আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৮
তানহা ইসলাম বৈশাখী
দুই দিন পর।
সব স্বাভাবিক। প্রার্থর গায়ে জ্বর নেই। অস্বাভাবিক ভাবে এই প্রথমবার বোধহয় দুদিনেই জ্বরের কবল থেকে বেঁচে গেলো সে। বলে না? – মনের জোরই সবচেয়ে বড় জোর। ঠিক তেমন প্রার্থর মনের জোরই তার সুস্থতার কারন। জ্বর হওয়ার পর বুঝেছে এই সময়ে বৃষ্টিতে ভেজা একদমই উচিত হয়নি। এসময় আবেগ দিয়ে কাজ করলে চলবে না। এখন পুষ্পর প্রার্থকে প্রয়োজন। অথচ দুদিন যাবত ও নিজেই সেবা নিচ্ছে পুষ্পর থেকে। তাই নিজ থেকেই নিজের মনোবল বাড়িয়ে নিজেকে আগাগোড়া সুস্থ করে নিয়েছে সে। এবার সমস্ত ফোকাস পুষ্পর উপর।
সকালের সূর্যটা উঠেছে অনেকক্ষণ। সূর্যর এবার মাথার উপরে যাওয়ার পালা৷ প্রার্থ সটান দাঁড়িয়ে আছে নিজের রুমের বারান্দায়। চোখ আটকে আছে গ্রিল পেরিয়ে রাস্তার উপর। গায়ে সাদা শার্ট কালো প্যান্ট। ফর্মাল গেটাপেই আছে। বাইরে কোথাও যাবে বোধহয়। একহাত তার পকেটে পুরা। অন্যহাতে কানে ফোন চেপে আছে। মুখভঙ্গি রূঢ় করে দাঁড়িয়ে। ওপাশের ব্যাক্তির কথাগুলো ঠোঁট কামড়ে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে। ওদিকের কথা ফুরালে এপাশ থেকে প্রার্থ গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
“-যা লাগে সবই পাবেন। টাকা যত লাগে তত নিবেন তবে চিকিৎসার কোন ঘাটতি যেন না হয়। বাহির থেকে বড় বড় ভালো মানের নিউরোসার্জন ইমিডিয়েটলি বিডিতে আনার ব্যাবস্থা করুন। তার ব্যাপারে কোন কার্পন্য নয়। কোন কম্প্রোমাইজ নয়। বেস্ট ট্রিটমেন্ট এনসিওর করুন ডক্টর। তাকে আমার সুস্থ স্বাভাবিক চাই। আই ওয়ান্ট হার এ্যট এ্যানি কস্ট।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“-ওকে থ্যাংক ইউ। টাকা আমি পাঠিয়ে দেবো। রাখছি।
ভারীক্কি স্বরে কথাগুলো শেষ করে ফোনটা পকেটে ঢুকালো প্রার্থ। বাইরে থেকে আসা বিশুদ্ধ হাওয়ায় দম নিলো বুক ভরে। নিশ্বাস ছাড়ার সঙ্গে ছাড়লো কিছু অপ্রকাশিত বেদনা। যে বেদনা একান্ত নিজের মনে পুষে পুষে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে।
“-আমি কি বাঁচবো না প্রার্থ ভাই?
হঠাৎ পরিচিতি নারী কন্ঠের আওয়াজ কর্ণকুহর হতেই চমকে উঠে প্রার্থ। তড়িৎ পেছনে ঘুরে তাকায় সে। বেলকনির দরজায় পুষ্পকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই ঘাবড়ে যায়৷ এটা তো হওয়ার কথা নয়। ও কি ফোনে বলা কথা শুনেছে সব ?
প্রার্থ কয়েকটা ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভিক করলো। স্বভাবত প্রশ্ন করলো
“-এরকম প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে?
পুষ্পর চোখ টলমলে। সে প্রার্থর প্রশ্নের জবাবে গেলো না। ভেঙে আসা গলায় ফের প্রশ্ন ছুড়লো,
“-বলুন না, আমি আর বাঁচবো না? আমার বাচ্চা এই দুনিয়ার আলো দেখবে না?
