আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ২৩

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ২৩
সালমা খাতুন

নির্বিকার, সদাহাস্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ আবিরের গলায় হঠাৎ করে এক গম্ভীর সুর ধ্বনিত হলো। গোটা কনফারেন্স রুম মুহূর্তেই যেন থমকে গেল।
আবির বলল, “আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, এই ডিলটা আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দীর্ঘ এক সপ্তাহ ধরে আমাদের ডিজাইন টিম, বিশেষ করে সব ডিজাইনার, দিন-রাত পরিশ্রম করে ফাইনাল ফাইলটি তৈরি করেছিল। প্রতিটি ডিটেইলে ছিল নিখুঁত যত্ন। সেই ফাইলটাই আজ হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেল। যেটা ছিল আমাদের হেড ডিজাইনার মায়ার কেবিনে।”

তার চোখদুটো কঠিন হয়ে উঠল। কথার ধার যেন আরও তীক্ষ্ণ হলো।
“গত রাতে মিস মায়া এবং মিস তানিশা মিলে সবকিছু চেক করে কেবিনটি নিজ হাতে লক করেছিলেন। নিশ্চিন্ত ছিলেন, ফাইল নিরাপদে আছে। আর আজ মিটিংয়ের সময় যখন ফাইলটি খোলা হলো, দেখা গেলো তার ভেতরে কেবল সাদা কাগজ। ডিজাইনের নামগন্ধ নেই। অথচ ফাইলটা দেখতে ছিল ঠিক আগের মতোই। তার মানে স্পষ্ট—কেউ ইচ্ছে করে আসল ফাইল সরিয়ে, একদম একই রকম দেখতে ফাইল রেখে গেছে। এই কাজ বাইরের কেউ করতে পারে না, অফিসের কারো পক্ষেই এটা সম্ভব।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর আবিরের কণ্ঠে শুনতে পাওয়া গেল দৃঢ় সতর্কবাণী—
“তাই বলছি, যিনি এটা করেছেন, অনুগ্রহ করে নিজে থেকেই সামনে আসুন। তাতে হয়তো কিছুটা ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ থাকবে। কিন্তু যদি আমাদের খুঁজে বের করতে হয়, তাহলে তার শাস্তি হবে ভয়াবহ। আমরা কোনো আপোস করবো না।”
আবিরের এই রূপ কেউ কখনো দেখেনি। গোটা হল ঘর জুড়ে এক অদ্ভুত ভারী নীরবতা। নীরবতা ভেদ করে কেবল ফিসফিস শব্দ—
“কে হতে পারে?”
“কেনই বা করবে এমন কাজ?”
“এই ডিলটা তো আমাদের সবার ভবিষ্যতের প্রশ্ন…”

সবার চোখে স্পষ্ট ভয়। তারা জানে, আরমান স্যারের রাগ কতটা ভয়ানক হতে পারে, বিশেষ করে এমন একটি সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে। পুরো অফিসের এক সপ্তাহের অমানুষিক পরিশ্রম, একেকটা ডিজাইনের প্রতিটি লাইনের পেছনে ছিল নির্ঘুম রাত, চাপ, এবং এক অদম্য ইচ্ছা—এই ডিলটা জেতার।
আর আজ, যখন সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম, তখন আশার আলো হয়ে উঠলেন মায়া।
হ্যাঁ, মায়ার বুদ্ধিমত্তার জন্যই আজ বেঁচে গেছে দলটি। প্রতিটি ডিজাইনের কপি ও আলাদা করে সংরক্ষণ করেছিলো—একটি ফাইলে। আর হারিয়ে যাওয়া ফাইল টা ছিল সেই কপি ফাইল।‌ ঠিক সময়ে মায়া তুলে ধরে আসল ফাইল, যার জন্য কাস্টমারদের সামনে তারা তুলে ধরতে পেরেছে প্রকৃত কাজটি।
ডিলটি তারা পেয়েছে, ঠিকই। কিন্তু সেই বিজয়ের আনন্দে নেই উচ্ছ্বাস, নেই হাসির ছোঁয়া। আছে কেবল শঙ্কা, সন্দেহ আর এক ভয়াবহ প্রশ্ন—

