আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২৩

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২৩
তানহা ইসলাম বৈশাখী

নতুন সূর্যোদয়। পূব আকাশের একফালি সূর্যরশ্মি জানালা গলিয়ে প্রবেশ করেছে হসপিটালের কেবিনে। তাতে খুব একটা তেজ নেই। সবে সকাল হলো। সূর্য তার প্রখরতা ছড়ায়নি পুরোপুরি।
কেবিনে দুজন মানব মানবীর তপ্ত শ্বাসের আওয়াজ ছাড়া আর কোন আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না।
ছোট কেবিনের নরম বেডের উপর অবচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে পুষ্প। সফেদ কোমল মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। তবে নাকের ডগাটায় এখনো লাল হয়ে আছে।
কাপলটা শুভ্র রংয়ের ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢাকা। হাতের কিছু কিছু জায়গায় পোড়া দাগ। সেখানে মলম লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ব্যান্ডেজ এর প্রয়োজন পরেনি।

প্রার্থ নিজের ব্যান্ডের করা হাতদুটো দিয়ে পুষ্পর কোমল হাতটা আলতো করে চেপে ধরে আছে।
বেডের সাথে ঘেষে একটা টুলের উপর বসে আছে সে। ঝুকে আছে পুষ্পর মুখের উপর। সূর্য তখনও উঠেনি সেই তখন থেকেই সে একইভাবে বসে আছে। কোন নড়চড় নেই।
কেমন কেমন চোখে দেখছে তার ফুলকে। যে চোখে ঘৃণা, প্রতিহিংসা ছাড়া কিছুই ছিলোনা, সে চোখে আজ কত মায়া! কতটা ভালোবাসা! পুষ্প তবে ঠিকই বলেছিলো -“ঘৃণা থেকেই প্রেম জন্মায়। অবহেলা থেকেও ভালোবাসা জন্মায়।”
সেই কখন থেকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। তার কি চোখের ক্লান্তিও নেই। ভালোবাসলে মানুষ কি ক্লান্ত হয় না? ক্লান্ত হবে কি করে? তার ভালোবাসার মানুষের মুখে যে এত মায়া সেটা কি সে আগে জানতো? এত মায়াভরা চোখ মুখে তাকিয়ে থাকতে কি কারো ক্লান্তি লাগে? আগে যে কেন এত মায়াময়ী লাগতো না? এখন আফসোস হচ্ছে প্রার্থর। আগে থেকেই এমন লাগলে কি একটু বেশিই উপভোগ করতে পারতো না?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রার্থর হাতের তালুটা ঝলসে গেছে। ডাক্তাররা চেক-আপ করে সেখানে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। হাতের বাহুতে ছুরিকাঘাতের জন্য অনেকটা কেটে গেছে। সেথায়ও সাদা ব্যান্ডেজ জরানো। মাথায় আঘাত লাগায় সেখানেও সফেদ কাপড় দিয়ে মোড়ানো হয়েছে। নিজের শরীরের আঘাত তার কাছে আঘাত মনে হচ্ছে না। পুষ্পর শরীরের আঘাত তার ভেতরে বারবার আঘাত হানছে।
নিজের পোড়া হাতের মাঝে পুষ্পর ফোস্কা পড়া নরম হাতটার দিকে তাকালো এবার। পরম যত্নে নিকোটিনের আনলে পোড়া ঠোঁট দুটো ছুয়িয়ে দিলো সেথায়। আবেশে বুজে নিলো চোখদুটো। হুট করেই একফোঁটা জল টপ করে পড়লো বিছানায়।
ছেলেটার মনেহয় আজ চোখের বাধ ভেঙেছে। ছোট ছোট বিষয়েও কেমন করে পড়ছে। ছেলেদের কি এরূপে মানায়?
সে চোখ খুলে আবার পুষ্পর মুখে তাকালো। হাতটা মুঠোয় পুরে ঠেকিয়ে রাখলো তার গালে সাথে।
মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো।

