আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৬

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৬
তানহা ইসলাম বৈশাখী

সকাল সাতটা। কাল রাত দেরটার দিকে হসপিটালে এসেছে চারজন। তারা আর ঘরমুখো হয়নি। রাত থেকে এখানেই পরে আছে। পুষ্পর জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। কেবিনে এখন পুষ্প আর প্রিয়া আছে৷ প্রার্থ গিয়েছে ডাক্তারের সাথে আলাপ সারতে। অন্তও বাইরে গেছে কিছু হালকা খাবার আনতে।
প্রিয়া বোনের সামনে বসে বসে কাঁদছে। ক্ষনে ক্ষনে নাক টানছে।
পুষ্প তাকে শান্তনা দিতে বললো।
“-আরে বাবা! এভাবে কাঁদছিস কেন? আমি তো ঠিক আছি। প্রেগন্যান্সির সময় এমনটা হওয়া তো স্বাভাবিক।
প্রিয়া নাক টেনে চোখের পানি ফেলে বললো।
“-ভয় পেয়েছিলাম বুবু। যদি তোমার খারাপ কিছু হয়ে যেত?

পুষ্পর মায়া হলো অনেক। মানুষ বলে পিঠাপিঠি ভাই-বোনেরা নাকি কখনো মিশতে পারে না একে অপরের সাথে। সবসময় ঝগড়া হয়। কিন্তু তাদের বোনের সম্পর্কে ঝগড়া জিনিসটা খুব বিরল। পুষ্প যেমন স্নেহ করে প্রিয়াকে প্রিয়াও তেমন শ্রদ্ধা করে বড় বোনকে। ঝগড়ায় এক্সপার্ট মেয়ে হলেও বোনের সাথে সে ঝগড়া করে না কখনোই। বরং বোন ছাড়া তার চলেই না।
পুষ্প বেডে হেলান দিয়ে শুয়ে ছিলো। বোনকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো। প্রিয়া তার বেডের পাশেই একটা টুলে বসে ছিলো। বোনের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের ফাক গলে জরিয়ে ধরে তাকে। পুষ্প তার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললো।
“-হয়েছে। থাম এবার। কিছু হয়নি তো। একটু মাথা ঘুরেছিলো আর কিছু না। তোর যখন বিয়ে হবে বাবু হবে তখন তোরও এমন লাগবে। এটা স্বাভাবিক। এ নিয়ে এত চিন্তা করতে হয় নাকি পাগল!
প্রিয়া উঠে বসে বললো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“-আগে তোমার বরকে বোঝাও। সে যেমন পাগলামো করেছে তা দেখে সবাই ভয় পাবে। প্রার্থ ভাই কিন্তু খুব ভয় পেয়েছে। আমি সিওর এখনো শরীর দিয়ে ঘাম ছুটছে তার।
পুষ্প কিছু বলবে তখনই কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো কেউ। দুজনই সেদিকে তাকাতেই দেখলো প্রার্থ দাঁড়িয়ে। প্রিয়ার কথা অনুযায়ী সত্যিই ঘেমে আছে ছেলেটা। সামনের দুটো খোলা বোতামের শার্টটা শক্ত ফোলা পেশির সাথে আটোসাটো হয়ে আছে। বড় চুলগুলোতেও ঘামের চিহ্ন বিদ্যমান। চোখ দুটো লাল।
জ্ঞান ফেরার পর এইযে এখন সে পুষ্পর দেখা পেলো। এবার বুকের ভেতর হালকা লাগছে। সে আস্তে ধীরে এগিয়ে যায় সামনে। কাছাকাছি গিয়েই প্রিয়ার উদ্দেশ্যে বাক্য ছুঁড়ে।
“-বাইরে যা।
প্রিয়া কথা বাড়ালো না। বুঝলো তাদের একান্ত সময় প্রয়োজন। তাই চুপচাপ চপল পায়ে বেড়িয়ে গেলো বাইরে।
প্রার্থ দাঁড়িয়ে থাকে একইভাবে। না কথা বলে আর না বসে। শুধু চেয়ে রয় পুষ্পর দিকে। সে কথা বলছে না বলে পুষ্পই সাহস করে বললো।
“-আপনাকে এমন লাগছে কেন? আমার কিছু হয়নি তো। এত চিন্তা করছেন কেন? নিজের চোখ মুখের অবস্থা দেখেছেন?

