আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৪০
তানহা ইসলাম বৈশাখী
অসহনীয় তীব্র পেটের ব্যথার দরুন বিছানার উপর কুঁকড়ে যাচ্ছে নারী দেহটা। আজ সারাদিন শরীর খারাপ করছে। এখন হঠাৎ শুরু হয়েছে পেটে ব্যথা। পুষ্পর ভয় হচ্ছে ভীষন। এসময় পেটে কেন ব্যথা করছে? গত কয়েকদিন যাবত সে মানসিক ভাবে সুস্থ স্বাভাবিক নেই। চিন্তায় বুদ হয়ে থাকে মন মস্তিস্ক। বেহায়া মন বারবার মনে করে, ওর কিছু হয়ে গেলে প্রার্থর কি হবে? সে যে ওকে অত্যাধিক ভালোবাসে। পুষ্প যতটুকু চেয়েছে তার থেকে বেশি পেয়েছে। আল্লাহ কি এই ভালোবাসাটুকু ক্ষণিকের জন্য দিয়েছিলেন ? আজ যদি ও ম*রে যায় তবে তো আর কিছুই রইলো না প্রার্থর কাছে। ভালোবাসা, বাচ্চা দুজনকে একসাথে হারাবে।
পুষ্পর বেঁচে থাকার ইচ্ছে হলো খুব। যার একসময় শুধু মরে যেতে ইচ্ছে করতো তার আজ ভীষন করে বেঁচে থাকার ইচ্ছে জাগছে। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করতে, বাঁচতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু পেটের অসহনীয় ব্যথা সেটা কি তাকে বাঁচতে দেবে? ব্যথার প্রকোপে জোরে জোরে ডাকতেও পারছে না কাউকে। যেটুকু গলার স্বর বের হচ্ছে ওতটুকু নিচে পৌঁছাচ্ছে না।
এলাচি বিছানায় কাতরাতে থাকা পুষ্পর এদিক ওদিক অস্থীর হয়ে ঘুরছে। অবুঝ বোবা প্রাণীটি কি করবে সে নিজেও বুঝছে না।
পুষ্প যখন নিজ চেষ্টায় বিছানা ছেড়ে উঠতে যায় তখনই রুমে ক্লান্ত পায়ে প্রবেশ করে প্রার্থ। প্রার্থকে দেখেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে সে। বাঁচার ইচ্ছে আরো দ্বিগুন হয়। দুহাত পেট আঁকড়ে রেখে ব্যথায় কাঁদতে থাকে।
প্রার্থ পুষ্পর এই অবস্থা দেখেই স্তব্ধ হয়ে যায়। কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারে না তবে পেটে কিছু হয়েছে সেটা সে ঠিকই বুঝতে পারছে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় পুষ্পর সামনে। তাকে হাতে আগলে ধরে অস্থির চিত্তে জিজ্ঞেস করে,
“-কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন? পেটে..পেটে ব্যথা করছে?
