আত্মার আগলে শেষ পর্ব
সানজিদা আক্তার মুন্নী
আকাশটা আজ বড় নরম।
সূর্যটা ঢলে পড়েছে পশ্চিমে, আলোটা আর তেমন তীব্র নয়—স্নিগ্ধ, শান্ত এক রঙ ছুঁয়ে যাচ্ছে চারদিক।
ছাদের এক কোণে চুপচাপ বসে আছে মেহরাজ।
কোল জুড়ে মেহরুব এর এক বছরের ছোট্ট ছেলে—মেহরাব।নরম ত্বক, গভীর চোখ—চেনা মুখশ্রী।দেখলেই বুকটা কেঁপে ওঠে তার।
মেহরাজ তাকিয়ে থাকে সামনে।
যেখানে বিকেলের রোদে চারটি শিশুমন দৌড়াচ্ছে প্রাণপনে।
তার চার বছরের জমজ ছেলে এহবাব ছিদ্দিক মুসা আর মাহতাব ছিদ্দিক মাহবুব—দুই ভাই যেন ছোট্ট দুই ঝড়।
পাথরের টুকরো দিয়ে বানিয়েছে নিজেদের রাজত্ব।তাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে আঠারো মাসের ছোট্ট বোন মাহা—মাহা বিনতে মেহরাজ।পাথর কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে, আবার হেসে উঠছে কাকের মতো খিলখিল করে।
আরেক কোণে বসে আছে মেহরুবের প্রথম কন্যা—তিন বছরের নূজা, পুরো নাম নুজা বিনতে মেহরুব।চোখে উদাস নিরীক্ষা, কিন্তু ঠোঁটে হাসির ছায়া।সে শুধু চুপ করে বসে থেকেও আলো ছড়ায়।
চারটা প্রাণ…
চারটা নিঃশ্বাস…
আর সে—কোল জুড়ে মেহরাবকে আগলে, নিঃশব্দ পাহারাদার হয়ে বসে আছে।
আসরের নামাজের পর সে সোজা হাসপাতাল থেকে এখানে চলে এসেছে।
এই ছাদে বসে থাকাটা তার একটা পুরোনো অভ্যাস—
যখন ছোট বেলায় তার পাশে থাকত মেহরুব, কোলে থাকত মেহনূর।
আজ মেহনূর নেই…
কিন্তু তার ছায়াগুলো আছে।
মেহরাবের চোখে, নূজার চুলে, মাহার হাঁটায়…
সবখানে তারা ছড়িয়ে আছে।
সে চোখ বন্ধ করে মেহরাবকে বুকে টেনে নেয়।
কপালে আলতো চুমু খায়।একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বুক থেকে উঠে আসে তার ঠোঁট পর্যন্ত।
বাতাসে তখনও ভাসছে নূজা আর মাহার হাসির শব্দ।
আর সেই হাসির ভিতর সে খুঁজে ফেরে হারানো দিনগুলো…
ফিরে পাওয়ার নয়, তবু বুকের ভেতর কোনো এক আশার নাম হয়ে থাকে।
ছয়টি বছর কেটে গেছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শহর উল্টে তল্লাশি চালানো হয়েছিল সেদিনের পর থেকেই। মেয়র এহসান তালুকদার আর তাঁর স্ত্রী মেহনূরের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
পাবেই বা কী করে? এলি যে নিজ হাতে তাদের মাটিচাপা দিয়ে রেখেছে, সময়ের নিচে, নিরবতায়, নিঃশব্দ চিৎকারের ঘরে।
তালুকদারদের বাড়িতে আজও কেউ কেউ আশায় থাকে—
“একদিন হয়তো ফিরে আসবে এহসান আর মেহনূর… একদিন হয়তো দরজায় কড়া নাড়বে আমাদের হারিয়ে যাওয়া প্রাণগুলো…”
কিন্তু সে আশার আলোর কাছে বারবারই হেরে যায় সময়।
এহসানের বাবা-মা কেউ আর বেঁচে নেই।
এহসানকে না পাওয়ার যন্ত্রণায় একদিন হৃদয়ভাঙা হয়ে চলে যান এনিসা বেগম।
আর তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন পর মনিরুল সাহেবও পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেন নিঃশব্দে।
যে সমস্ত কালোবাজারি ব্যবসার সঙ্গে এহসান জড়িয়ে ছিলেন, সেগুলোর শেষ টানে জয়নাল আর হাসিব।
তাদের জানা হয়ে গিয়েছিল—
“এহসান আর নেই।”
তবুও ছোট তালুকদার বাড়ি আজও অপেক্ষায় থাকে মেহনূরের জন্য।
একটি অনাহুত অপেক্ষা… যার শেষ নেই, নেই কোনো শুরু।
এশা সবকিছু মেনে নিয়েছে ঠিকই,
তবে প্রিয় বান্ধবীকে হারানোর সেই তীব্র যন্ত্রণা—
তা কাউকে বোঝানো যায় না। বলা যায় না।
মেহরুব আর মেহরাজ প্রতিদিন ভুলে থাকার চেষ্টা করে তাদের ছোট্ট মেহনূরকে।কিন্তু রক্তের টান কি আর মুছে যায়?
