আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২২

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২২
তানহা ইসলাম বৈশাখী

সন্ধ্যার পরবর্তী সময়। কার্তিক বিয়ের আসরে বসে পরেছে। পুরোহিত বিভিন্ন মন্ত্র পাঠ করছে। এবার কনে কে আনা হবে। ছেলেটা অধীর আগ্রহে বসে আছে হবু বউয়ের জন্য কিন্তু বউকে কেউ আনছেই না। আর যে কত সময় লাগবে। বিয়ের এমন সময়ে কি আর দেরি সহ্য হয়?
এদিকে আরেক ঝামেলায় পরলো অর্নব। এরকম সময়েই তার মা ফোন করেছে। তারা নাকি এখন আসছে। এসে পরেছে প্রায়। অর্নবকে গেট থেকে এগিয়ে আনতে যেতে হবে। কার্তিকের তরফ থেকে ওর বন্ধুর বাড়ির সকলকে দাওয়াত করা হয়েছে। রকির বাবা মা এসেছেন কিছুক্ষণ আগেই হৃদয়ের বাসা থেকে কেউ আসেনি। প্রার্থর বাসার থেকে বড়রা আসতে পারেনি তবে ছোটরা সকলেই এসেছে।
এখন অর্নবদের পরিবার থেকে আসলেই সব কমপ্লিট।
ছেলেটা ফোন হাতে তারাহুরোয় বাইরের দিকে যাচ্ছে। চোখ ফোনের স্ক্রীনের উপর। আরেকবার ফোন করবে ভাবছে। এতক্ষণে তো গেটের সামনে আসার কথা৷

বাবার নাম্বারে ডায়াল করে কেবলই ফোনটা কানে তুলবে তার আগেই অসাবধানতায় বারি খেলো একটা মেয়ের সাথে। তৎক্ষনাত ফোনটা পরে গেলো হাত থেকে। মেয়েটাও সমান ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলো। অর্নব দুহাত বাড়িয়ে তার কোমড় জড়িয়ে আটকে দিলো। দুজনে পরতে পরতেও বেচে গেলো।
মেয়েটা ভয়ে চুপসে গেছে। দুচোখ খিঁচে আছে। মেয়েটার পরনে শাড়ী। অর্নব তাকে পড়ে যাওয়া থেকে বাচাতে কোমড় জরিয়ে ধরেছিলো। একহাত তার গিয়ে স্পর্শ করেছে মেয়েটির উন্মুক্ত কোমড়।
মেয়েলি শরীরে হাত পড়ায় সাথে সাথে হাত ছেড়ে দেয় অর্নব। মেয়েটির শরীরের ভর অর্নবের হাতে ছিলো। সে হাত ছেড়ে দেওয়ায় মেয়েটি পড়ে যেতে নেয়। সাথে সাথে অর্নবের গলা জড়িয়ে ধরে। গলা ধরে ঝুলে যাওয়ায় অর্নব আরো ঝুঁকে যায়। মুখোমুখি হয় দুজনের মুখ।
মেয়েটা হতভম্বের মতো তাকায় অর্নবের দিকে। অর্নব আবারো তার কোমড় ধরে। টান দিয়ে সোজা করে মেয়েটাকে। নিজেও সোজা হয়ে দূরে দাড়ায়। ভদ্রতার খাতিরে বলে।
“-আপনি ঠিক আছেন?
মেয়েটা একটু লজ্জা পেয়েছে বোধহয়। মাথা নিচু করে বলে।
“-জি। আপনি ঠিক আছেন? দুঃখিত আমি দেখতে পাইনি।
অর্নব ভদ্রতা বজায় রেখে বললো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“-ইট’স ওকে। আমারও দোষ ছিলো। আমি খেয়াল করিনি।
অর্নব ফোনটা তুলে নিচ থেকে। উপরের গ্লাস খানিকটা ফেটে গেছে। মেয়েটা ফাটা গ্লাস দেখে বললো।
“-একি! ভেঙে গেলো তো। আমি সত্যিই দুঃখিত। আমি জানতাম না……
মেয়েটাকে আর বলতে দিলোনা। দোষ যেহেতু অর্নবেরও তাই তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বললো
“-ইট’স ওকে। আপনার ভুল নেই। এটাতে সমস্যা নেই। গ্লাস বদলে নিলেই হবে। আপনাকে সরি বলতে হবেনা। যেতে পারেন
মেয়েটা আচ্ছা বলে চলে যেতে নিলো। তার আগেই ভেসে এলো কারো গলার স্বর।
“-মেয়েটি কে অর্নব?
মেয়েটি সম্বোধন করায় সে যেতে যেতেও থেকে যায়। পেছনে ঘুরে দেখে একজন প্রৌঢ়া তার দিকেই তাকিয়ে আছে। অর্নব মহিলাটির উদ্দেশ্যে বললো।
“-তোমরা এসে পড়েছো?
আবার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো।
“-চিনিনা আম্মু।

