আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ১০

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ১০
তানহা ইসলাম বৈশাখী

ঘুটঘুটে অমানিশায় ঢাকা কক্ষ। আশেপাশে কোথাও কোন শব্দ নেই। সারাদিন বৃষ্টি হওয়ায় রাতের পরিবেশটাও বেশ ঠান্ডা। খোলা জানালা দিয়ে বাতাসের সাথে ভেসে আসছে ভেজা মাটির সুবাস। রাত এখন অনেকটাই গভীর। মোবাইল ফোনের স্ক্রীনে উপরে দেখা যাচ্ছে রাত ২ টা বেজে ২০ মিনিট।
প্রিয়া এত রাতেও ফেসবুক স্ক্রোল করে যাচ্ছে। ফোনের হালকা আলো ছাড়া রুমে আর কোন আলো নেই।
মেছেঞ্জারে একবার ঢুকে দেখলো হৃদয় এখনো অনলাইনে। হৃদয়ের আইডির ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো কতক্ষন। দাত দিয়ে হাতের নখগুলো খুঁটতে খুঁটতে ভাবলো, মেছেজ কি দিবে একটা? এত রাতে উনি অনলাইনে কি করছে? প্রেম টেম করে নাকি আবার?

অন্য মেয়ের সাথে প্রেমের কথা ভেবেই বুকটা ব্যাথায় বিষিয়ে গেলো। আবার মনকে শান্তনা দেওয়ার জন্য নিজে থেকেই ভাবলো ” না না প্রেম মনেহয় করে না। আমিও তো এত রাতে অনলাইনে। আমি কি প্রেম করছি নাকি। এত রাত পর্যম্ত অনলাইনে থাকলেই কি প্রেম করা হয়ে যায় নাকি। এসব আজাইরা চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল প্রিয়া। তুইই হবি হৃদয় ভাইয়ের একমাত্র প্রিয়তমা।
নিজ মনেই দশ বিশ ভাবতে লাগলো। এরপর আবার কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তে একটা মেছেজ পাঠিয়েই দিলো।
“ভাইয়া কেমন আছেন?”
এই মেছেজটুকু যাওয়া দেরি সিন হতে দেরি হলো না। প্রিয়ার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। এত তাড়াতাড়ি সিন করে ফেললো? মনেহয় মেছেঞ্জারেই বসে ছিলো। এখন ভয় করছে। এত রাতে মেছেজ দেওয়াটা মনেহয় ঠিক হয়নি।
ওপাশে হৃদয় টাইপ করছে। এদিকে তিনটে ডট লাফালাফি করছে সাথে প্রিয়ার হৃৎপিণ্ডটাও সমানতালে লাফাচ্ছে।
হৃদয়ের মেছেজ চলে এসেছে।
“-এইত আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি… তুমি কেমন আছো? এত রাতে অনলাইনে যে?
প্রিয়া নিজের উঠানামা করতে থাকা বুকটাকে শান্ত করে লিখলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“- আসলে ঘুম আসছিলো না এজন্য একটু ফোন দেখছিলাম।
আবারও সাথে সাথে সিন হলো। হৃদয় ওপাশ থেকে লিখলো।
“-তা ঘুম আসছিলো না কেন? প্রেমে পড়েছো নাকি? তোমাদের বয়সী মেয়েরা তো প্রেমে পড়লে ঘুমাতে পারে না।
প্রিয়া লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। হৃদয় ভাই কি করে বুঝলো প্রিয়া প্রেমে পড়েছে? সে কি জানে প্রিয়া যে তারই প্রেমে পড়েছে?
এপাশ থেকে প্রিয়া বললো।
“-এমন কিছু না। কিন্তু আপনি এত রাতে অনলাইনে কি করছেন।
“-আমার কত কাজ। একে ওকে সামলাতে সামলাতেই রাত পার হয়ে যায়।
প্রিয়া বুঝলোনা মেছেজের অর্থটা। লিখলো।
“-মানে?