পুষ্প কিছু বলে না। তার ব্যথায় কুঁচকে যাওয়া মুখই বলে দিচ্ছে সব। প্রার্থ আর দেরী করলো না। চটজলদি কোলে তুলে নিলো তাকে। ভাবাভাবি বাদে বেরিয়ে যায় হসপিটালের উদ্দেশ্যে৷
সন্ধ্যার সেই মুমূর্ষু ঘটনা মানস্পটে ভেসে উঠতেই আরেক দফা বুক কেঁপে উঠলো প্রার্থর৷ দুহাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে সে। আশেপাশে শুভাকাঙ্ক্ষীর কমতি নেই। কমতি শুধু সেই নারীটির যার জন্য সে ক্রমে ক্রমে দূর্বল হয়ে পড়ছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
হসপিটালের করিডোরে প্রার্থরা বসে আছে। প্রার্থর বন্ধু থেকে শুরু করে পুষ্পর পরিবার অব্দি সবাই উপস্থিত হাসপাতালে। কার্তিক এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে থাকা প্রার্থর কাঁধে হাত রাখলো। ধীর গলায় বলল,
“-প্রার্থ, ভেঙে পরিস না ভাই। শক্ত হ। আন্টি কান্না করছে প্রচুর। এভাবে তো অসুস্থ হয়ে যাবে। তুই একটু সামলা উনাকে। আমাদের কথা শুনছে না৷
প্রার্থ ঝুঁকে থাকা মাথা উপরে তুললো। চোখ দুটো লাল টকটকে বর্ণ ধারণ করেছে । যেন কান্না না করার নির্মম যুদ্ধ চালিয়েছে নিজের সাথে। কার্তিক ভরকায় সেই চোখ দেখে। বন্ধুর বিদ্ধস্ত অবস্থা দেখে তারও অস্বস্তি হয় ভীষন। ছেলেটা এত বেশি কেন ভালোবাসে পুষ্পকে? ঘৃণা থেকে এতটা ভালোবাসা কি করে হয়? এ প্রশ্নের উত্তর সে খুঁজে পায় না।
প্রার্থ ততক্ষণে উঠে দাঁড়ায়। দূর্বল শরীরটা টেনেটুনে এগিয়ে নিয়ে যায় সামনে। পুষ্পর কেবিনের বাইরে কেবল ওর বন্ধুরা আর পুষ্পর বাবা প্রত্যয় এহসান ছিলো। বাকি সবাইকে ওয়েটিং রুমে রাখা হয়েছে। পূর্ণিমা বেগমও সেখানে আছেন। প্রার্থ টলমলে পায়ে সেদিকেই গেলো। পেছন পেছন গেলো চারবন্ধু।
“মা!”
প্রার্থর ডাক শুনেই পূর্ণিমা বেগম হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। সাথে সমানতালে নিঃশব্দে কাঁদছেন পূর্ণতাও। প্রিয়া এবং স্নেহা মিলেও তাদের সামলে রাখতে পারছে না। যখন তারা পুষ্পর রোগ সম্পর্কে জানতে পারে তখন থেকেই আতঙ্কে কাঁটা দিয়ে উঠছে শরীরে। চাইলেও নিজেদের সংযত রাখতে পারছে না।
প্রার্থ এগিয়ে যায়। দুই হাতে দুই মাকে আগলে ধরে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে তাদের শান্তনা দেয়,
“-কেন কাঁদছো তোমরা ? পুষ্পর কিছু হয়নি তো। তোমরা তো জেনেই গেছো ওর কি হয়েছে। অসুস্থতার কারনে মাঝে মাঝে এরকম প্যানিক অ্যাটাক হয়। চিন্তা করো না। একটু পরেই ডাক্তার বের হবে। তাদের থেকেই শুনে নিও। আর ওর রোগ নিয়েও চিন্তা করো না। আমার ডাক্তারের সাথে কথা বলে সব ঠিক করে নেওয়া শেষ। শুধু অপারেশনটা করলেই অল ওকে। ঠিক আছে? এবার আর কেঁদো না শরীর খারাপ করবে। পুষ্প এসে তোমাদের এমন অবস্থা দেখলে আমার সাথে রাগ করবে। তখন সামলিও তোমাদের মেয়েকে।”
অহনা বেগমের খানিক রাগ হলো ছেলের উপর। এতদিন কেন সে বলেনি পুষ্পর কথা? আজ কেন নিজ থেকে জানতে হলো? উনাদের কি জানার অধিকার নেই? ভদ্রমহিলা অভিযোগও করলেন এই নিয়ে ছেলের কাছে।
“ওর এমন অসুস্থতার কথা আগে কেন জানালি না আমাদের? আমাদের জানার অধিকার নেই?