কথা শুনে মনে হলো মহিলাটি অর্নবের মা। সাথে আরেকজন ভদ্রলোকও ছিলো। হয়তো তার বাবা হবে। মহিলাটি এগিয়ে গেলো মেয়েটার দিকে। বললো।
“-তোমার নাম কি মা?
মেয়েটা মাথা নিচু করে বললো।
“-স্নেহা।
“-বাহ বেশ মিষ্টি নাম। তুমি চেনো অর্নবকে?
মেয়েটি দুপাশে মাথা নাড়লো।
অর্নব মুখে ‘চ’ সূচক শব্দ করে বললো।
“-আম্মু! উনার সাথে ধাক্কা লেগেছিলো। পরে যেতে নিয়েছিলো তাই ধরেছি। বেশি ভেবোনা তো।
তিনি ধমক দিলেন ছেলেকে।
“-তুই চুপ কর। আমি কি তোর জন্য জিজ্ঞেস করছি নাকি। এমনি ভালো লাগলো তাই কথা বললাম।
“-আচ্ছা ঠিক আছে। চলো ভেতরে চলো। আব্বু এসো। বিয়ে শুরু হয়ে গেছে। কার্তিক রাগ করবে।
অর্নব তার বাবাকে নিয়ে হাটা ধরলো। ভদ্রমহিলা স্নেহার হাত ধরে বললো।
“-তুমিও তো ভেতরে যাবে তাইনা? চলো একসাথে যাই। কিছু মনে করো না। আমি আবার অনেক মিশুক।
মেয়েটা মাথা নাড়িয়ে বললো।
“-ঠিকাছে সমস্যা নেই আন্টি চলুন।
ভদ্রমহিলা তার হাত ধরেই হেটে গেলেন সামনের দিকে। অদূর হতে কারো ঈগল নজর পর্যবেক্ষণ করে গেলো সবটা। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো রহস্যময়ী হাসি। যে হাসির অর্থ বোঝার ক্ষমতা নেই কারো।

বিয়ে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। নতুন বর-বউকে স্টেজে বসিয়ে রাখা হয়েছে। একটু পর প্রার্থদের গানের পারফরম্যান্স করা হবে।
প্রিয়াকে সারা সেন্টার খুজেও কোথাও পায়নি। শেষমেষ ছাদে গিয়ে মিলেছে তার দেখা। তখন থেকে সেই ছাদেই ছিলো। পুষ্পর তো ভয়ে জান শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা। ছাদে ছিলো বলে প্রশ্ন করা হয়েছে কেন এতক্ষণ সেখানে ছিলো। প্রিয়া স্বাভাবিকভাবে জবাব দিয়ে ভালো লাগছিলো না তার। মাথা ব্যাথা করছিলো তাই শোরগোল থেকে দূরে ছিলো।
পুষ্প আর প্রশ্ন করেনি। চেয়ারে বসিয়ে রেখেছে তাকে। কিন্তু অন্তর এখনো খবর নেই। প্রার্থ ফোনও করেছিলো ওকে ফোনও তুলেনি।
প্রার্থ প্রিয়াদের কাছে আবার এলো। প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো।

