আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৩৮

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৩৮
সালমা খাতুন

না আবিরের কোনো কথায় পাত্তা দিলো না আরমান। নিজের মনে সই করে উঠে দাঁড়ালো। এদিকে পুরো হলে তখন যেনো ঝড় চলছে। সকল মানুষের একে অপরের সাথে ফিসফিস করছে। সবাই যেনো একটা বড়ো রকমের ধাক্কা খেলো।
আরমান উঠে দাঁড়িয়ে পেন টা পাশে থাকা আয়ানের দিকে বাড়িয়ে দিলো।
আরমান— “নে, সই কর।”
আয়ান কিছু না বলে পেনটা হাতে নিয়ে মাইশার পাশে বসে পড়ল। কোনো দ্বিধা, কোনো প্রশ্ন, কোনো ভয়—কিছুই ছিল না ওর চোখে। নিঃশব্দে সই করল রেজিস্ট্রি পেপারে। তারপর উঠেও দাঁড়াল নিঃশব্দে। ওদিকে এখনো রাগে তেতে আছে আবির। চারজন গার্ডে ওকে ধরে রেখেছে। তার মাঝেই আরমানের বাবা ও চাচা সাক্ষী হিসেবে সই করলেন কাগজে।

হলরুমজুড়ে তখন এক রকম হুলস্থূল পরিস্থিতি। মিডিয়ার লোকেরা একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে। ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝলকে চারদিক যেন জ্বলজ্বল করছে। ঠিক তখনই আরমান এগিয়ে এল সবার মাঝখানে। এক হাতে তুলে নিল মাইক্রোফোন। চোখে ছিল অদ্ভুত এক দৃঢ়তা। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলতে শুরু করল—
“Good evening everyone. Please stay quiet for a moment. আপনাদের সকলকে আমার জীবনের সত্যিটা জানানোর জন্যই আজ এখানে ডাকা হয়েছে। তাই একটু ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনুন।”
তার গলার গভীরতা, স্বরের দৃঢ়তায় পুরো হলরুমটা হঠাৎ করেই স্তব্ধ হয়ে গেল। কৌতূহল, বিস্ময় আর অজানা আশঙ্কায় সবাই তাকিয়ে রইল আরমানের দিকে।
আরমান আবারও বলতে শুরু করল, এবার একটু ধীর হয়ে—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমি আরমান শাহরিয়ার। বিবাহিত। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন আপনারা—আমি বিবাহিত, তবে আজকের এই মুহূর্ত থেকে নয়। দেড় বছর আগে, আমার দাদুর চাপে পড়ে আমি বিয়ে করি মায়া তালুকদারকে। যাকে আপনারা কিছুক্ষণ আগে দেখেছেন—মাইশার চাচাতো বোন।
কিন্তু সেই বিয়ে আমি কখনো মন থেকে মেনে নিইনি। কারণ আমার হৃদয় তখনও অন্য কারো জন্য ব্যাকুল ছিল। আমি মায়াকে স্ত্রী হিসেবে কখনোই গ্রহণ করতে পারিনি। ওর মুখটা পর্যন্ত দেখতে চাইনি। বিয়ের পরদিনই ওকে ওর বাবার বাড়িতে রেখে এসেছিলাম। শুধুমাত্র মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাতাম, ভরনপোষণের জন্য। কিন্তু আজ জানলাম, সেই টাকাও কখনো ছোঁয়নি মায়া।

ছয় মাস পর আমার দাদু মারা গেলেন। আর তার ঠিক ছয় মাস পর আমি পাঠালাম ডিভোর্স লেটার—মায়ার বাড়িতে। সঙ্গে কিছু টাকা। কিন্তু মায়া সেই কাগজে সই করে, টাকা সহ সব কিছু ফেরত পাঠাল।
আমি মায়াকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে ছিলাম, আমার ভালোবাসা, আমার আসক্তি, পিচ্চি মায়াবতীর জন্য। এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগবে যে এই পিচ্চি মায়াবতী টা আবার কে? চলুন এই পিচ্চি মায়াবতীর পরিচয় দিই।
ওর নাম কিন্তু পিচ্চি মায়াবতী নয়, এই নাম আমার দেওয়া। ওকে আমি এই নামেই ডাকতাম। আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে, বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে একটা ছোট্ট দুর্ঘটনার শিকার হই আমি। ঠিক তখনই, এক নয়-দশ বছরের মেয়ে আমার সামনে আল্লাহর ফেরেশতার মতো হাজির হয়েছিল। আমাকে গাড়ি থেকে টেনে বের করে আনে।
সেই ক্ষণিকের দেখাতেই ওর মুখটা আমার হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল। আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম ওকে। একটা বাচ্চা মেয়েকে, সে জানতেও পারেনি, কী গভীর ছাপ ফেলে গেছে আমার মনে।
আমি সুস্থ হয়ে উঠলেও ওর খোঁজ পাইনি আর কখনো। শুধু মনে ছিল ওর স্কুল ড্রেসের নেম প্লেট—‘মাইশা তালুকদার। ক্লাস সেভেন।’

