আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৪২
তানহা ইসলাম বৈশাখী
ভোর সকাল। পাখির কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে বাইরে থেকে। ফজরের আযান দিয়েছে অনেকক্ষণ। প্রার্থ হসপিটালের নামাজের কক্ষ থেকে নামাজ পড়ে মাত্রই এলো কেবিনে। পুষ্প এখনো ঘুমাচ্ছে। সে এগিয়ে আসে। তার চোখদুটো লাল হয়ে আছে। সারা রাত চোখদুটো এক করতে পারেনি। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয়েছে এই বুঝি তার প্রাণ পাখিটা উড়ে গেলো। ভয়ে চিন্তায় ঘুমাতে পারেনি । শুধু চেয়ে থেকেছে পুষ্পর মুখপানে।
সে এগিয়ে ঘুমন্ত পুষ্পর উপর ঝুকে পরে। কপালে চুমু দেয়। প্রার্থ বারবার হাজারবার বলবে এই চেহারাটা তাকে শান্তি দেয়। মুহুর্তেই অস্থির করে আবার মুহুর্তেই শীতল করে তোলে বক্ষপট। এই মুখের দিকে তাকিয়ে এই মুহুর্তে মনে একটাই সুর বাজছে,
“Meri bechaniyo ko, chan mil jaye.
Tera cehra jab nazar aye…..! ”
প্রার্থর ঝুকে থাকা অবস্থায় দরজায় টোকা পরে। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ভেতরে আসতে বলে তাকে। একজন নার্স সেলাইন নিয়ে এসেছে। দূর্বলার জন্য সেলাইন দিয়ে রাখতে হচ্ছে। নার্স টা এসে সেলাইন সেট করতে করতে প্রার্থকে বললো,
“আপনাকে ডক্টর ইফতেখার তার কেবিনে ডেকেছে স্যার।”
প্রার্থ তাকে পুষ্পর খেয়াল রাখতে বলে চলে গেলো।
সে ডক্টর ইফতেখারের কেবিনের সামনে এসে টোকা দিতেই ভেতর থেকে গমগমে আওয়াজ ভেসে এলো। অনুমতি পেতেই সে ভেতরে ঢুকে যায়৷
“আসো প্রার্থ। বসো।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ডক্টর ইফতেখারের সৌজন্যতায় সামান্য হাসলো প্রার্থ। টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে বসে পড়লো।
প্রার্থর শুকনো চোখমুখ দেখো ড. ইফতেখার বললেন,
“স্ত্রীর সাথে সাথে দেখছি নিজেও দূর্বল হয়ে যাচ্ছো ইয়াং ম্যান। নিজের দিকে খেয়াল দিচ্ছো না? খাওয়া দাওয়া কি ঠিকমতো হচ্ছে না? তোমাকে দেখে তো সুস্থ সবল যুবক লাগছে না।”
প্রার্থ ঠোঁটে সামান্য হাসি ফোটালো। মলিন গলায় বললো,
“যেখানে আমার ভালো থাকার মানুষই সুস্থ নেই সেখানে আমাকে আর কত সুস্থ থাকতে বলছেন আঙ্কেল?”
“সে তো আছেই কিন্তু তোমাকে তো সুস্থ থাকতে হবে। স্বামী-স্ত্রী একসাথে অসুস্থ হলে কি করে চলবে?”
প্রার্থ কিছু বললো না। ডক্টর ইফতেখার এবার আসল আলোচনায় আসলেন।
“পুষ্পর আমরা যত দ্রুত সম্ভব অপারেশন টা করতে চাই। ওর শারিরীক ভাবে এখনো কিছু দূর্বলতা আছে। আশা করি দুদিনের মধ্যে সব দূর্বলতা কেটে যাবে এবং এটার দায়িত্ব আমি তোমার উপরেই দিলাম। ওকে ডায়ভার্ট করো। যা গেছে তা গেছে। তাকে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। বাচ্চার বিষয় নিয়ে ওর সামনে কথা বলা টোটালি অফ করে দাও। মানসিক সুস্থতাই বড় সুস্থতা। ওকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করো নয়তো অপারেশনের সময় নানা সমস্যার দেখা দিতে পারে। আশা করি বুঝতে পেরেছো আমার কথা।”
প্রার্থ তপ্ত শ্বাস ফেলে। ও তো চায় পুষ্পকে এই ট্রমাটা থেকে বের করতে কিন্তু সদ্য সন্তান হারানো মাকে কি এত সহজেই সব ভোলানো যায়? তবুও প্রার্থ চেষ্টা করছে। সে নিচু স্বরে বললো,
“জ্বি আঙ্কেল বুঝতে পেরেছি। আমি ওকে যথাসম্ভব ডাইভার্ট করার চেষ্টা করবো। আপনি প্লিজ ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাবস্থা করুন। যাই হয়ে যাক ওর যেন কিছু না হয়।
“ডোন্ট ওয়ারি ইয়াং ম্যান। সি উইল বি ফাইন। এটা খুব জটিল কোন রোগ নয়। অপারেশনটা সাকসেসফুলি করতে পারলেই অল ওকে। তুমি চিন্তা করে না। আমি একটু পর গিয়ে চেক করে আসবো একবার। সকালে স্যুপ বা পুষ্টিকর কিছু খাইয়ে দিও। আনহাইজেনিক খাবার একদম এলাও নয়।
ডক্টর কিছু মনে করে আবার বললো,
“ওহ আরেকটা কথা, সিঙ্গাপুর থেকে যে ডক্টর এপোয়েন্ট করেছি। তিনি আজ আসছে বিডিতে। বেশিদিন থাকবে না এখানে। সো, যত দ্রুত পারো পুষ্পকে অপারেশনের জন্য তৈরী করো। এটুকুই। যাও ওর কাছে যাও।
প্রার্থ উঠে দাঁড়ালো। কৃতজ্ঞতা সরূপ ডাক্তারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেড়িয়ে গেলো সে।
সকাল সকাল চৌধুরী বাড়ির মানুষ তৈরী হয়েছে হসপিটালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। প্রত্যয় আর পূর্ণতাও কাল এবাড়িতেই এসেছে। কাজ থেকে দুজনেই ছুটি নিয়েছে তারা। মেয়েকে এভাবে রেখে কাজে কখনোই যেতে পারবেন না। সবকিছু ঠিকঠাক করে আশরাফের গাড়িতে উঠে পড়েছে তারা। পূর্ণিমা বেগমসহ মোট চারজন উঠলো সে গাড়িতে। অহনা বেগম প্রার্থর গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভিংয়ে অন্ত বসা। প্রিয়া ভেতর থেকে এলাচিকে নিয়ে আসছে।
এলাচিকে নিয়ে গাড়ির সামনে আসতেই অহনা বেগম কড়া গলায় বললেন,
” হসপিটালে মেবি পেট এলাও নয়। এলাচি কে রেখে এসো।
প্রিয়া মিয়িয়ে যায়। মাথা নিচু করে বলে,
“এলাচি কে দেখলে বুবুর একটু ভালো লাগতে পারে। তাই আরকি….।”
“তবুও তুমি ওকে রেখে আসো। বিড়ালে অনেকের এলার্জি থাকতে পারে। সেখানে নিতে হবে না। রেখে এসো। বাসায় রুবি আছে। ও দেখে রাখবে ওকে।
প্রিয়া ডাইভিং এ বসা অন্তর দিকে একবার তাকালো। অন্ত ইশারা করলো রেখে আসতে। ও আর কিছু না বলে মাথা নিচু করে চলে যায় এলাচি কে রেখে আসতে।
একটু পর যখন এলাচিকে রেখে সে এগিয়ে এলো তখন মনে মনে প্রার্থনা করছিলো যেন অহনা আন্টির সাথে ওর যেতে না হয়। ওই রগচটা মহিলা কি না কি বলে বসে আল্লাহ মালুম।
এবার সোজা গিয়েই মায়ের সাথে বসে পড়বে। অন্তর সাথে যাবে না। করলোও তাই। গটগট পায়ে চলে গেলো আশরাফের গাড়ির সামনে। চটপট বসে গেলো গাড়িতে। ততক্ষণে অহনা বেগম বসে পরেছে অন্তর পাশের সিটে। প্রিয়াদের গাড়ি আগে ছাড়লে অন্তও গাড়ি ছেড়ে দিলো।
বেশ অনেকক্ষণ মা ছেলে চুপ রইলো। অন্ত মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করছে। ও জানে মা কেন এমন স্ট্রিক্ট বিহেভ করছে। কিছু একটা যে বলবে এটা ও সিওর।
অহনা বেগম মুখ খুললেন আরো কিছুক্ষণ পর। সামনে তাকিয়ে তেজি গলায় বললেন,
“তোমার সাথে আমার কথা আছে অন্ত”
অন্ত ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বললো
“বলো আম্মু।
ভদ্রমহিলা কথায় কোন রাগঢাগ রাখলেন না। সোজাসুজি প্রশ্ন ছুড়লেন,
” তোমার আর প্রিয়ার মাঝে কি চলে?”