“-অন্ত কোথায়?
প্রিয়া বসে ছিলো। শান্ত স্বরে বললো।
“-আমি জানিনা।
প্রার্থ গম্ভীর হয়ে আবার বললো।
“-ফোন করছি ফোন ধরছে না কেন?
পুষ্প পাশে ছিলো। প্রার্থর প্রশ্ন শুনে ভ্রুকুটি করে বললো।
“-সেটা ও কি করে জানবে? ফোন তো আমিও করছি। তুলছে না তো। কোথায় গেলো না বলে? বাসায় একটা ফোন করা দরকার।
প্রার্থ পুষ্পর দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো
“-প্রয়োজন নেই। আমি দেখছি।
প্রার্থ যেতে নেয়। তখনই পেছন থেকে ডেকে উঠে অন্ত।
“-ভাই ফোন করেছিলে?
একসঙ্গে সবগুলো চোখ বার্তালো অন্ত’র উপর। অন্তর চোখ মুখের বিদ্ধস্ত অবস্থা। লাল লাল হয়ে আছে চোখ। প্রিয়া একবার ওর দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।
প্রার্থ কড়া গলায় প্রশ্ন করলো।
“-কোথায় ছিলি? ফোন করছি তুলছিস না কেন?
অন্ত মাথা নিচু করে বললো।

“-মাথা ব্যাথা করছিলো তাই বাইরে গিয়েছিলাম। আর ফোন সাইলেন্ট ছিলো এজন্য তুলতে পারিনি।
প্রার্থ অন্ত, প্রিয়াকে পরখ করে একই স্বরে বললো।
“-তোদের দুজনের মাথা ব্যাথা একসাথেই হলো?
অন্ত তাকালো প্রিয়ার দিকে। প্রিয়াও একই সময় তাকালো। দুজন চোখাচোখি হতে আবার চোখ সরিয়ে নিলো। আজ তো সব জানে প্রিয়া তাই আজ অন্তর সবকিছুতেই অস্বস্তি হচ্ছে তার। এইযে পাশে দাঁড়িয়ে আছে তাতেও অস্বস্তি লাগছে। অথচ বিষয়টা আজকের আগে হলে চৌদ্দবার তাকে খোঁচা মারতো।
তবে আজ দুপুরের পর থেকে বিষয়টা ভিন্ন। অনুভুতিগুলো ভিন্ন, সম্পর্কটা ভিন্ন। আজ থেকে তাদের সম্পর্কে নতুন অদৃশ্য দূরত্ব সৃষ্টি হলো যা আদোও ঘুচবে কিনা জানা নেই কারো।
অন্তকে চুপ দেখে পুষ্প বললো।
“-তোরা দুজন কি করিস বুঝিনা। মাথা ব্যাথা করছে আমাকে বলতি। আমাকে বলে বাইরে যেতি। না বলে গেছিস সেই কখন। চিন্তা হয় না?
অন্ত মাথা নিচু করে বললো।
“-সরি। বুঝিনি তোমরা চিন্তা করবে।
প্রার্থ তাড়া দেখিয়ে বললো।
“-ভালো না লাগলে প্রিয়া আর প্রান্তকে নিয়ে বাড়িতে যা। আমি আর পুষ্প পরে আসবো।
পুষ্প প্রার্থর কথায় পাত্তা দিলো না।মুখ কালো করে অন্তকে বললো।

“-আমিও তোদের সাথে যাবো। তোরা এখন যাবি বাসায়?
প্রান্ত লাফিয়ে উঠলো।
“-না না আমি যাবোনা এখন। আমি প্রার্থ ভাইয়ের গান শুনেই যাবো।
“-ঠিকাছে তারপরেই নাহয় যাবো চারজন।
প্রার্থ ধমকালো পুষ্পকে।
“-চুপ। তোকে আমি যেতে বলেছি? ওরা তিনজন যাবে। তুই আমার সাথে যাবি। আর কোন কথা নয়। আমি এসে যেন সবকটাকে এখানেই পাই।
হুকুম দিয়েই চলে গেলো প্রার্থ। চুপচাপ মুখ গুজে বসে রইলো চারজন। ওদের গান শুনেই নাহয় যাবে। তাছাড়া এত তাড়াতাড়ি গেলে কার্তিক ভাইও রাগ করতে পারে।