প্রার্থর এবার নিজেকে অসহায় লাগছে। ভারী হচ্ছে শ্বাসপ্রশ্বাস। এত লুকানো চুরানো কথাগুলো সে কি করে জানলো? এবার কি হবে? কি করে সামাল দিবে? দুশ্চিন্তায় আবারও দুটো ঢোক গেলে। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,
“-এ..এসব কেন বলছিস?
“- আমি সব জানি প্রার্থ। আপনি তবুও কেন লুকাচ্ছেন?
“- কি কি করে জানলি?
পুষ্প এবার তেড়ে আসে। প্রার্থর বুকে এলোপাথাড়ি কিল ঘুষি দিয়ে হেচকি তুলতে তুলতে বলে,
“- কি ভেবেছেন? এতবড় জিনিস আপনি লুকিয়ে যাবেন আমি কিছু টের পাবো না? আমাকে জানালেন না কেন আপনি? একা একা কেন ভুগছেন? কেন নিজের মাঝে চেপে রেখেছেন? আমার জানার অধিকার নেই?
পুষ্পর কিল ঘুষি উপেক্ষা করে প্রার্থ তাকে নিজের বুকের মাঝে জরিয়ে ধরলো শক্ত করে। পুষ্প নড়াচড়া করতে করতে থেমে যায়। বেড়ে যায় কান্নার গতি। প্রার্থর বুকের কাছে শার্ট ভিজে যায় নোনা তরলে। পুষ্প দু হাতে খামচে ধরছে দুপাশে শার্টের অংশ। শঙ্কা জর্জরিত মায়ের মন নিয়ে ফের বলে উঠে,
“-আমার বাচ্চা! আমার বাচ্চার কিচ্ছু হবে না তো? ও…ও আমার কোলে আসবে তো? আমি মরে যাবো? আপনাকে রেখে চলে যাবো।
বলতে বলতেই দু হাতে শক্ত করে জরিয়ে ধরে প্রার্থকে। যেন এখান থেকে সে যাবে না। তাকে প্রার্থর থেকে কেউ কোথাও নিতে পারবে না। দুদিন যাবত প্রার্থর থেকে ওর জানার খবর লুকিয়ে বুঝেছে, একা একা বুকের ভেতর ভয় পেষন করা কত কঠিন। আজ সে সুস্থ বলে আর চুপ থাকতে পারলো না। সব দুর্বিষহ ব্যাথা ঠোঁট ফুরে বেড়িয়ে এলো। অথচ প্রার্থ কতদিন ধরে একা একাই সব সহ্য করছে। ভাবতেই আরো হেঁচকি তুলে কাঁদে পুষ্প।
প্রার্থ যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রাখে। কারণ সে স্বাভাবিক না থাকলে পুষ্পকে স্বাভাবিক করা যাবে না৷ বুকের ভেতর হতে পুষ্পর সুতনু কোমল মুখটা নিজের দু হাতের আজলায় পুরে তাকে সোজা করলো। মুখোমুখি করে চোখে চোখ রেখে আশ্বাস দিলো,
“-এমন কেন ভাবছিস? সব ঠিক হবে। তোর কিছু হবে না। আমাদের বাচ্চারও কিছু হবে না। ওপরওয়ালা আছেন তো। তিনি এত নিষ্ঠুর নয়। তোকে আমার থেকে এত দ্রুত কেঁড়ে নিবে না সে। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি তো। তিনি বলেছে সার্জারি করে জমাট বাঁধা রক্ত বের করে দিলেই তুই সুস্থ। দেশের বড় বড় নিউরোসার্জনদের আনা হবে তোর অপারেশনের জন্য। তুই সুস্থ হয়ে যাবি ফুল। প্লিজ নিজের মাঝে টেনশন নিস না। মস্তিস্কে চাপ ফেলিস না। সমস্যা হবে।
প্রার্থর হাতের তালু ভিজে যায় পুষ্পর চোখের নোনা জলে। মেয়েটা এখনো কাঁদছে। প্রার্থর রাখা হাতের উপর পুষ্প নিজের হাত রাখে। কান্না আটকে ভাঙা স্বরে বলে,
“- সব দোষ আমার। আমি বলেছিলাম না, আপনাকে আমার আমারণ প্রেমতৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত রেখে একদিন চলে যাবো। অনেক দূর চলে যাবো। কিন্তু বিশ্বাস করেন আমি এতদূর যেতে চাইনি। আমি চাইনি আপনি আমার এমন তৃষ্ণায় ভুগেন। যদি জানতাম তবে আপনাকে ভালোবাসার সুযোগই দিতাম না। নিজে থেকে পিছিয়ে যেতাম। যদি জানতাম আল্লাহ আমার শব্দগুলো এভাবে কবুল করবে তবে আমি কোনদিনও এই শব্দগুলো উচ্চারনও করতাম না। আমকে কেন চলে যেতে হবে প্রার্থ? আপনাকে পেয়েও কেন পাবো না বলুন তো। আমি কি এতটাই পাপি?