“-ও তুমি বুঝবে না। আচ্ছা অনেক রাত হয়েছে ঘুমাও তাহলে। বেশি রাত জাগা ভালো নয়।
প্রিয়া মনে মনে ভাবলো এখনই বলে দেই মনের অনুভুতি গুলো। আর কতদিন চেপে রাখবে? শেষে না আবার অন্য মেয়ে এসে তাকে নিয়ে যায়। এরকমটা হওয়ার আগে সব বলে দেওয়ায়ই ভালো। প্রিয়ার ভেতরে অদৃশ্য এক বিশ্বাস জেঁকে ধরেছে। সে জানে একবার হৃদয় ভাইকে মনের কথাগুলো বলে দিলে সে আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না তাকে।
মনে একগাদা সাহস জুগিয়েই লিখলো।
“-ভাইয়া একটা কথা ছিলো।
এবার মেছেজ একটু দেরিতে সিন হলো। হৃদয় ব্যাস্ততা দেখিয়ে বললো।
“-হ্যা বলো।
প্রিয়া বড় একটা শ্বাস নিয়ে কীবোর্ডে ডিরেক্ট টাইপ করলো।
“- I love you… 🙈❤️🥀

কীবোর্ডের লেখাটা সেন্ডও করতে পারলো না। হুট করে ভাইব্রেশন মুডে ফোনটা বেজে উঠলো। অসাবধানতায় হাত থেকে ছুটে গেলো ফোনটা। শুয়ে শুয়ে ফোন দেখায় উপর থেকে একেবারে নাকের উপর এসে পড়লো সেটা। এত জোরে লাগলো যে চোখে পানি এসে গেলো। এমনিতেও নাকে ব্যাথা লাগলে চোখে পানি চলে আসে। এভাবে ফোনটা পড়ায় ব্যাথা পেলো অনেক। মুখের উপর থেকে ফোনটা উঠিয়ে দেখলো অন্ত কল করেছে।
অন্তর ফোনটা দেখেই রাগ উঠে গেলো শরীরে। উঠে বসে ফোনটা রিসিভ করেই চেচিয়ে উঠলো।
“-এই অন্ধের বাচ্চা। ফোন কেন দিছো তুমি?
অন্ত’র ওপাশের শান্ত স্বর।
“-আগে বল তুই এত রাতে অনলাইনে কি করছিস?
“-প্রেম করছি আমি। তোমার সমস্যা?
অন্ত হাত মুঠো পাকিয়ে নিলো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না আর। জোর খাটিয়ে বললো।
“-একটা থাপ্পড় দিয়ে গালের সবগুলো দাত ফেলে দেবো। ওই ফেল্টুসের বাচ্চা বয়স কত তোর? থাপড়ে তোর প্রেম পিরিতি ছুটিয়ে দেবো।

“-তোমাকে ভয় পায় কে? আসো থাপ্পড় দিতে। তোমার দুগালে চারটা থাপ্পড় দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দেবো।
অন্ত ওর কথায় পাত্তা দিলো না উল্টে অধিকার দেখিয়ে বললো
“-তুই কি ঘুমাবি? নাকি আমি আসবো?
“- আশ্চর্য! আমার ঘুম দিয়ে তুমি কি করবে? তুমি এত রাতে অনলাইনে কি করছো ? অসময়ে ফোন দিয়ে আমার নাকটাই ফাটিয়ে দিলে। এখনো ব্যাথা করছে নাকে। শুধু তোমার জন্য পেলাম ব্যাথাটা।
অন্তর কন্ঠ এখন মলিন হয়ে আসলো। আস্তে করে মলিন কন্ঠে বললো।
“-আর আমার ব্যাথা? আমার পুরো ভেতরটাই যে ব্যাথা। সে ব্যাথার দায় কে নেবে ?
প্রিয়া ভ্রু কুচকে বললো।
“-তোমার আবার কিসের ব্যাথা? কি হয়েছে?
“-অসুখ হয়েছে।