লাইট’স অফ। মানুষজন চুপচাপ বসে পড়েছে রাইডার্সদের পারফরম্যান্স দেখার জন্য। কনসার্ট ছাড়াই গান হবে আজ। তবে আজ সেখানে কার্তিক নেই। সে বর। বউয়ের সাথে বসে মজা নিবে শুধু।
লাইট অফ ছিলো। হুট করে কতগুলো অন হয়ে গেলো। সেগুলোর আলো সরাসরি প্রার্থদের উপরে পড়েছে। এক সারিতে চারজন বসে আছে টুলের উপর। সামনে স্ট্যান্ট মাইক। প্রর্থর হাতে গিটার। সবার হাতে হাতে একটা করে বাদ্যযন্ত্র।
প্রথমে গিটারে সুর তুললো প্রার্থ। অর্নব হৃদয় রকির কপাল কুচকে গেলো। কারন তারা যে গানের প্রিপারেশন নিয়েছিলো এটা সে গানের সুর নয়। রকি, হৃদয় অর্নবের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালে। অর্নব চোখ দিয়ে ইশারা করলো যাতে কিছু না বলে এখন।
আবারও ইশারায় বোঝালো ‘কিছু করিস না। ও যেটা তুলেছে সেটাই বাজা।
ওরাও আর কিছু বললো না। প্রার্থ যে গানের সুর তুলেছে সেটাই বজালো। এরমধ্যে গান শুরু করে দিলো প্রার্থ। চোখ সরাসরি বসা পুষ্পর দিকে অটল রেখে গাইলো।

Tum mere ho iss pal mere ho
Kal shayad yeh aalam na rahe
Kuch aisa ho tum tum na raho
Kuch aisa ho hum, hum na rahein…
Yeh raaste alag ho jaaye
Chalte chalte hum kho jaayein…
Main phir bhi tumko chahunga
Main phir bhi tumko chahunga
Iss chahat mein marr jaaunga
Main phir bhi tumko chahunga
Meri jaan mein har khamoshi mein
Tere pyaar ke naghme gaaunga
Mmm…
Main phir bhi tumko chahunga
———-
Aise zaroori ho mujhko tum
Jaise hawayein saanson ko
Aise talashun main tumko
Jaise ki per zameeno ko
Hansna ya rona ho mujhe
Paagal sa dhoondu main tumhe
Kal mujhse mohabbat ho na ho
Kal mujhko ijazat ho na ho
Toote dil ke tukde lekar
Tere darr pe hi reh jaaunga
Mmm…
Main phir bhi tumko chahunga

আরিজিৎ সিং এর পুরো গানটা গেয়ে থামলো সে। চারিদিক থেকে ভেসে এলো হাততালির আওয়াজ। গান গাওয়ার পুরোটা সময় তার চোখের সামনে ছিলো পুষ্প। একধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে গেয়েছে।
ওরকম চাহনিতে পুষ্পর শিরদাঁড়া সোজা হয়ে যায়। বুকের ভেতরের উচাটন বেড়ে যায়। এমনিতেই প্রার্থ পুষ্পের প্রেমতৃষ্ণায় বেকাবু। তার উপর এমন চাহনি সহজে হজম হয় না। এরকম করে তাকালে কি দূরে যেতে ইচ্ছে করে? গানের অর্থগুলোও কেমন যেন। মনে হলো তাকেই বলা হচ্ছে এগুলো। গানের প্রতিটা লাইনে প্রতিটা প্রতিটা সুরে কেঁপে উঠছিলল সে। লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলো বারবার।
ততক্ষণে তাদের আরেকটা গান শুরু হয়ে গেলো। পুষ্প আর বসে থাকতে পারলো না। উঠে চলে গেলো হরবার করে।

প্রার্থদের মিউজিক পারফরম্যান্স শেষ। সেখান থেকে বেড়িয়েই খুজলো পুষ্পকে। মেয়েটা প্রথম গান শুনেই চলে গেলো। প্রার্থর এত রাগ হয়েছিলো তখন। মন চাইছিলো উঠে গিয়ে টেনে এনে চুপচাপ সামনে বসিয়ে রাখতে। কিন্তু এত মানুষের ভীরে তা করা সম্ভব নয়। এখন এদিক ওদিক খুজছে কিন্তু পাচ্ছে না।
পেলো প্রিয়া প্রান্তকে। ওদেরকে পাঠিয়ে দিলো অন্তর সাথে। যদিও প্রিয়ার অন্তর সাথে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না। তবুও গেলো। এখানে আর ভালো লাগছে না। আজ সারাটাদিন মেয়েটা মনমরা হয়ে ছিলো।
প্রার্থ ওদের জন্য উবার বুক করে দিয়েছে। কারন গাড়ি একটাই এনেছে। আর সেটাতে করে প্রার্থ আর পুষ্প যাবে।
উবার চলে এসেছে হলের সামনে। প্রিয়া প্রান্ত পেছনে উঠে বসলো। অন্ত হতাশ শ্বাস ছেড়ে সামনে উঠে বসলো। নীরবে বসে থেকেই চললো কিছুক্ষন। অন্ত আর না পেরে ডাকলো প্রিয়াকে।

