আত্মার আগলে পর্ব ৮
সানজিদা আক্তার মুন্নী
এহসান মুচকি হেসে হাসিবকে ডাকল।
— হাসিব, উনার জন্য বিশেষ উপহার রেখেছি, নিয়ে আয় তো সেটা।
হাসিব থমকে যায়। এহসান “বিশেষ উপহার” কথাটা যখন বলে, তখন তার মানে একটাই— কেউ পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। কিন্তু এই স্নাইপার তো তেমন কিছু করেনি! তবে?
হাসিব কিছু না বলে নির্দেশ পালন করে। কয়েক মিনিটের মধ্যে সে এক বিশাল বাক্স আর একটা অটো ড্রিল মেশিন এনে এহসানের সামনে রাখে।
স্নাইপারটি অবাক হয়ে বাক্সের দিকে তাকায়। কিছু বুঝতে না পেরে কপাল কুঁচকে বলে,
— হোয়াট ইজ দিস, ব্রো?
এহসান কোনো উত্তর দেয় না। ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি রেখে সে বাক্স খুলে দুটো লম্বা, মোটা, ধারালো পেরেক বের করে।
হাসিব নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। সে জানে এখন কী হবে।
এহসান এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্নাইপারের দিকে তাকায়। লোকটি চেয়ারের হাতলে হাত রেখে বসে আছে। এহসান কোনো শব্দ না করে এক ঝটকায় এগিয়ে আসে।
চেয়ারের ওপর রাখা স্নাইপারের দুটো হাতে সজোরে পেরেক গেঁথে দেয়!
ধাতব শব্দে পেরেকগুলো কাঠ ভেদ করে ঢুকে যায়। স্নাইপারের হাত চেয়ারের হাতলের সঙ্গে একেবারে আটকে যায়।
স্নাইপারটা তীব্র চিৎকার করে উঠে।
এহসান দাঁত চেপে ফিসফিস করে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— আমার বাড়ির মহিলার দিকে চোখ দিস, কুত্তার বাচ্চা! তুই তোর পুরুষত্ব হাসিল করতে চাস? দাঁড়া, আমি দেখাচ্ছি।
তারপর সে পাশে রাখা ড্রিল মেশিনটা হাতে তুলে নেয়। একবার চালিয়ে দেখে, মেশিনটা ঠিকঠাক চলছে কি না।
ঘরজুড়ে গর্জন তুলে শব্দ করে ওঠে ড্রিল মেশিন।
এরপর কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই এহসান সেটা সোজা স্নাইপারের প্যান্টের ওপর দিয়ে তার পুরুষাঙ্গে ঠেসে ধরে!
বাগানে কানের পর্দা ফাটানো এক বিকট চিৎকার ছড়িয়ে পড়ে!
স্নাইপারটা মাথা উঁচিয়ে আর্তনাদ করে, শরীরটা কাঁপতে কাঁপতে ঝাঁকুনি খায়।
এহসান এক হাত দিয়ে ওর মাথাটা ধরে রাখে। আরেক হাতে দ্রুত একটা ছুরি বের করে নিয়ে তার জিভ মাঝখান থেকে এক টানে কেটে ফেলে!
রক্ত ছিটকে পড়ে চারপাশে।
ড্রিল মেশিন বের করে এনে এবার সে হাসিবের দিকে তাকায়।
— ওর চোখে ছুরি ঢোকা, হাসিব।
হাসিব একটু কাঁপে।
— কিন্তু কেন?
এহসানের চোখ দুটো লাল হয়ে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— ও নিপাকে নিজের বিছানায় চেয়েছে!
আর দেরি করে না হাসিব। নিপা তার অনেক শখের নারী। ওর দিকে এই জানোয়ারটা চোখ তুলেছে!
এক পলকে ছুরি তুলে নেয় সে। এক হাতে স্নাইপারের মাথাটা ধরে, আরেক হাতে ছুরিটা ওর দুই চোখে একসঙ্গে গেঁথে দেয়।
স্নাইপারটা এবার সত্যিকারের নরক যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠে। কিন্তু তার জিভ তো নেই— সেই চিৎকার বোবা কান্নার মতো মনে হয়।
মাত্র কয়েক মুহূর্ত…
তারপর সব শেষ।তার দেহটা নিথর হয়ে পড়ে থাকে চেয়ারের সঙ্গে আটকে।
কে জানত, একটা নোংরা প্রস্তাব তার জীবনকে এত নির্মমভাবে শেষ করে দেবে?
