আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৭

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৭
তানহা ইসলাম বৈশাখী

রাত বাজে প্রায় সোয়া ১১ টা। অন্ধকার ঘরে লুমিনাস ক্লকের জ্বলজ্বলে সময়টাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো অর্নব। বিছানাতে গা এলিয়েছে সেই কখন অথচ ঘুম বাবাজি এখনো চোখে ধরা দিচ্ছে না৷ বড় সুন্দর চোখদুটো পলকহীন তাকিয়ে আছে সিলিংয়ের দিকে। ক্ষণে ক্ষণে শুষ্ক ঢোক গিলে যাচ্ছে। অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে আছে শরীর। নিজের শরীরের উপর নারী দেহের উপস্থিতি তাকে বড্ড জ্বালাচ্ছে। ঘুরে ফিরে কেমন অবাধ্য চিন্তাগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।

স্নেহার ছোট্ট পাঁ-টা অর্নবের মেদহীন পেটের উপর রাখা। এই নিয়েই অর্নবের যত জ্বালা।
বিয়ের এতদিন হলেও তারা এত কাছাকাছি আসেনি কখনো। অর্নব কাছে যায়নি স্নেহাও কোন অভিযোগ তুলেনি। আজ ঘুমের তালে মেয়েটা যে কখন এত কাছে চলে এলো। এখন পা সরাবে কি করে? স্নেহার পাজামাটা হাঁটুর উপরে উঠে গেছে। এবার হাঁটুর নিচে হাত দিয়ে সরাতে গেলে উন্মুক্ত পায়ে হাত পড়বে। আবার হাঁটুর উপরেও হাত রাখতে ইচ্ছে করছে না। অস্বস্তি ধীরে ধীরে বেড়েই যাচ্ছে অর্নবের। পাশে এমন রমনী নিয়ে ঘুমানো যায় নাকি তাও যদি থাকে সে এত কাছে।
অর্নব ভাবলো ডাকবে স্নেহাকে। করলোও তাই। চাপা স্বরে ডেকে উঠলো তাকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“-স্নেহা! স্নেহা! শুনতে পাচ্ছো? তোমার পা-টা সরাবে? আমার ঘুম হচ্ছে না।
কোন ফায়দা হলো না। এত ডাকেও উঠলো না। উল্টো আরো কাছে এলো। অর্নবকে কোলবালিস ভেবে দুহাতে জাপ্টে ধরে। পা-ও আরো শক্ত ভাবে রাখে। মাথা ঠেকিয়ে দেয় বুকের কাছে। তবে অর্নব চিত হয়ে শোয়ায় তেমন জুত করতে পারছে না সে।
এদিকে অর্নবের বারোটা বেজে যাচ্ছে। কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে। শ্বাস ভারী হয়ে এসেছে। মনেহয় এখনই দম বেড়িয়ে মরে যাবে সে। এসি চালিত রুমের মধ্যেও মিনিটের মাঝেই তরতরিয়ে ঘেমে উঠে তার শরীর। উফফ! এই মেয়ে মানুষের এত শক্তি? নিমিষেই একটা পুরুষের শরীরে ঘাম ঝড়িয়ে দিতে পারে? এখন সে কি করবে? প্রথমেই সে নিজেকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। ভাবলো- ‘এটা তো কোন পরনারী নয়। এ তোর বিয়ে করা বউ। তোর সম্পূর্ণ অধিকার আছে তাকে স্পর্শ করার ‘

এই ভেবে দ্বিধা কাটিয়ে ডাকতে চায় তাকে। কিন্তু মুখটা চুল দিয়ে একদম ঢেকে গেছে স্নেহার। সে একহাতে আলগোছে চুলগুলো সব সরিয়ে দেয় স্নেহার মুখ হতে। তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে আসে সুন্দর, কোমল, নিষ্পাপ এক চেহারা। অন্ধকারের মাঝে বাইরের সল্প আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাকে। ঘুমন্ত অবস্থায় কি সুন্দর লাগছে তাকে। চেহারায় বাচ্চা বাচ্চা ভাব আছে মেয়েটার। দেখলেই স্নেহ জাগে। বারবার মুখ থেকে ওই একটাই শব্দ আসে “স্নেহময়ী”।
অর্নব চটা হাতটা ওই কোমল গালে রাখলো। হালকা ঝাঁকিয়ে ডাকলো তাকে,