প্রার্থ এগিয়ে যায়। পুষ্পর একহাত টেনে বুকের উপর চেপে রাখে। বলে।
“-মনের অবস্থা দেখেছিস? এই দেখ এখানে এখনো কেমন করছে।
পুষ্পর এক হাত প্রার্থর বুকের বা-পাশে রাখা। ভেতরের ধ্বক ধ্বক করা হৃৎপিণ্ডের গতি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কি জোরে জোরে ছুটছে যন্ত্রটা। সে অন্যহাত নিয়ে প্রার্থর গালে রাখে। মায়া ভরা কন্ঠে বলে।
“-এত চিন্তা করে নিজের ক্ষতি কেন করছেন? আপনি শিক্ষিত ছেলে। আপনার তো জানার কথা প্রেগন্যান্সিতে এরকম হরমোনাল প্রবলেম হয়-ই। এতে এত চিন্তা করলে চলবে? আমি কি আপনাকে ছেড়ে যাচ্ছি নাকি? এত সহজে ছাড়ছি না আপনাকে।
প্রার্থ আলতো হাতে তাকে গিয়ে জরিয়ে ধরলো। মাথায় চুলের ভাজে চুমু দিয়ে বললো।
“-আমি ছাড়তে দিচ্ছিও না।
পুষ্প দুহাত প্রার্থর পিঠে রেখে ভালোভাবে জরিয়ে নিলো তাকে। বললো
“- তাহলে এত ভয় কিসের?

ভয়টা যে কিসের সেটা তো আর পুষ্পকে বলা যাবে না। ভয়টা প্রার্থর মনেই থাক। দুঃস্বপ্নগুলো স্বপ্নেই শেষ হোক। শুধু দুঃস্বপ্ন হলেও হতো। কিন্তু আজ ডাক্তার কি বললো! ডাক্তারের কথাতেই প্রার্থর প্রান যাচ্ছে আর আসছে। এই অজ্ঞান হওয়াটা নাকি শুধু প্রেগন্যান্সির জন্য নয়। অন্য কোন কারন আছে যা তারা এখনো ধরতে পারেনি। পুষ্পর কিছু টেস্ট করা হবে। এরপরই বুঝবে সব।
প্রার্থ মনে মনে শুধু দোয়া করছে যাতে খারাপ কিছু না হয়। ‘খারাপ কিছু’ কথাটুকু ভাবলেও অস্থির লাগছে।
প্রার্থ পুষ্পকে ছেড়ে তার মুখোমুখি বসলো। পুষ্পর শুষ্ক ঠোঁটে ছোট চুমু খেলো। ভয় বা ভয়ের কারণ কিছুই বললো না। গালে হাত রেখে শুধু বললো।
“-ভয় নায় শূন্যতা। তোকে জ্ঞানশূন্য দেখলে ভেতরে সবকিছু শূন্য শূন্য লাগে।

কেবিনের বাইরে সারিবদ্ধ চেয়ার রাখা। প্রিয়া সেখানে বসে আছে। চোখ ফ্লোরে আটকে। একটু পর পর নাক টানছে। কান্নার দরুন নাকটা ঢিলে হয়ে গেছে। পানি আসছে শুধু। চোখের কোনেও পানির ঝিলিক। শুধু মনে হচ্ছে বড় বোনটার আজ কিছু হয়ে গেলে কি হতো। সেই অযাচিত ভাবনা থেকেই বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছে। সাথে নাকেরও বারোটা বাজছে।
এমনসময় হঠাৎ পাশে এসে কেউ বসলো। চোখ তুলে তাকানোর আগেই দেখলো ছেলেটা একটা সাদা রুমাল এগিয়ে দিয়েছে। রুমাল ধরা হাতটা দেখেই বুঝলো হাতের মালিক কে হতে পারে। তাই আর চোখ তুলে তাকালো না। নিচে তাকিয়ে রইলো।
অন্তর রাগ হলো। গুরুগম্ভীর স্বরে বললো।

