ছো না…কিছুই না… শুধু পান্তা ভাত ছাড়া…”!
মেহনূর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে—
— “তো আর কি করব!পান্তা ভাত ছাড়া আর কিছু গিলতে পারলে তো খেতাম… তবে…”
মেহনূর থেমে যায়।
এহসান অস্থির হয়ে উঠে পড়ে—
— “তবে কি? বলো!কি খেতে চাও? বলো আমায়…”
মেহনূর ধীরে বলে—
— “মনে হচ্ছে যদি শুটকি ভর্তা হয়, তবে খেতে পারব…”
এহসান হেসে ফেলে। সেই হাসিতে শান্তি, আনন্দ, আবার দায়িত্বের ছোঁয়া—
— “আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি ব্যাবস্থা করছি।”
সে উঠতে নেয়। মেহনূর তার হাত ধরে তাকে থামিয়ে দেয়।
চোখের চাহনিতে যেন অনুনয়, যেন চায়—”এখনই যেও না।”
ইশারায় বসতে বলে।এহসান আলগোছে বসে পড়ে ওর পাশে।মেহনূর মাথা এলিয়ে দেয় ওর কাঁধে। চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে শ্বাস নেয়। যেন ওর বুকের ভিতর জমে থাকা কষ্টগুলো একটু শান্তি চায়।
এহসান মুচকি হেসে, হাত বুলিয়ে দেয় তার প্রিয়তমার মাথায়।তার ঠোঁট কাঁপে এক নিরব প্রার্থনায়—
এই নারী, এই প্রেমিকা—তিনিই তো তার শ্রেষ্ঠ নিয়ামত।যাকে ধরে রাখতে পারা—রবের এক অনন্ত করুণা।
এহসান হাতে এক খুদে সাদা-কালো ছোপ ছোপ রঙের বিড়াল নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে।
বাইরে তখন রোদের ঝিলিক, হালকা বাতাস—একটা প্রশান্ত দুপুর।
ঘরে ঢুকেই ডানদিকের ছোট ঘরে ঢুকে পড়ে, ওখানেই ওর ভাইপো-ভাতিজিরা খেলছে।
বিড়ালটা ওদের দেখিয়ে দেয়—
— “এই দেখো, তোদের জন্য একটা চমক নিয়ে এলাম!”
বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। ছোট ছোট হাতগুলো বিড়ালের গায়ে বুলিয়ে দেয়।বিড়ালটাও মিউমিউ করে মাখামাখি ভালোবাসা বিলিয়ে দেয়।
কিছু সময় ওদের সাথে কাটায় এহসান। চোখে-মুখে প্রশান্তির রেখা, তবুও কোথাও এক ব্যস্ত ক্লান্তি ভর করেছে চোখের কোণায়।
বিড়ালটাকে নিয়ে আবার উঠে আসে ঘরে।ঘরে ঢুকেই চোখ পড়ে বেলকনির দিকে। ধীরে ধীরে পা টিপে সেখানে এগিয়ে যায়।
শব্দহীন নিস্তব্ধতায় ভেসে থাকা বিকেলের আলোয় সে দেখতে পায়—
তার স্নিগ্ধাময়ী, তার চাঁদমুখী স্ত্রী মেহনূর দাঁড়িয়ে আছেন বেলকনিতে।
চুলে হালকা বাতাসের দোলা, চোখে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা অপার্থিব এক প্রশান্তি।
চাঁদের স্নিগ্ধতায় যেন শরীরটা রূপালি আলোয় রাঙা হয়ে উঠেছে।
সেই রূপে, সেই আলোয়, এহসান এক মুহূর্তের জন্য শ্বাসও নিতে ভুলে যায়।
তিন মাস হলো মেহনূরের গর্ভে এসেছে তাদের ভালোবাসার নিঃশব্দ ফল।শরীরটা একটু গুলোমালো হয়ে উঠেছে, হালকা ফুলে আছে পেট—
তবুও যেন আরও মায়াবী, আরও কোমল, আরও অনিন্দ্য লাগছে মেহনূরকে।ওর গায়ের রংটাও যেন দিনে দিনে চকচকে হয়ে উঠেছে—হয়তো আল্লাহর রহমতেই এমন আলোয় ভরে উঠছে ওর অস্তিত্ব।
তবে এই আলোর আড়ালে লুকিয়ে আছে কষ্ট।রাতগুলো সহজ যায় না মেহনূরের।কখনো কোমরে ব্যথা, কখনো পেটে চাপ, কখনো হঠাৎ নিঃশ্বাসে ক্লান্তির ছায়া।এই অল্প সময়েই শরীর যেন পাল্টে যাচ্ছে।তবু মুখে কিছু বলে না সে।
চোখে-মুখে যন্ত্রণার আঁচ নেই—দাঁত চেপে সব কিছু সহ্য করে যায়।একটাও অভিযোগ নয়, একটাও “উহ” শব্দ নয়।
কিন্তু এহসান তো বোঝে।সে তো মেহনূরের প্রতিটি নীরবতা, প্রতিটি নিঃশ্বাস পড়ার ছন্দ পড়ে ফেলতে জানে।সে জানে—এই নারী কষ্ট পাচ্ছেন।
তবুও কিছু বলেন না, শুধুই সহ্য করেন—তাতে যেন তার ভালোবাসার পরিপূর্ণতা আছে।
নিজেও তো কম ব্যস্ত নয় এহসান।কখনো পার্টি অফিস, কখনো নিজের অফিস, কখনো বড় কোনো ডিল, কখনো জরুরি মিটিং…তবুও শত ব্যস্ততার মাঝে চেষ্টা করে মেহনূরের পাশে থাকার।একটুখানি সময় পেলেই ঘরে ফেরে, ওর কাঁধে হাত রাখে, মেহনূরের মুখের দিকে তাকিয়ে শান্তি খোঁজে।
এই ক’টা মাসে জীবন যেন পাল্টে গেছে।সুখ আর দায়িত্ব—দুই মিলে একটা নতুন পৃথিবী তৈরি হয়েছে।
তবুও মাঝে মাঝে হিমশিম খেতে হয়।জীবন থেমে থাকে না তো।তবুও এহসানের মন বলে—এই নারীর জন্য, এই সন্তানের জন্য… সবই তো সওয়া যায়।
এই নারী…!এই স্নিগ্ধতায় ভেজা চেহারা…”!এই মাতৃত্বের কোমল রেখা…!এ যেন পৃথিবীর সব শান্তি মিলিয়ে এক নিখুঁত শিল্পকর্ম।
মেহনূর হঠাৎ যেন হালকা শিহরণ টের পায় শরীরে।
চেনা এক ঘ্রাণ নাকে এসে লাগে।।
ঐ যে… ওর প্রিয় পুরুষের শরীরের মন মাতানো ঘ্রাণ!