দুর্ঘটনার সময় ওর ড্রেসের সেই নেমপ্লেটটা আমার হাতে এসে পড়েছিল। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর আমার জিনিসপত্রের সঙ্গে সেটাও দেওয়া হয়েছিল বাড়িতে। কিন্তু আমি তখন ভুলেই গিয়েছিলাম ওই নেম প্লেটটির কথা।
এরপর বহু বছর ধরে আমি খুঁজেছি তাকে। পাইনি কোথাও। আর সেই না-পাওয়ার যন্ত্রণায় আরও গভীরভাবে মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম আমার ‘পিচ্চি মায়াবতী’র প্রতি।

আমি সুস্থ হয়ে ওঠার পর ওই মেয়েটিকে অনেক খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। এরপর দেড় বছর আগে দাদুর জোড়াজুড়িতে বিয়ে করতে হয় মায়াকে। কিন্তু তখনও আমি ভুলে পারিনি সেই বাচ্চা মেয়েটিকে। আমার পিচ্চি মায়াবতীকে। গভীর ভাবে আসক্ত হয়ে পড়ে সেই পিচ্চি মায়াবতীর প্রতি। আর তার কারণেই মায়াকে মেনে নিইনি আমি। বিয়ের দিন আবছা দেখেছিলাম মায়াকে, কিন্তু আজ বলতে দ্বিধা নেই, সেই আবছা মুখ আমাকে একটি রাতও শান্তিতে ঘুমাতে দেয়নি। ঠিক একই রকম ভাবে, মানে পিচ্চি মায়াবতীর এবং মায়ার মুখ ভেসে উঠতে আমার চোখের সামনে। রাগ হতো নিজের উপর। ভীষণ ভাবে বিভ্রান্ত হতাম আমি। নয় বছরের ভালোবাসা পিচ্চি মায়াবতী আর কিছুদিনের বিয়ে করা বউ মায়া। সবকিছু এলোমেলো লাগতো। ভীষণ ভাবে মায়ার ওই মুখ বিরক্ত করতো আমায়। প্রতিটা রাতে ঘুমাতে গেলে ভেসে উঠত মায়ার মুখ। কিন্তু আমি ভালোবাসি আমার পিচ্চি মায়াবতীকে। আর এই কারণেই একটু একটু করে রাগ জমতে থাকতো মায়ার উপর। এইভাবেই কেটে যাই একটা বছর।

হঠাৎই একদিন আমার ড্যাডের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। মায়াকে নিয়ে। ড্যাড বলে, আমি কেন এই ভাবে মায়াকে তার বাবার বাড়িতে রেখেছি? হয় ওকে এই বাড়িতে নিয়ে এসে ওর প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দিই নাহলে একেবারের জন্য ছেড়ে দিই। এই নিয়ে অনেক কথা কাটাকাটি হয় আমার ড্যাডের সাথে। রাগের মাথায় আমিও সিদ্ধান্ত নিই মায়াকে ডিভোর্স দেবো। তাই রাগের মাথায় মায়ার বাড়িতে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিই। ডিভোর্স পেপার পাঠালেও আমি কিন্তু ওই পেপারে সাইন করে দিইনি। প্রথম সাইন মায়াই করেছিল। তারপর মায়া ওই পেপার সহ আমার দেওয়া সমস্ত টাকা ফেরত পাঠাই। আবির নিয়ে এসে আমাকে দেয় ওই পেপার। আমি কিছুটা অবাক হয়ে ছিলাম মায়ার সাইন দেখে। আমি জানতাম মায়া আমাকে স্বামী হিসাবে মন থেকে মানে তাই অবাক হয়ে ছিলাম।

