আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২৯

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২৯
তানহা ইসলাম বৈশাখী

দিনগুলো চলছে দিনের গতিতে। সে চলাতে কোন ব্যাস্ততা নেই। তবে মানুষের জীবন এই দিনের ফেরে ভীষণ ব্যাস্ত। তেমনই ভীষন ব্যাস্ত একজন মানুষ প্রার্থ। বাসা থেকে স্টুডিও, স্টুডিও থেকে এখানে, এখান থেকে সেখানে মানে খুবই কর্মচঞ্চলতায় কাটছে তার জীবনের গতি৷ ইদানীং আবার নিজেদের অফিসেও যাচ্ছে সময় পেলে। আশরাফ সাহেব ও অহনা বেগম একা আর কত করবেন? এবার ছেলেদেরও ব্যাবসায় হাত দেওয়া দরকার। অন্ত এখনো ছোট। পড়ালেখা শেষ হলেই নাহয় হাত দিবে। কিন্তু প্রার্থর তো যথেষ্ট নলেজ আছে বিজনেস নিয়ে। এজন্য তিনি চাইছিলেন একটু একটু করে এবার সে বুঝে নিক তার কোম্পানি। যদিও প্রার্থ প্রথমে নারাজ ছিলো ব্যাবসায় নামার জন্য। তবে পুষ্প বুঝিয়ে শুনিয়ে একটু রাজি করেছে। সেই সুবাদেই কয়েকদিন অন্তর অন্তর সে যায় অফিসে।
আজ আর অফিসের দিকে পা মারাবে না। আজ স্টুডিওতেই যাবে। সাথে অর্নবের বিয়ের জন্যও কিছু কাজ নিপটিয়ে আসবে।

সকালের মধ্যভাগ এখন। চৌধুরী পরিবারের সকলে বসেছেন সকালের নাস্তা করার জন্য। সাথে আজ আশরাফ সাহেব ও অহনা বেগমও আছেন।
রুবি এবং পুষ্প মিলে সব খাবার এনে টেবিলে রাখলো। ব্যাস্ত হাতে একেকজনের প্লেটে ভাত তুলে দিচ্ছে পুষ্প। সবাইকে দিয়ে এবার এলো প্রার্থর কাছে। তার প্লেটে ভাত দিয়ে তার উপর চিংড়ি মাছের তরকারি টাও দিয়ে দিলো। ওমনিই প্রার্থর ভ্রু কুঞ্চিত হলো। সাথে হতভম্ব হলো সকলে। যারা এটা খেয়াল করলো তারা সকলে অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে আছে পুষ্পর দিকে। পুষ্প ঘুরে ফিরে সকলের ওমন চাহনী দেখে ভরকে গেল কিছুটা। অপ্রস্তুত হয়ে বললো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“-কিছু হয়েছে?
পূর্নিমা বেগম হেসে উঠলেন। বললেন।
“-কি হবে আবার। কি করেছিস দেখ।
কথা বলে তিনি ইশারা করলেন প্রার্থর প্লেটের দিকে। পুষ্পও সেদিকে তাকালো কিন্তু তেমন বিশেষ কিছু খুঁজে পেলো না। কিছু না বুঝে আবারও বললো।
“-কি করেছি বড়আম্মু? সব তো ঠিকই আছে?
এবার সকলে তাকালো প্রার্থর প্লেটে। চিংড়ি মাছে তার প্রচুর এলার্জি। ছোট বেলায় একবার চিংড়ি খাওয়ায় প্রায় ম*রার দশা হয়েছিলো। সেই থেকে চিংড়ি খাওয়া বাদ দিয়েছে। বাদ দিয়েছে বলতে এটা খাওয়া নিষেধ তার। সাথে অন্তও এই রোগটা পেয়েছে। তার দাদারও নাকি এই সমস্যাটা ছিলো। বংশগত কারনেই বোধহয় এখনো এই সমস্যা তাদের শরীরে বইছে।
আর এই কথাটা বাড়ির ছোট বড় সবাই জানে। পুষ্প নিজেও জানে অনেক আগে থেকেই। তবে আজ এরকম কান্ড দেখে সবার কাছেই বিষয়টা অস্বাভাবিক লাগলো।
পুষ্পর এমন খামখেয়ালি দেখে কপাল চাপড়ালো প্রিয়া। বললো।