“-ধর এটা।
প্রিয়া হাত বাড়িয়ে ধরলো সেটা। ধরে হাতেই রাখলো। রুমালের ডিজাইনটা দেখলো। এটা অহনা বেগমের হাতের কাজ। ভদ্রমহিলা অবসরেও খালি থাকে না। কিছু না কিছু করতেই থাকে।
প্রিয়াকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অন্ত ফের বললো।
“-শুধু ধরে রাখতে দেইনি। পানি গুলো মুছতেও দিয়েছি।
প্রিয়া রুমালটা নাকে চেপে শব্দ করে নাকের সবটুকু পানি মুছে ফেললো। নাকটাক মুছে রুমাল ভরিয়ে দিয়ে আবার অন্তকে ফেরত দিতে নেয়। অন্তর দিকে তাকাতেই দেখে সে সরু চোখে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই হাতটা গুটিয়ে নেয়। তুতলিয়ে বলে।
“-স..সরি। এটা থাক আমার কাছে। আমি ধূয়ে দিয়ে দিবো।
“-প্রয়োজন নেই।

অন্ত হাত বাড়িয়ে সেই সর্দি ললাগা রুমালটা নিতে নেয়। কিন্তু প্রিয়া দেয় না। হাত সরিয়ে নিয়ে বলে।
“-না থাক। এটাতে ময়লা লেগে গেছে। আমি ধুয়ে দিয়ে দিবো। ততক্ষণ থাক আমার কাছে।
অন্ত কিছু বললো না। তার হাতে কয়েকটা ব্যাগ। ডাক্তার বলেছে কিছু খাবারের ব্যাবস্থা করতে যাতে পুষ্পর দূর্বলতা কিছুটা কাটে। অন্ত বাইরে গিয়ে রুটি, কলা, অন্যান্য ফল, জুস নিয়ে এসেছে।
ব্যাগ থেকে একটা ব্রেড বের করে বললো।
“-এটা খা।
“-খাবো না।
প্রিয়ার চোখের কোনে একবিন্দু জল জমে আছে। অন্তর চোখে বিধলো সেটা। সে হাত বাড়ায় সে চোখের দিকে। ইতস্ততায় গলা বেয়ে নেমে যায় তরল পদার্থ। অবশেষে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো সে চোখ। বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মুছিয়ে দিলো এক বিন্দু নোনা জল।

অন্তর হাতের স্পর্শে প্রিয়ার শিরদাঁড়া বেয়ে গড়িয়ে পড়ে তরল। বুকের ভেতর উথাল-পাতাল ঝড়। কি অদ্ভুদ! কদিন আগেও যাকে ধরে ধরে মেরেছে খোচা দিয়েছে আজ তার সামান্য স্পর্শেই গাত্রে অদ্ভুদ শিহরণ তুলছে।
অন্ত হাত সরালো না। পুরো হাতটা রাখলো প্রিয়ার গালে। বললো আদর নিয়ে।
“-এত কাঁদছিস কেন? আপু ঠিক আছে। কিছু হবে না।
প্রিয়া বাকহারা। একটু স্পর্শ আর ওই চশমা ওয়ালা চোখের সম্মোহনী চাহনী। দুটোই তার মুখ বন্ধ করে রেখেছে। কেমন কেমন চোখে চেয়ে আছে অন্তর দিকে।
অন্ত হাত সরিয়ে আনে। রুটিটা মুখের সামনে ধরে বলে
-“হা কর। বাড়ি যেতে দেরি হবে। আপুর কিছু টেস্ট করাবে।
প্রিয়ার মসৃণ ভ্রু নিমিষেই কুচকে গেলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“-কিসের টেস্ট?
“-জানিনা। প্রার্থ ভাইয়ের সাথে ডাক্তারের কেবিনে গিয়েছিলাম তখন তিনি বললেন কিছু টেস্ট করাতে। তেমন কিছু না। তুই চিন্তা করিস না। হা কর।
প্রিয়া সত্যিই হা করলো। মুখের ভেতর পুরে নিলো অন্তর দেওয়া পাউরুটির টুকরো। অন্ত অবাক হয়। অন্ত ভেবেছিলো এইত এখনই প্রিয়া মুখ ফিরিয়ে বলবে খাবো না যাও এখান থেকে, নয়তো বলবে আমার হাত আছে আমি খেয়ে নিতে পারবো। কিন্তু না। এগুলোর কিছুই হয়নি। উল্টো সে অন্তর হাত থেকেই খেয়ে নিলো। এই দৃশ্যটুকু ক্যামেরা বন্দী করে রাখলে সুন্দর হতো না? না থাক এই দৃশ্যটুকু মন বন্দী হয়েই থাকুক।