“-প্রিয়া!
এরকম কোমল মায়াভরা ডাকের বিপরীতে ভেসে এলো কাঠখোট্টা আওয়াজ।
“-মামা গাড়ি জলদি চালান। বাসায় যাবো।
কার রাগ কার উপর বার্তালো ঠিকই বুঝলো সে। তবুও হাল ছাড়লোনা। পেছনে ঘুরে বললো।
“-এমন কেন করছিস আমার সাথে?
সে উল্টো তেজি গলায় প্রশ্ন করলো
“-তুমি জানোনা কেন করছি?
অন্ত চুপ হয়ে গেলো। এরপর আর কি বলবে বুঝতে পারছে না। তাছাড়া প্রান্তর সামনে কিছু বলতেও চাইছেনা।
প্রান্ত ওদের দুজনকে একটু পরখ করে ভ্রু গুটিয়ে বিজ্ঞের ন্যায় বললো।
“-ব্যাপার কি বলো তো? তোমাদের দুজনের আবার ঝগড়া হয়েছে? তোমরা তো দেখি আমার থেকেও বেশি ছোট। আমি স্কুলে আয়রার সাথেও তো এত ঝগড়া করিনা। তোমরা সারাদিন কি করে ঝগড়া করো?
প্রিয়া দিলো ধমক।
“-তুই চুপ থাক। ভালো লাগছে না।
প্রান্ত রেগে বললো।
“-তুমি অন্ত ভাইয়ের রাগ আমার উপর কেন ঝাড়ছো প্রিয়াপু?
অন্ত থামালো তাকে। শান্ত গলায় বললো।
“-প্রান্ত। চুপচাপ বস। এত কথা বলতে হবেনা তোকে।
প্রান্ত রেগেমেগে চুপ হয়ে গেলো। আজকাল ভালো কথারও কোন দাম নেই। দুজনের রাগ দুজনেই তার উপরে উঠাচ্ছে। ও ছোট হতে পারে কিন্তু ওদের রাগ নিজের উপর ফেলতে দিবে না। চুপ হয়ে রইলো ছেলেটা। অন্তও আর কথা বললো না। চুপচাপ রইলো সারাটা পথ।

রাত প্রায় দুইটা। বিয়ের সকল নিয়ম কানুন শেষ। যে যে যার যার মতো চলে যাচ্ছে। প্রার্থও মাত্র পুষ্পকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। হৃদয়, অর্নব আর রকি এক গাড়িতে যাবে। হৃদয় মোহকে বাড়িতে পৌছে দিয়েছিলো অনেক আগে। এখন বন্ধুদের সাথে আবার রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
অর্নবদের গাড়ি আগে ছেড়ে গেলো। প্রার্থও গাড়ি স্টার্ট করলো। একবার আড়চোখে পুষ্পর দিকে তাকাতে দেখলো পুষ্প সিটবেল্ট বাধেনি। এবার আর বেল্ট বাধার আগেই গাড়ি ছুটালো না। না তাকে বললো বেল্ট বাধতে। সে নিজে এগিয়ে গিয়ে বেল্টটা বেধে দিলো। পুষ্প অবাক না হয়ে পারলো না। প্রার্থর ব্যাবহার ওর কাছে কোনমতেই সুবিধার ঠেকলো না। কিছু তো একটা হয়েছে যার জন্য প্রার্থর ব্যাবহার এত চেঞ্জ হয়েছে। কিছু না হলে তো সে এভাবেই গাড়ি চালাতো। পুষ্পর সিটবেল্ট বেধে দেওয়া তো দূর ওর দিকে তাকাতো না পর্যন্ত। তাহলে হঠাৎ কি এমন হলো যার কারনে এত খাতির যত্ন করছে? প্রশ্ন তৈরী হলো মনে অনেক কিন্তু উত্তর খুজে পেলো না
প্রার্থ গাড়ি চালাতে শুরু করলো। ড্রাইভ করছেও খুব ধীরে। কিছুক্ষণ চলার পর প্রার্থই প্রশ্ন করলো।

