আদিল মির্জা’স বিলাভড পর্ব ১৩

আদিল মির্জা’স বিলাভড পর্ব ১৩
নাবিলা ইষ্ক

এলেন সবসময় দেখে এসেছে, জেনে এসেছে আদিল মির্জা যা চায় তা আদায় করে নেয় —বাই হুক ওর বাই ক্রুক। তাই দেরি করে হলেও যখন এলেন বুঝতে পেরেছে তার বস মিস রোযাকে চাচ্ছে, তার মনে হয়েছে মিস রোযা ভালোয়-ভালোয় না মানলে সোজা তুলে নিয়ে আসা হবে। প্রয়োজনে আটকে রাখা হোক। দিনশেষে বস যেই নারীকে খুব করে চাচ্ছে, তাকে হাতের খুব কাছে রেখে এমন উপোস থাকার তো কোনো কারণ নেই। এতো ভাবাভাবির কি কিছু আছে এখানে? কেনো তার বস অপেক্ষা করে থাকবে? সিসিটিভি ফুটেজে কিংবা লুকোচুরি করে দেখবেই বা কেনো? তুলে আনলেই তো হয়।

আদিল মির্জা চেয়েছে আর তা সে পায়নি, এমন কী কখনো হয়েছে? হয়নি। তো?
কদিন ধরে মাথায় ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নটি আজ কেমন মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো! মুখটা কি শান্তকে অনুসরণ করছে?
এলেন আড়চোখে তাকাতেই দেখল শান্ত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। কিছুটা সরেও দাঁড়িয়েছে তার থেকে! দাঁতটা কিড়মিড় করে উঠল এলেনের। এযাত্রায় আদিলও ফিরে তাকিয়েছে। মুহুর্তে বেচারা সতর্ক হয়। বসের গভীর দৃষ্টির সামনে নির্বিকার থাকার চেষ্টা করে যায়। আড়চোখে নজর রাখছে আদিলের হাত দুটোর ওপর। তাদের ওপর রাগলেই প্যান্টের বেল্ট দিয়ে মা রার মতন অঘটন অনেকবার ঘটিয়েছে। আবার না ঘটায়! তবে তেমন কিছুই হলো না। আদিল পুনরায় মাথা ঘুরিয়ে দৃষ্টি বাগানে রেখেছে। এতক্ষণ যাবত গলায় শ্বাস আটকে ছিলো এলেনের। এযাত্রায় আটকে রাখা শ্বাসটুকু ফেলল। তখুনি আদিলের শান্ত, ধীর স্বর শোনা গেলো –

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘লেট’স টেক ইট স্লো!’
শান্ত হকচকিয়ে উঠল। তখুনি জিজ্ঞেস করতে মন উতলা হলো –
‘হোয়াট ইউ ওয়ানা টেক ইট স্লো, বস?’
তবে সাহস হলো না। এলেনও আর একটি টু-শব্দও করেনি। তার শুধু চোখে ভাসছে বসের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। কবে যেন বস তার গলাটা টিপে ধরে! ভবিষ্যতে মুখ সামলে কথা বলতে হবে। ওসময় আদিলের ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা সোফার সামনের টি-টেবিলের ওপরে ছিলো। এলেন গিয়ে ফোন এনে বাড়িয়ে ধরল। তাকালোও না স্ক্রিনের দিকে। অথচ শান্ত ঘাড়টা কাত করে ঠিকই দেখে নিয়েছে। কল করেছে ম্যানেজার আনোয়ার খন্দকার। নামটা দেখেই তার চোখমুখ কুঁচকে এলো।