” তা নয় মা। আমিই জানতে পেরেছি কয়েকদিন আগে। আমি বলতাম সবাইকে। শুধু সময়ের অপেক্ষা করছিলাম। তার আগেই সব জেনে গেলে। আর এত সিরিয়াস নয়। এজন্য জানাচ্ছিলাম না।
অকপটে মিথ্যেটুকু বলে ফেললো সে। হার্টের রোগী মাকে বেশি চিন্তা দিতেও ভয় হয় তার। সবাই যদি তাকে ছেড়ে চলেই যায় তাহলে সে কি নিয়ে থাকবে? এই ভয়ে কাউকে বলতে চায়নি সে। কিন্তু নিয়তিতে তো অন্য কিছু ছিলো। আকাশে চাঁদ উঠলে যে কখনো ঢাকা থাকে না। একসময় মেঘ সরে গিয়ে চাঁদের দেখা মিলবেই। এটা তার বোঝা উচিত ছিলো।
শেষমেষ দুজনকে শান্তনা বানী বুঝিয়ে আবার সেখান থেকে উঠে গেলো প্রার্থ।” ওদিকটা দেখতে হবে” বলে যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই চলে গেলো। পা দুটো টলছে তার। শরীর স্বায় দিচ্ছে না এগিয়ে যেতে৷ দুশ্চিন্তার দরুন দূর্বল হয়ে পরেছে শক্তপক্ত দেহখানা৷ তবুও সে হাটলো। মাঝপথে একবার পা টলে গিয়ে পরতে নেয়। বন্ধুরা তাকে ধরে ফেলে। সে মুচকি হেসে আবার হাঁটা দেয় নিজ উদ্যোগে। কাউকে ধরতে দেয় না। সে কি দূর্বল নাকি? সময় ও পরিস্থিতি তার একটু শক্তির পরীক্ষা নিচ্ছে, এইতো!
ডাক্তার শারমিন কেবিন থেকে বের হলো রাত প্রায় সারে ৮ টার দিকে। পুষ্পকে এখানে আনা হয়েছে সন্ধ্যা ৭ টারও আগে। ডাক্তার মুখের সার্জিক্যাল মাস্ক খুলে থুতনিতে ঝুলিয়ে রাখলেন। প্রার্থ নিজেকে কোনমতো তুলে ডাক্তারের সামনে বিদ্ধস্ত রূপে দাঁড়ালো। প্রার্থর বিচলিত, প্রশ্ন জর্জরিত মুখ দেখে আর কিছু বলতে হলো না তাকে। ডাক্তার নিজেই বলতে শুরু করলেন,
“- মিস্টার প্রার্থ চৌধুরী, কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনুন। প্লিজ হাইপার হবেন না। পেশেন্টের ক্রনিক সাবডুরাল হেমাটোমার কারণে মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি হচ্ছিলো। এই ইন্ট্রাক্রানিয়াল প্রেশার বাড়ার কারণে অটোনোমিক সিস্টেমে ডিসরাপশন হয়। ফলে ইউটেরাইন ব্লাড ফ্লো কমে গিয়ে প্লাসেন্টার কার্যক্ষমতা বিঘ্নিত হয়। এই রকম পরিস্থিতিতে ফিটাস পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না এবং স্যাডলি, স্পন্টেনিয়াস অ্যাবরশন ঘটে যায়।
একটু থেমে ফের বললেন,
“-বাচ্চা আর নেই মিস্টার চৌধুরী। আপনার স্ত্রীর মিসক্যারেজ হয়েছে। ”
“বাচ্চা আর নেই” কথাটুকু কর্ণকুহর হতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো সকলের । প্রত্যয় সাহেব ভেঙে পড়লেন কান্নায়। কার্তিক, রকি গিয়ে তাকে ধরলো।
প্রার্থ এখনও স্তব্ধ দাঁড়িয়ে। সমস্ত শরীর কাঁপছে তার। সে হয়তো পড়ে যাচ্ছে। কমজোরতায় পেছনে পড়ে যেতে নিলো ফের। অন্ত এসে খপ করে ধরে ফেলে তাকে। পরপর অর্নবরাও এসে পেছন থেকে আগলে ধরে প্রার্থকে। সে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। শরীরের অবাধ কম্পন নিজেও টের পাচ্ছে। রক্তজবার ন্যায় লাল চোখে অশ্রুদের দখলদারি। টপটপ করে কয়েক ফোনা নোনা তরল গড়িয়ে পড়লো কপোল বেয়ে।
ডাক্তার দেখলো তার অশ্রুসিক্ত নয়ন জোরা। কে বললো, ছেলেরা কাঁদে না, ছেলেদের কাঁদতে নেই? ছেলেরাও কাঁদে, তাদেরও কষ্ট হয়, তাঁদেরও কাঁদা উচিত। ডক্টর শারমিন এই ডাক্তারী পেশায় এসে বহু পুরুষকে কাঁদতে দেখেছেন। হাউমাউ করে বাচ্চাদের মতোনও কাঁদতে দেখেছেন।
প্রার্থ তখন সিক্ত নয়নে তাকিয়ে ভাঙা গলায় অস্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“-আমার ফুল?
