আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২২ (২)

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২২ (২)
তানহা ইসলাম বৈশাখী

আতঙ্কিত, ভয় জরানো গা ছমছমে এক নিশীথ। অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তার মাঝে চলছে জীবন মরন খেলা। শত্রুরা মেতে উঠেছে প্রতিশোধের ক্রোধে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব আবার মানুষই পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য জীব। তারা শুধু নিজেদের স্বার্থর জন্য বাচে। কোনটা ঠিক কোনটা ভুল তা দেখার দরকার হয় না মানুষের। সে যেটা করবে সেটাই ঠিক ধরে নিতে হবে।
রাস্তর মাঝে কেউ পাচ্ছে পৈশাচিক আনন্দ। কারো আবার দুনিয়া দুলে উঠছে। অনুভুতিটা অল্প কয়েকদিনের কিন্তু তার গভীরতা! তার গভীরতার কোন পরিমাপ নেই।
দূর থেকে কিছু খ্যাক শিয়ালের গোঙানির মতো আওয়াজ ভেসে আসছে। এছাড়া আশেপাশে আর কোন আওয়াজ নেই। না আছে একটা গাড়ি।

এটা মেইনরোড না হওয়ায় এত রাতে কোন যানবাহন চলছে না এদিক দিয়ে। আর কিছুটা পথ গেলেই প্রার্থ পুষ্প মালিবাগ পৌছে যেত। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস তাদের সে পর্যন্ত যেতে দিলো না।
পুষ্পের গলায় এখনো ছুড়ি ধরে আছে রাজিব। এক ফোটা রক্ত গলা বেয়ে পরলো। প্রার্থর চোখে মুখে ভয়। এখন সে কিছু করলেই তার ফুল শেষ। প্রার্থ শান্ত চোখে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো।
“-রাজিব। কাজটা ঠিক করছিস না। তুই ছাড় ওকে। ওকে মারলে কি হবে বুঝতে পারছিস? জেলে যেতে হবে তোদের। তোদের দল পুরোপুরি ডাউন হয়ে যাবে রাজিব। এর থেকে ভালো তুই বল তোর কি চাই আমি তাই দেবো। ছেড়ে দে ওকে।
রাজিব হাসে। সে হাসিতে পৈশাচিক আনন্দ স্পষ্ট। দেখতে কি বিশ্রীই না লাগছে। একটু হেসে তাৎক্ষনাত আদল বদলে নিলো। ক্রোধ সমেত চোখে তাকিয়ে কথার বান ছুড়লো।
“-তোর কি মনেহয় আমি এতই বোকা? কোন প্রিপারেশন নিয়ে আসিনি? এত বড় লোককে ফাসাবো কোন প্ল্যান ছাড়াই?
প্রার্থ তেড়ে আসতে চায়। পেছন থেকে টেনে ধরে চ্যাংড়া ছেলেগুলো।
রাজিব সাবধান করে বললো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“-উ,উ! একদম না। বেশি চুদুরবুদুর করলে তোর ঘুঘুর গলা কাটতে সময় লাগবে না।
প্রার্থ থেমে যায় সহসা। অসহায় নেত্রে তাকায় পুষ্পর দিকে। পুষ্প চোখের ভাষা কেমন লাগলো। প্রার্থকে তার জন্য ছটফটাতে দেখতে কি তার ভালো লাগছে? বোধহয় লাগছে। এজন্যই গলার ব্যাথা, মরার ভয় ভুলে প্রার্থর দিকে অপলক চেয়ে আছে।
প্রার্থর বক্ষ ছঁলকে উঠে ওমন চাহনিতে। এরকমটা কি কখনো ও ভেবেছিলো! সে কি এতটাই দূর্বল যে তার ফুলকে সে বাঁচাতে পারছে না।
প্রার্থ শেষবারের মতো রাজিবকে বোঝাতে যায়। কারন এবার সে পুষ্পকে না ছাড়লে অন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। রয়েসয়ে বললো রাজিবকে
“- দেখ রাজিব, ওকে মারলে তোর কি লাভ হবে বল। তোর শত্রুতা আমার সাথে আমাকে মার। ও মরলে তো আর আমার কিছু হবে না তাইনা? শুধু শুধু তুই খুনি হওয়ার তকমা কেন গায়ে লাগাবি?
রাজিব অভিনয় করার মতো করে বললো।