“এখন নয় আম্মু প্লিজ। এখন এগুলো জিজ্ঞেস করো না। আমরা পুষ্প আপুকে দেখতে যাচ্ছি।
“এখন নয় তো কখন? পুষ্পকে দেখতে যাচ্ছি কিন্তু কোথাও লেখা নেই যে আমরা এখন এ বিষয়ে কথা বলতে পারবো না। তুমি যদি তোমার জায়গা থেকে ঠিক থাকো তাহলে এখন আর তখনের প্রয়োজন হবে না আমার মতে।”
“কিচ্ছু চলছে না আম্মু।
” কিচ্ছু চলছে না? অন্ত ডোন্ট আন্ডারেস্টিমেট মি। মা হই তোমার। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না।”
“আচ্ছা বলো কি শুনতে চাও?”
“প্রশ্নটা আমি প্রথমেই করেছি। কি চলে তোমাদের মাঝে?”
অন্ত আর লুকোচুরির খেলা খেললো না। সরাসরি বলে দিলো,
“কিছু চলছে না আম্মু। আমি ওকে পছন্দ করি।”
অহনা সরু চোখে তাকালেন। ঝাঁঝালো গলায় প্রশ্ন করলেন,
“শুধু তুমি পছন্দ করো? সে করে না?”
“আম্মু ওর খবর দিয়ে তুমি কি করবে? ”
“অন্ত।”
ধমকে উঠেন অহনা। তার ছেলে তার সাথে এভাবে কথা বলছে? এত শান্তশিষ্ট ছেলে কথার উপর কথা বলছে। এ যেন মায়ের এতদিনকার অহমিকায় আঘাত আনলো বেশ। দাঁতে দাঁত চেপে ফের বললেন,
“বেশি বড় হয়ে গেছো? মায়ের উপরে কথা বলো তুমি? বয়স কত তোমার? কিসে পড়ো? রোজগার করো? গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে রেখেছো তাহলে কোন আক্কেলে?
অন্ত মায়ের উপর গলা বাড়িয়ে কথা বললো না। সবকিছু বোঝানোর জন্য খুব নরম গলায় বললো,
“আম্মু আমি বলিনি আমি এখন বিয়ে করবো। আই নোউ মাই লিমিটস। আর ও আমার গালফ্রেন্ড নয়। আমি ভালোবাসি ওকে। কোন একদিন বিয়ে করবো। গার্লফ্রেন্ড নামে তাকে আখ্যা দিবো না।
অহনা আশ্চর্যের উপর আশ্চর্য হলেন। তার ছেলে ঠিক কতটা বড় হয়েছে? সে কি আদতে এই ছেলের মা? কই মা হয়ে তো তিনি বুঝতে পারছে না তার ছেলে ঠিক কতখানি বড় হয়েছে। এভাবে ভয়ভিতী হীন কথা বলতে কোথা থেকে শিখেছে?
তিনি যেন আরো কঠোর হলেন। তেজস্বী স্বরে বললেন,
” তুমি ভালোবাসার কি বুঝো? তুমি মানুষ চিনতে শিখেছো? ওই মেয়ের আশেপাশেও যেন তোমাকে না দেখি৷ ক্যারিয়ারের চিন্তা না করে তুমি প্রেম, বিয়ের চিন্তা করছো? ওয়াও! এত উন্নতি আমার ছেলের!”
“আম্মু, তুমি এসব নেগেটিভ ভাবে কেন নিচ্ছো?”
” তো পজেটিভ ভাবে নিতে বলছো? শুনে রাখো অন্ত, তোমার ক্যারিয়ারের আগে কিছু না। এসব প্রেম পিরিতির খেলা এখানেই শেষ করো। দ্বিতীয়বার বলবো না আমি। এবং তুমি জানো আমি সত্যিই বলবো না। আর প্রিয়াকে বলে দিও তোমার থেকে দূরে থাকতে। আমি বললে কি কি বলবো সে তো তুমি জানোই।
অন্ত অসহায় চোখে তাকায় মায়ের দিকে। কন্ঠে সমান অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলে বলে,
“আম্মু এমন কেন করছো? আমি বলিনি আমি এখনই বিয়ে করবো বা করছি। আমি আগে নিজের পায়ে দাঁড়াবো। ক্যারিয়ারের চিন্তা আমারও আছে। প্লিজ তুমি ভুল বুঝো না আমাকে। প্রিয়াকেও কিছু বলো না প্লিজ। ওর কোন দোষ নেই। তুমি কি চাও? আমি ওর সাথে কথা না বলি, দেখা না করি তাই তো? ঠিকাছে মানলাম। পড়ালেখায় মন দিবো তো? দিলাম। কিন্তু মা শুনে রাখো বিয়ে আমি ওকেই করবো। তা আজ হোক বা ১০ বছর পর। ও অন্তর নামেই লেখা থাকবে। ”
অহনা হাতে তালি দিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন,
” বাহ! ভালোই তো হাতিয়ে নিয়েছে দেখছি। একেবারে বস করে ফেলেছে। তাকে বিয়ে না করতে পারলে তুমি মরে যাবে? দুনিয়ায় আর মেয়ে নেই।”
“দুনিয়ায় হাজার টা মেয়ে আছে। কিন্তু আমার তাদের কাউকে লাগবে না। আমার ওকেই লাগবে। ওকে না পেলে আমি সত্যিই মরে যাবো।”
ছেলের লাগামহীন বেলেল্লাপনা কথা শুনে অহনার রাগের পরিসীমা দ্বিগুন হলো। একটা মেয়ের জন্য তার ছেলে আজ এই পর্যায়ে এসেছে। এদিনও তাকে দেখতে হলো! মনে মনে তিনি পন করলেন, ওই মেয়েকে তিনি তেরো ঘাটের পানি খাইয়েই ছাড়বে।
তখনই পাশ থেকে অন্ত মায়ের মতিগতি বুঝে বলল,
“আম্মু, আমার তোমার কাছে অনুরোধ তুমি প্রিয়াকে কিচ্ছু বলবে না। আমাদের মাঝে আজকে যা কথা হয়েছে তাও না। কিচ্ছু না। তুমি যা বলেছো আমি তা মেনেছি। শুধু ওকে তুমি কোন কথা বলবে না। এটা আমার শর্ত অথবা অনুরোধ মানতে পারো।”
অহনা চুপ রইলেন। তার নিজের ছেলের উপরও সে বিরক্ত। সারাজীবন অফিস অফিস করে ছেলেদের দিকে ধ্যানই দিতে পারেননি তিনি। আজ তারই ফল ভোগ করছে যেন। ছেলে মায়ের হাত ছাড়া হয়ে গেছে অনেক আগেই। সে অন্য মেয়ের জন্য এখন মায়ের মুখের উপর কথা বলছে। মরে যেতে চায়। অথচ এই ছেলেই ছিলো বাড়ির সবচেয়ে নম্র ভদ্র আর শান্তশিষ্ট।
মায়ের মনে হাজারটা অভিযোগ তুললো। কিন্তু ছেলেকে কিছু আর বলতে পারলো না। এরপর পুরো টা পথ একইরকম চুপ হয়ে রইলো সে।
পুষ্পর কেবিনটা এখন কানায় কানায় ভর্তি। মানে পরিবারের সব সদস্য উপস্থিত। তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে। প্রার্থর হাতে স্যুপের বাটি। গরম স্যুপ চামচে তুলে ফু দিয়ে দিয়ে পুষ্পর মুখে পুরে দিচ্ছে সে। পুষ্পও চুপচাপ খাচ্ছে। আজ একবারও কাঁদেনি পুষ্প। নিরবতা পালন করছে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে হু হা করে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে শুধু। তবুও এটুকুতেই খুশি তারা। পুষ্প যে এমন শক্ত থাকবে তা তো ভাবতেই পারেনি কেউ৷ ভেবেছিলো সকালে হয়তো পুষ্পকে সামলানো খুব মুশকিল হয়ে যাবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে নিজে থেকেই শান্ত হয়ে আছে। বিষয়টা একটু হলেও শান্তি দিচ্ছিলো সকলের মনে।
পুষ্পর মা তখন ওর উসকোখুসকো চুলগুলোতে বেনুনি পাকাচ্ছিলেন। এমনিতেই সবারই মুখ থমথমে তবুও পুষ্পকে ভালো রাখার জন্য টুকটাক অনেক কিছুই বলে যাচ্ছে।
পুষ্পর সেদিকে তেমন ধ্যান নেই। সে প্রার্থর শুকনো মুখে তাকাচ্ছে বারবার। তার শুকনো খড়খড়ে মুখটা দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠছে। এ কদিনে মানুষটা বোধহয় ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়াও করেনি। চোখ মুখে ক্লান্তির ছাপ সাথে চিন্তার ছাপও স্পষ্ট ফুটে আছে। আরেক চামচ স্যুপ মুখের সামনে ধরতেই পুষ্প শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো,
“আপনি খেয়েছেন?”
প্রার্থ সামান্য হেসে বলে,
“পরে খেয়ে নিবো।”
“কখন?”