“-বুবু! তুমি প্রার্থ ভাইয়ের প্লেটে চিংড়ি মাছটা কেন দিলে? ভাইয়ের এলার্জি আছে মনে নেই নাকি?
পুষ্প একটু চমকালো বোধহয়। তড়িঘড়ি করে বললো।
“-আপনার এলার্জি আছে? আল্লাহ! আচ্ছা ওটাতে হাত দিয়েন না আমি অন্যটায় দিচ্ছি আপনাকে।
হরবার করে ধরে প্লেটটা পাল্টে দিতে। তবে প্লেটটা টেবিল থেকে আর উঠাতে পারলো না। তার আগেই খপ করে হাতটা ধরে ফেললো প্রার্থ। নিজের পাশের খালি চেয়ারটা দেখিয়ে বললো।
“-বোস এখানে।
পুষ্প না বসে বললো।
“-না না। আগে আপনার থালাটা চেঞ্জ করে দেই। আপনার তো এলার্জি আছে।
“-প্রয়োজন নেই। আমি বসতে বলেছি।
পুষ্প বসবে কিনা বুঝতে পারছে না। সকাল সকালই কি ভুল করে বসলো। একটুও খেয়াল করলো না যে প্রার্থ চিংড়ি খায় না। মন কোথায় থাকে কে জানে।
পুষ্প দাঁড়িয়ে আছে বলে আশরাফ সাহেব বললেন।
“-বসো পুষ্প মা। আগে খেয়ে নাও তোমাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে। আমরা নিয়ে খাবো সমস্যা নেই তুমি আগে বসে খাও।
পুষ্প বসে পরলো প্রার্থর দেখানো চেয়ারে। প্রার্থ তখনও হাত ছাড়েনি তার। পুষ্প বসতেই তার প্লেটটা ঠেলে পুষ্পর সামনে রাখলো। খুবই নরম কন্ঠে বললো।
“-এটায় তুই বোস।
পুষ্প অপরাধ বোধে মাথা নিচু করে ফেললো। চোয়াল ঠেকিয়ে দিলো গলার ভাজে। ছোট্ট করে বললো।

“-সরি।
প্রার্থ স্বাভাবিকই ছিলো। তবে পুষ্পর ‘সরি’ বলায় রাগ হলো একটু। সে কি এটার জন্য তাকে বকবে নাকি? ভুল হতেই পারে। তবে এই ভুলটা তার কাছে খুব সহজ ভুল মনে হচ্ছে না। পুষ্পর কিছু তো একটা হয়েছে। নাহলে ওমন ভুল ও কখনোই করবে না।
প্রার্থ কথা বাড়ালো না। ‘সরি’র উত্তর দিয়ে বললো।
“-সরি চাইনি। খেতে বলেছি।
সে নিজের জন্য আরেকটা প্লেট নিয়ে নিজেই নিজের খাবার নিয়ে নিলো এক হাতে। তখনো প্রার্থ তার হাত ধরে রেখেছে। পুষ্প খাচ্ছে না বলে প্রার্থ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“-কি হলো? খাচ্ছিস না কেন?
পুষ্প হাতের দিকে তাকিয়ে মিহি স্বরে বললো।
“-হাত তো আপনি ধরে রেখেছেন খাবো কি করে?
প্রার্থ হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো সত্যিই এখনো ধরে রেখেছে। এরপর ছেড়ে দিলো হাতটাকে। ওপাশ থেকে প্রান্ত মেজাজ খুয়িয়ে বলে উঠলো।
“-যেখানে সেখানে এভাবে ফুল আপুর হাত ধরবে না তো। ভাল্লাগে না আমার।
প্রার্থ চোখ মুখ কুচকে কপাল গুটিয়ে বললো।

