আদিল মির্জা’স বিলাভড পর্ব ৪
নাবিলা ইষ্ক
রাত তখন দশটা নয়। আজিজুল সাহেব ড্রয়িং রুমে বসে আছেন মেয়ের অপেক্ষায়। সাধারণত মেয়ে তার নয়টার মধ্যে বাড়ি ফেরে। আজ এমন দেরি হওয়াতে কিছুটা চিন্তিত তিনি। কল করেছিলেন দু-বার। ফোন বন্ধ। ওসময় কলিংবেল বাজল। নিপা বেগম রান্নাঘরে ছিলেন। সন্ধ্যার রান্না এখন আবার গরম করতে চুলোয় বসিয়েছেন। হাত দুটো ওড়নায় মুছতে মুছতে এগুলেন দরজা খুলতে। খুলতে খুলতে বললেন –
‘আজ এতো দেরি হলো কেনো? তোর বা —’
বাকি কথা মুখের মধ্যে আটকে গেল, বাজেভাবে। ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেন। ক্রমান্বয়ে কয়েক পা পেছনে চলে এলেন। অস্পষ্ট গলায় আর্তনাদ করলেন। আজিজুল সাহেব দাঁড়াতে পারলেও ভালোভাবে হাঁটতে পারেন না। পা দুটো তার দুর্বল। সেই পা-জোড়া নিয়েই ছুটে আসতে চাইলেন স্ত্রীর আতঙ্কিত মুখটা দেখে। কোনোরকমে এসে দরজার সামনে দাঁড়ানো লম্বা, বিশালদেহী পুরুষ মানুষ দেখে সামান্য কাঁপলেন –
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘আ – আপনারা?’
শান্ত, এলেন, রনি, স্বপন সহ বাকিরা কালো পোশাকে আবদ্ধ। সুন্দর ভাবে, সারিবদ্ধ হয়ে দুটো বিভাগে দাঁড়িয়ে আছে — মধ্যে যাওয়ার পথ রেখে। মধ্যের ওই পথটুকুতেই হেঁটে এগিয়ে আসছে আদিল মির্জা। গায়ে সকালের পোশাক। ধূসর চোখে অথবা পাতলা ঠোঁটের আশেপাশে হাসির ‘হ’টুকুও নেও। বসের হয়ে শান্ত– দ্য বাটারফ্লাই অব দেয়ার গ্রুপ…এগিয়ে গেল কথা বলার জন্য। গাল ভরে হেসে হাতের বুকেটা এগিয়ে দিতে নিয়ে বলল –
‘ভয় পাবেন না মিস্টার তালুকদার। শান্ত হোন।’
হাতে ফুলের বুকে নিয়ে ভদ্রলোক আহাম্মকের মতো আদিলকে দেখলেন। আদিল দুয়ার পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জানাল –
‘আদিল মির্জা।’
নিপা বেগম আঁতকে উঠলেন। বড়ো বড়ো চোখে তাকালেন স্বামীর দিকে। আজিজুল সাহেব নিজেকে সামলে নিয়েছেন। ঠোঁটে হাসি আনার চেষ্টা করে বললেন –
‘আসুন না, স্যার…বসুন বসুন।’
অথচ তার আসুন বলার কারণ নেই। আদিল বলার আগেই ঢুকেছে ভেতরে। চতুর্দিকটা দেখতে দেখতে গিয়ে বসল সোফায়। তার পিছু পিছু কয়েকজন বডিগার্ড এলো। হাতের সরঞ্জাম গুলো সারিবদ্ধভাবে রেখে গেলো একপাশে। আদিলের চোখ গেল সামনের দেয়ালে। রোযার বড়ো একটা ছবির ফ্রেম টানানো। ছবিতে সে আউটডোর স্পোর্ট ড্রেস পরে আছে। হাতে বাস্কেটবল। সম্ভবত বয়সটা বিশের দিকে। নিপা বেগম কাঁপতে কাঁপতে রান্নাঘরে গেলেন অতিথি আপ্যায়নের জন্য নাস্তাপানির ব্যবস্থা করতে। আজিজুল সাহেব দুর্বল পা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সে যে দাঁড়িয়ে আছে তা আদিল খেয়াল করল অনেকটা সময় পর। ছবির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বলল –
‘বসুন মিস্টার তালুকদার।’
আজিজুল সাহেবের কপালে ঘাম জমল। ওপর পাশে বসলেন গুটিশুটি মেরে। বিনয়ী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন –
‘স্যারের হঠাৎ আগমনের… কারণ?’