“তোর খাওয়ার পর।”
“কাল রাতে খেয়েছিলেন কিছু?”
“হুম।”
প্রার্থর মিথ্যে টুকু সে চট করে ধরে ফেলে। তেজ দেখিয়ে বলে,
“মিথ্যে কেন বলছেন? আমার সামনে মিথ্যে বলবেন না। আপনাকে এই অবস্থায় দেখার জন্য আমি এখানে বসে আছি? নিজের দিকে একবারও তাকিয়ে দেখেছেন? নাকি শুধু আমাকে নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন? একবার ভাবলেন না আপনাকে এভাবে দেখতে আমাদের কেমন লাগবে।
বলতে বলতে কন্ঠ রোধ হয়ে আসে পুষ্পর। কেঁপে কেঁপে উঠে স্বর। চোখ টলমল করছে।
প্রার্থ এতগুলো মানুষের তোয়াক্কা করলো না। সবার সামনে এক হাতে কান ধরে বললো,
“স্যরি। আর হবে না। এখন আমাকে কি করতে হবে?
পুষ্প ভেঙে আসা গলায়ই তেজ দেখিয়ে বললো,
” কি করতে হবে আবার? নিজের চেহারা সুরত ঠিক করুন।”
প্রার্থ একটু মজা নিলো। দুষ্টুমির স্বরে বললো,
“কেন? আমাকে ভালো দেখাচ্ছে না? পুরোনো হয়ে গেছি এজন্য?
পুষ্প ধমকে উঠে,
” চুপ করুন আপনি বেলাজ লোক। বড় আম্মু তুমি কিছু খাইয়ে দাও তোমার ছেলেকে। চেহারা ভরলে আমার সামনে আসতে বলো। ভাঙা চেহারায় আমার সামনে যেন না আসে।
প্রার্থ নাকোচ করে বলে,
“আগে তুই এটুকু শেষ কর। এরপর খেয়ে নিবো প্রমিস।
কোত্থেকে প্রিয়া এসে প্রার্থর হাত থেকে বাটিটা নিয়ে বললো,
” যাও যাও আমি খাইয়ে দিচ্ছি বুবুকে। তুমি গিয়ে খেয়ে আসো। বুবুর তোমাকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না। খেয়েদেয়ে মুখটাতে একটু মাংস বানিয়ে নিয়ে আসো। যাও।
পূর্ণিমা বেগমও বললো,
“বাবা, খেয়ে নে। তুই অসুস্থ হলে আমার মেয়েটার এমন যত্ন নিবি কি করে?
কেবিনে একটা সোফা আছে। সাথে ছোট্ট একটা টেবিল সেট করে সেখানে খাবারের বক্স রাখলো সব পূর্ণতা বেগম। বাসা থেকেই তারা খাবার নিয়ে এসেছে। খায়নি এখনো কেউই।
অহনা আর আশরাফ পুষ্পর সাথে দেখা করেই চলে গেছে। তারা অফিসে খেয়ে নিবেন।
খাবার গুলো টেবিলে রাখতেই পুষ্প প্রত্যয় সাহেবকে বলে উঠলো,
“আব্বু, আমি জানি তুমিও খাওনি কিছু৷ যাও জামাই শশুড় একসাথে বসো। আমি এখান থেকে তোমাদের খাওয়া দেখবো তারপরেই খাবো বাকিটুকু।”
আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৪১
প্রত্যয় মেয়ের মাথায় হাত রেখে চলে গেলেন খাবার খেতে। প্রার্থও গিয়ে বসেছে। পুষ্প আলগোছে হাসে। টপ করো একফোটা জল নিজের হাতের উপর পরে৷ এইত মানুষগুলো খাচ্ছে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে। নয়তো ওর চক্করে বাকি সকলের ঘুম হারাম হচ্ছিলো। বিশেষ করে প্রার্থর। যাকে ভালোবাসে তার মনের অবস্থা সে কি টের পায় না? আলবাত পায়। ছেলেটা সবসময় এত ভয়ে থাকে। বুকের উপর মাথা রেখে শুলেই বোঝা যায় চঞ্চল হৃৎপিণ্ড ভয়ে কেমন ধরাস ধরাস করছে। এই মানুষটাকে একটু শান্তি দেিয়া প্রয়োজন। আর কত ভুগবে সে? পুষ্প কি তাকে এমন প্রেমতৃষ্ণায় ভোগাতে চেয়েছিলো? ও তো এত কঠোর শাস্তি চায়নি তবুও কেন যে এত কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হলো ও নিজেও জানে না।