তাদের হৃদয়ে এখনও সেই অনুরণন বাজে—
একদিন ফিরে আসবে সে…
একদিন…
তাহাজ্জুদের মুনাজাতে কত রাত যে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করেছে তারা—
“হে রব… আমাদের ছোট্ট পরীটাকে ফিরিয়ে দাও…”
মুস্তফা সাহেবও আর বেঁচে নেই।মনিরুল সাহেবের মৃত্যুর পর তিনিও চলে যান।এনিফা বেগম আছেন, তবে অসুস্থ।
শুধু মাজহারুল সাহেব এখনো মেয়ের সুখে কাতর হয়ে বোকার মত প্রতিদিন
বড় তালুকদার বাড়িতে এসে খোঁজ নেন—
“মেহনূর এসেছে?”
সেদিন ঈদের মার্কেট থেকে ফিরে তারা পেয়েছিল কেবল দুইজন কাজের লোক।
অনেক জিজ্ঞেস করেও কিছু জানতে পারেনি কেউ।
অনেক অনেক খোঁজা হয়েছিল সারা শহরের অলিতে গলিতে।
এহসানের লোকজন, পুলিশ, গোয়েন্দা—সবাই মিলে খুঁজেছে।কেউ পায়নি কোনো হদিস।
সেদিন হাহাকার তুলে কেঁদেছিল জনতা।
এহসান তালুকদারকে ফিরে পাওয়ার জন্য রাস্তায় আন্দোলন পর্যন্ত হয়েছিল।
কিন্তু… সব নিরর্থক।
কয়েক মাস পর সব থেমে যায়।শুধু তালুকদার পরিবারের হৃদয়ের ব্যথা থেমে থাকেনি।
এমরান এখন মেয়রের আসনে।ভাইয়ের সব হারাম কাজ-কর্ম গুঁড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।
যা হালাল ছিল, তা নিজ হাতে সামলাচ্ছেন দুই ভাই।
মেহরাজের চোখে পানি জমে আসে।
সে তো এমন করে কোলে বসিয়ে রাখত তার ছোট্ট মেহনূরকে!কথা তো ছিল—এখন তার ভাগ্নে-ভাগ্নী আসবে কোলে বসে হাসবে, খেলবে…
তবে কোথায় গেল তারা?
কেন হারিয়ে গেল এহসান তালুকদার আর তার ছোট বোন?
কেন ফিরল না তারা?
কেন?
মেহরাজ চোখ মুছে নেয় ধীরে, নীরবে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে একরাশ হাহাকার নিয়ে…
ঠিক তখনই এশা এসে দাঁড়ায় চায়ের কাপ হাতে।
চা এগিয়ে দিয়ে নিজের হাতে মেহরাবকে কোলে তুলে নেয়।
ছোট্ট গালে ঠোঁট ছুঁয়ে আদর করে বলে—
— “কত শান্ত আমার কলিজাটা। এমন শান্ত যদি আমার তিন আজাজিল হতো, কতই না ভালো হতো!”
মেহরাজ মুচকি হেসে বলে—
— “যেমন মা, তেমন তো হবে বাচ্চা।”
এশা চোখ রাঙিয়ে বলে—
— “নিজের দোষ আমায় দিচ্ছো? তোমার ছেলে-মেয়ে তো সব তোমার মতো হয়েছে!”