মনের গভীর থেকে এক কণ্ঠ বলে ওঠে—
— “তোমার প্রিয় পুরুষ তোমার আশেপাশেই আছেন…”
এক চিলতে হাসি খেলে যায় ওর ঠোঁটে।ধীরে ধীরে পিছনে তাকায়।
এহসানের চোখে তখন অপার মুগ্ধতা।সে জানে—এই নারীর মতো করে কেউ ভালোবাসতে পারে না, সহ্য করতে পারে না, দিতে পারে না।
আর মেহনূরের চোখে তখন বিস্ময় আর স্বস্তি মিলিয়ে এক কোমল দীপ্তি—
যেন চোখেই বলে উঠলো—
“আপনি এসেছেন… আমি ঠিক বুঝেছি…”
এহসান ধীরে ধীরে ছোট্ট সাদা বিড়াল মেহনূরের সামনে ধরে।
মেহনূরের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়।
বিড়ালটি যেন হুবহু কোনো হারিয়ে যাওয়া সময়ের স্মৃতি হয়ে ফিরে এসেছে।
এহসান কোমল কণ্ঠে বলে—
“নিন, আপনার উপহার।”
মেহনূর হা করে চেয়ে থাকে এহসানের মুখ আর সেই সাদা তুলতুলে প্রাণিটার দিকে।চোখ ধীরে ধীরে জলে ভরে ওঠে…মন ভেসে যায় পনেরো বছরের এক বিকেলে।
স্মৃতির ধুলো ঝেড়ে সামনে আসে তার শৈশবের প্রিয় সঙ্গী, তার মুআযযা—সেই সাদা বিড়াল যে ছিল তার নিঃসঙ্গ সময়ের নীরব বন্ধুর মতো।
কাঁপা কণ্ঠে বলে—
“মুআযযা… আমার মুআযযার মতন… এটা…”
এহসান একটু কাছে এগিয়ে এসে বলেন, এক অদ্ভুত স্নেহে ভরা কণ্ঠে—
“নিবে না কোলে? এটা তোমার সেই প্রিয় বিড়াল নয়,
কিন্তু ঠিক তার মতো, তার ছায়া হয়ে এসেছি আজ তোমার জীবনে।”
মেহনূর কাঁপতে থাকা হাতে সাদা বিড়ালটিকে কোলে তুলে নেয়।তার চোখ ভিজে যায়, ঠোঁট কাঁপে,শরীরের মধ্যে দিয়ে এক নরম স্নেহের ঢেউ বয়ে যায়।সে নীরবে বিড়ালটির শরীরে হাত বুলিয়ে যায়,যেন সে স্পর্শ করছে শৈশবের এক কষ্টে ঢাকা ভালোবাসাকে।
এহসান সেদিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলেন—
“তোমার মুআযযা… ওকে আমিও খুব মিস করি।তোমায় তো দেখাই হয়েছিল ওর কারণেই…”
মেহনূর চোখ বড় করে তাকায় তার দিকে, অবাক হয়ে প্রশ্ন করে—
“কি করে? কীভাবে?”
এহসান একচিলতে মুচকি হাসি দিয়ে এগিয়ে আসে,
তার গালে হালকা করে হাত রাখে।তার চোখে একরাশ স্মৃতি জমে আছে।
“প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর…
তুমি তোমাদের উঠোনে ছোট ছোট পায়চারি করতে করতে,ওকে নিয়ে খেলতে, দৌড়াতে…তোমার মুআযযা আর তুমি যেন ছিলে একই আত্মা।তোমার হাসির শব্দ, ওর দৌড়,সব মিলিয়ে এক স্বপ্নময় ভোর হয়ে উঠত।
আমি… আমি দূর থেকে দেখতাম…নিঃশব্দে, অবাক হয়ে।তোমায় দেখতাম প্রতিদিন।”
মেহনূরের গলা শুকিয়ে আসে।
সে চেয়ারে বসে পড়ে, বিড়ালটিকে নামিয়ে দিয়ে বলে—
“আপনি… আপনি আমায় দেখতেন?কীভাবে? কখন থেকে?”