“-আমি কেন খুনি হবো? খুনি হবি তো তুই। তোর বউকে মেরে তার খুনের দায় তোর গায়ে লাগাবো।
কথা শেষ করেই ছুড়ির পেছনপাশ দিয়ে পুষ্পর মাথায় সজোরে আঘাত করে সে। ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো সে। মুদে আসলো নয়ন। মাথায় পূর্বে থেকে আঘাত পাওয়া ছিলো বলে এই আঘাতে প্রচন্ড ব্যাথা পায়। মস্তিস্কের ভেতরে যেন কিলবিল ওঠে উঠছে ব্যাথা। নরম হয়ে আসে শরীর। ভর ছেড়ে দিতে চায়।
প্রার্থ ‘রাজিব ছেড়ে দে’ বলে হুংকার দিতেই তার মাথাও আঘাত পড়লো। লোহার রড দিয়ে মাথার পেছনে আঘাত করায় নিমিষেই ঝাপসা হয়ে এলো চারপাশ। পেছন ঘুরে গলা চেপে ধরলো বারি মারা ছেলেটার। বাকিরা টেনে ধরলো তাকে।
রাজিব একজনকে বললো
“-পেট্রলটা নিয়ে আয়।

একজন দৌড়ে গিয়ে রাস্তার পার থেকে একটা বড় পাঁচ লিটারের বোতল নিয়ে আসে। যেটা ভর্তি পেট্রল।
প্রার্থ বিষয়টা বুঝতে পেরেই ছটফটিয়ে উঠে। শরীরে ভর করে অদম্য শক্তি। মাথায় আঘাতে কিছুটা দূর্বল হয়ে পরেছিলো সে। এবার ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে। যেই আটকাতে আসে তাকেই ধরে পেটায়।
ততক্ষণে পেট্রল নিয়ে আসা ছেলেটা একদিক থেকে পুরো গাড়িতে তেল ছিটিয়ে দেয়। সব শেষ হয়ে গেলে পেছনে দরজা খুলে দেয়। রাজিব পুষ্পর মুদে আসা শরীরটাকে ধরে টেনে গাড়ির ভেতর ঠেলে দেয়। দরজা লাগিয়েই পৈশাচিক হাসে। পকেট থেকে ম্যাচ বের করে জালিয়ে চোখের সামনে ধরলো। জঘন্য হেসে ম্যাচটা ছুড়ে মারে গাড়ির উপর। টয়োটা ব্র্যান্ডের কালো গাড়িটাতে সাথে সাথে দাওদাও করে জ্বলে উঠে আগুন। এক নিমিষেই ছেয়ে যায় পুরো গাড়ি জুড়ে।
তখনই প্রার্থ ঝাপিয়ে পড়ে রাজিবের উপর। আরেকটু আগে আসতে পারলে হয়তো আগুন লাগানো থেকে আটকাতে পারতো। কিন্তু সাথে আসা ছেলেগুলোকে মারতে মারতেই কান্ড ঘটে যায়। পুষ্পর কাছে আসতে চেয়েও আসতে পারছিলো না। বাধা হয়ে দাড়িয়েছিলো ছেলে গুলো। ওগুলো মেরে আধমরা করে রাস্তায় ফেলে রেখেছে। একেকটা রাস্তায় পরে গুতরাগুতরি করছে মারের চোটে।

রাজিবকে রাস্তায় শুয়িয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মুখের উপর আঘাত করলো। এক আঘাতেই মুখ দিয়ে রক্ত বেড়িয়ে এলো। প্রার্থ উঠে গাড়ির কাছে এলো। আগুন যত ছড়াচ্ছে প্রার্থর ভয় তত বাড়ছে। মনেহচ্ছে মনের ভেতর থাকা যন্ত্রটা এক্ষুনি বুঝি বেড়িয়ে আসবে।
গায়ে থেকে কালো কোট টা খুলে ফেললো ত্রস্ত্র। কোট দিয়ে বারি মেরে মেরে আগুন নেভাতে চাইলো।
ভয় সংক্রান্ত গলায় আহাজারি করে উঠলো।
“-ফুল তোর কিচ্ছু হবে না। আমি আছি। আমি কিচ্ছু হতে দেবো না তোর। ভয় পাস না ফুল।
যতই আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে আগুন ততই বাড়ছে। রাজিব রাস্তায় শুয়ে শুয়ে দেখছে আর হাসছে। রক্তমাখা ঠোটে তার ক্রুর হাসি। এতদিন ধরে পুষে আসা হিংসেতে এবার শান্তির বান ছুটছে।
রাজিবকে খুকখুক করে হাসতে দেখে বুট পরা পা দিয়ে দিলো আরেকটা লাথি। মাথাটা তার রাস্তার সাথে লেগে রক্ত রেড়িয়ে এলো।

যে ছেলেটা গাড়িতে কেরোসিন ঢেলেছিলো সে এসে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করলো প্রার্থকে। প্রার্থ সরে যাওয়ায় আঘাতটা লাগলো তার বাহুতে। কেটে গিয়ে রক্ত বেড়িয়ে এলো সাথে। তাকেও লাথি দিয়ে ফেলে দিলো নিচে।
আবারও গাড়ির আগুন নেভাতে তৎপর হয়ে পরলো সে। হাত ঝলসে যাচ্ছে তাপে। পুড়ে যাচ্ছে প্রতিটা পশমের গোড়া। তবুও সে থামছে না। আগুনকে থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু আগুনও নিভছে না তার প্রচেষ্টায়।
রাজিব আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। বললো আনন্দ নিয়ে।
“-এবার আসবে পুলিশ। তারা এসে দেখবে দ্যা গ্রেট রকস্টার ইউভন প্রার্থ চৌধুরী মাঝ রাস্তায় তার বউকে গাড়ির মধ্যে রেখে জালিয়ে দিয়েছে। তার সাক্ষী হবে কে জানিস? ওইযে ওই ছেলেটা। ওকে ভাড়াই করেছি সাক্ষী হওয়ার জন্য।

রাস্তায় পরে থাকা ছেলেদের মধ্যে থাকা একটা ছেলেকে দেখালো হাতের ইশারায়। পরপর আবার বললো।
“-কেস হবে। প্রার্থ চৌধুরীর অমতে বিয়ে হওয়ায় ক্ষোভে তার বউকে সে মাঝরাস্তায় আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। রাস্তার একজন পথচারী সেটা দেখে তাকে ফেরাতে গেলে তাকেও সে আঘাত করে। দুজনের ধস্তাধস্তি হয় অনেক্ক্ষণ। তবুও সেই পথচারী ফেরাতে পারেনি প্রার্থকে। শেষমেশ মেরেই ফেলেছে নিজের সদ্য বিবাহিত বউকে।
বলেই আবারও খুকখুক করে হেসে দিলো সে। প্রার্থর কোন ধ্যান নেই তাতে। সে আগুন থেকে পুষ্পকে বাঁচানোতে ব্যাস্ত।
রাজিব নিজে টলতে টলতে আধমরা ছেলেগুলোকে টেনে তুললো। আরেকটা ছেলেও সাহায্য করলো যে মার কম খেয়েছে। একজনকে ফেলেই রেখে গেলো তারা। সে হবে প্রার্থর নামের খুনের সাক্ষী। মূলত তার জন্যই তাকে ভাড়া করা হয়েছে। সে জখম হয়ে সেখানে পড়ে আছে। পুলিশরা দেখলে নিশ্চিত তাকেই বিশ্বাস করবে যেভাবে আধমরা হয়ে পরে আছে।

প্রার্থ যখন কিছুতেই কিছু করতে পারছেনা তখন বুক ফেটে কান্না আসছে। শক্ত, পাষাণ পুরুষটারও চোখ বেয়ে পানি পড়লো না পাওয়া সুখ হারানোর শোকে। মনের কোনে ফোটা এক সুখ-ফুল বুঝি আজ ঝড়ে যাবে। না বলা কথাগুলো কি তবে না বলাই রয়ে যাবে?প্রার্থর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো।
“-ফুল আমি তোকে ভালোবাসি। আমার ভালোবাসাটা প্রকাশ করতে দে। ছেড়ে যাস না এভাবে।
কিন্তু বদলে পারলো না কিছুই। উন্মাদের মতো করে শুধু ‘ফুল’ বলে ডেকে গেলো তাকে। কোট দিয়ে জোরে জোরে বারি মারছে গাড়িতে। হাতের কোটটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে প্রায়। বিভ্রান্ত হয়ে এবার দিক বিদিক ভুলে হন্যের মতো আগুনেই হাত দিলো। দরজার কাছের আগুনটা নিভে এসেছিলো হালকা। সেখানেই কাচা হাতটা দিয়ে গরম দরজাটা একটানে খুলে ফেললো। তৎক্ষনাত ঝলসে গেলো হাতের তালু।
দরজা খুলে ভেতরে তাকাতে হিম হয়ে আসলো শরীর। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেলো তা। হৃদয়টা শূন্য হয়ে এলো। হৃৎস্পন্দন থমকে গেলো শূন্য গাড়িটা দেখে। থ হয়ে তাকিয়ে রইলো ভেতরে।