“দলটার মধ্যেই কেউ একজন বিশ্বাসঘাতক!”
মায়া এতোক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। হল রুমের প্রতিটি মানুষের ফিসফিস আওয়াজ যেনো সেই মুহূর্তে ধারাল ছুরির মতো মায়ার শরীরে এসে বিঁধছিল। আবিরের কথাগুলো যেন চারদিকের বাতাসকে ঘন করে তুলেছিল, ঘরটা ভারী হয়ে উঠেছিল সন্দেহ, শঙ্কা আর চাপা উত্তেজনায়।
তবে তার বুকের ভেতর চলছিল একেবারে ভিন্ন এক যুদ্ধ। হেড ডিজাইনার মায়া—চিরশান্ত, কাজপাগল, ঠাণ্ডা মাথার মানুষ—এই মুহূর্তে নিজের ভেতরে অনুভব করছিল এক অদ্ভুত রকম চাপ।
হ্যাঁ, ডিলটা তারা পেয়েছে। নিজের সেই শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্ত—প্রতিটি ডিজাইনের ব্যাকআপ আলাদা করে রাখা—তা আজ তাদের রক্ষা করেছে। কিন্তু এতে কি হৃদয়ের ভার কিছুটা হালকা হয়েছে? মোটেই না।
তার ভেতরে এক জ্বালা জ্বলছিল। যন্ত্রণার সেই নাম ছিল “বিশ্বাসভঙ্গ”।

এই অফিস, এই টিম—এখানে প্রতিটি মানুষকে মায়া জেনেছে, বুঝেছে, ভালোবেসেছে। সবার সাথে শেয়ার করেছেন প্রতিটি সৃষ্টির আনন্দ। অথচ এই টিমের মাঝেই লুকিয়ে আছে কেউ, যে কিনা সবকিছুকে পেছন থেকে ছুরি মেরেছে।
মায়ার চোখ পড়লো আশেপাশে থাকা সহকর্মীদের দিকে। সকলেই মাথা নিচু করে একে অপরের সাথে ফিসফিস করে কথা বলতে ব্যস্ত, সবার মুখেই আছে কিছুটা ভয়, আতঙ্ক। প্রত্যেকেই যেন নিষ্পাপ, আবার প্রত্যেকেই যেন সম্ভাব্য সন্দেহভাজন।
মায়া অনুভব করল, এক গভীর শূন্যতা বুকের ভেতর জমাট বাঁধছে। তার সবচেয়ে আপন জায়গাটা—তার টিম, তার সহযোদ্ধারা—তাদের মধ্যেই আজ একটা দেয়াল তৈরি হয়ে গেল। সেই দেয়ালের ও পার থেকে আর সহজে কারো চোখে চোখ রাখা যাবে না।
কিন্তু তবুও…

মায়া জানে, এখন ভেঙে পড়ার সময় নয়। এখন নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রেখে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার সময়। কারণ সেই বিশ্বাসঘাতক যদি ধরা না পড়ে, তবে এই বিষ একদিন পুরো দলটাকেই নিঃশেষ করে দেবে।
মায়ার চোখদুটো ছিল স্থির, কণ্ঠস্বর শান্ত, কিন্তু তাতে এমন এক দৃঢ়তা ছিল যা প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয়ে ধাক্কা দিলো। ও কাউকে উদ্দেশ্য করে কথা বলেনি, অথচ প্রত্যেকেই বুঝে গেল—এই কথা তার জন্যও।
মায়া বলল—“আমি জানি, আমরা সবাই একসঙ্গে খুব কঠিন একটা সপ্তাহ পেরিয়েছি। রাত জেগে, চাপ সহ্য করে, একসঙ্গে কাজ করেছি আমরা। কারণ আমরা একটা টিম। একটা স্বপ্ন নিয়ে আমরা এগিয়েছিলাম, যেন নিজেদের সেরাটা দিতে পারি।”