“-অসুখ হয়েছে তো ডাক্তার দেখাও। আমাকে কেন জ্বালাচ্ছো?
“- এ অসুখ যদি কোন ডাক্তারকে দিয়ে সারিয়ে তোলা যেতো তাহলে কবেই চলে যেতাম সেখানে।
প্রিয়া এবার একটু চিন্তায় পড়ে গেলো। কি বলছে অন্ত? বড় কোন অসুখ হলো নাকি? এসব চিন্তা মাথায় আসতে উদ্বীগ্ন হয়ে বললো
“-কি হয়েছে তোমার? বড় কোন রোগ হয়েছে?
অন্ত হাসলো প্রিয়ার চিন্তায়। বললো।
“-হুম। আননেক বড় রোগ হয়েছে। এ রোগ নির্দিষ্ট মানুষ ছাড়া ঠিক হবে না।
অন্তর হাসির শব্দ শুনতে পেয়ে প্রিয়া ভাবলো অন্ত ওর সাথে মজা করছে। কটমটিয়ে বললো।
“-তোমার কি আর কাজ নেই? এত রাতে কেন বেহুদা পেচাল পারতেছো আমার সাথে? ফোন রাখো।
“-আগে তুই বল তুই এখন ফোন রেখে ঘুমাবি।

“-আমি যা ইচ্ছে তাই করবো। তুমি ঘুমাও তোমাকে কে বারন করেছে?
“- তুই যা ইচ্ছা তাই করতে পারবি না। তোকে ঘুমাতে বলেছি তুই ঘুমাবি। ব্যাস
“-ঘুমাবো না। কিসের অধিকার দেখাও তুমি আমার উপর?
“-অদৃশ্য অধিকার। যে অধিকার কখনো তোর চোখে পড়বে না। তুই এখন ফোন রেখে ঘুমাবি নয়তো তোর ফোন কি করে নিয়ে যেতে হয় আমার জানা আছে।
প্রিয়া আর কিছু বলতে দিলো না অন্তকে। ফোনটা কেটো দিলো নিজে থেকে। কল কেটে মেছেঞ্জারে হৃদয়ের আইডিতে গিয়ে দেখলো সে পাঁচ মিনিট আগে অফলাইন হয়ে গেছে।
কীবোর্ডের লেখাটাও আর সেন্ড করা হলো না। যেটুকু লিখছিলো ওটুকুও কেটে দিলো। সব রাগ গিয়ে পরছে অন্তর উপর। ও বেশি বাড়াবাড়ি না করলে আজকেই সব হয়ে যেত।
রাগ করে নেট অফ করে ফোনটা বালিসের পাশে রেখে শুয়ে পরলো। মনে মনে একশো একটা গালি দিতে থাকলো অন্তকে।

আজকের সকালেও আকাশটা গুমোট বেঁধে আছে। সূর্যের দেখা নেই। আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। পূবের জানালাটা দিয়ে শীতল হাওয়া প্রবেশ করছে রুমে। হালকা শীত অনুভব করায় প্রার্থ গায়ের কম্বলটা আরো ভালো করে জরিয়ে নিলো গায়ে। আজকেও সোফায় শুতে হয়েছে তাকে। এতটুকু জায়গায় ভালোভাবে শুয়ে থাকতেও পারছে না।
হঠাৎ ঘুমের মধ্যেই অনুভব করলো পায়ের কাছে নরম কিছু একটা আছে। বেশ গরমও জিনিসটা। পুরো শরীরে শীত করলেও পায়ের কাছটায় একদম গরম হয়ে আছে।
প্রার্থর ঘুম ভেঙে যায়। মাথা উচিয়ে পায়ের দিকে তাকালো।
এলাচি প্রার্থর পায়ের উপর ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে। এলাচিকে দেখেই ভয়ে ‘ওই’ বলে চিৎকার দিয়ে পা ঝাড়া দিলো। প্রার্থর ঝাড়ায় এলাচি ছিটকে গিয়ে ফ্লোরে পড়লো।
বিড়ালটা ব্যাথা পেয়ে শব্দ করে ডেকে উঠলো।
প্রার্থ চেচিয়ে উঠলো