ভেতরে কেউ নেই। ভেতরের কিছু কিছু জায়গায় আগুন ছড়িয়ে গেছে। পুরোটাতে ছড়ায়নি। কারন তেলটা উপরে ঢালা হয়েছিলো এপাশ থেকে। গাড়ির জানালা বন্ধ থাকায় তা ভেতরে ঢুকতে পারেনি।
শূন্য গাড়িটা দেখে একটু সস্তি পেলেও পরপর জ্বলে উঠলো নিউরন। ফুল গাড়িতে নেই তো কোথায়?
পাগলের মতো জোরে জোরে ডাকলো তাকে।
“-ফুল! তুই কোথায় ফুল? আমার কাছে আয় প্লিজ। আমাকে একা ফেলে যাস না। আমি থাকতে পারবোনা তোকে ছাড়া। ফুল!
হন্যে হয়ে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে। তার ফুল কোথায় গেলো? গাড়ির ওপাশে ছুটে যাবে তখনই গাড়ির পেছনদিক থেকে ভেসে এলো পুষ্পের কাষ্ট গলার স্বর। সে টালমাটাল পায়ে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে ডাকলো প্রার্থকে।
“-প্রার্থ ভাই!

প্রার্থ ঘুরে পুষ্পকে দেখেই থমকে গেলো। পুষ্প এখানে কিন্তু কি করে?
গাড়ির এপাশ থেকে পেট্রোল ছোড়ায় অন্যপাশে কম গিয়েছিলো। ছেলেটা ওদিকে যায়নি। একদিক থেকেই ছুড়ে ছুড়ে মেরেছে সব। এজন্য আগুনটা এদিকে বেশি লাগলেও অন্যদিকটাতে কম ছড়িয়েছিলো। পুষ্প পুরোপুরি জ্ঞান হারায়নি তখনও। শীর্ন দেহটা টেনে ওপাশের দরজাটা খোলে কোনমতে। আগুন ছাপিয়ে আস্তে ধীরে নেমে পরে গাড়ি থেকে। দূর্বল সংকীর্ণ দেহটা টেনে গাড়ির পেছনে এসে ডাকে প্রার্থকে।
প্রার্থ স্তম্ভীত ফিরে পেয়েই ছুটে গেলো তার কাছে। ঝাপ দিয়ে জড়িয়ে ধরলো তাকে। দুহাতে কোমড় জড়িয়ে ধরে একহাত উপরে উচু করে উঠালো। মুখ গুজে দিলো পুষ্পর গলদেশে। এত কঠোর ব্যাক্তিত্বের ছেলেটা আপন মানুষ ফিরে পেয়ে কেঁদে উঠলো ফুঁপিয়ে।

নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে ধরলো পুষ্পকে। নিজের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চলছে যেন।
হারাতে হারাতে পেয়ে যাওয়া মানুষটাকে আর হারাতে চায় না। এখন ছেড়ে দিলে যদি আবার হারিয়ে যায়। এইযে একটু আগে যে ভয়টা তার মনে গেঁথে ছিলো সেটা কি সে আজীবন মনে রাখবে? অবশ্যই রাখবে। কারন এর থেকে বড় ভয় আর কিছুতে কখনো পেয়েছে কিনা তার জানা নেই।
তাকে হারাতে গিয়ে আজ বুঝলো এই মেয়েকে ছাড়া একটা দিনও চলবে না তার। এই কদিনে এত গভীর অনুভুতি কারো মনে জন্মায়? প্রার্থ এবার বুঝতে পারছে পুষ্পকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে সে কতটা ভুল করেছে। ও যে প্রার্থর মনের অসুখ নিরাময়ী সুখ। এই সুখ সে হারালে অসুখে পরে ধুকে ধুকে মরে যাবে। এইযে জাপ্টে ধরেছে নিজের সাথে। আর কখনো অবহেলা করবে না। আর কখনো দূরে যেতে দিবে না তাকে।
পুষ্পকে পেয়ে একইভাবে জড়িয়ে থেকে একটু শান্ত করে নিলো অশান্ত বুকটা। পরপর মুখটা তুলে পুষ্পর মুখাবয়বে এলোপাথাড়ি চুমু একে দিলো। ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিলো তাকে। যেন ছোট বাচ্চা তার প্রিয় খেলনাটা ফিরে পেয়েছে।