“-স্নেহময়ী… না.. মানে স্নেহা। স্নেহা একটু উঠবে? তুমি আমাকে ধরে আছো আমার অস্বস্তি হচ্ছে।
স্নেহা কি আদতে এ দুনিয়ায় আছে? সে রঙ বেরঙের স্বপ্ন দেখতে মশগুল। অর্নবের ডাকে একটু নড়ে উঠলো। এবার মাথা উচিয়ে অর্নবের বুকের উপর ভালোভাবে রাখলো। অর্নবের হার্টবিট ফার্স্ট হয়। স্নেহময়ী কি শুনতে পাচ্ছে হৃদয়ে গতি? হয়তো শুনতে পাচ্ছে কিন্তু মস্তিষ্ক ধারন করতে পারছে না। কিন্তু অর্নব তো স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার হার্টটা আর তার সাথে নেই। একা একাই কেমন জোরে ব্রিথ করছে দেখো।
গলা কাটা মুরগির মতো ভেতর ভেতর ছটফট করলেও বাহিরে সে স্বাভাবিক। সে তুতলিয়ে আরেকবার ডাকলো,
“-স..স্নেহা! শুনছো?
স্নেহা শুনলো কিনা বোঝা মুশকিল তবে মুখ ফুটে অস্পষ্টে কিছু বললো,
“-আপনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন। আমাকে কেন বাসেন না অর্নব? আমার কষ্ট হয়। আমাকে কবে একটু ভালোবাসবেন?
অর্নব থমকে যায়। হার্ট বিট করা মিস করে দেয়। মেয়েটা কি এটা সজ্ঞানে বললো নাকি স্বপ্নে? তবে যাইহোক কথাগুলো শুনে একটু হাসি পেলো অর্নবের। একটু লজ্জা সূলভ ভাব ফুটিয়ে কোনোমতে বললো
“- এভাবে ধরে রাখলে ভালোবাসতে বোধহয় সময় লাগবে না স্নেহময়ী।

প্রিয়া অস্থীর পায়ে অন্তর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজায় টোকা দিবে কি দিবে না করে করে টোকা দিয়েই ফেললো৷ মিনিট কয়েকের মাথায় অন্ত এসে দরজা খুলে দাঁড়ায়। চুলগুলো উসকোখুসকো হয়ে আছে। নাকের ডগাটা লাল হয়ে আছে। চোখও লাল লাল দেখাচ্ছে। বোধহয় মাত্রই শুয়েছিলো।
সে এত রাতে প্রিয়াকে দেখে বলল,
“-তুই এখানে? এত রাতে কি চাই?
গম্ভীর স্বরের কথা শুনে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো প্রিয়া। মুখ বাকিয়ে কিছু বলবে তার আগেই অন্ত জব্বর একটা হাঁচি দিলো। প্রিয়া আতকে উঠে হঠাৎ হাঁচিতে। অন্তর হাতের রুমালটা নাকে চেপে ধরলো। বৃষ্টিতে ভিজে তারও অবস্থা প্রায় খারাপের পথে। ক্ষণে ক্ষণে হাঁচি দিচ্ছে। নাকে পানি পরছে। নাক মুছতে মুছতে ডগাটা লাল করে ফেলেছে। প্রিয়া চিন্তিত হয়। কোনোকিছু না ভেবেই হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেয় অন্তর কপাল।

অন্ত অবাক চোখে তাকায়। তাদের মাঝের দূরত্ব খুব বেশি নয়। কাছে এসে কপাল ছোঁয়ায় মাঝের দুরত্ব কম। এত কাছাকাছি থেকে ওই কোমল মুখটায় নিজের জন্য চিন্তা দেখে মুগ্ধ হয় অন্ত। মোহগ্রস্ত সেই চাহনি উপেক্ষা করে প্রিয়া তার কপালের তাপমাত্রা বুঝে নিতে ব্যাস্ত। শরীরে জ্বর জ্বর ভাব। হালকা গরম আপাতত তবে বোঝাই যাচ্ছে রাতের দিকে জ্বরটা ভালোভাবেই আসবে। কপাল থেকে হাতটা সরিয়ে চিন্তিত সুরে বলল,
“-তোমারও তো জ্বর… জ..জ্বর আসবে মনেহয়।
অন্তর চাহনিতে হঠাৎ চোখ পড়তেই তুতলে যায় প্রিয়া। ওভাবে তাকিয়ে থাকার কি আছে? কপালটাই তো ছুঁয়েছে। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে হালকা কেশে বলল,
“-এভাবে তাকাবে না তো। অন্যদিকে তাকাও।
অন্ত চোখ নামিয়ে নেয়। ঠোঁট কামড়ে হাসলো একটু। বুকের কাছে দুহাত ভাজ করে বলল,
“-আচ্ছা তাকাবো না শুধু দেখবো । এখন বল কি চাই এত রাতে?
প্রিয়া এবার আসল কথায় আসতে চায়। পিরিতির কথা শোনার সময় আছে নাকি এখন। কিন্তু সে অন্তর দিকে আর তাকালো না। নিচে তাকিয়েই বলল,