‘ফুল’ বলাতে তিনি বুঝলেন না। ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করবে তার আগেই পাশ হতে অর্নব বলল,
“-মানে ওর স্ত্রী। পুষ্পর কথা জিজ্ঞেস করছে। ওর কি অবস্থা? ও ঠিক আছে?
“-ঠিক আছে। তবে সামনে ঠিক না-ও থাকতে পারে। শুধুমাত্র অতিরিক্ত চিন্তার ফলে এই অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটে গেলো। তিনি যখন জানবেন তার গর্ভে তার সন্তান নেই তখন হয়তো আরো ভেঙে পড়বেন। এবং এটিই তার জন্য সর্বনাশ ডেকে আনবে। মিস্টার চৌধুরী, আপনাকে দ্রুত সব করতে হবে। নিউরোসার্জনের সঙ্গে যোগাযোগ করুন । ইমিডিয়েটলি অপারেশনের ব্যাবস্থা করুন। ডক্টর ইফতেখারকে আমি আপনার কাছে পাঠাচ্ছি। পরামর্শ করে নিবেন।
প্রার্থর শরীর থরথর করে কাঁপছে। শ্বাস নিতে পারছে না কেন? দম বন্ধ হয়ে আসছে। বুকের ভেতর এত চাপা লাগছে কেন? মনে হচ্ছে ভারী কিছু রেখে দিয়েছে কেউ। সে আবার রোধ হয়ে আসা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“-এ..একটু দেখা করতে পারবো?
“-পারবেন। কিছুক্ষণের মধ্যে অন্য রুমে শিফট করা হবে তখন দেখা করে নিবেন। নিজেদের খেয়াল রাখুন এবং আপনার স্ত্রীকে যথাসম্ভব চিন্তামুক্ত রাখার চেষ্টা করুন। আসি।
ডাক্তার চলে গেলো। প্রার্থ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো পাথর বনে। স্তব্ধ ভাইকে দেখে অন্ত পেছন থেকে মলিন কন্ঠে ‘ভাই’ বলে ডাকলো। প্রার্থর ধীরে মাথাটা অন্তর দিকে ঘুরিয়ে বললো,
“-অন্ত, আমার বাচ্চা, আমার বাচ্চাটা আর নেই!