“-তখন ওভাবে চলে গেলি কেন?
পুষ্প ভ্রু কুচকে বললো
“-কখন?
“-যখন তোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তাকিয়ে ছিলাম বলে উঠে গেছিস?
সরাসরি কথাটায় ঘাবড়ে গেলো পুষ্প। ও কি করে জানলো ওর তাকিয়ে থাকার জন্যই পুষ্প উঠল গেছে।কিন্তু সে তাকিয়ে কেন ছিলো?
মনে প্রশ্নটা উঠতেই সেটা শব্দে পরিনত করলো
“-আপনি তাকিয়ে ছিলেন কেন?
প্রার্থ গা ছাড়া উত্তর।
“-আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই। আমার জিনিসে আমি তাকাবো না তো কে তাকাবে?
পুষ্প না বুঝে বললো।
“-মানে?
প্রার্থ পুষ্পর দিকে তাকালো। স্বাভাবিকভাবে বললো।
“-মানে বুঝতে হবে না। আমাকে বুঝলেই হবে।
পুষ্প ভ্রু গুটিয়ে বললো।
“-আপনাকে ঠিক বুঝতে পারছিনা। আজকাল আপনার ব্যাবহার আমার ঠিক হজম হচ্ছে না। আপনি কি মতলবে এমন করছেন কিছুই বুঝতে পারছিনা।

“-আমার ব্যাবহারই হজম করতে পারিস না আমার ভালোবাসা কি করে হজম করবি?
পুষ্প কেপে উঠে। প্রার্থর এমন কথায় সে দূর্বল হয়ে পড়ে। অথচ সে চায় না দূর্বল হতে। দূর্বল তো অনেক হলো। দূর্বল হয়ে বুঝলো যে দূর্বলদের কেউ মূল্য দিতে পারে না। সম্মান করতে পারে না। শুধু তুচ্ছতাচ্ছিল্যই করতে পারে। কিন্তু পুষ্প কারো তাচ্ছিল্য সহ্য করবে না আর। সে সামনে তাকিয়ে কড়া গলায় বললো।
“-ভালোবাসাও চাইনা সেটা হজম করতেও চাইনা।
প্রার্থ কিছু বলবে তার আগেই পুষ্প বড় বড় চোখ করে চিৎকার করে উঠলো।
“-সামনে দেখুন প্রার্থ ভাই।
প্রার্থ সামনে তাকিয়ে সাথে সাথে ব্রেক কষলো গাড়ির। আরেকটু হলেই গাড়ি বারি খেত রাস্তার মাঝে থাকা বড় বড় পাথরের সাথে। মাঝ রাস্তায় অনেকগুলো বড় পাথর দিয়ে পৎ আটকে রেখেছে কেউ। আশেপাশে তেমন গাড়িও নেই। একেবারে মাঝ রাস্তায় সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে সেগুলো।
প্রার্থ দরজা খুলে নামতে যায় গাড়ি থেকে। পুষ্প তার হাত ধরে ফেলে। চিন্তিত স্বরে বলে।

“-যাবেন না। গাড়ি ঘোরান। অন্যদিক দিয়ে যাই।
পুষ্পর ধরে রাখা হাতটার দিকে তাকালো প্রার্থ। এইটুকু ছোয়ায় কি প্রশান্তি যে অনুভব করলো তা যদি পুষ্প দেখতো। প্রার্থ পুষ্পর হাতের উপর নিজের হাত রাখলো আলগোছে। ভরসা দিয়ে বললো।
“-তুই বোস এখানে। আমি আসছি কিছু হবে না। গাড়ি থেকে নামবি না। ঠিকাছে?
পুষ্প ছাড়তে চাইলো না ভয়ে। প্রার্থ নিজেই ছাড়িয়ে নিলো। গাড়ি থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় এদিক ওদিক তাকালো। সামনে এগিয়ে পাথরগুলোর দিকে গেলো।
আচমকা পেছন থেকে কেউ সজোরে বারি দিলো প্রার্থর মাথায়। পুষ্প গাড়ি থেকেই চিল্লিয়ে উঠলো প্রার্থ ভাই বলে।
প্রার্থ মাথায় হাত দিয়ে পেছনে ঘুরে গেলো। হাত বাড়িয়ে আগে থামালো পুষ্পকে। পুষ্প গাড়ি থেকে নামতে চেয়েছিলো। প্রার্থ থামিয়ে বললো।
“-ওখানেই থাক। নামবি না। লক কর গাড়ি।
পুষ্প থেমে গেলো। যাওয়াটা প্রয়োজন কিনা বুঝতে পারছেনা। লোকটা কে? কিন্তু এভাবে কেন মারলো তাকে? পুষ্প যেতে চাইলে কিন্তু থেমল গেলো প্রার্থ বারন করায়। তবুও পরিস্থিতি বিগড়ে গেলেই সে নেমে যাবে।
প্রার্থ তাকালো সামনের ব্যাক্তিটির দিকে। মাথা দুটো ঝাড়া দিয়ে বললো।
“-শা*লা কাপুরুষের বাচ্চা। এত সাহস থাকলে সামনে থেকে মারতি। দিলিতো মাথাটা শেষ করে। বল কিসের প্ল্যান করছিস?

বিপরীত পাশের ছেলেটা রাগ দেখিয়ে বললো।
“-তোদের মারার প্ল্যান করেছি। অনেক জালিয়েছিস। আজ তোকে আর তোর মাসুকা কে এখানেই মেরে পুতে রাখবো।
প্রার্থ হাসলো। সে হাসিতে কি ভয়ংকর লাগলো তাকে। রাজিব ঘাবড়ে যায় এতে। প্রার্থ হেসে হেয়ালি গলায় বলে।
“-তুই মারবি আমাকে আর আমার মাসুকাকে? নে মার। আগে আমাকে মার তারপর ওর কাছে যাস। কাম অন। হিট মি।
রাজিব বললো।
“-আমি একা মারতে আসিনি তোকে। চারিদিকে চেয়ে দেখ। ছয়জনকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে ভাড়া করেছি তোকে মারার জন্য। আমরা আছি দলের চারজন। দশজন যথেষ্ট দুজনকে মারার জন্য
চারপাশ থেকে বেড়িয়ে এলো ভারি গড়নের আট দশজন ছেলে। তবুও প্রার্থকে ঘাবড়াতে দেখলো না। রাজিব দাঁতে দাত চেপে বলে

“-ভয় লাগেনা তোর তাইনা? ভয় করবে সমস্যা নেই। ওইটা বউ হয় না তোর? বউকে যখন চোখের সামনে মরতে দেখবি তখন বুঝবি ভয় কাকে বলে।
প্রার্থ তেড়ে এলো রাজিবের দিকে। গলা টিপে ধরলো। রাগে রি রি করে বললো।
“-ওর দিকে হাত বাড়ানোর আগে তোর ওই হাত ভেঙে গুড়িয়ে দেবো।
গলা চেপে ধরা পেছনে আসা ছেলেগুলো ধরে ছাড়িয়ে নিয়ে গেলো প্রার্থকে। রাজিব গলায় হাত দিয়ে বড় বড় শ্বাস নিলো। রাগে কিড়মিড় করে বললো।
“-অনেক ভালোবাসিস না? তোকে মারার আগে ওকে মারবো। তারপর দেখাবো বউ চলে গেলে কেমন লাগে। তোর জন্য শুধুমাত্র তোর আর তোর দলের জন্য আমাদের জেলে যেতে হয়েছে। আমার বউ ছেড়ে চলে গেছে আমাকে। কি ভেবেছিস এমনিই ছেড়ে দিবো? তোদের ব্যান্ডের জন্য আমাদের ব্যান্ড উপরে উঠেও নিচে নেমে গেছে। প্রতিনিয়ত মানুষের কথা শুনি শুধু তোদের জন্য।
প্রার্থ ছেলেগুলোর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। চুলগুলো দু হাতে পেছনে ঠেলে বললো।
“-যোগ্যতা থাকলে আমরা কেন আমাদের মতো দশটা আসলেও তোরা উপরে থাকতি। নিজের যোগ্যতা যাচাই কর আগে।
“-যোগ্যতাই দেখাবো এখন তোকে। তারপর তোর সবগুলো বন্ধুকে। ওই সবুজ মার শা*লাকে।
হুকুম পেয়েই তেড়ে আসলো ছেলেগুলো। কিন্তু প্রার্থকে আঘাত করতে পারলোনা সহজে। উল্টো তারা নিজেরা মার খেলো।
মারামারি দেখে পুষ্প ভয় পেয়ে যায়। প্রার্থর কথায় গাড়ি থেকে নামেনি সে। কিন্তু এখন আর বসে থাকতে পারলো না। আতঙ্কিত হয়ে নেমে পড়লো। ভয় জরানো গলায় ডাকলো প্রার্থকে।
“-প্রার্থ ভাই!
পুষ্পকে নামতে দেখেই প্রার্থর আত্মা শুকিয়ে যায়। অসাবধানতায় বারি খায় আবার। পুষ্প দৌড়ে আসে প্রার্থর কাছে। প্রার্থ মাথায় হাত দিয়ে দাড়ায়। পুষ্পকে থামাতে বলে

“-এখানে আসবি না। গাড়িতে উঠ। আমার কিছু হবেনা।
পুষ্প কিচ্ছু শুনছে না। কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে যাচ্ছে। ওমনিই পেছন থেকে রাজিব ধরে ফেলে তাকে। গলায় ছুড়ি ঠেকিয়ে দেয় সাথে সাথে। প্রার্থ থমকে যায়। বেড়ে যায় হৃৎপিণ্ডের গতি। আকুতি করে বলে।
“-রাজিব ছাড় ওকে। কিছু করবি না। ছাড়। রাজিব আমি কিন্তু মেরে ফেলবো তোকে। ছাড় আমার ফুলকে।
পুষ্প অবাক হয়। কান্না থামিয়ে তাকিয়ে রয় প্রার্থর দিকে। ফুল ডাকলো যে অবাক হবে না? প্রার্থকে শান্ত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার পেছনের ছেলেগুলো সুযোগ পেয়ে লাঠি দিয়ে কষাঘাত করতে থাকে। পুষ্প এগুলো দেখে ফুপিয়ে উঠে। কাঁদতে কাঁদতে বলে।
“-ছেড়ে দিন উনাকে প্লিজ। আপনারা কেন মারছেন? প্লিজ মারবেন না। মরে যাবে তো উনি। এমন কেন করছেন? ছেড়ে দিন
পুষ্পর এমন আহাজারি কেউ শুনলো না। মারতে থাকলো প্রার্থকে। প্রার্থ উঠে ওদের মারতে নিলে রাজিব বলে উঠে।

“-আমার ছেলেদের গায়ে হাত দিলে মেরে ফেলবো তোর জানে মানকে।
প্রার্থ থেমে যায়। ছুড়িটা পুষ্পর গলার খুব কাছে। প্রার্থর পাথর বুকেও ঝড় হয় এমন অবস্থা দেখে। সে থেমে গিয়ে বলে।
“-ঠিকাছে মারবোনা। তুই ছুরি সরা। রাজিব ছুরি সরা।ওর গায়ে একটা আচরও লাগলে সবকটাকে মেরে ফেলবো আমি। ছাড় রাজিব। তোর সমস্যা আমার সাথে তো? তাহলে আমাকে মার। আমাকে মেরে ফেল কিন্তু ওকে ছাড় রাজিব প্লিজ। তুই যা চাইবি আমি তাই করবো। মারিস না রাজিব প্লিজ।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২১

রাজিব শুনলোনা প্রার্থর আহাজারি। ছুরিটা হালকা করে ডাবিয়ে দিলো গলায়। কেটে গিয়ে রক্ত বেড়িয়ে আসলো। পুষ্প কেঁদে যাচ্ছে। প্রার্থর অন্তর খালি হয়ে যাচ্ছে। ভয় জেঁকে ধরেছে মন মস্তিস্কে।এখন খুব করে বুঝতে পারছে এই মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে সে বাচবে না। হৃদযন্ত্রটা এখনই বেড়িয়ে আসতে চাইছে। মস্তিস্ক ফাকা হয়ে যাচ্ছে। তার ফুলকে সে কি করে বাচাবে? এখনো তো অনেককিছু বাকি। তাদের তো ভালোবাসাও হলোনা ঠিক মতো। পুষ্পর সুখের সংসারও করা হলোনা তার প্রার্থ ভাইয়ের সাথে।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২২ (২)