আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ২৭

আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ২৭
নূরজাহান আক্তার আলো

-‘ভাইয়াকে বলুন, আমাকে দেশে রেখে আসতে। এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমাকে এখানে থেকে না নিয়ে গেলে আমি সত্যিই মারা যাব।’
রিদওয়ান নিশ্চুপ। এই নিয়ে কিছুটা ভয়েও ছিল সে। কুহু তো একেবারে অবুজ না যে বুঝবে না। আর ডেইজির কথা সে চিকিৎসা আরম্ভ করেছে ভুলেও যেন সেটা থামানো না হয়। এতে রোগটা বাড়বে বৈ কমবে না।
আর যেভাবেই হোক কুহুকে মেডিসেন খাওয়াতে হবে। যেভাবেই হোক।
এদিকে কুহু যা জেদ কিভাবে কি করবে? বেচারা রুপককেও কিছু বলা যাচ্ছে না। এমন এক ঝামেলায় আছে না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সহ্য করতে। রিদওয়ান কিছু ভাবল তারপর বলল,

-‘কুহু!’
-‘বলুন শুনছি।’
-‘আমার কথাগুলো মন দিয়ে আগে শুনে তারপর জবাব দাও।’
-‘হুম।’
–‘কি করলে বুঝবে আমরা তোমাকে অসুস্থ বানাতে চাচ্ছি না। বরং সুস্থ করতে চাচ্ছি।’
-‘আবার! আবারও ওই একই কথা বলছেন আপনি?’
-‘তারমানে আপনারা ধরেই নিয়েছেন আমি অসুস্থ। আর অসুস্থ বলেই সুস্থ করার কথা আসছে। আর কতবার বলব আমি অসুস্থ নয়। অসুস্থ নই। ‘

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘ঠিক আছে! ঠিক আছে! মেনে নিলাম আমি। শান্ত হও। থামো প্লিজ।’
-‘আপনারা সবাই আমাকে অসুস্থ বানিয়ে দিচ্ছেন। কেন এমন করছেন? কি করেছি আমি? আগে ভাবতাম, আমার ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু না, সেও আমাকে একটুও ভালোবাসে না। সে আমাকে ভুল বুঝিয়ে এখানে এনেছে। আর জীবনেও আর ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলব না। আমি দেশে যাব।’
-‘ঠিক আছে যেও। আমি তোমাকে নিয়ে যাব,কেমন? তবে আমি তোমাকে সময় দিলাম তুমি ভেবেচিন্তে জবাব দিও।

-‘কি জানতে চান আপনি? কি পরে জানাব আপনাকে?’
-কি করলে বুঝবে, আমরা তোমাকে অসুস্থ বানাতে চাচ্ছি না। বরং সুস্থ করতে চাচ্ছি।’
-‘যদি আপনি প্রমাণ করতে বলি করবেন?’
-‘করব।’
-‘ভেবে বলছেন?’
-‘বলছি।’
একথা শুনে কুহু কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল,
-‘ধরে নিলাম আমি অসুস্থ। এই অসুস্থ মেয়েটাকে বিয়ে করতে পারবেন?

রিদওয়ান হতবাক। তার হতবাক করা মুখ দেখে কুহু হাসল। মুখে সবাই বড় বড় বুলি আওড়াতে পারে রিদওয়ানের মতো। কিন্তু কেউ জীবনসঙ্গী বানাতে পারে না৷ পারবেও না। এরা আসলে তাকে পুতুলের মতো ইচ্ছে মোতাবেক নাচাচ্ছে। কারো কাছেই তার দাম নেই। চাওয়া পাওয়ার মূল্য নেই। ভাইয়ের কাছেই নেই। সেখানে ভাইয়ের বন্ধু আর কি মূল্য দেবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে রিদওয়ান বলল,

-‘বিয়ের সাথে চিকিৎসা সম্পর্ক কি?’
-‘আমার ভাইয়ের ভালোবাসার নমুনা দেখে নিলাম। এবার আপনারটাও দেখান।’
-‘তুমি..!’
-‘আপনি এখন যান। ভুলেও আর আমার চোখের সামনে আসবেন না।’
-‘আমি রাজি।’
-‘কি রাজি!’
-‘তোমাকে বিয়ে করতে।’

-‘হা হা হা! আবারও মন ভোলানো কথা! কি ভেবেছেন, বারবার আমাকে বোকা বানাবেন। ঘোল খাওয়াবেন। ভুলে যাওয়া রোগ আছে দেখে ধরেই নিয়েছেন একটুপরেি সব ভুলে যাব। তাই মন ভোলানোর কথা বলছেন।
এত কষ্ট করতে হবে না রিদওয়ান রিদ আপনি যান। আর আপনার প্রিয় বন্ধুকে গিয়ে বলেন দ্রুত টিকিট কনফার্ম করে তারপর এখানে আসতে। আমি এখান থেকে সোজা দেশে ফিরব।’

রিদওয়ার আর একটাও কথা বলল নাম চুপ করে উঠে চলে গেল। সেটা দেখে কুহু হাসল। এরা তাকে ধরে বেঁধে অসুস্থ বানিয়ে দিচ্ছে। এভাবেই মজা নিচ্ছে। বন্ধুর বোন পাগল হলে তার কি? নিজের বোন সুস্থ, সবল।
তাদের তো আর কোনো সমস্যা নেই। তারা তো ঠিক। যত সমস্যা তার।
এজন্য রিদওয়ানকে পরীক্ষা করার জন্য সে এমন একটা প্রস্তাব দিলো।
মন পরীক্ষা করতে গিয়ে প্রমাণ পেল সবাই তার ভালো চায়। আপন ভাই
বেড়ানোর নাম করে ভুলিয়ে ভালিয়ে এখানে নিয়ে এলো। চালাকি করে ডাক্তার দেখাল। অসুস্থ বানালো। ভাইয়ের বন্ধু মজা নিতে ভালো সাজার অভিনয় জুড়ে দিলো। বাহ্! এই না হলো জীবন। তবে এই জীবন রাখার চেয়ে না রাখা উত্তম নয় কি! যে জীবনে অন্য কারো দখলদারি বেশি সে জীবন রেখে কি লাভ?এসব নানান কথায় মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।

তবে সে সিদ্ধান্ত নিলো আগে দেশে ফিরবে। মাথার কোলে মাথা রাখবে। মায়ের শরীরের ঘ্রাণ প্রাণভরে নিয়ে তারপর সুইসাইড করবে। এছাড়া আর উপায় নেই। এমন জীবন সে চায় না। তখন রুপক এলো। বোনের মাথায় হাত রেখে জোরপূর্বক হাসল। তারপর ফোন এগিয়ে দিয়ে ভেজা কন্ঠে বলল,

-‘আম্মুর সঙ্গে কথা বল।’
ভাইয়ের উপর অভিমান করে কুহু অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে ছিল।
আম্মুর কথা শুনে ফোনটা হাতে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দেশে ফেরার কথা জানাল। ইসমত আরা কাঁদতে কাঁদতে নিজের অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে। গলা বসে গেছে। উনি ফ্যাসফেঁসে গলায় কাঁদতে নিষেধ করে নিজেও কাঁদছেন। কুহু তার ভাইয়ের নামে অভিযোগ করল। তাকে কেন এনেছে, এনে ডাক্তার দেখানোর কথাও বলল। ইসমত আরা শুনলেন।
কুহু কথা শেষ করে কাঁদছে। ইসমত আরা তখন বললেন,

-‘রিদওয়ান তোমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে।তুমি কি রাজি?’
-‘কিহ্!’
-‘সে নিজে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। সে নাকি আজই তোমাকে বিয়ে করবে। রিদওয়ান ছেলে হিসেবে সব দিক দিয়ে পার্ফেক্ট। আমার কিংবা তোমার বাবার কোনো দ্বিমত নেই। তাকে আমরা মেয়ে জামাই হিসেবে মেনে নিতে রাজি। এখন সব নির্ভর করছে তোমার উপর। এখন বলো তুমি কি চাও?’
একথা শুনে কুহু মনে মনে ফুঁসতে লাগল। হিরো সাজা হচ্ছে, হিরো। ঠিক আছে সেও দেখবে তার হিরোগিরি। তাই সেও এবার সরাসরিই জবাব দিলো,

-‘ ঠিক আছে, আমিও রাজি।’
-‘সত্যি তো! পরে মত বদলাবে না? ভুল বুঝবে না রিদওয়ানকে? অথবা কোনোরকম দোষারোপ করবে না তো?’
-‘না।’
-‘তাহলে বিয়ের ব্যবস্থা করতে বলি?’
-‘বলো। তবে বিয়ের আগে আপনি উনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’
-‘ঠিক আছে।’

রুপক নির্বাক। তার কিছু বলার নেই। না বন্ধুকে আর না বোনকে। এরা নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল। অতঃপর কুহুকে তিন দিন হসপিটালে থাকতে হলো। চারদিনের দিন আতিকুর রহমান আর রুপক এসে তাকে বাসায় নিয়ে গেল। একয়েকদিনের মধ্যে রিদওয়ানের সঙ্গে তার দেখা সাক্ষাৎ কোনোটাই হয় নি। তবে বাসায় আসার পর জানতে পারল আজ দুপুরে তাদের বিয়ে। বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। দুপুরের দিকে রিদওয়ান তার রুমের দরজার নক করল। কুহু পারমিশন দিলে সে ভেতরে প্রবেশ করল। রিদওয়ানের পরনে পাঞ্জাবি। সে কুহুর থেকে দুরত্ব রেখে বসল। তারপর ঠোঁটে হাসি এঁটে ভ্রুু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করল,

-‘প্রস্তুত?’
-‘হুম।’
-‘সিওর তো?’
-‘একদম।’
-‘তাহলে এখানে সাইন করে দাও।’
-‘কি এটা?’
-‘নিজে পড়ে দেখো।’
কুহু পেপার হাতে তুলে নিলো। রেজিস্ট্রি পেপারের মতোই দেখতে এটা।

সে নেড়েচেড়ে পুরোটা লেখাটা পড়ল। পড়ে বিষ্ময় নিয়েই রিদওয়ানের দিকে তাকাল। এখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা, কুহু আর রিদওয়ান বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর কেউ কখনো, কোনোদিন, বিচ্ছেদ চাইতে পারবে না। কোনো অবস্থাতেই না। সারাজীবন তাদের একসঙ্গে থাকতে হবে। এক ছাদের নিচে সংসার সাজাতে হবে।আসলে এটা করার কারণ হচ্ছে কুহুর ভুলে যাওয়া রোগ। বিয়ে তো আর দু’দিনের খেলা না।

আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ২৬

ভবিষ্যতের কথা ভেবেই সেটা এই পেপার তৈরি করেছে। যাতে কুহু কোনো সমস্যা সৃষ্টি করলে প্রমাণ হিসেবে এটা দেখতে পারবে। কুহু বুঝল। তারপর আর না ভেবে সাইন করে দিলো। এরপর দুই পরিবারকে সাক্ষী রেখে তাদের বিয়ে সম্পূর্ণ হলো। ভাবনা নয়, স্বপ্ন নয়, তারা সত্যি সত্যিই বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হলো। শুরু হলো নতুনভাবে তাদের পথ চলা।

আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ২৮