এমন মলিন অসহায় কন্ঠে বুক ফেটে যায় সকলের। টলমল করে উঠে চোখ। অর্নব বলে,
“-ভেঙে পরিস না। এদিকে একটু বোস।
প্রার্থ বসে না। ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ ধপ করে হাটু মুরে বসে পড়ে। মাথা ঝুঁকে অশ্রু বিসর্জন দেয়। দুই হাত উঁচু করে চোখের সামনে তুলে। হাত দুটো থরথর করে কাঁপছে। সেই শূন্য কাঁপা হাতের দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় আওড়ায়,
“-আমার বাচ্চাকে আমি আমার দুহাতে তুলতে পারলাম না। ওকে সবার প্রথম আমি আমার এই হাতে তুলতে চেয়েছি। ভেবেছিলাম সে এসে আমার বাবার রেখে যাওয়া খালি থাকা জায়গাটা পূরণ করে দেবে। আমার বাবা হয়ে আসবে সে আমার কাছে। কিন্তু সেও চলে গেলো। আমাকে ধোঁকা দিয়ে চলে গেলো? জায়গাটা তো শূন্য হয়েই রয়ে গেলো। আমার তাকে না দেখে না ছুয়েই বিদায় দিতে হচ্ছে।
প্রার্থর এমন আহাজারিতে কেঁদে ফেলে অন্ত। নিচে বসা অবস্থায় জরিয়ে ধরে ভাইকে। অর্নবরাও পাশে থেকে তাকে জরিয়ে নেয়। ভরসা দেয়। নিচ থেকে উঠিয়ে বসায় চেয়ারে। পাশে বসে অর্নব শান্তনা দেয়,
“-প্রার্থ প্লিজ সামলা নিজেকে। জন্ম মৃত্যু সব আল্লাহর হাতে। তিনি যেমন নিয়েছেন তার থেকেও বেশি দিবেন। এখন ফোকাস পুষ্পর উপর রাখ। ও ঠিক থাকলে আবারও তোদের সন্তান আসবে। তোর ফাকা জায়গাটা আবারও পূরণ হবে। তুই-ই যদি ভেঙে পরছিস তাহলে ওর কি হবে ভাব। ওকে তো তোকেই সামলাতে হবে। বোঝাতে হবে। ডাক্তার কি বলে গেলো শুনলি তো।
প্রার্থ জানে তাকে শক্ত থাকতে হবে এবং সে শক্ত থাকবেও। তবুও ওই না দেখা পাখিটার জন্য তার বুক পুড়ে যাচ্ছে। মায়া হচ্ছে খুব। বাচ্চাটা নিয়ে তাদের কত স্বপ্ন। কিন্তু এটা বুঝি স্বপ্নই রয়ে গেলো। স্বপ্ন কি কখনো বাস্তব হয় না? পুষ্পর এই জটিল রোগটা না হলে কি হতো না? তাদের সুখের সংসারটা আরেকটু সুখের হতো। মাঝে কষ্ট নামক জিনিসটা থাকতোই না। ভালোবাসার মানুষটাকে সারাজীবন বুকে আগলে রাখতে চাওয়া টা কি অন্যায়? অন্যায় নয় তো। তবে কেন প্রকৃতির এমন ছিনিয়ে নেওয়ার খেলা? ভালোবাসায় এত কষ্ট কেন? এখানে শুধু সুখ নামক জিনিসটা থাকতে পারে না বুঝি?
প্রার্থর আবার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বড় বড় শ্বাস টানে তবুও যেন অক্সিজেন পৌছায় না ভেতরে। পুষ্পর জন্য এবার আরো চিন্তা হচ্ছে। তাকে সামলাবে কি করে? মনে মনে প্রার্থনা করে, “আল্লাহ শক্তি দাও। সবকিছু সামলানোর মতো ধৈর্য দাও। আমার ফুলকে আমার বুকে ফিরিয়ে দাও”
পুষ্পকে এই কেবিন থেকে অন্য কেবিনে শিফট করা হচ্ছে। চলন্ত বেডে করে মাত্রই কেবিন থেকে বের করলো তাকে। প্রার্থ হুরমুরিয়ে যায় তার সামনে। পুষ্প চোখদুটো স্বল্প পরিসরে খুলে রেখেছে। চোখমুখে ক্লান্তির ছাপ। প্রার্থ সামনে আসতেই সে ক্যানেলা লাগানো হাতটা উপরে উঠায়। প্রার্থ সে হাত খুব যত্নে মুঠোয় পুরে। অন্যহাত তার মাথায় রেখে ঠোঁটে একটু হাসি টেনে বলে,
“-কেমন লাগছে?
পুষ্প কথা বলে না। দুচোখের কোন ঘেঁসে গড়িয়ে পরে নোনা পানি। একহাত খুব ধীরে নিজের পেটের উপর রাখে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাঁপা স্বরে শুধায়,
“-নেই?
প্রার্থ চেষ্টা করলো যাতে চোখে জল না আসে। তবুও অবাধ্য অসভ্য জলেরা হামলে পড়লো তার উপর। টপ করে এক ফোলা পানি পরলো পুষ্পর হাতে। পুষ্প ফুঁপিয়ে উঠে তখন। প্রার্থ কিছু বলতে পারে না।প্রত্যয় এহসান এসে দাঁড়ায় তখন মেয়ের অন্য পাশে। মেয়ের মাথায় আদুরে হাত রেখে তিনি ডাকেন,
“-মা, মা রে, কাঁদিস না। আল্লাহ পাক নিয়েছেন তিনি আবার দিবেন। আস্থা রাখ তার উপর। ভেঙে পরিস না। তুই সুস্থ হ। আল্লাহ চাইলে তোর কোল আলো করে আবার সন্তান আসবে। শক্ত হ মা। তোকে বাচতে হবে। আমাদের জন্য বাঁচতে হবে, প্রার্থর জন্য বাঁচতে হবে।
উনার মুখে প্রার্থর কথাটা শুনে অবাকই হলো বাকিরা। সবাই জানে তিনি প্রার্থকে পছন্দ করেন না। কিন্তু প্রার্থর পুষ্পর প্রতি ভালোবাসাটুকু দেখে বোধহয় তার ধারণা বদলালো।
ততক্ষণে ওয়েটিং রুম থেকে এখানে হাজির হয়েছেন পূর্ণিমা, পূর্ণতা, প্রিয়া আর স্নেহা। অফিস থেকেও ছুটে এসেছেন আশরাফ চৌধুরী। আসতে পারেনি শুধু অহনা। তিনি ব্যাবসায়ের তাড়নায় গেছেন ঢাকার বাইরে। সেখান থেকেই এখন ছুটে আসছে সে। এখনো এসে পৌঁছায়নি। কেবিনের বাইরেই একপ্রকার হুলুস্থুল অবস্থা। নার্সরা তাড়া দিয়ে সকলকে সরিয়ে দিলো। অন্য কেবিনে শিফট করে নাহয় কথা বলে নিবে। এভাবে মাঝ পথে দাঁড়িয়ে কথা বলা রুলসের বাইরে। পেসেন্টের জন্যও ক্ষতি। তারা জায়গা ফাকা করে নিয়ে গেলো সামনে। সাথে সাথে চললো সকলে।
পেছনে থেকে গেলো শুধু প্রিয়া। সে ধপ করে বসে পরেছে বেঞ্চিতে। অন্তও অনেকটা পথ চলে গেছিলো। পেছনে ফিরে প্রিয়াকে সেখানে দেখেই ফিরে এলো। প্রিয়া হেঁচকি তুলে কাঁদছে। অন্ত তার পাশে বসে কাঁধে হাত রাখে। কিছু বলে ভরসা দিতে চায়। অথচ ‘প্রিয়া’ বলে সেই হৃদয়কারা ডাকটা দিতেই প্রিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্ত’র বুকে। হেঁচকি তুলে তুলে বলে,
“-আমার বুবুর সাথেই কেন এমন হলো বলো তো। আমার বুবু কার কি ক্ষতি করেছে? আল্লাহ তাকে এত বড় শাস্তি কেন দিচ্ছে?