এহসান হেসে ফেলে, একটু খুনসুটির ভঙ্গিতে বলে—
“এত অস্থির হয়ো না, আজ তো সব জানার পালা।
তোমায় শুধু ভালোবাসিনি,তোমার প্রতিটি দিন, প্রতিটি অভ্যাস আমি মুখস্থ করেছি।তোমার হাঁটা, তোমার হাসি, তোমার মুআযযাকে কোলে নেওয়া…সব দেখেছি।”
মেহনূর রাগে চোখ পাকায়, ঠোঁট কাঁপে—
ঠিক তখনই এহসান হঠাৎ তার মুখ এগিয়ে এনে,
মেহনূরের থুতনিতে থাকা ছোট্ট তিলে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়।
মেহনূর দাঁত চেপে বলে—
“সবসময় মনে হয়… এসব ধান্দাতেই আপনি ব্যস্ত থাকেন!”
এহসান হেসে বলে—
“তোমার মতো রূপবতী নারী সামনে থাকলে আর কী ধান্দা আটবে বলো তো মনে!আর তোমার থুতনির এই তিলে ঠোঁট ছোঁয়ানোর লোভ সামলানো যে দায়?”
মেহনূর বিরক্ত হয়ে সোফায় বসে পড়ে, বিড়ালটি তার পায়ের পাশে এসে বসে।
সে গম্ভীর গলায় বলে—
“এবার বলুন, কিভাবে, কখন, কোথায়… আমাকে আপনি প্রথম দেখলেন, আর কতবার…”
এহসান মুচকি হেসে মেহনূরের পাশে বসে। চারপাশ নিস্তব্ধ। বাতাসে ভেসে আসে ফেলে আসা সময়ের গন্ধ।
তার গলার স্বর যেন এক আবছা স্মৃতির গহ্বর থেকে উঠে আসে—
“তখন আমার বয়স বিশ।তুমি হয়তো বারো কিংবা তেরো।একটা কোমল সকাল ছিল সেদিন,শাওয়াল মাসের তিন তারিখ।ভোরের আলো তখনও ধবধবে হয়ে ওঠেনি,
আর আমি ফিরছিলাম ফজরের নামাজ পড়ে।হঠাৎই তোমায় দেখলাম…তোমার পরনে সাদা একখানা নামাজের হিজাব,গায়ে কালো গাউন—চোখেমুখে নামাজের পবিত্র আলো,আর ঠোঁটে সেই নিষ্পাপ, নির্ভার হাসি।তুমি হাসতে হাসতে দৌড়ে যাচ্ছিলে তোমার মুয়াযযার পেছনে,পেছনে ছুটছিল মেহরুব আর মেহরাজ।
সেই এক মুহূর্তেই—তুমি আমার দুনিয়াটাকে বদলে দিলে।
সে মুহূর্তে কিছু একটা চেপে বসেছিল হৃদয়ে—অজানা, অদেখা এক অনুভব।চুপচাপ ফিরে এসেছিলাম বাড়ি।
কিন্তু মাথার ভেতর শুধু তুমি…একটা অপরাধবোধ ঘিরে ধরেছিল আমাকে।
নিজেকে জিজ্ঞেস করছিলাম—
‘তুই পাগল হয়েছিস?তুই তো ওকে ভাতিজির চোখেই দেখার কথা!’ঘৃণা হচ্ছিল নিজের উপর।তবু জানো, সেই ঘৃণার মধ্যেও ভালোবাসার একটা মৃদু আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছিল।তোমার চোখের আলো, তোমার হাসির ধ্বনি, তোমার দৌড়ে যাওয়া পায়ের শব্দ…
সবকিছু আমার ভেতরে গভীর কিছু জাগিয়ে তুলছিল।আমি নিজেকে বারণ করতাম, বলতাম—
‘না এহসান, হারাম…!’কিন্তু হৃদয় ছিল একেবারে অবাধ্য।তোমার একটিমাত্র দেখা পেতে আমি ছটফট করতাম।
আমার সমস্ত আত্মা তোমার আশেপাশে ঘুরে বেড়াত—
যেন তুমি একটা দোয়ার উত্তর,যে দোয়া আমি কখনো চেয়েই উঠিনি,তবু যেন আল্লাহ নিজ হাতে তুলে দিয়েছিলেন চোখে।
এহসান একটু থামে।চোখ মেলে তাকায় মেহনূরের দিকে।তার কণ্ঠে ভারি আবেগ—
“তোমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় তো আমাদেরও জমি ছিল নয় শতক।
তোমার বাবা-চাচারা সবাইকে সেই পথ দিয়ে যাওয়া নিষেধ করলেও,
আমরা যেতে পারতাম।মসজিদে যাবার অজুহাতে আমি সেদিক দিয়ে চলতাম—না, শুধু নামাজের জন্য কেবল নয়…তোমায় দেখার তীব্র তৃষ্ণা আমাকে সে পথ টেনে নিয়ে যেত।
তুমি বুঝতে না—তুমি তখন ছিলে আকাশের মতো মুক্ত,
আমি ছিলাম তোমার পৃথিবীর বাইরে একজন নির্বাক দর্শক।দূর থেকে তাকিয়ে থাকতাম তোমার দিকে,
তোমার চলাফেরা, হাসি, চুলের নড়াচড়া—সবকিছু আমার হৃদয়ে একেকটা মধুর খোঁচা দিয়ে যেত।তোমার অজান্তেই আমি প্রতিদিন পুড়ে মরতাম।তুমি হাসলে আমি শান্তি পেতাম,তুমি না থাকলে দিনটা ফিকে লাগত।
নিজেকে বারবার বোঝাতাম—এ অনুচিত।তবুও প্রতিবার তোমায় দেখলে,মনে হতো, যেন কোনো হারাম জিনিসেও যদি এতটা প্রশান্তি পাওয়া যায়,তবে আল্লাহ বৈধ করে দিলে এর স্বাদ কেমন হতো!”
