আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ১১

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ১১
সালমা খাতুন

সকালবেলা…..
সকালের সূর্যটা ধীরে ধীরে আকাশের পূর্ব দিক থেকে উঁকি দিচ্ছে। চারপাশে এক শান্ত, নির্মল পরিবেশ। পাখিরা ডানা মেলে গাছের ডালে বসে মিষ্টি সুরে ডাকে, প্রকৃতির এক স্বাভাবিক সংগীত। বাতাসে হালকা শিশিরের গন্ধ, ঘাসে জমে থাকা শিশিরবিন্দু সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। গাছের পাতাগুলো রৌদ্রছায়ায় দুলছে, যেন সকালে তারা নতুন প্রাণ পেয়েছে।

এই মনোরম দৃশ্য মায়া তার বারান্দা থেকে দেখছে আর উপভোগ করছে। আজ খুব সকালেই ঘুমটা ভেঙে গেছে ওর। তাই বিছানা থেকে উঠে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়েছে। কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলো ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে। তারপর হাত মুখ মুছে রওনা দিলো রান্না ঘরের উদ্দেশ্যে। এই বাড়ির সবাই হয়তো এখোনো ঘুমে। শুধু পাখির কিচিরমিচির ছাড়া চারিদিক এখনো নিস্তব্ধ। মায়া রান্না ঘরে গিয়ে সকালের নাস্তা বানাতে শুরু করলো।
কিছুক্ষণের পরেই শোনা গেলো কোরোর পায়ের আওয়াজ। মায়া রান্না ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো, মিসেস আনজুমা বেগম আসছেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আনজুমা বেগম:- “আরে মায়া মা তুমি? এতো সকালে রান্না ঘরে কি করছো?”
মায়া মুচকি হেসে বলল, “এই তো ছোটো আম্মু ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছি।”
আনজুমা বেগম:- “তোমার বানানোর কি দরকার মা? রান্নার জন্য শেফ আছে, আমি আছি।”
ঠিক তখনি রান্না ঘরে প্রবেশ করলো রুবি। এরই মধ্যে ওদের বাড়ির শেফরাও উঠে যে যার কাজ লেগে গেছে।
রুবি:- “মায়া! স্যার এই সময় কফি খায়। জিম রুমে আছেন উনি। এরপর উনার ঘরটাও পরিস্কার করতে হবে।”
মায়া:- “আচ্ছা আপু ঠিক আছে। আমি এখনি যাচ্ছি কফি নিয়ে। আর উনার জিম রুমটা কোন দিকে?”
রুবি:- “উনার রুমের সাথেই অ্যাটাচ রুম আছে। ওটাই জিম রুমে।”
মায়া:- “আচ্ছা আপু।”

আনজুমা বেগম অবাক হয়ে দেখছে এই ছোট্ট মেয়েটাকে যে কিনা বুকে হাজারো কষ্ট চাপা রেখে কতটাই না স্বাভাবিক দেখাচ্ছে নিজেকে। ভালোদের সাথেই সবসময় কেন এমন হয়? মেয়েটার তো ওর বাবা ছাড়া এই দুনিয়ায় কেউ নেই। আর দেখাই বোঝা যেত ওর বাবা ওকে কতটা আদরে মানুষ করেছে। যদি ওর বাবা এই দুনিয়ায় থাকে তাহলে কোথায় যাবে মেয়েটা? তখনো কি এইভাবে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারবে? ভীষণ মায়া হয় উনার এই মেয়েটাকে দেখলে। কত সুন্দর মিষ্টি স্বাভাবের মেয়েটা। আর তার কপালেই কিনা এতো কষ্ট। ভাবলেই অবাক লাগে।
মায়া কফি বানাতে বানাতে আনজুমা বেগমের উদ্দেশ্যে বলল, “কি ভাবছো ছোট আম্মু?”
আনজুমা বেগম মায়ার কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “কিছু না মামনি। দোয়া করি আল্লাহ তোমার সব কষ্ট ধুয়ে মুছে দিক। তুমি দেখবে, এখন কষ্ট পেলেও একদিন খুব সুখী হবে তুমি।”

মায়া এই কথার প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। শুধু ওর মুখে ফুটে উঠলো কষ্টের হাসি। তারপর বলল, “আচ্ছা ছোট আম্মু, আমি তো জানি না এই বাড়ির সবাই ব্রেকফাস্টে কি খায়, তাই লুচি আর আলুর দম বানিয়েছি।”
আনজুমা বেগম হেসে বললেন, “অনেক ভালো করেছো। আমি তোমার আঙ্কেলরা আর সমিরা তো লুচি খেতে অনেক ভালোবাসি। দেখবে ওরা এই ব্রেকফাস্ট দেখে অনেক খুশি হবে। বড়ো ভাবী আর আরমান হয়তো খাবে না ওরা ডায়েট করে তো, তাই খুব বেশি অয়েলি জিনিস খায় না ওরা।”

মায়া:- “আচ্ছা ঠিক আছে। আর আঙ্কেলরা কি উঠে গেছে? তাহলে উনাদের জন্য বানাতাম।”
আনজুমা বেগম তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে বল উঠলো, “ওহ দেখছো আমি তো ভুলেই‌ গেছি। তোমার আঙ্কেল দের জন্যই চা বানাতে এলাম আমি। উনারা মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়েছে, এখনি ফিরে এসে চা চাইবেন।”
মায়া মুচকি হেসে নিজের কাজ করতে করতেই বলল, “তুমি চিন্তা করো না ছোটো আম্মু, আমি এখনি বানিয়ে দিচ্ছি।”
বলেই চা বানাতে শুরু করলো। আর আনজুমা বেগম না না করে বললেন, “আরে আরে আমি বানাচ্ছি, তুমি যাও এরপর তোমাকে আরমানের রুম পরিস্কার করতে হবে। তারপর অফিসেও তো যাবে তুমি। আজকে আবার প্রথম দিন।”

মায়া:- “ওহ কোনো ব্যাপার না ছোট আম্মু, এখনি হয়ে যাবে বেশিক্ষণ লাগবে না। যাও তুমি গিয়ে ড্রইংরুমে বসো আমি এখনি চা আনছি।”
আনজুমা বেগম মায়ার মাথার চুল গুলো হালকা এলোমেলো করে দিয়ে বললেন, “পাগলী একটা।”
বলেই উনি চলে গেলেন। এদিকে মায়া নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে গেলো।

এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই মায়া সবকিছু রেডি করে, রান্না ঘর থেকে উকি দিয়ে ড্রয়িংরুমে তাকলো, দেখলো আঙ্কেল রা চলে এসেছেন। মায়া একটা ট্রেতে করে চা নিয়ে গেলো উনাদের কাছে। ছোটো আম্মু কেও চা দিলো। এরপর আবারও রান্না ঘর গিয়ে আরমানের জন্য বানানো কফি নিয়ে এগিয়ে গেলো দোতালার দিকে। তারপর আরমানের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনেক্ষন নক করার সত্বেও ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ এলো না। ওর মনে পড়লো রুবি বলেছিল জিম রুমে থাকবে এই সময় তাই হয়তো অত দূরে নক করার আওয়াজ যাচ্ছে না। মায়া আর কোনো কিছু না ভেবেই রুমের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। ওর এই রুমটা ভালো করে দেখা হয়নি কখনো, তাই পুরো রুমটাই একবার চোখ বুলালো।

বিশাল বড়ো রুমটা। সবরকমের ফার্নিচারও আছে। পুরো রুমাটাই সাদা কালার, তার সাথে দরজা জানালার পর্দা থেকে শুরু করে বিছানার চাদরটাও সাদা কালার। এতো ঝাঁ চকচকে রুমটার কি পরিস্কার করবে ভেবে পেলো না মায়া। রুমে কিং সাইজের একটা বেড রাখা। আর তার কিছুটা পাশেই একটা বিশাল বড়ো বেলকনি। থাই গ্লাস লাগানো। সেই থাই গ্লাস ভেদ করে রুমে সকালের মিষ্টি রোদ প্রবেশ করছে। রুম থেকে যতোদূর দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে বেলকনিটা অনেক ফুল গাছ দিয়ে সাজানো। মায়ার আবার ফুল গাছ অনেক পছন্দ। তাই মায়া কফি হাতেই এগিয়ে যেতে গেলো সেইদিকে, কিন্তু তখনি একটা মোটা গম্ভীর পুরুষালী আওয়াজ ভেসে এলো ওর কানে, “আমার রুমে কি করছো তুমি?”

আরমান একটা টাওয়েল দিয়ে ঘামে ভিজে থাকা শরীরটা মুছতে মুছতে জিম রুম থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে মায়ার উদ্দেশ্য কথা টা বলল।
মায়া আরমানের গম্ভীর গলার আওয়াজে থেমে গেলো। তারপর আস্তে আস্তে আরমানের দিকে ঘুরলো কিন্তু তখনো ও মাথা নিচু করে রেখেছে। আরমান আবারও গম্ভীর গলায় বলল, “কারোর রুমে ঢুকতে হলে আগে অনুমতি নিতে হয়, সেই জ্ঞান টা নেই তোমার?”
মায়া:- “সরি আসলে আমি আপনার জন্য কফি এনেছি। বাইরে থেকে অনেক বার নক করেছি কিন্তু আপনি হয়তো শুনতে পাননি। তাই বাধ্য ঢুকেছি রুমে।”
কথা গুলো বলেই মায়া মুখ তুলে তাকালো আরমানের দিকে, আর সাথে সাথেই পিছনের দিকে ঘুরে গেলো ও। কারণ আরমানেন গায়ে কোনো জামা ছিল না। শুধু একটা থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পড়া ছিল।
আরমান মায়াকে এইভাবে পিছনে ঘুরে দাঁড়াতে দেখে এগিয়ে এলো মায়ার কাছে। একদম মায়ার ঠিক পিছনে পিঠ ঘেষে দাঁড়িয়ে মায়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে বাঁকা হেসে স্লো ভয়েসে বলল, “এমন ভাব করছো যেনো মনে হচ্ছে তুমি আমাকে এই অবস্থায় প্রথম বার দেখছো?”

মায়া ভীষণ লজ্জা পেলো ওর কথায়। এই লজ্জা একজন স্বামীর কথায় স্ত্রী যেমন পাই তেমন লজ্জা নয়। এই লজ্জা অপমানের লজ্জা। এই লজ্জা অন্য জনের থেকে অপমানিত হওয়ার লজ্জা।
মনে পড়ে গেলো সেই দিন সেই ক্লাবের কথা। ওর বাবাকে হসপিটালে ভর্তি করার পর পরই টাকা চেয়েছিল ওর থেকে। আগে নাকি হসপিটালের বিল জমা করতে হবে তারপর ট্রিটমেন্ট শুরু করবে। অনেক রিকোয়েস্ট করে দুইদিন সময় চেয়েছিলো ও। তারপর অনেক জায়গায় ছুটে ছিল টাকার জন্য, কিন্তু ও কুপ্রস্তাব ছাড়া কেউ ওকে টাকা দিতে চাইনি। প্রথম দিন ব্যার্থ হয়েছিল টাকা জোগাড় করতে। তারপর ওর একটা কলেজ ফ্রেন্ড কে কল করে। তেমন একটা কাছের বন্ধু ছিলো না। এমনি চেনা পরিচয় ছিল। ওর কাছে সাহায্য চাইলে, ওই মেয়েটায় ওকে ওই ক্লাবের ঠিকানা দেয়। আর ওই কাজের প্রস্তাব দেয়। মায়া প্রথমে না করে দিয়েছিল। মেয়েটা অনেক বুঝিয়ে ছিল যে এতো টাকা হঠাৎ করে কেউই ওকে দিতে পারবে না ওটাই একমাত্র উপায়।

তারপরও মায়া না করে দিয়েছিল। আবারও সারাদিন ছুটে বেরিয়ে ছিল অনেক জায়গায় লোনের জন্যেও। কিন্তু একদিন লোন দেওয়া সম্ভব না। সন্ধ্যার দিকে হসপিটাল থেকে কল আসে ও যদি টাকা জমা না করে তাহলে ওর বাবাকে কেবিন থেকে বের করে দেওয়া হবে।
তখন মায়ার হাতে আর কোনো উপায় ছিল না। ওর মায়ের রাখা গয়না গুলো বিক্রি করে যেই টাকা টুকু জোগাড় করেছিল সেই টাকা টুকু জমা করে আসে হসপিটালে। আর ওই রাতটুকু সময় চেয়ে নেয়। বাকিটা কাল সকালে জমা করবে বলে।

এরপরই আর কোনো উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে শুধুমাত্র ওর বাবাকে বাঁচানোর জন্য ওই পথ বেছে নিয়েছিল। আর ওই জায়গায় আরমানকে দেখে জেদের বসে ও কি কি বলছিল সেটা নিজেরও খেয়াল ছিল না। কেমন যেনো একটা ঘোরের মধ্যে ছিল ও। সেই কথা গুলো আর ওর করা কাজ গুলো মনে পড়লে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে ওর। কিন্তু ওর যে কিছু করার নেই। ও মরে গেলে ওর বাবার কি হবে? ওর বাবার শেষ সম্বল হচ্ছে ও।
প্রথম প্রথম ওর অজান্তে ওকে কিনা নেওয়ার জন্য আরমানের উপর রাগ, ঘৃণা থাকলেও এখন ও সত্যিই আরমানের কাছে কৃতজ্ঞ, ওকে এই সার্ভেন্ট এর কাজ দেওয়ার জন্য। যদি ওকে কিনে না নিত, যদি ওর সার্ভেন্ট না বানাতো, তাহলে ওকে ওই নোংরা জায়গায় এখনো কাজ করতে হতো। সত্যিই আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
মায়ার এই সব কথা ভেবেই চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। আরমান ওকে এক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিল। ওদের বিয়ের পর কখনো এতো কাছে থেকে, কাছে থেকে তো অনেক দূরের কথা, দূর থেকেও চোখ তুলে একপলক দেখেনি ভালো করে। শুধু মাত্র মাইশার কথা ভেবে। আর এখন মেয়েটাকে দেখলে কেমন যেনো তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে।

আরমান তখনো মায়ার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েই এক দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়া সেটা বুঝতে পেরে কাঁপা কাঁপা হাতে কফিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আ…আপনার কফি। ঠা.. ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
আরমানের ঘোর কাটলো যেনো। না না কি করছে ও। ওকি এই মেয়েটার মায়ায় পড়ে যাচ্ছে? না না এটা কিছুতেই সম্ভব না। ও শুধু মাত্র ওর মাইশাকে ভালো বাসে।
আরমান মনে মনে ভীষন বিরক্ত হলো মায়ার উপর। বিরক্তিকর গলায় ওর কাছ থেকে সরে এসে বলল, “ঠান্ডা তো হয়েই গেছে। যাও আবার গিয়ে নতুন করে কফি বানিয়ে নিয়ে আসো।”
মায়াও যেনো এই অপেক্ষাতেই ছিল। আরমানের বলার সাথে সাথেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আর আরমান নিজের উপরেই বিরক্ত হয়ে ওয়াশরুমে গেলো শাওয়ার নিতে।
এদিকে মায়াকে আবার কফি হাতে ঘুরে আসতে দেখে ছোটো আম্মু বললেন, “কি হলো মামনি, কফি নিয়ে ঘুরে এলে যে?”

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ১০

মায়া:- “আসলে ছোটো আম্মু উনি জিম রুমে ছিলেন তাই কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে।”
আনজুমা বেগম:- “ওহ আচ্ছা।”
মায়া আবারও রান্না ঘরে গিয়ে কফি বানাতে শুরু করলো। কফি বানাচ্ছে আর নিজের মনে বিড়বিড় করে আরমানকে বকছে। কফি বানানো হয়ে গেলে মায়া আবারও আরমানের রুমে গেলো। দরজায় নক করলে, কোনো সারা পেলো না। তাই দরজাটা হালকা খুলে মুখ বাড়িয়ে দেখলো রুমে কোথাও আরমান আছে কিনা। কিন্তু আরমানকে রুমে কোথাও দেখতে পেলো না। ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ আসছে। তারমানে আরমান ওয়াশরুমে। এই ভেবে রুমে ঢুকে গেলো মায়া। কফিটা বেড সাইড টেবিলে রেখে যেমন এসেছিল তেমন ভাবেই চলে গেলো মায়া। এবার বুঝে করুক উনি, এখন আর কফি ঠান্ডা হলে ওর কোনো দোষ নেই। খেলে খাক না খেলে না খাক।

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ১২