“-আমার বউ আমি যেখানে খুশি তার হাত ধরবো তোর কি? তোর ভাল্লাগে না দিয়ে আমি কি করবো?
প্রান্ত আস্ত একটা চিংড়ি মুখে পুরে চিবাতে চিবাতে বললো।
“-উহহহ্! এখন আসছে ‘আমার বউ’ বলতে। ফুল আপু তোমার বউ হওয়ার আগে আমার ফুল…..
প্রার্থ ধমকে উঠলো তৎক্ষনাৎ।
“-খবরদার ফুল বলবি না ওকে। আমি বারন করেছি না?
“-আমি বলবোই। তুমি কেন এখন…..
“-প্রান্ত!
ধমকে উঠলেন অহনা বেগম। গুরুগম্ভীর কন্ঠে ভরকে গেলো প্রান্ত। চুপ হয়ে গেলো সাথে সাথে।
অহনা বেগম বললেন।
“-খাবার খাওয়ার সময় এত কথা কেন? ও বড় ভাই না তোমার? ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করে কেউ?
প্রার্থ আগুনে ঘী ঢেলে বললো।
“-এক কাজ করো কাকিমা। ওকে বোর্ডিংয়ে পাঠিয়ে তাও তাহলেই ভালো হবে ও।
প্রান্ত কাদো কাদো হয়ে বললো।
“-ভাইয়া ফুল আপুকে আর ফুল ডাকবো না। তবুও বোর্ডিংয়ে দিও না।
প্রার্থ গম্ভীর মুখেই বললো।

“-প্রমিজ?
“-পাক্কা প্রমিজ।
এক ফুলকে নিয়ে দুই মালির ঝগড়া নিয়ে হাসলো সকলে। পুষ্প প্রান্তকে শুধিয়ে বললো।
“-তুই আমালে ফুল বলেই ডাকবি প্রান্ত। তোর ভাইয়ার কথা শোনার দরকার নেই।
প্রার্থ পুষ্পর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে কিছু বলতে নেয়। তার আগেই পুষ্প উঠে দৌড় দেয় ওয়াসরুমের দিকে। হুট করে কি হলো বুঝতে পারলো না কেউ। প্রার্থ খাবারে হাত দিয়ে রেখেছিলো। সেই প্লেটেই হাত ধুয়ো উঠে গেলো। সবার উদ্দেশ্যে বলে গেলো।
“-তোমরা খাও আমি দেখছি।
পুষ্পর পিছু পিছু বেসিনে এসে দেখলো পুষ্প বেসিনে ঝুঁকে বমি করছে। প্রার্থ গিয়ে পেছন থেলো তাকে আগলে নিলো। চিন্তার ভাজ পড়ে গেলো কপালে। বুকের গতি থেমে গেলো। হঠাৎ কি হলো। এভাবে কেন বমি করছে বুঝতে পারছে না। দিশেহারা হয়ে হন্যের মতো বললো।

“-ফুল? কি হয়েছে? ভমেট হচ্ছে কেন?
বেসিনের ট্যাব ছেড়ে দেওয়া। খালি পেটে সকালে কিছুই বের হলো না পানি ছাড়া। তবে সব উগলে দেওয়ায় ঝাকুনিতে শরীর দূর্বল হয়ে পড়লো। ভর ছেড়ে দিলো প্রার্থর হাতে। প্রার্থ দু হাতে তাকে আগলে আছে। পুষ্পর চোখ বুজে আসছে বলে মুখ চাপড়ে বললো।
“-ফুল, বেবি কি হয়েছে? এমন কেন করছিস? শরীর খারাপ করছে? চোখ খোল ফুল।
পুষ্প চোখ খুললো না। উল্টো চোখ বুজে সমস্ত শরীর ছেড়ে দিলো প্রার্থর উপর। প্রার্থ সাথে সাথে কোলে তুলে নিলো তাকে। ভয়ে চিৎকার করে ডাকলো অন্তকে।
“-অন্ত ডাক্তারকে কল কর। তোর ভাবি জ্ঞান হারিয়েছে। অন্ত? চাচ্চু প্লিজ কল দ্যা ডক্টর।
পুষ্পকে কোলে করে নিয়ে গেলো লিভিংরুমে। শুয়িয়ে দিলো তাকে সোফার উপর। সামনে ফ্লোরে হাটু মুরে বসে পুষ্পর মুখ ঝাঁকিয়ে বারকয়েক ডাকলো তাকে।
“-ফুল। ফুল চোখ খোল ফুল। প্লিজ চোখ খোল। এভাবে ভয় দেখাস না প্লিজ।
ততক্ষণে সকলে ঘিরে ধরেছে তাদের। পূর্নিমা বেগম কেঁদে ফেলেছেন। প্রিয়া সোফায় বসে পুষ্পর পায়ের তালু ঘসছে। আশরাফ সাহেব ফোন করেছেন ডাক্তারকে।
প্রার্থ পুষ্পর হাতের তালু ঘষছে আর পাগলের মতো ডাকছে তাকে। অন্ত পানি নিয়ে এলো। মুখে পানি ছিটিয়ে দেওয়া হলো তবুও পুষ্পর জ্ঞান ফিরলো না। এতে করে আরো ভয় পেলো সকলে। প্রার্থর হার্ট মনে হয় না তার কাছে আছে। এমনকরে বিট করা মিস করছে যেন দম বেড়িয়ে যাবে এক্ষুনি। নিশ্বাস ভারী হচ্ছে। দুচোখে তার ভয়, কাতরতা। এই বুঝি তার প্রান ভ্রমর উড়ে গেলো তাকে একা ফেলে।