আর কিছু বলতে দেয় না প্রার্থ। পুষ্পকে টেনে ফের নিজের মাঝে জরিয়ে ধরলো শক্ত হাতে। মাথার চুলের ভাজে চুমু দিয়ে বললো,
“-এমন কথা আর একবারও বলবি না ফুল। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো তুই যতদিন বেঁচে থাকবি ঠিক ততদিন আমার জন্য তোর তৃষ্ণা আমরণ প্রেমতৃষ্ণা। এ তৃষ্ণা ফুরাবার নয়। কেন চলে যাওয়ার বাহানা দিচ্ছিস?
পুষ্প হেঁচকি তুলে বলে,
“-কিন্তু আমি…আমি যদি ম…..
প্রার্থ আর বলতে দিলো। পুষ্পকে আটকে দিয়ে নিজেই বললো,
“-কিছু হবে না। মনোবল হারাস না। তুই ভেঙে পড়লে স্ট্রেস নিলো তোর যেমন ক্ষতি আমাদের বাচ্চারও তেমন ক্ষতি। রোগ তো মানুষের হবেই। তাই বলে কি তার চিকিৎসা নেই? তুই সুস্থ হবি আমাদের বাচ্চাও আসবে পৃথিবীতে। শুধু তুই নিজেকে ঠিক রাখ। প্লিজ চুপ কর। মাথা ব্যাথা করবে। রাতেও তীব্র ব্যাথায় ঘুমাতে পারিস নি।
আবার পুষ্পর মুখ খানা দুহাতে তুলে উচু করে৷ রিক্ত কপালে ঠোঁট ছুয়িয়ে দেয়৷ আশ্বাসবাণী দিয়ে বলে,
“- মনকে শক্ত কর। সামনে তোকে অনেক লড়তে হবে৷ আমাদের সংসার আমরা অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাবো।
পুষ্প কথাগুলো বুঝলো কিনা বোঝা গেলো না। তবে সে চুপ হয়ে গেলো। প্রার্থ ফের তাকে টেনে বুকের মাঝে ফেলে রাখে। বেশ অনেকক্ষণ সময় বারান্দায় কাটলো দুজনের। খুব নিরবে নিভৃতে চোখের জল ফেলে গেলো পুষ্প।
প্রার্থ ভেতর থেকে খুব শক্ত রইলো। তার ভেতরে যে দ্বিগুণ ভয়। এ ভয় কারো সামনে প্রকাশ করা বারন। দুজনেই সমান তালে ভয় পেলে কি করে চলবে। কাউকে তো স্ট্রং হতেই হবে৷ তবে না মুশকিল আসান হবে৷
মাথার উপরে থাকা রৌদ্র ঝাঁজ ক্রমশ হেলে পরছে পশ্চিমাকাশে। প্রিয়ার কলেজ ছুটি হলো সবে। গায়ে শ্বেত রাঙা কলেজ ড্রেস। লম্বায় কোমড় অব্দি চুলগুলো আজ দুপাশে বেনি করে সামনে এনে রেখেছে। সাথে গলায় ঝুলছে একটা পাতলা জর্জেটের ওরনা। প্রিয়া, শিফা ও আরো একজন মেয়ে একসাথে মাঠের মাঝখান দিয়ে হেটে যাচ্ছে গেটের পথে। সাথে সমানতালে মুখ চলছে তিন বান্ধবীর৷ গল্প করতে করতে হাটার সময় হঠাৎ একটু দূর থেকে কেউ একজন ‘প্রিয়া’ বলে ডেকে উঠে। শব্দটা অল্প হওয়ায় প্রিয়া তেমন মনোযোগ দিলো না। পরপর আবারও একই ডাক ভেসে আসে একটু জোরে। এবার থেমে যায় সে। এদিক ওদিক তাকিয়ে শব্দের উৎস খোঁজে।
মিনিট দুয়েকের মাথায় ছিনছাম গড়নের একটা ছেলে পেছন থেকে দৌঁড়ে এসে দাঁড়ায় তাদের সামনে। হাঁপিয়ে গিয়ে বড় বড় শ্বাস নেয় ছেলেটা। প্রিয়া ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করে,
“-কিরে রবিন। এভাবে দৌঁড়ে এলি কেন? কি হয়েছে?
