আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ১৫

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ১৫
সালমা খাতুন

আরমান মায়ার মাথা টা ভালো করে বুকে চেপে ধরলো। ঝড়ের এতোটাই বেগ যে হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে আরমানের। অতো স্বাস্থ্যবান মানুষটাকেও মনে হচ্ছে উড়িয়ে ফেলে দেবে ঝড়ে। চারিদিক অন্ধকার। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজে চারিপাশ আলোকিত হয়ে উঠছে।
আরমান মায়াকে কোলে নিয়েই অনেক কষ্ট করে এগিয়ে গেলো ওই চায়ের দোকান টার দিকে। দোকান টার সামনে গিয়ে, দুই হাতে মায়াকে কোলে নেয়াই পা দিয়ে আওয়াজ করলো টিনের বানানো দরজায়। আর মুখে আওয়াজ করে চেঁচিয়ে উঠলো, “কেউ আছেন? প্লিজ হেল্প মি!! একটু দরজা টা খুলুন প্লিজ।”

চারিদিকে ঝোড়ো হাওয়া আর বজ্রপাতে আওয়াজে হয়তো ভিতরে থাকা মানুষগুলোর কানে আরমানের গলার আওয়াজ পৌঁছাচ্ছে না। আরমান পা দিয়ে জোড়ে জোড়ে শব্দ করতে লাগলো টিনের দরজায়। তখনি ভিতর থেকে আওয়াজ হলো হয়তো কেউ দরজা খুলছে।‌ আরমান একটু সরে দাঁড়ালো। ঠিক তখনি আওয়াজ করে খুলে খুলে গেলো টিনের দরজা, সামনে একজন একজন মধ্য বয়সী হ্যাঙলা পাতলা লোক দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খোলার সাথে সাথে ভিতর থেকে কিছুটা আলো এসে বাইরেটাও আলোকিত করে দিলো।
হ্যাঁ আরমান ঠিকই ধরেছিল, এটা একটা ছোটো চায়ের দোকান। ভিতর দিয়ে হয়তো ছোটো বাড়ির মতো আছে। আসলে একটা ছোটো বাড়িই তার সাথে লাগোয়া একটা ছোট্ট দোকান।
লোকটি বলল, “কি হয়েছে বাবা? এতো রাতে? আরে তোমার কোলে দেখছি কেউ আছে!! এসো, এসো আগে ভিতরে এসো। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছো যে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

লোকটির ভিতরে যেতে বলাই আরমান তাড়াতাড়ি মায়াকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। সামনেই একটা বেঞ্চ রাখা ছিল, আরমান আর কোনো কিছু না ভেবেই মায়াকে ওই বেঞ্চ এ শুইয়ে দিলো। অনেকক্ষণ থেকে কোলে নিয়ে আছে, তাই ওর পুরো হাত ব্যাথা করছে।
মায়া অজ্ঞান আর আরমানের কোলে থাকাই ওর গায়ের ওরনা কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেছে। সামনে একজন বয়স্ক লোক। তাই আরমান কিছুটা সংকোচ নিয়েই মায়ার গায়ের ওরনাটা কিছুটা টেনে নামিয়ে দিলো। তারপর লোকটার দিকে ঘুরে বলল, “আসলে আমাদের গাড়িটা মাঝ রাস্তায় খারাপ হয়ে গেছে। আর ও বজ্রপাতের ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে।”

লোকটি:- “ওহ বুঝতে পেরেছি। তা ও তোমার বউ বুঝি?”
আরমান এই কথার প্রতিউত্তরে কি বলবে বুঝতে পারলো না। তখন একজন মধ্য বয়সী মহিলা এগিয়ে এসে তাড়াতাড়ি বলল, “কি সব বলছো তুমি? ওদের দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে যে ওরা স্বামী স্ত্রী। আর তুমি প্রশ্ন করছো?”
তারপর আরমানের দিকে তাকিয়ে মহিলাটি বলল, “তুমি ওকে এখানে শোয়ালে কেন বাবা? ভিতরে নিয়ে আসো। ওই টুকু বেঞ্চ থেকে পড়ে যাবে মনে হচ্ছে।‌ তুমি ওকে ভিতরে নিয়ে আসো।”
মহিলাটির কথায় আরমান আবারো মায়াকে কোলে তুলে নিলো, তারপর মহিলাটিকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলো ভিতরের দিকে। একটা ছোট্ট ঘরে একটা ছোট্ট কাঠের চৌকি। তাতে মহিলাটি তাড়াতাড়ি করে একটা কাঁথা বিছিয়ে দিলো, সাথে একটা বালিশও দিলো। এটা দেখে আরমান বলল, “আন্টি ও তো ভিজে গায়ে আছে, কাঁথা ভিজে যাবে তো।”

মহিলাটি:- “ওহ কোনো ব্যাপার না বাবা। তোমরা বড়ো ঘরের মানুষ, শুধু চৌকিতে শোয়ালে গায়ে হাতে ব্যাথা করবে। তুমি চিন্তা করো না, জামা কাপড় পাল্টানোর পর আবারও আমি কাঁথাটা পাল্টিয়ে দেবো। তুমি শুইয়ে দাও তোমার বউকে।”
আরমান আর কিছু না বলে মায়াকে শুইয়ে দিলো। মহিলাটি বলল, “ওর তো জামা গুলো পাল্টাতে হবে বাবা। না হলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।”
আরমান:- “হ্যাঁ আন্টি। প্লিজ ওর এই ভিজে জামাটা একটু পাল্টানোর ব্যবস্থা করুন।”
মহিলাটি:- “হ্যাঁ বাবা আমি দেখছি। তুমি আসো তোমারও তো জামা প্লাটাতে হবে। তুমিও ভিজে গেছো।”

আরমান বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ালো। দুই কামরার মাটির বাড়ি। ঘরে গুলো ছোটো ছোটো। বাড়িটির পিছনের দিকে দোকানটি। আর সামনেই রোড। বাড়ি যাওয়া আসার এই রাস্তায় এই দোকানটিকে প্রতিদিন দেখে আরমান। আশেপাশে কোনো ঘর বাড়ি নেই। এরই মধ্যে দূরে জোড়ে কোথাও বজ্রপাত হলো তাই কারেন্ট চলে গেলো। সাথে সাথে অন্ধকার হয়ে গেলো চারিপাশ। লোকটি এবং মহিলাটি তাড়াতাড়ি করে হ্যারিকেন জালালো দুটো। একটা হ্যারিকেন নিয়ে মহিলাটি ছুটে গেলো মায়া যেই ঘরে আছে সেই ঘরে।
লোকটি জানালো তাদের নাকি বস্তির ভিতরে আগে বাড়ি ছিল। আর এই দোকান অনেক আগেই করেছিল। তাদের এক মেয়ে ছিলো, কঠিন রোগ হয়েছিল তার। টাকা পয়সার অভাবে ঠিক মতো চিকিৎসা করাতে পারেনি। তাই মারা গেছে। জীবন তো কারোর জন্য থেমে থাকে না। জীবনে চলতে গেলে টাকার দরকার। উনি ইনকাম করা বন্ধ করে দিলে তো আর পেট চলবে না। তাই উনি দোকানে আসলে বউ তার মেয়ের শোকে সারা দিন কান্না করতো। বউকে বাড়িতে একা রেখে এসেও দোকানে তার মন টিকতো না তাই এই কারণে এই ফাঁকা জায়গা এই ছোট্ট বাড়িটা বানানো।

মহিলাটি মায়াকে যেই ঘরে রাখা হয়েছে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে অন্য ঘরে গিয়ে একটা নতুন লুঙ্গি গেঞ্জি আর একটা শাড়ি নিয়ে এসে আরমানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এই নাও বাবা ভিজে জামা কাপড় গুলো পাল্টে এগুলো পড়ে নাও। তুমি বলছি বলে আবার রাগ করো না, বুঝতে পারছি বড়ো ঘরের মানুষ তোমরা। তবুও তুমি বলছি কারণ তোমরা আমাকে ছেলে মেয়ের বয়সী।”
আরমান তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো, “আরে আন্টি, তুমিটাই ঠিক আছে। ওহ কোনো ব্যাপার না। আমি রাগ করছি না। বরং ভালো লাগছে।”
মহিলাটি মুচকি হেসে বলল, “তোমরা বড়ো ঘরের হলে কি হবে মনটা কিন্তু অনেক ভালো।”
আরমান কিছুটা বোকা হেসে লুঙ্গি গেঞ্জি এবং শাড়িটা দেখিয়ে বলল, “কিন্তু আন্টি আমি তো শাড়ি পড়াতে পারি না। আর এই লুঙ্গিও পড়তে পারি না।”

মহিলাটি:- “আরেহ দেখছো! আমিও না, হ্যাঁ সেটাই তো তুমিই বা কিভাবে শাড়ি পড়াতে পারবে? কোই আমাকে দাও আমিই পড়িয়ে দিচ্ছি। আর তোমার চাচা দেখিয়ে দেবে কিভাবে লুঙ্গি পড়তে হয়। আসলে তোমার চাচি লুঙ্গি ছাড়া তো আর কিছু পড়ে না তাই এইসব প্যান্ট আমাদের ঘরে নেই তাই কিছু মনে করো না বাবা।”
আরমান:- “না আন্টি আমি কিছু মনে করছি না। আপনি যান, ওর জামাটা পাল্টে দিন।”
মহিলাটি চলে গেলো। আর এদিকে আরমান শার্ট কোর্ট খুলে গেঞ্জি পড়ে নিলেও লুঙ্গি টা পড়তে পারলো না। লোকটি অনেক দেখিয়ে দিলেও পারলো না। শেষ পর্যন্ত ওই লোকটি পড়িয়ে দিলো। কিন্তু তবুও আরমান ভয় পাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি লুঙ্গির গিট খুলে পড়ে যাবে। আর একবার যদি পড়ে যাই তাহলে ওর সাধ্য নাই যে নিজে পড়ে। তাই লোকটিকে একটি সেটপিন এনে দিতে বলল। লোকটি একটা বড়ো সাইজের সেটপিন এনে দিলে আরমান তা নিজের মতো করে লুঙ্গিটা টাইট করে সেটপিন এঁটে নিলো। এবার যেনো একটু শান্তি পেলো আরমান। যাক বাবা আর ভয় নেই লুঙ্গি খুলে যাওয়ার।ও চেয়েছিল ভেজা প্যান্টেই থাকতে। কিন্তু উনারা ওদের জন্য এতো করছে, আর ওর লুঙ্গি না পরায় যদি কিছু মনে করে, তাই এই সেটপিন দিয়ে লুঙ্গি পড়া।

কিছুক্ষনের মধ্যেই মহিলাটি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বললেন, “জামা তো পাল্টিয়ে দিয়েছি বাবা। জ্ঞান না থাকায় শাড়িটা কোনো রকমে গায়ে পেঁচিয়ে দিয়েছি। কিন্তু মেয়েটার শরীরে তো ভীষণ জ্বর এসেছে। জ্বরে একেবারে গা পুঁড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে।”
আরমান এটা শুনে তাড়াহুড়ো করে গেলো মায়া যেই ঘরে আছে সেই ঘরে। গিয়ে মায়ার কপালে হাত দিয়ে দেখলো সত্যিই গা ভীষণ গরম।‌ হাত দেওয়া যাচ্ছে না একেবারে। হ্যারিকেনের আলোয় মায়ার মুখটা আরো মায়াবতী লাগছে। চারিপাশে আবছা হোলদেটে আলো।

তখনি মহিলাটি একটা বাটি করে জল আর একটা কাপড়ের টুকরো হাতে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। আরমান তাড়াতাড়ি মায়ার মাথার কাছে বসে বলল, “আমাকে ওটা দিন আন্টি আমি পানি পটি দিয়ে দিচ্ছি।”
মহিলাটি:- “আগে তুমি তোমার বুকে আর একবার কোলে তুলো। বিছানা টা কিছুটা ভিজে গেছে। পাল্টাতে হবে।‌”
আরমান মহিলাটির কথায় মায়াকে আবারও কোলে তুলল। এরপর মহিলাটি পানির বাটি পাশে রেখে বিছানা টা পাল্টে দিলে আরমান সাবধানে মায়াকে বিছানায় শুইয়ে দেয়।

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ১৪

এরপর মহিলাটি পানির বাটি আরমানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। আর আরমান কাপড় টা ভিজিয়ে মায়ার কপালে দিতে শুরু করলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই মহিলাটি হাতে একটি থালা এবং একটা ওষুধ নিয়ে ফিরে এলেন। উনি বললেন, “এতে দুটো রুটি আর তরকারি আছে বাবা। মেয়েটার একটু জ্ঞান ফিরলে খাবারটা খাইয়ে দিয়ে এই প্যারাসিটামল ট্যাবলেট টা খাইয়ে দিও।”
আরমান:- “ঠিক আছে আন্টি। আপনি যান। আপনারা গিয়ে শুয়ে পড়ুন। এমনিতেই আমাদের জন্য অনেক টা কষ্ট পেতে হচ্ছে আপনাদের।”

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ১৬