“-ফুল! কেন পোড়াচ্ছিস? চোখটা খোল না। আমাকে একটু দেখ। তোর ডাগর নয়নদুটো আমাকে দেখছে না কেন? তোর চোখে আমি আমাকে দেখতে চাই ফুল। আর পোড়াস না আমাকে। তোর বিরহে শক্ত নিরেট পুরুষটার বুকে ঝড় বইছে। বুঝতে পারছিস না কেন?
প্রার্থর আকুতি শুনলো না সে। বুঝতে পারলো না তার শখের পুরুষের মনে তার জন্য কতটা জায়গা তৈরী হয়েছে। তার কষ্ট সার্থক হয়েছে। বোকা ফুল কিছুই জানতে পারলো না।
এমন সময় দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো কেউ। দরজার শব্দ পেয়েও প্রার্থ নড়লো না। তাকিয়ে রইলো একধ্যানে। সে জানে কক্ষে এখন কারা প্রবেশ করেছে।
অর্নব, হৃদয়, রকি তিনজন শান্ত পায়েই ভেতরে প্রবেশ করলো। অর্নবের চোখ গিয়ে আটকালো দুজনের হাতের মাঝে। কি সুন্দর করে পুষ্পর হাতটা ধরে আছে প্রার্থ। মনের শোকে একটু হাসলোও সে। এগিয়ে এসে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ডাকলো প্রার্থকে।

“-প্রার্থ!
প্রার্থ আলগোছে পুষ্পর হাতটা নামালো বেডে। সটান করলো পিঠ। এতক্ষণ ধরে নরম থাকা মানুষটা আগের ন্যায় গুরুগম্ভীর হয়ে উঠলো। স্ফুলিঙ্গের ন্যায় বাক্য ছুড়লো
“- পেয়েছিস?
হৃদয় বললো।
“-হ্যাঁ। মগবাজারে ওদের একটা আড্ডাখানা আছে সেখানেই আছে।
আবারও ভেসে এলো পুরুষালি নিরেট কন্ঠস্বর
“-সঠিক খবর নিয়েছিস তো?
রকি এগিয়ে এলো।
“-ঠিক মানে একেবারে কারেক্ট খবর। শরীফুলকে দিয়ে ট্রাক করেছি। ব্যাটা বললো ওরা ভোর চারটা থেকে ওইখানেই আছে। এখন ওর কথা রাখ। বাইরে তো পুলিশ আসছে। কি বলবি?

“-আসছে ওনারা?
“-হুম আমরা আসার সময় ওদের রিসিপশনে দেখে আসছি
“-ঠিকাছে টেনশন নিস না। ওরা কোথায় আছে পুলিশকে জানানোর প্রয়োজন নেই। পুলিশকে আমি দেখছি।
অর্নব আটকালো প্রার্থকে। সন্দিহান গলায় বললো।
“-প্রয়োজন নেই মানে? কি বলছিস তুই? ওরা অপরাধী ওদের পুলিশ ধরবে না?
প্রার্থর শান্ত স্বর।
“-আগে আমি ধরবো এরপর পুলিশ।
প্রার্থ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পুষ্পর উপর ঝুকে পরলো খানিক। পুরু ঠোঁট বাড়িয়ে ছুয়ে দিলো সাদা ব্যান্ডেজে ঢাকা কপালটা। লম্বা একটা চুম্বন একে উঠে এলো।

বন্ধুদের সামনেই চুমু দিয়ে বসলো। অথচ তাদের মাঝে কোন পরিবর্তন দেখা গেলো না। একটুও না। কারণ কাল সারা রাত তারা দেখেছে প্রার্থর উন্মদানা। ডাক্তার কেবিনে ঢুকতে দেয়নি বলে সারারাত হাসফাস করে কাটিয়েছে। নিজে নিজেই এটা ওটা বলে বিলাপ করেছে। কখনো কখনো অস্থির হয়ে উঠেছে। নিজের আঘাত লাগা সত্ত্বেও চিকিৎসা নিতে চায়নি। বন্ধুরা পাশে ছিলো বলে সামলে নিতে পেরেছে। ডাক্তার কেবিনে ঢোকার অনুমতি দেয়নি অথচ ভোর সকালেই সে বিনা অনুমতিতে কেবিনে ঢুকেছে। এ নিয়ে সকালে ডাক্তার একবার বারন করে গেছে তাকে কিন্তু সে শোনেনি। অর্নবদের খবর নিতে বলেছে রাজিবদের। তাদের এক বন্ধু গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করে। তাকে দিয়ে নাম্বার ট্র্যাক করিয়ে খবর নেওয়া হয়েছে রাজিবের।
এখন বোধহয় পুলিশ এসেছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। প্রার্থ না পুলিশকে ইনফর্ম করেছে না বাড়িতে কাউকে জানিয়েছে । এখন সে তার চাল চালবে।
পুষ্পর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে হাটা ধরলো। আদেশ করে বললো।