তারপর হঠাৎ থেমে যায়।
মেহরাজের চোখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে বুঝে যায়—সে কাঁদছিল।
প্রতিদিনই এটা হয়।
নরম স্বরে জিজ্ঞেস করে—
— “কাঁদছিলে মেহনূরের জন্য, তাই না?”
মেহরাজের বুকটা ধক করে ওঠে।
মেহনূরের নাম শুনলেই হৃদয়টা ছ্যাঁৎ করে ওঠে।
সে চোখের পানি ফেলে বলে—
— “রক্তের টান, তাই তো ভুলে থাকতে পারি না। মনে হয়, ও এখনো কোথাও আছে।”
এশা চুপ করে যায়।
নিজেও তো পুড়ে পুড়ে এক সময় নিঃশেষ হয়ে গেছে।
নিজেকে শক্ত করে বলেই—
— “.. كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ”
–মনে রেখো, আমাদেরও একদিন যেতে হবে
মেহরাজ হালকা কাঁপা গলায় বলে—
— “যদি অন্তত আমার বোনটার লাশটা দেখতে পেতাম…
তাও তো নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম।”
এশা মাহা আর নূজার দিকে তাকিয়ে বলে—
— “দেখো, তোমার মেহনূর আমাদের মাহা আর নূজার মাঝে বেঁচে আছে।
রব ওদের ঠিক ফুপ্পির মতো করে পাঠিয়েছেন আমাদের কোলজুড়ে।”
মেহরাজ এক চিলতে হাসে।
— “হ্যাঁ, একদম আমার ছোট্ট পরীর মতো… আমার এই দুই পরী।”
ঠিক তখনই নূজা চেঁচিয়ে ওঠে—
— “বড় আম্মু! বড় ভাইজান আমার পাথর নিয়ে নিচ্ছে! দিচ্ছে না!”
এশা মুখ ঘুরিয়ে বলে—
— “এহবাব আব্বু, দিয়ে দাও। ছোট বোন তো, কেন এমন করছো?”
এহবাব একটু মুখ ভার করে পাথরগুলো এগিয়ে দেয়।
— “নে, আর রাখব না তোকে। আমাদের সাথে খেল।”
নূজা পাথরগুলো হাতে নিয়ে হেসে বলে—
— “আমায় ছোট ভাইজান রাখবে!”
এশা হেসে মেহরাবকে বুকে জড়িয়ে ছাদ থেকে নামতে নামতে বলে—
— “সাহেব, ওদের নিয়ে নামুন। এখন ছাদে থাকা মানা।”
এশার আযানের ধ্বনি বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। আজ একটু তাড়াতাড়িই অফিস থেকে ফিরে এসেছে মেহরুব। ঘরের দরজায় পা রাখতেই কানে আসে চেনা কণ্ঠের কিছু কথাবার্তা—টুনির মা, অর্থাৎ নূরি, টুনিকে শাসাচ্ছে।
— “আজ আসতে দে তোর বাপ কে… দেখবি কী করি! উনি সব পাকের উস্তাদ! আমি হাজার বার বলেছি, যে মেয়ে কে মসজিদে নিয়ে যাবে না, না যাবেন না। পরে অভ্যাস হয়ে যাবে—তাহলেই তো হলো! এখন তুই মেয়ে মানুষ হয়ে কেনো রে মা মসজিদে যাবি? মেয়েরা ঘরে নামাজ পড়ে, মসজিদে না।”
নূজার ছোট্ট গলা কেঁপে ওঠে, কান্নায় ভেঙে পড়ে সে।
— “না… আম আমি বড় আব্বুর সাথে নামাজে যাব! ভাইজান রাও যাচ্ছে, আমিও যাব! আমি যাব!”
নূরি কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই দরজায় মেহরুব।
— “কি হয়েছে শুনি? কে কে বকা দেয় আমার আম্মু কে?”
হাতভর্তি অফিস ব্যাগ নামিয়ে রাখতেই চোখ পড়ে নূরির দিকে। সে তখন মেহরাবকে ফিডিং করাচ্ছিল। হঠাৎ স্বামীকে দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ে, আঁচলে নিজেকে ঢাকার চেষ্টা করে।
মেহরুব হালকা হেসে এগিয়ে যায়। নূজাকে কোলে তুলে নেয়ার সময় তাকায় নূরির দিকে।
— “আস্তাগফিরুল্লাহ! ছিঃ! তুই এখনও আমার সামনে এত লজ্জা পাস? আরে তুই দুই সন্তানের মা হয়ে গেছিস! তোর বাচ্চার বাপ আমি! যাকে খাওয়াচ্ছিস, সেও আমার দেওয়া! এত লজ্জা তুই কই থেকে পাস রে ফুল?”