বিকেল বেলা। সূর্যের উত্তাপ তখন প্রায় শেষের পথে। অর্নবরা এসেছিলো সেসময়। পুষ্পর অসুস্থতার খবর শুনে বন্ধুরা সকলে চলে এসেছে। সাথে স্নেহাও এসেছিলো অর্নবের বউ হিসেবে। তাছাড়া প্রার্থর মা-ও দেখেনি নতুন বউকে। এই উছিলায় বউও দেখা হলো।
বেশ অনেকটা সময় গল্পগুজব করে খাওয়া দাওয়া করে চলে গেছে তারা।
হসপিটাল থেকে আসার আগে প্রয়োজনীর সব টেস্ট করিয়ে এনেছিলো। ডাক্তার বলেছে দুদিন পর এসে রিপোর্ট নিয়ে যেতে। আপাতত এ নিয়ে আর কোন ঝামেলা হয়নি। পূর্নিমা বেগম একটু চিন্তায় ছিলেন কিন্তু গর্ভকালীন সময়ে এসব কমন বলে চিন্তাটা একটু কমেছে। অবাঞ্ছিত চিন্তাগুলো শুধু প্রার্থর মাথাতেই কিলবিল করছে। বাড়ির প্রতিটা মানুষ শান্তিতে থাকলেও শান্তিতে থাকতে পারছে না প্রার্থ। যতক্ষণ পর্যন্ত না রিপোর্টে সব ঠিকঠাক আসছে ততদিন পর্যন্ত শান্তি নেই।

দুই দিন পর।
দিনের মতোই দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে তাদের জীবন। প্রার্থদের কনসার্টের কাজ চলছে, অফিসের কাজ করছে, পুষ্পর দেখভাল করছে, মা’কে সময় দিচ্ছে। প্রিয়ার কলেজ চলছে, অন্তর ভার্সিটি চলছে। দিন দিনের মতোই চলছে। সবকিছুই স্বাভাবিকভাবেই চলছে।
আজ দুদিন পর পুষ্পর রিপোর্ট আনার কথা। সেদিকে কারো তেমন খেয়াল না থাকলেও প্রার্থর ঠিকই খেয়াল আছে। তাই শত ব্যাস্ততার মাঝেও সে গিয়েছিলো হসপিটালে। সেখান থেকে ফিরেছে সন্ধ্যার দিকে। সবার সাথে স্বাভাবিক থেকেছে। খাবার খেয়েছে মায়ের সাথে। মা’কে ওষুধ খাইয়ে রেখে আবার কোথায় যেন চলে গেছে। বাইরে গেলো না ছাদে পুষ্প নিজেও বুঝতে পারছে না।
ঘুমানোর সময় হয়ে এলো তবুও প্রার্থ ঘরে আসছে না। সবাই যার যার ঘরে চলে গেছে ঘুমানোর জন্য। প্রার্থরই কোন খবর নেই।
পুষ্প তার অপেক্ষায় বসে আছে রুমে। কোলের মাঝে এলাচি। তার সাথে খেলা করছে, গা চুলকে দিচ্ছে মাঝে মাঝে বকবকও করছে। একসময় বিরক্ত হয়ে এলাচিকে বললো।

“-উনি কই গেলো রে এলাচি? আমার ঘুম পাচ্ছে। লোকটার কি জ্ঞান নেই? এখন ঘুমিয়ে গেলে এসে জরিয়ে ধরে শুয়ে পড়বে তখন আমার কাচা ঘুমের বারোটা বাজাবে। আশ্চর্য! কোন দায়িত্ববোধ নেই।
তখনই দরজায় খট করে শব্দ হলো। প্রার্থ দরজা আটকে দাড়িয়ে আছে সেথায়। এদিকেই তাকিয়ে আছে। চোখ মুখের কি বিদ্ধস্ত অবস্থা। গোছানো চুলগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে আছে। চোখের ভাষায় আজ অন্যকিছু। দাড়িয়ে আছে যে তাও বোধহয় খুব কষ্ট করে। যেন এখনই গাত্রের সমস্ত ভর ছেড়ে দিয়ে পরে যাবে। পুষ্পর ভ্রু কুঁচকে যায়। প্রার্থ এগিয়ে আসে সামান্য। পুষ্প সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“-আপনার কি হয়েছে? এমন লাগছে কেন? কোথায় ছিলেন?
প্রার্থ একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিলো না। বিদ্ধস্ত চোখমুখে তাকিয়ে পথ হারানো পথিকের ন্যায় আবদার ছুড়লো।
“-আমাকে একটু জরিয়ে ধরবি ফুল?

