আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৪৫

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৪৫
সালমা খাতুন

উনার কথায় মায়ার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উচ্ছাসিত কন্ঠে বলে উঠলো মায়া….
“বাগানে যেই ঘরটা আছে, মানে ওই যে ছাদ আছে, কিন্তু চারিপাশ ফাঁকা। আর কি জেনো রাখা আছে ওগুলো…”
মায়া আর মনে করতে পারছে না ওগুলোকে কি বলে। সামিরা ঝট করে বলল, “সোফা, চেয়ার টেবিল রাখা আছে ওখানে।”

মায়া— “হ্যাঁ ওগুলো ওখান থেকে সরিয়ে আমার ঘরে যে খাট টা আছে ওটা ওখানে রেখে দেবে। আমি আজ থেকে ওখানেই থাকতে চাই। এটাই হচ্ছে আমার সব থেকে বড়ো ইচ্ছা।”
মায়ার কথা শুনে সবাই হেসে ফেললো। আর আসিফ, সে যেনো আকাশ থেকে পড়ল। অবাক হয়ে মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়ে বাইরে বলল এক আর এখন সবার সামনে বলছে আর এক।
সাবিনা বেগম— “কিন্তু মায়া মামনি ওখানে তো সব সময় থাক যাই না। বৃষ্টি পড়লে তো ছাঁট আসবে ভিজে যাবে, আবার দিনের বেলা সূর্যের তাপ লাগবে, গরম করবে।”
মায়া জেদি গলায় বলল, “না আম্মু, আমি অতো কিছু বুঝি না। আমি আজ থেকে ওখানেই থাকবো। ওই জায়গাটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আসিফ মায়াকে বোঝানোর মতো করে বলল, “কিন্তু মায়া, তুমি বাড়ির সবাইকে অন্য কিছু বলতে চাইছিলে। এটা তো নয়।‌ তোমার তো আরো একটা ইচ্ছা আছে বলছিলে, সেটা বলো।”
মায়া আসিফের দিকে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে বলল, “অন্য কিছু? কি সেটা? এটাই তো আমার বড়ো ইচ্ছা, আমি ওই বাগানের ঘরটাতে থাকতে চাই।”

আসিফ মায়াকে মনে করানোর চেষ্টা করে বলল, “আরে এটা না। তুমি তখন আমাকে দোলনায় বসে যেটা বললে, ওটার জন্য বাড়ির সবাইকে রাজি করাবে বললে। ভুলে গেলে এতো তাড়াতাড়ি?”
আসিফ শেষের কথাটা কিছুটা অসহায় গলায় বলল। মায়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল, “দোলনায় বসে কি বললাম? আমি তো বসে বসে বাগানের ঘরটাতে থাকার কথা ভাবছিলাম। আপনাকে তো কিছু বলিনি।”
মায়ার কথায় আসিফ বোকা বনে গেলো যেনো। নির্বাক হয়ে মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখে যেন একরাশ বিস্ময়, আর মনের গভীরে এক তীব্র হতাশা। এমনটা হবে, ভাবেনি ও। যেন মুহূর্তেই ওর সমস্ত হিসেবনিকেশ গিয়ে ঠেকেছে শূন্যে। আসিফ মায়ার দিকে অসহায় চোখে তাকালো—কিন্তু মায়া সেদিকে কোনো পাত্তা দিলো না।
আসিফের মনে হচ্ছিল, যেন নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়ে ফেলে। মায়াকে নয়, বরং নিজেকেই ওর এখন পাগল মনে হচ্ছে।

ও জানে, মায়ার মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে প্রতারণা করে ওর সাথেই—কিছু কিছু কথা, কিছু মুহূর্ত, অল্প কিছু সময় পরেই মুছে যায় যেন ধোঁয়ার মতো। আজ যা বলেছে, কাল তা হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অন্ধকারে। কিছু কিছু স্মৃতি আটকে রাখে ঠিকই, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই ওর ব্রেন যেন এক খরস্রোতা নদী—ধরা যায় না কিছুই।
এই অসহায় পরিস্থিতির সুযোগটাই তো নিতে চেয়েছিল আসিফ। মায়া যখন বিয়েতে রাজি হলো, তখন সে ভেবেছিল বাকিটুকু পথ সহজ হবে। পরিবারকে সে চাপে ফেলবে— মায়ার এখন যা অবস্থা তাতে মায়া এখন যা চাই ওকে তাই দিতে হবে না হলে ওর ব্রেনে উল্টো প্রভাব পড়বে। ভেবেছিল, একবার যদি মায়া নিজের জেদে বলত, “আমি বিয়ে করবো”, তবে কেউ আর কিছু বলার সাহস পেত না।
কিন্তু এখন? এখন মায়া যেন সব ভুলে বসে আছে! মুহূর্তে সব কিছু গিলে ফেলেছে ওর মস্তিষ্কের অদৃশ্য অরণ্য। আসিফ কিছুতেই ভাবতে পারেনি এতো দ্রুত এমন একটা রূপ নিতে পারে পরিস্থিতি।
তার ঠান্ডা অবহেলা, স্মৃতির ছেঁড়াখোঁড়া ধরণ, আর সেই নিষ্পাপ দৃষ্টি—সব মিলে আসিফের সমস্ত কৌশল এক মুহূর্তেই মাটি করে দিয়েছে।

“কি ব্যাপার, দেশের বিখ্যাত বিজনেস ম্যান আজ আমার দুয়ারে? তাও আবার এই অবস্থায়?”
কিছুটা তাচ্ছিল্য করে কথাগুলো বলল আসিফ।‌ আরমান নিজের হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে একাই আসিফের রুমে প্রবেশ করছে। আরমান গম্ভীর গলায় বলল, “ভুল জায়গায় হাত দেওয়ার চেষ্টা করছিস তুই আসিফ। ভালো হবে সময় থাকতে সরে যা, না হলে এই আরমান শাহরিয়ার এর কলিজায় হাত দেওয়ার ফল ভালো হবে না।”
আসিফ বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, “তোর কলিজা? ভাই, ওটা তো এখন একটা খালি ডায়েরি—যার পাতা আছে, গল্প নেই। তুই বোধহয় এখনও সেই পুরনো গল্প গুলো খুঁজে চলেছিস। এখন ভয় পাচ্ছিস নাকি, যে সেই খালি ডায়রির সাদা পাতা গুলোই যদি অন্য গল্প বসে যায়?”

