আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ২২

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ২২
সালমা খাতুন

আজ আরমানের অফিসে একটি বিশেষ আয়োজন ছিল। ডিল ফাইনাল হওয়ার খুশিতে সকল কর্মচারীদের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মিটিং রুমে যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের জন্য আলাদা একটি ঘরে সযত্নে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।
আরমান ও আবির সেই নির্ধারিত ঘরে প্রবেশ করলো। তাদের পেছনে ধীর পায়ে মায়াও এগিয়ে এলো। ঘরের মাঝখানে এক দীর্ঘ ডাইনিং টেবিল। টেবিল জুড়ে বাহারি খাবারের সমারোহ। অধিকাংশ অতিথিরাই এসে বসে পড়েছেন, শুধু অপেক্ষা করছেন আরমান ও মায়ার জন্য। মায়া ভেতরে প্রবেশ করতেই ওই রুমে থাকা সবার চোখ গিয়ে পড়লো মায়ার উপর। মায়া নিজের উপর এতো গুলো চোখের দৃষ্টি একসাথে পড়তে দেখে ভরকে গেলো। আরমানও কিছুটা অবাক হলো সবাইকে একসাথে হঠাৎ মায়ার দিকে তাকাতে দেখে। কিন্তু সকলের এই তাকানোর মানে বুঝতে পারলো না।

এরপর আরমান চুপচাপ এগিয়ে গিয়ে টেবিলের মাথার দিকের চেয়ারে বসলো। মায়া আরমানের বা হাতে কামড় দিয়েছিল। আর আরমান সেই হাত পকেটে ভরে রাখায় কেউ কিছু বুঝতে পারলো না। যদিও কেউ কিছু বুঝলে আরমানের কোনো যাই আসে না, কিন্তু ও চাই না মায়াকে কোনো অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলতে।
টেবিলের ঠিক অপর প্রান্তে বসে আছেন তার বাবা, পাশে রয়েছেন ছোটো আব্বু। সেখানে উপস্থিত আছেন মিস্টার ড্যানিয়েল, তার ব্যক্তিগত সহকারী, আরমানের পিএ মিরাজ, তানিশা ও আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সবাই নিজ নিজ আসনে বসে নিরব প্রতীক্ষায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিস্টার ড্যানিয়েল নিজের পাশের একটি চেয়ার ফাঁকা রেখেছেন—মায়ার জন্য। কাউকে সেখানে বসতে দেননি। এমনকি তার নিজের পিএ যখন ওই চেয়ারটিতে বসার চেষ্টা করলো, তখন তিনি একগাল হেসে, একটু অপ্রস্তুত হয়ে, কষ্ট করে বাংলা উচ্চারণে বলে উঠলেন,“হারে, হেখানে ভসো না ঠুমি, হেখানে মাইহা ভসবে।”
মিস্টার ড্যানিয়েলের কথাটাই যেন মুহূর্তে পরিবেশ বদলে দিল। মায়া রুমে ঢুকতেই সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল তার দিকে। আরমান চোখের ইশারায় পিএ মিরাজকে জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে। মিরাজও চোখের ইঙ্গিতে ড্যানিয়েলের পাশের খালি চেয়ারটির দিকে ইঙ্গিত করল। কিন্তু আরমান কিছুই বুঝে উঠতে পারল না—বুঝল তখনই, যখন মিস্টার ড্যানিয়েল হেসে বলে উঠল,

“হারে মাইহা, হেসো ঘেছো ঠুমি। হাসো, হাসো, হেখানে ভসো।”
ড্যানিয়েল তার পাশের চেয়ারটি দেখিয়ে মায়ার উদ্দেশে কথাগুলো বলল। মুহূর্তেই রাগে আরমানের চোখ লাল হয়ে উঠল। টেবিলটা এক ঝটকায় উল্টে দিতে ইচ্ছে করছিল তার। কেন জানি মিস্টার ড্যানিয়েলের মায়াকে নিয়ে এই বাড়াবাড়ি সহ্য হচ্ছিল না তার। মন চাচ্ছিল ডিলটাই বাতিল করে দেয়, কিন্তু এখন সেটা আর কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

মায়া ড্যানিয়েলের কথা শুনে একবার ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাল আরমানের দিকে। আরমানের লাল চোখে দৃষ্টির তীব্রতা দেখে যেন মায়ার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। সে ভয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলল। তাড়াহুড়ো করে আরমানের পাশের খালি চেয়ারে বসে পড়ল, যেটা তখনো ফাঁকা ছিল। জোর করে একফোঁটা হাসি ঠোঁটে টেনে মায়া বলল,
“আমি এখানেই ঠিক আছি। সবাই বসে আছেন কেন? খাওয়া শুরু করুন।”
মায়ার কথায় মিস্টার ড্যানিয়েলের মুখটা হঠাৎই ছোট হয়ে এল। মন খারাপ করে সে নিজের পাতে খাবার তুলে নিতে শুরু করল। আর এ দৃশ্য দেখে আবির, মিরাজ আর তানিশা মুখ চেপে হাসল।
এদিকে মিস্টার ড্যানিয়েল এর মন খারাপ বেশিক্ষণ টিকলো না। সে খেতে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল, “হেগুলো মাইহার রানহা ঠাই নাহ?”

আবির মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “হ্যাঁ এগুলো মাইহার হাতের রান্না। ও শুধুমাত্র আপনার কথা ভেবে সেই ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে নিজে হাতে রান্না করেছে।”
হয়ে গেলো।‌ মায়া মিস্টার ড্যানিয়েল এর পাশে না বসায় যেটুকু আরমানের মেজাজ শান্ত হয়েছিল সেটুকু আবার তার নিজের জায়গায় পৌঁছে গেলো। রাগে তার হাতে থাকা চামচ শক্ত করে ধরে খাওয়া থামিয়ে দিলো। তারপর চোখ তুলে আবিরের দিকে, কটমট করে তাকালো। যেনো একা পেলো আবির কে পুরো খেয়ে ফেলবে।‌ আবির আরমানের দিকে প্রথমে বোকা বোকা হাসি দিলো। তারপর ভয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে নিজের বের করা বত্রিশ টা দাঁত ঢেকে নিলো। যদিও ও কথাটা আরমানকে জ্বালানোর জন্যই বলেছিল।

ঠিক তখনি এন্ট্রি নিলো মিস দিশা। ও রুমের দরজা খুলে ঢুকে হাসি মুখে বলল, “আমাকে ছাড়াই সবাই খাওয়া শুরু করে দিয়েছেন? আর কংগ্রাচুলেশন স্যার, শুনলাম ডিলটা ফাইনাল হয়ে গেছে?”
মিরাজ হাসি মুখে কিছুটা ব্যাঙ্গ করে দিশা কে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপনি যে আবার এখানে ফিরে আসবেন আশা করিনি, তাই সবাই খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। আর আপনি কি ভেবেছিলেন ডিলটা ফাইনাল হবে না?”
দিশা মিরাজের এমন কথা শুনে প্রথমে চমকে উঠলো। তারপর নিজেকে সামলে বলল, “আরে তা কেন ভাবতে যাবো? অনেক কষ্টে আমাদের মায়া এতো গুলো ডিজাইন রেডি করেছিল। ডিল ফাইনাল না হয়ে আর যাবে কোথায়?”

দিশা‌ কথা গুলো বলতে বলতে মায়ার দিকে এগিয়ে এসেছিল। আর দিশার কথা শেষ হতে না হতেই মায়া, আহহহ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো। সবাই মায়ার চিৎকারে মায়ার দিকে তাকাতেই দেখলো মায়া তার ডান হাত দিয়ে বা হাত ধরে হাতে ফু দিচ্ছে। আর মায়ার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। মুখে দিয়ে আহ উহ শব্দ করছে মায়া। সবাই খাওয়া বাদ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। হঠাৎ করে কি হলো কেউ বুঝলো না। আবির নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে আসলো। আর এদিকে আরমান পাশে বসে থাকাই তাড়াতাড়ি একটা পানির জগের মুখি খুলে মায়ার হাত টেনে নিয়ে তাতে ডুবিয়ে ধরেছে।

তথক্ষণাৎ দিশা কিছুটা ন্যাকামো করে বলে উঠলো, “আরে মায়া, কিভাবে খাবার নিচ্ছো? দেখে নেবে তো? দিলে তো নিজেই নিজের হাতটা পুড়িয়ে। স্যার আপনি ছাড়ুন, আমি দেখছি। মায়া কই হাতটা দাও দেখি।”
শেষের কথা গুলো বলতে বলতে দিশা, মায়া ও আরমানের চেয়ারের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। তারপর মায়ার হাতটা দেখার উদ্দেশ্যে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলো। এইদিকে মিস্টার ড্যানিয়েল ও বিচলিত হয়ে উঠে এসেছে নিজের চেয়ার ছেড়ে।

এই দিকে আরমান দিশার কথায় মায়ার হাত ছেড়ে দিয়ে, নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে আসার সময় ওর পাশে থাকা গরম ধোঁয়া উঠা সুপের বাটিটা টুক করে দিশার দুই পা বরাবর ফেলে দিলো। তারপর আরমান এমন ভাব করলো যেনো এক্সিডেন্টলি ঘটনা ঘটেছে।
আরমান মুখে কোনো অনুভূতি ছাড়ায় বলে উঠলো, “সরি মিস দিশা আমি খেয়াল করিনি। কিভাবে যে বাটিটা পড়ে গেলো।”
আর এইদিকে দিশা দুই পা নিয়ে ক্যাঙ্গারু ডান্স শুরু করেছে। ধোঁয়া ওঠা গরম স্যুপের পুরোটা ওর দুই পায়ে পড়েছে। চিৎকার করে মা গো বাবা গো করছে দিশা।

আসলে আরমান ওটা নিজে থেকেই করলো। কারণ মায়ার হাতে মায়ার পাশে থাকা গরম স্যুপের বাটিটা ইচ্ছে করেই দিশা ফেলেছে। আর তা আরমান নিজের চোখে স্পষ্ট দেখেছে। মায়া ডান হাত খাবার প্লেটে দিয়ে নাড়াচাড়া করছিল অন্যমনস্ক ভাবে, ও কিভাবে খাবে বুঝতে পারছিল না। তখন আরমান ওভাবে ধরায় দাঁতের চাপে কেটে গেছে। এখনো জ্বালা করছে। খাবার খেলে আরো জ্বলবে। এদিকে না খেয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে যাওয়াটাও এতো মানুষের সমানে ভালো দেখাবে না। এটাই ভাবছিল ও অন্যমনস্ক ভাবে। বা হাত টা টেবিলেই উপড়েই রাখা ছিল একটা গরম ধোঁয়া ওঠা স্যুপের বাটির পাশে। আর এই সুযোগ টাই কাজে লাগিয়েছে দিশা। সবার চোখের আড়ালে কথা বলতে বলতে মায়ার দিকে এগিয়ে এসে টুক করে বাটিটা ওর হাতের উপর উল্টে দিয়েছে।
কিন্তু এই দৃশ্য সবার চোখের আড়াল হলেও, আরমানের চোখের আড়াল হয়নি। তাই আরমানও রাগে ক্ষোভে আর ধরে রাখতে পারেনি নিজেকে। ঠান্ডা মাথায় মায়ার হয়ে প্রতিশোধ তুলে নিলো ও একই ভাবে গরম স্যুপের বাটি দিশার পায়ে ফেলে।

এদিকে দিশা তখন পা ধরে মেঝেতে বসে কাঁদছে। আবির আরমানকে হাড়ে হাড়ে চেনে। তাই ওর বিষটা বুঝতে সময় লাগেনি। সবাই অবাক হয়ে দিশার দিকে তাকিয়ে আছে। কি থেকে কি হলো বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছে। আর এই দিকে মায়াও নিজের হাতের জ্বলন ভুলে অবাক হয়ে একবার দিশার দিকে তাকাচ্ছে তো একবার আরমানের দিকে তাকাচ্ছে। আরমান যে নিজে থেকেই গরম স্যুপের বাটিটা দিশার পায়ে ফেলেছে সেটা মায়া খেয়াল করেছে। তাই ও এতো অবাক হওয়ার কারণ।
আবির একটা পানির জগ নিয়ে মেঝেতে বসে কান্নারত দিশার পায়ে ঢেলে দিলো। কিছুটা উপর থেকে এভাবে পানি ঢালায় দিশার লাল টকটকে হয়ে যাওয়া পা টা আরো জ্বলে উঠলো। আর চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো দিশা।
আরমান মিরাজ কে উদ্দেশ্য করে বলল, “মিরাজ উনাকে এখান থেকে নিয়ে যাও। উনার পায়ে মেডিসিন লাগানোর ব্যবস্থা করো।”