নূরি থতমত খেয়ে যায়। সত্যি তো… কিন্তু মাথা নিচু করে শুধু বলে—
— “ওই না, আসলে…”
তার আগেই ঘুমন্ত মেহরাব কেঁদে ওঠে। ছোট্ট পিচ্চি মায়ের এই অহেতুক লজ্জার জন্য শান্তি পেল না। নূরি তাকে তুলে নেয় কোলে, শান্ত করে।
বিছানায় বসে মেহরুব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের দিকে। এটাই তো তার প্রাপ্তি, তার শান্তি।
নূরি মেহরুবের দৃষ্টিতে লজ্জায় লাল হয়ে যায়। হেসে বলে—
— “আপনার মেয়ে কে সামলান আগে। সবসময় আমার অবাধ্য হয়!”
মেহরুব মুচকি হেসে নূজার মুখের দিকে তাকায়—
— “তোমার আম্মু কি বলছে শুনি? তুমি নাকি আমার নূরি ফুলের কথা শুনো না?”
নূজা মাথা নিচু করে নেয়, একদম মায়ের মতো। তার সেই ভঙ্গিমা দেখে নূরি আর হাসি চাপতে পারে না। নূজা নরম গলায় বলে—
— “আপনার নূরি ফুল আমায় শুধু বকেন।”
মেহরুব হেসে তার ছোট্ট গালে চুমু খায়।
— “আমার নূরি ফুল এমনি। নিশ্চয়ই কিছু করেছো, তাই বকা খাও।”
নূরি একটু কড়া স্বরে বলে—
— “আপনার মেয়ে মসজিদে যেতে চায়। ইশার সময়ও। আর গিয়ে এহবাব আর মাহতাবের সাথে দুষ্টামি করে। নামাজ ফেলে দেয়!”
নূজা মাথা নিচু করে ফিসফিসিয়ে বলে—
— “আর এমন হবে না আব্বুর নূরি ফুল… আপনি আমায় যেতে দিন মসজিদে।”
নূরি এবার উঠে দাঁড়ায়। কণ্ঠ কঠিন—
— “আমি বলেছি যখন না, তখন না। তুমি এখন থেকে ঘরে নামাজ পড়বে।”
তারপর মেহরুবের দিকে তাকিয়ে হুঁশিয়ারি দেয়—
— “আর আপনি যদি ওকে নিয়ে যান মসজিদে, তাহলে দেখবেন আমি কি করি।”
মেহরুব হাসে। চোখে একরকম ঘায়েল দৃষ্টি।
— “তুই দেখাতে চাইলে এই মুহূর্তেই দেখাতে পারিস। আমার কোনো আপত্তি নেই।”
নূরি রেগে গিয়ে বলে—
— “দুই বাচ্চার বাপ আপনি! একটু মুখে লাগাম দিন! তাড়াতাড়ি গোসল করে নিন, খাবার দিচ্ছি।”
মেহরুব হেঁসে উঠে শুধু বলে—
— “জ্বি, হুকুমের দাস আমি।”
নূরি মুখে রাগ, চোখে লজ্জা, আর ঠোঁটে একটা লুকোনো হাসি নিয়ে মেহরাবকে কোলে তুলে নেয়। আর মেহরুব নূজাকে পাশে বসিয়ে আলতো করে বলে—
— “চলো মা, আমরা এখন ইশার নামাজ পড়ি… আব্বু আর আব্বুর নূরি ফুলের নূজা একসাথে।”
ঘরে নরম আলো জ্বলছে। এশা বিছানায় বসে মাহাকে ঘুম পাড়াচ্ছে। ছোট্ট মেয়েটা মায়ের বুকে মাথা রেখে ধীরে ধীরে চোখ বুজে আনছে। এদিকে মেঝেতে বসে খেলায় ব্যস্ত এহবাব আর মাহতাব। পুতুল ঘর আর টেডি নিয়ে দুই ভাইয়ের যুদ্ধ যেন থামছেই না।
বিছানার গায়ে বসে আছে মেহরাজ। এক হাতে কোলবালিশ, অন্য হাতে দুষ্টুমি। সে বারবার এশার পায়ের তালুতে কাতুকুতু দিচ্ছে।
— “কি হলো? এমন করছ কেনো? সবসময় আমায় জ্বালাও কেনো?”