“-রকি বাড়িতে ফোন করে জানা সব। যেভাবে জানাতে বলেছি সেভাবেই বলবি। অর্নব আর হৃদয় আমার সাথে চল পুলিশের ঝামেলা খতম করে রাজিবকেও দেখতে হবে। আর রকি কেউ না আসা পর্যন্ত এখান থেকে কোথাও যাবি না।
রকি সম্মতি দেয়। মাথা নাড়ায় উপর নিচ। প্রার্থর ভরসা আছে রকির উপর এজন্যই একা রেখে যাচ্ছে নয়তো এখান থেকে নড়তোও না। সে হুকুম করেই দুজনকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো।
বাইরে বের হতেই করিডোরে পুলিশের চারজন সদস্যের সাথে দেখা হলো তাদের। এস.পি সাহেব প্রার্থকে দেখেই বললেন।
“-ইউভান প্রার্থ চৌধূরী?
প্রার্থর নিখুত কন্ঠ
“-ইয়েস।
“-আপনার নামে অভিযোগ এসেছে আপনি আপনার স্ত্রী প্রাপ্তি এহসানা পুষ্পকে মার্ডার করতে চেয়েছিলেন।
প্রার্থ হাসলো কথাটায়। ঠোঁটের কোনে হাসি বজায় রেখে বললো।
“-তাকে মারার আগে আমার মৃত্যু হোক। নিজের ভালোবাসার মানুষকে কে মারতে চায় বলুন?
“-দেখুন আমাদের কাছে কমপ্লেইন এসেছে আপনার নামে। আপনি আপনার স্ত্রীকে গাড়ির ভেতর রেখে আগুনে পোড়াতে চেয়েছিলেন। আপনি যাকে মেরে আধমরা করে রেখেছেন তার স্পষ্ট স্বীকারোক্তি আপনি আপনার স্ত্রীকে খুন করার চেষ্টা করেছিলেন এবং সে দেখে ফেলায় তার গায়েও হাত তুলেন। আগুনে পোড়া গাড়ি এবং ভিকটিম দুটোই আমাদের জিম্মায়।

“-এটুকু দিয়ে কিছুই প্রমান হয় না অফিসার। তাকে মারতে চাইলে হসপিটালে আনতাম না অবশ্যই। দেখুন আমি এখন কিছুই বলবো না এ বিষয়ে। কারন আমার কথা আপনাদের বিশ্বাস হবেও না। আমার স্ত্রীর জ্ঞান ফিরুক এরপর তাকেই জিজ্ঞেস করে নিয়েন কি কি হয়েছিলো।
পুলিশের সাথে অনেকক্ষন কথা বলে মিটমাট করলো সব। কারন এইটুকু প্রমানের ভিত্তিতে কাউকে এরেস্ট করা যাবে না। যেহেতু পুষ্পর কিছু হয়নি।সে হসপিটালে জীবিত অবস্থায় আছে। এখানে ভিক্টিমের স্বীকারোক্তিরও প্রয়োজন। পুলিশের সাথে ডাক্তারের কথা হয়েছে আগেই। তারা কথা বলেই এসেছে। এখন একজনকে এখানে দায়িত্বে রেখে তারা যাবে আবার জায়গাটা পর্যবেক্ষণ করতে।
প্রার্থও তাড়া দিয়ে চলে গেছে নিজ গন্তব্যে।