“-প্রার্থ ভাইয়ের তো জ্বড় এসেছে।
বাকি কথা বলার আগেই অন্ত বিচলিত হয়ে বলল,
“-কি বলিস? ভাইয়ের জ্বর এলো কি করে? বৃষ্টিতে ভিজেছে নাকি?
“-হ্যাঁ বুবু বললো আজ ভিজেছে দুপুরের পর। এখন তো গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। তুমি তো জানোই ভাইয়ের জ্বর কেমন। বুবু বড় আম্মুকেও জানাতে দিলো না। এই রাতটুকুতে তাকে আর টেনশন দিতে চায় না। মেডিসিনও দেখলাম সব শেষ হয়ে গেছে। তোমার কাছে প্যারাসিটামল হবে?
অন্ত একটু ভেবে বলল,
” আমার কাছে তো নেই থাকলে আমিই খেতাম। এখন কি করি?
“-একটা কাজ করবে? আমি প্রার্থ ভাইয়ের গাড়ির চাবিটা এনে দেই তুমি সামনের রিয়াজুল আঙ্কেলের ফার্মেসি থেকে ওষুধ গুলো নিয়ে এসো। আঙ্কেলের দোকান ১২ টা অব্দি খোলা থাকে। এখন খোলা আছে নিয়ে এসো।
অন্ত মাথা নাড়িয়ে বলল,

“ঠিকাছে চাবিটা আন। আমি নিয়ে আসছি।
সম্মতি পেয়ে প্রিয়া এক দৌঁড়ে চলে যায় চাবি আনতে। মিনিটের মাথায় গাড়ির চাবিটা নিয়ে হাজির হয় সামনে। অন্ত চাবিটা নিয়েই বেড়িয়ে পরলো। কিছু বললোও না প্রিয়াকে। এটা দেখে বোধহয় একটু মন খারাপও হলো তার।
বেশ অনেকক্ষণ হয়ে যায় তবে অন্ত এখনো ফিরছে না। এতক্ষণ তো লাগার কথা না। এইত পাঁচ মিনিটের রাস্তা। অথচ বিশ মিনিট হতে চললো অন্তর খবর নেই। ঠিক আছে তো ছেলেটা? ওরও তো জ্বর জ্বর ভাব শরীরে। এই অবস্থায় বাইরে পাঠানো কি ঠিক হলো? যদি খারাপ কিছু ঘটে যায়? অজানা শঙ্কায় মন থিতিয়ে আসে প্রিয়ার। ভয় ক্রমশ বাড়তেই থাকে। এত দেরি করছে কেন অন্ধের বাচ্চা? প্রিয়াকে কি হার্ট অ্যাটাক করিয়ে মারতে চায় নাকি? সে অস্থির পায়ে করিডোরের এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করে যাচ্ছে। মনে মনে আল্লাহ কে স্বরণ করছে -” আল্লাহ এইবারের মতো অন্ধটাকে সহিসালামত ফিরিয়ে দাও। এরপর আর কক্ষনও এত রাতে কোথাও পাঠাবো না। প্লিজ ফিরিয়ে দাও। আমার মন কেমন করছে।

মনে মনে প্রার্থনা করার সাথে সাথেই বাইরে থেকে গাড়ির আওয়াজ শুনতে পেলো। বুকে হাত রেখে ভয়ের শ্বাসটা বের করে দিলো বাইরে। অস্থির চিত্তে চপল পায়ে দৌঁড়ে গেলো নিচে। আগেই দরজা খুললো না। দরজায় আস্তে দুটো টোকা পরলে ঝটপট খুলে ফেললো সেটা। অন্তকে দেখে শান্ত হলো চোখদুটো।তবে চিন্তাবসত যে রাগ হলো সেটা উগলে দিলো অন্তর উপর। খ্যাক করে বলে উঠলো,
“-কোথায় ছিলে তুমি? মাথায় সেন্স নেই? আসতে যেতে ১০ মিনিটের রাস্তা তুমি ২০ মিনিট পার করে ফেললে? আমার চিন্তা হয় না? তোমার জন্য যে কেউ অপেক্ষা করছে সে খেয়াল…..
আর বলতে দিলো না। অন্ত এগিয়ে এসে প্রিয়ার কোমল ঠোঁট চেপে ধরলো হাতে। কাছাকাছি থেকে বললো।
“-শশশশ্! আস্তে। সবাই উঠে যাবে। আমার জন্য এত চিন্তা কেন হচ্ছিলো তোর? আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে কেন?