“-পুষ্প! এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে সরাবি এটাকে। নয়তো তোকে সহ তোর বিড়ালকে বাড়ির বাইরে ফেলে দিয়ে আসবো।
এলাচির পরার শব্দ আর প্রার্থর চেচানোর শব্দ পেয়েই ঘুম ভেঙে গেলো পুষ্পর। ধপ করে শোয়া থেকে উঠে বসলো। ফ্লোরে প্রিয় বিড়াল ছানাকে পরে থাকতে দেখে অসুস্থ শরীরেই বিছানা থেকে উঠে দৌড়ে এলো। ফ্লোর থেকে এলাচিকে উঠিয়ে দেখলো কোথাও লেগেছে নাকি। হাত দিয়ে আদর করে বললো।
“-এলাচি। বাচ্চা আমার! বেশি ব্যাথা লেগেছে?
প্রার্থর দিকে তাকিয়ে কটমটিয়ে বললো।
“-আপনি কোন ধরনের মানুষ? একটা বোবা প্রানী ও। তার উপরেও একটু মায়া হয় না? মানুষের উপর তো কখনো মায়া দেখানই না একটা প্রানীর উপরও কোন মায়া দয়া হয় না আপনার।
মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে প্রার্থ তাও এই বিড়ালের জন্য। সকাল সকাল মেজাজটা চটে গেছে একদম। চোখ মুখে বিরক্তি ভাব নিয়ে বললো।

“-না হয় না। আমার মাঝে এত দয়া মায়া নেই যে অন্যের প্রতি মায়া আসবে। যেমন উদ্ভট তুই তেমন উদ্ভট তোর বিড়াল তেমনই উদ্ভট তার নাম।
“-আমাদের মাঝে উদ্ভটের কি দেখলেন আপনি?
“-তুই আর তোর বিড়াল দুটাকেই সহ্য হয়না আমার। অথচ দুজনেই আমার আশেপাশে ঘুরে বেড়াস। তারউপর ফালতু একটা নাম দিয়ে রেখেছিস বিড়ালের।
“-ওর নামে আবার আপনার কি ক্ষতি করলো?
“-এলাচি চিনিস? কি জিনিস জানিস? ওটার কি বিশ্রী গন্ধ। সেই বিশ্রী একটা জিনিসের নাম তোর বিড়ালের দিয়ে রেখেছিস। সরা সামনে থেকে।
“- এত যে বিশ্রী বলছেন, ওই এলাচি ছাড়া খাবার খেয়ে দেখিয়েন। না ফ্লেবার আসবে না টেস্ট। জিনিসের একটা দোষ ধরে বসে থাকলে চলে না। যার একটা দোষ আছে তার হাজারটা গুনও আছে।
প্রার্থ সোফা ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে উপহাস করে বললো।
“-হ্যাঁ তোর আর তোর বিড়ালের তো হাজার হাজার গুন। গুন দিয়ে ভরিয়ে রেখেছিস আমার জীবন।
“-অবশ্যই। কিন্তু আফসোস আপনার চোখে আমাদের গুনটা দেখায় যায় না।
“-লাইফটাকে তো হেল করে রেখেছিস। চোখে পড়বে কি করে?
পুষ্প সামান্য হেসে বললো

“-বিয়ের রাতে তো আপনি বলেছিলেন যে আমার জীবনটাকে আপনি হেল করবেন তাহলে আমি কি করে করলাম। এই দায়িত্বটা তো আপনি নিয়ে রেখেছেন।
প্রার্থ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পুষ্পর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঠেস দিয়ে বললো।
“- গন্ডারের চামড়া বলতে একটা জিনিস আছে জানিস তো? তোর চামড়াটাও তাই। এজন্য দায়িত্বটা ঠিকঠাক পালন করতে পারছি না। কারণ তোর গায়েই লাগে না কিছু।
পুষ্প কথাটা কীভাবে নিলো বোঝা গেলো না। সে হেসে হেসে নির্দিধায় বললো।
“-ঠিকই বলেছেন। চামড়াটা এত শক্ত না হলে এই পর্যন্ত টিকতেই পারতাম না। কতগুলো আঘাত পেলাম ইভেন এখনো পেয়েই যাচ্ছি কিন্তু আমার চামড়া তো শক্ত তাই আমার গায়েই লাগেনা। লাগে শুধু মনে। কারন মনটা তো আর এত মোটা চামড়া দিয়ে ঢাকা নেই। সেখানে আঘাতগুলো লেগে একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। এক হিসেবে আপনিই ঠিক আছেন। আপনার মনটা তো পাথর দিয়ে তৈরী। আর পাথর কখনো নরম হয় না।
“-তোকেও একটা বুদ্ধি দেই। মনটাকে পাথর করে নে। বেচে যাবি। নরম মন নিয়ে বেশিদিন বাচতে পারবি না।
“-পাথরকে যে ভেঙে টুকরো টুকরো করা যায় সেটা হয়তো আপনার অজানা। আমি যেমন আছি তেমনই ঠিক আছি।
“-ওকে এ্যাজ ইউর উইস।