এ কেমন কথা? জরিয়ে ধরার জন্য এমন আকুতি ভরা স্বরে আবদার করতে হবে? পুষ্প বুঝলো কিছু তো একটা হয়েছে। নয়তো হঠাৎ এমন করবে কেন? সে আর উল্টো কোন প্রশ্ন করলো না। কোল থেকে এলাচিকে নামিয়ে দিলো। খাট থেকে নেমে এগিয়ে গিয়ে নিজ উদ্যোগে গলা জরিয়ে ধরলো প্রার্থর। প্রার্থ লম্বা হওয়ায় খুব একটা যুত করতে পারছিলো না। আচানক প্রার্থ দু হাতে শক্ত করে জরিয়ে ধরে একহাত উচু করে নিলো পুষ্পকে। গলায় গুজে দিলো মুখ। পারছে না তো ভেতরের সমস্ত দুঃখ ঢেলে দিতে ইচ্ছে করছে। এত কষ্ট প্রার্থ কই রাখবে? নিজের ভেতর চেপে রাখতে রাখতে একদিন মরে যাবে না?
পুষ্পর মনে হলো খারাপ কিছু হয়েছে। নয়তো এভাবে এত শক্ত করে জরিয়ে ধরার তো কথা নয়। এদিকে প্রার্থর শরীর থেকে সিগারেটের উগ্র গন্ধে পেট গুলিয়ে আসছে পুষ্পর। গন্ধটা একটু বেশিই উটকো লাগছে। আর সহ্য করা যাচ্ছে না। কষ্ট করে বমি আটকে বললো।
“-প্রার্থ ভাই সিগারেট খেয়েছেন? ছাড়ুন। গন্ধে পেট গুলিয়ে আসছে। বমি পাচ্ছে।

প্রার্থর টনক নড়ে। নিচে নামায় তাকে। পুষ্প ছাড়া পেয়েই দৌঁড় দেয় ওয়াসরুমে। প্রার্থ সত্যিই সিগারেট খেয়েছে। একটা নয় দুটো নয় তিনটে সিগারেট একসাথে শেষ করেছে। একটাবার খেয়াল করেনি পুষ্পর কাছে গন্ধ লাগতে পারে। এই চিন্তা তার মাথাতেই আসেনি। রাগে ক্ষোভে চুল খামচে ধরে। শরীরের সমস্ত জোর খাটিয়ে ঘুষি দেয় শক্ত দেওয়ালে। নিজেকে আরো কিছুক্ষণ আঘাত করতে পারলে বোধহয় শান্তি লাগতো। তবে এখন এসবের সময় নেই। পুষ্প বোধহয় বমি করছে তাকে দেখা দরকার।

সিগারেটের গন্ধ গর্ভধারিণী মায়েদের সহ্য হয় না। পুষ্পরও হলো না। ভকভক করে বমি করলো কিছুক্ষণ। প্রার্থ খুব কাছে গেলো না তার। কারন শরীরে এখনো সিগারেটের গন্ধ রয়েছে।
পুষ্পকে ফ্রেশ করিয়ে এনে বিছানায় শুয়িয়ে দিলো। প্রার্থ চলে গেলো এই রাতের বেলায় শাওয়ার নিতে। শরীরের গন্ধটা আগে দূর করা দরকার। এত অসাবধান সে কি করে হলো সেটাই বুঝছে না।
শাওয়ার শেষে শরীরের গন্ধটা দূর করে ওয়াসরুম থেকে বেরিয়ে আসে প্রার্থ। পুষ্প বিছানায় নেতিয়ে আছে। প্রার্থর অনুসূচনা হলো ভীষন। সিগারেটটা না টানলে কি হতো না?
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো পুষ্পর পানে। পুষ্প চোখ বুজে আছে। প্রার্থ তার মাথায় হাত রাখলে চোখদুটো খুলে।
“-স্যরি!
প্রার্থ ভেবেছিলো পুষ্প রাগ করেছে। তাই স্যরি বললো। কিন্তু পুষ্প রাগ করলো না উল্টো ঠোঁটে কিঞ্চিত হাসি নিয়ে বললো।
“-স্যরি কেন?