এহসানের গলা জড়িয়ে আসে।
তার চোখে এক অদ্ভুত আলো, যা কেবলই প্রেমিকের হয়।
এহসান আবার বলে—
“দিন গড়াতে লাগল,তুমি ধীরে ধীরে রূপ পেতে লাগলে নারীত্বের।তোমার শরীরের ভাষা বদলাতে লাগল,তোমার হাসির গভীরতা বাড়তে লাগল।
আর আমার ভালোবাসা…তা যেন এক অগ্নিস্রোতের মতো বয়ে যেত আমার রক্তে।তোমার এক ঝলক দেখাও হতো না প্রতিদিন।মাসে হয়তো একবার…তাও দূর থেকে।
তবুও আমি সেই একবারেই ভরে যেতাম।আমার হৃদয় তোমার স্মৃতিতে মজে থাকত রাতদিন।আমি তোমায় ভালোবাসতাম…অবর্ণনীয়ভাবে ভালোবাসি, মেহনূর।ভীষণ রকম ভালোবাসি।তোমার ছায়াও যদি পেতাম, তাও তৃপ্ত হতাম।তোমার নামের ধ্বনিও হৃদয়ের ভেতর গুনগুন করত।”
কিছু মুহূর্ত যেন থেমে থাকে…ভেসে আসে হারিয়ে যাওয়া সময়ের হাহাকার…
এহসান হঠাৎ নরম গলায় বলে ওঠে—
“আমার বয়স তখন সাতাশ।আব্বা বারবার তাগিদ দিচ্ছেন বিয়ের জন্য।চারপাশে চাপ, পরিবারে অস্থিরতা,আর আমি?আমি যেন দিশেহারা এক পথিক, যার চোখে কেবল একটিই গন্তব্য—তুমি, মেহনূর।তোমার নামটিই তখন আমার অস্তিত্ব ,তোমার মুখটাই ছিল আমার সব স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু।
কিন্তু কীভাবে বলি?কীভাবে বলি, যে মেয়েটিকে দূর থেকে ভালোবেসেছি,তাকেই আমি আমার জীবনের সাথি করতে চাই?
তোমার বয়স, সম্পর্ক, সমাজ—সবকিছু আমার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ছিল।তবু একদিন সাহস করে ফেলি।
চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলে—
‘আব্বা… আমি মাজহারুলের মেয়েকেই বিয়ে করতে চাই।বিয়ে যদি করি, শুধুই মেহনূরকে করব।নয়তো সারাজীবন তার অপেক্ষাতেই কাটিয়ে দেব।’
এহসানের কণ্ঠ কেঁপে উঠে।
সে বলে—
আমি ভেবেছিলাম আব্বা হয়তো রাগ করবেন, শাসন করবেন,
কিংবা থাপ্পড় দেবেন…কিন্তু না, তিনি শুধু গভীরভাবে আমার চোখে তাকালেন।ভাইজানেরা প্রতিবাদ করল,
তবু আব্বা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন—
‘আচ্ছা, দেখা যাক।’
ওইটুকু শুনে আমি যেন উড়তে লাগলাম,আমার মনে সেদিন এক নতুন সূর্য উঠেছিল।
সেই রাতেই মসজিদে গিয়েছিলাম,সেজদায় পড়ে তোমায় হারাম করে দেখার জন্য মাফ চেয়েছিলাম,
কেঁদে কেঁদে চেয়েছিলাম—
‘হে আল্লাহ, যদি ভালোবাসা হারাম হয়, তবে তুমি নিজে হালাল করে দাও এই মেয়েটিকে আমার জন্য।’
আমার বুক ভেঙে পড়ছিল…কিন্তু মন বলছিল—তুমি একদিন আমার হবে।
এখানে এহসান একটু থামে।তার চোখ জলে টলমল।
স্মৃতির ভারে ভারাক্রান্ত।
“তোমার বাবার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া হলো।
প্রথমে তারা তীব্রভাবে না বলে দিল।
তাদের গর্ব, অভিমান, সমাজ—সবকিছু যেন তোমার সামনে এক দেওয়াল তুলে দিল।
তবুও হঠাৎ এক চুক্তি হয়।পশ্চিমের বন নিয়ে দরকষাকষির মাঝে এক সমঝোতা—তারা রাজি হয়,
শুধু নামমাত্র এক বিয়ের চুক্তিতে।আমার খুশি লাগছিল,
ভাবছিলাম—অবশেষে তুমি আমার হলে!