সকাল বেলায় প্রার্থ আর কথা বাড়ালো না। এমনিতেও এই মেয়েকে একটা বললে দশটা শুনিয়ে দেয়। অযথা বকবক শোনার চেয়ে এর থেকে দূরে থাকায়ই বেটার।
গায়ে যেই কম্বলটা জরানো ছিলো সেটা উঠিয়ে পুষ্পর মুখে ছুঁড়ে মেরে বললো।
“-এটাকে নিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে দিবি। তোর গুনবতী বিড়ালের লোম লেগে গেছে এতে।
মুখের উপর ফেলে রেখেই চলে গেলো ওয়াসরুমের দিকে।
পুষ্প প্রার্থর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো।
“-আপনাকে ভালোবাসতে হবেই প্রার্থ ভাই। তা নাহলে বুঝবেন কি করে ভালোবাসা কত কষ্টের। আপনাকে আমি ভুগাবো। যেভাবে আপনি আমাকে আপনার প্রেমতৃষ্ণায় ভুগাচ্ছেন ঠিক একইভাবে আপনাকে আমার আমরণ প্রেমতৃষ্ণায় ভুগাবো আমি।

সকাল নয়টা বাজে। ডাইনিং টেবিলে বসে আছে সবাই শুধু অহনা বেগম, আশরাফ সাহেব এবং প্রার্থ বাদে। অহনা এবং আশরাফ সকাল সকাল চলে গেছেন অফিসে। ভাইয়ের মেয়ে এসেছে তার সাথে ভালোভাবে একটু কথাও বলতে পারেনি। অফিসে কাজের এত চাপ যে সারাদিন অফিসেই কাটিয়ে দিতে হয় তাদের।
প্রার্থ হয়তো রুমে আছে। একটু পরেই চলে আসবে। কারন সারাদিন সে যেখানেই থাকুক সকালের নাস্তাটা মায়ের সাথেই করবে।
পুষ্প সবার প্লেটে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। প্রিয়া ডাইনিংয়ে বসে বসে ঝিমাচ্ছে। অন্ত পা দিয়ে প্রিয়ার পায়ে লাথি দিয়ে বললো।
“-খাবার টেবিলে বসে বসে ঝিমচ্ছিস কেন? সারা রাত চুরি করিস? পড়ালেখাও তো করিস না। তাহলে রাতে ঘুমাস না কেন? পুষ্প আপু ওর ফোন নিয়ে যাও ওর কাছ থেকে। তাহলেই ঠিক হবে ও
প্রিয়ার ঘুম শেষ। ঝিমাতে থাকা শরীরে আচানকই জোর চলে এলো। ক্ষোভ ঝেড়ে বললো।
“-তুমি চুপ করবে? আমার প্রতিটা জিনিসেই তোমার সমস্যা। আমি ঘুমালেও দোষ না ঘুমালেও দোষ। আর আমার ফোন নিবে কেন?এটা আমার ফোন।
পুষ্প চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো।
“-অন্ত তো ঠিকই বলছে। সারা রাত ঘুমানো বাদে ফোন দেখিস বলেই তো ঝিমাচ্ছিস। এরকম চলতে থাকলে সত্যিই ফোন নিয়ে নিবো দেখিস।

প্রিয়া কথা বাড়ালো না আর। শুধু মুখ বাকিয়ে বিড়বিড় করলো।
“-হুহ্! আমি ফোন দিলে তো তুমি নিবে।
হুট করে সানা বলে উঠলো।
“-তোমরা সবাই প্রার্থকে ছাড়াই খেতে বসে পরলে? ওর জন্য কি অপেক্ষাও করতে পারলে না পুষ্প? আফটার অল এখন তোমার হাবি সে। নাকি তোমাদের মাঝে তেমন হাসবেন্ড ওয়াইফ সম্পর্কই নেই?
পুষ্প দাতে দাত চেপে ধরলো। পূর্নিমা বেগমের দিকে একবার তাকালো। তিনি কপাল গুটিয়ে তাকিয়ে আছে সানার দিকে। পুষ্প জোরপূর্বক হেসে বললো।
“- খাওয়ার সময় হাসবেন্ডের জন্য অপেক্ষা না করলেই যে তাদের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর মতো সম্পর্ক হয় না এটা তোমাকে কে বললো? শোনো, বুঝা ভালো বাট অতিরিক্ত বুঝা ভালো না। উনি এখনই নিচে নামবে। আমি কিন্তু এখনো খাবার নেইনি আমার প্লেটে। বুদ্ধিটা আমাদের সম্পর্কের মাঝে না খাটিয়ে অন্য কোথাও খাটাও। কাজে আসবে।

তখনই উপর থেকে ধুপধাপ পা ফেলে সিঁড়ি নেমে নিচে আসলো প্রার্থ। একেবারে ফর্মাল গেটআপে এসেছে। কাঁধে গিটার ঝুলিয়ে রেখেছে। সে এসেই মায়ের পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। গিটারটা নামিয়ে রাখলো নিচে।
পুষ্প উঠলো প্রার্থর প্লেটে খাবার দেওয়ার জন্য। কিন্তু প্রার্থ তার আগেই নিজের প্লেটে নিজের খাবার তুলে নিলো। পুষ্পও আর এগোলো না।
পূর্নিমা বেগম ছেলেকে প্রশ্ন করলেন।
“-এখন কোথায় যাবি গিটার নিয়ে?
“-স্টুডিও তে যাবো মা।
“-আজ নাকি পুষ্পর সেমিস্টার ফি দিতে যেতে হবে। আরো কি কি কাজ আছে ভার্সিটিতে। ওর সাথে তুই একটু যা বাবা।
প্রার্থ পুষ্পর দিকে তাকালো। ভ্রু গুটিয়ে বললো।
“-তোর সেমিস্টার?
পুষ্প শুধু বললো
“-হু।
“-তাহলে টাকা নিয়ে….

প্রার্থকে কিছু বলতে না দিয়ে পুষ্প বললো।
“-টাকা তো আপনি দিয়েছেন। আমি বলেছি তো বড়আম্মুকে। আমি বলেছি সেমিস্টার ফি এর টাকা আপনি আমাকে কাল রাতেই দিয়েছেন।
প্রার্থর ভ্রু কুচকে এলো। সন্দিহান গলায় বললো।
“-আমি কখন….
এবারো কথা সম্পন্ন করতে দিলো না। তার আগেই কথা ঢাকতে বললো।
“-আরে আপনাকে যেতে হবে না। সমস্যা নেই। আমি গিয়ে দিয়ে আসতে পারবো। আপনি স্টুডিওতেই চলে যান। আমি সুরাইয়ার সাথে ভার্সিটি গিয়ে সব কমপ্লিট করে আসবে।
প্রার্থ হয়তো এবার বুঝলো আসল ঘটনাটা। তবে কিছু বললো না এখনই।
পূর্নিমা বেগম বললেন।
“- তোর শরীরটা এমনিতেই ভালো নেই। প্রার্থর সাথে যা আসার সময় ডাক্তারের কাছ থেকে মাথার ব্যান্ডেজগুলোও খুলে নিয়ে আসিস।
“-প্রার্থ ভাই তো স্টুডিও তে যাবে। কাজ আছে হয়তো। আমি সুরাইয়ার সাথে মিলে সব করে নিতে পারবো। তুমি চিন্তা করো না। এমনিতেও কদিন পর থেকে ভার্সিটিতে রেগুলার হতে হবে। অনেকদিন অফ গেছে। আজ ভাবছিলাম ক্লাসটাও করে আসবো।