আদিলের সোফার পেছনের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে শান্ত আর এলেন। বাকিরা সব দুয়ারে দাঁড়িয়ে। এতগুলো মানুষ বারবার নজরে এলেই মিইয়ে যাচ্ছেন আজিজুল সাহেব। তার হৃদরোগের সমস্যা থেকে থাকলে নির্ঘাত তার আজ কিছু একটা হয়ে যেতো।
‘আপনার মেয়ে– মিস রোযা শি ইজ…উম টু গুড টু বি ট্রু। শি হ্যাজ ডান মি আ গ্রেট ফেভার। আমি বিপরীতে কিছু করতে চাই। শুনেছি আপনার চিকিৎসা এখনো চলমান? এই দেশের বেস্ট হসপিটালে আমি আপনার ভবিষ্যৎ সকল চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছি— ফর ফ্রি। ইউজ দ্যাট হসপিটাল এজ ইওর্স। আমার বডিগার্ড বাকিটা আপনাকে বুঝিয়ে দেবে।’
আজিজুল সাহেব বোকার মতন বললেন, ‘অ্যাহ? জি জি…জি আচ্ছা।’
রাজু পড়তে বসেছিল কানে ইয়ারপডস দিয়ে। হঠাৎ করে আওয়াজ শুনে বেরিয়ে এসে হতবিহ্বল সে। তোতলালো –
‘কা কারা আপনারা?’
শান্ত আদিলের কানের কাছে ছেলেটার পরিচয় জানাল –
‘মিস রোযার ছোটো ভাই।’
আদিল আঙুলের ইশারায় কাছে আসার ইশারা দিলে ছেলেটা কাচুমাচু ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে। আদিল মুখটা ভালোভাবে দেখে। মিস রোযার সাথে চেহারার মিল নেই। ছেলে মায়ের মতো আর মেয়ে বাবার মতো হয়েছে। আজিজুল সাহেবের গায়ের রংটা এখন একটু ময়লা দেখালেও বোঝার উপায় আছে যে ভদ্রলোক ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙের ছিলেন। শান্ত চাপা গলায় বলল –
‘বস, মেয়েরা বাবার মতন হওয়া মানে লক্ষ্মী। মা-চাচিরা বলেন। মিস রোযা ভীষণ লক্ষ্মী।’
আদিল ভ্রু তুলে তাকালে বেচারা হাঁসফাঁস করে ফের সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। নিপা বেগম কাঁপতে কাঁপতে এসেছেন ট্রে হাতে। ট্রে ধরা হাতটা ঠকঠক করে কাঁপছে। আদিল সর্বদাই আনন্দ পেয়ে এসেছে—যখন কেউ তাকে দেখে কাঁপে, ভয় পায়। আজই বোধহয় সে অসন্তুষ্ট হলো। গটগট করে উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে এলো। মিস রোযা তো ভীষণ সাহসী। তার বাবা-মা এমন ভীতু কেনো!
রোযার বাড়ি ফিরতে দেরি হলো ভীষণ। তার ওপর ফোনেও আজ চার্জ নেই। বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। সে কলিংবেল বাজালে দরজা খুলে দিলো রাজু। বেচারার মুখটা শুঁকনো হয়ে আছে। রোযা হাত বাড়িয়ে গাল ছুঁয়ে চিন্তিত গলায় প্রশ্ন
করল –
‘শরীর খারাপ নাকি? মুখটা এতটুকুন হয়ে আছে কেনো?’
বলতে বলতে ভেতরে প্রবেশ করে আরও আশ্চর্য হলো। বসার ঘরে বেশ কিছু প্যাকেজ। সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা। সেগুলো একটু পরপর নিপা বেগম দেখছেন। এযাত্রায় রাজুও গিয়ে বসল ওগুলোর সামনে। আজিজুল সাহেব মেয়ের দিকে চেয়ে আছেন আশ্চর্য নিয়ে। বাবা-মা দুজানার মুখের অবস্থা অবর্ণণীয়।
‘কী হয়েছে? এসব কে পাঠাল?’
নিপা বেগম মেয়ের হাত টেনে সোফায় বসালেন। রোযা বোকার মতো ভ্রু তুলল। আজিজুল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন –
‘আদিল মির্জা এসেছিলেন।’
রোযা এতটাই চমকায় যে সে দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘কী!!’
নিপা বেগম মেয়েকে পুনরায় টেনে বসালেন –
‘এসেছিল। তুই নাকি অনেক বড়ো উপকার করেছিস তার? বিপরীতে সেও কিছু করতে চায়। তোর বাবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন বিরাট বড়ো হাসপাতালে। এসব সেই এনেছে।’
রোযা হতবাক, আশ্চর্য। বলদের মতন কিছুক্ষণ মুখটা হা করে রাখল। নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় লাগল তার। আজিজুল সাহেব মূখ্য বিষয়ে প্রশ্ন করলেন –
‘কী করেছিস, মা? কোন উপকারের কথা বলছেন?’