প্রিয়া জোর করে একটু ঢোক গিলে গলাটা ভেজালো। দুজনের মাঝের দূরত্ব এত কম যে অন্তর গরম শরীরের তাপ অনুভব করতে পারছে সে। রক্তাভ চোখদুটোতে কেমন কাতরতা। তার তপ্ত শ্বাস আছড়ে পরছে প্রিয়ার মুখে।
ভালো ফ্যাসাদে পড়লো তো! বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। কথা আটকল যাচ্ছে অথচ তাকে নাকি এগুলোর উত্তর দিতে হবে। কিন্তু কি উত্তর দিবে?
সে বোকার মতো কিছুক্ষণ অন্তর দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে কিছু ভাবলো,
গাল থেকে অন্তর হাতটা সরিয়ে ধীর স্বরে তেজ নিয়ে বলল,
“-চিন্তা হবে না? জ্বর শরীরে তোমাকে বাইরে পাঠালাম আমি। তোমার কিছু হয়ে গেলে কার দোষ হতো? আমারই তো। আর অপেক্ষা করবো না? ভাইকে ওষুধ দিতে হবে না?
অন্ত জহরী নজরে তাকায়। চতুরতার সাথে বলে

“শুধু এজন্যই?
“-হ্যাঁ। তো আর কি হবে? ওষুধ এনেছো? দাও আমাকে। তুমিও একটা খেয়ে নিও। নয়তো রাতে জ্বর আসবে।
কথাটুকু বলে অন্তর হাত থেকে ওষুধের প্যাকেটটা নিজেই নিয়ে নিলো। জলদি জলদি কেটে পরতে চাইলো এখান থেকে। আরেকটু দাঁড়িয়ে থাকলেই প্রিয়ার চোরা অনুভুতিও গুলো ধরা পড়ে যাবে। তাই অন্তকে রেখেই হাঁটা দিলো সামনে। অন্ত দরজা আটকে হাসতে হাসতে ওর পেছন পেছন চলে যায় উপরে। তার কি আর বোঝার বাকি আছে এসব? হয়তো একটু বাকি আছে। ওই একটু টাও পূরন হয়ে যাবে প্রিয়ার সেই জাদুকরী তিন শব্দে। আদতে মেয়েটা কখনো বলবে ওই শব্দগুলো?

গায়ে কম হলেও ১০০ এর উপরে জ্বর। তাপমাত্রা দেখেই বোঝা যাচ্ছে জ্বরের তীব্রতা। গায়ে মোটা দুটো কাথা জরিয়ে দিয়েছে প্রার্থর। অন্তর আনা ওষুধ পুষ্প খায়িয়ে দিলো প্রার্থকে। ওষুধের পাতাটা অন্তর হাতে বুঝিয়ে দিয়ে বলল,
“-এখান থেকে তুই ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পর। গায়ে জ্বর আসবে ভাইয়ের মতো। প্রিয়া, তুইও রুমে চলে যা অনেক রাত হয়েছে। সকালে কলেজে যেতে হবে তোকে।

অন্ত – প্রিয়া দুজন ভাইকে আরেকবার দেখে লক্ষী বাচ্চার মতো কথা শুনে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
পুষ্প দরজাটা আটকে এসে প্রার্থর মাথার কাছে বসলো। একটা বাটিতে ঠান্ডা পানি নিয়ে রেখেছে তার সাথে ছোট্ট এক টুকরো কাপড়। বিছানায় বসে প্রার্থর গরম কপালে ভেজা কাপড়ের টুকরো রেখে জলপট্টি দেওয়া শুরু করলো। প্রার্থর চোখদুটো বুজে রাখা ছিলো। সে আস্তে করে লাল লাল চোখদুটো খুললো। একহাত উঠিয়ে কপালের কাছে পুষ্পর হাতটা চেপে ধরলো। রুক্ষ গলায় কোনোমতে বলল,
“-এগুলোর প্রয়োজন নেই। তুই আমার কাছে শুয়ে থাক।
পুষ্প রাগ দেখালো। হাত ছাড়িয়ে কর্কশ গলায় বলল,