বিরক্তিতে চোখ তুলে তাকায় এশা।
মেহরাজ দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে ঘরের চারদিকে তাকায়। তারপর নরম গলায় বলে—
— “ভাবছিলাম… আরেকজন প্রয়োজন এই ঘরে। তুমি যদি রাজি হও, তবে চল—আরও একটা ছোট্ট বাচ্চার বাপ…”
এশা চট করে উঠে পড়ে।
— “মেহরাজ! বাচ্চাদের সামনে উষ্টা খেতে না চাইলে মুখ আর হাত সাবধানে রাখো!”
মেহরাজ হেসে উঠে, হাসির ফাঁকে বলে—
— “তোমার উষ্টা খেয়েও তো তোমায় তিনটা বাচ্চার মা বানিয়ে ফেলেছি। সমস্যা কি, আরও কয়েকটা উষ্টা খেয়ে আরেকটা নিয়ামতের অধিকারি হলে?”
এশা মুখ চেপে হাসে। কী করবে এই লোকটাকে নিয়ে? সবসময় এত বেসামাল! এমন হঠাৎ হঠাৎ কথা বলে যে রাগ না হেসে থাকা যায় না।
সে চোখ টিপে এহবাব আর মাহতাবকে ডাকে—
— “এই যে নবাব সাহেবরা! চুপচাপ চলে আসো বিছানায়। সারাদিন খেলেছো, ঘুরেছো। এখন ঘুমুতে যাও।”
মাহতাব মুখ নিচু করে বলে—
— “জ্বি আম্মু।”
মেহরাজ উঠে দাঁড়ায়। দুই ছেলের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে—
— “চল, আজ তোমাদের ওযু করিয়ে নেই। তোমাদের আম্মু তো শুয়ে আছেন।”
পিছন থেকে এশা বলে ওঠে—
— “আচ্ছা শুনুন, ওদের মিসওয়াক দিয়ে ওযু করাবেন—এমনি করাবেন না।”
মেহরাজ চোখ টিপে বলে—
— “হুমম, মিসওয়াক সহই করাবো, হুকুমের বাইরে যাওয়া যাবে না তো!”
অতঃপর, দুই ছোট্ট ছেলে—এহবাব আর মাহতাব—বাবার হাত ধরে ওযুখানার দিকে পা বাড়ায়।
ঘরটা আবার নিস্তব্ধ। মাহা মায়ের বুকের কাছে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর এশা বিছানায় বসে চুপিচুপি হাসছে—একটা গোটা জীবন তার পাশে এমন বেসামাল একজন পুরুষ নিয়ে যেন প্রতিটা রাত একেকটা গল্প হয়।
নূজা আর মেহরাব ঘুমিয়ে গেছে।
বেলকনির ঠাণ্ডা বাতাসে আধো আলোয় নীরবতা ছড়িয়ে আছে চারপাশে।
নূরি আধশোয়া হয়ে বসে আছে সোফায়।
ওর বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে মেহরুব।
কিন্তু মেহরুবের মন ভারে ভরা।
মাজহারুল সাহেব আজও গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে এসেছেন বড় তালুকদার বাড়িতে। মেহনূরের আশায়!
মেহরুব নিজেই নিয়ে এসেছিল তার আব্বাকে।
তবুও কোনো সান্ত্বনা নেই কোথাও।
নিজেই জানে না কীভাবে সান্ত্বনা দেবে তার নিজেকে বাবা কে কি দেবে।
সে নিজেই তো নিজের ক্ষত শুকাতে পারে না…
তার বোন মারা গেছে না কি নিখোঁজ?
লাশ নেই, খবর নেই…
তবে কি বেঁচে আছে?
কোথায় আছে? কার কাছে আছে?
নীরবতা ভেঙে নূরি ওর চুলে আঙুল চালিয়ে বলে—
— “চিন্তা করবেন না… আমি আশা রাখি তারা যেখানে আছেন, ভালো আছেন, একসাথে আছেন!”
