আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৪৭
তানহা ইসলাম বৈশাখী
কৃত্তিম আলোয় সাজানো কমিউনিটি সেন্টার । চারপাশে আর্টিফিশিয়াল ফুল, ঝাড়বাতি, পাতলা পর্দা ইত্যাদি দিয়ে সাজানো। মেইন জায়গাটায় সুন্দর করে স্টেজ করা। স্টেজটাকে নানা রকম ফুল দ্বারা সাজানো হয়েছে। অতিথীদের বসার জায়গাটায় পরিপাটি করে সাজানো চেয়ার ও টেবিল।
হলজুরে মানুষের আনাগোনা।
অন্তর বাগদান গেলো মাত্র ২ মাস ১০ দিন হলো। তার মধ্যেই হৃদয়ের বিয়ের ঘন্টি বেজে গেলো। প্রেমিকা নিয়ে সে আর কত ঘুরবে? এবার বউ লাগবে। বন্ধুদের বিয়ে হয়ে বাচ্চা হয়ে গেলো অথচ সে এখনো বিয়েই করতে পারলো না। সেই জেদে ছেলেটা এত তোরজোর করে বিয়ের ব্যবস্থা করলো। অবশ্য এর পেছনে বহুত শ্রম দিতে হয়েছে। হবু শ্বশুর মশাইকে বাগে আনতে বহু কসরত করেছে সে। তার মোহকে চাই মানে চাই। যেকোন মূল্যে চাই। এত সিরিয়াসনেস দেখে সবাই যারপরনাই একটু অবাকই হয়েছে। মিনিটে মিনিটে গার্লফ্রেন্ড বদলে ফেলা ছেলা কিনা এক নারীতে আসক্ত হয়েছে। মায়া কি-না পারে? একবার কারো মায়ায় পড়লে সে মায়া কাটানোর মতো সাধ্য মানুষের বোধহয় নেই।
এইতো এত পাগলামি ছেলেমানুষির পর চন্ডাল শ্বশুরকে সে রাজি করাতে পেরেছে। তাছাড়া মোহর বাবাকে মানানোর পেছনে প্রার্থদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সবে সন্ধ্যা হলো। বরযাত্রী কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছেছে অনেকক্ষণ। এখনো বিয়ের কার্যক্রম শুরু হচ্ছে না। হৃদয় বসে বসে বোর হচ্ছে। এতদিনের দেরি সহ্য হলেও এটুকু দেরি আর তার সইছে না। কখন বিয়ে করবে কখন বাসর সারবে আর কখন যে বাচ্চার বাবা হবে এই ভেবে ভেবেই তার মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর এর মূল কারন কার্তিক সুস্মিতা। ওইতো হৃদয় বরাবর টেবিলটাতে সুস্মিতা বসে আছে। মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। কার্তিক এটা ওটা নিয়ে সুস্মিতাকে খাওয়াচ্ছে। বউয়ের থেকো দূরে সরছে না। হৃদয়েরও ইচ্ছে করছে মোহকে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় দেখতে। অথচ তাদের এখনো বিয়েই হলো না। বিশাল হতাশার শ্বাস ফেলতেই হৃদয়ের চোখ পড়লো অন্তর উপর। হাতে একটা কোন আইসক্রিম নিয়ে এদিকে আসছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
হৃদয় হাত উঁচিয়ে ডাকলো তাকে,
“আরে অন্ত বাবু। এদিকে আসো।”
অন্ত ডাক শুনে থামলো। হৃদয়ের কাছে এসে দাঁড়াতেই হৃদয় বলল,
“আইসক্রিম কার জন্য নিচ্ছো ভায়া?”