“-তবুও তুই প্রার্থর সাথেই যা। প্রার্থ বাবা তুই ওকে শুধু একটু দিয়েই আয় নাহয়। নাহলে আমি চিন্তায় থাকবো। এমনিতেই মেয়েটা অসুস্থ। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেনি এখনো। এখন ওকে একা ছাড়তে ভয় করছে।
প্রার্থকে কিছু বলতে না দেখে সানা বলে উঠলো।
“-পুষ্পর সাথে তাহলে প্রিয়া চলে যাক। দুইবোন গেলে সমস্যা হবে না।
এরপর প্রার্থর দিকে তাকিয়ে আবার বললো
“-প্রার্থ আজ না আমাকে শপিংয়ে যেতে হবে। তুমি বিকালে ফ্রী আছো তো? ভাবছিলাম বিকালে তোমার সাথে শপিংয়ে যাবে।
প্রার্থ খাবারে মনোযোগ রেখেই বললো।
“-ফালতু সময় নেই আমার।
সানা অপমান বোধ করলেও কিছু বললো না। দাতে দাত চেপে বসে রইলো।
ড্রয়িংরুম থেকে ভেসে এলো টিভির আওয়াজ। প্রান্ত খাবার খেয়েই বসে গেছে টিভি দেখতে।
সেখান থেকে স্পষ্ট ভেসে আসছে খবর চ্যানেলের উপস্থাপিকার স্পষ্ট আওয়াজ

“- সিঙ্গার ইউভান প্রার্থ চৌধুরীর প্রেমের গুঞ্জনে ভাসছে নেট দুনিয়া। এ এম কলেজে এলিগেন্ট রাইটার্স দের কনসার্টের সময় বড়সড় হাঙ্গামা তৈরী হয়। সেখান থেকেই একটা ভিডিও ক্লিপ কাল রাতে নেটে বেশ ভায়রাল হয়েছে। সেখানে দেখা যায় একটা মেয়ের আঘাত লাগায় প্রার্থ চৌধুরী নিজে গিয়ে মেয়েটাকে কোলে করে বের করে নিয়ে আসে। ভিডিওটা কাল রাতে সম্প্রচার করার পর থেকেই শোনা যাচ্ছে মেয়েটি তার প্রেমিকা। শোনা যায় কলেজ লাইফে তার প্রেমিকা ছিলো একজন। এরপর আর কোন মেয়ের সাথে তাকে দেখা যায়নি। এখন….
টিভিতে আর কিছু শোনা গেলো না। প্রার্থ গিয়ে টিভিটাই অফ করে দিয়েছে। সবাই স্পষ্ট শুনেছে মহিলার সব কথা।
সানা প্রার্থকে উদ্দেশ্য করে বললো।
“-তার মানে কেউ জানে না তোমাদের বিয়ে হয়েছে?
অন্ত বললো।

“-ভাই তোমার এখন বিয়ের ব্যাপারটা খুলাসা করা উচিত। সবাই তোমার বউকে তোমার প্রেমিকা ভাবছে।
প্রার্থ প্লেটে হাত ধুতে ধুতে বললো।
“-সো হুয়াট?
প্রিয়া বললো।
“-তুমি কি চাও না মানুষের ভুল ধারনাটা ভেঙে যাক। তুমি না বললে সবাই তো প্রেমিকাই ভাববে।
পুষ্প বললো।
“-ভাবতে দে তো। মানুষের কাজই ভাবা।
“-তবুও এখন জানানো উচিত ছিলো।
পুর্নিমা বেগমও তাই বললেন।
“-তাইতো। সবাই জানুক তোদের বিয়ে হয়েছে। দরকার হয় আমরা আবার বড় করে অনুষ্ঠান করবো। তোদের বিয়ে তো একদম সাদামাটা হয়েছে।
প্রার্থ বললো।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৯

“-দরকার নেই মা। সবাই এমনিতেই জেনে যাবে। এবিষয় টা এখানেই শেষ করো।
পুষ্প তৈরী হয়ে বাইরে আয়। তোকে ভার্সিটিতে দিয়ে স্টুডিওতেও যেতে হবে আমাকে।
পুষ্প অবিশ্বাসের ন্যায় তাকালো প্রার্থর দিকে। প্রার্থ যে পুষ্পকে ভার্সিটি দিয়ে আসতে চাইবে তা কল্পনাতীত ছিলো। সন্দিহান গলায় বললো।
“-আপনি যাবেন?
“-তো কি বললাম আমি এখন? সময় নেই আমার। পাঁচ মিনিটের ভেতর বাইরে আসবি।
পুষ্পকে আসতে বলে আর সময় নষ্ট করলো না। গিটারটা কাধে উঠিয়ে মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে গেলো।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ১১