মেহরুব মাথা নেড়ে উত্তর দেয়—
— “আমিও আশা রাখি… কারণ আমি জানি, এহসান তালুকদার নিজের প্রাণের গায়ে আঁচর লাগতে দেবে না।”
নূরি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
— “হুমম…”
মেহরুবও হাত বাড়িয়ে নূরির মাথায় হাত রাখে, বলে—
— “আমায় সবসময় সাহস দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ, নূরি ফুল… ধন্যবাদ।”
নূরি ওর কপালে চুমু খায়।
— “আমি সবসময় আছি, আপনার সাথে…”
মেহরুব ধীরে ধীরে মুখ তুলে ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়।
নূরি চোখ বুজে নেয়।
তারপর মেহরুব উঠে যায় ঘরের দিকে।
নূরিও উঠে বসে নিজেকে গুছিয়ে নেয়।
তবুও তার মনে একটা অস্বস্তি, একটা কথার বোঝা।
নীরবতা ভেঙে ও ডাক দেয়—
— “ম… ম… মেহরুব ভাই!”
‘ভাই’ শব্দটা শুনে মেহরুব দাঁত চেপে ঘুরে তাকায়।
চোখে একরাশ অভিমান, কণ্ঠে বিষাদ—
— “তোর বাচ্চারা আমায় বাপ না ডেকে মামা ডাকবে বলিস? আমি তো তোর ভাই… তাই না?”
লজ্জায়, অপরাধবোধে নূরি নিজের মুখে নিজের থাপ্পড় মারে।
— “সরি মেহরুব… মম… আমার একটা কথা বলার ছিল…”
ওর গলা শুকিয়ে আসে।
কী বলবে বুঝে ওঠে না।
অবশেষে উঠে দাঁড়ায়।
মেহরুব তাকিয়ে থাকে।
এই মেয়েটা এত ভীতু কেন?
নূরি সামনে এসে দাঁড়ায়।
চোখ বন্ধ করে বলে—
— “আপনি… আপনি আবারও নিয়ামতের অধিকার হতে যাচ্ছেন।”
মেহরুব থমকে যায়।
কণ্ঠ কাঁপে—
— “ত… তুই প্রেগন্যান্ট?”
নূরি মাথা নাড়ে।
— “হ্যাঁ… অনেকবার টেস্ট করেছি।”
মেহরুব খুশিতে মুখ চাপা দেয়।উচ্চারণ করে
“اللهم ارزقني الذرية الطيبة”
তারপর নূরির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওর পেটে কান লাগিয়ে বলে—
— “নূরি ফুল… তোকে তোকে অনেক অনেক ধন্যবাদ… আমায় আবারও নতুন করে ‘বাবা’ ডাক শোনার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।”
নূরি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে—
— “সব তো ঠিক আছে… কিন্তু আমাদের মেহরাব তো ছোট… আমাদের উচিত হয়নি এখন…”
মেহরুব ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে—
— “আল্লাহ যখন প্রাণ দেন, তখন বাঁচার সব ব্যবস্থাও দেন, নূরি ফুল। সব আল্লাহর রহমত।”
নূরি মুচকি হাসে।
মেহরুব ওকে নিয়ে আবার বসে যায় সোফায়।
নূরি বলে—
— “সবাইকে বলব?”
মেহরুব ওর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়—
— “হুম… আগামীকাল মিষ্টি বা খেজুর এনে সবাইকে বলব।”
নূরি মেহরুবের বুকে মাথা রাখে।শান্তি খুঁজে পায়।
কয়েক মুহূর্ত কেটে যায়।
হঠাৎ নূরি বলে—
— “একটা সত্যি কথা বলি আপনাকে?”
মেহরুব বলে—
— “হুম।”
নূরি ওর বুক থেকে মাথা তুলে দাড়িতে আঙুল বুলিয়ে দিয়ে বলে—
— “আমাদের বিয়ের মানে… প্রথমবার বিয়ের আগে… আমি আপনাকে ভালোবাসা নিবেদন করতে নিচ্ছিলাম… বোকার মতো বান্ধবীদের উৎসাহে…”
মেহরুব ভ্রু কুঁচকে বলে—
— “তারপর করলি না কেনো? দিতাম দু-একটা থাপ্পড়!”