এহসান ধীরে ধীরে নিজের পাঞ্জাবির দিকে তাকায়। কিছুটা রক্ত লেগে গেছে। বিরক্তির সঙ্গে বলে,
— লাশটা নর্দমায় ফেলে দে, আর সবকিছু পরিষ্কার করে রাখ। আমি গোসল করে আসি। নাপাক রক্ত লেগে গেছে শরীরে।
বলে সে বাগান থেকে বেরিয়ে যায়।
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে মেহনূর।একদম পাথর হয়ে গেছে ও।ওর চোখের সামনে যা ঘটল, সেটা কোনো দুঃস্বপ্ন নয়— এক নির্মম বাস্তবতা!
এহসান কীভাবে লোকটাকে শেষ করে দিল, কীভাবে পেরেক গেঁথে ওর হাত চেয়ারে আটকে দিল, কীভাবে ড্রিল মেশিন দিয়ে…না! ও এসব ভাবতে চায় না!
শরীরের রক্ত যেন জমে আসছে, শিরাগুলো শক্ত হয়ে গেছে। বুকের ভেতরটা ধকধক করছে, মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ডটা ফেটে বেরিয়ে আসবে!ওর হাত-পা ঠান্ডা বরফের মতো। কাঁপছে ও, ভয়ংকরভাবে কাঁপছে!
এহসান…এহসান যদি ওকেও মেরে ফেলে?
একবার যদি সন্দেহ করে যে ও সব দেখে ফেলেছে?ও কি পারবে সেই যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু সহ্য করতে? না! পারবে না!
মেহনূর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।এক দৌড়ে ছুটে যায় কাপড় রাখার কক্ষে। একটা অন্ধকার কোণে গুটিসুটি মেরে বসে পড়ে।
শরীরটা ঝাঁকুনি খাচ্ছে, চোখ ফেটে পানি আসছে, কিন্তু ও মুখ চেপে ধরে রেখেছে— কোনো শব্দ করা যাবে না!শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, মনে হচ্ছে এই মুহূর্তেই হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবে!
এহসান কক্ষে এসে দেখল মেহনূর নেই।বিছানা ফাঁকা, জানালার পর্দা থমকে আছে বাতাসহীন ঘরে।ওর ভ্রু কুঁচকে গেল।মেহনূর কোথায় গেল?বেলকনিতে ছুটে গেল— নেই!বাথরুমে দরজা ধাক্কিয়ে দেখল— সেখানেও নেই!
বাইরের দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধ, তাহলে বেরোলো কীভাবে?এহসানের চোখ সরু হয়ে আসে।ওর পায়ের শব্দ মৃদু হয়ে যায়, নিঃশ্বাস ধীর হয়ে আসে।
কোনো একটা সম্ভাবনা মাথায় আসতেই ধীরে ধীরে কাপড় রাখার কক্ষের দিকে এগিয়ে যায় ও।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ শোনে।
নিঃশব্দ…
তবুও একটা ঘ্রাণ ছড়িয়ে আছে বাতাসে।মেহনূরের শরীরের গন্ধ…এহসানের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি খেলে যায়।ও দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে।
ভেতরে অন্ধকার।আলো জ্বালাতেই চোখ চলে যায় কক্ষের এক কোণে।ঘাপটি মেরে বসে আছে মেহনূর!ভয়ের রূপ
ওর গায়ে একটা স্পর্শও লাগেনি, অথচ মনে হচ্ছে যেন কয়েক ঘণ্টা ধরে মারধর করা হয়েছে!শরীরটা কাঁপছে, চোখের কোণে পানি জমে আছে, মুখ শুকিয়ে গেছে।
এহসান ধীরে ধীরে ওর দিকে এগিয়ে যায়।কিন্তু যত এগোয়, মেহনূর তত সঙ্কুচিত হয়ে যায়, দেয়ালের গায়ে নিজেকে ঠেলে দিচ্ছে, যেন আরেকটু চাপ দিলেই দেয়ালের ভেতর ঢুকে যাবে!
ওর এই ভয়ের কারণ জানা, কিন্তু নিজ কানে শুনতে চায় এহসান।ও হাঁটু গেড়ে বসে ওর সামনে।
মেহনূর একটা অসহায়, ভীত কণ্ঠ ফিসফিস করে ওঠে,
— মা… মা… মারবেন
মেহনূর কান্না চেপে রেখেছে, কিন্তু ঠোঁট কাঁপছে, হাত দুটো বুকের কাছে শক্ত করে ধরা।
— মারবেন না আমায়…
এহসান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মেহনূরের দিকে “!ও কি সত্যিই মনে করছে যে ওকে মেরে ফেলবে?
একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয় এহসানের বুকের ভেতর।
ওর হাত এগিয়ে যায়, মেহনূরের নরম গাল ছুঁয়ে আলতো করে বলে,
— কী হয়েছে, বলো তো? এত ভয় পাচ্ছো কেন? বলো আমায়?
মেহনূর সাথে সাথে মুখ সরিয়ে নেয়, গালে লাগানো এহসানের হাতটা সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে,কিন্তু ভাঙা গলায় ফিসফিস করে বলে ফেলে,
— আপনি কি আমাকেও ঐভাবে মেরে ফেলবেন?আমায় মেরে ফেলবেন? তাইনা মেরে দিবেন? তাই…
এক মুহূর্তের জন্য এহসানের হৃদস্পন্দন থেমে যায়।ও কি সত্যিই এতটা ভয়ে আছে?এতটা আতঙ্কিত?
এহসান গভীর শ্বাস নেয়, তারপর মেহনূরকে এক ঝটকায় নিজের বুকের ভেতর টেনে নেয়।
— চুপ করো, মেহনূর…ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ধীর স্বরে বলে,— আমি তোমায় কিচ্ছু করব না।— যদি তুমি আমার কথা মতো চলো, যদি আমার নিয়মে থাকো, তাহলে আমি তোমায় আঘাত করব না।তুমি যদি কষ্ট পাও, আমি কী নিয়ে বাঁচব বলো?
ওর কণ্ঠে দৃঢ়তা, চোখে কোনো রহস্য নেই।কিন্তু মেহনূরের মন থেকে ভয় এখনো যায়নি।
কিছুক্ষণ পর এহসান ওকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
তারপর বলে,
— আমি গোসল করতে যাচ্ছি। ফিরে এসে যেন আমার পাঞ্জাবি, পায়জামা, আতর সব সামনে পাই।
ওর কণ্ঠ কঠিন, ধীর কিন্তু আদেশমূলক।
— এগুলো এখন থেকে তোর দায়িত্ব।
এ বলে একখানা লুঙ্গি আর বড় তোয়ালে নিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে, তারপর ওয়ারড্রব থেকে মিসওয়াক নিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়—উদ্দেশ্য পুকুরে গিয়ে ডুব দিয়ে গোসল করা!
ভয়ে পাথর হয়ে বসে আছে মেহনূর। শরীর কাঁপছে, হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে, কিন্তু মাথার ভেতর একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে—এহসান যদি ফিরে এসে দেখে তার কথামতো কিছুই রাখা হয়নি, তাহলে? ও কি তখনও শান্ত থাকবে? না কি আবারও ভয়ংকর রূপ নেবে?
সে আর দেরি করে না। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, হাতে তুলে নেয় এহসানের জন্য কালো রঙের পাঞ্জাবি-পায়জামা আর আতরের বোতল। বুক ধুকধুক করছে, কিন্তু সে কক্ষে ফিরে আসে। নিঃশব্দে এসে জামাকাপড় বিছানার ওপর রাখে, তারপর নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
ঠিক সেই মুহূর্তে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে এহসান। মেহনূর তাকিয়ে দেখে—এহসান কেবল লুঙ্গি পরে আছে, গায়ে জড়িয়ে আছে একখানা বড় তোয়ালে, আর চুল থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। এহসান একদম মেহনূরের সামনে এসে তোয়ালেটা খুলে বিছানায় ফেলে দেয়।
মেহনূরের চোখ এক মুহূর্তের জন্য আটকে যায়। নিখুঁত, ধবধবে ফর্সা শরীর—একটুও ক্ষতের দাগ নেই। অথচ সে তো কতবার আব্বা আর চাচাদের গোসল সেরে আসার পর দেখেছে, তাদের শরীরে ছোট-বড় কত ক্ষতচিহ্ন! কিন্তু এহসান… তার শরীরে একটিও নেই। যেন নিখুঁতভাবে গড়া, শক্তিশালী, তবু মসৃণ।
মেহনূরের এমনভাবে তাকিয়ে থাকা এহসানের চোখ এড়ায় না। একপাশে ভ্রু নাচিয়ে বলে,
— “কি রে, কি দেখছিস?”
মেহনূর ভাবহীন স্বরে বলে ফেলে,
— “আপনার শরীরে কোনো ক্ষতের দাগ নেই। আব্বা-চাচাদের তো…”
নিজের কথায় নিজেই লজ্জায় গুটিয়ে যায়। এ কী বলে ফেলল সে!
এহসান মৃদু হেসে বলে,
— “তোর বাপ-চাচার মতো কাপুরুষ না আমি, যে মারামারিতে গিয়ে কুকুরের মতো মার খেয়ে শরীরে ক্ষত নিয়ে ফিরব!”
মেহনূর চুপ করে যায়। কিছু বলার সাহস হয় না।
এহসান ধীর পায়ে মেহনূরের দিকে এগিয়ে আসে। মেহনূর শ্বাস আটকে যায়। একপা… দুই পা… এহসান যত এগোচ্ছে, মেহনূর ততই পিছোচ্ছে। একসময় পেছনের বিছানার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় সে। ভয়ে কাঁপা গলায় বলে,
— “না! এগোবেন না!”
এহসান কি এত সহজে থামবে? সে তো আরও ঝুঁকে আসে, যেন ভয় দেখিয়ে উপভোগ করছে।
মেহনূর শ্বাস নিতে পারছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ। সে আরও পিছোতে চায়, কিন্তু বিছানার সীমা শেষ হয়ে গেছে। এহসান থামছে না। একসময় মেহনূরের শরীরের ওপর তার ছায়া পড়ে যায়।
মেহনূর আর কিছু না ভেবে আকস্মিকভাবে এক লাথি মেরে বসে এহসানের বুক বরাবর “!এক মুহূর্তের জন্য সব স্তব্ধ হয়ে যায়।
এহসান নিজের বুক চেপে ধরে কিছুটা পিছিয়ে যায়। মেহনূর নিজের কান্ডে নিজেই স্তব্ধ! কী করল সে!তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে এহসানের কাছে আসে, ব্যাকুল স্বরে বলে,
— “ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি কী করে ফেললাম! বিশ্বাস করুন, আমি এটা ইচ্ছে করে করিনি! আপনাআপনি হয়ে গেছে! বিশ্বাস করুন!”
এহসান কাশতে শুরু করে, ইচ্ছে করেই। মেহনূর আরও বেশি ব্যাকুল হয়ে পড়ে, ওকে বিছানায় বসিয়ে দেয়, এক গ্লাস পানি এনে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়।আর অস্থির গলায় বলে
— “সত্যি বলছি, এটা আমি ইচ্ছে করে করিনি! বিশ্বাস করুন! কসম!”
এহসান পানিটুকু শেষ করে একপলক মেহনূরের দিকে তাকায়, তারপর শান্ত স্বরে বলে…
— “যা, ওয়ারড্রব থেকে জয়তুন তেল নিয়ে আয়।”
মেহনূর এক মুহূর্ত দেরি না করে দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। মাথার ভেতর দুশ্চিন্তার ঝড়—এখনই যদি এহসানের আদেশ না মানে, তাহলে? আল্লাহই জানেন, এহসান ওকে বাঁচিয়ে রাখবে কি না!
হাত কাঁপছে, তবু ওয়ারড্রব খুলে তেলের বোতলটা বের করে নিয়ে আসে। কক্ষের ভেতর ঢুকতেই এহসান একপ্রকার আদেশের সুরে বলে,
— “আমার সারা গায়ে তেল দিয়ে একটু মালিশ করে দে।”
একটা মুহূর্তের জন্য মেহনূরের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কী বলল এহসান?
ওর হঠাৎ করে ঘৃণা হতে থাকে। এই পাপী শরীর? এই কলঙ্কিত শরীর? যে হাতে হাজারো মানুষের খুন করেছো, যে শরীর পাপের বোঝা বইছে, সেই শরীরে কি সে হাত রাখবে? না! অসম্ভব!
কিন্তু সে কিছু বলে না। শুধু দাঁড়িয়ে থাকে এক জায়গায়, বোবা হয়ে।
এহসান একটু পরেই সেটা খেয়াল করে। ভূ কুঁচকে বলে,
— “এই, কোথায় হারালি? শুনতে পাচ্ছিস না?”
মেহনূর ঝট করে উত্তর দেয়,
— “আমি আপনাকে ছুঁতে পারব না!”
এহসানের চোখের ভ্রু খানিকটা নেমে আসে। চোখদুটো আরও গাঢ় হয়, গলায় চাপা বিস্ময়।
— “কেন?”