আমিও এরপর হাতে পেন তুলে নিয়ে সাইন করতে চেয়েছিলাম পেপারে, কিন্তু কেনো যানি সেই দিন ওই পেপারে আমি সাইন করতে পারিনি। আমার হাত কেঁপে উঠেছিল। কেঁপে উঠেছিল বুকের ভিতর টা। পারিনি সেই দিন আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে, বার বার ভেসে উঠছিল পিচ্চির মায়াবতীর মুখ এবং মায়ার মুখ। মনে হচ্ছিল সাইন করে দিলেই আমি আমার মূল্যবান কোনো জিনিস হারিয়ে ফেলবো। খুব কাছের কিছু হারিয়ে ফেলবো আমি। আমি আমার পিচ্চি মায়াবতী কে হারিয়ে ফেলবো।

সেই দিন আমি আমার এই অনুভূতির মানে বুঝতে পারিনি। কিছুতেই বুঝতে পারিনি আমার এই অনুভূতির মানে। মনে হচ্ছিল আমি কিছু একটা ভুল করছি। তাই নিজেকে সময় দিতে চেয়েছিলাম। সব কিছু বোঝার জন্য, আমার এই অনুভূতির রহস্য উন্মোচন করার জন্য সময় দিয়েছিলাম নিজেকে।
আমি জানতাম আবিরও চাই না মায়ার আর আমার ডিভোর্স হোক। কারণ আবির যে দাদুকে কথা দিয়েছে, ওর প্রাণ থাকতে কিছুতেই আমাকে এবং মায়াকে আলাদা হতে দেবে না। এই কথা দাদু নিজেই চেয়ে নিয়েছে আবিরের থেকে। অনেক বড়ো দায়িত্ব আবিরকে দিয়ে গেছে দাদু। আমিও প্রথমে বুঝিনি, কি এমন দেখেছে দাদু ওই মায়ার মধ্যে? যে আমাদের দুজনকে আলাদা হতে দিতে চাইনা। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও দাদু চেয়েছে আমি আর মায়া যেনো সারা জীবন এক সাথে থাকি।

তো আমি জানতাম যে আবির কিছুতেই চাই না আমার আর মায়ার ডিভোর্স হোক। ও কিছুতেই হতে দেবে না। আর এইদিকে আমি আমার মনের অনুভূতি বুঝতে পারছিলাম না। তাই আমি সাইন না করেই ওর হাতেই ডিভোর্স পেপার টা ধরিয়ে দিই উকিলকে দেওয়ার জন্য। আর আমার ধারণা মোতাবেক আবির পেপার জমা দেয় না উকিলের কাছে। আবিরও জানতো না যে আমি ওই পেপারে সাইন করিনি। আবির ভেবেছিল আমি ভুলে গেছি ডিভোর্স এর কথাটা তাই আর কোনো খোঁজ নিইনি। কিন্তু আমি সবকিছু জানতাম। ইচ্ছে করেই আর কিছু বলিনি ওকে।
আর আমাদের ইসলাম ধর্মের নীতি অনুযায়ী আমার এবং মায়ার মৌখিক তালাক ও হয়নি। তাই মায়া আর আমি এখনো স্বামী স্ত্রী।”

আরমান কথা গুলো বলে থামলো। সবাই অবাক। জীবনে প্রথম বার রগচটা, গম্ভীর আরমানকে একসাথে এতোগুলো কথা বলতে দেখলো সবাই।
পুরো হলরুমে এখন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। আরমানের পরিবারের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সবাই মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। সবকিছু মাথার উপর দিয়ে গেলো। ততক্ষণে আরমানের ইশারায় ওর গার্ডরা আবিরকে ছেড়ে দিয়েছে, আবিরও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আরমানের দিকে।
হলরুমের নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেসে এলো, মিডিয়ার লোকেদের একের পর এক প্রশ্ন।
“যদি মায়া তালুকদারের সাথে আপনার ডিভোর্স না হয়ে থাকে, তাহলে আজকে মাইশা তালুকদারের সাথে এই বিয়ে কেনো করলেন?”

“আপনার কথা মতো, নেম প্লেট এ সেই বাচ্চা মেয়েটির নাম ছিল মাইশা তালুকদার। তাহলে সেই মাইশাই কি এই মাইশা?”
“আপনার ডিভোর্স পেপারে সই না করার মানে কি আপনি আজও মায়াকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিচ্ছেন?”
“আবার আপনি বললেন, মায়ার চেহারা দেখে পিচ্চি মায়াবতীকে মনে পড়ত—এটার কি মানে দাঁড়ায় মিস্টার আরমান শাহরিয়ার?”
আরমান— “Please stop. আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। এরপর ওই ডিভোর্স পেপার পাঠানোর পর কেটে যায় ছয় মাস। আমি তখনও খোঁজ চালাতে থাকি আমার পিচ্চি মায়াবতীর। মানে সেই নেম প্লেট অনুযায়ী মাইশার খোঁজ করতে থাকি।
এরপর হঠাৎই একদিন অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখা হয় মায়ার সাথে। মায়ার বাবার অসুস্থতার জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিল। মায়ার একটা কাজের দরকার ছিল। মায়ার সেই কাজ খোঁজার মাঝেই হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখা হয় আমার সাথে।

মায়া আমার স্ত্রী হয়ে অন্য কোথাও কাজ করবে সেটা আমি মেনে নিতে পারিনি। এটা আমার আত্মসম্মানে আঘাত করে। জোড় করে অধিকার খাটাই মায়ার উপর। তাই রাগের বসে আমি নিষ্ঠুর হয়ে মায়াকে আমার বাড়ির মেইড এর কাজ দিই। অসহায় মায়া বাবাকে সুস্থ করে তোলার জন্য সেই কাজই করতে রাজি হয়ে যাই।”
কথা গুলো বলে আরমান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। যেনো এই দীর্ঘশ্বাস বোঝাতে চাইছে ও ভুল করেছে, ভুল বুঝেছে।

আরমান আবারও বলতে শুরু করলো— এরপর মায়া আমাদের বাড়িতে থেকেই মেইড এর কাজ শুরু করে। আর আমি মায়ার হাত দিয়েই খুঁজে পাই সেই নেম প্লেট। ওটা আমাদের বাড়িতেই ছিল যেটা প্রথম মায়ার হাতেই পড়ে। এরপর আমি ওই নেম প্লেট দিয়েই খুঁজে বের করি মাইশাকে। হ্যাঁ! ওই নেম প্লেটের মাইশাই আজকের বিয়ের সাজে মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা মাইশা।
আমি মাইশাকে খুঁজে পাওয়ার পর, ওকে দেখার পরও আমার সেই পিচ্চি মায়াবতী হিসাবে মেনে নিতে পারিনি। কারণ মাইশার সাথে সেই বাচ্চা মেয়েটির আমি কোনো মিল পাইনি। অথচ এর আগে আমি যতো বার মায়ার কাছাকাছি গিয়েছি ততোবার মনে হয়েছি যে পিচ্চি মায়াবতী আমার কাছেই আছে। সেই অনুভূতি আমি মায়ার মধ্যে পেয়েছি, যেটা পিচ্চি মায়াবতীর মধ্যে পেয়েছিলাম। তাই আমি মাইশা কে মেনে নিতে পারিনি সেই পিচ্চি মায়াবতী হিসাবে।

কিন্তু হঠাৎই আমার কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার মম মাইশাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে চলে আসে। কারণ আমার পরিবারের সবাই জানতো সেই পিচ্চি মায়াবতীর কথা। মম ও খোঁজ রেখেছিল সব বিষয়ে। মমও জানতে পারে মাইশার কথা, আর মাইশা কে নিয়ে হাজির হয় আমাদের বাড়িতে। আর তারপর শুরু করে এই বিয়ের আয়োজন।
কিন্তু এরই মাঝে মাইশার আচার আচরণের মাধ্যমে আমি বুঝতে পারি মাইশা সেই মেয়ে নয়। হঠাৎই একদিন খুব কাছ থেকে দেখি মায়াকে, মায়ার দুই চোখ, ওর কাছাকাছি আসার অনুভূতি, প্রথম থেকে সবকিছু ভেবে আমার সন্দেহ হয়। এবার আমি খোঁজ করতে শুরু করি মায়ার বিষয়ে। আর আমার ধারণা মিলে যাই।

