আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৫

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৫
তানহা ইসলাম বৈশাখী

মোবাইলে স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করা আলোয় দেখা যাচ্ছে সময় এখন ১:১৫ মিনিট। তারা ঝলমলে জোৎস্নার আলো এবং রাতের ঠান্ডা হাওয়া মাড়িয়ে প্রার্থর টয়োটা গাড়িটা ছুটে চলেছে বাড়ির পথে। গাড়িতে পাঁচজন মানুষ বসা অথচ সেখানে তাদের শ্বাসের আওয়াজ ছাড়া বাড়তি কোন শব্দ নেই। পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে বর্তমানে। ড্রাইভিংয়ে বসে আছে প্রার্থ তার পাশের সিটে পুষ্প। পেছনের সিটে বসে আছে দুজন যুদ্ধাপরাধী যোদ্ধা। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। মাঝখানে বেচারা প্রান্তকে বসিয়ে রেখে দুপাশ থেকে অন্ত এবং প্রিয়া নীরবে নিজেদের মাঝে ঘাত-প্রতিঘাত করে যাচ্ছে। কেউ কারো থেকে কম যায় না। একবার অন্ত প্রিয়ার দিকে সরু চোখে তাকায় আবার প্রিয়া অন্ত’র দিকে ভ্রুকুটি করে তাকায়। আবার দুজনেই চোখ ফিরিয়ে জানালায় তাকায়। এদের মনে কি চলছে এরাই জানে।
একটু পর পুষ্প নীরবতা ভেঙে কিছুটা বিচক্ষণতার সাথে প্রার্থকে একটা প্রশ্ন করতে চাইলো।

“-আচ্ছা প্রার্থ ভাই একটা প্রশ্ন ছিলো।
প্রার্থ পুষ্পর সম্মোধনটা শুনে সামনের রাস্তা থেকে চোখ ফিরিয়ে পুষ্পর উপর রাখলো। সরু চোখে তাকাতেই পুষ্প বুঝে ফেললো প্রার্থর ইঙ্গিত। তৎক্ষনাৎ জিভ কেটে ভুলটা শুধরে নিতে বললো।
“-ইয়ে মানে। বেবির আব্বু আপনাকে একটা প্রশ্ন করার ছিলো।
প্রার্থর প্রতুত্তর করার আগে পেছন থেকে প্রিয়া সন্দেহ নিয়ে বলে উঠলো।
“-কার আব্বু? কার আব্বু?
পুষ্প বিপাকে পরে আমতাআমতা করে বললো।
“-বে..বেবির আব্বু।
প্রিয়া নাক কুচকে বলে।
“-প্রার্থ ভাইকে “প্রার্থ ভাই” না বলে তুমি বেবির আব্বু কেন বলছো? আগে আমার ভাগ্নে-ভাগ্নী হোক এরপর ওদের নামের পাশে আব্বু লাগিয়ে ডেকো। এখন কেন ডাকছো?
সামনে থেকে ভেসে এলো প্রার্থর ভারী গমগমে আওয়াজ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“- আমি ওর ভাই হই?
প্রিয়া স্বভাবতই বলে।
“-ভাই বর দুটোই।
প্রার্থ রাশভারী কন্ঠে ফের বলে উঠে।
“-তোর হাসব্যান্ড কে তুই ভাই ডাকিস। ও আমাকে ভাই ডাকতে পারবে না। পেটে আমার বাচ্চা নিয়ে আমাকেই ভাই ডাকবে। আমি কি আমার বাচ্চার মামা হবো?
প্রিয়া এবার বুঝলো আসল কাহিনী। নিজের ভুল বুঝে কিছু বলতে নেয়। কিন্তু অন্ত আগেই ধমকে উঠে তাকে।
“-চুপ। তোর বরকে তুই ভাই ডাকবি ফাজিল? চওড়িয়ে দাঁত ফেলে দিবো।
কথার মাঝখানে নাক গলাতে দেখে ক্ষেপে উঠে প্রিয়া।
“-আমার বরকে আমি যা ইচ্ছা ডাকবো তোমার কি? তোমার দেখছি সাহস দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। আমাকে চড় দিবে তুমি?