মেহনূর চোখ ফিরিয়ে নেয় অন্যদিকে, কঠিন স্বরে বলে,
— “আমি চাই না কোনো পাপিষ্ঠ পুরুষের শরীর স্পর্শ করতে।”
কক্ষের বাতাস যেন ভারী হয়ে ওঠে।
এহসান কিছুক্ষণ মেহনূরের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে, তারপর মৃদু হাসে আর বলে
—-তুমি শুধু কি স্পর্শ করবে এই পাপিষ্ঠ শরীরে তুমি তো স্পর্শ করেছো এই পাপিষ্ঠ অন্তর “!
মেহনূর বাক্যহীন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তার মস্তিষ্কে একের পর এক অস্থির চিন্তা চলে আসে। কীভাবে এহসান এমন কথা বলে, বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু তার কিছু করার নেই। তারপর হঠাৎ করে এহসান তীব্রভাবে ধমক দিয়ে বলে,
— “চুপচাপ যা, বলেছি তা কর, নয়তো হাত কেটে রেখে দিব বেয়াদব নারী!”
মেহনূর সারা শরীরে এক শিহরণ অনুভব করে, সঠিক সময়ে বোধগম্য হয় যে তাকে এই কাজ করতেই হবে—এহসানের শরীরে তেল মালিশ। তবে তার মনে ঘৃণা আর সংকোচের চরম অনুভূতি ছিল। সে কী করবে, না করবে, কিছুই বুঝতে পারে না।
এক সময়, অবশেষে বাধ্য হয়ে মেহনূর বিছানায় উঠে যায়। তার হাতে কাপছে, তবে সে কিছু না ভেবে, খুব আলতোভাবে এহসানের গায়ে তেল মাখিয়ে দিতে শুরু করে। এহসান চোখ বন্ধ করে বসে থাকে, সে তার প্রিয় নারীর হাতের স্পর্শে এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছে। এমন শান্তিই তো তার প্রয়োজন ‘!
আধ ঘণ্টা পর, যখন মেহনূর এহসানের শরীর মালিশ শেষ করে, তখন এহসান চোখ খুলে বলে,
— “হয়েছে, হয়েছে। এখন যা, নিচ থেকে খাবার নিয়ে আয়!”
মেহনূর নিঃশব্দে তেলের বোতলটি রেখে নিচে চলে আসে। নিচে পৌঁছতেই, আয়শা বেগম তাকে দেখে বলেন,
— “কোনো প্রয়োজন মেহনূর?”
মেহনূর মাথা নিচু করে বলে,
— “এহসান চাচার জন্য খাবার নিয়ে যেতে বলেছেন।”
আয়শা মুচকি হেসে বলেন,
— “স্বামী হয় , তোমার চাচা নয়। এতে পাপ হবে এভাবে বল না।”
মেহনূর মাথা তুলে বিষাদময় হাসি দিয়ে বলে,
— “পাপ হবে না, কারণ আমি উনায় স্বামী হিসেবে মানি না, আর মানার কোনো কথাই উঠে না।”
আয়শা বেগম মেহনূরের গালে হাত রেখে হতাশ গলায় বলেন,
— “বুঝেছি আমি তোমার অবস্থা। আচ্ছা, আমি খাবার প্লেট নিয়ে দিচ্ছি, তুমি নিয়ে যাও।”
মেহনূর ধীর পায়ে খাবার প্লেট নিয়ে কক্ষে চলে আসে। কক্ষে ঢুকে দেখে, এহসান এখনও খালি গায়ে বসে ফাইল পড়ছে, শুধু লুঙ্গি পরিহিত। মেহনূরের মনে এক ধরনের অস্বস্তি হয়। তাকে এভাবে বারবার দেখে লজ্জা লাগছে।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, মেহনূর খাবারের প্লেট এহসানের সামনে রাখে। এহসান তার দিকে তাকায়, কিন্তু ফাইল পড়তে থাকে।
আত্মার আগলে পর্ব ৭
— “নিন, খাবার।” মেহনূর বলে।
এহসান আবারও ফাইল পড়তে পড়তে বলে,
— “খাবার মুখে তুলে দে।”
এখন মেহনূরের ভীষণ রাগ হয়। ঘৃণা আরও একধাপ বাড়ে। কটমট করে বলে,
— “আল্লাহ হাত আপনায় দেননি? না কি হাত পাপে ঝলসে গেছে?”
এহসান শান্ত চোখে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে বলে,
— “হ্যাঁ, ঝলসে গেছে, তবে হাত নয়—অন্তর। আর তা পাপে নয়, তোর মহো মায়ায়।”
মেহনূর কিছু না বলে, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, তার হৃদয়ে এক অদ্ভুত অবস্থা, যতটুকু কষ্ট, ততটুকু রহস্যময় অনুভূতি।