রোযা মিথ্যে বলতে চায় না। কিন্তু সত্যও বলা সম্ভব হচ্ছে না। ওসব শুনলে তারা ভয় পাবেন। আতঙ্কিত হবেন। অগত্যা একটু ঘুরিয়ে বলল –
‘হৃদি অসুস্থ হয়। আমিই ওর দেখভাল করি। এইজন্য হয়তো-বা।’
রাজু এসে চকচকে চোখে চেয়ে বলল, ‘আপু, খুলিইই? দেখি কী পাঠিয়েছেন?’
রোযা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। উনি মালিক, রোযা সামান্য চাকর। মালিক খুশি হয়ে উপহার দিয়েছেন, না করার সাধ্যি কি তার মতন নগন্য কারো আছে? অগত্যা মাথা দোলায়। রাজু ছুটে যায় প্যাকেজ গুলো খুলতে। সম্ভবত মানুষ বুঝে কেনাকাটা করা হয়েছে। যেমন আজিজুল সাহেবের জন্য স্পেশাল এক ধরনের পাইপ স্মোকিং পাঠিয়েছেন। যা দেখে আজিজুল সাহেবের চোখ ছানাবড়া। তিনি লুকিয়ে স্মোক করেন মেয়ের ভয়ে। রোযা বিরক্ত হলো। পাইপ স্মোকিং এর প্যাকেটটা নিজের কাছে রাখল। ভুলেও বাবার হাতে যেতে দিলো না। নিপা বেগমের জন্য তিনটে সুন্দর বেনারসি শাড়ি। ভদ্রমহিলা ভীষণ পছন্দ করেছেন।
রাজুর জন্য একটি গেমিং সেট — Sony PlayStation 5 (PS5).
যেটা দেখে ও কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়েছিল। এরপর এমন চিৎকার করল যে পুরো ফ্ল্যাট কেঁপে উঠল। রোযা নির্বিকার হয়ে দেখল সব। বুঝল — বেশ দামী গেমিং সেট। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমে এলো। মনে মনে আশা রাখল, এতটুকুতেই যেন কাহিনী শেষ হয়। আর যেন কোনো দায়বদ্ধতায় জড়াতে না হয়। তার কীজন্যে যেন ভয় হচ্ছে। অদ্ভুত কিছুর ভয়। তার সাধারণ, সাবলীল জীবনে ঝড় আসার ভয়….
নিপা বেগম প্লেটে ভাত-তরকারি সাজিয়ে নিয়ে এলেন রোযার রুমে। রোযা সবে গোসল সেরে বিছানায় বসেছে। চুলে হেয়ারমাস্ক দিয়েছে। বিশ মিনিট রাখবে। মুখে একটা মাস্ক লাগাতে লাগাতে বলল –
‘খিদে নেই মা।’
‘এসব বলিস না তো। রাগ লাগে আমার। হা কর।’
রোযা শব্দ করে হাসল, ‘ঊনত্রিশ বয়সী মেয়েকে এখনো হাতে ধরে ভাত খাইয়ে দিচ্ছো তা মানুষ জানলে হাসবে তোমার ওপর।’
নিপা বেগম এক নলা ভাত রোযার মুখে পুরে আওড়ালেন, ‘হাসুক, আমার বয়েই যাবে। আমার মেয়ের বয় চল্লিশ হোক অথবা পঞ্চাশ তাতে কী? যতদিন বল আছে আমি খাইয়ে দেবোই।’
রোযা আচমকা মুখ বাড়িয়ে মায়ের ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল –
আদিল মির্জা’স বিলাভড পর্ব ৩
‘এখন তুমি খাইয়ে দিচ্ছো, বৃদ্ধাকালে আমি খাইয়ে দেব তোমাকে। শোধবোধ।’
হাসলেন নিপা বেগম। মেয়েকে খাইয়ে খালি প্লেট নিয়ে চলে গেলেন। রোযা চুল ধুয়ে এসে বসল ড্রেসিংটেবিলের সামনে। ব্লো ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকাতে শুকাতে ভাবল হৃদির কথা। আজ মেয়েটা ভীষণ বায়না করছিল, চাচ্ছিল রোযা যেন ওর সাথে থাকে। একসাথে ঘুমোয়। বারবার বলছিল, ওর একা ঘুমোতে ভালো লাগে না। তখন কী যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল রোযার! সে যে একটুও হৃদির কষ্ট সহ্য করতে পারে না। পারে না ওর ইচ্ছেদের অপূর্ণ রাখতে।