“-সাহস আমার আগে থেকেই ছিলো। শুধু দেখাইনি। এবার দেখবি আমার সাহস ঠিক কতক্ষাণি।
প্রিয়া সহসা চুপ হয়ে গেলো। ইদানীং অন্তর সাথে তর্কও করতে পারে না মেয়েটা। অন্তর চালচলন সব বদলে গেছে। ঝগড়া করতে গেলে আগের অন্তকে পাওয়া যায় না। শেষমেষ প্রিয়াকেই চুপ থাকতে হয়।
মাঝখান থেকে প্রান্ত বিজ্ঞের ন্যায় বুকে দু-হাত গুঁজে বললো।
“-তোমাদের হলো? আমিও তো এত ঝগড়া করি না। তোমরা কি করে এমন সাপে নেউলের মতো সারাদিন লেগে থাকো?
সামনে থেকে পুষ্প টিপ্পনী কেটে বলে।

“-বুঝলি প্রান্ত ওদের দুজনকে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে তাহলেই যদি এরা থামে।
অন্ত – প্রিয়া দুজনেরই বুকে সূক্ষ্ম কম্পন শুরু হয়। হঠাৎ বুবু বিয়ের কথা তুললো কেন? তবে কি সব জেনে গেলো? ইয়া আল্লাহ! এবার কি হবে? বুবু যদি ভুল বুঝে।
মনের ভেতরের ভয়টা উগলে দিতে চায় প্রিয়া। বৃতিঃস্পৃহায় আটকে আসে স্বর। শুষ্ক ঢোক গিয়ে গলার শ্লেষ কাটিয়ে বলে।
“-আ..আমি কেন এই অন্ধের বাচ্চাকে বিয়ে করবো? ওকে অন্য কোথাও বিয়ে দাও। আমি ওকে বিয়ে করবো না।
পুষ্প চতুরতার সাথে বলে।

“-আরে আজব! আমি কখন বললাম তোদের দুজনকে বিয়ে দিয়ে এক করবো? আমি বলেছি তোদের বিয়ে দিবো। অন্তকে দিবো ভালো একটা মেয়ের সাথে। আর তোর জন্য আমেরিকান একটা সম্মন্ধ এসেছে। ভাবছি সেখানে কথা পাকা করবো।
কথাটা কর্ণকুহর হওয়া মাত্রই অন্তর চোখদুটোতে ভর করে অসহায়ত্ব। বুকের ভেতর কেউ যেন সজোরে একটা বারি দিলো। কেমন বিষাক্ত ব্যাথায় বিষিয়ে উঠে অন্তরটা। জুলজুল চোখে অসহায়ত্ব নিয়ে তাকায় প্রিয়ার দিকে। প্রিয়াও তখন তাকায় অন্তর ব্যাথাযুক্ত চোখে। আবারও সেই ধ্বক করে উঠে ভেতরটা। নাহ! এই ছেলে এমন চাহনী দিয়েই মেরে ফেলবে প্রিয়াকে।
প্রিয়া মাথা নিচু করে ফেলল। তখন যতটা চোটপাট দেখিয়েছিলো এখন আর তেমন চটপটে স্বর বের হয় না গলা দিয়ে। নিচু স্বরে বলে।

“-আমি এখন বিয়ে-টিয়ে করবো না বুবু। এসব নিয়ে এখন ভেবো না দয়া করে।
পুষ্প প্রিয়াকে আরো খুতিয়ে দেখতে চায়। বলে জোর দিয়ে।
“-কেন ভাববো না? তুই বড় হচ্ছিস না? তোকে নিয়ে ভাবতে হবে না? বিয়ে তো এমনিতেও হবে। বিয়ে করেই পড়ালেখা কন্টিনিউ করবি আমার মতো।
প্রিয়ার যেন সত্যিই কান্না এসে যাচ্ছে। কান্নাটা কিসের জন্য সেটাই ঠিক করতে পারছে না সে। এই নোনা জলটা কি শুধু বিয়ে করতে না চাওয়ার জন্য? নাকি অপরপাশে বসা অসহায় মানুষটার জন্যও? নিজের ভেতরের খবর নিজেও জানে না সে।
এদিকে চুপ থাকতে পারলো না অন্ত। যেন শত শত বছরের ব্যাথারা গালায় দলা পাকাচ্ছে। সমসাময়িক ভাবে ধারন করা চঞ্চল ভাবটা কেটে গেছে আগেই। নিজের আসল ব্যাক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলে অসহায় কন্ঠে বললো

