আপনাতেই আমি পর্ব ৫০
ইশিকা ইসলাম ইশা
(প্রথমেই বলি ২য় অংশ অনেকটা জুড়ে থাকবে রহস্য।তাই ধৈর্য ধরে শেষ পর্যন্ত পড়তে হবে।রিদের নাম পরিবর্তন করে রায়ান করেছি।রিদ,রিদি কনফিউজড লাগছে।আশা করি ২য় অংশ টা আপনাদের ভালো লাগবে।)
চারদিকে শুনশান নীরবতা। গ্রামীণ পরিবেশে এই নীরবতা যেন আরো গভীর মনে হয়। ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে রিদি।চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নীরব অশ্রুধারা।
কি দেখছিস??
রায়ানের কথাই পাশে তাকাই রিদি। রায়ান কে দেখে অবাক হয়ে বলে,
তুমি কখন এলে??
রায়ান উওর দেয় না।রিদি উওর না পেয়ে বলে,
দেখছো ভাইয়া আকাশে কত তারা!!
হ্যাঁ তো!!!
জানো তীব্র আর আমি প্রায় রাতে আকাশের তারা গুনতাম।তারা গুনলে নাকি মন ভালো হয়ে যায়!
রায়ান রেগে বলে,
তোকে কতোবার বলেছি ঐ জঘন্য মানুষটার নাম মুখে নিবি না।সে তোকে ছেড়ে তার স্ত্রী সন্তান নিয়ে যখন ভালো আছে তাহলে তুই কেন ভাবছিস ঐ লোকের কথা!!
রিদি মুচকি হাসে।চোখে পানি মুখে ব্যাথাতুর হাসি। দারুন কষ্ট,
ভালোবাসি যে ভাইয়া!এই যে আকাশ দেখছো!এক আকাশ পরিমাণ ভালোবাসি তাকে!সে আমার জীবন পূর্ণ করেছে যে !!!অধিক ভালবাসায়!
ভালোবাসায় নাকি ঘৃনায়!!
তোকে ঘৃনা করে সে রিদি এই কথা ভুলে যাস না!ভুলে যাচ্ছিস সেই দিনের কথা।
দোষ তো আমার ভাইয়া!!আমি যে যোগ্য না ওনার ভালোবাসার। তীব্র ঠিক বলেছে।আমি তার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না।আমি মা হওয়ার যোগ্য না।আমি কোন কিছুরই যোগ্য না।
রায়ান তাকালো রিদির দিকে। কয় মাসে মেয়েটা একদম শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।না ঠিক মতো খাওয়া না ঘুম। অনেক কষ্টে একটু সামলে উঠেছে। সেদিন যদি সঠিক সময়ে না আসত !!রায়ান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল,
খাবি চল!!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
খিদে পায়নি ভাইয়া!
অনেক হয়েছে!অনেক শুনেছি তোর কথা!খাবি চল!কাল তোর হসপিটালে ডিউটি আছে।এভাবে চললে হবে!! চল!! আমি না থাকলে তো খাওয়াটাও ঠিক মতো করিস না। রায়ান এক প্রকার জোর করে রিদিকে খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে ঘুমাতে পাঠিয়েছে।রিদির সাথে জোর না করলে সে কিছুতেই নিজের খেয়াল রাখবে না।
রিদি বিছনায় শুয়ে থাকলেও ঘুম আসছে না।তাই দুটো ঘুমের ওষুধ খেয়ে নেয়।এটা রোজ কার অভ্যাস।এই কয় মাসে এটা তার ঘুমের সঙ্গি।এখন তো আর কারো প্রসস্থ বুকে মাথা এলিয়ে রাখতে পারে না।তবে ইচ্ছে আছে ঐ বুকে মাথা রেখে শান্তিতে যেন মরতে পারে।
শহর থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত পলাশপুর গ্রাম। ছোট্ট একটা গ্রাম হলেও বেশ উন্নত।সেই গ্রামের হসপিটালে ডক্টর হিসেবে কাজ করছে রিদি।মাস খানেক আগে জয়েন হয়েছে।গ্রামের চেয়ারম্যান মনসুর আলী নিজেও একজন ডক্টর। ডক্টর আর চোয়ারম্যান হিসেবে তার নামডাক অনেক। তিনিই রিদিকে চাকরিটার জন্য বেছে নিয়েছেন।মূলত রিদিকে চিনে আগে থেকে। একবার ঢাকা থেকে ক্যাম্পিং এর জন্য এসেছিল তারা এখানে।সেই থেকেই তার পছন্দ রিদিকে।মেয়েটা যেমন ভালো ডক্টর তেমনি ভালো মানুষ।
রিদি শহর থেকে দূরে কোন হসপিটালে কাজ করতে চেয়েছিল তাই গ্রামের বিভিন্ন ছোট ছোট হসপিটালে সে অপ্লায় করেছিল। অদ্ভুত ভাবে সব হসপিটাল তাকে রিজেক্ট করে। শুধু এই হসপিটাল বাদে।রিদির উদ্দেশ্য টাকা ইনকাম করা না। মানুষের সেবা করা।তাই যেখানে সেবার সুযোগ পেয়েছ সেখানেই চলে এসেছে।রিদি শহর থেকে দূরে এই গ্রামেই থাকে মাস খানিক ধরে। মনসুর আলীর বাসায় যা হসপিটালের কাছেই। ওনারা পরিবার সমেত গ্রামের জমিদার বাড়িতে থাকে।এই বাড়িটা ২তলা বিশিষ্ট।নিচে একটা পরিবার থাকে আর উপরে রিদি একা থাকে যদিও মাঝে মাঝে রায়ান আসে।দুই রুম বিশিষ্ট বাসাটা সুন্দর,পরিপাটি, ছিমছাম।
গ্রামে আসার পর রায়ান রিদির সাথেই থাকছে।বোনকে সবাই ছেড়ে দিলেও সে ছাড়তে পারে না।সে না থাকলে রিদি একা হয়ে যাবে।একা থেকে নিজের আবারো কোন ক্ষতি না করে তাই সে বর্তমানে থাকছে রিদির সাথে।যদিও তাকে কাজের জন্য বেশি সময় শহরেই থাকতে হয়।তবে নিচ তলায় থাকা পরিবার টা বেশ ভালো হওয়াই তারা রিদির অনেক খেয়াল রাখে।এতে রিদ কিছুটা স্বস্তি পায়।
সকালে রায়ানের ঘুম ভাঙ্গে দেরিতে।রাতে কিছু কাজ করতে হয়েছিল তার।ফ্রেশ হয়ে নিজের রুমে থেকে বের হয় রায়ান ।রিদির রুমে নক করে ভেতরে ঢুকে দেখে রিদি নেই। রায়ান ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে ৮টা বাজে রিদি এখন হসপিটালে।সে অলস ভঙ্গিতে ডায়নিং এ আসে।ফোন বের করতেই দেখে রিদির ম্যাসেজ,
“সকালে দেখলাম গভীর ঘুমে তুমি তাই আর ডাকলাম না। নাস্তা করা আছে খেয়ে নিও”
রায়ান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে নাস্তা সেরে নেয়। নাস্তা করে ড্রইং রুমে বসে ল্যাপটপ অন করে কিছু কাজ করতেই কলিং বেল বেজে ওঠে।পর পর কলিং বেল বাজতেই বিরক্ত হয়ে উঠে দরজা খুলে দেয় রায়ান।দরজা খুলতেই দেখা মেলে ১২-১৩ একটা বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।ছেলেটাকে চিনে রায়ান।নিচের তলায় থাকে। রায়ান কিছু বলার আগেই নয়ন বলে,
রিদি আপু কোথায়??আপুকে ডাকেন!!
কেন?কি হয়েছে??
নির আপু কি যেন হয়েছে?? র র ক্ত পড়ছে!!
নির কে??
আমার বোন!আপুকে ডাকেন!!
কিন্তু রিদি তো হসপিটালে। আচ্ছা চলো আমি আসছি।
রায়ান নিচ এসে দেখে একজন মহিলা একটা মেয়েকে ধরে আছে আর চিৎকার করে কান্না করছে।মেয়েটার হাতের ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে।হয়তো আত্মহত্যা করেছে। রায়ান ছুটে এসে রুমাল দিয়ে
মেয়েটার হাত পেঁচিয়ে কোলে তুলে নেয়।
বাইরে গাড়ি আছে আপনি আসুন আমার সাথে।ওনাকে জলদি হসপিটালে নিতে হবে।
মহিলাটি রায়ানের কথায় রায়ানের পিছনে ছুটে আসে। রায়ান গাড়ি চালাচ্ছে।পেছনে মেয়েকে ধরে বসে আছে মহিলাটি।৫মিনিটে হসপিটালে পৌছে যায় ওরা। রায়ান গাড়ি থেকে মেয়েটাকে বের করে ডক্টরদের ডাক দেয়। ডক্টর এসে মেয়েটাকে চিকিৎসা রুমে নিয়ে যায়।
মিনিট দশেক পর একজন পুরুষ ছুটে আসে। পুরুষটিকে দেখে মহিলা আরো কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। রায়ান দূর থেকে সব দেখে রিদির কেবিনের দিকে পা বাড়ালো।রিদিকে ব্যাপারটা জানিয়ে সে বাসায় ফিরে যাবে।
পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাল নিলীমা।শরীর বেশ দূবল লাগছে তার। নিজেকে হসপিটালে দেখে মনে মনে বলল,মরে নি!!বেঁচে কেন আছে ভেবেই আশেপাশে তাকাল। আশেপাশে মা বাবাকে দেখল না। দূবল শরীরে একটু নড়েচড়ে দূরে বসে থাকা থাকা একজন পুরুষ কে দেখে হাইপার হয়ে উঠল। শরীর কাঁপতে লাগলো। মস্তিষ্ক স্মৃতিচারণ করল অতীতের ঘটনা গুলো।চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই অন্ধকার রাতের ভয়ানক ঘটনা।