আদিল না ফিরেই বাড়িয়ে ধরা ফোনটা হাতে নিলো। রিসিভ করে কানে ধরল। দৃষ্টি তখনো বাগানেই। মিহি বাতাসে দুলছে মিস রোযার চুল। সেই চুল এলোমেলো ভঙ্গিতে কানের পেছনে গুঁজে দু-হাঁটু ভেঙে বসেছে ঘাসের ওপর। সূর্যের আলোটা তীক্ষ্ণ না এইমুহূর্তে। ভীষণ মিষ্টি করেই ছুঁয়েছে সুন্দর মুখখানি। তিতান আর থোরের সাথে আহ্লাদ করে হাসতে থাকা তাকে আর হৃদিকে অন্যরকম লাগছে। ওপাশে ম্যানেজার আনোয়ার কী বললশোনা গেলো না। তবে অনেকটা সময় নিয়ে আদিল আওড়াল –
‘শুড আই কাট হিজ লিটল ব্রাদার? ঘ্যাচাং! ঘ্যাচাং!’
শান্ত কান খাঁড়া করে শুনতে চাচ্ছিল ওসময়ে আদিল পুনরায় বলল –
‘দেখি —হোয়াট ইজ হি আপ টু’
আদিল হাত নাড়িয়ে ইশারা করশান্ত আর এলেন বেরিয়ে এলো। শান্ত অবশ্য অনেকটা অনিচ্ছুক ভাবেই বেরিয়ে এসেছে। দরজার কাছে স্বপন দাঁড়িয়ে আছে। শান্তর আঁকাবাঁকা মুখের অভিব্যক্তি দেখে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে –

‘কী হয়েছে?’
শান্ত আওড়ায় আনমনা, ‘বসের ময়ে ময়ে হয়ে গেছে।’
স্বপন হতবিহ্বল, ‘বসের ময়ে ময়ে?’
তখুনি আদিলের গম্ভীর কণ্ঠের ডাক পড়ে, ‘শান্ত!’
শান্ত আঁতকে ওঠে। ঘাবড়ে যায়। বস কী শুনে ফেলেছে? ও মাই গড!! এলেন দাঁতে দাঁত পিষে চাপা গলায় বলে-
‘এবার তোর ময়ে ময়ে হয়ে যাবে।’
শান্ত কয়েকবার ধীর গলায় ‘না – না – না’ করতে করতে ভেতরের দিক এগুচ্ছে।

মরিয়ম বেগম যখন লাঞ্চের ট্রলি ঠেলে রুমের ভেতরে প্রবেশ করলেন, শুনতে পেলেন ওয়াশরুম থেকে ভেসে আসা হাসির আওয়াজ। হৃদির প্রাণোচ্ছল হাসির আওয়াজ রীতিমতো প্রতিধ্বনি তুলছে। মরিয়ম বেগমের দৃষ্টি নরম হয়ে আসে। মিষ্টি করে হাসতে হাসতে টি-টেবিলের ওপর লাঞ্চ পরিবেশন করতে থাকলেন।
ওদিকে রোযা অসহায়। হৃদিকে গোসল করাতে নিলেই ভীষণভাবে মুশকিলে পড়তে হয় তাকে! বাচ্চাটা এতো দুষ্টুমি করে! তারওপর আজ একটু বেশি করছে। গতকাল সে আসেনি বলেই বুঝি এমন প্রতিশোধ নিচ্ছে মেয়েটা? অসহায় হয়ে এবারে ওর চঞ্চল হাতদুটোকে থামাতে দ্রুতো বড়ো তোয়ালে দ্বারা পুরো ওকেই পেঁচিয়ে নিলো। পেঁচিয়ে কোলে তুলে নিলো ঝটপট। এনে রাখল নরম বিছানার ওপর। হৃদি দু-পা ভাঁজ করে বসেছে। ওর গায়ে গোলাপি রঙের বাথরোব। ভেজা চুলগুলো হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকাতে শুরু করেছে রোযা। ওসময়ে হৃদি হাপুস চোখে চেয়ে ধীরে প্রশ্ন করল –

‘স্নো-হোয়াইট, আর ইউ ফরগেটিং সামথিং?’
হেয়ার ড্রায়ারের তুমুল আওয়াজের মধ্যেও প্রশ্নটি স্পষ্ট শুনতে পায় রোযা। অবুঝের মতো নিজের কাজে ব্যস্ত থেকেই জবাবে বলে –
‘না তো। কী ভুলব?’
হৃদিআগ্রহী চোখে চেয়ে থেকে আরও দৃঢ়ভাবে ফের বলে, ‘মনে করার চেষ্টা করো।’
রোযা ভাবার অভিনয় করল কিছুক্ষণ। হৃদির চকচকে দৃষ্টির সামনে পুনরায় অসহায়ভাবে মাথা নাড়িয়ে বলল –
‘কিছুই তো মনে পড়ছে না! কী ভুলে যাচ্ছি আমি?’
হৃদির উজ্জ্বল মুখটা মুহূর্তে মিইয়ে গেলো কেমন। ওই মিইয়ে যাওয়া মুখটা একমুহূর্তের জন্যও সহ্য করতে পারল না রোযা। তৎক্ষণাৎ হেয়ার ড্রায়ার বন্ধ করে রাখল পাশেই। দ্রুতো হৃদির নাদুসনুদুস মুখটা আলতোভাবে দু-হাতে নিয়ে আদর করে দিয়ে বলল –

‘আমার প্রিন্সেসের জন্মদিন আমি কীভাবে ভুলতে পারি? হুম? সম্ভব?’
হৃদি শব্দ করে হেসে ওঠে। রোযার কোমর জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতেই বলে –
‘আমি জানি তোমার মনে আছে। আমিতো অভিনয় করছিলাম। আর তুমি বিশ্বাসও করে নিয়েছো! হাউ সিলিইই।’
রোযার চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে এলো। মিছিমিছি রাগ দেখিয়ে —পরমুহূর্তেই দু-হাতে কাতুকুতু দিতে শুরু করল। বিপরীতে হৃদি হাসতে হাসতে বিছানায় লুটিয়ে পড়েছে। চুলগুলো শুকিয়ে পাখির বাসা হয়ে আছে। ক্রমান্বয়ে মাথা নাড়িয়ে বোঝাচ্ছে, আর কাতুকুতু দিতে না। রোযাও আর দেয় না। বাচ্চাদের অতিরিক্ত হাসাতে নেই। আপাতত ওকে লাঞ্চ করিয়ে ঘুম পাড়াবে। হৃদি ঘুমিয়ে পড়লে সে একটা বই পড়বে বলে ভেবে রেখেছে। কাঁধ ব্যাগে বইটা কি রাখ হয়েছিল? খেয়াল আসছে না।

মাগরিবের আজান পড়েছে। হৃদির ঘুম ভাঙেনি এখনো। বাচ্চাটার বুঝি রাতে ঘুম হয়নি? হাতের বইটা রেখে রোযা উঠে দাঁড়াল। বিছানার কাছাকাছি এসে দেখল হৃদি ঘুমে বেহুশ প্রায়। ওঠার নামগন্ধ নেই। মরিয়ম বেগম নাস্তা নিয়ে কিছুক্ষণ আগে একবার এসেছিলেন। হৃদি ঘুমাচ্ছিল বলে ফিরে গিয়েছেন। এযাত্রায় ওর ঘুম না ভাঙালে রাতে মোটেও ঘুমাতে পারবে না। অগত্যা ইচ্ছের বিপরীতে গিয়েই হৃদিকে তুলতে আদুরে গলায় ডাকল। প্রথম ডাকে সাড়াশব্দ না করলেও দ্বিতীয় ডাকে ঠিক চোখ মেলে তাকাল। ঘুম থেকে উঠলে ওর মনমেজাজ ভালো থাকে না কিছুক্ষণ। ওসময়টা রোযার কোলে ঘাপটি মেরে ঝিমুতে পছন্দ করে। আজও তাই! কিছুক্ষণ হৃদিকে কোলে নিয়ে পায়চারি করে এগুলো ওয়াশরুমের দিকে। ফ্রেশ করিয়ে, চুল বেঁধে পরিপাটি করে নিয়ে বেরুলো রুম ছেড়ে। মরিয়ম বেগম তাদের দেখে ডাইনিংয়ে নাস্তা পরিবেশন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

রোযা আড়চোখে আশপাশটা ভালোভাবে দেখে নিলো। দুয়ারের দুটো বডিগার্ড ব্যতীত কাউকে দেখা যাচ্ছে না। যাক! শান্ত আর এলেনকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না অর্থাৎ এইমুহূর্তে আদিল মির্জা বাড়িতে নেই। ওরা নেই মানে আদিল মির্জাও নেই। রোযা কোনোভাবেই ওই লোকটার সামনে পড়তে চায় না। আজকের সকালের একটা বিষয় তাকে এখনো অপ্রস্তুত করছে। অনিচ্ছুক, অজানা ঘটনা! অথচ কেমন খারাপ প্রভাব ফেলেছে তার ওপর! নাকি রোযাই বেশি বেশি ভাবছে?
‘বডিগার্ড আংকেল, ড্যাডি কোথায়?’
ক্লান্ত দুয়ারেই দাঁড়িয়ে ছিলো সৈনিকের মতো। হৃদির প্রশ্নে কণ্ঠ নরম করার চেষ্টারত বলল –
‘বস তো বেরিয়েছেন। কোনো প্রয়োজন প্রিন্সেস? টেল মি।’
হৃদি মাথা নাড়িয়ে বোঝাল, কোনো প্রয়োজন নেই। ও ফিরে গিয়ে বসল রোযার কোলে। টেলিভিশন চলছে ডিজনিল্যান্ড। হৃদি মন দিয়ে তাই দেখছে। পাশাপাশি রোযার হাতে নাস্তাও করে নিচ্ছে।

বেশ রাত করে ফেরা হয়েছে রোযার। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে বারোটায়। বাড়িতে প্রবেশ করতেই তার চোখ কপালে উঠে এলো প্রায়। লিভিংরুমে জিহাদ বসে আছে। চোখমুখ ফোলা। মুখের বাম পাশ নীল হয়ে আছে। রোযা আঁতকে ওঠে। ছুটে গেলো ভেতরে। আর্তনাদ করে উঠল –
‘কী হয়েছে? তোমার এই অবস্থা কেনো? মারামারি করেছো?’
নিপা বেগম কাপড়ে বরফ পেঁচিয়ে ধরে রেখেছেন জিহাদের গালে। জিহাদ দুর্বলভাবে পড়ে আছে সোফার এককোণে। রোযার প্রশ্নে কোনোরকমে জবাবে বলল –

‘চৌরাস্তার মাথায় অটোর জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ কয়েকটা গাড়ি ঘিরে ধরল আমাকে। কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো কথা নেই, কিচ্ছু নেই। কয়েকজন বেরিয়ে এসে আমাকে মে রে চোখের পলকে চলে গেলো।’
রোযা হতবাক। এও সম্ভব? কারণ ছাড়া এমন করে কেউ? কাঁধ ব্যাগটা সোফায় ফেলে এগুলো। নিপা বেগম কাপড়ে মোড়ানো বরফটা তার হাতে দিয়ে উঠে রান্নাঘরের দিকে ছুটল। তার জায়গায় রোযা বসে বরফ হালকা করে চেপে ধরল জিহাদের গালের নীল হয়ে আসা স্থানে। ছেলেটা মুহূর্তে মৃদুস্বরে আর্তনাদ করল। ব্যথায় জর্জরিত পুরো শরীর। রোযা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে –

‘গাড়ির নাম্বার মুখস্থ করেছো? হুদাই কেনো এসে মে রে পালাবে? তুমি কারো সাথে লেগেছো?’
জিহাদ কারো সাথে লাগেনি। নিজের জ্বালাতেই তো সে বাঁচে না। অন্যদের নিয়ে ঝামেলা করার সময় কোথায়? আর তারওপর সে তো মূল কথাটাই বলতে পারল না কাউকে। এসব আবার বলা যায়? কীভাবে বলবে যে, ওই লোকগুলো চাকু দিয়ে তার লিটল ব্রাদারকে কাটতে চাচ্ছিল? দেশে কি নতুন স ন্ত্রাস নেমেছে? যারা পুরুষদের ছোটো ভাইকে কে টে নিয়ে যায়? সকালেও তো সে সংবাদপত্র পড়ল। এমন কোনো সংবাদ তো চোখে পড়ল না।

আদিল মির্জা’স বিলাভড পর্ব ১২

জিহাদ বোধহয় ভয়ে কিছুদিন বেরুতেই পারবে না ঘর ছেড়ে। চোখ বুজলেই ওই দৃশ্য চোখে ভেসে উঠছে। আতঙ্কে তার ঘুমও হবে না মনে হচ্ছে। আর আর, বিশেষ করে ওই লোকটা –যে খুব শেষের দিকে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। এসেই সোজা কেমন তার ওখানটায় পাড়া দিয়ে ধরল! কে ছিলো লোকটা? কারা ছিলো? কাদের নজর কাড়ল সে? চিন্তায় জিহাদের দুটো চুল পেকে গেছে। এই কী মসিবত! এমনিতে কী কম মসিবত আছে?

আদিল মির্জা’স বিলাভড পর্ব ১৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here