“-সিগারেট খেয়ে আসা ঠিক হয়নি। আমি বুঝতে পারিনি এমন হবে।
পুষ্প দূর্বলতার মাঝেও মজা করে বললো,
“-তা সিগারেট কেন খান? ছ্যাকা খেয়েছেন প্রেমিকার থেকে?
“-ছ্যাকা খেলে মানুষ সিগারেট খায়?
“-খেতেও পারে। এবার এই টপিক বাদ দিন। এরপর থেকে আর ওগুলো খাবেন না। কি বিশ্রী গন্ধ।
প্রার্থ মলিন হেসে বলে
“-আচ্ছা খাবো না।
পুষ্প দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে ডাকে প্রার্থকে।
“-আসুন শুয়ে পড়ুন। আপনাকে ছাড়া ঘুম আসছে না আপনাকে ধরে শোয়ার অভ্যেস হয়ে গেছে।
হয়তো প্রার্থরও এটারই প্রয়োজন ছিলো। সে সময় ব্যায় না করে বাতি নিভিয়ে পুষ্পর কাছে শুয়ে পরে। আজ স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই শক্ত করে ধরে পুষ্পকে৷ পুষ্প ঠিক ধরতে পারছে না প্রার্থর হয়েছে কি তবে বুঝতে পারছে কিছু তো একটা হয়েছে।
কিছুক্ষণ পর পুষ্প একটা প্রশ্ন করে বসে।

“-আজ না আমার রিপোর্ট আনার কথা ছিলো। এনেছেন? কিছু হয়েছে আমার?
প্রার্থ থমকে যায়। এই প্রশ্নের মুখোমুখি সে হতে চায়নি তবুও হতে হলো৷ প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে কোনরকমে বলে উঠে।
“-যাওয়ার সময় হয়নি তাই আনা হয়নি। ঘুমা পরে এনে দিবো।
পুষ্প আর কিছু বললো না। এমনিতেও অফিসে যোগ দেওয়ার পর প্রার্থ অনেক ব্যাস্ত হয়ে গেছে। ক্লান্ত শরীরে সেখানে না গিয়েই ভালো হয়েছে।
সে আর অত শত না ভেবে ঘুমিয়ে যেতে চাইলো। শরীর দূর্বল লাগছে বেশ৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো ঘুমিয়ে গেলো পুষ্প। কিন্তু ঘুমাতে পারলো না প্রার্থ। চোখে ভাসছে রিপোর্টের ওই লেখাটুকু “ক্রনিক সাবডুরাল হেমাটোমা”
কানে ভাসছে ডাক্তারের সেই তিক্ত কিছু কথা,

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৫

“-মিস্টার চৌধুরী আমরা যা সন্দেহ করেছিলাম তাই হয়েছে। আপনার স্ত্রীর শুধুমাত্র গর্ভাবস্থার কারনে সেন্সলেস হয়নি। উনার মস্তিস্কে রোগ ধরা পড়েছে। তার মাথায় আগে থেকেই আঘাত ছিলো সেখানে রক্ত জমাট বাধা ছিলো। এবং সেটিই ধীরে ধীরে বড় হয়ে মস্তিস্কে চাপ সৃষ্টি করে । এটাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে ক্রনিক সাবডুরাল হেমাটোমা। প্রাথমিক পর্যায়ে এর লক্ষন স্বল্প হওয়ায় ডাক্তাররা হয়তো এটা ধরতে পারেনি। এখন সেটি বড় হয়েছে এবং স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। এটি আপনাদের অনাগত সন্তানের জন্যও ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। সাবধানে দেখে রাখুন উনাকে। এবং দ্রুত অপারেশনের ব্যাবস্থা করুন।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৬ (২)