“-পুষ্প আপু। ওকে এখন কেন বিয়ে দিবে? ও তো অনেক ছোট? একটু সময় দাও। আরেকটু বড় হোক। আমেরিকায় কেন বিয়ে দিতে হবে? আমাদের দেশে কি ছেলের অভাব বলো?
পুষ্প বুঝলো অন্তর ভেতরের অবস্থা। আবার সিওর হলো অন্ত আসলেই প্রিয়াকে ভালোবাসে। মজা করাটা বোধহয় বেশি হয়ে গেলো। নরম মন সহজেই গলে গেলো পুষ্পর। প্রসঙ্গ বদলাতে বললো।
“-সেটা আমি বুঝে নিবো। আমি কি যেন বলতে চাচ্ছিলাম প্রার্থ ভা.. মানে আপনাকে কি যেন বলতে চাচ্ছিলাম।
শেষে মুখ ফসকে আসা শব্দটা গিলে নিলো সে। প্রার্থ সমনের রাস্তায় তাকিয়েই বললো
“-আমি কি করে বলবো?
পুষ্প কিছু মনে করে বললো।

“-ওহ হ্যাঁ। বলছিলাম আপনাদের বন্ধুদের সবার তো বিয়ে হয়ে গেলো। এখন আছে হৃদয় ভাইয়া আর রকি ভাইয়া। হৃদয় ভাইয়ার তো মোহ আছে। দুদিন পরেই আবার দাওয়াত খেতে হবে আমাদের। কিন্তু রকি ভাইয়ার কি খবর? তাকে কি বিয়ে শাদি দিবেন না? আমি তো তাকে সবসময় একাই দেখি।
প্রার্থ মনোযোগ ড্রাইভিংয়ে রেখেই স্বাভাবিক স্বরে বললো।
“-ওর বর্তমান গার্লফ্রেন্ড ইতালিতে থাকে। এটা যদি টিকে যায় তবে হৃদয়ের পরেই ওর পালা।
পুষ্প খুশি হয়ে বলে।
“-যাক তবে আপনারা সবাই মিঙ্গেল আছেন। আপনাদের গ্রুপের কেউ আর ব্যাচেলার থাকবে না।
“-হুম।
আবারও নিরবতা। আরেকটু পথ পেরোলেই চৌধুরী বাড়ির গেট। গন্তব্যে পৌঁছানোর ঠিক আগ মুহূর্তে প্রার্থ আঁড়চোখে তাকালো পুষ্পর দিকে। এক সেকেন্ডের জন্য চোখ ফিরিয়ে আনতেই সতর্ক হলো ফের। আতঙ্কিত চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে পুরোপুরি ভাবে তাকালো পুষ্পর দিকে। পুষ্পকে চোখ বুজে থাকতে দেখেই নড়ে উঠলো প্রার্থ। মাত্রই তো কথা বলছিলো। বাড়ির এত কাছে এসে এইটুকু সময়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার মানুষ তো পুষ্প নয়। সে গাড়ির স্পিড কমিয়ে বাঁ-হাত রাখলো পুষ্পর গালে। ডাকলো।
“-ফুল। কি হয়েছে…

আর কিছু বলতে পারলো না প্রার্থ। মুখটা ধরে ঝাকানোর ফলে পুষ্পর মাথাসহ পুরো শরীর টলে পরলো প্রার্থর হাতে। এবার টনক নড়লো প্রার্থর। ভয়ে কেঁপে উঠলো চারপ্রকষ্ট বিশিষ্ট হৃৎপিণ্ড। মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন জানান দিচ্ছে বিপদের আভাস। সে তৎক্ষণাৎ জবর চোস্ত একটা ব্রেক কষলো। গাড়ির প্রথম টায়ার দুটে এসে ঠেকলো বাড়ির গেটের সামনে। প্রার্থ সিটবেল্ট খুলে এগিয়ে যায় পুষ্পর দিকে। বারবার গাল ঝাকিয়ে অস্থির চিত্তে ডাকে তাকে।
“-ফুল। এ্যাই ফুল। কি হলো জান? এই মজা করছিস আমার সাথে? উঠ ফুল।
পুষ্প উঠে না। বেহুশ পরে থাকে প্রার্থর হাতে। পেছন থেকে অন্তরাও বিচলিত হয়ে পরে। তখনই প্রার্থ অন্তকে উদ্দেশ্যে করে ত্রস্ত স্বরে বলে উঠে।
“-অন্ত ড্রাইভিংয়ে আয়। উই হ্যাভ টু রিচ দ্যা হসপিটাল ইমিডিয়েটলি।
“-কিন্তু ভাই আমরা তো বাড়িতে এসে গেছি। আপুকে ভেতরে নিয়ে যাই? বাড়িতে ডাক্তার ডাকি?
অন্তর কথায় রক্তিম চোখে তাকালো প্রার্থ। ক্ষিপ্র স্বরে আদেশ ছুড়ে বললো।
“-তোকে ড্রাইভিংয়ে আসতে বলেছি আমি।