মজলিস থেকে উঠেই নিয়ে যাওয়া হলো কাজি অফিসে।
সেখানে সাইন করলাম,একটা শীতল কাগজে জীবনের সব উত্তাপ ঢেলে দিলাম।
তোমার কাছেও গেল প্রস্তাব।তোমাকে বুঝিয়ে, বোঝিয়ে…একটা স্বাক্ষর এনে দেওয়া হলো।
এহসানের কণ্ঠ তখন অশ্রুসিক্ত—
যখন শুনলাম তুমি সাইন করে দিয়েছ,
আমার মনে হয়েছিল—পুরো আকাশটা আমার হয়ে গেছে।সেদিন আল্লাহর সামনে কেঁদে কেঁদে শুকরিয়া আদায় করেছিলাম।
ভাবলাম, ‘শেষমেশ আমার দোয়া কবুল হয়েছে।’
তবে স্বপ্ন ভাঙল খুব দ্রুত।এক চরম বাস্তবতা এসে ছুঁড়ে ফেলল তাকে মাটিতে।
তার চোখ আরও ভিজে উঠে—
তারপরই খবর এলো—তুমি এটা নিতে পারোনি,তুমি শ্বাসকষ্টে ভুগছো,তুমি কাঁদতে কাঁদতে বলেছ—
‘আমি এহসান তালুকদারকে কখনো নিজের স্বামী হিসেবে মেনে নেব না!’তুমি আমাকে চাও না…মরে গেলেও চাও না।
আমি ছুটে গিয়েছিলাম হাসপাতালে…তুমি তখন ধীরে ধীরে একটু ভালো হচ্ছিলে।আর তখন…
তুমি চিৎকার করে মেহরুবকে বলেছিলে—
‘ভাইজান, আমি এত বড় কলঙ্কে রাঙতে পারব না।
আমি এহসান তালুকদারকে জীবনেও নিজের স্বামী মেনে নেব না।আমি এত খারাপ মানুষের স্ত্রী হতে চাই না।না, ও একটা খারাপ মানুষ… খুব খারাপ…!আমি চাই না… আমি চাই না…!
এহসানের গলা ধরে আসে।সে নিজের বুকের বাম পাশে আঙুল রাখে,
চোখে পানি, কণ্ঠে অগ্নি—
“এই… এখানে…
এই বুকের ভেতর এমন ব্যথা উঠেছিল,যেটা কোনো ওষুধে সারে না।তোমার প্রতিটা বাক্য যেন তীর হয়ে বিঁধেছিল আমার হৃদয়ে।সেদিন আমি বুঝলাম,ভালোবাসা যদি একতরফা হয়,তবে তা সবচেয়ে বড় আজাব..!
মেহনূর বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে এহসানের চোখে।
চোখের তারা যেন হঠাৎ কোনো অচেনা ভাষায় কথা বলে ওঠে।তার মন ওলটপালট হয়ে যায়।একজন মানুষ—এতটা ভালোবাসতে পারে?এতটা নিবেদন দিয়ে কাউকে চাইতে পারে?
তার চোখের কোণ ভিজে ওঠে।চোখের জল কিছুটা বিস্ময়ের, কিছুটা অনুশোচনার,আর বাকিটুকু এক গভীর অপরাধবোধের।
এহসান আবার বলে—
“তোমার বাপ-চাচা বলেছিল কিছুদিন সময় দিতে,
যাতে তুমি আমায় একটু একটু করে মেনে নিতে পারো…
কিন্তু তারা…তারা তো মীরজাফর।তাদের ভিতরে ছিল অন্য খেলা,তারা তো আমার প্রাণ, আমার ভালোবাসাকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্তে মেতে উঠেছিল।
তাই…আমি আর সময় দেইনি।তোমায় মাদ্রাসা থেকে তুলে আনলাম…নিজের হাতে, নিজের অধিকারবলে…
আবারও বিয়ে করলাম তোমায়।
তুমি জানো মেহনূর?আমি চাইনি তোমায় জোর করে পেতে,আমি চাইনি সমাজের চোখে শুধু বৈধ নয়,
রবের দরবারেও হালাল করে তোমায় কাছে টানতে।
কিন্তু পারিনি…
সময়ের, পরিস্থিতির, ষড়যন্ত্রের কাছে আমি হেরে গেছিলাম।
তবুও আমার হৃদয় জানে—আমি পাপের প্রেম করিনি!,আমি রাতের আঁধারে তাকিয়ে।কেঁদেছি,তাহাজ্জুদের সেজদায় পড়ে—তোমার নাম উচ্চারণ করে বলেছি—
‘হে আল্লাহ, আমি ওকে চাই,হালাল করে চাই…একটু ভালোবাসা দিয়ে চাই,আঁকড়ে ধরা এক প্রাণ চাই, যার নাম মেহনূর।’”
এহসানের চোখে তখন এক অব্যক্ত দীপ্তি।তার ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু কণ্ঠে প্রশান্তির ঝরনা।
“দেখো…আমার রব আমায় হতাশ করেননি।আজ…তুমি আমার,একান্ত আমার।তোমার স্পর্শে আজ আমার অস্তিত্ব জেগে উঠেছে…”
মেহনূর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে এহসানের দিকে।চোখে ভেসে আছে নরম এক কৃতজ্ঞতা।নিরব চরণে এসে দাঁড়ায় তার পাশে,এবং মাথাটি আলতো করে রাখে এহসানের কাঁধে।
– “এত ভালোবাসার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে…আমার মতো তুচ্ছ একজন নারীকে এভাবে ভালোবাসার জন্য।”
এহসান আকাশের দিকে তাকিয়ে, নিঃসাড় কণ্ঠে বলে—
– “তুমি তুচ্ছ নও প্রিয়তমা।তুমি আমার বেঁচে থাকার মূল কেন্দ্র।”
মেহনূর হেসে ফেলে, এক নিঃশ্বাসে তাকায় আকাশের তারা ভরা আকাশের দিকে—
– “আমি তো ভাগ্যবতী…কারণ এক পাপিষ্ঠ মানুষ আমায় ভালোবাসেন।আর পাপিষ্ঠদের ভালোবাসা হয় তীব্র… খুব তীব্র।”
এহসান হালকা ঘুরে মেহনূরের চোখে চোখ রাখে।
তারপর নিঃশব্দে তাকে জড়িয়ে ধরে,মেহনূরও তাকে আপন করে নেয় নিজের সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে।
একটু পর, এহসান আলগা হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে মেহনূরের সামনে।
তার পেটের উপর হিজাব সরিয়ে দেয় আলতো করে,
আঙ্গুলে ছুঁয়ে দেয় এক গভীর মমতায়,তার লুকানো অস্তিত্বকে।
– “আসসালামু আলাইকুম, আমার প্রিয় পবিত্র অস্তিত্ব।”
মেহনূর মুচকি হেসে ওঠে।এহসান মুখ গুঁজে দেয় মেহনূরের পেটে,তার নিজের সন্তানকে অনুভব করতে, ছুঁয়ে থাকতে।মেহনূর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় এহসানের—
– “আপনার সন্তানও আপনার মতো বেজাত হয়েছে।
একবার শান্তি দেয় না আমায়!”
এহসান মেহনূরের পেটে মুখ গুঁজেই হেসে ওঠে—
– “জাতে তালুকদার…আর তুমি আমাদের বানিয়ে দিলে বেজাত।”
মেহনূর ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে—
– “হুঁ! আমায় শান্তি না দিলে, আমি এসব কিছু বলবই!”
এহসান মায়াভরা কণ্ঠে বলে—
– “বলুন, যা ইচ্ছে বলুন।আপনার সব অভিযোগ, সব অভিমান, সব আবদার—আমি, এহসান তালুকদার, মাথা পেতে শুনে নেব।”
একটা নিঃশব্দ সময় পেরিয়ে যায়।
মেহনূর হঠাৎ প্রশ্ন করে—
– “এত ভালোবাসেন কেন আপনি আমায়?”
এহসান হেসে উত্তর দেয়—
– “ভালোবাসি বলেই তো এত ভালোবাসি।”
দু’জনেই হেসে ওঠে,আকাশ তখনও জেগে,তারাদের আলোয় জ্বলজ্বল করে তাদের ভালোবাসার প্রতিটি মুহূর্ত।
—
ছাঁদটা নিস্তব্ধ, আকাশের গায়ে হালকা মেঘেরা খেলা করছে। দূরের গলির ঘুঘুর ডাক ভেসে আসছে হালকা বাতাসে। সেই নীরব ছাঁদে পাশাপাশি বসে আছে নূরি আর মেহরুব।
মেহরুব বইয়ের পাতায় চোখ গুঁজে রেখেছে, আর নূরি চুপচাপ তাকিয়ে আছে তার দিকে।
হঠাৎ নূরি নরম স্বরে বলে ওঠে,
“+- মেহরুব ভাই… একটা আবদার ছিল।”
মেহরুব বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে ধীর ভঙ্গিতে তাকায় নূরির দিকে,
“— কি?”
নূরি ছটফটিয়ে উঠে মেহরুব এর পাশে এসে বসে। কিন্তু মুখে যেন তালা পড়ে গেছে। শরীরটা ঠান্ডা হয়ে আসছে লজ্জায়।
চোখ নামিয়ে ফেলে সে। শব্দ খুঁজে পায় না।
মেহরুব মুখ ফিরিয়ে আবার বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে নেয়। বিরক্ত গলায় বলে,
“— যদি এভাবে লজ্জা মরিস, তো দয়া করে বইন, তুই আমার আশেপাশে আসিস না। তোর কারণ ছাড়া এই লজ্জা দেখে আমার নিজেরই লজ্জা লাগে!”
নূরি মুখ ফুলিয়ে বলে,
“– হু, বলতে চেয়েছিলাম, বলব না।”
মেহরুব তার দিকে না তাকিয়েই বলে,
“– বল শুনি, কি আবদার?”
নূরি ঠোঁট কামড়ে বলে ফেলে,
“– আ… আমি… আপনায় ভালোবাসা নিবেদন করতে চাই। ঐ যেমন… প্রিয় পুরুষকে ফুল দিয়ে… ওভাবে… আপনি রাজি হবেন?”