বানিজ্যিক এলাকা মগবাজার। মানুষজন, দোকানপাট পেরিয়ে একটা শুনশান মতো জায়গায় এসে থামলো অর্নবের বাইক। তারাতাড়ির জন্য বাইকেই চলে এসেছে তারা। পুরান রংচটা একটা একতালা বাড়ি সামনে। প্রার্থ বাইক থেকে নেমে জিজ্ঞেস করলো।
“-এটাই তো?
অর্নব সিওর দিয়ে বললো।
“-হুম এটাই। শরীফুল এটার কথাই বলেছে। চল ভেতরে গিয়ে দেখি।
আর কথা না বাড়িয়ে পা বাড়ালো তারা। দরজার সামনে এসে টোকা মারলো কয়েকবার। তাও কেউ এলো না দরজা খুলতে। প্রার্থ ধৈর্য্য রেখে আবারও টোকা দিলো দরজায়।
কিছুক্ষনের মধ্যেই দরজা খুলে দাঁড়ালো একজন ছেলে। দরজা খুলতে দেড়ি প্রার্থর শক্তিশালী ঘুষি তার মুখে পড়তে দেরি হলো না। এক ঘায়েই নাক ফেটে রক্ত বেড়িয়ে এলো তার। আবারও ছেলেটার বুক বরাবর লাথি দিয়ে ফেলে দিলো নিচে। দাম্ভিক পায়ে তিনজন হেটে গেলো ভেতরে। ভেতরে ঢালাই বিছানার মাঝে এবড়োখেবড়ো হয়ে শুয়ে ছিলো আট নয়জন ছেলে। হাতে পায়ে, মুখে তাদের ব্যান্ডেজ এবং পট্টি লাগানো। দেখে মনে হচ্ছে নিজেরাই নিজেদের চিকিৎসা করেছে।

সবাই ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছিলো বোধহয়। সেখানে প্রার্থ মারার শব্দে আর ছেলেটার চিল্লানোর শব্দে সজাগ হলো সকলে।
রাজিব শুয়ে ছিলো। ধরফরিয়ে উঠে বসলো। চোখে তার ভয় এবং অবিশ্বাস।
সাইডে একটা টেবিল রাখা। তার উপর দুটো গিটার, মদের বোতল এবং কাল রাতে তাদের নেওয়া অস্ত্রপাতিও রাখা কতগুলো। সেখান থেকে একটা মদের বোতল তুলে নিয়ে রাজিবের সামনে গেলো।
রাজিব ভয়ে ভয়ে তুতলিয়ে বললো।
“-পপ্রার্থ! তু..তুই! তোরা ঠিক আছিস?
প্রার্থ হাসলো। বক্র হাসিতে ছেয়ে গেলো ঠোটের কোন।
“-তোর কি মনেহয় তোর মতো মানুষ আমাকে আমার ফুলকে মারতে পারবে? এত সহজ? তোর ওই পাতি বুদ্ধি দিয়ে আমাকে ফাসাবি? হাস্যকর! ওটা কোন প্ল্যান হলো? দু টাকার সস্তা বুদ্ধি দিয়ে আমাকে ফাসাতে চেয়েছিলি। তোর বুদ্ধির উপর ধিক্কার জানাই।
কথা শেষেই রাজিবের মাথায় সজোরে আঘাত করলো। কাচ ভেঙে মাথায় ঢুকে রক্ত বেড়িয়ে এলো। সে রক্ত এলকোহলের সাথে মিশে ধুয়ে নিচে পরে গেলো। রাজিব মাথা ধরে আর্তনাদ করে উঠে।
বাকিরা অসুস্থ শরীর নিয়েই উঠে যায়। হৃদয় দরজা বন্ধ করে দেয় তৎক্ষনাৎ। অর্নব আর সে মিলে বাকি মার খাওয়া ছেলেগুলোকে আরেকদফা মারতে থাকে।
প্রার্থ এগিয়ে গিয়ে বসে রাজিবের সামনে। এলকোহলে ভেজা চুল হাতের মুঠোয় শক্ত করে টেনে ধরে। এক হাতে নাকে আঙুল ঘষে নাটক করে বলে উঠে।