“-ছাড়ুন। আপনাকে বলেছিলাম না ভিজবেন না। তবুও ভিজলেন। শরীরের জোর দেখালেন তখন। এখন দেখুন তো নিজেকে। কেমন নেতিয়ে আছেন বিছানায়। এভাবে আপনাকে দেখতে কি আমার ভালো লাগে?
রাগে, অভিমানে পুষ্পর এখন নিজেকেই থাপড়াতে ইচ্ছে করছে। কি দরকার ছিলো বৃষ্টি দেখে এত খুশি হওয়ার?
প্রার্থ বুঝলো পুষ্পর অভিমান। তবে তেমন কিছু বললো না আবারও হাত ঠেলে পানির বাটিটা সরিয়ে দেয়। ভাঙা গলায় বলে,
“-বলেছি এখানে আয়। সরা এগুলো। আমাকে জরিয়ে ধরে শুয়ে পর। আমার উষ্ণতাটুকু তোর মাঝে মিশিয়ে দিতে চাই। তোর সাথে আমাকে একটু ঘুমাতে দে।

পুষ্প আর কিছু বলার অবকাশ পেলো না। পানিশুদ্ধ বাটিটা সাইডে টেবিলে রেখে দেয়। কাথার নিচে ঢুকে পরে ত্রস্ত। প্রার্থর গরম শরীরে জরিয়ে ধরে তাকে। একজন স্বাভাবিক মানুষের কাছে জ্বরের এই উষ্ণতা খুবই তীব্র। পুষ্পর গরম অনুভব হলো প্রচুর তবুও কিছু বললো না। প্রার্থর জন্য এটুকু উষ্ণতা কোন ব্যাপারই না। সে আস্তে ধীরে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিলো শুধু। প্রার্থ একটু শান্তি পেয়েই ঘুমাতে চাইলো।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ টের পেলো প্রার্থর উষ্ণ হাত পুষ্পর পেটের উপর নাড়াচাড়া করছে। বিড়বিড় করে কিছু বলছে। পুষ্প শুনতে পায়না সে কথা। প্রার্থর মুখে আলতো হাত রেখে ডাকে তাকে। কিন্তু তার তেমন হুশ নেই। শেষে পুষ্প মাথাটা একটু নিচু করে শুনতে চায় কি বলছে। প্রার্থ আবারও বিড়বিড় করে বলল,

“-কিছু হবে না বাবা। বাবা আছে তো। তোমার আর তোমার মায়ের কিছু হতে দেবেনা।
কথাটুকু বললো ঘুম জড়ানো ভাঙা কন্ঠে। পুষ্প এবার স্পষ্ট শুনতে পেলো সব। ভ্রু কুচকে প্রার্থকে ডেকে বলল,
“-প্রার্থ ভাই? কি হয়েছে? আপনি এমন কেন বলছেন?
প্রার্থর হুশ নেই। জ্বরের তোপে অচেতন ভঙ্গিমায় পুষ্পর পেটে হাত ছোঁয়াচ্ছে এবং আওড়াচ্ছে,
“-বাবা! আমার বাবা। তুমি পৃথিবীর আলো দেখবে বাবা। তোমাদের কিছু হবে না। ভয় পেও না।
এটুকু কথা বলতে অনেক সময় নিচ্ছে প্রার্থ। পুষ্পর কাছে কথাগুলো সুবিধার ঠেকছে না। মানুষ নেশাগ্রস্ত হয়ে যেমন সব সত্যিই কথা উগ্রে দেয় প্রার্থও জ্বরে পড়লে আবোল তাবোল কথা বলতে থাকে তনে সেগুলো হয় ওর মনের ভেতরের সব সত্য কথা যে কথা সে কাউকে জানায় না। শুধু জ্বর এলেই উগ্রে দেয়।
পুষ্প একটু আলগা হয়ে উঠতে চাইলো। কিন্তু প্রার্থ উঠতে দেয় না। তার কাছ থেকে কেউ সরে যাচ্ছে বুঝতে পেরেই জাপটে ধরে পুষ্পকে। বিড়বিড় করে ফের শুধায়,