মেহরুব বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে নূরির দিকে। মেয়েটা এতদিনে বউয়ের মতো কথা বলেছে! নয়তো সারাদিন লজ্জায় মুখ ঢেকে রাখে।
তার ঠোঁটে মুচকি হাসি খেলে যায়।
“– অবশ্যই। তবে ‘রাজি’র মতো করতে হবে, নয়তো রাজি হব না!”
নূরি লাফিয়ে উঠে দৌড়ে ছাঁদের এক কোণে চলে যায়।
পেছন ফিরে বলে,
“— অবশ্যই রাজি হবেন!”
কিছুক্ষণ পর এক হাতে কাঠগোলাপ ফুল নিয়ে ফিরে আসে সে।
মেহরুব এর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে।
ফুলটা বাড়িয়ে দেয়, চোখ বন্ধ করে নেয় এক গভীর শ্বাস। তারপর বলে ফেলে,
“— আমি আপনায় ভীষণ ভালোবাসি, আমার প্রিয় মেহরুব ভাই। আমি নিজের থেকেও আপনাকে বেশি ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি। এক সমুদ্র ভালোবাসা আমার অন্তরে আপনার জন্য ঢেউ খেলে প্রতি মুহূর্তে। আপনি আমার প্রিয়র চেয়েও প্রিয় পুরুষ। আমি আপনার প্রতি ভীষণ অন্তহীন ভালোবাসা রাখি…”
মেহরুব বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।
তার সেই লজ্জাবতী নূরি আজ সব লজ্জা গিলে এমন প্রেমভরা শব্দ উচ্চারণ করছে!
সে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে নূরির দিকে।
নূরি চোখ খুলে দেখে মেহরুব হা করে তাকিয়ে আছে।
তার ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে যায়।
এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“— পছন্দ হয়নি… আমার অন্তরের এই একাংশ কথাগুলো।”
মেহরুব এবার উঠে দাঁড়ায়,
তার সামনে বসে ফুলটি হাতে নেয়।
চোখে প্রশান্তির হাসি,
“— খুব খুব পছন্দ হয়েছে। আরও কিছু বলবি? বল না, আরও সুন্দর দুইটা কথা আমায় নিয়ে।”
নূরির ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটে ওঠে।
সে মুখ হাত দিয়ে হেসে ফেলে।
মেহরুব নিজের বুকে হাত রেখে বলে,
“– ইসস… আমি ধ্বংস, নূরি ফুল! আমি ধ্বংস! তোর এই হাসিই আমার ছোট্ট অন্তরের মরণের মূল অস্ত্র…”
নূরি হাসতে হাসতে বলে,
“– কি যে বলেন না আপনি!”
মেহরুব বসা অবস্থাতেই তার দিকে এগিয়ে আসে, কোমরে বাহু জড়ায়।
কানে কানে বলে,
“— আমি রাজি। আপনার প্রস্তাবে আমি রাজি।”
নূরি গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“+- আবারও বলছি… আপনায় ভীষণ ভালোবাসি। আমি আপনার নূরি ফুল শুধু আপনার অন্তরের বাগানেই থাকতে চাই। রাখবেন… গেঁথে।”
মেহরুব নূরির খোলা চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“— অবশ্যই। মৃত্যুর আগ আগ পর্যন্ত… আর মৃত্যুর পরও, আল্লাহ যদি চান… পরপারেও তোকে আগলে রাখব আমি।”
নূরি নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় মেহরুব এর গালে, তারপর থুতনিতে।
দাঁড়ির স্পর্শে কাঁপে, তবু মেহরুবকে আঁকড়ে ধরে রাখে।
আর আকাশের ওপরে তখন একটুকরো রঙিন মেঘ ভেসে বেড়ায়…
ভালোবাসার মতো নরম, উষ্ণ আর চিরস্থায়ী।
এদিকে এশা পা ধরে বসে আছে মেহরাজের সামনে। হাতজোড় করে বলছে, কাঁধে মাথা রেখে মিনতি করছে, তবু মেহরাজের অভিমান ভাঙছে না।
অভিমান করবে না, আসরের সময়ই তো এসেছিল সে এশার বাড়ি। রাত দশটা অবধি বারবার রান্নাঘরে উঁকি দিয়েছে, কত কৌশলে ডাক দিয়েছে তাকে। লজ্জাও পেয়েছে, অপ্রস্তুতও হয়েছে… তবু এশা আসেনি। আর এখন? এখন এমন করে আদর দেখাচ্ছে!
মেহরাজ মুখ গোমড়া করে বসে আছে বিছানায়। এশা অনেক কিছু বলছে, অনেক চেষ্টা করছে, তবু সে একটাও শব্দ করছে না।
একসময় এশার কোনো কথায় পাত্তা না দিয়ে বাতি নিভিয়ে সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে মেহরাজ।
এশা বুঝে যায়—মেহরাজ সত্যিই খুব রেগে আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে যায় ওযু করতে। ওযু শেষ করে ফিরে এসে নামাজের হিজাবটা খুলে ধীরে ধীরে রাখে সোফার ওপর।
তারপর নরম পায়ের শব্দে এগিয়ে আসে বিছানার দিকে। মেহরাজের চোখ আটকে থাকে তার শ্যামবর্ণ মুখশ্রীতে—অভিমানে রাগে জ্বলছে সে, তবু মুগ্ধ চোখ ফেরাতে পারছে না।
কেনো এত মায়াবী এই মেয়ে? কেনো তার চোখে এত ভয়ংকর মায়ার আঁচড়?