নূরি মুখ বাকিয়ে বলে—
— “এইয়া! এসেছেন থাপ্পড় মারতে! আপনাকে নিবেদন করলে থাপ্পড় দিতেন?”
মেহরুব ওর গালে দাঁত বসিয়ে দেয়।
— “করলি না কেনো বল?!”
নূরি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—
— “আমি সেদিন এক ওয়াজে শুনেছিলাম, যে নারী হারাম সম্পর্কে জড়ায়, কেয়ামতের দিন তার বুকের স্তনের মাঝে পেরেক মেরে ঝুলিয়ে রাখা হবে।”
ভয়ানক কথা শুনে মেহরুবের শরীর কেঁপে ওঠে।
নূরির গায়েও ঠাণ্ডা শিহরণ।
নূরি বলে—
— “এরপর থেকে আমি আপনার দিকে তাকানোও হারাম মনে করতাম। আল্লাহর দরবারে তওবা করেছিলাম। কিছুদিন পরই তো আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল…”
মেহরুব মুচকি হেসে নূরির গলায় মুখ গুঁজে দেয়।
নূরি হেসে ওঠে…
এলি এখন মার্কিন জেলে পচছে। এহসানদের হত্যার পর সে নিজের দেশে ফিরে এসেছিল। দেশে ফিরে সে আবারও ড্রাগ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ল, যা সে আগেই করত। সে এক একটি গ্যাংয়ের সাথে যুক্ত হয়ে এই অন্ধকার জগতে পা রাখে। কিন্তু দুই বছর পর একটি ডিলের সময় সে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। এখন সে মার্কিন জেলের অন্ধকারে, যেখানে প্রতিটি দিনই এক অনবরত যন্ত্রণার মতো। মার্কিন জেলগুলো এমনই, যে সেখানে মানুষ শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও ধ্বংস হয়ে যায়। এলির জন্য জেল এখন এক নরক, যেখানে সে তার অপরাধের শাস্তি ভোগ করছে।
শেষপাতা~📜
অবশেষে, সবাই নিজ নিজ জীবনে ফিরে গেছে। পূর্ণতায়,।সবাই পূর্নতা পেল”!
এহসান আর মেহনূর?
তারা এখন একসাথে ঘুমিয়ে আছে—নীরব এক কবরে।
শান্তিতে না আজাবে—তা একমাত্র রাব্বুল আলামীনই জানেন।
এহসান আর মেহনূর পেল পূর্নতা,, এক শ্রেষ্ঠ পূর্নতা “!
এইভাবেই শেষ হলো আমাদের তিন-চার মাসের এক ক্ষণিক যাত্রা।
এই অল্প সময়ের পথচলায় আমি পেয়েছি আপনাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা, স্নেহ আর মমতা।
একজন ক্ষুদ্র, তুচ্ছ লেখিকা হয়েও, আমি অনুভব করেছি একজন গল্পকারের প্রাপ্তি—আপনাদের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার সেই অদৃশ্য স্বীকৃতি।
আমি দুঃখিত—হয়তো এহসান আর মেহনূরের গল্পে সেই কাঙ্ক্ষিত পূর্ণতা এনে দিতে পারিনি।
তবুও আপনারা ছিলেন, ছিলেন গল্পের প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে।
তাই মন থেকে—
ধন্যবাদ।
আবারও ধন্যবাদ।
অসংখ্য, অফুরন্ত ধন্যবাদ।
আমার হাতের লেখা কাঁচা, ভুলে ভরা—জানি।
তবুও আশাবাদী, আপনারা ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন।
গল্পের প্রয়োজনে হয়তো আপনাদের অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে, কখনো হয়তো আচরণে কোথাও কষ্ট দিয়েছি।
আমায় মাফ করে দেবেন। সত্যিই।
এই গল্প একদিন শেষ হতোই।
তবু যে এতজন পাশে ছিলেন—এই সৌভাগ্যটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।আপনারা ছিলেন বলেই আমার গল্প বেঁচে ছিল।
আল্লাহ যদি তাওফিক দেন,
নতুন কোনো ভোরে,নতুন কোনো গল্পে,নতুন ভালোবাসায়—আবার দেখা হবে।
আত্মার আগলে পর্ব ৫৩
ইতি…
আপনাদের নিজের মানুষ,
আপনাদের এক তুচ্ছ লেখিকা।
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু