আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ২৯

আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ২৯
নূরজাহান আক্তার আলো

-‘ আমি বলামাত্রই বিয়েতে রাজি হলে কেন? কিসের জন্য রাজি হলেন?’
একথা শুনে রিদওয়ান মৃদু হাসল। সে যেন আগে থেকেই জানত এমন কিছু জিজ্ঞাসা করা হবে। কুহু জবাবের আশায় তাকিয়ে আছে তার মুখ পানে। তারপর কিয়ৎকাল চুপ থেকে রিদওয়ান অকপটে জবাব দিলো,

-‘ধরে নাও, তোমার তৈরি করা ভাবনাটাই সঠিক। ভালোবাসি তোমায়।’
-‘বলতে হবে তাই বললেন বুঝি?’
-‘এমন মনে হলো কেন?’
-‘আপনারা সবাই আমাকে অসুস্থ বানাতে উঠে পড়ে লেগেছেন। মন হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়?
-‘না। স্বাভাবিক নয়।’
-‘তাহলে ভালো না বেসে বিয়ে করলেন কেন? করুণা করতে?’
-‘বলো। তবে লিমিটি রেখে। আমাকে খোঁচা মারতে গিয়ে নিজেকে এত ছোটো করিও না।’
-‘

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘পৃথিবীতে সবাই যদি ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করতে পারত তাহলে এরেঞ্জ ম্যারেজ বলে কোনো শব্দ’ই থাকত না। ধরে নাও, আমরাদের বিয়েটা এরেঞ্জ ম্যারেজ। বিয়ের আগে ভালোবাসি তো কি? বিয়ের পর বাসব। বউটা তো আমারই, তাই না?’
কুহু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর মেঝের দিকে দৃষ্টি ফেলে মলিন কন্ঠে বলল,
-‘ মনে মনে আফসোস হচ্ছে তাই না?’
-‘কার?’

-‘আপনার।’
-‘কেন আফসোস হবে?’
-‘আমাকে বিয়ে করে।’
-‘এখন অবধি হচ্ছে না। তবে তুমি যদি আমার কথা না শোনো তাহলে আফসোস না বরং ভীষণ কষ্ট পাব।’
-‘কি কথা শুনতে হবে? ‘

-‘বিয়ের পর প্রতিটা হাজবেন্ড-ওয়াইফের দায়িত্ব একে অপরের খেয়াল রাখা। ভালো রাখা। ভালোবাসা। কবুল বলার সময়ই আমি ভুলে গেছি, তুমি আমার স্টুডেন্ট ছিলে, বন্ধুর বোন ছিলে, পূর্বের সব সম্পর্ক বাদ। আজ থেকে তোমার একটাই পরিচয় তুমি আমার বউ। বিয়ের করা বউ। আর বউয়ের জন্য যখন যেটা ভালো হবে আমি সেটাই করব৷ শুরুতেই বলেছি,প্রতিটা হাজবেন্ড-ওয়াইফের দায়িত্ব একে অপরের খেয়াল রাখা। ভালো রাখা। ভালোবাসা। সেই যুক্তি থেকে তুমি শুধু রেগুলার মেডিসিন

নিবা। ডেইজি যা বলবে শুনবা। তাহলেই আমি ভালো থাকব। বউ রুপে
তুমিও আমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব পালনে সাকসেস হবা। আর কোন রোগের মেডিসিন খাচ্ছো। কেন খাবা, হ্যান, ত্যান, কোনোকিছুই ভাবতে হবে না তোমার।শুধু মনেপ্রাণে এইটুকু বিশ্বাস রাখবা আমি বেঁচে থাকতে জেনে শুনে কখনো কোনো ক্ষতি হতে দেবো না তোমার, প্রমিস!’

-‘কি রোগ? কেন মেডিসিন খাচ্ছি তাও জানতে চাইব না?’
-‘না, চাইবে না।’
-‘নিষিদ্ধ জিনিস আকৃষ্ট করে বেশি।’
-‘করুক।’
-‘মন মানবে না।’
-‘জানাটা কি খুব দরকার?’
-‘হুম, দরকার।’

-‘তাহলে আজ থেকে জেনে নাও তোমার অসুখের নাম রিদওয়ান রিদ।’
শেষ নিঃশ্বাস চলাকালীন এই অসুখ থেকে তোমার নিস্তার নেই।’
-‘পেতেও চাই না।’
-‘তাহলে কি করতে হবে?’
-‘ভালো বউ হতে হবে।’
-‘ভালো বউ হতে গেলে কি করতে হবে?’
-‘ভালো রাখতে হবে।’
-‘ভালো রাখতে হলে কি করতে হবে?’
-‘হাজবেন্ডের মনমতো চলতে হবে।’
-‘হাজবেন্ডের মনমতো চলতে গেলে কি করতে হবে?’
-‘মেডিসিন নিতে হবে।’

-‘নিবা?’
-‘নেবো।’
-‘পরে পাল্টি খেলে কি করব?’
-‘ যা শাস্তি দেবেন মাথা পেতে নেবো।’
-‘ওকে।’
রিদওয়ান মুখভর্তি হাসল। এরপর ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে গেল। এসে দেখে কুহু জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি খোলা জানালায়। ওই দূর আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। অপরুপ তার সৌন্দর্য! অপার্থিব
সেই আলোয় রিদওয়ান তাকিয়ে আছে মায়াভরা, স্নিগ্ধধরা একটা পুতুল মুখের মেয়ের দিকে।সে ডাগর ডাগর নেত্রে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ মেয়েটার চোখ দিয়ে একফোঁটা অশ্রুবিন্দু। কুহু নীরবে কাঁদছে। সে এগিয়ে গিয়ে কুহুর পেছনে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর ডাকল,

-‘কু..হু।’
-‘আমার জীবনটা দিন দিন কেমন জানি হয়ে যাচ্ছি। আমি আজকাল বুঝতে পারি, আমি হঠাৎ হঠাৎ অনেককিছু ভুলে যাই। চোখের সামনে সেসব ঘটে কিছুক্ষণ তা মনে থাকে। একটুপরে কি ঘটল তা ভুলে যাই। তখন শতচেষ্টা করেও মনে রাখতে পারি না। ভাবি। প্রচুর ভাবি। ভাবতে ভাবতে আমি ক্লান্ত হয়ে যায় অথচ আমার ভাবনা শেষ হয় না। কি সব হচ্ছে আমার সাথে! কেন হচ্ছে! এখন আমার ভয় হচ্ছে। খুব ভয়। এই বিয়েটা না করাই উচিত ছিল।’
এইটুকু বলতে বলতে কুহুর কান্নার বেগ বাড়ল। ঝরঝর করে তার গাল বেয়ে গড়িয়ে গেল অশ্রুঁফোটা। সে ফুঁপিয়ে উঠল। তার ফুঁপানোর শব্দে
রিদওয়ান তাকে সামনে ঘুরাল। দুহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে কুহুর চোখ মুছে দিলো। ক্ষনিকেই গাল ভিজে একাকার। সে যতবার মুছে ততবারই কহুর অবাধ্য চোখের জল বেহায়ার হয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে। রিদওয়ান আবারও মুছে দিলো। এরপর কুহুর চোখে চোখ জিজ্ঞাসা করল,

-‘কাঁদছো কেন?’
-‘এমনি।’
-‘এমনি কেউ কাঁদে না?’
-‘কাঁদে।’
-‘কে কাঁদে?’
-‘আমি কাঁদি।’
-‘ভালোবাসো আমাকে?’
-‘খু্ব।’
-‘আমি চলে আসাতে কষ্ট পেয়েছিলে?’
-‘পেয়েছিলাম।’
-‘রাগ হয়নি?’
-‘হয়েছে।’
-‘তখন আমাকে কি করছে মন চাচ্ছিল?’
-‘(………)’
-‘বলো?’
-‘(………)’
-‘ চুপ কেন?’
-‘কিছু করতে মন চাই নি।’

-‘ওহ। তবে আমি চলে আসার পর কেউ একজন আমাকে ম্যাসেজ করেছিল, ‘এভাবে কথা না বলে চলে গেলেন কেন রিদ ভাইয়া? আমি কিন্তু কষ্ট পাচ্ছি। ফিরে আসুন। আপনি আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছেন। তাই আপনার বুকে মাথা রেখেই কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আমি কাঁদব। আপনি আসুন।’ সেদিনের ইচ্ছেটা আজ পূরণ করতে পারো। আমি এবং আমার বুক দু’টোই সাক্ষরহীনভাবে তোমার নামে লিখে দিলাম।’

কুহু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। এই কাজ আবার কখন করল? সে কি করে, না করে, তার মনেও থাকে না। তবে লজ্জা পেল। লজ্জায় তার
গাল দুটো লাল হয়ে উঠল। ঘড়িতে তখন রাত দুটো। কথা বলতে বলতে এত রাত! রিদওয়ান কুহুকে ইশারায় ঘড়ির দিকে তাকাতে বলেই হেসে ফেলল। তারপর বিছানার ফুল সরিয়ে পাশে জায়গা রেখে শুয়ে পড়ল।
একবার মাথা উঁচিয়ে অসস্ত্বিতে বুদ হওয়া কুহুর দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘চেঞ্জ করবে?’
-‘হুম।’
-‘কেন, শাড়ি পরে ঘুমানোর অভ্যাস নেই?’
-‘না।’
-‘ওই রুম থেকে ড্রেস এনেছো? নাকি এনে দেবো?’
-‘আমি ওই রুমে যাই?’
-‘ চেঞ্জ করতে যেতে চাইলে যাও তবে ঘুমাবে এখানেই।’
-‘আজ.. ম..মানে বলছিলাম যে ..!’
-‘কি?’
-‘আজ মানে বলছিলাম যে..। ‘

-‘আজ মানে বলেছিলে যে’ এর মানে কি বুঝব? তোতলাচ্ছো কেন? যা বলার স্পষ্টভাবে বলো। ওয়েট, ওয়েট, ওই রুমে ঘুমাতে চাও? হবে না।
যেতে দেবো না। বউ ছাড়া অনেকগুলো রাত অতিবাহিত করেছি আর না। দ্রুত চেঞ্জ করে এসো।’
একথা শুনে কুহু এই বেহায়া পুরুষটার দিকে কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তারপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পাশে এসে শুয়ে পড়ল।
করবে না চেঞ্জ। ওকে শুয়ে পড়তে দেখে রিদওয়ান মিটিমিটি হাসল। সে বুঝলেও তাকাল না। একটুপরে রিদওয়ান বলল,

-‘ আজকে রাতের আঁধারের সঙ্গে তোমার সব দুঃচিন্তাকে বিসর্জন দাও।
নিজেকে মুক্ত পাখির ন্যায় স্বাধীন করো।ভয়, দুঃচিন্তা এবং অহেতুক সব ভাবনার লাগাম টানো। নতুন এক সকালে নতুনভাবে জীবনের আর্বিভাব ঘটাও। মানুষ পারে না এমন কিছু নেই।’
একথা কথা বলে সে আচমকা হেঁচকা টানে তাকে কাছে টেনে তার বুকে কুহুর মাথা চেপে ধরল। তারপর ফিসফিস করে বলল, ‘ চিন্তা ভাবনার জন্য আমি আছি। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও।’

আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ২৮

নিরাপদ ভরসাস্থল খুঁজে পেয়ে কুহু সত্যি সত্যিই চোখজোড়া বন্ধ করল।
মুখে হাসি ফুটল। এইটুকুই তার চাওয়া। মুখ ফুটে না বলতেই সে পেয়েও গেছে। অবাধ খুশিতে তার চোখের কার্ণিশ বেয়ে অঝরে গড়াতে লাগল নোনাজল। সেই জল গিয়ে টি-শার্ট ভেদ করে স্পর্শ করল রিদওয়ানের প্রশ্বস্ত বুক। তবুও কেউ কথা বলল না। নড়লো না। সরলো না। শুধু কুহু উন্মাদের মতো ব্যাকুল সুরে মনে মনে আওড়াতে লাগল, ‘আমি বাঁচতে চাই! সুস্থ জীবন চাই। আমাকে ভালোবাসুন। আগলে রাখুন। কখনো দূরে সরতে দিয়েন রিদ। কখনো না!’

আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ৩০