ছেলেটা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
“-তোর একটা ভাইয়ের নয়ম অন্ত না?
অন্তর কথা শুনে বুক ধ্বক করে উঠে তার। কোনোরকমে নিজেকে সামলে বলে,
“-হ্যাঁ। কেন কি হয়েছে?
“-ওরা তো গুরুতরভাবে আহত।
প্রিয়া আঁতকে উঠে। সাথে চমকে যায় পাশে থাকা দুজন বান্ধবীও। প্রিয়া বড় বড় চোখ করে অস্থিরতা নিয়ে শুধায়,
“-কি বলছিস? কি হয়েছে? তুই কি করে জানলি?
রবিন ছেলেটা একটু শান্ত হয়ে বলে,
“-আরে আমার বড় ভাইও ওদের সাথে পড়ে। ভাইয়া কল দিয়েছে। ভার্সিটিতে নাকি মারামারি হয়েছে। ওখানে আমার ভাইসহ অন্ত ভাইরাও আহত হয়েছে। আমাকে যেতে বললো সেখানে। ভাইয়াকে নিয়ে বাসায় যেতে হবে। এখন তোকে দেখলাম তাই জানালাম। তুই তোদের বাসা থেকে কাউকে পাঠিয়ে দে। ওখানের কি অবস্থা তা তো বলা যায় না। ভাইয়া বললো মারামারি নেই তবে তারা মার খেয়েছে।
প্রিয়ার মাথায় শুধু অন্তর কথাই ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। ও তো মারামারি করার মতো ছেলে নয়। ও কি করে মারপিটের মতো জঘন্য কাজে জরালো? ও তো কাউকে মারতেও পারবে না। নিজে কত মার খেয়েছে কে জানে। যদি কিছু হয়ে যায়? শঙ্কায় বুক ছলকে উঠে তার। রবিনকে তড়িঘড়ি করে বলে,
“-ও এখন কোথায়?
“-এখনো ভার্সিটিতেই আছে। হসপিটালে নেয়নি কারন…..