“- উফফ! রাজিব! রাজিব! রাজিব! ইশশ! তোর কাছে কত আকুতিই না করেছে এই প্রার্থ চৌধুরী। ছ্যাহ! শেষে কিনা তোর কাছে আমাকে আকুতি মিনতি করতে হলো। বুঝতে পারছিস তুই কোথায় হাত দিয়েছিস? যাহ! তুই কি করে বুঝবি আমি তো নিজেই বুঝতে পারিনি ও আমার কী! কিন্তু তুই কাজটা ঠিক করিসনি বুঝলি। তোকে এখন ভুগতে হবে।
চুলের মুঠি ধরেই মুখের উপর দিলো এক ঘা। শক্ত ঘুষির তোপে নেতিয়ে পড়লো ছেলেটা। প্রার্থ উঠে গিয়ে সেই টেবিলের উপর থেকে একটা ছুড়ি হাতে নিলো। আবার এসে বসলো রাজিবের সামনে। রাজিবের ঘাড় ধরে সোজা করলো তাকে। ছুড়ি দেখিয়ে বললো।
“-এটা দিয়ে আঘাত করেছিলি না? কোথায় আঘাত করেছিস এখন উপলব্ধি করতে পারছিস? এখানে! এখানে আঘাত করেছিস তুই কু*ত্তার বাচ্চা।
নিজের বুকের উপর আঙ্গুল ঠেকিয়ে বোঝালো সে কোথায় আঘাত করেছে। কথাটা শেষ হতেই দক্ষ হাতে ছুড়ি চালালো রাজিবের বুক বরাবর। আড়াআড়ি ভাবে কেটে গেলো বুকের ফোলা অংশ। তৎক্ষনাৎ ফিনকি দিয়ে রক্ত বেড়িয়ে এলো। ব্যাথায় চিৎকার করে উঠলো রাজিব। প্রার্থ তার মুখ চেপে ধরলো। দাঁতে দাঁত পিষে কটমটিয়ে বলে উঠলো।

“-চুপপ! এটুকু ব্যাথা কিছুই না। এটুকু সহ্য করে নে। আঘতের ব্যাবস্থা তো তোর জন্য পারমানেন্ট ভাবে করছিই তখন চিৎকার করে নিস।
রাজিব কেঁদে দুহাত জরো করলো প্রার্থর সামনে। মাফ চেয়ে কাঁদো গলায় বললো।
“-ছেড়ে দে প্রার্থ। আর কখনো এমন করবো না।
“-আরে ধুর! তোকে কখনো সুযোগ দিলে তো তুই কিছু করবি। দেখ ভাই আমি হচ্ছি একেবারে ইনোসেন্ট একটা বয়। আমি কিন্তু খুব সহজে ঝামেলায় জড়াই না। কিন্তু এই বিষয়টা ভিন্ন। আমি ভালোর ভালো খারাপের খারাপ। এতদিন তো ভালো দিকটা দেখলিই এখন আমার খারাপ দিকটা একটু দেখ। ট্রাস্ট মি ভাই ভীষন মজা পাবি।
ছুড়িটা আবার গলায় ধরলো। কিছু মনে করার ভান করে বললো।
“-উমম এখানে ধরেছিলি না এটা? রক্তও বের করেছিস? কত সাহস তোর ভাবা যায়? ভাবা যায় বল?
দাঁতে দাঁত পিষে পিষে বললো কথাটুকু। সাথে ছুড়িটা প্রখরভাবে চেপে ধরলো গলায়। কেটে রক্ত বেড়িয়েও এলো সেখান থেকে। কিন্তু পুরোপুরি ঢুকিয়ে দিলো না। রক্ত বেড়িয়ে আসা পর্যন্তই।
সে আবার উঠে পড়লো। ছুড়িটা দূরে ফেলে বুট পড়া পা দিয়ে লাথি দিলো রাজিবকে। মুখ থুবড়ে বিছানার উপর পড়লো রাজিব।
প্রার্থ তাকে ধরে সোজা করে উঠালো। এলোপাথাড়ি কতগুলো ঘুষি লাগালো।
হৃদয়, অর্নব বাকিগুলোকে ততক্ষণে একেবারে শুয়িয়ে দিয়েছে। তারা প্রার্থর কাছে এসে পেছন থেকে জাপটে ধরলো প্রার্থকে।
অর্নব বললো।