নিলীমাকে হাইপার হতে দেখে রায়ান নিলীমার কাছে আসতেই নিলীমা পাশে থাকা সব কিছু ছুড়ে মারলো রায়ানের দিকে। রায়ান হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।সে রিদিকে সবটা জানিয়ে চলে আসতে চেয়েছিল কিন্তু মেয়েটার মা হঠাৎই ই ঙ্গান হারিয়ে ফেলে।এমন পরিস্থিতিতে রিদির কথায়ই সে মেয়েটার রুমে বসে ছিল।আর রিদি ওনার মা বাবা কে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। দুইজনেই অসুস্থ। হসপিটালে থাকলে আরো অসুস্থ হয়ে যাবে। তবে কেমন পাগলের মতো করছে মেয়েটা।মেয়েটার কি মেনটেলি সমস্যা আছে?? রায়ানের ভাবনার রুমে ঢুকে রিদি।নিলীমাকে হাইপার হতে দেখে ছুটে ওর কাছে আসে।নিলীমা রিদিকে দেখেই ভয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে।থরথর করে কাঁপতে থাকা নিলীমাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে রিদি। নীলিমা কাঁপছে আর বলছে,
বাচাও আমাকে!! বাঁচাও!!আপু আমাকে বাঁচাও!!
নীল ভয় নেই আমি আছি তো!দেখো আমার দিকে তাকাও। রিল্যাক্স!!!ও আমার ভাই নীল ।তুমি শান্ত হও।
নীলিমা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলেও রিদিকে ছাড়ল না।রিদি নীলিমা কে ইনজেকশন পুশ করে দিল। কিছু ক্ষণের মধ্য নীলিমা ঘুমিয়ে পড়লে তাকে শুইয়ে দিল রিদি। রায়ান এর দিকে তাকাতেই দেখল সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।রিদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীলিমার দিকে তাকালো।
আমাকে দেখে কি এমন রিএকশন???
ভাইয়ের কথায় রিদি ছোট্ট করে বলে,
হুম।
শুধু তোমাকে না।ওর বাবা ছাড়া সব পুরুষকে দেখলেই এমন করে নীলিমা।
কেন???
ওর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার সেই নরপিশাচ এর জন্য!!
রায়ান বুদ্ধিমান ছেলে। বিষয়টি বুঝতে তার সময় লাগলো না।একবার তাকালো ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটার দিকে।শ্যামলা বনের মিষ্টি একটা চেহেরা।একবার দেখে আর তাকালো না।
রিদু আমাকে ঢাকা ব্যাক করতে হবে জরুরি মিটিং আছে।
কখন যাবে?? দুপুর হয়েছে খেয়েছো কিছু??
না। যাবার পথে খেয়ে নিব।তুই চিন্তা করিস না।আর হ্যা দুপুরে তুই কিন্তু খেয়ে নিস!
হুম।
রায়ান রিদির হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল,
আপনাতেই আমি পর্ব ৪৯
রিদি অন্যকে দেখতে হলে আগে নিজেকে ঠিক রাখতে হবে।তোর উপর কতো মানুষ নির্ভর দেখেছিস।এই যে মেয়েটি শুয়ে আছে সে তোর উপর নির্ভরশীল।কারন তুই ডক্টর। ডক্টর হিসেবেই না হয় নিজেকে বাঁচিয়ে রাখ।
রিদি ছলছল চোখে তাকালো নিচের দিকে।সে ভেতরে ভেতরে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। জীবন্ত লাশ ছাড়া সে কিছু না। শুধু দায়িত্ব পালন করছে সে। কলকব্জর শরীর শুধু টেনে নিয়ে বেরাচ্ছে।এখন শুধু শেষ প্রহরের অপেক্ষা। চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে সেও তার সন্তানের কাছে চলে যাবে।মুছে যাবে সকল গ্লানি। ভুলে যাবে নির্মম পরিহাস।
রায়ান রিদির দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে বেরিয়ে যায়।সে জানে রিদির মনের অবস্থা।সে জানে নিজের সাথে যুদ্ধ করছে প্রতিনিয়ত মেয়েটা। কতো নির্ঘুম রাত পার করেছে।কতোটা যন্ত্রণা সহ্য করেছে।তবে এসবের জন্য যে দায়ী তাকে কোনদিন ক্ষমা করবে না রায়ান।উচিত শাস্তি দিবে। ছিন্নভিন্ন জীবন বয়ে বেড়ানো অধিক কষ্টকর।