বাকিটুকু শোনার আর ধৈর্য হলো না প্রিয়ার। গেটের দিকে পা বাড়িয়ে বান্ধবীদের উদ্দেশ্যে বলে গেলো,
“-তোরা থাক আমি যাচ্ছি।
হাওয়ার সাথে পা মিলিয়ে প্রাণপনে দৌড়ালো প্রিয়া। এক দৌঁড়ে রাস্তায় এসে থামলো। ঝটপট একটা রিক্সা দাঁড় করিয়ে ছুটে গেলো আইইউবি (IUB) এর উদ্দেশ্যে।
রিক্সার ভেতর যতক্ষন রইলো ততক্ষণ মন শুধু অস্থির হয়ে রইলো। অন্ত ঠিকাছে তো? গিয়ে কি দেখবে? রক্তমাখা অন্ত নাকি ব্যান্ডেজে মোড়ানো পঙ্গু এক অন্ত। যদি এর থেকেও বেশি খারাপ অবস্থা হয়, তখন? ওকে প্রিয়া বলে ওভাবে কে ডাকবে? কে বলবে-“আমার অন্তঃপ্রিয়া ছাড়া আমি নিঃস্ব।” “তোকে আমার অন্তঃপ্রিয়া করতে চাই প্রিয়া।” কে বলবে এমন মায়া জরানো কথাগুলো? ভাবতে ভাবতেই সরল চোখে অশ্রুরা হানা দেয়।
মুহুর্তেই আবার রাগে ফেটে যায়। আকাশের রং যেমন পলকেই বদলে যায় তেমনই প্রিয়ার মেজাজের হাল হলো। ওই গাধার বাচ্চাকে কে বলেছিলো মারপিট করতে। যদি ব্যাটার কিছু হয় তবে তাকে পাটার উপর বসিয়ে পুঁতো দিয়ে ছেঁচবে সে। প্রিয়াকে জ্বালানোর মজা হাড়ে হাড়ে টের পাবে।
এরকম বহু অযাচিত কথা ভাবতে ভাবতে ভার্সিটির গেটের সামনে পৌঁছালো রিক্সা। সে ত্রস্ত রিক্সা থেকে নেমে ভাড়াটা মিটিয়েই দৌড়ঁ লাগায় সম্মুখ পথে। মনে মনে জপতে থাকে আল্লাহর নাম।
গেট মাড়িয়ে একটু ভেতর ঢুকে এদিক ওদিক খুজতে থাকে অন্তকে। কিন্তু পায় না। ভার্সিটিতে এখন তেমন কেউ নেই। ছুটি হয়ে যাওয়ায় সবাই জায়গায় জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে চলে গেছে। হাতে গোনা কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে। সে আরো একটু এগোলো। সামনে খেয়াল পড়তেই নজর আটকে গেলো। ওইতো অন্ত আসছে। দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে কপালের সাদা ব্যান্ডেজ। নিজেকে আর আটকালো না সে। চঞ্চল হরিণীর মতো ছুটে গেলো অন্তর কাছে। একঝাপে গলা জরিয়ে ধরে অন্তর। হঠাৎ আক্রমনে দু কদম পিছিয়ে বন্ধুর শার্ট ধরে ফেলে অন্ত। হঠাৎ কি হলো কিছুই বুঝলো না। সে বন্ধুদের সাথে কথা বলতে বলতে আসছিলো। হঠাৎ করে কে এসে এমন জরিয়ে ধরলো?
প্রিয়ার গায়ের খুশবু আর গুনগুন করে কান্নার শব্দ শুনে অন্তর বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না যে এটা প্রিয়া। আচানক প্রিয়াকে এভাবে জরিয়ে ধরতে দেখে অন্ত বোকা বনে যায়। স্তব্ধ হয়ে যায় চারিপাশ। চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছাপ নিয়ে ডাকে,
“-প্রিয়া!
প্রিয়া অন্তর গলা জরিয়ে আছে। মুখ গুজে আছে তার কাঁধে। অন্ত লম্বা হওয়ায় প্রিয়ার পায়ের আঙ্গুল মাটিতে ছুঁই ছুঁই অবস্থা হয়ে আছে। অন্ত একটা শুস্ক ঠোক গেলে। মনদ্বিধা নিয়ে একহাত রাখে তার কোমড়ে। অন্য হাত তার মাথায় রেখে শুধায়,
“-কি হয়েছে প্রিয়া? কাঁদছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে?
প্রিয়া মুখ তুলে অন্তর মুখোমুখি হয়। তীরতীর করে কাঁপা ঠোঁট উল্টে দেয়। বাচ্চাদের মতো কেঁদে ভাসিয়ে বলে,
“-কি হয়েছে বলছো? তোমার কি হয়েছে? বখাটেদের মতো মারামারি করো? তুমি মারামারি করতে জানো? যদি কিছু হয়ে যেত?
অন্ত নেশালো চোখে তাকায়। কিছু কাঙ্ক্ষিত শব্দ শোনার আশায় আকুল স্বরে বলে,
“-হলে কি হতো?