“-থাম প্রার্থ। মরে যাবে। বাকিটা পুলিশ দেখে নিবে। আমাদের জন্য এটুকুই যথেষ্ঠ
প্রার্থকে টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে আনলো রাজিবের কাছ থেকে। সে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। রাগ কন্ট্রোল করা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। রাগে হিসহিস করছে।
হৃদয় অর্নবের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো প্রার্থ। কপালে এসে পরা চুলগুলো দুহাতে ঠেলে দিলো পিছনে। দু চোখ বন্ধ করে রাগ সংযম করলো। দুপাশে ঘাড় নাড়লো। মটমট করে উঠলো সেখানে।
রাজিবের হাল খারাপ। মুখ দিয়ে রক্ত বেড়িয়ে এসেছে। বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে।
প্রার্থ আবার ওকে বললো
“-একটু পর তোর মামার বাড়ি থেকে লোক আসবে তোকে জেলে নিতে। বল কি বলবি তাদের?
রাজিব কথা বলতে পারছে না। প্রার্থর দেরি সহ্য হচ্ছে না। সে তার কলার মুঠোয় ধরে সোজা করলো তাকে। ভরা গলায় হুংকার ছুড়লো।

“-বল কি বলবি?
রাজিব ভয় পেয়ে যায়। সংকীর্ন গলায় অস্ফুটে বলে উঠে।
“-ববলবো সব দোষ আমার। আমাদের। আমরা করেছি সব।
প্রার্থ মানলো না। কড়া গলায় বললো।
“-উহুম! এটুকু না। পুরোটা বল। কি করে কি করেছিস। সব বল। শুরু থেকে। নে শুরু কর সময় কম। আমাকে ফিরতে হবে। ভালোই ভালোই সব বললে শাস্তি কম করে দিবো কিন্তু একটা কথাও যদি মিস যায় তাহলে তোর আর দুনিয়ার আলো বাতাস দেখতে হবে না। সারাজীবন জেলে পচিয়ে মারবো।
রাজিব বড় বড় শ্বাস ফেলে। আতঙ্কিত স্বরে হাসফাস করে বলে উঠে।

“-বলছি বলছি। আমার, আমার তোদোর উপর রাগ হতো প্রচুর। আমাদের পরে এসেই মিউজিকে তোদের নাম ছিলো বেশি। তোদের আমি কলেজ লাইফ থেকেই দেখতে পারতাম না। সেই তোদের এত উন্নতি দেখে আমাদের কারোর ভালো লাগেনি। হিংসে হতো। তাই প্রথমবার তোদের কনসার্টে দাঙ্গা বাধাই। তখন আমরাই ধরা পরে যাই। এরপর তোকে মারার নেশা উঠে আমার। কারন তোকে মারলে তোদের দল এমনিই কমজোর হয়ে পরবে। কিন্তু তোকে মারলে আমাদের ধরা পরে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। এজন্য অনেকদিন প্ল্যান করে সাজাই তোকে মারবো না তোকে ফাসাবো। সারাজীবনের জন্য জেলে পুরবো। কিন্তু তেমন কোন উপায় পাচ্ছিলাম না৷ পরে শুনি কার্তিকের বিয়ে। তোরা সবাই সেখানে অবশ্যই থাকবি। এরপর একজন দিয়ে পুরো বিয়েতে পুরোটা সময় তোদের উপর নজর রাখি। সব সময়কার আপডেট আমার কাছে আসছিলো। যখন শুনি তুই গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিস তখনই রাস্তা আটকে দেই। এরপর তুই যখন ওই রাস্তায় পৌঁছাস তখন রাস্তার আরো অনেক আগে দুই দিকেই রাস্তা বন্ধ হওয়ার বোর্ড লাগিয়ে দেই। যাতে কোন গাড়ি এদিকে আসতে না পারে।

