আমার নিঠুর মনোহর সিজন ২ পর্ব ২

আমার নিঠুর মনোহর সিজন ২ পর্ব ২
জেনিফা চৌধুরী

“এই বাচ্চা আমি রাখবো না। বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলবো।”
পরিক্ষা হলে যাওয়ার জন্যই তৈরি হচ্ছিলো তামজিদ। তারিন তৈরি হয়ে বসে ছিলো। তামজিদ কাল থেকে এখন অব্দি তারিনের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কোনোরকম কথা বলেনি। ফিরেও তাকায়নি। সকালে উঠেই তারিন আর তানহা মিলে নাস্তা বানিয়েছিলো তাও তামজিদ মুখে দেয়নি। তানহা হয়তো কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে তাই তারিনকে সংগোপনে বলেছিলো,

“স্বামী-স্ত্রীর মাঝে অভিমানের দেয়াল বেশিক্ষণ তুলে রাখতে নেই। সম্পর্কের অবনতি ঘটে।”
তারিন তখন কথাটা বলার মানে খুব ভালো করে বুঝেছিলো। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি। তামজিদের এমন অবহেলা সহ্য করার ক্ষমতা ওর নেই। আবার তামজিদকে বুঝাতেও পারছে না যে, ও কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি। মাতৃত্ব স্বয়ং আল্লাহর দেওয়ার উপহার। এখানে মানুষ জাতির কোনো হাত নেই৷ তাহলে তামজিদ কেনো এই সহজ কথাটা বুঝতে পারছে না? তারিন সবকিছু ভেবে চিন্তে মনকে শান্ত করলো। যেভাবেই তামজিদের অভিমান ভাঙতে হবে। তামজিদকে ঠিক করতে হবে। তাই তারিন তামজিদের মনোভাব বোঝার জন্য উপরোক্ত কথাটি বলে উঠলো। কথাটা শোনা মাত্রই তামজিদ বিস্ফোরিত চোখে ঘুরে তাকালো তারিনের দিকে। তারিন তৎক্ষনাৎ মুখটা কাঁদো কাঁদো করে ফেললো। তামজিদের চোখ মুখে তখন আগুন জ্বালানো তেজ। গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“কি বললে?”
তারিন সে কথার উত্তর না দিয়ে বললো,
“কাল পরিক্ষা শেষ হলে আমাকে একটু হসপিটালে নিয়ে যাবেন, মাস্টার মশাই?”
তামজিদ যেনো আরো জ্বলে উঠলো। তারিন বুঝতে পেরেও মুখে প্রকাশ করলো না৷ তামজিদ দাঁতে দাঁত চে’পে জিজ্ঞেস করলো,

“হসপিটালে কেনো যাবে?”
“কেনো যায় হসপিটালের মানুষ?”
তারিনের পাল্টা এমন গা ছাড়া প্রশ্নে তামজিদের রাগ বেড়ে গেলো। তেড়ে গেলো তারিনের দিকে। হাতটা শক্ত করে চে’পে ধরে দাঁড় করালো। চোখ রাঙিয়ে প্রশ্ন করলো,
“একদম ত্যাড়ামি করবে না। যা বলছি সেটার উত্তর দাও। হসপিটালে কেনো যাবে?”

তারিন তামজিদের চোখে একবার চোখ রাখলো। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না। চোখ নামিয়ে ফেললো। দৃষ্টি রাখলো মেঝের টাইলসের উপর। মানুষটার চোখে ভীষণ মায়া৷ এই মুহূর্তে এই মানুষটার চোখ বলে দিচ্ছে মানুষটার মুখে কত ভয় জমেছে। সন্তান হারানোর ভয়৷ বাবা হওয়ার খুশি হারানো ভয়। তারিনের মনে প্রশান্তি বয়ে গেলেও তামজিদের চোখের দিকে তাকিয়ে কেনো যেনো চোখের কোনে অশ্রুকণা এসে ভীড় জমেছে। তারিনকে চুপ থাকতে দেখে তামজিদের রাগ তরতর করে বাড়ছে। গলা উঁচু করে চিৎকার করে বলে উঠলো,

“আমার ধৈর্য পরিক্ষা নিও না, তারিন। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”
তারিন নিচের দিকে তাকিয়েই আগের ন্যায় জবাব দিলো,
“আমাদের বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলবো, মাস্টার মশাই।”
তারিন প্রথমবার কথাটা তামজিদকে রাগানোর জন্য বললেও এখন উপলব্ধি করছে কথাটা বলতে ওর বুক কাঁপছে। সন্তান হারানোর ভয় জাগছে। কী আশ্চর্য এক অনুভূতি! দেহের ভেতর যার অস্বস্তি সবেমাত্র বিরাজ মান সেই অস্বস্তি হারানো ভয় এতটা মারাত্মক। যাকে এখনো ছুঁয়ে দেখা হয়নি, চোখে দেখা হয়নি সেই অস্বস্তিতের এত মায়া? কিভাবে? তারিনের কথাটা শেষ হতেই তামজিদ সজোরে তারিনের গালে থা’প্পড় মে’রে বসলো। তারিনের দুই বাহু শক্ত করে একপ্রকার খাবলে ধরলো। চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,

“এই মেয়ে এই! সবকিছু তুমি খেলা মনে করেছো? যা মুখে আসছে বলে যাচ্ছো? যা মনে আসছে করে যাচ্ছো? কোনো বিবেক বুদ্ধি নেই তোমার? আমাকে কি খেলনা পুতুল মনে হয় তোমার? নাকি যান্ত্রিক রোবট মনে হয়? আমার অনুভূতির কোনো দাম নেই তোমার কাছে? আমার ইচ্ছার কোনো দাম নেই? আমি কি চাওয়া পাওয়ার মূল্য নেই? কি ভেবেছো কি তুমি? তোমার যা ইচ্ছা তাই করবে? বলো? উত্তর দাও? কি চাও তুমি?”
তারিন কাঁদছে। তবে নিঃশব্দে। চোখ থেকে পানি পড়া যাকে বলে। তামজিদের কথাগুলো বলেই থামলো। তামজিদের চোখেও তারিন স্পষ্ট অশ্রুকণা খেয়াল করেছে। তামজিদ কয়েক সেকেন্ড থামলো। পুনরায় চেঁচিয়ে বলে শুরু করলো,
“উত্তর দাও না কেন ? কি চাও তুমি? এই মেয়ে বলো কি চাও?”

তারিন উত্তর দিতে পারছে না। ফুঁপিয়ে কান্না আসছে। তবুও কোনোরকমে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে উঠলো,
“আপনাকে চাই, মাস্টার মশাই। আপনি, আমি, আমাদের সন্তানকে নিয়ে সুখে, শান্তিতে বাঁচতে চাই। প্লিজ আমাকে আর অবহেলা করবেন না, মাস্টার মশাই। আমি মানতে পারিনা। একদিনেই ভেতরে ভেতরে আমি ম’রে যাচ্ছি। পারবোনা আপনাকে ছাড়া বাঁচতে। অনেক বেশি ভালোবাসি আপনাকে, মাস্টার মশাই। আপনার সুখ, শান্তির জন্য আমি সব করতে পারবো। এই বাচ্চা নিয়ে যদি আপনার সুখ নষ্ট হয়, স্বপ্ন নষ্ট হয় তাহলে এই বাচ্চাটাকেও আমি রাখবো…।”

তারিন শেষের কথাটা আর সম্পূর্ণ করতে পারলো না৷ তামজিদ তারিনকে বুকে প্যাঁচিয়ে ধরলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজলো তারিনের কাঁধে৷ বলে উঠল,
“আর একবার এই শব্দটা উউচ্চারণ করলে খুব খারাপ হবে।”
দুজনেই এবার কান্না করে উঠলো। তারিন তামজিদের শার্ট শক্ত করে আঁকড়ে ধরে জোরেই কান্না করে উঠলো। কান্না করতে করতে বলে উঠলো,

“আমি আপনার স্বপ্ন পূরণ করবো, মাস্টার মশাই। শুধু ডাক্তার হওয়া আমার স্বপ্ন না। মা হওয়া ও আমার স্বপ্ন। আমি মা হবো আর আপনি বাবা হবেন_____এর থেকে বেশি সুখ আমি আর চাইনা, মাস্টার মশাই। এই সুখটুকু আমার থেকে কেড়ে নিয়েন না, মাস্টার মশাই। আমি বাঁচতে পারবো না। আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে একদিন ঠিক ডাক্তার হয়ে আপনার সামনে দাঁড়াবো। আর রইলো সংসারের কথা। আপনি আছেন, তানহা আপু আছে , জাহেলা আপা আছে আমরা সবাই মিলে এই সংসার সামলে নিবো। যখন আমার হাঁটা চলা করতে কষ্ট হয়ে যাবে তখন মাকে নিয়ে আসবো৷ আপনি কেনো এত চিন্তা করছেন? সব ঠিকঠাক হবে। একটু শান্ত হোন। আল্লাহ আছে তো। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। সব ঠিক হবে দেখবেন, ইন শা আল্লাহ।”

এর মধ্যেই তানহা হন্তদন্ত হয়ে এসে রুমে উপস্থিত হলো। তানহাকে দেখে তামজিদ তারিনকে ছেড়ে দিলো। তানহা দুজনের চোখে পানি দেখে চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলো,
“কি হয়েছে ভাই? কাঁদছিস কেন? তারিন, ঠিক আছো? কোনো সমস্যা?”
তামজিদ চোখের পানিটুকু মুছলো৷ তানহার উদ্দেশ্যে বললো,
“সব ঠিক আছে।”
তারিন এবার মুখ খুললো। কান্নারত স্বরেই বলতে লাগলো,

“আপু, প্লিজ একটু আপনার ভাইকে বুঝান। আপনি, আমি, আমরা সবাই মিলে সব সামলে নিতে পারবো, বলেন? আপনার ভাই কেনো এত ভেঙে পড়েছে? কেনো চিন্তা করছে? আপু, আপনি বলেন পড়ালেখায় এক বছর গ্যাপ দিলে কি খুব বেশি ক্ষতি হবে? এই বছরটা গ্যাপ দিয়ে সামনের বছর থেকে আবার সব শুরু করবো। পড়ালেখা তো বেঁচে থাকলে করতে পারবো। সরকারিতে চান্স না পেলে বেসরকারিতে পড়বো। স্বপ্ন পূরণ তো করবোই। কিন্তু এই মা হওয়ার খুশি থেকে বঞ্চিত হলে আমার জীবনের আসল মানেই খুঁজে পাবো না৷ প্লিজ আপু একটু বুঝান না।”
তানহা তামজিদের কাঁধে হাত রেখে শান্ত স্বরে বললো,

“দেখ ভাই, মাতৃত্ব আল্লাহর দান৷ আল্লাহর খুশির দানকে এভাবে অবহেলা করিস না৷ এই দুনিয়াতে আছেই কি? কয়দিন বাঁচবো আমরা? একটু সুখে, শান্তি সবাই মিলে আনন্দ করে বাঁচি। চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে৷ আমরা সবাই মিলে সামলে রাখবো। বুঝলি, বলদ? বাবা হবি তুই, সেই খুশিতে কোথায় আমাদের বড়সড় একটা ট্রিট দিবি, তা না করে রাগ করে আছে৷ গাঁধা কোথাকার।”
তারপর তারিনের চোখের পানির মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,

“কাঁদে না, বোকা মেয়ে। সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন কান্নাকাটি করলে শরীর খারাপ করবে। যাও মাথা ঠান্ডা করে সাবধানে পরিক্ষা দিবে৷ এবার হাসো তো তোমরা একটু। হবু বাবা মায়ের এমন পেঁচার মতো মুখ দেখে আমাদের পুচকু তো রাগ করবে। বলো? হাসো দেখি? ইইইই?”

বলেই তানহা দাঁত কেলিয়ে উঠলো৷ তা দেখে সবাই একসাথে হেসে উঠলো। তানহা চলে যেতেই তামজিদ তারিনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো পরম যত্নে৷ আলতো স্বরে বলে উঠল,
“অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছে, তাইনা জান? আর কষ্ট দিবো না। কখনো দিবো না। তোমার গায়ে হাত তুলেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিও, প্লিজ। আর কখনো এই ভুল করবো না। এখন থেকে শুধু আদর করবো। বুঝছো? ভালোবাসি।”
তারিন ও প্রশান্তিতে হেসে বলল,

আমার নিঠুর মনোহর সিজন ২ পর্ব ১

“ভালোবাসি, মাস্টার মশাই। আপনি আমার নিঠুর মনোহর। যে ভালোবেসে আগলে রাখতে জানে, আবার কষ্ট পেলে, ভুল করলে শাসন করতেও জানে।”

আমার নিঠুর মনোহর সিজন ২ পর্ব ৩