প্রিয়া রাগে এলোপাথাড়ি কতগুলো কিল দিলো অন্তর বুকে। নাক টেনে বলে,
“-আবার বলছো কি হতো? তোমার লজ্জা করে না? আমাকে জ্বালাতে মজা লাগে? আমার কষ্ট হয় না?
“-কেন কষ্ট হয়?
“-তুমি সব বুঝেও কেন এমন করছো?
অন্তর চোখে জানতে চাওয়ার আকাঙ্খা।
“-আমি বুঝতে পারছি না। তুই বুঝা।
প্রিয়ার রাগ হয়। কান্না কমে আসে। রাগে জ্বলে উঠে বলে,
“-তোমাকে বুঝতে হবে না। তুমি নাকি গুরুতর আহত হয়েছো? কই? কপালের চোট ছাড়া তো কোন চোট দেখছি না। মিথ্যেবাদি একটা।
“-আমি এবিষয়ে কিছু বলেছি তোকে? তুইই তো ছুটে এলি।
প্রিয়া অভিমান করে বলল,
“-না বলোনি। কিচ্ছু বলোনি তুমি। ছাড়ো আমাকে।
অন্ত দুই কাঁধ উচিয়ে বলল,
“-আমি কি করে ছাড়বো? ধরে তো রেখেছিস তুই।
প্রিয়া দেখলো সে সত্যিই ওকে ধরে আছে। দুহাত অন্তর কাঁধের উপর। দুজন খুব কাছাকাছি। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই একটু দূরে সরে এসে দাড়ায়। ঠিক তখনই শোনা যায় একজন ছেলের কন্ঠস্বর,
“-কিরে দোস্ত? এটাই কি তোর অন্তঃপ্রিয়া নাকি?
প্রিয়া চমকে উঠে। পাশে তাকাতে দেখে অন্তর সাথে দুটো ছেলেও ছিলো। ছেলেদুটো বেশি আহত মনেহয়। তাদের হাতে, পায়ে, কপালে, নাকে সাদা ব্যান্সেজে মোড়ানো। প্রিয়া এতক্ষণ কোন জগতে ছিলো? এই ছেলে দুটোকে কি সে দেখেনি? ইশশ! কি লজ্জা। এদের সামনে অন্তকে জরিয়ে ধরে মরা কান্না কাদলো? তার চেয়েও বড় কথা এরা কি করে জানে অন্ত ওকে অন্তঃপ্রিয়া ডাকে?
বন্ধুর প্রশ্নে অন্ত প্রসন্ন হেসে সরল মুখে জবাব দেয়,
“-হুম। এই সেই অন্তঃপ্রিয়া। যার জন্য তোর বন্ধু পাগল, উন্মাদ।
এবার বোধহয় প্রিয়া হৃৎপিণ্ড টা আর নিজের কাছে রইলো না। এত জোরে বিট করছে যেন এক্ষুনি বুকের নরম মাংশ পিন্ড ভেদ করে বাড়িয়ে আসবে। এভাবে সবার সামনে অকপটে এরকম কথা বলে দিলো। সে আশ্চর্য চোখে তাকায় অন্তর দিকে।
পাশ থেকে আরেকটা ছেলের কন্ঠ শোনা গেলো,
“-তুই তো বলেছিলি সে এখনো মেনে নেয়নি তোকে। এত জলদি পটিয়ে ফেললি? কি করে পটালি ভাই? তোর মতো কুনো ব্যাংঙ একটা মেয়ে পটিয়ে নিলো? কি করে পটালি একটু শেখা। যাতে আমরা অসুস্থ হলেও কেউ একজন দৌড়ে এসে আমাদের জরিয়ে ধরে।
এরকম ইনডিরেক্টলি ডিরেক্ট কথা শুনে প্রিয়ার যে কি লজ্জা পেলো তা আর বলার অবকাশ রাখে না। মাথা নুয়িয়ে রাখলো গলার সাথে। তবে লজ্জা পেলো না বোধহয় অন্ত। বরং এত খুশি লাগছে যা জহির করার মতো নয়। সে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলল,
“-আমি তো নিজেও জানতাম না উনি এত দ্রুত আমাকে কবুল করবেন। আমি তো আরো কাঠখড় পোড়ানোর জন্য তৈরী হচ্ছিলাম।
প্রিয়া একবার আঁড়চোখে তাকায় অন্তর দিকে। মাথাটা উঠানো যাচ্ছে না লজ্জায়। হায় আল্লাহ! এই লজ্জাটুকু আগে কেন এলো না? আগে এলে তো আর অন্তকে ওভাবে জরিয়ে ধরতো না। সবকিছু সবসময় ভুল টাইমেই কেন হয়?