অন্ত তৎক্ষনাৎ নেমে পরে পেছন থেকে। ত্রস্ত পায়ে সামনে এসে বসে। প্রার্থ ততক্ষণে পুষ্পকে কোলে উঠিয়ে তার সিটে বসে পড়েছে। বারবার গাল ঝাঁকিয়ে ডাকছে তাকে। তার ফুল তো এইমাত্র কত হাসিখুশি কথা বলছিলো। হঠাৎ এমন কেন হলো? প্রেগন্যান্সির জন্য? নাকি অন্য কোন কারনে?
প্রার্থর আত্মা শুকিয়ে যায়। ভেতর থেকে একটু পানি চায় তৃষ্ণার্ত গলাটা ভেজানোর জন্য।
পেছন থেকে প্রিয়া কেঁদে ফেলেছে প্রিয় বুবুকে অবচেতন অবস্থায় দেখে। ছোট্ট প্রান্তটাও ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কেঁদে কেঁদে ফুল আপু ফুল আপু বলে ডেকে যায়। কিন্তু ফুল আপু আর উঠে না। একটা মেয়ে চারটা মানুষের হৃৎস্পন্দন থমকে দিয়ে কি সুন্দর ঘুমাচ্ছে দেখো!
গাড়ি থেকে পানির বোতল নিয়ে বার কয়েক ছিটিয়ে দিলো পুষ্পর মুখে। তবুও কোনো সাড়া পেলো না। প্রার্থর মনে হলো তার থেকে অসহায় ব্যাক্তি বোধহয় দুটো নেই। নিজের কোলের মাঝে নিজের স্ত্রী বেহুশ হয়ে পরে আছে। সে তাকে হুঁশে আনতে পারছে না। ডেকে তুলতে পারছে না। সারাদিন চোখে চোখে রাখার পরেও চোখের সামনেই অঘটন ঘটে গেলো।

মনের মাঝে সকল নিষিদ্ধ অবাঞ্ছিত ভাবনারা এসে ঘুরপাক খাচ্ছে। ভয়ের পরিমান যেন বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এত কিছুর পরেও যখন জ্ঞান ফিরে না তখন বুকের মাঝে জাপ্টে ধরলো পুষ্পর মাথাটা। পুষ্প হুঁশে থাকলে বোধহয় শুনতে পেতো এই পেশিবহুল বুকটার ভেতরের ছোট্ট হৃদযন্ত্র নামক বস্তুটা ঠিক কেমন গতিতে ছুটে চলছে। কতটা দ্রুত গতিতে ধুকপুক করে চলেছে তার প্রস্তরকঠোর হৃৎপিণ্ডটা।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৪

গাড়ি ফুল স্পিডে ছুটে চলেছে। মধ্যরাতের শুনশান রাস্তায় অন্ত হাওয়ার গতিতে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে গাড়িকে। ড্রাইভিংয়ে খুব একটা পাকা নয় সে। সবে শিখেছে গাড়ি চালানো। তেমন অনুশীলনও নেই। তবুও ঝুকি নিয়ে ছুটে চললো সে। ত্রিশ মিনিটের রাস্তা তাদের কাছে আর ফুরাচ্ছে না। বিপদের সময় কি সব এমন ধীর হয়ে যায়? নাকি মানুষের মস্তিষ্ক অচল হয়ে যায়?

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৬