আমার তুমি সিজন ২ পর্ব ২৫

আমার তুমি সিজন ২ পর্ব ২৫
জান্নাত সুলতানা

“আমি দ্রুত ফিরে আাসার চেষ্টা করবো।
তুমি ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে নিও।”
ছোট একটা বার্তা। রিধির এতোক্ষণ মন খারাপ ছিল।সকালে ঘুম থেকে ওঠেই ওয়াজিদ এর একটা কল আসায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। দেশে আসার পর একটা হসপিটাল জয়েন করেছে ওয়াজিদ। যদিও সে একেবারেই চলে আসে নি।তবে যতদিন দেশে আছে ততদিনে সেটায় ডিউটি করবে।হসপিটালের মালিক ওয়াজিদ এর এক বন্ধুর বাবা আর সেই ওয়াজিদ কে সময় দেওয়ার জন্য আবদার করেছেন।
রিধি ওয়াজিদ কে ফিরতি কিছু একটা বার্তা পাঠিয়ে ফ্রেশ হতে ওয়াশ রুমের দিকে পা বাড়াল।

-“বাবা অসুস্থ।
দু’দিন থাকি?”
অনেক টা সাহস সঞ্চয় করে আবদার টা করে ফেললো প্রিয়তা।ওপাশে নিশ্চুপ সাদনান।প্রিয়তা চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষারত।অনুমতি কি দিবে মন্ত্রী সাহেব?
প্রিয়তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সাদনান গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-“তুমি এখন যাও।
এব্যাপারে আমি পরে কথা বলছি।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আহ্ কি রাশভারী কণ্ঠস্বর। এই কথার পিঠে কি বলবে প্রিয়তা? কোনো শব্দচয়ণ যে তার মস্তিষ্ক তৈরী করতে পারছে না। তাই তো নিঃশব্দে ফোন কেটে দিলো। সাদনান ফোনের ওপাশে কোনো সারা শব্দ না পেয়ে ফোন কান হতে সড়িয়ে সামনে আনলো।লাইন কেটে দিয়েছে প্রিয়তা।তপ্ত শ্বাস ছাড়ে সাদনান। আজ দু’দিন হয় শফিক সওদাগর একটু অসুস্থ।

মূলত বিয়ে বাড়ি থেকে যাওয়ার পর কিছু টা অসুস্থ বোধ করছিল।আয়না দেখতে গেলেও প্রিয়তা কে সাদনান যেতে দেয় নি।বলেছে সময় করে সে নিয়ে যাবে কিন্তু এখনো আজ দু’দিন পেরিয়ে গেলো সাদনান নিয়ে যেতে পারে নি। এরমধ্যে শফিক সওদাগর নিজের আদরের ছোট মেয়ে কে দেখার জন্য বারংবার বলে যাচ্ছে। প্রিয়তা নিজের বাবা-র জন্য মন খারাপ।আর আজ আম্বিয়া মির্জা নিজেও দেখতে যাবে।তাই সবাই একসাথে চলে যাবে।
এমনটাই সালেহা বেগম সাদনান কে ফোন করে জানিয়েছে।সাদনান সেসব ভাবনা সাইডে রেখে সামনে মিটিংয়ে মনোযোগ দিলো।

সকাল এগারোটা নাগাদ সওদাগর বাড়ি এসে পৌঁছাল মির্জা বাড়ির প্রায় অর্ধেক মানুষ।সব মহিলার এসেছেন। দুপুরে খাওয়া দাওয়া আর সারা দিন থেকে বিকেলে নাস্তা করে সবাই আবার চলে গেলো।সাথে করে আয়নাকে নিয়ে গেছে।প্রিয়তা বিকেল টা বাবা-র ঘরে বসে রইলো।আয়ান বোনের জন্য সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এলো।সাথে নিয়ে এলে বোনের পছন্দের হরেকরকমের বাহিরের খাবার।প্রিয়তা ভাইয়ের সঙ্গে আর বাবার গা ঘেঁষে বসে।
আজ অনেক দিন ধরে নিজে কে মুক্ত পাখি মনে হলো।সারা দিন কোনো খবরদার করে নি যে কেউ।বাবা-র শরীরের গন্ধ শুঁকে। ভাইয়ের ভালোবাসা আর যত্ন সব সময় আলাদা।

আয়ান বোন কে নিজের হাতে খাইয়ে দিলো।সাথে মাইশা কেও। রাতে আড্ডা দিয়ে খাবার প্রিয়তা শফিক সওদাগর এর রুমে বসে খেলো।রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ প্রিয়তা রুমে এলো।ফ্রেশ হয়ে ফোন টা হাতে নিলো।সারাদিন মানুষের ভীড়ে থাকলে কষ্ট একাকিত্ব ঘুচে যায়।কিন্তু রাত?রাত হলেই তো আবার সেই একাকিত্ব।বুকের কষ্ট যে সব উগড়ে বেরিয়ে আসতে চায়।দমবন্ধ লাগে। বুকের ভেতর তীব্র থেকে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব হয়।প্রিয়তা কথা গুলো ভাবতে ভাবতে ফোন টা হাতে নিয়ে ফোনের স্কিনে মন্ত্রী সাদনান শাহরিয়ার একটা সফেদা পাঞ্জাবি গায়ে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছবি জ্বলজ্বল করছে। প্রিয়তার চোখ হতে অশ্রু গড়িয়ে ঠিক সাদনান এর পিকচার টার উপর পড়লো। প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা ডান হাত টা তুলে সাদনানের ছবিটার উপর হতে জলের ফোঁটা টা মুছতে মুছতে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,

-“আপনি এতো টা কেনো পাষাণ প্রিয় পুরুষ?
আপনার সাথে থাকা যে দিনদিন বন্দী পাখির ন্যায় হয়ে যাচ্ছে।ভালোবাসার মানুষ টার সাথে থাকা মানে তো স্বাধীনতা।কিন্তু আপনি তো আমার সব স্বাধীনতা বেড়াজালে বন্দী করে দিয়েছেন।”
প্রিয়তার বকবক করার মাঝেই একটা নোটিফিকেশন এলো। প্রিয়তা হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে নোটিফিকেশন ওপেন করতেই নজরে এলো,

“আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।
আয়ান কে বলে দিচ্ছি। চলে এসো।”
প্রিয়তা চোখ বন্ধ নিলো।পরপরই দ্রুত হাতে কিছু একটা টাইপ করে সেন্ট করে দিয়ে নেট অফ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো।মিনিট পাঁচ মিনিট এর মধ্যে শরীরে ঠান্ডা হাতের শীতল স্পর্শ পেতে প্রিয়তা চমকাল।

চোখ বড় বড় করে শোয়া থেকে ওঠে বসতেই প্রথমে দরজার দিকে নজর দিলো।দরজা বন্ধ করে নি সে।কিন্তু দরজা এখন বন্ধ আছে। প্রিয়তা এবার সামনে তাকাল।ড্রিম লাইটের কমলা রঙের আবছা আলোয়ে শুভ্র পাঞ্জাবি পরিহিত বলিষ্ঠ পুরুষ সাদনান শাহরিয়ার কে দেখতে দানবের চেয়ে কম কিছু লাগছে না।প্রিয়তা আস্তে করে একবার ফাঁকা ঢোক গিলে পানি। পরপরই নিজের বাহুতে শক্ত হাতের খাবলা অনুভব করলো।সাদনান কিছু টা টেনে দাঁড় করালো বউকে।
চোয়াল শক্ত করে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,

-“একটু আগে কি বললে!আর যাবা না তুমি আমার সাথে?”
প্রিয়তা চোখ বন্ধ করে খিঁচে দাঁড়িয়ে রইলো। কোনো জবাব দিলো না। সাদনানের রাগ যেনো এবার তরতর করে বেড়ে গেলো।মেয়ে টার সাহস ইদানীং বেড়েছে।কি বলল ও?একটু আগে! সাদনান কথা টা ভেবেই আরো রাগ বাড়ে।দিকবিদিকশুন্য হয়ে পরে।ভুলে গেলো ভালোবাসার মানুষ টার কষ্টের কথা। এক হাতের প্রিয়তার মুখ চেপে ধরে। প্রিয়তা অবাক হয়।ব্যাথায় চোটে চোখের কোঠায় জল চিকচিক করে।কিছু বলার জন্য খোঁজে পেলো না।বিয়ের একবছর হতে চলে।কখনো এমন ব্যবহার করে নিয়ে সাদনান।তাই ব্যথার চেয়ে বিস্ময় টা বেশি।প্রিয়তার ভাবনার মাঝেই সাদনান হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,

-“এই,এই উত্তর কেনো দিচ্ছিস না তুই?
আরেকবার বল!কি যেনো বলছিলি!”
প্রিয়তার দুই হাত সাদনানের হাতের উপর রেখে সরানোর বিফল চেষ্টা করতে করতে কাঁপা কাঁপা অধর জোড়া নেড়ে বলল,

-“আমার লাগছে।”
সাদনানের কি হলো?হুঁশ কি এলো?নিজের কলিজায় আঘাত করে কি সে ব্যথা পায় নি?হয়তো পেয়েছে। তাই তড়িৎ গতিতে বউয়ের চোয়াল ছেড়ে দিলো।শক্ত করে বুকে চেপে ধরতেই প্রিয়তার গলা দিয়ে গোঙানোর শব্দ হলো।চোখের জল সাদনানের পাঞ্জাবি বেদ করে বুকে স্পর্শ করতেই সাদনান বউয়ের মাথায় তালুতে চুলের ভাঁজে নিজের অধর বারকয়েক ছোঁয়াল।মুখে কিছু বলল না।প্রিয়তা ছুটাছুটি করল। তবে বিশেষ কোনো লাভ হলো না।সাদনান শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই প্রিয়তা কান্না করতে করতে বলতে লাগলো,

-“আমার স্বাভাবিক জীবন চাই।বলেছিলাম আমি।আপনি আপনি জানতেন আমি কেমন।সেদিন এতো এতো মানুষের মধ্যে কতটা খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম আমি।চারদিকে মানুষ ক্যামেরা,প্রশ্ন। অস্বস্তি হয় এসব আমার। আপনার সাথে কোথাও যাওয়া যায় না।আমি একা যেতে পারি না। সব সময় সাথে মানুষ নিয়ে চলে ফেরা করতে হয়।অসহ্য লাগে আমার এসব।সাধারণ আমি।সাধারণ ভাবে থাকতে কমফোর্টেবল ফিল করি।এতো সবে আমার দমবন্ধ লাগে। আপনার এতো কড়াকড়ি নিয়ম আমার একদম ভালো লাগে না। এদিকে যাবা না,ওটা করবা না,এভাবে থাকবে না,এটা খাবা না,ওটা খাবা না,এটা ধরবে না,ওটা পড়বে না।বিরক্ত লাগে সব কিছু।”

সাদনান যেনো স্তব্ধ। এতো এতো অভিযোগ বউয়ের? সত্যি কি সে ভালোবাসার নাম করে ভালোবাসার মানুষ টার সব স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছে নিজের অজান্তেই!
কতটা বয়স?তারউপর থেকেছে তো সব সময় বাবা আর ভাইয়ের ছায়াতলে। এসবের ছোঁয়া যে কোনো ভাবে ছুঁয়ে যায় নি মেয়ে টাকে।
-“আ’ম সো্ সরি জান।”
কি মধুর কণ্ঠ। কি করে রেগে থাকবো প্রিয়তা?মানুষ টাকে না চাইতেও নিজের থেকে বেশি ভালোবেসে ফেলেছে।

রাত তখন দেড় টা।সাদনান তখনো বউ কে বুকে আগলে বসে আছে। রাগ না-কি অভিমান কোন টা বউয়ের মনে! সাদনান জানে না। তবে বউ এখন কিছু টা স্বাভাবিক হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। সাদনান বউয়ের হাতের উলটো পিঠে চুমু খেয়ে জিগ্যেস করলো,
-“ঘুমবে না জান?”
-“হু।
আপনি খাবার খাবেন না?”

প্রিয়তা মিনমিন করে জিগ্যেস করে। তখন হঠাৎ করে কি করে এতো সাহস এসছিল মনে প্রিয়তা জানে না।কত গুলো কথাই না মানুষ টা কে আজ শোনাল।ইশ এখন লজ্জায় মানুষ টার বুকেই মুখ লুকিয়ে বসে আছে। ভাবা যায়!সাদনান বউয়ের মুড যে স্বাভাবিক হয়েছে একদম শিওর হয়ে গেলো।মুখ গম্ভীর কণ্ঠ থমথমে এনে বলল,
-“এখানে এসছি রাত এগারো টায়।
এখন দেড় টা বাজে। তোমার এতো সময় পর আমার খাবার এর কথা মনে পড়লো!বাই দ্য ওয়ে, আমি খাবার খেয়ে এসছি।”

প্রিয়তা মনে মনে নিজে কে ইচ্ছে মতো গালাগাল করলো।সারা দিন মানুষ টা নিশ্চয়ই এক জায়গায় বসে ছিল না।এখানে সেখানে ঘুরাঘুরি করে এতো রাতে এসছে আর ও?এখন নিজের উপর রাগ লাগলো। তবে মুখে বলল,
-“আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে আসুন।”

সাদনান তাই করে।গায়ের পাঞ্জাবি খুলে নেয়।উদোম হওয়া মাত্র প্রিয়তার মনে পড়ল।মন্ত্রী মশাই এখন পড়বে টা কি?তড়িঘড়ি করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।বাহিরে বারান্দা থেকে গিয়ে আয়ানের একটা ট্রাউজার আর টি-শার্ট নিলো।ভাগ্য ভালো ছিল আজ আয়ান নিজের প্রায় অর্ধেক কাপড় ধুয়ে দিয়েছিল।আর প্রিয়তার ব্যালকনিতে বিকেলে রোদ পড়ে তাই তো বোনের ব্যালকনিতে এনে কাপড় মেলে দিয়ে গিয়েছিল। প্রিয়তা মনে মনে ভাই কে হাজার টা ধন্যবাদ দিতে ভুলে না।রুমে এসে দেখলো সাদনান ফ্রেশ হয়ে চলে এসছে।প্রিয়তার হাতের দিকে তাকিয়ে সাদনান কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই প্রিয়তা বলে উঠলো,

-“এগুলো পড়ে নিন।
হবে এতে?”
সাদনান কিছু বলে না।শুধু টি-শার্ট টা নিয়ে পড়ে নিলো।গাড়িতে অবশ্য একসেট ড্রেস সব সময় থাকে।সে কি আর জানতো বউ এমন ঠমক ধরবে তবে নাহয় ড্রেস নিয়ে তারপর আসতো।
প্রিয়তা ট্রাউজার আবার নিয়ে ব্যালকনিতে রেখে আসে।
সাদনান ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল ঠিকঠাক করে। প্রিয়তা বিছানায় বসে পিটপিট করে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

মানুষ টা এই আবছা আলোয়ে কি এতো সাজুগুজু করছে!প্রিয়তার বুঝে আসে না।
সাদনান বিছানায় প্রিয়তার পাশে বসতেই প্রিয়তা একটু নড়েচড়ে বসলো।মূলত সাদনানের গা ঘেঁষে বসলো। সাদনানের পেট মুচড়ে হাসি পায়।

তবে হাসে না।বা হাতে বউয়ের কোমড় টেনে নিজের সাথে চেপে ধরে।আস্কারা পেয়ে বিড়াল ছানার ন্যায় গুটিশুটি মেরে সাদনানের বুকে গাপটি মেরে গেলো প্রিয়তা। সাদনান বউ কে নিজের উপর থেকে বিছানায় শুইয়ে দেয়।দুই হাত প্রিয়তার দু’দিকে রেখে প্রিয়তার পুরো মুখে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ধীরে কণ্ঠ বলে উঠলো,
-“মুড কি ঠিক আছে?”

আমার তুমি সিজন ২ পর্ব ২৪

প্রিয়তা নিজের মাথা টা উঁচু করে সাদনানের অধর নিজের অধর আলতো ছুঁয়ে দিয়ে জানাল,
-“বেশি না।
তবে আপনার ছোঁয়া তা সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হবে।”

আমার তুমি সিজন ২ পর্ব ২৬