মায়াই আমার পিচ্চি মায়াবতী, আমার ভালোবাসা, আমার অর্ধাঙ্গিনী, যাকে আমি ডিভোর্স দিতে গিয়েও দিতে পারিনি। মায়ার স্কুলে খোঁজ লাগিয়ে জানতে পারি, যে দশ বছর আগে মায়ারই স্কুল থেকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দার্জিলিং। আর মধ্য বিত্ত পরিবারের মায়া, তার বাবার আর্থিক দিক থেকে স্বচ্ছল ছিল না, কিন্তু তার তুলনায় মাইশার বাবা ছিল আর্থিক দিক থেকে স্বচ্ছল। স্কুল থেকে ঘুরতে নিয়ে গেলে, মায়ার কাছে নতুন স্কুল ড্রেস ছিল না। তাই চাচাতো বোনের থেকে স্কুল ড্রেস চেয়ে নিয়ে ওটা পড়েই ঘুরতে যাই।

সেদিন মৃত্যুর মুখ থেকেই মায়াই আমাকে ফিরিয়ে এনেছিল। আর এটা আমার দাদুও জানতো। দাদু মায়ার খোঁজ আমার আগেই পেয়ে গিয়েছিল। আর তাই দাদু জোড়াজুড়ি করে আমার সাথে মায়ার বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কখনো কাউকে জানাইনি যে মায়াই সেই মেয়ে। দাদু চেয়েছিল আমি নিজেই তাকে চিনে নিই। দাদু যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তখন জানাতে চেয়েছিল আমাকে এই বিষয়টা। কিন্তু দূর্ভাগ্য বশত সেটা আর হয়নি। আমি সেই সময় বিজনেস এর কাজে বিদেশে ছিলাম। তাই দাদু আমার জন্য একটা চিঠি রেখে গিয়েছিল সকলের অজান্তে। সেই চিঠিও আমি মায়ার হাত দ্বারার পেয়েছিলাম। মায়া যেই ছোট বাক্স টা আমার হাতে তুলে দিয়েছিল, ওটাতেই ছিল সেই নেম প্লেট সহ দাদুর রেখে যাওয়া চিঠি। যেটা আমার চোখে প্রথমে পড়েনি।

সব কিছু জানার পর সেই নেম প্লেট বাক্স থেকে আবারো বের করতে গিয়ে আমার চোখে পড়ে ওই চিঠিটি। এবং তা থেকেই আমার কাছে স্পষ্ট হয় সবকিছু।
আর ওই নেম প্লেট অনুযায়ী আমার ভুল ধারণা ছিল যে, আমার প্রাণ বাঁচানো ওই মেয়েটি মাইশা। আর ওই নেম প্লেট ধরেই আমি পৌঁছায় মাইশার কাছে, আর সাথে আমার মম ও। মিসেস মুনজিলা বেগম মানে, মাইশার মা, মিথ্যা বলে আমার মমকে। মম সব ঘটনা খুলে বললে, উনি বলেন সেদিন উনার মেয়ে মাইশাই ছিল ওখানে। আর আমার জানামতে মুনজিলা বেগমই মাইশাকেও ভুল বুঝায়। মাইশাকে লোভ দেখিয়ে রাজি করাই উনার এই নোংরা খেলায় নামতে।‌ মিসেস মুনজিলা বেগম‌‌‌ প্রতারণা করে আমাদের সাথে। কি ঠিক বললাম তো মিসেস মুনজিলা বেগম?”
আরমান শেষের কথাটি মিসেস মুনজিলা বেগম এর উদ্দেশ্যে বলল। হল রুমের প্রতেকটা ব্যাক্তি থমকে গিয়েছে, বিশেষ করে আরমানের পরিবারের সবাই। সবাই বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। কারোর মুখে কথা নেই।
কিন্তু মিসেস মুনজিলা বেগম এর মুখে ঘাবড়ে যাওয়ার চিহ্ন। উনি কি বলবেন বুঝতে পারছে না। সবার উৎসুক দৃষ্টি এখন উনার দিকে।