অন্ত এক হাতে তাকে আগলে নিলো। অন্যহাত মাথায় রেখে বললো,
“-মাঝে মাঝে আল্লাহ আমাদের কঠিন কিছু পরিক্ষা নেয়। এই পরিক্ষায় হাল ছাড়া যাবে না। ধৈর্য ধরতে হবে। আল্লাহ না চাইলে আপুর কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। দেখিস আপু সুস্থ হয়ে যাবে। আল্লাহ চাইলে সে আবারও মা হবে। চিন্তা করিস না।
অন্ত একটু থামে। প্রিয়ার মাথায় ছোট্ট করে ঠোঁট ছুয়িয়ে বলে,
“-কাঁদিস না। চল আপুর কাছে চল। ওখানে আপুর সামনে একদম কাঁদবি না। আপু ভেঙে পরবে।
“-পুষ্প কোথায়?”
সামনে থেকে পরিচিত গম্ভীর নারী কন্ঠের আওয়াজ পেয়ে ভরকে যায় ওরা। প্রিয়া অন্তর বুক হতে মুখ তুলে দেখে অহনা বেগম গম্ভীর চোখমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রিয়ার বুক ছলকে উঠে ভয়ে। অন্ত’র থেকে দুরুত্ব বজায় রেখে মাথা নিচু করে বসে। অন্ত উঠে দাঁড়ায়। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
“- ৩০৪ নাম্বার রুমে আম্মু। সামনেই আছে। বড়মা খুব কাঁদছে। একটু দেখো গিয়ে।
তার মুখভঙ্গি বদলালো না। ওরকম গম্ভীর মুখেই বললেন,
“-তুমিও এসো।
একবার প্রিয়ার উপর চোখ বুলিয়ে তিনি চলে গেলেন। অন্তর মা তাঁদের সচরাচর ‘তুমি’ বলে ডাকে না। ‘তুই’ বলে ডাকে। যদি কোন সিরিয়াস ইস্যু হয় ঠিক তখনই ভদ্রমহিলা ছেলেদের ‘তুমি’ সম্বোধন করেন। অন্ত বুঝেও চুপ রইলো। তার মাঝে ভয় কাজ করছে না। যে ছেলের মাকে দেখলেই ভয় হতো। মায়ের ভয়ে যে সবসময় মায়ের পছন্দ মতো কাজ করতো। সে আজ মাকে ভয় পেলো না। মনে যেন অজস্র সাহস তার। যদি এখন তার মা জিজ্ঞেসও করতো -“প্রিয়া তোমার কি হয়? তোমাদের তো এভাবে জরিয়ে ধরার সম্পর্ক নয়। তবে কেন দু’জনে এত কাছাকাছি? ”
অন্ত তখন নির্দিধায় নির্লজ্জের মতো বলতো -“সম্পর্ক এখনো সে পর্যায়ে যায়নি যে পর্যায়ে গেলে একটা ছেলের অধিকার থাকে তার প্রেয়সীকে বুকে আগলে সামলে রাখার। কারন আমাদের বিয়ে হয়নি। কিন্তু প্রেমিক পুরুষ হিসেবে প্রেমিকার দুঃখে বুক পেতে দেওয়া তো আমার দায়িত্ব। আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি। কারন আমি তাকে ভালোবাসি। যেদিন বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবো সেদিনই নাহয় বলবো সম্পর্কের কথা।
অন্তকে এখনো বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রিয়া অবাক হয়। কান্না থামিয়ে অবাক চোখে তাকায়। পরপর চোখে খানিক ভয় নিয়ে শুধায়,
আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৯
“-আন্টি কি বুঝে ফেললো? বকবে আমাদের?
অন্ত প্রিয়ার হাত ধরে টেনে দাঁড় করায়। বলে,
“-কিছু হবে না। আমি আছি তো। আপুর কাছে চল ।
প্রিয়া আর কিছু বলে না। এখন এগুলো ভাবার সময় না। তাকে তার বুবুর কাছে যেতে হবে। ওখানে বুবু কেমন পাগলামি করছে কে জানে।