“প্রিয়ার জন্য। ও বলছিলো গরম লাগছে আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে তাই বাইরে থেকে নিয়ে এলাম।”
হৃদয় হতাশার শ্বাস ফেলে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,
“ছ্যাহ! তোমাদেরই জীবন। আমার আগেই এঙ্গেজমেন্ট করে নিলে। এখন প্রেমিকা নিয়ে বিন্দাস ঘুরছো। আর আমি এখনো বিয়েই করতে পারলাম না।”
অন্ত দ্বিগুন হতাশ হয়ে বলল,
“একটু পরে তো বিয়েটা হয়েই যাচ্ছে ভাই। আমার বিয়েটা তো অনেক দেরি। আগে এনগেজমেন্ট করেও লাভ হলো না।”
“তা ঠিক। ঠিকই আছে। আমাদের আগে তোমাদের বিয়ে হয়ে বাচ্চা হয়ে গেলে তো ঝামেলা। লজ্জার ব্যপার হয়ে যায়। মানুষ বলবে বড়দের আগে ছোটটা বাবা ডাক শুনে নিয়েছে।”
অন্ত একটু লজ্জা পেলো ওর কথায়। অজুহাত দেখিয়ে বলল,
“আচ্ছা ভাই যাই। আইসক্রিমটা গলে যাবে। প্রিয়া আবার আমার উপর রাগ করবে। ”
“হ্যাঁ হ্যাঁ যাও ভায়া যাও। প্রেমিকা পালনের ঠ্যালা বুঝো। কিন্তু প্রিয়তমা কই? দেখলাম না তো। ”
এই লোকটা আবার প্রিয়াকে প্রিয়তমা বলে ডাকছে। ও মোহকে ভালোবাসে বলে অন্ত এখন ওর নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না কিন্তু প্রিয়ার মুখে হৃদয় ভাই আর হৃদয়ের মুখে প্রিয়তমা শুনলেই অন্ত রাগ হয়। সে রাগ চেপে খানিক চিড়বিড়িয়ে বলল,
“ভাই ওকে প্রিয়তমা ডাকবেন না প্লিজ। প্রিয়া নামটা বেশি সুন্দর। শুধুই প্রিয়াই ডাইকেন। আসি। আইসক্রিম গলে যাচ্ছে। ”
হৃদয়কে আরো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অন্ত চলে গেলো সামনে থেকে। ছেলেটা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো তখনো। কিছু বলতেও পারলো না।
এমন সময় এলো রকি। হৃদয়ের পাশে ধপাস করে বসে পড়লো। হৃদয় এবার অন্তকে ভুলে রকিকে জিজ্ঞেস করল,
“এতক্ষণ কই ছিলি ভাই? বোর হচ্ছি আমি। একেকজনের সাথে ছবি তুলতে তুলতে কাহিল হয়ে গেছি।”
রকি আয়েশি ভঙ্গিতে বসে বলল,
“সোফিয়া কল করেছিলো। কথা বলে আসলাম। ”
হৃদয় চোখদুটো মার্বেলের মতো বড়বড় করে বলল,
“সোফিয়াটা আবার কে? ইনারার সাথে তোর ব্রেকআপ হয়ে গেছে নাকি?”
“হোপ ব্যাটা! ওর ফুল নেইম ‘ইনারা সোফিয়া’। আগে না বললাম, মনে নেই?”
“ওহ তাই বল। আমি ভাবলাম বন্ধুর আমার নারীদোষ আছে।
রকি সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
” আমাকে কি তোর মতো ভাবিস?”
হৃদয় অবাক হয়ে বলে,
“তো আমাকে তুই কি ভাবিস? আমি মেয়েবাজ ?
” সেটা আবার বলতে হবে?”
“দেখ ভাই। মেয়েবাজ ছিলাম মানছি। কিন্তু এখন আমি এক নারীতে আসক্ত পুরুষ। ভুলেও মোহ জানের সামনে এগ্লা বলিস না। নয়তো আজ বাসর ক্যান্সেল।
বেশ বেদনার সাথে কথাগুলো বলল হৃদয়। দুঃখী দুঃখী মুখ করে রাখলো। তখন ওদের পাশে এসে বসলো প্রার্থ আর অর্নব। দুজন বসতেই হৃদয় মুড বদলে মুখে বিরক্তি নিয়ে বলল,
” কি ভাই? কই থাকিস? আমাকে রেখে তোরা এদিক ওদিক ঘুরছিস। এদিকে সবার সাথে কথা বলতে বলতে আমার হাল বেহাল।”
প্রার্থ পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ করে বসে বলল,
“বউ সামলে এলাম। ”
“ওহ আমার তো মনেই নেই আপনারা মহাপুরুষ। বউ ছাড়া হাগু করতেও যান না। তা বউ ছাড়া এখানে এলেন কি করে?”
