আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৩

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৩
সালমা খাতুন

শাহরিয়ার ম্যানশন….
মায়া অটো থেকে নেমে শাহরিয়ার ম্যানশনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যেই বাড়িতে তার বউ হয়ে ঢোকার কথা ছিল সেই বাড়িতে আজ রক্ষিতা নামে ঢুকতে হচ্ছে। বিয়ের পর আরমান মায়াকে তাদের বাড়ি নিয়ে আসেনি। বিয়েটা মায়াদের বাড়িতেই হয়েছিল। কবুল বলার পর আর এক মুহূর্তও ওদের বাড়িতে থাকে নি। চলে গিয়েছিল নিজের ফ্ল্যাটে। আর বলেছিল ওই মেয়ে যদি ওদের বাড়িতে আসে তাহলে ওই বাড়িতে আর কোনোদিন পা দেবে না। সারা জীবনের জন্য পাড়ি দেবে বিদেশে। আরমানের মা চাইনি ছেলেকে হারাতে তাই বাধ্য হয়েই মায়াকে তার বাবার বাড়িতেই রেখে এসেছিল। মায়াও অনেক ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু নিজেকে শক্ত করে নিয়েছিল শুধু মাত্র ওর বাবার কথা ভেবে। ওর বাবার যে এই দুনিয়ায় আর কেউ নেই ও ছাড়া।

মায়া গেটের সামনে গিয়ে দাড়োয়ানকে ডাক দিলো। দাড়োয়ান মায়ার পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে মায়া কি উত্তর দেবে ভেবে পেলো না। শুধু বললো মিস্টার আরমান তাকে আসতে বলেছিল, তার সাথে দরকার আছে। দাড়োয়ান কল করলো আরমানের পার্সোনাল মেডকে। মেড যাওয়ার পারমিশন দিলে দাড়োয়ান গেট খুলে দিলো। মায়া ভিতরে প্রবেশ করলো। আর চারিদিকের সৌন্দর্য দেখে অবাক হয়ে গেলো। রাজপ্রাসাদের মতো ডুপ্লেক্স বাড়ি। গেট থেকে সোজা মোরাম বিছানো রাস্তা কিছুটা গিয়েই তিন ভাগ হয়ে গেছে। মাঝখানে পানির ফোয়ারা। একটা রাস্তা গেছে বাড়ির মেন গেট পর্যন্ত। আর একটা গাড়ির গ্যারেজে। এবং আর একটা সুইমিং পুল ও বাগানের দিকে। বাগানে বিভিন্ন রকমের গাছ। আর সেই গাছে বিভিন্ন রং বেরঙের ছোট ছোট লাইট লাগানো। এটা রাত্রি বেলা হলেও চারিদিকে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। চারিদিকের সৌন্দর্য দেখে মায়া মুগ্ধ হয়ে গেলো।
চারিদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে গেলো বাড়ির মেন দরজার কাছে। কেন জানি মায়ার আজ খুব ভয় করছে। কাঁপা কাঁপা হাতে কলিং বেলে চাপ দিল মায়া।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরমান নিজের রুমে সোফায় বসে আছে চোখ বন্ধ করে ও চোখের উপর এক হাত দিয়ে। কি হচ্ছে ওর সাথে ও কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। আজ যখন ও ক্লাব থেকে বেরিয়ে অফিসে গেলো, তখন অফিসে কোনো কাজেই মন বসাতে পারছিল না। বার বার শুধু মায়ার বলা কথা গুলো মনে পড়ছিল। কেন জানি ও মানতে পারছিল না যে মায়া আজ অন্য কোনো পুরুষের সাথে রাত কাটাবে। সারাটা দিন ও নিজের কাজে মন বসাতে পারেনি। যেই মায়া, ডিভোর্স লেটারের সাথে ওর দেওয়া টাকা ফিরিয়ে দিয়েছিল সেই মায়া আজ নিজের ইচ্ছে পূরণের জন্য এই রাস্তায় নেমেছে সেটা কিছুতেই মানতে পারছে না ও। কিভাবে মানবে? ও যে খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছিল ওটা মায়ার প্রথমবার ছিল। আর তার প্রমাণ ছিল বিছানায় লেগে থাকা ব্লাডের দাগ।

কিন্তু মায়া যে বলছিল ও এর আগেও অন্যের সাথে….. না না আর কিছু ভাবতে পারছিল না আরমান। ওর মাথা হ্যাঙ হয়ে যাচ্ছিল। মায়া কেনো ওকে মিথ্যা বলেছিল তাহলে? কেন ও নিজেকে আরমানের চোখে খারাপ বানাতে চাইছিল। কিচ্ছু বুঝতে পারছে না আরমান। তাই আর কোনো কিছু না ভেবে কল লাগিয়ে ছিল সেই ক্লাবের মালিককে। টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে মায়াকে একমাসের জন্য।

মায়ার আসার সময় হয়ে গেছে। হয়তো আর কিছুক্ষনের মধ্যেই চলে আসবে। আরমান সোফায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে নিজের করা কাজের কথা ভাবছিল, আর বিরক্তও হচ্ছিল। ও কেন এতো আগ্রহ দেখাচ্ছে মায়ার বিষয়ে? কেনই বা রাগের মাথায় হুট করে মেয়েটাকে এক মাসের জন্য কিনে নিলো ও। আর কেনই বা মায়ার সাথে রাগের মাথায় রাত কাটালো? কি থেকে কি হয়ে গেলো কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। ও তো ক্লাবে কোনো মেয়ের সাথে রাত কাটানোর জন্য যাইনি, তাহলে? ও তো ওর একটা ডিলের জন্য গিয়েছিল। ও তো মায়াকে ডিভোর্স দিয়েছিল ওর একমাত্র ভালোবাসা….মাইশার জন্য। তাহলে কেন আবার এই মেয়েটাকে ওর জীবনে ঢুকতে দিলো। ওর মাইশাকে কি ওর ঠকানো হলো না?
মাইশা….ও তো এখনো ওর মাইশার কোনো খবর পাইনি। কোথায় আছে? কেমন আছে? আদেও কি এই দুনিয়ায় বেঁচে…. না না কি ভাবছে ও এইসব? মাইশা আছে, কিচ্ছু হতে পারে না ওর।‌ ঠিক একদিন খুঁজে পাবে ও ওর মাইশাকে।

হঠাৎ দরজায় নক হওয়ার শব্দে নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো আরমান। সোজা হয়ে বসে দরজার ওপাশে থাকা ব্যক্তিকে আসার অনুমতি দিয়ে বলল, “Come in.”
দরজা খুলে প্রবেশ করলো আরমানের পার্সোনাল মেড রুবি। এই রুবিই আরমানের সমস্ত কাজ করে। আরমানের খাওয়া দাওয়া, রুম গোছানো, কাপড় ধোওয়া থেকে শুরু করে সমস্ত যাবতীয় কাজ রুবিই দেখাশোনা করে। বয়স 26 এর কাছাকাছি। রুবি রুমে ঢুকে বলল, “স্যার যেই মেয়েটির আসার কথা ছিল ওনি এসে গেছেন।”
আরমান বুঝতে পারলো রুবি মায়ার কথা বলছে। আরমান বলল,“ঠিক আছে তুমি ওকে আমার রুমে পাঠিয়ে দাও। আর দরকার হলে আমি তোমায় ডেকে নেবো।”
রুবি:- “ওকে স্যার।”
এই বলে রুবি নীচে চলে যাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজায় আবারো নক হওয়ার আওয়াজ হয়। আরমান বুঝতে পারে এটা মায়াই হবে। আরমান আসার অনুমতি দিলে মায়া আস্তে করে দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে। মায়ার চোখ যাই সোফায় চোখ বন্ধ করে বসে থাকা আরমানের উপড়ে।

আরমান:- “তো চলে এসেছো তুমি? অনেক টা লেট করে দিয়েছো”
মায়া আরমানকে বলে, “আমার বস আমাকে বলেছিল যে আপনি আমাকে এক মাসের জন্য ভাড়া করেছেন, মিস্টার আরমান শাহরিয়ার, আমি জানতাম না যে আমার সার্ভিস আপনি এত পছন্দ করবেন। শুধু আপনার কারণে আমার অন্য ক্লায়েন্টরা খুবই হতাশ, আজ আমি অন্য কারো সাথে যেতে চাইছিলাম। আমি তার জন্য অনেক প্রস্তুতিও নিয়ে ছিলাম, কিন্তু ক্লাবে পৌঁছে আমি জানতে পারি যে আমাকে আপনার কাছে আসতে হবে, তাই আমাকে অন্য ক্লায়েন্টদের সাথে আমার পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়েছে।”
মায়া কথা গুলো নিজের মতো করে সাজিয়ে মিথ্যা বলে। এগুলো শুনে আরমান তার হাতের মুঠো শক্ত করে নেয়, উঠে এসে মায়ার কাছে দাঁড়ায়, তারপর মায়াকে একবার উপর থেকে নীচ অবধি দেখে নিয়ে বলে,”তাহলে তুমি আজকে এই পোশাক পরে অন্য কাউকে খুশি করতে যাচ্ছিলে বুঝি?”
আরমান ব্যাঙ্গাত্মক গলায় একথা বলে। কারণ আজ মায়ার পরনে ছিল সিম্পল থ্রিপিস। আবার মাথাতেও ওরনা দেওয়া।

মায়া আমতা আমতা করে বলল, “হ্যাঁ, আসলে আজ হোটেলে যাওয়ার কথা ছিল। আমি ওখানেই আমার ড্রেস চেঞ্জ করে নিতাম। একেবারে হট ড্রেস পড়ে তো আর বাইরে বের হওয়া যাই না।”
আরমান তাচ্ছিল্য হেসে বলে, “ওহ তাই বুঝি? এই কাজ করতে লজ্জা লাগছে না। আর হট ড্রেস পড়ে বাইরে বের হতে লজ্জা লাগছ? বাহ!! তোমারো লজ্জা বলতে কিছু আছে তাহলে?
মায়া আরমানের কথায় কষ্ট পেলেও তা মুখে প্রকাশ করে না। মুখে হাসি নিয়ে মায়া বলে, “ওহ মিষ্টার এসব কথা বাদ দিন কাজের কথায় আসুন। আমি আমার কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি ফিরতে চাই।”
আরমানের মুখের অভিব্যক্তি আরো কঠিন হয়ে যাই। “খুব তাড়া দেখছি তোমার এই কাজ করার জন্য। আচ্ছা যাও আমার ডিনার নিয়ে আসো আমার রুমে। তোমার জন্য এখনো আমার ডিনার করা হয়নি। আর অবশ্যই নিজ হাতে রান্না করে আনবে।”

কথাটা শুনে মায়া যেন আকাশ থেকে পড়লো। “হোয়াট??? আমি মনে হয় ভুল শুনেছি, কি বললেন আরেক বার বলুন?”
আরমান চোখ সরু করে বলল, তুমি ঠিকই শুনেছ। আমি তোমাকে বলেছি আমার জন্য রান্না করে আনতে।”
মায়া ভ্রু কুঁচকে বলে, “আমাকে কি আপনার বাড়ির মেড মনে হয়? আমি তো এখানে রান্না করতে আসিনি। আমার কাজটা ঠিক কি আপনি খুব ভালো করে জানেন। তাই আমি আপনার জন্য রান্না করতে পারবো না।”
আরমান:- “আমি তোমাকে কিনছি, পুরো এক মাসের জন্য, আজ থেকে পুরো একমাস তুমি শুধু আমার বিছানায় থাকবে, আর এই এক মাসে তোমাকে শুধু আমাকে খুশি করতে হবে, এই সময়ের মধ্যে অন্য কারো দিকে তাকাতেও পারবে না তুমি। তাই আমি যা বলবো চুপচাপ শুনবে।”
আরমান শাহরিয়ার, মায়ার কানের কাছে এসে খুব লোভনীয় কণ্ঠে কথা গুলো বলল, যার কারণে মায়ার লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল।

মায়া এক ঝটকায় আরমানের থেকে দূরে সরে এলো। তারপর রাগ নিয়ে বলল, “হ্যাঁ আপনি আমায় কিনেছেন। কিন্তু এই কাজের জন্য তো নয়। আমার কাজ শুধু আপনাকে বিছানায় খুশি করা। আপনার বাড়ির কাজের লোক হয়ে তো আসেনি।”
আরমান:- “তুমি কি পেপারে সাইন করার সময় দেখোনি ওখানে কি কি শর্ত দেওয়া ছিল? ওখানে স্পষ্ট করে বলা আছে এই এক মাস আমি যা যা বলবো তোমাকে আমার সব কথা শুনে চলতে হবে। তাতে ঘর মুছায় হোক বা রান্না করা বা আমার জামা কাপড় ধোয়া, আমি যা যা বলবো সব তোমায় শুনতে হবে।”
মায়া অবাক হয়ে বলল, “পেপার কিসের পেপার? কি সব বলছেন আপনি? এই কথা তো ছিল না।”
আরমান:- “এখানে আসার আগে কন্ট্রাক্ট পেপারে সাইন করে আসোনি তুমি? তোমার বস তোমার সাইন নেইনি? আমার মনে হয় ওই পেপার টাও তোমার ওই ব্যাগেই আছে। দেখে নিতে পারো।”

মায়ার মনে পড়ে গেলো পেপারে সাইন করার কথা। মায় যখন ক্লাব থেকে বেরিয়ে এসেছিল তখন ওর বস আবারো ওকে কল করে ডাকে। মায়া গেলে মায়াকে একটা পেপার দেয় সাইন করার জন্য। মায়া জিজ্ঞাসা করলে ওর বস জানায় ওদের ওখানে কাজ করলে এটাতে সাইন করতে হয়। মায়াও আর কোনোকিছু না ভেবে ওই পেপারে সাইন করে দেয়। সাইন করা হয়ে গেলে মায়াকে যেতে বলে। মায়াও চলে আসছিল কিন্তু ক্লাব থেকে বেরোনোর আগেই ওর বস আবারো ওর পিছু পিছু ছুটতে ছুটতে আসে আর একটা ফাইল ধরিয়ে দেয় মিস্টার আরমান শাহরিয়ারকে দেওয়ার জন্য।

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ২

মায়া তাড়াতাড়ি ওর হাতে থাকা ব্যাগটা খুলে ফাইলটা বের করে। আর ফাইল থেকে বের করে সেই সাইন করা কাগজ। আর কাগজটা পড়ে দেখতেই মায়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে।

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৪