বিছানায় নিথর দেহটাকে যত্নসহকারে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে। আশেপাশে শুভাকাঙ্ক্ষীর অভাব নেই। সকলেই পুষ্পকে ঘিরে আছে। অথচ তার কোন হুশ নেই। তার মাথার একপাশে আছে প্রার্থ অন্যপাশে প্রত্যয় সাহেব। মেয়ের অসুস্থতার খবর শুনে অস্থির হয়ে ছুটে এসেছেন অফিস ছেড়ে।
ডাক্তার এসে চেক-আপ করে গেছেন অনেকক্ষণ আগে। বলে গেছে কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে ভয়ের কিছু নেই। সাথে আরও একটা খুশির খবর দিয়ে গেছেন। জ্ঞানহীন মেয়েটির ভেতরে বাস করছে আরেকটি প্রান। মা হতে চলেছে প্রার্থর সুখ ফুল। এ খবর শুনে ভয় বদলে সবার চোখে নেমে এসেছে বিস্ময়, খুশির ঢল। একেকজন পারছে না তো কেঁদেই ফেলছে। প্রথমে যা ভয় পেয়েছিলো এখন আর তেমন ভয় নেই কারো মনে।
প্রত্যয় সাহেব যখন এলেন তখনই তিনি প্রার্থর উপর হামলে পরেন। সবকিছুর জন্য দায়ী প্রার্থকেই করেছিলেন। কারন তিনি জানতেন প্রার্থ পুষ্পকে মেনে নেয়নি। যদিও পুষ্প তাকে কয়েকদিন আগেও বলেছিলো প্রার্থ ভালো হয়ে গেছে বদলে গেছে। তাকে আর কষ্ট দেয় না। অনেক যত্ন করে। ডিভোর্স নিয়ে যেন আর না আগায়।
প্রত্যয়ও মেয়ের কথা বিশ্বাস করে খুশি হয়েছিলেন। ডিভোর্সের কাগজ বানিয়েই ফেলেছিলেন কিন্তু পরে তিনিই ক্যান্সেল করে দেন সব।