মিরাজ মুখ কাচুমাচু করে বলল, “কিন্তু স্যার আমি উনাকে কিভাবে নিবে যাবো? আমার মনে হয়না উনি হাঁটতে পারবেন ঠিক মতো?”
আরমান ভীষন বিরক্ত হলো। আবির বলল, “আরে মিরাজ বাইরে থেকে কাউকে ডেকে সাহায্য নাও।”
মিস্টার ড্যানিয়েল:- “হারে মাইহার হাটেও টো মিডিসিন লাঘাতে হুবে।”
আবির এবার নিজের মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমি মায়ার ব্যাপার টা দেখছি মিস্টার ড্যানিয়েল। আপনি আমাদের গেস্ট। বেশি চিন্তা না করে লাঞ্চ টা শেষ করুন। মায়া চলো আমার সাথে।”
এরই মধ্যে মিরাজ দুজনকে মেয়েকে ডেকে নিয়ে এসেছে দিশা কে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তারা অনেক কষ্ট দিশাকে ওখান থেকে তুলে নিয়ে গেলো। দিশার পায়ে অনেক জায়গায় ফোসকা পড়ে গেছে এরই মধ্যে। অনেক কষ্টে বেচারি কোনো মতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দুইজনের সাহায্য উঠে গেলো। এরপর তানিশা মায়া গায়ে হাত দিয়ে বলল, “চলো মায়া তোমার হাতেও মেডিসিন লাগাতে হবে।”

মায়া তখনো অবাক। ওর হাতেও কিছুটা জায়গায় ফোসকা পড়ে গেছে। তখনো ওর হাত জ্বালা করাই নিঃশব্দে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কিন্তু আরমান এমনটা করবে কখনো ভাবতে পারিনি ও। ও নিজেও বুঝতে পেরেছে যে দিশা কাজটা ইচ্ছে করে করেই করেছে। কিন্তু আরমান যে সেটার এমন ভাবে প্রতিশোধ নেবে ভাবতে পারেনি মায়া।
আবির মায়াকে এভাবে অবাক হয়ে ভাবতে দেখে বলল, “কি হলো মায়া? কি ভাবছো? চলো।”
আবিরের কথায় মায়া একবার আবিরের দিকে তাকিয়ে আবারও আরমানের দিকে তাকালো। আরমান গম্ভীর গলায় বলল, “মিস মায়া, যান আবিরের সাথে গিয়ে হাতে মেডিসিনটা লাগিয়ে নিন।”
মায়া একটা শুকনো ঢোক গিলে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। মিস্টার ড্যানিয়েল বলে উঠলো, “হামিও ঝাই।”
আরমান কিছু বলবে তার আগেই আবির নিজেই গম্ভীর গলায় বলল, “না মিস্টার ড্যানিয়েল। বললাম তো আপনি আমাদের গেস্ট। তাই আপনাকে এই নিয়ে ভাবতে হবে না। খাওয়াই মনোযোগ দিন। সকলে নিজেদের খাওয়া কন্টিনিউ করুন। মায়া চলো।”

মায়া একবার আরমানের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। পিছু পিছু তানিশা আর আবিরও গেলো। মিস্টার ড্যানিয়েল তখনো মায়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে। উনার ইচ্ছে ছিলো নিজে হাতে মায়ার হাতে ঔষধ লাগিয়ে দেওয়ার। কিন্তু তা আর হলো না। তাই উনার মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
আরমান মিস্টার ড্যানিয়েল এর উদ্দেশ্যে বলল, “Mr. Daniel, please sit down and continue eating.”
মিস্টার ড্যানিয়েল:- “Yes mister Harman.”
বলেই উনি মন খারাপ করে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে খাওয়া শুরু করলো। বাকি সকলেও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে যে যার চেয়ারে বসে খাওয়াই মনোযোগী হলো।

আরমানের অফিসের বিশাল হল রুমটা তখন টানটান উত্তেজনায় ভরা। অফিসের সকল কর্মচারী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তাদের বসের জন্য। দুপুরের লাঞ্চের পরপরই ছুটি দেওয়ার কথা ছিল আজ, বিশেষ এক উদ্‌যাপনের দিন বলেই অফিস থেকেই সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ডিলটা সাকসেসফুল হওয়ায় সকলে খুশির আবহে ডুবে ছিল। মিস্টার ড্যানিয়েল লাঞ্চ শেষ করেই বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু সেই আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।
হঠাৎ করেই ছড়িয়ে পড়ল একটা খবর—আরমান স্যার নাকি সবার উপস্থিতি চেয়েছেন হল রুমে, জরুরি একটি মিটিং ডেকেছেন তিনি। কারও বুঝে উঠতে দেরি হলো না যে, কিছু একটা গুরুতর হয়েছে।
এই কথা ছড়িয়ে পড়তে দেরি হলো না—ডিজাইনের আসল ফাইল নাকি গায়েব হয়ে গেছে! কেউ একজন চুপিচুপি আসল ফাইলটি সরিয়ে তার জায়গায় নকল একটা ফাইল রেখে দিয়েছে। এমন এক ভয়ঙ্কর খবর যেন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল পুরো অফিসে।

সেই থেকেই গোটা হল রুম ফিসফাসে ভরে উঠেছে। কে করল? কেন করল? কি হবে এখন?—এইসব প্রশ্নে সবাই মুখে মুখে কথা চালাচ্ছে, কিন্তু কণ্ঠ নিচু, যেন কেউ শুনে না ফেলে।
ঠিক তখনই মুহূর্তের মধ্যে হল রুমটা একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। সকলের গুঞ্জন থেমে গেল আচমকাই। চোখ ঘুরে গেল দরজার দিকে। বিশাল হল রুমের বড়ো দরজাটা দিয়ে প্রবেশ করল আরমান—প্রতিবারের মতোই বস্তাভর্তি অ্যাটিটিউড নিয়ে, মাথা উঁচু করে, এক অদ্ভুত দৃঢ়তা ও তীক্ষ্ণ গাম্ভীর্য নিয়ে। মুখ তার যেন পাথরের মতো কঠিন—কোনো আবেগ নেই, নেই কোনো হাসির রেখা।

তার ঠিক পেছনে পেছনে প্রবেশ করল আবির, মিরাজ আর মায়া। আবিরের মুখেও গম্ভীর ছায়া। মিরাজ স্বভাবমতো চুপচাপ, আর মায়ার চোখে মিশ্র অনুভূতির প্রতিচ্ছবি—আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা, আর একটা অজানা আশঙ্কা।
আরমান দৃপ্ত ভঙ্গিতে সবার সামনে হেঁটে এসে নির্দ্বিধায় নিজের জন্য নির্ধারিত চেয়ারটায় বসে পড়ল—পায়ের উপর পা তুলে একেবারে সেই পরিচিত আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে। যেন তার উপস্থিতিই সকল প্রশ্নের উত্তর, সকল অনিশ্চয়তার ইতি।
আবির, মায়া আর মিরাজ নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়াল আরমানের পাশে—তাদের মুখে কোনো শব্দ নেই, চোখেমুখে চাপা উত্তেজনা, যেন কেউ শ্বাস নিতে ভুলে গেছে। হল রুমের পরিবেশ তখন এতটাই নিস্তব্ধ যে কারও শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত স্পষ্ট শোনা যায়।
সেই নিস্তব্ধতা ছিন্ন করে মুহূর্তের মধ্যে গমগম করে উঠল আরমানের গলা। তার কণ্ঠে ছিল এমন এক গম্ভীর, কঠিন আর ধ্বংসাত্মক সুর, যেন কোনো শাসকের শেষ নির্দেশ!
“ফাইলটা কে সরিয়েছে?”

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ২১

শব্দগুলো যেন বুলেট হয়ে ছুটে গেল চারদিক দিয়ে, বাতাসে কেঁপে উঠল নিঃশব্দ দেয়ালগুলোও।
সেই একমাত্র বাক্যে রুমজুড়ে যেন একটা অদৃশ্য ভূমিকম্প বয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য সবাই জমে গেল—নড়াচড়া বন্ধ, চোখের পাতা ফেলাও যেন নিষিদ্ধ।
প্রতিটা কর্মচারীর মুখ থেকে রং সরে গেল, বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে গেল দ্বিগুণ। কেউ কারও চোখে তাকাতে পারছে না, কেউ কেউ ঘাড় নিচু করে ফেলেছে, আবার কেউ কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সহকর্মীর দিকে ফিসফিস করে তাকাচ্ছে—কিন্তু কেউ সাহস করছে না উত্তর দেওয়ার।
আরমান তখনো ঠান্ডা, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টিতে আগুন। তার শরীর নিথর, অথচ চারপাশে যেন বিস্ফোরণের পূর্বক্ষণ।

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ২৩