পুষ্প ততখনে নেতিয়ে পরেছে। সমস্ত ভর ছেড়ে দিয়েছে প্রার্থর উপর। প্রার্থ কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না। না পেয়ে পাওয়ার মতো উন্মাদ হচ্ছে। আবারো মুখ গুজে দিলো পুষ্পর গলায়। কেঁদে হাটু গেঁড়ে বসে পরলো পুষ্পকে নিয়ে। এতক্ষণ সে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে ছিলো এখন চোখও বুজে ফেলেছে। প্রার্থর ভয় আবারও জেঁকে ধরলো তাকে।
পুষ্পর মুখ চাপড়ে ভাঙা গলায় বলে উঠলো।
“-ফুল! শোন আর কখনো তোর সাথে খারাপ ব্যাবহার করবো না। তোকে কখনো আঘাত দেবো না। শোন না! তুই তো আমার ভালোবাসা চেয়েছিলি তাই না? দেখ আমি তোকে ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি। যতটা ভালোবাসলে একজন হৃদয়হীন ব্যাক্তিরও তোকে না পাওয়ার আকুলতায় শ্বাস আটকে যায়। দম বন্ধ হয়ে আসে না পাওয়ার যন্ত্রনায়। আমি তোকে তার থেকেও বেশি ভালোবাসি। ওঠ না ফুল। দেখ আমাকে। দেখ তোর প্রার্থ ভাই তোকে ভালোবাসি বলছে। দেখ।
পুষ্প দেখলো না। চোখ মেলে চাইলো না। প্রার্থর গলা শুকিয়ে যায়। বুকের মাঝে আবার জাপ্টে ধরে পুষ্পর মুখ। আবার এলোপাথাড়ি চুমু খায় মুখে।

এবার আর সময় নষ্ট না করে পুষ্পকে কোলে তুলে উঠে দাঁড়ায়। আশেপাশে দেখে কাউকে পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। আগুনের শিখায় চারপাশ পরিস্কার।
প্রার্থ পুষ্পকে কোলের মাঝে তুলেই হাটা ধরলো দূর্বল পায়ে। কিছুটা পথ দূর্বল চিত্তে হাটার পর সামনে থেকে একটা গাড়ি আসতে দেখলো। সে ইচ্ছে করে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাটলো যাতে গাড়িটা থেমে যায় তাদের দেখে।
হলোও তাই। গাড়িটা প্রার্থর একটু সামনেই থামলো। সেখান থেকে বেড়িয়ে এলো তিনজন ছেলে। ছেলে তিনজনই তার বহু পরিচিত। ওদের দেখে কিছুটা অবাক হলো প্রার্থ।
অর্নব, হৃদয়, রকি দৌড়ে প্রার্থর কাছে এলো। প্রার্থর বিদ্ধস্ত অবস্থা এবং পুষ্পকে কোলের মাঝে অজ্ঞান দেখে তিনজন একসাথে বলে উঠলো
“-কি হয়েছে প্রার্থ। পুষ্পর কি হয়েছে ?
প্রার্থ অবাকের রেশ কাটিয়ে শান্ত হলো। স্বস্তি পেলো বন্ধুদের দেখে। কোন কথা না বাড়িয়ে রকিকে হুকুম দিলো।
“-গাড়ি খোল রকি।