কিন্তু এবার হঠাৎ মেয়ের অসুস্থতার কথা জেনে মাথায় সবার আগে প্রার্থর কথাই আসে। ভেবেছিলো বোধহয় ও-ই ভালো মানুষের নাটক করে মেয়েটাকে মারতে চাইছে। সেজন্য তিনি এসেই প্রার্থর মুখে ঘুষি মারে। এরপর কলার ধরে ঝাকিয়ে বলেছিলেন।
“-জা*নো*য়ার! বল আমার মেয়েকে কি করেছিস? কি করেছিস ওর সাথে বল? আমি জানি তুইই ওর সাথে খারাপ কিছু করেছিস। আমার মেয়ে বলেছে আমাকে তুই ওকে সহ্য করতে পারিস না। তুই আমার মেয়েকে পছন্দ করিস না। তাহলে ভালোমানুষির নাটক কেন করেছিলি? ডিভোর্স দিয়ে দিতি। আমার মেয়েকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতি। এখন আমার মেয়ের কিছু হলে তোকে আমি ছাড়বো না মনে রাখিস।
এই এক কথায় সকলের মাথায় যেন বাজ পরেছিলো। খুশি খুশি পরিবেশে যেন ঝড় চললো। সবার মানতে কষ্ট হচ্ছিলো বিষয়টা।
কিন্তু প্রার্থ কিছু বললো না। উল্টো শশুড় মশাইয়ের কথায় শান্ত হইলো। তবে সে যখন মলিন কন্ঠে বললো।

“-আমি অপছন্দ করতাম, অবহেলা করতাম, ঘৃণা করতাম আপনার মেয়েকে। সবই করতাম কিন্তু এখন করিনা। এখন ভালোবাসি আমি তাকে।
তখন সবাই অবাক হয়েছিলো। পূর্ণিমা বেগমের মানতে কষ্ট হচ্ছিলো যে প্রার্থ ঘৃণা করতো পুষ্পকে, কষ্ট দিতো তাকে। এই এক কথায় যেন সবকিছু সবার সামনে চলে এলো যা এতদিন পুষ্প প্রার্থ এবং গোটাকয়েক মানুষের জানা ছিলো তা এখন বাকি সবার জানা হয়ে গেলো।
প্রত্যায় সাহেব আবার তেড়ে আসতে চাইছিলেন। প্রার্থ হাত উচিয়ে থামিয়ে দেয় তাকে। শান্ত স্বরে বলে।
“-যা বলার পরে বলবেন। আমার বউকে ঘরে নিয়ে যেতে হবে। সি ইজ প্রেগন্যান্ট। আর এই বয়সে আপনি মেয়ের জামাইয়ের জন্য ডিভোর্স লেটার না বানিয়ে নিজের নাতি নাতনির জন্য কিছু বানান।
শশুর মশাইকে আসল কথা শুনিয়েই পুষ্পকে সোফা থেকে কোলে তুলে নেয়। তখন পূর্নিমা বেগম বলেন।
“-তুই পুষ্পকে ঘৃণা করতি প্রার্থ? ওকে কষ্ট দিতি?
প্রার্থ পুষ্পকে কোলে করেই দাঁড়িয়ে যায়। কন্ঠ যথাসম্ভব মোলায়েম রেখে বলে।
“-মা আমি বলেছি করতাম। জোর করে বিয়ে দেওয়ায় আমি ওকে অনেক অপমান অবহেলা করেছি। কিন্তু উজ্জল নক্ষত্রের মতোই একটি চিরন্তন সত্য হলো আমি ওকে ভালোবাসি মা। সি ইউ মাই এভ্রিথিং। আই লাভ হার ভেরী মাচ।

পুষ্পকে কোলের মাঝে রেখেই সবার সামনে তার কপালে চুমু খায় সে। সবাইকে উপেক্ষা করে দেয় নিয়ে যায় রুমে। ডাক্তার এসে নিচে থেকে দেখেই খুশির খবর দিয়ে গেছে।
এবার উপরে সবাই অপেক্ষা করছে আসল মালকিনকে তার খুশিটুকু শুনিয়ে দেওয়ার। যার গর্ভে এতগুলো মানুষের খুশি ভালোবাসা বেড়ে উঠছে।
এরপর আর প্রত্যয় সাহেব কিছু বলেননি অবশ্য। মেয়ে প্রেগন্যান্ট বিষয়টা সত্যিই খুশির তবে তার মনের সংশয় এখনো কাটেনি। পুষ্পর জ্ঞান ফিরলেই সব ক্লিয়ার হবে।
পুষ্পর হুস এলো আরো দশমিনিটের মাথায়। ক্লান্ত চোখদুটো পিটপিট করে খুললো। চোখের সামনে প্রথমেই ভেসে উঠলো প্রার্থর চকচকে চেহারা। পাশে তাকাতে দেখলো তার বাবাও তার দিকে মায়া চোখে তাকিয়ে। হঠাৎ হুসে আসায় কিছুই বুঝলো না কি হয়েছে। খানিক বাদ সে উঠে বসতে চাইলে। দুইপাশ থেকে বাবা এবং স্বামী তাকে ধরে উঠালো। বাকি সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। কি বলবে কিভাবে বলতে বুঝতে পারছে না। খুশির কারনে কথাই বন্ধ হয়ে গেছে।
পুষ্পকে বেডে হেলান দিয়ে বসালো এরপর প্রার্থই সবার সামনে তার কানের কাছে গিয়ে বললো।

“-কনগ্র্যাচুলেশন মাই ফ্লাওয়ার। ইউ আর প্রেগন্যান্ট।
পুষ্প ঝট করে তাকালো প্রার্থর চোখে। এটুকু কথায়ই তার চোখে জল আনিয়ে দিয়েছে। অবাক নেত্রে তাকিয়ে আছে প্রার্থর দিকে। যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না কথাটা।
পুষ্পকে এরকম অবাক হতে দেখে প্রার্থ হাসলো। বাকিরা মিটিমিটি হেসে দিলো। পূর্ণিমা বেগম এগিয়ে এসে পুষ্পর মাথায় হাত রেখে বললেন।
“-সুখী হ মা। নিজের যত্ন রাখ। আর ভেতরে যে বড় হচ্ছে তারও যত্ন কর। বেচে থাক তোরা। দোয়া করি আল্লাহ তোদের দীর্ঘায়ু করুক।
পুষ্পর চোখে জল। নিজের মাঝে কেমন অনুভুতি হচ্ছে। একে একে সবাই তাকে শুভেচ্ছা জানালো। দোয়া করলো মন থেকে। প্রিয়া প্রান্ত পারছে না তো নাচতেই শুরু করে দিচ্ছে। প্রিয়া হৈ হৈ করে বলে উঠলো ।
“-ইয়েএএ! আমি খালা হবো। ও বুবু তুমি মা হবে আমি খালামনি হবে। আল্লাহ! আমার তো এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। এই অন্ধ একটু চিমটি কাটো না?
হাত বাড়িয়ে অন্তর সামনে ধরলো। অন্ত শান্ত চোখে তাকালো তার দিকে। প্রিয়ার হঠাৎ মনে পরে গেলো তাদের সম্পর্ক এখন আর তরল নেই খুব জটিল হয়ে গেছে। এ সম্পর্কে মজা যায় না আনন্দ যায় না। সহসা হাতটা নামিয়ে ফেললো সে। হৈ হুল্লোড় থামিয়ে অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
এতজনের খুশির মাঝে এত কথার মাঝে হঠাৎ প্রত্যয় সাহেব সকলকে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে বললেন। পুষ্পর সঙ্গে নাকি তার একার কিছু কথা আছে। এ নিয়ে সবাই দ্বিধামন্ত করে শেষে রুম থেকে বেড়িয়েই গেলো তাদের একা ছেড়ে।
যদিও প্রার্থ যেতে চাইছিলো না। তবে পুষ্প চোখ দিয়ে আশ্বাস দেওয়ায় সেও বেড়িয়ে যায়।