এশা চুপচাপ এসে মেহরাজের বুকে শুয়ে পড়ে। দুই হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। মেহরাজের বুকে মুখ ঘেঁষে বলে—
— মাফ করে দাও… আর এমন হবে না। জান, আমি সত্যি বলছি। আর কখনো তোমার অবাধ্য হবো না। তুমি যখন ডাকবে, তখনই ছুটে আসব তোমার কাছে।
মেহরাজ কিছুই বলে না। মনে মনে যেন বলে—
“বুঝ বেডি, তুই যখন রেগে উঠিস, তখন আমার ভেতরটা কীভাবে ফাটে।”
এশা মুখটা তার দিকে ঘুরিয়ে নিতে চায়। থুতনিতে আলতো চেপে ধরে বলে—
— এরে হুনরায়নি চাও তে?
মেহরাজ চুপ। মুখ ফিরিয়ে নেয়।
এশা নিজের ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে দিতে থাকে মেহরাজের গাল, কপাল, চিবুক—ধীরে ধীরে।
তার এই বাচ্চামি দেখে হেসে ওঠে মেহরাজ।
— হয়েছে… আর দেখাতে হবে না আন্দাজি প্রেম!
এশা ওর বুকে কিল মেরে বলে—
— প্রেম না, ভালোবাসা! আর এটা একদম সত্যিকারের ভালোবাসা।
মেহরাজ এবার ওকে কাছে টেনে নেয়। বালিশে শুইয়ে দেয় আদরে। পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দেয় মুখ থেকে থেকে। চুপচাপ তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে—
— এত যখন ভালোবাসো, তখন আমার ডাকে সাড়া দিলে না কেন?
এশা চোখ নিচু করে বলে—
— সত্যি বলছি, আর এমন হবে না।
মেহরাজ হেসে ওর গলা থেকে চুল সরিয়ে দেয়, আদুরে কণ্ঠে বলে—
— তাহলে এখন এর শাস্তিসূরুপ সারা রাত ঘুমহীন থাকতে হবে কিন্তু!
নূরি মেহরুবের কোলে বসে আছে। গলা কাঁপছে, ঠোঁট জড়সড়, চোখে ভয় আর লজ্জার ছায়া। মেহরুব ওকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। যেন বলছে—”তুই এখন নিরাপদ, আমি তো আছি।”
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মেহরুব ধীরে গলায় বলল—
— “তুই এতদিন অসুস্থ ছিলি… কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারিনি। আয়ানের কাছ থেকে… মানে, ওখান থেকে তুই কিভাবে পালালি, নূরি?”
নূরির চোখে-মুখে অজস্র স্মৃতির ধাক্কা খেলে গেল। গলা শুকিয়ে এল। তারপর খুব ধীরে বলল—
— “সে আমাকে একটা হোটেলের ঘরে আটকে রেখেছিল। হাত-পা বেঁধে রেখেছিল, যেন আমি পালাতে না পারি। অনেক চেষ্টা করেও খুলতে পারিনি। ও শুধু বলছিল, কাজি আনবে… আজই নাকি আমাদের বিয়ে হবে।
“আমি কাঁদছিলাম, চিৎকার করছিলাম, কিন্তু কেউ শুনছিল না। এরপর হঠাৎ একসময় ওর ফোনে কল আসে, সেটা ধরতে ও আমার হাত-পা বেঁধেই বাইরে বেরিয়ে যায়—তাড়াহুড়ো করে। বলল, কাজি নিয়ে আসছে। দরজা বাইরে থেকে তালা দিয়ে গেল…”
নূরি থেমে গেল একটু, গলা কেঁপে ওঠে।
— “ঘরের ভিতরে একটা টেবিলের কোণায় ভাঙা গ্লাস ছিল। আমি শরীরটা টেনে টেনে ওটার কাছে যাই… তারপর হাতের বাঁধনটা কাটতে শুরু করি। অনেক কষ্টে… রক্ত ঝরছিল… কিন্তু আমি থামিনি। কাটতে কাটতে একসময় হাত খুলে গেল। তারপর পা খুলে দৌড় দিলাম দরজার দিকে। লোহার তালা ছিল, জানালার পাশ দিয়ে বের হওয়ার একটা সরু ফাঁক পেয়েছিলাম… আমি ওইটুকু পথ দিয়েই বেরিয়ে পড়ি।”
তার চোখ আবার কেঁপে ওঠে।
আত্মার আগলে পর্ব ৪৯+৫০
— “রাস্তায় বেরিয়েই আমি দৌড়াতে থাকি… অন্ধের মতো… কিছু বুঝিনি, শুধু দৌড়াচ্ছিলাম… তারপর হঠাৎ একটা গাড়ি… খুব জোরে ধাক্কা দেয়। আর কিছু মনে নেই। যখন চোখ খুললাম, তুই সামনে ছিলি… তুই…”
মেহরুব আর কিছু শুনতে পারছিল না। বুক ফেটে যাচ্ছিল ওর।
সে নূরিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
— “তুই অনেক সাহসী… তুই আমার নূরি। এখন আর কেউ তোকে ছুঁতে পারবে না। এবার তুই শুধু আমার… শুধু আমার।”
