আমার তুমি সিজন ২ পর্ব ৩৬
জান্নাত সুলতানা
সাদনান আজ পাঁচ দিন হয় দেশে নেই।প্রিয়তা এই পাঁচ দিন পাঁচ যুগের সমান মনে হয়েছে। ঠিকঠাক খাবার খেতে পারে না। ঘুম হয় না।মানুষ টা কে একবার ছুঁয়ে দেখা না পর্যন্ত এই অস্থিরতা ঠিক হওয়ার নয়।
ফোনে কথা বলে তৃষ্ণা মিটে না।আচ্ছা সুদূর থাইল্যান্ড অবস্থান করা মানুষ টারও কি এমন হয়?না-কি হয় না?এমনতর একই অবস্থাও কি ওই মানুষ টার মনের?
প্রিয়তার কাছে এর কোনো উত্তর নেই।কারণ এইসব প্রশ্ন গুলো বৃথা। কারণ মন্ত্রী সাদনান কেমন সেটা ওর থেকে ভালো কেউ জানে না।মানুষ টা নিশ্চয়ই ওর থেকে-ও বেশি তৃষ্ণার্ত। আজ বাড়িতে অনেক মানুষ। শুধু এই একটা মানুষ নেই।অবশ্য ঘন্টাখানেক এর মধ্যে এসে মির্জা বাড়ি পৌঁছে যাবে বলে শুনেছে প্রিয়তা। রিধি ওয়াজিদ এসছে ওদের দেড়বছরের বাচ্চা রুহিকে কে নি।মাইশা, আয়ান এসছে চার বছরের ছেলে মিশান কে নি।তিন্নি কবির এসছে ওদের আড়াই বছরের ছেলে তুরাগ কে নি।বাড়ি ভর্তি মানুষ।বেশ বড়সড় করে অনুষ্ঠান হচ্ছে। সেটাও রাহান আর সারা’র বউভাত এর অনুষ্ঠান।রাহান তখন বউয়ের জন্য কিছু না করতে পারলে সামর্থ্য হওয়ার পর ঠিকই করছে।ভালোবাসা যেনো দুজনের মাঝে এক রত্তির কমে নি।বরং বেড়েছে।আজ্জম মির্জা এখন এসব দেখে এখন শান্তি পায়।ছেলের উপর গর্ববোধ হয় বোনের জন্য ছেলে তার একদম পারফেক্ট পাত্র চুজ করেছে। মাঝখানে তিনি কি বাগাড় টাই না দিয়েছিলেন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রিয়তা নিচে একটা ঘরে থাকে এখন।সিঁড়ি বেয়ে উপর ওঠানামা করতে কষ্ট হয় বিধায় সাদনান প্রিয়তার যখন ছয় মাস চলে তক্ষুণি নিচে বাবা মায়ের পাশের রুমে সিফট করেছে। প্রিয়তার এতে অবশ্য সুবিধা হয়েছে।
এই যেমন রুমে বসে এখান থেকে পুরো লিভিং রুম দেখতে পাচ্ছে।সালেহা বেগম বলে গিয়েছে একটু পর এসে ওকে শাড়ী পড়িয়ে দিবে।
তাই বসে বসে অপেক্ষা করছে।
প্রিয়তা অনেক্ক্ষণ হয় বসে আছে। শরীর কেমন অস্থির লাগছে।তাই শোয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতেই রুমে হন্তদন্ত হয়ে রোজিনা বেগম প্রবেশ করলো।
হাতের শাড়ী প্রিয়তার দিকে এক পলক তাকিয়ে শাড়ির ভাঁজ খুলতে খুলতে ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
-“তুই কষ্ট করে একটু দাঁড়িয়ে পর প্রিয়।
তোর শাশুড়ী ভীষণ ব্যস্ত।তাই আমি এলাম।”
প্রিয়তা মৃদু হাসলো।পেটে চিনচিন ব্যথা হচ্ছে। কিন্তু সেসব পাত্তা দিলো না।
রোজিনা বেগম এর কাছ থেকে শাড়ির সব প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।টুইন বেবি হওয়ায় পেট টা একটু বেশি বড়ো।তাই চলাফেরা করতে যথেষ্ট কষ্ট হয়।
প্রিয়তা ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে এলে রোজিনা বেগম শাড়ী পড়িয়ে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে যাচ্ছিল।কিন্তু হঠাৎ কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ পেছনে ফিরে দেখতে পেলো প্রিয়তা ড্রেসিং টেবিলের সামনে চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর নিচে একটা কিছু পড়ে আছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে প্রিয়তা ঠিক নেই।হয়তো পরে যাচ্ছিল চেয়ার ধরে নিজে কে সামলে নিয়েছে।রোজিনা বেগম আঁতকে উঠলেন।বুকের ভেতর ভয় এসে হানা দিলো। কিছু টা দৌড়ে গিয়ে প্রিয়তা কে ধরলো।বিছানায় নিয়ে বসাতে বসাতে বিচলিত কণ্ঠে জিগ্যেস করলো,
-“কি হয়েছে?
শরীর খারাপ লাগছে?”
প্রিয়তা কোনো জবাব দিতে পারলো না।শরীর ঘামছে কেমন অস্থির অস্থির করছে। রোজিনা বেগম তৎক্ষনাৎ জোরে জোরে সবাই কে ডাকতে লাগলো।প্রিয়তা বারকয়েক জোরে জোরে শ্বাস টেনে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বলল,
-“পেটে ব্যাথা হচ্ছে ভীষণ।
সকাল থেকে,,,
আর কিছু বলতে পারে না। চুপ করে ঠোঁট কামড়ে ধরে চুপ করে গেলো।সবাই ততক্ষণে এসে ভীড় জমিয়েছে।কোনো পুরুষ রুমে এলো না।সালেহা বেগম সুফিয়া বেগম সহ কাজের লোকের সাহায্যে প্রিয়তা কে গাড়ি পর্যন্ত নেওয়া হলো।এতোক্ষণ রমরমা করা পরিবেশ কেমন থমথমে হয়ে গেলো।
এয়ারপোর্টে থেকে বেরিয়ে সাদনান নিজের জন্য বরাদ্দকৃত গাড়িতে বসে গেলো।আজ পাঁচ দিন এক রাতেও ঠিকঠাক ঘুমোতে পারে নি।পাঁচ দিন পাঁচ বছর মতন হয়েছে।সময় যেনো পাড় হচ্ছিল না।এতো দীর্ঘ সময় সে কখনো বউয়ের এমন অবস্থায় বউয়ের থেকে দূরে সে কিছুতেই থাকতো না।শুধু জরুরি প্রয়োজন বিধায় থাকতে বাধ্য হয়েছে। যদিও প্রয়োজন টা নিজেরই।প্রাক্তন এমপি যে নিজে সুইসাইড করেছে আর খারাপ ছিল তার কিছু প্রমাণ এখান থেকে সংগ্রহ করেছে সে সেইজন্য এখানে থাকতে হয়েছে।
কোটে যে কেসটা চলছে তার লাস্ট শুনানিতে এই প্রমাণ গুলো প্রয়োজন।সাদনান জানে এই প্রমাণ গুলো কোটে একবার পেশ করতে পারলে খেল খতম।গাড়ি চলছে মির্জা বাড়ির উদ্দেশ্যে।সাদনান চোখ বন্ধ করে গাড়িতে বসে ছিল।চোখে ঘুম প্রচুর। বাড়িতে গিয়ে বউ কে জড়িয়ে ধরে লম্বা একটা ঘুম দিতে হবে।নয়তো মনের মধ্যে যে বউ কে এতো দিন ছুঁতে না পারার তৃষ্ণা কিছুতেই মিটবে না।
সাদনানের চোখবুঁজে থাকা অবস্থায় পাশের সিটে ফোন টা সশব্দে বেজে উঠল। সাদনানের পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট সাদনানের দিকে একবার সামনের সিট হতে মাথা ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকালো।সাদনান চোখ খুলে দেখলো সেদিকে একবার। পরপরই ফোন টা হাতে নিয়ে দেখলো রাহান কল করেছে।
সাদনান ভ্রু কুঁচকালো। আধঘন্টা আগে এয়ারপোর্ট হতে বেরিয়ে কথা বলেছে ওর সাথে।
আবার কেনো ফোন করেছে বুঝতে পারলো না। ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ পরিমাণ কুঁচকে ফোন টা রিসিভ করে কানে তুলে কিছু বলার আগেই রাহান ওপাশ থেকে চিন্তিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
-“আমরা উপজেলায় চলে এসছি ভাবি কে নিয়ে।
তুই আসব,,,
রাহানের পুরো কথা শুনলো না সাদনান।কিছু মাথায় এলো না। শুধু ভাবলো বউ ঠিক আছে তো?এতোক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে থাকা পুরুষ টার মুখ কেমন চিন্তিত দেখাচ্ছে।গাড়িতে এসি তারপরও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামে চিকচিক করছে। কোনো রকম ঠোঁট জোড়া নেড়ে রাহান কে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে নিজেই জিজ্ঞেস করলো,
-“এখন কোথায় ও?
ঠিক আছে?”
-“ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
মনে হচ্ছে স,,,
-“ফোন টা ওটিতে দিয়ে আয়।”
-“কিন্তু?,,
-“চুপ।
আমি যা বলছি তা কর।
পনেরো মিনিট এর মধ্যে আমি হসপিটাল পৌঁছাচ্ছি।”
রাহান সাদনানের এক ধমকে চুপ হয়ে গেলো। ডক্টর তাসলিমা রাউন্ড শেষ হয়েছে ওটিত যাচ্ছিল।রাহান ওনাকে ডেকে সাদনানের কথা জানালো।ডক্টর তাসলিমা বারণ করলো না।একজন আয়ার হাতে ফোন টা ভিডিও কলে দিয়ে বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলো রাহান।সবাই দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। আর মন্ত্রী সাদনান এর পাগলামির খবরও পেয়ে গেলো।
-“জানে মেরে দেবো।
এভাবেই থাকবে ফোন।
জান, জান আমি আছি তো।ভয়ে পাওয়ার কিচ্ছু নেই।”
সাদনানের বাজখাঁই কণ্ঠে সবাই চুপসে গেলো।মনে হচ্ছে গাড়িতে নয়।সে হসপিটাল রয়েছে।আর এক্ষুণি হাতের নাগালে পেলে সবাই কে চিবিয়ে খেতো।।চোয়াল শক্ত। কিন্তু অস্থির। একটু পরপরই বউ কে এটাসেটা বলে যাচ্ছে লাগাতার।আর হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ হচ্ছে একজন এনেস্থিসিয়া। তিনি সাদনান কে ঠিক চিনতে পারে নি। আর সেইজন্য রোগী কে অজ্ঞান হওয়ার ইনজেকশন দেওয়ার পর তিনি কল কাটার কথা বলেছেন। এতেই সাদনান রেগে বোম।আয়া ফোন সেভাবেই ধরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ডক্টর তাসলিমা আর কিছু বলতে পারলো না।প্রিয়তা ব্যথায় ছটফট করছে।সাদনানের কথায় কাতর কণ্ঠে বলল,
-“প্লিজ আপনি শান্ত হোন।
আর কল টা রাখুন।”
সাদনান প্রিয়তার কথা পাত্তা দেয় না। ডক্টর তাসলিমা কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
-“ওর যেনো কিচ্ছু না হয়।
আই সোয়ার ওর কিছু হলে হসপিটাল আমি চায়ের দোকান বানিয়ে দেবো।”
আমার তুমি সিজন ২ পর্ব ৩৫
হুমকি টা ছিল বড়োই অদ্ভুত।হয়তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এতোক্ষণে এখানে হাসির বন্যা বয়ে যেতো।কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন হওয়ায় এই হুমকি টা সবার কাছে ভয়ংকর মনে হলো।এরমধ্যে বাইরে কিছু টা শোরগোল এর আওয়াজ শোনা গেলো।প্রিয়তা নিবুনিবু চোখে একবার মাথা টা কাত করে আয়ার হাতের ফোন টার দিকে তাকালো। ওই তো সফেদা রঙের পাঞ্জাবি গায়ে উষ্কখুষ্ক চুলসহ অস্থির আর চিন্তিত মানুষ টা নজরে এলো।হসপিটাল পৌঁছে গেছে। এই মূহুর্তে ওটির বাহিরে অবস্থান করছে। প্রিয়তার ব্যথিত শরীর না চাইতেও ঠোঁটের কোণায় হাসি খেলে গেলো।আর সেই সাথে চোখ জোড়াও বন্ধ হয়ে এলো।