কিছুক্ষণের মাঝেই প্রত্যয় সাহেব বেড়িয়ে এলেন রুম থেকে। তার যা যা জানার ছিলো সব জেনে গেছেন। মেয়ে সুখে আছেন শুনে তিনিও সুখী। নিচে এসে প্রার্থর কাছে মাফও চাইলেন তিনি। তবে প্রার্থ আটকে দিলো। দোয়া চাইলো তাদের জন্য।
এবার সবাইকে রেখে সে নিজে চলে গেলো উপরে। সবাই দেখে নিয়েছে পুষ্পকে। এবার তারা স্বামী স্ত্রী একটু আলাদা কথা বলুক। ততক্ষণে নিচে সবাই মিলে আবারও রান্না বান্নার কাজ করবেন। পুষ্প যা খেতে চায় তাই রান্না হবে আবার। সকালে তো কেউ ঠিকঠাক নাস্তা করবে পারেনি। এবার সুসংবাদ শুনে কবজি ডুবিয়ে খাবে। মিষ্টির অর্ডার দিয়েছেন আগেই। খুশিতে তারা কি রেখে কি করবে সেটা ভেবে ভেবেই যেন দিশেহারা সকলে।
প্রার্থ রুমে পৌঁছেই প্রথমে দরজা আটকে দিলো। পুষ্প সেভাবেই বসে আছো বিছানায়। চোখে তার খুশির জোয়ার। প্রার্থ এগিয়ে গিয়ে বসলো তার সামনে। আঙুল দিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিলো। কম্পনরত উষ্ঠে ছোট্ট উষ্ণতার স্পর্শ একে দিলো।
উত্তেজনায় প্রার্থরও চোখে জল চলে আসছে। সে নিজের হাত নিয়ে রাখলো পুষ্পর মেদহীন পেটে।
পরম মায়াভরা কন্ঠে বলে উঠলো।

“-আমাদের?
ছোট্ট একটা কথাই যথেষ্ট ছিলো পুষ্পর খুশি উপচে পরার। কাঁদতে কাঁদতে মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে বুঝালো ” হ্যা আমাদের”। দু হাত বাড়িয়ে দিলো প্রার্থর উদ্দেশ্যে।
দু হাতের ফাক গলে সামনে এগিয়ে আলতো হাতে প্রার্থ জরিয়ে ধরলো তাকে। ঘাড়ে চুমু দিয়ে বললো।
“-থ্যাংক ইউ মাই ফ্লাওয়ার। থ্যাংক ইউ ফর গিভিং মি দিস হ্যাপিনেস।
এরপর হালকা ছেড়ে দিয়ে আবার দীর্ঘ চুম্বন আঁকে পুষ্পর কপালে। অতঃপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে।
“-আমি বাবা হবো ফুল। তুই মা হবি? এখানে আমাদের বাচ্চা? আমাদের? আমাদের ভালোবাসা এখানে?
পুষ্প দুহাত নিয়ে রাখলো প্রার্থর গালে। হাতে গরম তরল কিছু অনুভুত হলো। বুঝলো তিনি প্রবল আবেগে বাধহারা হয়ে গেছেন। কপাল থেকে কপাল উঠিয়ে চোখ রাখলো প্রার্থর চোখে। সে চোরের মতো অশ্রু শুদ্ধ চোখ লুকাতে ব্যাস্ত হলো
পুষ্প হেসে অশ্রুসিক্ত নয়নে বললো।

“-আপনি খুশি?
প্রার্থ হাসিমুখে বললো।
“-এটা আবার জিজ্ঞেস করার মতো কোন প্রশ্ন নাকি? তুই আমার জীবনের সবথেকে বড় খুশি। আর আমাদের এই বাচ্চাটা আমার খুশির আমাদের ভালোবাসার প্রতীক।
পুষ্প টলটলে জল সমেত ভাঙা গলায় আবদার করলো
“-আমাকে একটু জরিয়ে ধরবেন?
এমন মায়াবী আদুরে আবদারে প্রার্থর হাসা ছাড়া উপায় নেই। জরিয়ে ধরার জন্য নাকি আবদার করতে হয়? প্রার্থ তো পারলে তাকে সারাদিন জরিয়ে ধরে শুয়ে থাকতো।
পুষ্পর আবদারে তাকে সাথে সাথে বুকের মাঝে জরিয়ে নিলো। এর থেকে সুখ এর থেকে শান্তি বোধহয় অন্যকিছুতে নেই।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ২৮

দুজনে নীরব হয়ে মুহুর্তটা উপভোগ করলো। বাবা মা হওয়ার সময়টা জীবনে কয়েকবার আসলেও প্রথম অনুভুতি প্রথমই হয়। যেটা জীবনে একবারই আসে। আলাদা অচেনা অজানা অনুভুতি তৈরী হয় যখন কেউ প্রথম মা বাবা হওয়ার সুযোগ পায়। এই সময়টা নষ্ট করার মতো সময় না। এই মোমেন্টটা তারা তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে উপভোগ করবে।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩০