আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৪৬

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৪৬
তানহা ইসলাম বৈশাখী

দুই মাস পর….
হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে শায়শায় গতিতে উড়ে গেলো সময়। দুই মাস যেন চোখের পলকেই গায়েব। পুষ্প এখন অনেকটা সুস্থ। মাঝে মাঝে মাথা যন্ত্রনা দেখা দেয়। তবে সেটা স্বাভাবিক।
প্রার্থ পুরোপুরিভাবে নিজেদের বিজনেসে যোগ দিয়েছে। বাড়ির বড় ছেলের তো সবদিক থেকেই জোগাড় হয়ে গেলো। এবার মেজো ছেলের পালা।
ছেলেটার বয়স ছোট হয়ে যাওয়াটাই যত জ্বালা। এইতো আজ দুই পরিবার একত্রিত হয়েছে। প্রিয়ার পরিবার এবং অন্তর পরিবার। রিলেশনের দু মাস হলো কি হলো না নিব্বা নিব্বি দুইটা ধরা খেয়ে গেলো সবার কাছে। ইচ্ছে করে ধরা খাওয়া বলা যায়। অন্তটা প্রার্থর হাতে পায়ে ধরে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করেছে প্রথমে। এরপর ওকে দিয়েই পোল খুলে দিয়েছে।
সপ্তাহখানেক আগে, প্রার্থরা সকলে একসাথে রাতের খাবার খেতে বসেছে। হঠাৎ প্রার্থ অহনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“কাকিমা ছেলে বড় হচ্ছে। ওর বিয়ের ব্যবস্থা করো।”
এমন একটা কথায় সকলের খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে থাকে প্রার্থর দিকে। অহনা হয়তো বুঝতে পেরেছে কি বলবে তাই তিনি কৌশলে বললেন,
“বিয়ে তো অবশ্যই দিবো। ছেলে আরেকটু বড় হোক। বিয়ের বয়স এখনো হয়নি।”
প্রার্থ নিজের খাওয়ায় মন দিয়েই বলল,
” কিন্তু তোমার ছেলে এখনই বিয়ে করতে চায়। বিয়ে করিয়ে দাও নয়তো কোথায় কি করে বসবে কে জানে। আমার যে পা ধরেছে পা আর ছাড়ে না। বলে বিয়ে না দিলে পা ছাড়বে না। ”
এবার সকলের বড় বড় চোখ গিয়ে পড়লো অন্তর দিকে। কারো বিশ্বাস হচ্ছে না যে অন্ত এমনটা করতে পারে। বেচারা অন্ত লজ্জায় পারছে না মাটির সাথে মিশে যাবে। ও যদি জানতো প্রার্থ এভাবে বলবে তাহলে কোনদিন বলতো না ওকে। দরকার পরে বিয়ে না করে থাকতো তবুও পা ধরে বসে থাকতো না। অন্ত ভেবেছিলো প্রার্থ সবাইকে আলাদা আলাদা করে নিজের মতো বুঝিয়ে রাজি করাবে। কিন্তু ও যে সবার সামনে এভাবে বলে দিবে কে জানতো?
পূর্ণিমা বেগম তখন পাশ থেকে বলে উঠলেন,
“এগুলা কি বলছিস? ওর বিয়ের বয়স হয়েছে? কিরে অন্ত, ও কি বলে? তুই এখন কাকে বিয়ে করবি? ”
প্রার্থ আবারও বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কেন মা আমাদের প্রিয়া আছে তো। ওকেই বিয়ে করবে। ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে তো। ”
চমকের উপর চমক। পুষ্প, অহনা ব্যপারটা জানলেও পূর্ণিমা বা আশরাফ সাহেব কেউই জানতো না। সবাই এমন ভাবে ওদের দুটোকে দেখছে যেন গিলে খাবে। প্রিয়ার ইচ্ছে করছে অন্তর মাথায় একটা বারি মেরে মাথাটা ফাটিয়ে দিতে। এতদিন বাবার বাড়ি ছিলো তাতেই শান্তিতে ছিলো। কেন যে দুদিন আগে আসতে গেলো। নিজের মাথায় নিজের বারি দিতে ইচ্ছে করছে।
অন্তরও একই অবস্থা। প্রার্থর কাছে হাতে পায়ে ধরে সব বলাটা যেন তার ভুল হয়ে গেছে। কে জানতো এভাবে ঘাটে হাঁড়ি ফাটাবে।
সবার অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করে অহনা বেগম কড়া গলায় বললেন,
“ওরা ভালোবাসার কি বুঝে? বয়স কত দুজনের? মেয়ে তো কলেজের গন্ডিও পার করেনি। ছেলে কি করে খায়? এই বয়সে বিয়ে দিবো? কখনো না। বিয়ে করতে চাইলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাক। বাইরে থেকে কামাই করে খাওয়াক বউকে।”
আশরাফ চৌধুরী তখন স্ত্রীর পাশ থেকে শান্ত গলায় বলল,
“থামো অহনা। আগে শুনতে দাও পুরো বিষয়টা। অন্ত, তোমার ভাই কি বলছে? এগুলো সত্য? তুমি পছন্দ করো প্রিয়াকে?”
অহনা তেতে উঠে,

“তুমি এগুলো শুনে কি করবে? প্রার্থ বলল শুনলে না? তোমাট ভদ্র ছেলো প্রেম করে বেড়ায়। আবার বিয়ে করতে চায়। তিনি নাকি তাকে ছাড়া বাঁচবে না। মরে যাবে। এই বয়সেই এইসব কথা তোমার ছেলের। তুমি ওকে বিয়ে দিবে এখন? ওর বয়সটা বুঝতে পারছো? আবেগের…..!
” আন্টি বিয়ে না দিলেন। ওদের সম্পর্কের একটা নাম দেওয়া যাক আপাতত। বিয়েটা নাহয় ওরা সেটেল্ড হলেই করবে। ”
মাঝপথে পুষ্পর কথায় অহনা থেমে যায়। পুষ্পর দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলে,
“তুমি বলছো এই কথা? তোমার তো উচিত ছিলো বোনকে শাসনে রাখা। তা না করে তুমি নির্লজ্জের মতো…
” কাকিমা ওখানেই থামো। ওর সাথে রুড বিহেভ করবে না। আমার পছন্দ না। যা কথা বলার আমার সাথে বলো।”
প্রার্থর গম্ভীর স্বরে থেমে যায় অহনা। পুষ্প পাশ থেকে প্রার্থর হাত শক্ত ধরে যেন রাগ করে আরো কিছু বলে না ফেলে। যতই হোক চাচি তো। তিনি দু কথা নাহয় বলতেই পারেন তাই বলে তার সাথে রুড হওয়া যাবে নাকি?
অহনা তখন রাগে কিড়মিড় করে বলল,
“ঠিকাছে তোকেই বলছি তাহলে। ঠিক কর তোর ভাই আর বোনকে। এখন বিয়ের কথা বললে যেন বেড়িয়ে যায় বাড়ি থেকে। ”

কথাটুকু বলেই তিনি খাওয়া ছেড়ে উঠে চলে যান হনহনিয়ে। নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যায় ডাইনিং হল। আশরাফ সাহোব শান্ত গোছের মানুষ। তিনি ছেলেকে আবার প্রশ্ন করলেন,
“অন্ত, তুমি বিয়ে করতে চাও প্রিয়াকে?”
বাবার শান্ত স্বরে ঘাবড়ে যায় অন্ত৷ শান্তশিষ্ট ছেলে ছোটবেলা থেকেই বাবা মায়ের সব আদেশ পালন করে এসেছে। এখন এসে তাদের অবাধ্য হতেও খারাপ লাছে। তবুও কিছু করার নেই। প্রিয়াকে পেতে হলে এতটুকু অভদ্র তাকে হতেই হবে। সে মাথা উপর নিচ নাড়ালো। কুন্ঠায় গুঁজো হয়ে বলল,
“জ্বি আব্বু।”
“কতদিন ধরে চলছে এগুলো? আর প্রিয়া তুমি…..!”
বাবাকে আর বলতে না দিয়ে অন্ত ফটফট করে বলে ফেলল,
“ওর কোন দোষ নেই আব্বু। আমিই দুবছর যাবত ওকে ভালোবাসি। ও তো রাজি ছিলো বা আমিই জোর করেছি। আমিই…!”
“থামো! বুঝতে পেরেছি। আমি প্রিয়ার দোষ দিচ্ছিনা। যেভাবে ওকে প্রটেক্ট করছো যেন ওকে বকা দিচ্ছি। আমি শুধু ওর মতামত জানতে চাইছিলাম। প্রিয়া, মা তুমিও কি তাই চাও?”
আশরাফ সাহেবের কথায় অন্তর লজ্জায় গায়েব হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। ও সত্যিই ভেবেছিলো বাবা প্রিয়াকে বকা দিবে। তাইতো এভাবে হরহর করে কথাগুলো বলে দোষ সব নিজের ঘাড়ে নেওয়া। এখন লজ্জায় তার মরি মরি অবস্থা।

ওদিকে প্রিয়ার হালাতও একই। ও আগে জানলে এ বাড়িতে পা রাখতো না। এত নার্ভাস লাগছে মেয়েটার! সবচেয়ে বেশি নার্ভাস বোনের রিয়েকশান দেখে। বুবু যে আগে থেকে সব জানতো তা সে জানতো না। আজ মেয়েটা যে কতটা চমকেছে তা হিসাবের বাইরে।
আশরাফের করা প্রশ্নে প্রিয়া চোখ, দাঁত খিঁচে উপর নিচ মাথা নাড়ালো।
উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন আসরাফ। সাথে বুকের ভেতরের পাথর নেমে গেলো অন্তর। ছেলেটা ভেবেছিলো প্রিয়া হয়তো ভয়ে মানা করে দিবে। কারণ এমন পরিস্থিতি তাদের দুজনের অন্যই অজ্ঞাত ছিলো। আগে থেকে কোন পরামর্শও করা ছিলো না তাদের। হুট করেই যেন সব হলো।
অশরাফ সাহেব খাওয়া শেষে উঠে গেলেন। প্রার্থকে বলে গেলেন,
“তোর শশুড় বাড়ির লোকেদের আসতে বল প্রার্থ। শুভ কাজে দেরি কিসের? প্রত্যয় সাহেবের দুই মেয়েই আমার ঘরের লক্ষী হোক। ”

সকলেই খুশি হলো এমন একটা কথায়। বিশেষ করে পূর্ণিমা বেগম। তিনি ভয়ে ছিলেন। দেবর আর জা যদি তার বোনের মেয়েটাকে ভুল বুঝে এ নিয়ে । কিন্তু তার দেবর তার ভয়কে ছু মন্তর করে দিলো।
প্রাণে পানি এলো অন্তরও। বেচারার তো জান যায় যায় অবস্থা। বাবা চলে গেলে সে প্রার্থর দিকে অসহায় চোখে তাকায়। যার অর্থ ‘ আম্মুকে কি করে রাজি করানো যায়?’
প্রার্থ তাকে আশ্বাস দিলো। তৃপ্তি নিয়ে খাবার চিবাতে চিবাতে বলল,
“চিন্তা নেই। কাকিমাকে ম্যানেজ করতে সময় লাগবে না। তুই তোর জায়গা ধরে রাখ।”
ছোট্ট প্রান্ত টা এতক্ষণ চুপ ছিলো। এখন কেমন হইহই করে অন্তকে বলে উঠল,
“ইয়েএএ! আরেকটা বিয়ে খাবো। আচ্ছা ভাইয়া তোমরা তো সবসময় ঝগড়া করো। বিয়ের পরেও কি ঝগড়া করবে?”
এ প্রশ্নের উত্তর আর দিতে পারলো না অন্ত। বেচারার লজ্জা যেন কাটছেই না। তবে পুচকুটার কথা শুনে হাসলো সকলে।

এরপর প্রার্থ আর আশরাফ সাহেব মিলে বহু কষ্টে অহনা বেগমকে রাজি করালো। কিন্তু শর্ত হলো বিয়ে নয়, শুধু বগদান সেরে রাখবে। বিয়ে হবে অন্তর পড়ালেখা শেষ হলে। পড়ালেখার জন্য অন্তকে পাঠানো হবে অস্ট্রেলিয়ায়। সেখান থেকে ফিরে অন্তর নিজের পায়ে দাঁড় না হওয়া অব্দি বিয়ে হবে না। যেদিন অন্তর সামর্থ্য হবে। বউকে খাওয়ানো পড়ানোর মতো যোগ্য হবে সেদিনই বিয়ে হবে। সময় যত লাগে লাগুক। দুজনেই মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। এরপর বড় করে অনুষ্ঠান করে তাদের বিয়ে দেওয়া হবে। এ কথাতেই অন্ত এক পায়ে রাজি। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। যেটুকু পেয়েছে এটুকুই অন্তর জন্য অনেক। পরে আবার পুরোটা চলে গেলে! তখন কি করবে? তাইতো আজ একেবারে অর্ধেক জামাই সেজে এসেছে আংটিবদল করতে। প্রিয়াকে নিজের নামে অর্ধেক দখল করে রাখতে।

দুই পরিবারের উপস্থিতিতে অবশেষে আংটিবদল সময় হয়ে এলো । অন্ত সাদা রংয়ের সুন্দর একটা পাঞ্জাবী পড়ে এসেছে। প্রিয়ার গায়ে নীল রাঙা সুতির শাড়ী। দুজনকে দেখতে বেশ বড় বড় লাগছে। একটা সোফায় পাশাপাশি বসা দুজন। অন্তকে বলা হলো আংটিটা পড়ানোর জন্য। ছেলেটার হাত কাঁপছে খুশিতে। কাঁপা কাঁপা হাতে সে প্রিয়ার সুন্দর হাতটা ধরলো। গোল রিংটাতে ডায়মন্ডের ছোট্ট পাথর বসানো আংটিটা গলিয়ে দিলো প্রিয়ার অনামিকায়। প্রিয়ার হাতটা এত সুন্দর লাগছে অন্তর ইচ্ছে করছে এক্ষুণি টুপ করে একটা চুমু খাবে এই হাতটাতে। কিন্তু এত মানুষের মধ্যে তা আর করা হলো না।
এরপর প্রিয়াও অন্তর শ্যামবর্ণের হাতের আঙুলে আংটিটা পড়িয়ে দিলো। আপাতত দুজন দুজনের নামে অর্ধেক দখল হয়ে গেলো।
আলহামদুলিল্লাহ ধ্বনিতে মুখরিত হলো ড্রয়িংরুম।
সময়টা অপরাহ্নের। অন্ত একা প্রিয়াদের ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণের ফুরফুরে হাওয়া মনকে সতেজ করে দিয়ে যাচ্ছে। এমনিতেও ছেলেটার মন আজ ফুরফুরে। প্রেয়সীকে নিজের করে পাওয়ার এক ধাপ সম্পূর্ণ করে ফেলেছে ও। এবার কবুল বলার অপেক্ষায় শুধু।
ওর নিঃসঙ্গতায় দাঁড়িয়ে থাকার মাঝেই পেছন থেকে অতি কাঙ্ক্ষিত শব্দ কানে এলো।
“কি হয়েছে? এখানে কেন ডাকছো? নিচে সবাই আছে। কি ভাববে সবাই? ”
অন্ত পেছনে ঘুরলো। নীল শাড়ীর নীলাঞ্জনাকে দেখে আর দৃষ্টি থমকে যায়। নিজে ভালো করে তাকাতে পারেনি। এবার প্রানভরে দেখে নিলো নিজের অন্তঃপ্রিয়াকে। প্রিয়ার অস্বস্তি বাড়ল। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,

“এভাবে কেন তাকাচ্ছো?”
“কাছে আয়। ”
অন্তর আবদারে প্রিয়া মুখ বাকাল। বলল,
“পারবো না।”
“কেন?”
“কেন আবার? তুমি জানো না কেন?”
“রাগ করছিস কেন জান?”
ছেলেটা বেয়াদব হয়ে গেছে। ইদানীং কথায় কথায় জান বলে ডাকে। প্রিয়ার যে জানে পানি থাকে না তখন সেটা কি সে বুঝে না। প্রিয়া গাল ফোলালো। সে যাবেনা অন্তর কাছে।
অন্ত নিজ উদ্যোগে এগিয়ে গিয়ে প্রিয়াকে টেনে নিয়ে এলো। গালে একহাত রেখে বলল,
“এমন রাগ করলে আমি যাবো কি করে বলতো? ”
প্রিয়া মাথা নিচু করে অশ্রু লুকিয়ে বলে,
“যেতে হবে কেন?”

“আমাদের জন্য। আমাদের ভবিষ্যতের জন্য। বিয়ে করতে হবে না আমাদের?”
“দেশে থেকে পড়ালেখা করলে কি হতো? দেশে কি পড়ালেখা হয় না? আন্টি কেন তোমাকে এমন দূরে করে দিচ্ছে? আমার ভালো লাগছে না।”
“প্রিয়া, একটা চুমু খাই?”
প্রিয়ার এমন কথার বিপরীতে অন্তর এরকম কথা কখনোই আশা করেনি সে। হতবাক হয়ে তাকালো সে অন্তর দিকে। পরক্ষণেই আবার খেপে গেলো। এমন একটা ইমোশনাল মোমেন্টে উনার চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। প্রিয়ার ইচ্ছো করলো ঠোঁট দুটো সেলাই করে দিতে। মুখ কুঁচকে কিছু বলবে তার আগেই অন্ত প্রিয়ার ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে বলল,
“এখানে খাবো না। এত আগেই এতদূর যাচ্ছি না।
এরপর কপালে আঙুল ঠেকিয়ে বলল,
” এখানে খাবো। জাস্ট একটা। খাই?”

প্রিয়া আহাম্মক বনে তাকিয়ে রইল অন্তর দিকে। তার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করো অন্ত ঠোঁট বাড়িয়ে দিলো। সুন্দর ঠোঁট দুটো গিয়ে ঠেকালো প্রিয়ার মসৃণ কপালে। বেশ অনেকক্ষণ একইভাবে রইলো। দুজনেরই চোখ বন্ধ। মুহুর্ত টুকু তাদের জন্য বাঁধা। বাক্য নয়, মন দিয়েই তাদের ভাষার আদান-প্রদান হলো। অনেকক্ষণ পর যখন অন্ত সরে এলো তখন প্রিয়ার চোখে জলের রেখা দেখা গেলো। অন্ত আলগোছে মুছিয়ে দেয় সেই তরল। দুহাতে প্রিয়ার মুখ তুলে বলে,
“কাঁদছিস কেন জান? তোকে ছেড়ে যেতে কি আমার খুব ভালো লাগবে? যেতে হবে তো। একেবারে নিজের করে পাওয়ার জন্য একটু দূরত্ব নাহয় সহ্য করলামই। দূরত্ব যেদিন শেষ হবে সেদিন তো এক হবই। মাঝের এই অপেক্ষাটুকু কি করা যায় না? ”

প্রিয়া অশ্রুসিক্ত নয়নে উপর নিচ মাথা নাড়ালো। অন্ত আবার বলল,
“তাছাড়া অস্ট্রেলিয়া যেতে এখনো অনেকদিন বাকি। মাস দুয়েক সময় তো লাগবেই। এখন এগুলো ভেবে সময় নষ্ট না করি? আমরা আমাদের বর্তমানটুকু উপভোগ করি, কেমন?”
প্রিয়া আবারও মাথা ঝাঁকাল। অন্ত এক হাতে ওকে পুরোপুরি ঘুড়িয়ে দেয়। প্রিয়ার পিঠ ঠেকে অন্তর বুকে। রেলিংয়ে দু হাত রেখে প্রিয়াকে আটকে রাখে নিজের বাহু বেষ্টনীতে।
বেশ খানিকটা সময় তাদের কাটলো নিরবতায় প্রকৃতি বিলাস করতে করতে।
আচমকা দরজার কাছ থেকে শব্দ এলো। অন্ত পেছনে ঘুরে দেখে প্রার্থ, পুষ্প দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্প প্রার্থকে টানছিলো বোধহয় চলে যেতে। অন্ত তাকাতেই ও থেমে যায়।
এদিকে ভাই ভাবিকে সামনে দেখে ছিটকে দূরে সরে যায় অন্ত। প্রিয়া ওর এমন ব্যবহারে বিমূঢ় বনে তাকায়। কি হলো কিছুই বুঝলো না মেয়েটা। অন্তর চোখ লক্ষ করে দরজার পানে তাকাতে সে-ও ভয় পেয়ে যায়। আঁতকে উঠে কিছুটা।

ওদিক থেকে প্রার্থ দরজার কাছে দাঁড়িয়েই রাশভারি গলায় বলল,
“তোদের হয়েছে? এবার নিচে যা সবাই ডাকছে। প্রেম পরে করিস। ”
বড় ভাইয়ের কাছে এভাবে ধরা খাওয়ায় দুজনেই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। অন্ত তো কোন বাক্য ব্যায় হীন দ্রুত পদে চলে যায় ছাঁদ ছেড়ে। এদিকে প্রিয়া কি করবে বুঝতে পারছে না। দরজার কাছে ফাঁকা জায়গা দেখতেই মেয়েটা দৌড়ায় নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
ওরা যেতেই পুষ্প চোখ রাঙিয়ে বলে,

“দিলেন তো ছেলে মেয়ে দুটোকে লজ্জা পায়িয়ে। আপনার কি আক্কেল জ্ঞান নেই? ওরা না-হয় একটু সময় একা পাড় করছে আপনি এভাবে কাবাবে হাড্ডি হয়ে যাবেন?”
প্রার্থ সরু চোখে তাকিয়ে বলে,
“তো কি করবো? দুটো কত পেকে গেছে দেখিস না? বাড়িতে এত মানুষ। ওরা এখানে প্রেম করছে। আশ্চর্য! ”
“এখন তো আশ্চর্য হবেই? বলে না, নিজের বেলায় ষোলো আনা অন্যের বলায় চার আনা। আপনিও ঠিক তাই। নিজে যখন সবার সামনে প্রেম করতে চান তখন আপনার লজ্জা করে না? ”
“তো আমি আমার বউয়ের সাথে প্রেম করতে পারবো না?”
দুজন কথা বলতে বলতে ছাঁদের কোনায় এসে দাঁড়িয়েছে। পুষ্প তপ্ত শ্বাস ফেলল। উনার সাথে ইদানীং তর্কে পারা যায় না। গম্ভীর মানুষটা পুষ্পর সামনে এলে বোধহয় বাচ্চা হয় নয়তো তার মুখের তালা খুলে যায়। কথার পৃষ্ঠে কথা বলে মাত দেয় ওকে।
পুষ্প তাই কথা না বাড়িয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো। প্রার্থ তার পেছনে দাঁড়িয়ে দুহাতে ওর মেদহীন কোমড় আঁকড়ে ধরে। পুষ্পর খোলা চুলের মাঝে নিজের মুখ ডুবিয়ে দেয়।
পুষ্প ঠেস দিয়ে বলতে নেয়,

“এখন কেন আপনি….!
প্রার্থ বাঁধা দেয়। বেশ গম্ভীর স্বরে ধমকে উঠে,
” উমম! বলেছি না আপনি বলবি না। ”
“তো কি বলবো?”
“তুমি।”
পুষ্পর মাথায় তখন দুষ্টু বুদ্ধি এলো। বলল,
“ঠিকাছে, যদিন আমি দ্বিতীয়বার মা হবো সেদিন থেকে ‘তুমি’ বলে ডাকবো আর যেদিন তৃতীয় বার মা হবো সেদিন থেকে ‘তুই’ বলে ডাকবো। আর যেদিন চতুর্থ বার মা হবো সেদিন বাবুর আব্বু বলে ডাকবো। চলবে?”
প্রার্থ এবার পুষ্পকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। দুহাত কোমড়ে রেখে কাছাকাছি দাঁড়ালো। চোখা চোখে তাকিয়ে বলল,
“এটা কেমন নিয়ম? মা হওয়ার সাথে আমার সম্বোধনের কি সম্পর্ক? আর মাঝে ‘তুই’ শব্দটা এলো কেন? তোর সাহস আছে আমাকে ‘তুই’ বলে ডাকার?”
“আপনি তাহলে আমাকে ‘তুই’ বলেন কেন? আমি কি এখন আপনার খালাতো বোন আছি? আমি এখন আপনার স্ত্রী। ”
“তো তুই কি চাইছিস আমি তোকে ‘তুমি’ বলে ডাকবো।”

“হ্যাঁ ডাকবেন।”
“কখনো না।”
“তাহলে আমিও আপনি বলেই ডাকবো।তুমি কখনো বলবো না।”
প্রার্থ হতাশ হয়। যেন-তেন করে তো ভাই বলা আটকেছে এবার আর ‘আপনি’ বলা থেকে আটকাতে পারছে না। ভারি মুশকিলে পড়লো ছেলেটা। বউয়ের মুখে আর কতদিন আপনি ডাক শুনবে। একটু তুমিও তো ডাকতে পারে।
প্রার্থ এবার কঠোর হলো। মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,
“তুই কি ‘তুমি’ ডাকবি নাকি না?”
পুষ্পর দু হাত প্রার্থর বুকের উপর ঠেকিয়ে রেখেছে। সে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল,
“না, ডাকবো না। আপনি আমার কাছে আপনিতেই সুন্দর।”
প্রার্থ আচমকা কামড় বসালো পুষ্পর ফোলা নরম গালের মাঝে। ফর্সা ত্বক মুহুর্তেই লালচে হয়ে গেলো। দাগ বসে গেলো দাঁতের। সে আহাম্মক বনে তাকিয়ে আছে প্রার্থর দিকে। প্রার্থ সেই কামড় বসানো জায়গায় ছোট ছোট চুমু দিয়ে বলল,
“এটা আমার কথা না শোনার শাস্তি।”

পুষ্পর চোখদুটোতে বিস্ময়। গালে হাত দিয়ে দেখে একদম দাগ বসে গেছে। কন্ঠেও একইরকম বিস্ময় নিয়ে বলল,
“তাই বলে কামড়াবেন?”
“ভবিষ্যতে কথা না শুনলে আরো ভয়ংকর শাস্তি দিবো।”
“কিন্তু এটাতে দাগ বসে গেছে তো। নিচে কি করে যাবো? সবাই বুঝে যাবে। ”
প্রার্থ বাকা হেসে বলে,
“এটাই তো শাস্তি।”
পুষ্পর মাথায় আকস্মিক এক বুদ্ধি এলো। সে বুদ্ধির জেরে হুট করে পুষ্পও অনাকাঙ্ক্ষিত একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলল। ঝাপ দিয়ে প্রার্থর গলা জরিয়ে ধরে ওর উন্মুক্ত ঘাড়ে কামড় বসালো। প্রার্থ ব্যথা পেলেও সরে গেলো না বা নড়চড় করলো না। কামড় দিতে দিলো ইচ্ছেমতো।
কামড়টা দিয়েই পুষ্প উঠে এলো। ভ্রু নাচিয়ে বোঝালো সে বিশ্ব জয় করে ফেলেছে। প্রার্থ শান্ত স্বরে বলল,
“এটা কি ছিলো?”
“কামড়। এটা আপনার শাস্তি। আমি একা কেন শাস্তি পাবো। আপনিও পান। নিচে গেলে এবার আপনিও লজ্জা পাবেন। ”
প্রার্থ হাসলো। সে হাসিতে ঠোঁট প্রসারিত হলো না খুব একটা। পুষ্পকে বুঝতে দিলো না। বলল,
“তোর মনে হয় আমার লজ্জা আছে?”
পুষ্প বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে বলল,
“নেই?”
“আছে?”
পুষ্পর তখন মনে পড়লো তার সুপার হিরো বরের লজ্জা বলতে কিচ্ছু নেই। সে পারে না শরীরের সবখানে দাগ নিয়ে উদম হয়ে বাড়িময় ঘুরে বেড়াবে। তবুও লজ্জা নামক বস্তু তার ধারে ধরা দিবে না। পুষ্প নিজেই নিজের কপাল চাপড়ালো।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৪৫

প্রার্থ তখন হো হো করে হেসে দিলো। দুষ্টুমি ভরা কন্ঠে বলল,
“লজ্জা কিন্তু তোকেই পেতে হবে। দুটো কামড়ের জন্যই। চাইলে আরেকটা দিতে পারিস। এবারেরটা ঠোঁটে দে। নে।”
বলতে বলতেই নিজের ঠোঁট এগিয়ে দেয় সে। পুষ্প দুহাতে ওর ঠোঁট চেপে ধরে। মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
“চুপ করুন। বেহায়া লোক। লজ্জা কি সব বানের জলে ধুয়েমুছে দিয়েছেন?”
প্রার্থ বন্ধ মুখেই বলল,
“থাকলে তো ধুবো।”
একরাশ হাসি ঠাট্টা, মুগ্ধতা, ভালোবাসা নিয়েই তাদের দিন কাটে। এমন কোনো দিন নেই যেদিন তাদের ভালোবাসার গল্প হয় না। প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটি ক্ষণে তাদের ভালোবাসা আদান প্রদান হয়। হয়তো একটু ভিন্ন ভাবে একটু ভিন্ন উপায়ে। তবে ভালোবাসা কমে না। দিনকে দিন সে ভালোবাসার পাল্লাটা যেনো বেড়েই চলেছে। অবশেষে এত এত দুঃখের পর তাদের জীবনে এক টুকরো সুখ এসে ধরা দিয়েছে। এ সুখ কি এভাবে সেভাবে ফেলে রাখবে নাকি। সবটা দিয়ে উপভোগ করবে এ সুখ।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৪৭