আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৫৬
ইশিকা ইসলাম ইশা
রিদির চোখ বেয়ে অশ্রুধারা বয়ছে।মায়ের পরিবার সম্পর্কে তার কখনো কোন ধারনা ছিল না।মাকে যখন বলত নানু বাড়ির কথা মা বলত,
রিদু আমার কেউ নেই।আমি একজন এতিম। একমাত্র তুই ছাড়া আমার কেউ নেই।
মা কষ্ট পেত, কান্না করত দেখে ছোট রিদি কখনো আর নানু বাড়ির ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করত না।তাহলে এমন কি হয়েছে যার জন্য মা নিজেকে এতিম বলে!!সে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল তীরার দিকে।তীরা রিদির মুখখানা দেখে আবারো বলতে শুরু করল।
অতীত,
তখন সন্ধ্যায় আয়োজন চলছে হলুদ সন্ধার।আমাকে দিয়া এসে একটা শাড়ি দিয়ে গেছে পড়ার জন্য। কিন্তু এমন কমদামি শাড়ি আমার পছন্দ হয়নি তাই পড়ি নি।নিজের একটা শাড়ি পড়েই বেরিয়ে এলাম রুম থেকে।দিয়া সহ সবাই বারবার বলছিল কেন তাদের দেওয়া শাড়ি পড়িনি।আমি মিথ্যে বললাম শাড়ির আঁচলটা একটু ছেড়া ছিল।তাই পড়িনি।তিশার মা লজ্জিত হয়ে আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন।আমি ফরমালিটি রক্ষা করলাম।এরপর দেখি সেই নিয়ে দিয়াকে বেশ কথা শুনিয়েছে তিশার মা।মেয়েটা উদাস হয়ে তাকিয়ে ছিল শুধু।কিছু বলেনি।
হলুদ সন্ধার পর চারদিকে তখন পরিবেশ শান্ত।আমি গরমে অতিষ্ঠ হয়ে খোলা জায়গায় দাড়াবো বলে ছাদে আসতেই দেখি দুটো মেয়ে ছাদের এক কোনায় বসে কিছু একটা করছে।মেয়েটা ছিল রাইফা আর দিয়া।রাইফা বকবক করছে আর দিয়া খাচ্ছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তুই কি বলতো!!একটু বলবি আমায় তুই কি আদোও মানুষ?
কেন আমাকে কি তোর পেত্নি মনে হয়?
হ্যাঁ হয়!বিনা দোষে শাস্তি পেতে ভালোবাসিস বুঝি?
আহা খেতে দে তো!খিদায় পেট চু চু করছে!
সে তো করবেই সেই সকালে খেয়েছিস!সারাদিন এটা ওটা করে বেড়াচ্ছিস!তার উপর আন্টি আবার বিনা দোষে শাস্তি দিয়েছে??
বাদ দে তো!আমার অভ্যাস আছে!
কিসের?বিনা দোষে শাস্তির নাকি না খেয়ে থাকার!
দুটোই!!
আন্টিকে সত্যি কেন বললি না তুই শাড়িটা দেখেই দিয়েছিল আমির ভাইয়ার বৌ কে?
বললেও কি আম্মু কি আমার কথা শুনত!
বড়লোকদের যত সব পায়তারা!তুই সবচেয়ে ভালো শাড়িটাই তো দেখে দিলি অথচ ওনার কাছে যেতেই ছিড়ে গেল!
আহা!বাদ দে না!হয়তো ওনার পছন্দ হয়নি তাই এমনটা বলেছে।
ওনার পছন্দ হয়নি।অথচ শাস্তি তুই পেলি!বুঝি না আমির ভাই তিশা আপুকে রেখে এমন মেয়েকে কেন পছন্দ করল।দেখতেই সুন্দর!! মনটা অসুন্দর!
এসব ছাড়!! ভবিষ্যতে কিন্তু তোকে ঐ বাড়িতেই থাকতে হবে!! আরফিন ভাইয়ের বৌ হিসেবে!
ধুর ছেমড়ি!!!
এখন ধূর !!পরে তুমি অমি বহুদূর!!বুঝি বুঝি!!!বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো।
হাসবি না!!
আচ্ছা যা হাসলাম না! কিন্তু তুই কিভাবে জানলি আমি না খেয়ে আছি?
ভাইয়া বলল!!
তোর ভাই আজকাল আমার বেশ খোঁজ রাখে ব্যাপার কি?মাস্টার মশাই কালির প্রেমে পড়ল নাকি!!
তুই কালি বলেই তো আজকে ছেলেরা ড্যাবড্যাব করে দেখছিল তোকে!
তাই বুঝি!!কোই তোর ভাই ছাড়া একটা পোলাও আমাকে বলল না!!
কি বলেছে ভাইয়া??
তোর নিরামিষ ভাইই বলেছে,
এতো সাজার কি আছে মেয়ে!মানুষকে হত্যা করার পায়তরা বুঝি!!
সত্যি!!
তো!!!আমি ভাবলাম কোথায়……….আরে ভাবি আপনি এখানে??কিছুর দরকার ছিল??
না!!তবে রাইফা তোমার ভাইয়ের চয়েস ভালো না!!
রাইফা কিছু বলার আগেই দিয়া ওর হাত ধরে ফেলল।
আসলেও ভাবি ওর ভাইয়ের চয়েস ফালতু!! ঠিক আমির ভাইয়ার মতো!
বলেই রাইফার হাত ধরে টেনে বেরিয়ে গেল।আমি তখন রাগে ক্ষোভে ফুঁসছি।এই গাইয়া মেয়ে তাকে অপমান করে গেল।
সেদিন রাতে আমিরের সাথে আমার ঝরগা হলো।রাতেই চলে যাব আমি।পরে তীব্রর দাদি এসে আমাকে বিয়ের দিনটা থাকতে বলে চলে যায়।আমি দাঁতে দাঁত পিষে সহ্য করে রাতটা পার করলাম।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠে দেখি বিয়ের আয়োজন চলছে।আমি বাধ্য হয়েই রেডি হয়ে নিচে নেমে এলাম।দিয়াকে দেখলাম সেই শাড়ি পড়ে ঘুরঘুর করছে।অথচ রাইফা কামিজ পড়েছে।আমি বুঝলাম দিয়া নামক মেয়েটা হয়তো ইচ্ছে করে শাড়ি পড়ে ঘুরঘুর করছে।আমি নিচে এসে আমিরের পাশে বসলাম।একটু পরেই বর চলে এলো।
আপ্যায়ন করতে করতে পেরুলো ঘন্টা খানেক।আমি ভেবেছিলাম সেনাপ্রধান মানে হয়তো বুড়ো কোন লোক হবে। কিন্তু লোকটা ছিল সুদর্শন পুরুষ। শ্যামবর্ণ পুরুষটি যথেষ্ট সুন্দর।এরপর শুরু হয় বিয়ে,বিদায়। বিদায়ের সময় সেকি কান্না দিয়া আর তিশার।এরপর বিদায় হতেই আমি আসার জন্য জোড়া জোড়ি করলে আমির আমাকে নিয়ে চলে আসে।ঠিক দু’দিন পর আসে তীব্রর দাদা,দাদু আর আরফিন! শুনলাম আরফিনের বিয়ে নাকি রাইফার সাথে ঠিক করে এসেছে। আমার কারো ব্যাপারে এতো ইন্টারেস্ট ছিল না তাই আমার কিছু যায় আসত না কার বিয়ে ঠিক হয়েছে না হয়েছে।
এরপর থেকে কাটতে থাকে সময়।আমি ভার্সিটি, ফ্রেন্ডস, পার্টি,ক্লাব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।আমির পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার সাথে ব্যবসায় মনোযোগ দিল। আমির আমাকে কোন কিছুর জন্য বাধা দিত না।মাঝে মাঝে বুঝাত কিন্তু আমি শুনতাম না।এরপর ঠিক ১ বছরের মাথায় আমি কনসিভ করি।তবে এতো তাড়াতাড়ি বাচ্চা আমার চাই না তাই বাচ্চা নষ্ট করতে চাইলে আমির আমাকে বাঁধা দেয়। সবার জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়ে বাচ্চা টা ক্যারি করতে হয়। আমির আমার বাইরে যাওয়া, ড্রিংকস করা সব কিছু বাদ দিতে বলে।এই নিয়েও তার সাথে আমার তুমুল ঝগড়া হয়।
এইটুকু বলেই থামলেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো বলতে শুরু করল,
প্রেগন্যান্ট হওয়ার কয়েক মাস পর আমার নায়কা হওয়ার অফার আসে।এটা ছিল আমার ড্রিম। ডিরেক্টর ফোন করে আমাকে আসতে বলে। কিন্তু এতেও বাঁধা দেয় আমির। আমার রাগ জেদ আরো বেড়ে গেল।
তখন আমার ৮ মাস চলছে। একদিন হুট করেই আমির হাজির হলো তিশাকে নিয়ে। তিশার তখন ৭ মাস চলছে প্রেগন্যান্সির।তিশাকে হুট করে দেখে আমি অবাক হলাম।একটু পরেই জানতে পারলাম তিশার হাজবেন্ড মিশনে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে সপ্তাহ খানেক হয়েছে।তিশার অবস্থা খারাপ হচ্ছিল দেখে ডক্টর তাকে পরিবেশ পরিবর্তনের জন্য বলে।তাই তীব্রর দাদি আর আমির তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। যেহেতু আমি পরিবারের ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহী ছিলাম না তাই জানতাম না তিশার ব্যাপারে কিছুই।
দিন গড়িয়ে মাসে পদার্পন করল।তখন আমি ৯মাসের অন্তঃসত্ত্বা। হঠাৎ করেই অসহ্য ব্যাথায় চিৎকার করে উঠলাম।বাড়িতে সেদিন কেউ ছিল না।সারভেন্ট ছাড়া।আমার চিৎকার শুনে তিশা ছুটে আসে।লিভার পেইন উঠেছে আমার।পানি ভেঙ্গেছে।তিশা আমাকে ঐ অবস্থায় সারভেন্ট এর সাহায্যে হসপিটালে নিয়ে আসে।অথচ সে নিজেও ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
