আদিল মির্জা’স বিলাভড পর্ব ৩

আদিল মির্জা’স বিলাভড পর্ব ৩
নাবিলা ইষ্ক

রোযার বিশ্রীভাবে সংকোচবোধ হচ্ছে। কেনো হচ্ছে? কোনোভাবেই মনের এই খচখচে অনুভূতি দূর করা যাচ্ছে না। যতো সে এগুচ্ছে, ততো যেন মনের অস্বস্তি বেড়ে চলেছে। হৃদির রুমের সামনে শান্ত দাঁড়িয়ে পড়ল। হাত নাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশের ইশারা করল। রোযা কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থাকল। বড়ো করে দম নিয়ে স্বাভাবিক হলো। অবশেষে পা বাড়াল ভেতরে। অন্ধকার রুমে হলদে ড্রিমলাইট জ্বলছে। যার মৃদু আলোয় বোঝা যাচ্ছে, আদিল মির্জা সোফায় বসে আছে। তার ঊরুতে হৃদি মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। রোযা মাথাটা নুইয়ে এসে দাঁড়াল সোফার থেকে খানিকটা দূরে। আড়চোখে দেখল আদিল ডানহাতে হৃদির মাথা বুলিয়ে চলেছে। বাম হাতটা সোফার হাতলে এলিয়ে রাখা। তার দৃষ্টিও নিজের মেয়ের মুখের ওপর আবদ্ধ। রোযা দৃষ্টি নামিয়ে যথাসম্ভব কণ্ঠ নামিয়ে সালাম জানাল –

‘আসলামু আলাইকুম, স্যার।’
আদিল চকিতে তাকাল। মৃদু আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল না অদূরে দাঁড়ানো নারীর মুখ। অথচ আদিলের চোখের পাতায় এখনো তখনকার ওই দুঃসাহসিক কাণ্ডের দৃশ্য ভেসে বেড়াচ্ছে। তেজস্বিনী কণ্ঠে বলা কথাগুলো, ধারালো চোখের দৃষ্টি, বুকের দিকে তাঁক করে রাখা পিস্তল ধরা হাত। সোফার হাতলে রাখা আদিলের হাতটা দুটো চুটকি বাজাতেই দুয়ারে দাঁড়ানো শান্ত ভেতরে এলো।
‘বস!’
‘রুমের সবগুলো লাইট জ্বালিয়ে দে।’
রোযা সামান্য হকচকাল। এমনই তো ভালো ছিলো। লাইট জ্বালানোর কী প্রয়োজন? শান্ত দ্রুতো হাতে লাইটের সুইচ গুলো টিপে দিয়েছে। ধবধবে সাদা বাল্বের আলোয় রোযার চোখ দুটো কুঁচকে আসতে চাইলেও সে কুঁচকাল না। চোখমুখ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল। আদিল তাকিয়েই ছিলো তখনো। উজ্জ্বল আলোয় সময় নিয়ে দেখতে থাকল। অনেকটা সময় পর মুখ খুলল –

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘মাথা তোলো।’
রোযার কপাল কুঁচকে আসতে চাইল ‘তুমি’ সম্বোধন শুনে। তবে কোঁচকাল না, দৃষ্টি তুলে তাকালও না। শুধু মাথাটা তুলল, দৃষ্টি নামিয়েই রাখল। পরপরই ওমন গাঢ় কণ্ঠ ফের আদেশ করল –
‘কাম ক্লোজার….’
রোযার অস্বস্তি এবারে কিঞ্চিৎ ভয়ের দিকে মোড় নেয়। সে বরাবরই ভয় পেয়ে এসেছে এধরনের মানুষের সাথে জড়িয়ে যাওয়ার ভাবনাতেই। চার-পা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াতেই আদিল পুনরায় আদেশ করে –
‘লুক এট মি।’
রোযা তাকাল। চোখে চোখ পড়ল। আদিলের দৃষ্টিতে পড়ে কেমন অদ্ভুতভাবে এক ভয়ংকর শিহরণ বয়ে গেল তার শরীর জুড়ে। ওই ধূসর রঙা চোখে দু-সেকেন্ড চেয়েই তার মন কেমন কুইঙ্গিত দিয়ে উঠল। দমবন্ধ হয়ে আসতে চাইল। নিজেকে স্বাভাবিক রাখাটাই কেমন কঠিন হয়ে দাঁড়াল।

‘নাম?’
রোযা সরাসরি চোখে আর তাকিয়ে থাকতে পারে না। মুখে চেয়ে জবাবে বলে –
‘রোযা।’
আদিল বিড়বিড় করে নামটা –
‘রোজ… আ…!’
আদিল নিবিড়ভাবে চোখে দেখে মেয়েটার মুখের একেকটি গড়ন। লম্বা সময় ধরে নীরবে শুধু দেখেই গেল। সময় নিয়ে বলল –
‘টুডেই, ইউ ডিড আ গ্রেট জব। কী চাই, তোমার?’
রোযা স্পষ্ট কণ্ঠে বলে, ‘আমার দায়িত্ব ছিলো। দায়িত্বটুকু পালন করেছি শুধু। আই ডোন্ট ওয়ান্ট এনিথিং, স্যার। থ্যাংকিউ।’

আদিল আবারো নীরব হয়ে পড়ল। রোযার ধৈর্য্য ফুরিয়ে যাচ্ছে। অস্বস্তিতে বিরক্ত লাগছে, মাথা গরম হচ্ছে। কখন থেকে এমন দাঁড় করিয়ে তাকিয়ে থাকার মানে কী? রোযার মুখে কি কিছু লেগে আছে? রোযা যখন ভাবল মুখ খুলে সে বেরিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইবে তখুনি আদিল মুখ খোলে –
‘আমার মেয়ে — শি কলস ইউ ‘স্নো-হোয়াইট’… কেনো?’
রোযা লজ্জা পেলো আনমনে। হৃদি তাকে স্নো-হোয়াইট ডাকে কারণ বাচ্চাটার নাকি মনে হয় সে ওর পছন্দের ডিজনি প্রিন্সেসের চরিত্র ‘স্নো হোয়াইট’ এর মতো ফর্সা। সেটা কি বলা যায়? রোযা নির্বিকার থেকে অন্য কিছু বলতে চাইল –
‘ওর পছন্দের প্রিন্সেস….’
আদিল ভাবুক গলায় নিজেই বলল –
‘মেইবি বিকজ ইউ আর হোয়াইট এজ স্নো।’

রোযা অপ্রস্তুত হয়। সাথে বিরক্তও। নিজ মনেই আওড়ায়, ‘জানিসই যখন তাহলে প্রশ্ন করলি কেনো? প্রশ্ন করে আবার নিজেই বলতেছিস কেনো? বজ্জাত।’ কিন্তু মুখে সে কিছুই বলল না। দোয়াদরুদ পড়তে থাকল যে দ্রুতো তাকে চলে যেতে বলে। আর কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে রোযা দমবন্ধ হয়ে মা রা যাবে।
আল্লাহ যেন রোযার ডাক শুনল। শান্ত হঠাৎ করে এসে আদিল মির্জার কানে কিছু বলল। মুহূর্তেই তার গাঢ় দৃষ্টি সরল রোযার থেকে। রোযা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, বড়ো করে শ্বাস ফেলল। মেয়েকে দু-হাতে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল আদিল। বিছানায় শুইয়ে দিতে গেলে হৃদি ঘুমের ঘোরে শক্ত করে ধরল হাত –

‘ড্যাডিইই….’
‘ড্যাড ইজ হিয়ের, সোনা।’
হৃদির হাতের বাঁধন আলগা হতেই ওকে কম্ফোর্টারে ঢেকে সোজা হয়ে দাঁড়াল আদিল। শান্তর হাতে ওফহোয়াইট রঙের কোট। কোটটা তার হাত থেকে নিয়ে পরতে পরতে আদিল আরেকবার তাকাল রোযার দিকে। এরপর বেরিয়ে গেল দ্রুতো কদমে। রোযা প্রাণ ভরে শ্বাস নিলো। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল রুমের টেম্পারেচার হাইয়েস্ট মাউন্টেইনের চূড়ায়। একটা মানুষের উপস্থিতি এতটা গাঢ় কীভাবে হতে পারে?

রোযার ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। কল করছে জিহাদ। কল রিসিভ করতে সে বারান্দায় এলো। এটাই যেন তার অন্যতম ভুল। নিচটা পুরো দৃশ্যমান। ছটা গাড়ির পাশে দাঁড়ানো সারিবদ্ধ বডিগার্ডদের একটাকে যেই লোক চার-পাঁচটা লাথি মারল সে অন্যকেউ না, স্বয়ং আদিল মির্জা। সম্ভবত গালিগালাজও করছে। স্পষ্ট শোনা গেলো না। রোযার শ্বাস গলায় আটকে আছে। সে দ্রুতো ভেতরে ফিরে এলো। জিহাদের কলটা আর রিসিভ করা হলো না। বিপরীতে মেসেজ পাঠাল। এরমধ্যে হৃদির ঘুম ভেঙে গেছে। সে উঠে বসেছে। নিভুনিভু চোখে চেয়ে আছে।

‘স্নো হোয়াই, আর ইউ হার্ট?’
রোযা মিষ্টি করে হাসে। দু-হাতে হৃদিকে কোলে নিয়ে নরমসরম গালে চুমু খায়। বলে –
‘উহুঁম, একটুও না। তোমার বলো, খারাপ লাগছে এখনো? ভয় হচ্ছে?’
হৃদি হাসল। রোযার বুকে মিশে গিয়ে ফটরফটর করে বলল –
‘ডোন্ট ইউ নো মাই ড্যাড?’
‘অ্যাহ?’
হৃদি হাপুস চোখে চেয়ে আওড়াল –
‘আমার বাবা আদিল মির্জা। কেনো ভয় পাবো আমি?’
রোযা এইযাত্রায় বুঝল র ক্তের কতো শক্তি। এমন নাদুসনুদুস একটা বাচ্চা মেয়ে অথচ ঠিকই পিতার ছায়ার তলনিতে থেকে বিগড়ে যাচ্ছে। হৃদির গাল টেনে দিয়ে রোযা হেসে ফেলল।

বাংলোটা নিরিবিলিতে হারিয়ে আছে। ওখানের এক রুমে বারোজন লোককে চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে। শরীরে কাপড় নেই। আঘাতে জর্জরিত পুরো শরীর। র ক্তে মেখে আছে ফ্লোর। ফ্লোরে পড়ে যে আর্তনাদ করে যাচ্ছে সেই লোকটাই সকালের টাক ওয়ালা মানুষ যার পায়ে রোযা গু লি করেছিল। সেই জখ মিত পায়ের ওপর আদিলের পা-টা চেপে রেখেছে। শক্ত করে, যা প্রতি সেকেন্ডে আরও গাঢ় হচ্ছে সাথে লোকটার আর্তনাদ। মুখের মধ্যে কাপড় গোঁজা অবস্থাতেও কেমন আর্তনাদ অস্পষ্ট ভাবে চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে। আদিল হাত বাড়াতেই একটা মেশিন এগিয়ে দিলো এলেন। ওটার মধ্যে খুব সাবলীলভাবে লোকটার হাতের একটা আঙুল রাখল। এক চাপেই পুরো আঙুলটা কেটে ফেলল। র ক্তে, আর্তনাদে ভারী হয়ে এলো রুমের দেয়াল গুলোও। পুনরায় আরেকটা আঙুল বসিয়ে ভীষণ শান্ত কণ্ঠে আদিল প্রশ্ন করল –

‘কে? কে পাঠিয়েছে?’
লোকটা হাঁসফাঁস করছে। কিছু বলতে চাইছে। তখনো তার মুখ থেকে গুঁজে রাখা কাপড় সরানো হলো না। আদিল পুনরায় আরেকটা আঙুল কেটে এরপর কাপড়টা সরালো। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে বলে ফেলল –
‘নাদিম… নাদিম পাঠিয়েছে। আ আমি আমি নির্দ….’
পরমুহূর্তেই পিস্তলের বারোটা বুলেটের শব্দে বাংলো সহ কেপে উঠল। পরপরই নিস্তব্ধতা। রক্তে ভেসে গেলো জমিন। আদিল বেরিয়ে এলো রুম থেকে। পেছনে শান্ত আর এলেনও বেরিয়ে এসেছে। এলেন তাদের লোকদের সবকিছু আড়াল করার আদেশ ছুঁড়ে বসের সাথে গাড়িতে চড়ে বসল। গাড়িগুলো বেরিয়ে এসেছে বাংলো থেকে। এলেন, শান্ত সহ বাকিরাও লক্ষ্য করল তাদের বসের ভাবুক মুখ। গাড়ির ব্যাকসিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। কী যেন ভাবছে! অন্য কোথাও ধ্যান নেই। এলেন সন্দেহ চোখে তাকায় শান্তর দিকে। শান্ত চোখ পিটপিট করছিলো। তার যা সন্দেহ হচ্ছে সেই পথেই এগোল –

‘বস? বস?’
আদিল সময় নিয়ে জবাবে নাকমুখ দিয়ে শব্দ করে, ‘হুম…’
শান্ত গলাটা ঝেড়ে বলে, ‘উনার নাম আয়াত তালুকদার রোযা। মিস রোযা… মিস…নট মিসেস।’
আদিল চোখ মেলে তাকাল শান্তর দিকে। শান্ত মিইয়ে এলো। ভুল অনুমান করল নাকি? বেতের বাড়ি খেতে হবে নাকি? আদিল চোখের পলকে এলেনের হাত থেকে ডকুমেন্ট করা ফাইল নিয়ে ওটা দিয়ে শান্তর মাথায় কয়েকটা বাড়ি মারতেই, শান্ত মাথা ধরে সরে গেলো কিছুটা। তবে ঠিক ঠোঁট টিপে হাসল। গলাটা ঝেড়ে আবারও বলতে শুরু করল –

‘নাম রোযা, বাবা-মায়ের বড়ো সন্তান। ছোটো একটা ভাই আছে। আজিজুল তালুকদার এবং মা নিপা সিকদার —….’
এলেন হতবাক হয়ে বলল –
‘কাজের আলাপ করছিলাম। হঠাৎ মেয়েমানুষের বৃত্তান্ত নিয়ে আলাপ তুললি কেনো?’
শান্ত নাক সিঁটিয়ে আপদমস্তক এলেনকে পরখ করে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। তাকাল আদিল মির্জার দিকে। যে হাতের ফোনটা ঘুরাচ্ছে। আদিল অনেকটা সময় কথা বলল না। ধীর কণ্ঠে অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করে –
‘এইজ?’
শান্ত যেন পড়াশোনা করে এসেছে রোযার সম্পর্কে –

আদিল মির্জা’স বিলাভড পর্ব ২

‘টুয়েন্টি নাইন।’
আদিল আপনমনে আওড়াল, ‘শি লুকস ইয়ং।’
এলেন নড়েচড়ে ওঠে। বড়ো বড়ো চোখে তাকায় শান্তর চোখে। শান্ত ভ্রু নাচায়। মিচকে হাসিতে চোয়াল নড়ছে।

আদিল মির্জা’স বিলাভড পর্ব ৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here