অর্নব সামনে ইশারা করে বলল,
“বউকে সামনে রেখেই এখানে এসেছি। ”
ওরা সামনে তাকাতে দেখলে পুষ্প আর স্নেহা এক জায়গায় বসে বসে গল্প করছে খুব মন দিয়ে। এতক্ষণ ছিলো না। ওরাই বোধহয় ধরে বেঁধে এনে সামনে বসিয়ে রেখেছে। হৃদয় আরো কিছু বলবে তার আগেই একটা ছেলে বেশ ঘটা করে এসে বসলো হৃদয়ের পাশে। অর্নবকে ঠেলে হৃদয়ের সাথে ঠেসে বসল। অর্নবের মেজাজ চটলেও কিছু বলল না বিয়ে বাড়ি বলে।
ছেলেটা এসেই হৃদয়কে এক হাতে জরিয়ে ধরে বলল,
“ভাই কংগ্রাচুলেশনস! আমাদের রেখেই বিয়ে করে ফেলছিস। বিবাহ জীবন তোর ভালো কাটবে না দেখিস। ”
হৃদয় চিড়বিড়িয়ে বলল,
“শালা অভিশাপ উঠা। বিয়েটা করতে কম কাঠখড় পোড়াইনি। এরপর আবার খড় পোড়াতে হলে তোর জীবনও যাতে নরক হয়ে যায়। ”
ওদের অভিশাপের মাঝে বাকি লোক নিরব দর্শক। একটু কথা বলার পর যা বুঝলো ছেলেটার নাম রিজভী। হৃদয়ের মামাতো ভাই। ছেলেটা প্রার্থদের সাথেও পরিচিত হয়ে নিলো।
ওদের কথার মাঝে হঠাৎ রিজভী বলে উঠল,
“ভাই, বিয়েটা তো করে ফেলছিস এবার এই বড় ভাইটার বিয়ের ব্যবস্থা করে দে।”
হৃদয় বেশ আনন্দ নিয়ে বলল,
“তো বিয়েটা কর না। মেয়ে দেখবো নাকি? আমার অনেক এক্স আছে। সবগুলোই সুন্দরী।”
ছেলেটা হেসে বলল,
“ধুর, তোর এক্সের টাইম আছে নাকি? আমার এখান থেকেই মেয়ে পছন্দ হয়ে গেছে। তুই শুধু নাম আর পরিচয় টা বল। বাকিটা আমি দেখে নেবো।
হৃদয়ের প্রশ্ন করার আগেই ছেলেটা হাত উচিয়ে সামনে দেখিয়ে বলল,
” ওইযে রেড কালারের শাড়ী পড়া মেয়েটা বসে আছে না ওইটা৷ মেয়েটা কিন্তু দারুন সুন্দর। কে রে ওটা। আগে তো দেখিনি। নাম কি?”
ইশারা অনুযায়ী সেখানে রেড শাড়ী পড়া পুষ্পকে দেখে ভয়ে হৃদয়ের হৃদয় শুকিয়ে এলো। আতঙ্ক নিয়ে তাকালো প্রার্থর দিকে। প্রার্থ শান্ত চোখে রিজভীর দিকে তাকিয়ে আছে। ওই চোখ দেখেই ওর ভয় হলো। আতঙ্ক ভরা চোখমুখে বলল,
“তোর কি ওই মেয়েটাকেই পছন্দ হয়েছে? আর কাউকে পেলি না ভাই?”
ছেলেটা প্রফুল্ল চিত্তে বলল,
“আরেকজনও আছে তো। ওইযে ওই মেয়েটার পাশেই পিংক কালারের শাড়ী পড়া যে মেয়েটা আছে ওটা। ওটা আমাদের মন্টু ভাইয়ের পছন্দ হয়েছে। ওইটার বায়ো ডেটাও চাই। ”
হৃদয় এবার বিস্ফোরিত চোখে তাকালো অর্নবের দিকে। অর্নব কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে ছেলেটার দিকে৷ হৃদয় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“আর কাউকে পেলি না শালা। আমার নিষ্পাপ বন্ধুর বউদের দিকেই নজর দিতে হলো?”
ছেলেটা বুঝলো না ঠিক। ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো। হৃদয় ওকে পাত্তা না দিয়ে প্রার্থ আর অর্নবকে বোঝাতে যায়। প্রার্থ হাত উচিয়ে থামিয়ে দেয় ওকে। উঠে দাঁড়ায় সোজা হয়ে। ছেলেটার সামনে এসে শীতল কন্ঠে বলল,
“শি ইজ মাইন। ডো’ন্ট ইয়্যু ডেয়ার লুক এ্যাট হার এগেইন। আমার জিনিসে কারো ছায়া পড়াও আমার পছন্দ না। আর ও তো আমার মহা মূল্যবান জিনিস, আমার হার্টবিট৷ যেটা ছাড়া বাঁচা যায় না। বুঝলি তো কোথায় চোখ দিয়েছিস? বন্ধুর বিয়ে বলে বেঁচে গেলি। বাট নেক্সট টাইম মেক সিউর ইয়্যুর আইস নোউ দেয়ার লিমিটস। দ্বিতীয় বার ভুলেও যেন ওইদিকে চোখটা না যায়। গট ইট?
ঠান্ডা গলার ঠান্ডা হুমকি দিয়ে সে চলে গেলো সেখান থেকে। ওদিকে রিজভীর মুখটা দেখার মতো হয়ে আছে। ছেলেটা বুঝতে পারেনি কোনো বউ পাগলা জামাইয়ের সামনে সে তারই বউকে চেয়ে বসেছে। গলাটা শুকিয়ে এসেছে তার ওই ঠান্ডা স্বরে। আতঙ্কিত চোখে শুধু তাকিয়েই আছে প্রার্থর যাওয়ার দিকে।
এদিকে এক তুফান যেতেই অন্য তুফান হাজির। অর্নব ওর সামনে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
” আর তোর ওই মন্টু ফন্টু কেও বলে দিস। আমার বউয়ের দিকে আর একবার তাকালে ওর চোখ আমি উপ্রে ফেলবো। সাদাসিধা বউ আমার। অনেক সময় পর বউকে নিজের করেছি। ওখানে অন্য কারো চোখও আমার সহ্য হবে না। তাই বলে দিস যেন আমার বউয়ের থেকে একশো হাত দূরে থাকে। নয়তো…. হোপ ইয়্যু আন্ডারস্ট্যান্ড! ”
নিজের কড়া বাক্যগুলো ছেড়ে সেও চলে গেলো সেখান থেকে। রিজভী কি বলবে বুঝতে পারছে না। সামান্য পছন্দ হয়েছে বলায় ছেলেগুলো এতগুলো ঠান্ডা হুমকি দিয়ে গেলো?
ওদিকে প্রার্থ পুষ্পদের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। স্নেহাকে শুধু বলল,
“অর্নব তোমাকে ডাকছে স্নেহা। যাও। ”
স্নেহা ভদ্র মেয়ের মতো “আচ্ছা ভাইয়া” বলে চলে গেলো। প্রার্থ পুষ্পর হাত ধরে উঠিয়ে টানতে টানতে নিয়ে গেলো বাইরের দিকে। পুষ্পকে কিছু বলার সুযোগও দিলো না। ওরা গিয়ে থামলো গেটের দিকে। যেখানে মানুষজন আপাতত কম। প্রার্থ রাগে ফুঁসছে যেন। পুষ্প চিন্তামাখা গলায় প্রশ্ন করল,
“কি হয়েছে? এমন করছেন কেন? এখানে কেন এলাম?”
প্রার্থ গম্ভীর গলায় বলল,
“ভেতরে যাবি না। ”
“কেন? কি হয়েছে ভেতরে?”
“আগুন লেগেছে।”
পুষ্প ভয় পেলো। ভাবলো সত্যিই বুঝি কোথাও আগুন লেগেছে। বিচলিত হয়ে বলল,
“কোথায় লেগেছে আগুন? ওরা সবাই ভেতরে তো। কিছু করুন৷ কোথায় আগুন? ”
“আগুন ওখানে না এখানে। আমার ভেতরে লেগেছে আগুন।”
বুকের কাছটা দেখিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল কথাটুকু৷ পুষ্প ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। প্রার্থ আবার বলল,
“ভেতরে কত ছেলে জানিস? তোর দিকে নজর তাদের। হাউ কুড? আমি থাকতে অন্য কোন ছেলে তোর দিকে নজর দেয়। হাউ ডেয়ার হি? ওর চোখটা খুলে ফুটবল খেলতে পারলে ভালো লাগতো। শালা আমার বউয়ের দিকে নজর দেয়। ওর….
পুষ্প তখন হো হো করে হেঁসে ফেলল। প্রানখোলা হাসি। দেখতে এক টুকরো শুভ্র মেঘের মতোই ঝলমলে লাগছে। যা দেখে চোখ ঝলসে যায় প্রার্থর। কথা বন্ধ হয়ে যায় আপনাআপনি। পুষ্প হাসতে হাসতে ওর গায়ে ঢলে পড়লো। এত হাসি দেখে প্রার্থ এবার চোখমুখ কুঁচকে মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,
” তোর হাসি পাচ্ছে?”
পুষ্প হাসি থামালো৷ ঠিকঠাক হয়ে এগিয়ে গেলো। প্রার্থর বুকের উপর দুহাত রেখে হসি চেপে বলল,
“তোমার জ্বলছে মিস্টার হাসব্যন্ড?”
এইতো এই সম্বোধনটা। এটা প্রার্থর রাগ হাওয়া করে দেয়। কিন্তু এ ডাকের দেখা সহজে মেলে না। পূর্ণিমার চাঁদের মতোন এই ডাক। মেয়েটা ইচ্ছে করে এমন এমন সময় ‘তুমি’ বলে ডাকে যখন প্রার্থ খুব রেগে থাকে। আর তারপরই প্রার্থর রাগ হাওয়া হয়ে যায়।
কিন্তু এবার আর সে দমলো না। এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“তো জ্বলবে না? আমার বউয়ের দিকে নজর দেয়। কতবড় সাহস!”
“শান্ত হন মিস্টার। আপনার বউ তো আপনাকে ছাড়া কাউকে দেখছে না। ওদিকে আপনার দেখার দরকার নেই।”
“দরকার আছে ম্যাডাম। আমার বউকে আমি দেখবো। শুধু আমি। অন্যকেউ কেন তাকে ভালো লাগার নজরে দেখবে?”
“আপনি টিনেজারদের মতো বিহেভ করছেন। ”
“কারণ আমার বয়স ষোলো।”
এমন আজব কথায় পুষ্প আরেকদফা হাসলো। সে হাসিতে আবারও প্রার্থর রাগ মাটির সাথে মিশে গেলো। মোহনীয় স্বরে আওড়ালো,
“এভাবে হসিস না ফুল। বুকে ব্যথা করে। ”
পুষ্প হাসি থামিয়ে সরু চোখে তাকিয়ে বলে,
“এখনো ব্যথা করে?
“তুই যতদিন হসবি ততদিনই করবে।”
“তাহলে হাসি বন্ধ করে দেই? শুধু শুধু আপনার বুকে ব্যথা দিতে পারি?”
প্রার্থ বুঝতেই পারছে ওকে জ্বালানোর জন্য পুষ্প এমন করছে। ও হুট করে দুহাত বাড়িয়ে পুষ্পর কোমড় জরিয়ে ধরে কাছে টেনে আনল। বলল,
“আমাকে জ্বালাতে খুব মজা লাগে, না?”
পুষ্প নিজেকে ছাড়ানের চেষ্টা করে বলল,
“কি করছেন। মানুষ এখানে। কি বলবে। ”
প্রার্থ ওকে ছেড়ে হাত ধরে টানতে টানতে আবার হাঁটা ধরলো। পুষ্প জিজ্ঞেস করল,
“আবার কোথায় যাচ্ছেন?”
“মুড চেঞ্জ। এখন রোমান্স করবো। তাই ছাঁদে যাচ্ছি।”
ছেলেটার যখন তখন রোমানৃসের প্যারা উঠে। দিনের ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১৪ ঘন্টাই মানুষ রোমান্সের মুড নিয়ে কি করে থাকে পুষ্প বুঝে পায় না। তবে সে এনজয় করে। কারণ ওই সময়টা তারই থাকে। তাদের থাকে। একান্ত কিছু সময়। একটু সুখের, একটু আনন্দের। একটু ভালোবাসাদের।”
ওদিকে স্নেহা যখন অর্নবের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ডাকছিলেন?”
তখন ছেলেটা কিছু না বলেই ওকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো হলের পেছনের দিকে। ওখানে মানুষ নেই বললেই চলে। শুনশান জায়গাটায় এসে দাঁড়ালো দুজন। স্নেহা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে অর্নব নিজে প্রশ্ন ছুড়লো,
“বিয়ের আগেও ছেলেরা এভাবে তোমার দিকে নজর দিতো?”
আগামাথা হীন কথাটার মর্ম তেমন বুঝলো না সে। কনফিউশান নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“বুঝলাম না। কি বলতে চাইছেন?
” বললাম আমাদের বিয়ের আগেও ছেলেরা তোমার পিছু পড়ে থাকতে? ডিস্টার্ব করতো?”
স্নেহা বুঝতে পারছে না হঠাৎ এমন কথা কেন উঠছে? অর্নব তো এমন কথা কখনো বলে না। হঠাৎ কি হলো। স্নেহা ওই প্রশ্নে না গিয়ে খানিক মিইয়ে গিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, একটু আধটু ডিস্টার্ব তো ছেলেরা মেয়ে দেখলে করেই।
” তোমাকে এত সুন্দর হতে কে বলেছে?”
“আপনি এমন করে বলছেন কেন? কি হয়েছে?”
“তোমাকে দেখে অন্যের বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে। আমার বউয়ের দিকে নজর দেয়। ওর চোখটা তুলে ফেলা উচিত ছিলো। সামনে পেলে একটা চড় অন্তত মারবোই।”
স্নেহা অবাক হয়ে শুুধু তাকিয়ে রইলো। ওদের সম্পর্কটা আগের থেকে অনেক স্বাভাবিক। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যেমন সম্পর্কটা থাকা প্রয়োজন ঠিক তেমনই চলছে তাদের সম্পর্ক। কিন্তু মাঝে মাঝে ইতস্ততা তাদের একটু কাবু করে রাখে। অর্নব কখনো এমন জেলাসি টাইপ আচরণ করে না। আজই প্রথম হলো। তাইতো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“অর্নব, আপনি কি জেলাস?”
অর্নব মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে বলল,
“হয়তো।”
“হয়তো মানে? সিউর না?”
“আমার ভালো লাগে না তোমার দিকে কেউ অন্য চোখে তাকালে। এটাকে এখন কি বলবো?”
“অর্নব, আপনি অনুভূতিদের ক্ষেত্রে বড্ড কাঁচা। বুঝতে অনেক সময় নেন।”
“এখন তুমি বুঝিয়ে দাও।”
“আমি বোঝাবো?”
অর্নব একটু এগিয়ে এলো। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে মেঘমন্দ্র স্বরে বলল,
“হ্যাঁ বোঝাবে। আমার মন তো আমার আগে তুমি পড়ে ফেলো তাহলে এই অনুভূতিটাও তুমিই ব্যক্ত করে দাও। ”
স্নেহা একটা শ্বাস ফেলে বলল,
“নিজের ভেতরের আবেগ, অনুভূতি নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়। নিজে থেকে বুঝে নিতে হয়। আমি কি আপনার অনুভূতি বুঝতে বা আপনাকে বোঝাতে পারব? এইযে দেখুন না, আপনি যখন স্টেজে পারফর্ম করেন তখন কত মেয়েরা আপনাকে দেখে ক্রাশ খায়। আমার তখন কি করতে ইচ্ছে করে জানেন?”
“কি?”
“ইচ্ছে করে ওই মেয়েগুলোর গালে ঠাস ঠাস দুটো মেরে বলে আসি,-অর্নব হাসান আমার। তার দিকে বদ নজর দিলে তোর নজর খুলে নিবো। ফালতু মেয়ে! তার পর ইচ্ছে করে আপনার সুন্দর মুখটা ঢেকে রাখি। যাতে ফাজিল মেয়েগুলো আপনাকে আর দেখতেই না পারে। ”
“আর কি কি করতে ইচ্ছে করে?”
“আর…….!
হঠাৎ মেয়েটার কথা থেমে যায়। দুহাতে মুখ চেপে ধরে। বড়বড় চোখে তাকায় হাস্যরত অর্নবের দিকে। অর্নব হাসছে। বাচ্চা বাচ্চা কথাগুলো তার কাছে দারুণ লাগে। মেয়েটা যে মুখ ফসকে এতগুলো কথা বলে ফেলেছে তা অর্নব জানে। এখন হুসে এসেছে এখন আর একটা কথাও বলবে না তাও জানে। তবুও সে বলল,
” কি মিসেস স্নেহা অর্নব হাসান, তারপরে কি? বললেন না যে।”
স্নেহার এই একটা রোগ। কথা বলতে গেলে সে কি বলতে কি বলে ফেলে নিজেও জানে না। যেসব কথা বলা বারণ, নিজের মনেই শুধু রাখা দরকার–সেসব কথাই যেন তার ভেতরে থাকে না। হুটহাট এটা ওটা বলতে গেলে নিষিদ্ধ কথাগুলোও বলে ফেলে। এখনো তাই হলো। মনের সব কথা উগলে দিলো। এবার লজ্জায় পারছে না মাটির সাথে মিশে যাবে। ও উত্তর না দিয়ে ছুটে যেতে চাইলো। অর্নব এক থাবায় ওর কব্জি টেনে নিজের বুকের উপর ফেলল। দু হাতে আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে ধরে বলল,
“এত লজ্জা কেন আপনার, শুনি? কথাগুলো যখন বলেই ফেলেছেন তাহলে শেষ করেন। আমি মন দিয়ে শুনবো, প্রমিস। আমার বউয়ের জেলাসিটাও তো মাপতে হবে। দেখা যাক কার জেলাসি লেভেল কত বেশি।”
স্নেহা অর্নবের বুকের মাঝেই চোখ মুখ খিঁচে বলল,
“আমার লজ্জা লাগছে ছাড়ুন।”
এটুকু বলতে গিয়েও কন্ঠ কেঁপে উঠল স্নেহার। অর্নব শব্দ করে হাসল। ওকে আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“তুমি এত মিষ্টি কেন স্নেহময়ী? আমাকে তুমি এভাবে কাবু করে নিলে? তুমি বড্ড অন্যায় করে ফেলেছো, মেয়ে। এবার শাস্তি সরূপ আমাকে তোমার সারাজীবন সহ্য করতে হবে। ”
স্নেহা শান্ত হলো। মনে কেমন প্রশান্তির শীতল স্রোত বয়ে গেল। ছটফট না করে হাতদুটো বাড়িয়ে অর্নবের পিঠে রাখলো। মায়া ভরা কন্ঠে বলল,
“শাস্তি যদি সয়ং আপনি হন তবে সে শাস্তি আমার সারাজীবনের জন্য চাই। প্রাপ্তির খাতায় আপনি নাহয় সুখ জরানো শাস্তি হয়েই রয়ে গেলেন।”
নানারকম ফুল দিয়ে সাজানো কক্ষে লাল টুকটুকে বউ হয়ে বসে আছে মোহ। হৃদয় নামক এক বখাটে, মেয়েবাজ, বিগড়ে যাওয়া ছেলের বউ। যার মাঝে এক অসভ্য ছেলেকে বদলে সভ্য করার অদম্য গুন আছে।
আজ থেকে সে তার অর্ধাঙ্গিনী।
হৃদয় সে ঘরটাতে এলো কিছু সময় পর। তার তর সইছে না বউয়ের কাছে আসার জন্য অথচ মানুষের হট্টোগোল, আনন্দ পেরিয়ে সে ঘরে ঢুকতেই পারছিলো না। বহু কষ্টে টাকা পয়সা দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো। নিজেরই বউয়ের কাছে আসতে কিনা তাকে টাকা দিতে হলো। তবুও বউয়ের কাছে আসার জন্য আর দেরি করলো না। টাকা দিয়েই চলে আসল ভেতরে।
ধীর পায়ে এগিয়ে এলো সে। খাটের উপর বসে আস্তে করে মোহর ঘোমটা তুলল। মোহর স্নিগ্ধ মহোনীয় মুখটা দেখেই সে বুকের বাঁ-পাশে হাত রাখলো। চোখ বন্ধ করে ধপাস করে শুয়ে পরল বিছানায়। মোহ হাসলো তার পাগলামোতে।
হৃদয় আবার উঠে বসে। মেয়েটা এখন তার বউ ভাবতেই শরীরের শিরা-উপশিরায় শীতল স্রোত বয়ে যায়। সে এগিয়ে মোহর কপালে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে দেয়। এরপর ফোলা গালদুটোতেও ঠোঁট ছোঁয়ায়। মোহনীয় স্বরে বলে,
“তুমি এত সুন্দর কেন জান?”
মোহ হেসে বলল,
“তোমার চোখ সুন্দর তাই।”
“এতকাল তো আমার চোখ সুন্দর ছিলো না। তুমি আসার পরই কেন হলো? তারমানে তুমিই সুন্দর। লাগামহীন সুন্দর।”
“তোমার চোখে আমি তোমার প্রেম। তাই আমি সুন্দর।”
“শুধু কি প্রেম? তুমি তো আমার ভালোবাসা জান। তোমার ওই মোহনীয় রুপ আমাকে বরাবর ঘায়েল করে। তুমি মনের ভেতরটা বড্ড বাজেভাবে দখল করে রেখেছো। একটু জড়িয়ে ধরবো জান। অনুমতি দাও।”
মোহ দুষ্টুমি করে বলল,
“যদি অনুমতি না দেই তো কি করবে?”
“ঝাপিয়ে পরব।”
“সাহস আছে?”
“দেখবে?”
দেখবে বলে আর সময় নিলো না। সত্যি সত্যি ঝাপিয়ে পড়লো নব বধূর উপর।
আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৪৬
শুরু হলো আরো দুটি মানুষের একসাথে পথচলার গল্প। দুটি মন একত্রে মিলনের গল্প। প্লে-বয় খ্যাত হৃদয়দের জীবনেও এমন মোহদের আগমন ঘটুক। তাদের জীবনেও এমন ভালোবাসা আসুক যেমন ভালোবাসায় তারা নিজেদের জীবনের নতুন সূচনার সূত্রপাত ঘটাতে পারবে। প্রমান হোক কেনো নারীতে আসক্ত না হওয়া প্রেমিকটাও এক নারীতে আসক্ত হয়ে এক জীবন কাটিয়ে দিতে পারে।
হৃদয়ের নতুন পথচলা সুন্দর হোক। মোহ তার পূর্ণতার পরিপূরক হোক।