অন্ত বন্ধুদের ইশারায় বিদায় করলো। দুই বন্ধু ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে চলে গেলো অন্য পাশে। নিচে প্রিয়ার ব্যাগ পরে গেছিলো। সেটা এক হাতে তুলে প্রিয়ার হাতের ফাঁকে গলে নিজের হাত গুজে দিলো। শক্ত করে চেপে ধরে ‘চল’ বলে হাঁটা দেয় সামনে।
একটা রিক্সা থামিয়ে দুজন উঠে পরে সেটায়। প্রিয়া এখনো মাথাটা উচু করতে পারছে না। অন্ত দুষ্টু চোখে বারবার তাকাচ্ছে প্রিয়ার দিকে। সাথে ঠোঁটে ঝোলানো মিটিমিটি হাসি তো আছেই।
হঠাৎ মনে পড়লো অন্তর আঘাতটা শুধু কপালেই দেখলো। আরো কোথাও কি আঘাত লেগেছে? দাঙ্গাটা হলো কি করে? মনের ভেতরের প্রশ্নগুলো জমা রাখতে না পেরে উগলে দিলো,
“-তুমি মারামারি ঝগড়ায় জরালে কি করে?
“-আমি ঝগড়া করিনি। আমার সাথে যে দুজন ছিলো। ওরা লেগেছিলো সিনিয়রদের সাথে। ওদের ফেরাতে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছি। কিন্তু তুই এসব কোথা থেকে শুনলি?
“-আমাদের ক্লাসমেট বললো ওর ভাই আর তোমার সাথে নাকি কার মারামারি হয়েছে। তোমরা গুরুতর আহত। সেই শুনেই…!
আর কিছু বললো না। মিয়িয়ে এলো শেষে এসে। পরের কথাটুকু শেষ করলো অন্ত। প্রিয়াকে লজ্জায় ফেলতে বলল,
“-সেই শুনেই প্রিয়া তার অন্ধকে দেখতে ছুটে এসেছে। তাইতো?
অন্তর মুখে ‘তার অন্ধ’ কথাটা শুনে কি ভীষন লজ্জা পেলো প্রিয়া। মুখ ফুটে আর কোন কথা বের হলো না।
অন্ত আবারও টিপ্পনী কেটে বলে,
আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৭
“- আগে যদি জানতাম আমি একটুখানি চোট পেলে আমার অন্তঃপ্রিয়ার থেকে এতটা সমাদর পাবো তবে নিজে থেকে গিয়ে বেশি বেশি করে মার খেতাম। দরকার পরে গুন্ডা ভাড়া করে এনে মার খেতাম। আমার এতদিনের ছটফটানি একটু হলেও কমতো তখন।
লজ্জায় শরমে প্রিয়র কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। গরম ধোঁয়াও উঠছে বোধহয় কান থেকে। এখন হয়তো প্রিয়ার কান বন্ধ করা প্রয়োজন নয়তো ওই ছেলেটার দুষ্টু মুখ বন্ধ করা প্রয়োজন। এইরকম সাদাসিধে ছেলেও নাকি এমন মুখ চালাতে পারে। একটু লজ্জাও করছে না? সব কি উল্টো হলো নাকি? যেই প্রিয়ার মাঝে লজ্জার বালাই নেই সেই প্রিয়াই লজ্জায় মরে যাচ্ছে। ওদিকে যে লজ্জায় কারো সামনে কথা বলতে পারে না সে নাকি লাগাম ছাড়া বাজে কথা বলছে। একটু লজ্জাও করছে না।