আপনাতেই আমি পর্ব ৫৯

আপনাতেই আমি পর্ব ৫৯
ইশিকা ইসলাম ইশা

হসপিটালে নিজের কেবিনে বসে আছে রিদি।তার কোলে শুয়ে আছে ছোট্ট রোজ। তুলতুলে শরীরটা আরামে ঘুমাচ্ছে।তবে কপালে রিদির চিন্তার ভাঁজ।আজ অনেকদিন ই তো হলো রোজের কেয়ার টেকার সেই যে গেছে। এরপর আর আসেনি।না এসেছে রোজ এর বাবা মা কোন সন্ধান না তারা সয়ং এসেছে।সন্তানের প্রতি কেমন ভালোবাসা এতো দিনেও খোঁজ নেয়নি।নাকি ওদের সন্তান চাই না!!নাকি কোন বিপদে আছে!!আর ভাবতে পারছে না রিদি! কয়েকদিন থেকে এই একটাই ভাবনা তার।

হসপিটালে দেওয়া ঠিকানায় অনুযায়ী যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না। বাড়িটা ছিল পরিত্যাক্ত বাড়ি।মনে হয় অনেক বছর এখানে কেউ থাকে না। অথচ এই বাড়ির ঠিকানা দেওয়া হয়েছে সেদিন । কয়েকদিন থেকে এটা নিয়েইও ভাবছে রিদি। কিন্তু কোন ক্লু পাচ্ছেনা।আর না বুঝতে পারছে এখন কি করা উচিত!!
রিদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকালো ঘুমন্ত রোজের দিকে।আলতো করে কপালে চুমু দিয়ে বলল ,””মায়া বাড়িয়ে ছেড়ে যাবি না তো সবাই তো ছেড়েই যায় ,না হয় স্বার্থে ব্যাবহার করে””
কথাটা বলতেই রিদির চোখ ভিজে ওঠল। শুকনো মুখে বলল,তুই চলে গেলে আর বাঁচতে পারবো না রোজ।এমন কোন দুনিয়া নেই সেখানে তুমি আর থাকব!আমরা মা মেয়ে হয়ে থাকব!কেউ আমাদের খুজে পাবে না!! রিদি নিজের ভাবনায় ই হাসল।জীবনটা কোন রুপকথা তো আর না। হয়তো কোন একদিন রোজ ও ফিরে যাবে বাবা মার কাছে। আবারো রিদি একা হয়ে পড়বে এই বিশাল পৃথিবীতে। কথাগুলো ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বাবু বাবু ডেকে বিরক্ত হয়ে নীর ওর নাম রেখেছে রোজ।রোজ মানে গোলাপ।বাবুটাও ফুটন্ত গোলাপের মতোই সুন্দর তাই নীর রোজ নাম রেখেছে।মাঝে মাঝে যখন লাল টুকটুকে জামা পড়ানো হয় তখন নীর ভালোবেসে ডাকে রেড রোজ।মিতু তো আবার ডাকে আরেক নামে হলদে পাখি।রোজের গায়ের রং সবার থেকে আলাদা দুধের সাথে কাঁচা হলুদ মেশানো রং তার শরীরে।সে যেন এক হলুদ কন্যা। তাই মিতু ডাকে হলদে পাখি।এসব ভেবে মুচকি হেসে তাকালো রোজের দিকে।একদম প্রান জুরানোর মতো শান্ত,সিগ্ধ ঘুমন্ত মুখ।ঠিক যেন তীব্রর ঘুমন্ত মুখটা দেখছে রিদি।রিদি মনে মনে বলল,

দেখেছেন!! আপনি নেই আজ আমার সাথে। তবুও মনে হয় আপনি আছেন!এই যে আজানা রোজের মধ্যে ও আপনার ছোয়া পায়।ওকে জরিয়ে ধরলে মনে হয় আপনাকে জরিয়ে আছি। আল্লাহ কি বন্ধন দিয়েছে তাই না।কাছে না থাকলেও,পাশে না থাকলেও মনে হচ্ছে আপনি এখানেই আছেন।অথচ বাস্তবতা হচ্ছে আপনি অনেক দূরে।অনেক টা দূরে! আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে।খুব ভালো আছেন তাই না!! নতুন জীবনে! নতুন মানুষের সাথে!! আমার কথা কি মনে পড়ে!!পড়বে কিভাবে?? আপু হয়তো আপনাকে অনেক ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছে।
রিদির চোখে পানি আর মুখে তাচ্ছিল্য হাসি।তবে এই কান্না দীর্ঘ ক্ষন স্থায়ী হলো না।হুট করেই কেঁদে
উঠল রোজ। ঘুমন্ত অবস্থায় ই ঠোঁট ফুলিয়ে কাদছে।তা দেখে রিদির মুখে ফুটে উঠে বিস্তর হাসি।চোখে পানি মুখে হাসি এ যেন হাসি কান্নার মেলা।রিদি উঠে আলতো করে বাবুকে বুকে চেপে পিঠ চাপড়াতে লাগল।

কতো বার তোমাকে কল দিই তীব্র।একবার হলেও তো ফোন ধরতে পারো…..
রুমে ঢুকতেই মোনার কথায় তার দিকে তাকায় তীব্র। বাঁকা হেসে বলল,
সত্যি সত্যি বৌ ভাবছ নাকি!!
মোনা ছলছল চোখে তীব্রর দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবল,
সেই ভাগ্য আমার কোথায়?মনেমনে ভাবলেও মুখে কঠিন ভাব ফুটিয়ে বলল,
না!!তবে আমার তো চিন্তা হয়!রিদি ফিরে না আসা পর্যন্ত তোমার খেয়াল রাখা আমার দায়িত্ব বলে মনে করছি।
তীব্র উওর না দিয়ে প্রশ্ন করল,
মুগ্ধ ঘুমাচ্ছে??
মোনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

হ্যাঁ!!
তীব্র পকেটে দুই হাত গুজে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
রাত অনেক হয়েছে গিয়ে ঘুমাও!!!
মোনা ঠাই দাঁড়িয়ে থেকে বলে,
তোমাদের সন্তান বেঁচে আছে??
তীব্র একই ভঙ্গিতে বলে,
বেঁচে আছে! বর্তমানে মায়ের কাছে আছে!!
মোনা অবাক হয়ে বলল,
মানে!!
মানে যার মেয়ে তার কাছেই আছে তবে অন্য পরিচয়ে!!
মোনা অবাক সুরেই বলল,
কি বলতে চাইছ!!
তীব্র শীতল কন্ঠে বলে,
আপাতত কিছু বলতে চাইছি না।

মোনা জানে তীব্র নিজ ইচ্ছায় না বললে তাকে বলানো সম্ভব নয়।তবে রিদির কাছে যে তার মেয়ে এটা বুঝেছে।কি অদ্ভুত!!এই মেয়েটাকেই কি নির্দয় ভাবে সেদিন কথাগুলো বলেছিল।যদিও মনের কথা ছিল না।রিদিকে দূরে সরিয়ে রাখতে কথাগুলো বলেছিল।অথচ রিদি সেদিন রুম থেকে বেরিয়ে যাবার পর সব ভাংচুর করে নিজেকে ক্ষত বিক্ষত করেছে আর বার বার শুধু একটাই কথা বলছে,

“কেন একবার জরিয়ে ধরলো না।কেন এই বুকে জ্বলতে থাকা আগুন নিভিয়ে গেল না। পরনারীর স্পর্শ আছে তাই ঘৃনা করছে তাই না। অসভ্য মেয়ে!!কেন আসল ও আমার জীবনে।কেন আমার কথা অমান্য করল?কেন কেন??””
তীব্র কে পাগলের মতো প্রলাপ করতে দেখে সেদিন মোনার চোখ ভিজে গেছিলো।ঠিক কতোটা ভালোবাসলে তীব্র চোধুরী ও পাগলের মতো প্রলাপ বকতে পারে। কিন্তু সে তো এসব চাই নি।সে তো বাধ্য হয়ে এসব করেছে।মোনার মনে তীব্রর জন্য যে অনূভুতি আছে তা সে চাইলেই মুছে ফেলতে পারে না।তাই বলে সে তীব্রর ক্ষতি চাই না।সে চাই তীব্র ভালো থাকুক। কিন্তু সামান্য অতীত যে আজ তার ছেলের জীবনে ঝুঁকি নিয়ে আসবে এটা তো কখনো ভাবে নি। তাঁদের মধ্যে তো কিছুই হওয়া তো দূর।তীব্র তাকে ছুঁয়েও দেখেনি।যদিও সে তার অনূভুতির কাছে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল এটা ঠিক কিন্তু তীব্র !!সে নেশার করলেও তার হুস ছিল।তার এই নেশার চেয়েও কঠিন নেশা রিদি। রিদি ছাড়া তার সামান্য ছোঁয়াও তীব্র নিজের শরীরে লাগতে দেয়নি।নিজেই নিজের হাত দিয়ে সেদিন পিঠের উপর দাগ করেছিল।সবটা রিদিকে দেখানোর জন্যই। তীব্র শুধু তাকে বলেছিল পাশের রুমে যাও।সকালে এই রুমে এসো!!
“আমি তোমার আর মুগ্ধর টিকিট করে দিয়েছে আমেরিকার””

তীব্রর কথায় ধ্যান ভাঙল মোনার।অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তীব্রর দিকে। তীব্র সেদিকে না তাকিয়ে বলল,
“আমি চাই না তুমি মুগ্ধ কে নিয়ে এই রিস্ক এ থাকো। আমি চাইছি তুমি সেফলি দেশের বাইরে চলে যাও।তোমাদের সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি।ওখানে যাও গিয়ে মুগ্ধ কে মানুষ করো।তুমি চাইলে কিন্তু আমার কোম্পানিতে জয়েন হতে পারো বা তোমার পছন্দ অনুযায়ী কোন জব করতে পারো!চয়েস ইজ ইউরস!””
কথাটা বলেই রুম থেকে বের হয়ে যায় তীব্র। তার বলা শেষ মানে আর এক মুহূর্তও এখানে থাকা যাবে না।তীব্র তার বেকানো বিল্ডিং এ যেতেই দেখা হয় আমিরের সাথে। কিন্তু আমির কোন কথা না বলেই চলে যায়।তা দেখে তীব্র বাঁকা হাসে।মনে মনে ভাবে,
মি: চৌধুরীর দেখি ছেলের মতোই এটিটিউড!!নট ব্যাড!!

সকাল সকাল রায়ান কে গেটের বাইরে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল নীর!! অনেকদিন ধরে বোনের সাথে দেখা হয়না।তাই ভোরেই রওনা দিয়ে সকাল সকাল এসে পৌঁছেছে রায়ান। ইদানিং কাজের চাপ যেন বেড়েই চলেছে তার।তবে এতো সকালে রিদির জায়গায় নীর কে দেখে ভু কুঁচকে তাকাল নীরের ঘুম থেকে উঠা ফোলা ফোলা মুখের দিকে। মেয়েটার হুস নাই নাকি।ওরনা বিহীন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বেয়াদব মেয়ে!!তার জায়গায় যদি অন্য কেউ হতো!!
বাসার ওরনা কি সোকেশে তুলে রাখেন মিস নীর!!

যে পড়ে আসতে ভুলে যান!!নাকি মানুষ কে শরীর দেখাচ্ছেন!!কিছুটা রেগেই বলে রায়ান।
নীর ঝট করেই চুল গুলো সামনে এনে ছুটে চলে যায়। সকাল সকাল কলিং বেল শুনে দৌড়ে এসে দরজা খুলে দেয় নীর সে ভেবেছিল প্রতিদিন এর মতো তার মা হয়তো এসেছে।তাছাড়া রোজ ঘুমাচ্ছিল শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেলে রিদি ছাড়া কারো কাছে থাকবে না। কেঁদে কেঁদে একদম চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলে।রিদি সবেই গোসলে ঢুকেছে এখনি তো আর বের হতে পারবে না।তার সব ভেবেই তাড়াহুড়ো করেই ওরনা ছাড়া বের হয়ে এসেছে। কিন্তু রায়ান কে এই সময়ে আশা করেনি।তবে রায়ানের কথায় কিছুটা খারাপ ও লেগেছে তার!!
রায়ান নীরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভেতরে ঢুকে গেট লাগিয়ে সোজা রুমে চলে যায়।লম্বা একটা সাওয়ার নিয়ে ডায়নিং এ এসে দেখে রিদি নাস্তার প্লেট টেবিলে সাজিয়ে রাখছে।রায়ানকে দেখে মুচকি হেসে বলে,
হুট করে আসলে যে!

এমনি মনে হলো তাই চলে আসলাম!! রেড রোজ কে মিস করছিলাম! বাচ্চাটার মধ্যে জাদু আছে দেখছি।আমার বোনকে অনেক দিন পর হাসতে দেখলাম।
রিদি আবারো মুচকি হাসল,
নীর বলল তুমি এসেছ তাই ঝটপট খিচুড়ি রান্না করতে দিয়েছি।বাইরে তো ঝিম ঝিম বৃষ্টি পড়ছে।তুমি বৃষ্টিতে ভিজে এসেছো নাকি!!
না!! গাড়িতে এসেছি!!শোন সাথে আচার টা দিস!জোস একটা আচার!!
নিচের আন্টি বানিয়েছে। দারুন আচার বানায়।নীর ও পারে!তবে এই মেয়ে যা অলস!!
আপু তুমি কি আমার দূনাম করছ!!
নীরের কথায় নীরের দিকে আড়চোখে তাকালো রায়ান।ওরনা গায়ে মাথা পর্যন্ত ঢেকেছে।ঘুম ঘুম মুখে লাল ওরনা মাথায় দারুন লাগছে।

নীরের কথায় রিদি মুচকি হাসল। রায়ান ব্যাঙ্গ করে বলে,
সুনাম করার মতো কিছু থাকলে না করতো!তোর থেকে দু বছরের ছোট!!অথচ তুই ডক্টর আর সে এখন অনার্স ১ম বষের ছাএী।দু তিনটে বছর তো শোকেই কাটিয়ে দিয়েছে।এখন শোক ছেড়ে জীবনে এগিয়ে যেতেই পারে।
রিদি অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো।তার ভাই তো এমন করে কথা বলে না ।তবে কি!!!রিদি নিজের ভাবনা থেকে একবার নীর তো একবার রায়ানের দিকে তাকাল।নাকি সে বেশি ভাবছে!!রিদির ভাবনার মাঝেই নীর বলে,
একদম আমাকে ফালতু কথা বলবেন না।এমন কিছু আপনার সাথে হলে বুঝতেন!!
রায়ান শান্ত দৃষ্টিতে নীরের দিকে তাকিয়ে বলে,
জীবন তোমার!! দায়িত্ব তোমার!!আমাদের জীবনে অনেক খারাপ সময় আসে!আসবেও!! তাই বলে জীবনকে থামিয়ে রাখা কোন সলিয়েশন না!আমি চাই তুমি তোমার জীবনে এগিয়ে যাও অতীত ভুলে। অতীত ভেবে ভবিষ্যৎ নষ্ট করো না!!

সে যাই হোক!!রোজ উঠেছে নাকি!!
রিদি নীরের দিকে তাকিয়ে বলল,
কি রে উঠেছে!!
নীর হেসে বলে,
উঠলে এতোক্ষণ কেদে কেদে ফুলকো হয়ে যেত।উঠে নি।
রায়ান পরিস্থিতি ঠিক করতে বলে,
মামা হাজির ভাগনী উঠবে না এটা হতে পারে।কোই মামুর রেড রোজ কোথায়!!বলে রিদির ঘরের দিকে চলে গেল!!
রায়ান যেতেই রিদি নীরের কাছে গিয়ে বলল,
ভাইয়ার কথায় কিছু মনে করিস না নীল!!
নীর তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

আপনাতেই আমি পর্ব ৫৮

মনে করি নি আপু!! ঠিকই তো বলছে!!জীবনে থামিয়ে দিলে আমি তো পিছিয়ে পড়ব আপু!!আমি তো জানি আমি পবিত্র!!কারো অপবিত্র বললে তো আর আমি অপবিত্র হয়ে যাব না তাই না!!
রিদি নীরের মাথায় হাত রেখে মুচকি হাসল।সে জানে বলা যতটা সহজ করা ঠিক কতোটা কঠিন।তবে নীরের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে।আগের মতো সে আর মনমরা নেই।হয়তো এই পরিবর্তন ই জীবনে ভালো কিছু আনবে!!

আপনাতেই আমি পর্ব ৬০