রকি তড়িৎ খুলে দিলো দরজাটা। প্রার্থ পুষ্পকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। কোলের উপরেই রাখলো তাকে। মাথাটা চেপে রাখলো বুকের সাথে। হুকুম ছুড়লো সবেগে
“-গাড়ি স্টার্ট কর অর্নব। আমার ফুলকে হসপিটালে নিতে হবে। তাড়াতাড়ি কর। ওকে দেখ ও চোখ খুলছে না।
আবার ডাকলো পুষ্পকে। অসহায় তার স্বর।
“-ফুল! এ্যাই ফুল! উঠ না। ভয় করছে তো আমার।
অর্নবরা গাড়িতে উঠে বসে তুরন্ত গতিতে গাড়ি ছোটালো। হৃদয় সামনে থেকে চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করলো।
“-তোদের এই অবস্থা কে করলো প্রার্থ? পুষ্প অজ্ঞান কেন? ও আমাদের মেছেজ করে শুধু বললো তোরা বিপদে আসিছ। কেউ তোকে মারছে।
প্রার্থ পুষ্পর থেকে চোখ তুলে হৃদয়ের দিকে তাকালো। চোখ লাল হয়ে আছে। নাক লাল হয়ে আছে। চোখে স্পষ্ট জলের আভাস। সে যে অশ্রুবিসর্জন দিয়েছে তা ঢের বোঝা যাচ্ছে। চোখমুখের বিদ্ধস্ত অবস্থা দেখে কেউ আর চুপ থাকতে পারছেনা।

প্রার্থ খানিক অবাক হয়ে বললো।
“-ও তোদের মেছেজ দিয়েছিলো?
অর্নব ড্রাইভ করতে করতে বললো।
“-হ্যা। প্রথমে কল দিয়েছিলো আমি খেয়াল করিনি। এরপর মেছেজ দিয়ে রেখেছিলো ছোট করে। তারপরও খেয়াল করিনি। রকিদের বাড়ির সামনে এসে থেমে ফোন হাতে নিয়ে দেখি পুষ্পর মেছেজ। ও বলছে।
“-ভাইয়া আপনারা কোথায় আছেন? অনেকগুলো ছেলে মাঝরাস্তায় আমাদের আটকে রেখেছে। প্রার্থ ভাইকে মারছে। প্লিজ মালিবাগের রোডে আসুন আপনারা। আমার ভয় হচ্ছে।
ব্যাস! এতটুকুই মেছেজ ছিলো। মেছেজের কথাটা বললে রকি আবার বললো।
“-মেছেজটা পেয়ে আর নামিনি। গাড়ি ছুটিয়েই এই রোডে এসেছি। কিন্তু কারা এছিলো? তোদের মারলো কেন? পুষ্প ভাবির কোথায় আঘাত লেগেছে?
প্রার্থ পুষ্পর গালে মুখ ডোবালো। নরম তকের মাঝে ডুবে গেলো যেন। পুষ্পর মুখে মুখ রেখেই বললো।

“-পরে বলবো। আগে আমার ফুলকে বাচা রকি। ওকে ছাড়া আমি শূন্য। আমার ফুল একবার আমার কাছে ফিরে আসুক ওই কুত্তার বাচ্চাদের একটাকেও ছাড়বো না আমি।
প্রার্থ মুখ তুললো।প্রথমে শান্ত থাকলেও আচমকাই চোখমুখে ফুটে উঠলো ক্রোধ। ফুলকির ন্যায় জ্বলে উঠলো কালো মনির চোখ দুটো। চোখটা আবার ফেরালো পুষ্পর বিবর্ণ মুখটাতে। দপ করে নিভে গেলো জ্বলে উঠা শিখা। সেখানে আবার হানা দিলো অসহায়ত্ব। পুষ্পর বিবস মুখে হাত বুলিয়ে দিলো স্বযত্নে। চেয়ে রইলো অপলক দৃষ্টিতে।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২২

সামনের ভিউ মিরর দিয়ে সব দেখে গেলো অর্নব। অর্নবের বুঝতে বাকি নেই প্রার্থর মনের ভাব। একমনে সে ভীষন খুশি হলো। অন্যদিকে কোথাও একটু খারাপ লাগা কাজ করলো। একটু না হয়তো একটুর বেশি খারাপ লাগলো কোথাও। তবে সে এগুলো পাত্তা দিলো না। ও যা চেয়েছে তাই তো হয়েছে। খারাপ লাগা দূরে সরিয়ে ভালোলাগাকে প্রশ্রয় দিলো। গাড়ি চালালো আরো দ্রুত যেন দ্রুত হসপিটালে পৌছাতে পারে।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২৩