মিসেস মুনজিলা বেগম— “নাহ! মিথ্যা কথা। আমি কিচ্ছু জানতাম না। আরমানের মা আমাদের নিয়ে আসে উনার ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে। দেখো আরমান বাবা, এখন তুমি একদম কথা ঘুরাবে না। আমার মেয়ের সাথে তোমার কিন্তু বিয়ে হয়ে গেছে। কিছুক্ষন আগেই তুমি নিজে সাইন করেছো রেজিস্ট্রি পেপারে। আর তার সাক্ষী আছে এই হল রুমে থাকা প্রত্যেকটা মানুষ। তাই এখন তোমাকে আমার মেয়েকেই স্ত্রী হিসাবে মেনে নিতে হবে। এখন কোনো বাহানা দেখাবে না তুমি। না হলে কিন্তু আমি থানায় যেতে বাধ্য হবো। মামলা দেবো তোমার নামে।”

উনার কথায় হু হা করে হেসে ফেলল আরমান। যেনো উনি খুব মজার একটা কথা বলেছে। আরমান হাসতে হাসতেই বলে উঠলো— “আপনি আমার নামে মামলা দেবেন? এই আরমান শাহরিয়ার এর নামে? বাহ! দারুন তো। ‘চোরের মায়ের বড়ো গলা।’ কথাটা শুনে ছিলাম, আর আজ নিজের চোখে তার প্রমাণ দেখলাম।”
আরমান এবার হুংকার ছেড়ে বলে উঠলো— “শুনে রাখুন মিসেস মুনজিলা বেগম!! আমি এই আরমান শাহরিয়ার আপনার চোদ্দগুষ্ঠী কে জেলের ঘানি টানানোর ক্ষমতা রাখি। আর আপনি যেই প্রতারণা করেছেন আমাদের সাথে তার ফল কি পেতে হয় শুধু দেখতে থাকুন। আর কি বললেন? আপনার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে? এখন তাকে আমাকে মেনে নিতে হবে? আমি সাইন করেছি রেজিস্ট্রি পেপারে?

হ্যাঁ বিয়ে তো হয়ে গেছে, তবে আমার সাথে নয়, বিয়ে হয়েছে আমার ছোটো ভাই আয়ান শাহরিয়ার, আপনার মেয়ের তিন বছরের প্রেমিকের সাথে। হ্যাঁ সাইন করেছি আমি তবে পাত্রের জায়গায় নয়, বরং স্বাক্ষীর জায়গায়। আর পাত্রের জায়গায় সাইন করেছে আমার ছোটো আয়ান শাহরিয়ার। যার সাথে আপনার মেয়ের তিন বছরের সম্পর্ক ছিল।”

মাইশা মঞ্চে দাঁড়িয়ে শুনছিল আরমানের কথা গুলো। ওর মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো।‌ আরমানের কথা শেষ হতেই মাইশা ধপ করে সোফায় বসে পড়লো, চিৎকার করে উঠল ও— “নাহহ!! এটা হতে পারে না।”
আরমান বলল— “কেন হতে পারে না মাইশা? কেন হতে পারে না? কি ভেবেছিলে? আমার ভাইয়ের সাথে তিন বছর সম্পর্ক রেখে হঠাৎ করে আমাকে পেয়ে ওকে ছেড়ে দিয়ে আমার সাথে ঘর বাঁধবে? আমার ভাইকে কষ্ট দিয়ে তুমি আমার সাথে লাক্সারি লাইফ লিড করবে? আর আমি সেটা মেনে নেবো? নাহ কখনোই না। তোমাদের এই সব আমি পরে দেখে নেবো। যেটার জন্য আজ আমি সবাইকে এখানে ডেকেছি সেটা সম্পূর্ণ করি আগে।”

এরপর আরমান আবারও হলের মাঝখানে এসে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলতে শুরু করলো— “তো আজ আমি সবার সামনে, আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার পিচ্চি মায়াবতী, আমার ভালোবাসার মানুষটিকে তার যোগ্য সম্মান দিয়ে ফিরিয়ে আনতে চাই আমার জীবনে। সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই তার। পুরো দুনিয়ার সামনে আমি আমার ভুলের ক্ষমা চাইবো তার কাছে। নিজের অনুভূতি না বুঝে অনেকটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তাকে, অনেক অন্যায় করেছি তার সাথে, সে আমার করা সব অন্যায় মুখ বুজে সহ্য সহ্য করেছে। আমি বুঝতে পেরেছি আমার করা ভুল গুলো, আমি আমার সব ভুল শুধরে নেবো। এই আরমান শাহরিয়ার জীবনে কখনো কাউকে সরি বলেনি, আজ আমি এই আরমান শাহরিয়ার পুরো দুনিয়ার সামনে নিজের ভুল স্বীকার করে সরি বলতে চাই তাকে। সব কিছুর বিনিময়ে আমি তাকে আমার জীবনে ফিরিয়ে আনতে চাই। দরকার পরলে সকলের সামনে আমি ওর পা ধরে ক্ষমা চাইবো, তবুও আমি আমার জীবনে ওকে চাই। ভুল করেছি আমি, (চিৎকার করে উঠল আরমান) হ্যাঁ এই আরমান শাহরিয়ার মস্ত বড় ভুল করেছে। সে তার মায়াবতীকে চিনেও চেনেনি। আমার খুব কাছাকাছি থাকার সত্ত্বেও চিন্তে পারিনি আমি। আমার দাদু আমাকে আমার জীবনের সেরা উপহার টা দিয়েছিল কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। চিন্তে পারিনি আমি আমার মায়াবতীকে।”

কথা গুলো বলে শেষ করে মাথা নিচু করে নিলো আরমান। হঠাৎই ওর কাছে ছুটে এলো রুবি। মুখে ভয়ের ছাপ। আরমান রুবিকে দেখে ওকে উদ্দেশ্য করে বলল ধীর গলায় বলল, “রুবি!! যাও মায়াকে নিয়ে আসো।”
আরমানের এমন কথায় রুবির মুখের ভয়ের ছাপ আরো কিছুটা বেড়ে গেছে গেলো। ঘাবড়ে গেলো ও।
আরমান ভ্রু কুঁচকে তাকালো রুবির দিকে। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কি হয়েছে রুবি? মায়া!! মায়া ঠিক আছে তো?”
রুবি ভীতু গলায় বলে উঠলো— “স্যার মায়া..মায়া ম্যাম রুমে নেই। আমি..আমি ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি মায়া রুমে নেই। আসেপাশে অনেক খুঁজলাম আমি। কিন্তু কোথাও পেলাম না। আপনাকে আরো আগেই বলতে চেয়েছিলাম আমি, কিন্তু আপনি এইদিকে কথা বলাই ব্যাস্ত ছিলেন বলে বলতে পারিনি। এখন না বলে থাকতে পারলাম না।”

রুবি কথা গুলো বলেই মাথা নিচু করে নিলো।
আরমান অবাক গলায় চিৎকার করে উঠলো— “হোয়াট!! মায়া রুমে নেই মানে কি? অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় যাবে? খুঁজে দেখো আশেপাশেই কোথাও আছে। হয়তো এতো ভীড়ের মাঝে কোথাও আছে তাই খুঁজে পাওনি তুমি।”
রুবি আবারও বলল, “না স্যার মায়া ম্যাম কোথাও নেই। উনি চলে গেছেন। আর এই যে আপনার জন্য রেখে গেছেন চিঠি।”
আরমান অবাক গলাতেই বলল— “চলে গেছে মানে কি? অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় যাবে ও? আর কিসের চিঠি এটা?”
রুবি— “মায়া ম্যাম আপনার জন্য রেখে গেছে এই চিঠি। আর..আসলে..মানে…বিছানায়…”
আরমান বিরক্ত গলায় ধমকে উঠে বলল— “কি আসলে মানে করছো রুবি? আমতা আমতা না করে, যা বলার স্পষ্ট করে বলো।”

রুবি চমকে উঠে বলল— “মায়া ম্যাম যেই রুমে ছিলেন সেই রুমে, বিছানায় এবং ফ্লোরে রক্তের দাগ।”
আরমান চমকে উঠলো— “হোয়াট?? রক্ত!! কিসের রক্ত??”
রুবি— “জানি না স্যার। এই যে মায়া ম্যামের রেখে যাওয়া চিঠি।”

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৩৭

আরমান তাড়াতাড়ি রুবির হাত থেকে কাগজটা কেড়ে নিলো। এবং সেটা খুলে পড়তে শুরু করলো। কিছুটা সময় নিয়ে চিঠি টা পড়লো ও। হ্যাঁ চিঠি টা মায়রই লেখা। চিঠি টা পড়ার সাথে সাথে আরমানের পায়ের নীচে থেকে মাটি সরে গেলো যেনো। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এতোটাই শক পেলো ও যে হাঁটু মুড়ে ধপ করে বসে পড়লে ফ্লোরে…।

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৩৯