“-যাস না ফুল। আমাকে ছেড়ে যাস না। ডাক্তার বলেছে একবার ছেড়ে গেলে আর ফিরে পাবো না। প্লিজ যাস না।
পুষ্প শুকলো ঢোক গিলে। বুঝতে পারছে না বিষয়টা কতটা সিরিয়াস। প্রার্থ এমন সব কথা কেন বলছে। সে তার গালে হাত রেখে বুঝিয়ে বলে,
“-কোথাও যাবো না প্রার্থ ভাই। আমি তো এখানেই আপনার কাছেই আছি। ডাক্তার কি বলেছে আপনাকে?
প্রার্থ অস্পষ্টে শুধু বলল,
“-হেমাটোমা।
পুষ্প বুঝতে না পেরে বলল,
“-কি টোমা?
প্রার্থ আর উত্তর দিলো না। পুষ্প গাল ধরে ঝাঁকিয়ে ফের বলল,
“-আমার রিপোর্ট এসেছে তাইনা? আপনি বললেন না যে রিপোর্ট আসেছে। রিপোর্টে খারাপ কিছু এসেছে?
প্রার্থ একটু একটু করে বললো,

“-রিপোর্ট?.. ওটা কেন হলো তোর? আমার কেন হলো না।
কথাগুলো অস্পষ্ট। বুঝা গেলো না খুব একটা। তবে পুষ্প এবার সিওর খারাপ কিছুই হয়েছে। প্রার্থ রিপোর্ট টা হাতে পেয়েছে অবশ্যই। অথচ পুষ্পকে জানালো না? খাপলা নিশ্চয়ই আছে। সে আর কিছু বললো না। প্রার্থকে শান্ত করলো। মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করলো। বেশ অনেকক্ষণ পর প্রার্থ চুপ হলো। ঘুমে একেবারে বুদ হয়ে গেলো। এই ফাকে পুষ্প উঠে যায় আলগোছে। এবার চিরুনি তল্লাশি করবে কোথায় ওর টেস্টের রিপোর্ট গুলো। খাট থেকে শুরু করে ঘরের প্রতিটি জিনিসই দেখা শেষ দিলো কিন্তু কোথাও কোন রিপোর্টের ফাইল পেলো না। এখন আর কোথায় খুজবে সে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে থাকলো। হঠাৎ চোখ গেলো খুলে রাখা আলমারির একটা ফাইলের উপর। ফাইলগুলো তো সব শুধু উপরে উপরেই দেখা হলো।

প্রার্থর অফিসের ফাইল সবগুলো তাই ভেতরে ঘাটেনি। হসপিটালের টা তো আলাদাই থাকবে। কিন্তু এগুলো কি একবার ভেতরেও দেখা উচিত? দেনামনা করে গেলো ভেতরে চেক করতে। অনেকগুলো ফাইল রাখা সেখানে। একটা একটা করে খুলে দেখতে থাকলো কিন্তু কিছুই পেলো না। হুট করেই একটা ফাইল খুলে চোখ আটকে গেলো। উপরে হাসপিটালের নাম লেখা। এই হসপিটালেই তো গিয়েছিলো তারা। ঝটপট চোখ বুলালো পুরো রিপোর্টের উপর। সবার আগে চোখ আটকালো নিজের নামের উপর। বুকটা দুরুদুরু করছে। এরই মাঝে চোখ পড়লো ডায়াগনোসিস এর নিচে লেখা রোগের নামটার উপর। “ক্রনিক সাবডুরাল হেমাটোমা” নামটা যেন জ্বলজ্বল করছে। সাথে সাথে অশ্রুতে জ্বলজ্বল করে উঠে পুষ্পর চোখ। তাহলে ব্যাপারটা এখানেই? প্রার্থর অস্বাভাবিক আচরনের হেতুটা তবে এখান থেকেই তৈরী?

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৬ (২)

সে পাতলা কাগজটা থেকে সিক্ত চোখ উঠিয়ে বিছানায় নেতিয়ে থাকা প্রার্থর দিকে তাকালো একবার। হাত আপনাআপনি চলে গেলো নিজের পেটের উপর। এটা কেমন রোগ? এ রোগ কেন তার হলো। তাহলে মাথা ঘোরা অজ্ঞান হওয়াটা কি শুধু প্রেগন্যান্সির জন্য নয়? এর কারনে বাচ্চাটার কোন ক্ষতি হবে না তো? প্রার্থ ভাই তবে কেন বারবার বাচ্চাকে ডেকে অভয় দিলো। ভয়ের কিছু আছে বলে?

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৮