ওর কণ্ঠ কিছুটা থেমে গেল, চোখ বুলিয়ে নিলো চারপাশে থাকা চেনা মুখগুলোর দিকে। তারপর আবারও বলল—
“কিন্তু আজকে যা ঘটেছে, সেটা শুধু একটা ভুল নয়। সেটা একটা ইচ্ছাকৃত আঘাত। কোনো বাইরের মানুষ এসে ফাইল বদলে দেয়নি। কেউ একজন—আমাদের ভেতর থেকেই—এটা করেছে। সেই মানুষটা শুধু একটা ডিজাইন চুরি করেনি, সে চুরি করেছে আমাদের বিশ্বাস। আমাদের একে অপরের ওপর নির্ভর করার জায়গাটা।”
মায়ার চোখের দৃষ্টিটা তখন যেন একটু কঠিন হয়ে উঠল। ও সরাসরি কারোর দিকে তাকালো না, তবু যেন তার কথাগুলো এক অদৃশ্য ছায়ামূর্তির দিকে সোজা ছুটে গেল—

“আপনি জানেন আপনি কে। আপনি জানেন, আপনি এটা ইচ্ছা করেই করেছেন। আমি জানি না, আপনি কাকে আঘাত করতে চেয়েছেন—আমাকে? টিমকে? না পুরো কোম্পানিকে। কিন্তু যেটাই হোক, আপনি হয়তো ভুলে গেছেন, আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করি, আপনারও হয়তো পরিশ্রম ছিল ওই ফাইল রেডি করার পেছনে। আপনি এক হিংসার নেশায় হয়তো নিজের পরিশ্রমের কথাটাও ভাবলেন না।
মনে রাখবেন বিশ্বাস কিন্তু একবার ভাঙলে, সেটা আর আগের মতো জোড়া লাগে না।”
এক মুহূর্ত থেমে মায়া নিঃশ্বাস নিলে, তারপর শেষ কথাগুলো উচ্চারণ করল গম্ভীর সুরে—

“আপনি যদি সাহস দেখাতে চান, তাহলে সামনে এসে সত্যি বলুন। ভুল মানুষই করে, কিন্তু নিজের দায়িত্ব স্বীকার করার সাহস সবাই রাখে না। আপনি সেই সুযোগ এখনও হারাননি। এখনো সময় আছে—নিজেকে সরিয়ে না রেখে, সত্যিটা স্বীকার করার। নইলে মনে রাখবেন, সত্য কোনোদিনও চাপা পড়ে না। ঠিকই বেরিয়ে আসে। আর সেদিন আপনার মুখটা যেমন আমাদের সামনে আসবে, তেমনি আপনার আসল চেহারাটাও।”
পুরো হল রুম তখন পাথরের মতো স্তব্ধ। যেন প্রত্যেকেই নিজের ভেতরটা ছুঁয়ে দেখছে—আমি কি তবে সেই সন্দেহের ছায়ায় আছি? আর যিনি সত্যিই দোষী, তার হৃদয়ে তখন হয়তো এক কাঁপুনি, এক অস্থিরতা, সে ভাবছে—“মায়া কি জানে?… কিছু না কিছু সে ঠিকই জানে।”

নাহ… এত কিছু ঘটার পরেও সেই অজ্ঞাত ব্যক্তি সামনে এলো না। যেনো কোনো কিছুর তোয়াক্কা নেই তার। হয়তো তার আত্মবিশ্বাস এতটাই প্রবল, সে ভাবছে—কাজটা সে এমন নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করেছে যে তাকে চিহ্নিত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বাহ্যিক দৃষ্টিতে যতই হুমকি ধামকি আসুক, যতই প্রশ্ন উঠুক—কেউ কখনো জানতে পারবে না, এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে সে রয়ে গেছে।

রুমজুড়ে থমথমে এক নিঃশব্দ পরিবেশ। হলঘরে একদিকে সবাই নীরব, অন্যদিকে গাঢ় চিন্তায় ডুবে থাকা আরমান পায়ের ওপর পা তুলে গম্ভীর মুখে বসে আছে। তার চোখেমুখে স্পষ্ট এক ধরনের জেদ ও দৃঢ়তা। মায়া যখন দৃঢ় কণ্ঠে নিজের বক্তব্য রাখছিল, তখন আরমানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন রেডারের মতো একেকজনের মুখের উপর দিয়ে সরে যাচ্ছিল—ধীরে ধীরে, নিখুঁতভাবে। রুমে উপস্থিত প্রতিটি মানুষ সেই দৃষ্টি টের পাচ্ছিল। আর সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টির স্পর্শ যার চোখে লাগছিল, সে যেন কেমন করে মাথা নিচু করে ফেলছিল; এক ধরনের অপরাধবোধ অথবা আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিতে। যেন বোঝাতে চাইছিল—“আমি নই, আমি নির্দোষ… আমি কিছুই জানি না।”
মায়ার কথা শেষ হতেই, আরমান আবার একবার রুমজুড়ে চোখ বুলিয়ে নিলো। তার দৃষ্টি এবার আরও দৃঢ়, আরও অনড়। হঠাৎ করেই সে আবিরের দিকে তাকিয়ে মৃদু একটা ইশারা করলো। সেই ইশারার ভাষা আবির ভালো করেই বুঝে নিলো। গম্ভীর কণ্ঠে সে দাঁড়িয়ে বলল,

“ঠিক আছে… এত কিছু বলার সত্ত্বেও অপরাধী যদি সামনে না আসে, তাহলে এবার আমাদের নিজের পথেই হাঁটতে হবে। আমরা আমাদের মতো করেই খুঁজে বের করবো—কে এর পেছনে আছে।”
আবিরের কণ্ঠে কোনো উত্তেজনা ছিল না, ছিল কেবল দৃঢ়তা। কথা শেষ করেই সে ঘুরে দাঁড়িয়ে অফিসের সিকিউরিটি রুমের দায়িত্বে থাকা দুইজন কর্মীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ টা বের করুন। এখনই আপনারা আপনাদের কাজ শুরু করুন।”

ঘরজুড়ে আবারও ছড়িয়ে পড়ল এক অদৃশ্য আতঙ্কের স্রোত। চাপা উত্তেজনা যেন হঠাৎই নিঃশব্দ বিস্ফোরণের মতো আঘাত হানলো উপস্থিত সকলের মনে। কারও মুখে আর কোনো শব্দ নেই—শুধু হৃদস্পন্দনের শব্দ যেন ক্রমশ গাঢ় হয়ে উঠছে। কেবল অনুভব করা যাচ্ছে, সময় থমকে গেছে এক অজানা রহস্যের সামনে দাঁড়িয়ে। কারণ, এখন খেলার নিয়ম আরমান ও তার টিমের হাতে। বাকিরা কেবল দর্শক।
অল্প কিছু সময় পর, সিকিউরিটি রুমের একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফুটেজ খুলে দেখায় বিশাল স্ক্রিনে। সকলের দৃষ্টি আটকে গেল সেই দৃশ্যের ওপর।
ফুটেজে দেখা গেল—রাতের কোনো এক নিস্তব্ধ সময়, এক নারী—শাড়ি পরা, অথচ সারা শরীর চাদরে মুড়ে রাখা—চুপচাপ প্রবেশ করছে সিকিউরিটি কন্ট্রোল রুমে। তার চলনে ছিল অসাধারণ সাবধানতা, যেন প্রতিটি পদক্ষেপ আগে থেকেই হিসেব করে রাখা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পষ্ট দেখা যায়—রুমের দায়িত্বে থাকা দুইজন নিরাপত্তাকর্মী অচেতন হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। নিঃশব্দে ছায়ার মতো নড়াচড়া করতে করতে নারীটি এগিয়ে গেল কম্পিউটার টার্মিনালের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে, নিখুঁত দক্ষতায় তার আঙুলগুলো চলতে লাগলো কিবোর্ডে। তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়—সে নির্দিষ্ট কিছু সিকিউরিটি ফুটেজ, বিশেষ করে নিজের প্রবেশের মুহূর্তগুলো, একে একে মুছে দিচ্ছে। যেন কখনো সে সেখানে ছিলই না।
তবে এখানেই শেষ নয়।

কাজ শেষ করেই, কোনোরকম তাড়াহুড়ো ছাড়াই সে আবার দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায়। চাদরে মোড়া মুখটি তখনো অদৃশ্য—একটুকুও দৃশ্যমান নয়, যেন ছায়া হেঁটে যাচ্ছে করিডোরজুড়ে।
পরবর্তী ফুটেজে দেখা যায়—সে সোজা গিয়ে দাঁড়ায় মায়ার কেবিনের সামনের করিডোরে। মুহূর্তের মধ্যেই সে করিডোরের লাইট সুইচ অফ করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ ডুবে যায় গাঢ় অন্ধকারে—এক রহস্যময় কুয়াশা যেন সমস্তটা ঢেকে ফেলে। এরপর আর কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না। সবকিছু যেন নিঃশেষ হয়ে যায় অন্ধকারের চাদরে।
রুমের মধ্যে নিস্তব্ধতা চেপে বসে আরও গভীরভাবে। কারও নিঃশ্বাস ফেলার শব্দও যেন কানে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। শুধু মাত্র আরমান বাদে রুমে থাকা প্রত্যেকটি ব্যাক্তি গভীর মনোযোগে ফুটেজের প্রতিটি ফ্রেম পর্যবেক্ষণ করে।
ফুটেজের সেই রহস্যময় দৃশ্য শেষ হতেই রুমজুড়ে আবারও ছড়িয়ে পড়লো এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। কেউ কিছু বলছে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে যেন সবার মনে একটাই প্রশ্ন ঘূর্ণি তুলে দিচ্ছে—কে সেই নারী?

ধীরে ধীরে, মায়ার টিমে কাজ করা প্রতিটি ডিজাইনারের চোখ একে একে ঘুরে গেল রুমের এক কোণায় থাকা হুইলচেয়ারে বসে থাকা দিশার দিকে। যেন অজান্তেই সকল সন্দেহের তীর ঠিক তাক করল তার দিকেই।
দিশা প্রথমে বুঝে উঠতে পারছিল না কী ঘটছে। কিন্তু যখন টের পেল যে একে একে সবার চোখ তার দিকেই নিবদ্ধ, তখন তার শরীরটা মুহূর্তেই ঠান্ডা হয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখলো, আবার নিজের হাত জড়ো করে বসে রইলো—কিন্তু সেই দৃষ্টি থেকে রেহাই নেই।

তার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠলো, কপাল বেয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে পড়তে লাগল। ওর চোখে তখন একটা ভীত-ভীত ভাব—যেন কেউ ওকে অন্ধকারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, আর আলোটা একদম ওর মুখের ওপর ফেলে রেখেছে।
হাত কাপছে, ঠোঁট কাঁপছে—একটা রুমাল বের করে হাত কাঁপতে কাঁপতেই কপালের ঘাম মুছে নিলো সে। তারপর আমতা আমতা করে, গলায় আতঙ্ক মেশানো এক ব্যাকুলতায় বলল,

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ২২

“তো… তোমরা… আমার দিকে এভাবে তা… তাকাচ্ছো কেন? ওটা… ওটা আমি না… আমি না…”
তার কণ্ঠে ছিল না কোনো জোর, বরং ছিল ভাঙা বিশ্বাস আর প্রচণ্ড অস্থিরতা। কথাগুলো যেন তার নিজেরও বিশ্বাস হচ্ছিল না—বা হয়তো, সে চাইছিল সবাই বিশ্বাস করুক, যে সে নির্দোষ।
রুমজুড়ে তখনও কারও মুখে কোনো শব্দ নেই। শুধু দিশার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ আর অনিশ্চিত দৃষ্টি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল চারপাশে।

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ২৪