ভেবেছিলাম ফাকা রাস্তায় তোদের গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিবো। তোকে রাস্তায় অজ্ঞান করে রেখে দিবো কিন্তু তুই উল্টো আমাদের মেরে রেখে দিস। এজন্য আগুন লাগিয়ে তোকে ওইভাবে রেখেই আমরা চলে যাই। আর রাস্তায় যেই সাইনবোর্ড দিয়ে আটকে ছিলাম সেগুলো সরিয়ে দেই। এরপর নতুন এক নাম্বার দিয়ে অজানা সেজে পুলিশকে কল দেই
কথা শেষে প্রার্থ আবারও বুট দিয়ে লাথি দিলো রাজিবের বুকে। বেচারা এই কথাটুকুই বলেছে আধাঘন্টা সময় নিয়ে। কথা বলতে পারছিলো না। শুধু ভয়ে রক্তমাখা গালেই সব বলে গেলো। তার কথায় স্পষ্ট বোঝা গেছে সে কতটা আঘাতপ্রাপ্ত। তবুও প্রার্থর মায়া হলো না। সে হুমকি দিয়ে বলে গেলো।

“-একটু পরে তোর বাপেরা আসবে। তাদের সামনেও সুন্দর করে সব উপস্থাপন করবি। নয়তো তোকে কি করে জেলে পচাতে হয় সেই ব্যাবস্থা আমার করা আছে। আমি চাইলে কি কি করতে পারবো সেটা সময় এলে তোকে বুঝিয়ে দেবো।
নিজেরা আগে মেরে মনের আশ মিটিয়ে নিলো। প্রথমেই পুলিশের কাছে হস্তান্তর করলে তো আর নিজে এই মারটা দিতে পারতো না। তখন তার শান্তিও হতো না। এখন নিজের ইচ্ছে মতো মেরে একটু শান্তি লাগছে। ও প্রার্থর কোথায় হাত দিয়েছে সেটা বোঝাতে হবে না?
সবগুলোকে পিটিয়ে আধমরা করে রেখে বেড়িয়ে গেলো। ঘরের বাইরে থেকে ছিটকিনি মেরে গেলো যাতে কেউ বের হতে না পারে।

সকাল প্রায় নয়টা। সূর্য তখন তার উত্তাপ ছড়াতে ব্যাস্ত। প্রার্থ যাওয়ার পর রকি সবাইকে জানায় তাদের এক্সিডেন্টের কথা। সবাই হুলুস্থুলু বেধে উপস্থিত হয়েছে হসপিটালে। প্রিয়া নিজের বাসায় ছিলো। অন্ত তাকে তার বাড়িতে পৌছে দিয়ে প্রান্তকে নিয়ে নিজেদের বাড়ি গেছে। প্রিয়ারা এখন খবর পেয়েই মা বাবা সহ হসপিটালে উপস্থিত হয়েছে।
পূর্নিমা বেগম অসুস্থ হওয়া সত্তেও এসেছে। আশরাফ সাহেবের গাড়িতে করে অন্ত নিয়ে এসেছে তাদের। সাথে অহনা বেগমও এসেছে।
তারা এসে পুষ্পকে বেহুসই পেয়েছে। একটু আগেই তার জ্ঞান ফিরলো। ডাক্তার বলেছে ভয়ের কিছু নেই। প্রথম থেকেই আঘাত ছিলো মাথায়। রক্ত খানিক জমাট বেধে ছিলো। দ্বিতীয়বার মাথায় আঘাতে সেন্স হারিয়েছে। এবং আগুনের কারনে কিছু কিছু জায়গায় পুড়ে গেছে। ঔষধ দেওয়া হয়েছে। ঠিক হয়ে যাবে ধীরে ধীরে। এছাড়া তারা আর কোন লক্ষন দেখেনি রোগীর শরীরে বা মস্তিস্কে।