আমাকে ভর্তি করানোর পরেই ও অসুস্থ হয়ে পড়ে।ওকেও ভর্তি করানো হয়।আর আমার আগেই ওর নরমাল ডেলিভারি হয় তাও ৮মাসে।অথচ আমাকে তখনো অভজাবেশনে রেখেছে।পরের দিন সকালে আমাকে ওটিতে নেওয়া হয়।তখন তীব্র হয়।আমার অনিয়ম এর কারনেই আমার কষ্ট বেশি হয়েছিল।
এরপর আমাকে বাসায় আনা হয়। তীব্র কে ফিডিং আমি করাতে চাইতাম না। অদ্ভুত লাগত।রাগ লাগত।ছেলেটা খাবারের জন্য কাঁদত।এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয় আমিরের সাথে।৭ দিনের ছেলেকে নিয়ে আমির হতাশ ছিল।তুলা এনে খাইয়েও কি মায়ের মতো পুষ্টি পায়!তবে ছেলেটা খেত।দিনের বেশির ভাগ সময় ওর দাদির কাছেই থাকত।আর রাতে আমির সামলে নিত।আমার কোন ঝামেলা হতো না।
সেদিন আমার বাড়ির লোক এসেছে।আমি সবেই বন্ধুদের সাথে দেখা করে ফিরেছি। ড্রয়িং রুমে সবাইকে দেখে ঘাবড়ে গেলাম বিশেষ করে বাবাকে দেখে।বাবার কোলে তখন ছোট্ট তীব্র খেলছে। সেদিন বাবা আমাকে বলেছিল সব কিছু শেষ না করে দিতে পরে পস্তিয়ে আর কুল কিনারা পাবে না।ব্যাস এইটুকুই।এই টুকু কথার মানে তখন আমি বুঝিনি।
এরপর একদিন ঐ ডিরেক্টর আমাকে আবার ফোন করে।আমি এবার কোন কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে যায় এটা নিয়েও আমিরের সাথে তুমুল ঝগড়া হয়।আমি রাগ করে বাড়ি থেকে চলে যায়। বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে উঠি। তীব্র তখন ১মাস বয়স কেবল।আমি এতোটাই নির্দয় মা ছিলাম ১ মাসের ছেলের খোঁজ খবর ও নিলাম না।জীম ফিটনেস নিয়ে পড়ে রইলাম।এর মাঝে আমির এসেছিল ফিরিয়ে নিতে আমি যাই নি। আমার চোখে তখন নায়িকা হওয়ার রঙিন স্বপ্ন।
এরপর ঠিক ২ মাস পর আমি চৌধুরী বাড়িতে গেলাম।তিশা তখন দুই বাচ্চা কে সামলে নিয়েছে। তীব্রর সাথে তীর।তীর তিশার ছেলে। ইভেন তিশা নিজেই তীব্র কে ফিডিং করাতো। তীব্র নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল যার জন্য ডক্টর বলেছে এটা করতে।তিশার তখন দুই সন্তান। তীব্র,তীর তখন ছোট ৩ মাসের ছেলে।আমি চৌধুরী বাড়িতে গিয়েছিলাম মূলত তীব্র কে নিজের কাছে নিতে। কিন্তু তীব্র কে দেয় নি তিশা।তিশা সেদিন বলেছিল,
তীব্র এখনো অনেক ছোট আপু!ওকে নিয়ে গেলে অনেক সমস্যা হবে। তাছাড়া আপনি ব্যস্ত থাকলে তীব্রর কি হবে!!
আমি সেদিন রেগে গিয়ে তিশা কে অনেক বাজে বাজে কথা শোনালাম।আমির আর তিশা কে নিয়েও বাজে কথা বললাম।সেদিন প্রথম বার আমির আমাকে থাপ্পর মেরেছিল।আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিতে চেয়েছিল।আমিও জেদের বসে এর শেষ দেখে ছাড়ব বলেছিলাম।আমি কোট এ যাব বলে হুমকি দিয়েছিলাম।
আবারো থামল তীরা। হাঁপিয়ে উঠেছে যেন।খুক খুক করে কেশে উঠতেই রিদি হতদন্ত হয়ে তীরাকে শান্ত হতে বলল।তীরা কাশির কারনে কিছু বলতে পারল না।একটু পর ডক্টর এসে ইনজেকশন পুশ করে গেল।আর রেস্ট নিতে বলল।রিদির মনে তখনো অনেক প্রশ্ন??
আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৫৫
রাইফা আন্টি তবে তার মায়ের বান্ধবী।যদি বান্ধবীই হয় তবে তার মাকে এতো ঘৃনা করে কেন?কি এমন করেছে তার মা!প্রশ্ন অনেক কিন্তু উওর নেই!রিদি ঘুমন্ত তীরার দিকে তাকিয়ে বসল তার পাশে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।