এইটুকু খবরে সবাই একটু শান্ত হতে পেরেছে। কেবিন ভর্তি পুষ্পর পরিবারের লোকজন। হুসে ফিরে এসেই তার পরিবারের সবাইকে সে পেয়েছে অথচ প্রার্থকে পায়নি। দুচোখ তার চাতক পাখির ন্যায় খুজে গেছে তাকে। তবুও সেই পাষান লোকটার দেখা পায়নি। কাল রাতে প্রার্থর চোখে একটু ভয় দেখে পুষ্প কি না কি ভেবেছিলো। অথচ প্রার্থর মনে যে তেমন কিছুই নেই তা এখন বুঝতে পারছে। অল্পতে গলে যাওয়া মানুষের অনেক জ্বালা। এইযে কাল প্রার্থর চোখ মুখের অবস্থা দেখে পুষ্প কত কি-ই না ভাবলো। কিন্তু তার সব আশায় পানি ঢেলে দিলো সে।
নিজের মনের উপর নিজের বিরক্তি আসছে পুষ্পর। মনকে এত বেহায়া হতে বলেছে কে? এত আশাই বা রাখতে বলেছে কে? সে তো আশা দেখায়নি তাহলে তার জন্য এত কিসের অপেক্ষা?
কিন্তু কালকের ঘটনাও যে ভোলার মত নয়। প্রার্থ ভয়, আহাজারি, ছুটে এসে তাকে জরিয়ে ধরা এসব তো মিথ্যে নয়। পুষ্পর স্পষ্ট মনে আছে প্রার্থ তাকে জরিয়ে ধরেছিলো। তাহলে?
নিজের মনে নিজেই প্রশ্ন পাকিয়ে যাচ্ছে। একেকজন একেক প্রশ্ন করছে তাকে তাতে তার কোন ধ্যান নেই। সে তার ভাবনায় মসগুল।

এমন সময় কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো প্রার্থরা। পুষ্পর চোখ প্রথমেই গিয়ে আটকালো প্রার্থতে। প্রার্থও ভেতরে ঢুকেই সবাইকে ছাপিয়ে পুষ্পর দিকে তাকিয়েছে। দুজনের চোখাচোখি হওয়ায় পুষ্প চোখ নামিয়ে নেয়। কিন্তু প্রার্থ নামায় না। সে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। সবাই প্রার্থকে এটা ওটা বললো। কোথায় ছিলো এতক্ষণ? রাতে কি কি হয়েছিলো?
কিন্তু প্রার্থ কারো কথার উত্তর দিলো না। পুষ্পর উদ্দেশ্যে শীতল কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো।
“-এখন কেমন লাগছে?
পুষ্প বুঝলো না প্রশ্ন কাকে করলো। বুঝার জন্য চোখ তুলে তাকালো। প্রার্থ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে বলে বললো।
“-হুম ঠিক আছি? আপনি ঠিক আছেন?
“-তুই ঠিক থাকলেই হবে।
প্রার্থর কথার ইঙ্গিত সে বুঝলো না। ভাবলো খোচা মারলো বুঝি। কারন প্রার্থর কাজই এটা। কথায় কথায় পুষ্পকে খোচা দেওয়া অপমান করা তার রোজকার রুটিন। পুষ্প রাগে দুঃখে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো।

“-আম্মু বাড়ি যাবো আমি। বাড়িতে নিয়ে চলো।
প্রার্থ ফট করে বলে বসলো।
“-কোন বাড়ি?
“-আমারদের বাড়ি।
“-আমাদের বাড়ি কোনটা? বাবার বাড়ি না শশুড় বাড়ি?
পুষ্প ভ্রু কুচকে বললো।
“-বাবার বাড়ি।
প্রার্থর মেজাজ চটলো। পরপরই আবার শান্ত হয়ে এলো। শান্ত কন্ঠেই বললো।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২২(২)

“-বাড়িতে যাবি কিন্তু আমার সাথে আমাদের বাড়িতে। শশুড় বাড়ি থাকতে কেউ বাবার বাড়ি এতদিন পরে থাকে না।
প্রার্থর কন্ঠ শান্ত হলেও তার বলা প্রতিটি বাক্য ছিলো কঠোর। পুষ্প গো ধরে বসে রইলো। সে প্রার্থর সাথে প্রার্থর বাড়িতে যাবেনা। যেখান থেকে চলে এসেছে সেখানে আবার কেন যাবে?

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২৪