আরমান ঠাণ্ডা গলায় আসিফের দিকে তাকিয়ে বলল, “খালি ডায়েরির পাতা যে নতুন গল্প লিখতে দেয়, সেটা ঠিক। কিন্তু কিছু গল্প থাকে—যা একবার লেখা হয়ে গেলে মুছে ফেলা যায় না। হয়তো মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলা সম্ভব কিন্তু হৃদয় থেকে নয়। তুই হয়তো সেই খালি পাতায় জোড় করে ঢুকতে চাইছিস, কিন্তু ভুলে যাস না—এই পাতাগুলো খালি হবার আগেও সেখানে আমার গল্পই লেখা ছিল। হ্যাঁ আমারই একটু অসাবধানতায় কেউ হয়তো মুছে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে, সেই পুরনো গল্প। কিন্তু এবার আমি সেই গল্প আবারও লিখবো—নিজের কলমে, নিজের কালী দিয়ে, নতুন ভাবে। আর সেই পাতায় কাউকে হস্তক্ষেপ করতে দেবো না।”
আসিফ বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, “ঠিক আছে, দেখা যাক—সেই সাদা পাতায় শেষ পর্যন্ত কার গল্প বসে যায়।”

কেটে গেছে প্রায় দু’মাস। আরমান এখন শারীরিকভাবে একেবারে সুস্থ। ফিরে এসেছে সেই আগের রুপে। কিন্তু বাইরের সেই নির্ভরতার মুখোশের নিচে—একটা ভেঙে পড়া হৃদয় নিঃশব্দে রক্ত ঝরিয়ে চলেছে। আরমান ভেঙে গেছে ভিতর থেকে, মায়ার অবহেলা, মায়ার নির্লিপ্ত আচরণে।
অন্যদিকে, মায়াও ফিরে এসেছে। তবে সেই আগের মায়া নয় সে—নতুন এক রূপে, যেন অনিশ্চিত এক ঝড়ের মতো। চোখেমুখে এখন আগুনের ছায়া, কথায় কথায় জেদ, আচরণে তীব্র রাগের আঁচ। ছোট ছোট বিষয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেলে, আবার এক মুহূর্তেই সেই রাগের ভেতর থেকে চোখ টপটপ করে ঝরে পড়ে অশ্রু। যেন ভিতরে জমে থাকা হাজার প্রশ্ন, হাজার অস্পষ্টতা তাকে গ্রাস করে চলেছে প্রতিদিন।

তবে চিকিৎসকের সুশৃঙ্খল থেরাপি, আরমানের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর অক্লান্ত যত্নে মায়া এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। এখন আর স্মৃতির পাতাগুলো সাদা পড়ে থাকে না। নতুন করে যা ঘটে, তা ধরে রাখতে পারে ওর মস্তিষ্ক। তবে হারানো অতীত—সেই অধ্যায়টা রয়ে গেছে এক অদৃশ্য কুয়াশায় ঢেকে।
মায়ার নিয়মিত ভাবে নিয়ে যাওয়া হয় একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে, যিনি ওর আবেগ আর মানসিক ওঠাপড়া বুঝতে চেষ্টা করেন। আর একজন শিক্ষিকা ধীরে ধীরে গড়ে তুলছেন ওর ভাঙা জ্ঞানভাণ্ডার। মায়া—সে এখন ঠিকই বোঝে চারপাশের সবকিছু। আর এই বোঝার মাঝেই, ওর ভিতরে জন্ম নিচ্ছে এক তীব্র প্রশ্ন—কে সে? কেনই বা তার জীবনের এত বড়ো একটি অংশ ধোঁয়ায় ঢাকা? এই উত্তরহীনতা ওকে অস্থির করে তোলে, নিজের কাছেই নিজেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে ফেলে প্রতিদিন।

কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও সেই প্রশ্ন গুলো উত্তর ও খুঁজে পাই না। সামিরা, রুবি এই বাড়ির সকলের কাছে জানার চেষ্টা করেছে নিজের সম্পর্কে, কিন্তু স্পষ্ট কোনো উত্তর ও পাইনি।
মায়া আর আরমানের সম্পর্ক এখনো স্বাভাবিক হয়নি। মায়াকে আরমান নিজের সাথে সহজ হওয়ার সুযোগ টাই দেয়নি। আরমানের কাছেও বহুবার করেছে নিজের মনের প্রশ্ন গুলো, কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি।
এখন ডক্টর বারণ করেছে, হঠাৎ ওর আগের জীবনের ঘটনা গুলো বলতে, এতটা চাপ মায়ার ব্রেন নিতে পারবে না। তাই সবাই অসহায় হয়ে পালিয়ে বেড়ায় মায়ার প্রশ্ন গুলো থেকে।
এই দুই মাসে মায়াকে খাবার খাইয়ে দেওয়া, ওষুধ খাইয়ে দেওয়া সবটাই নিজ হাতে করেছে আরমান। আর আরমানের হাতে খাবার খাওয়া টা মায়ার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আরমান আসে চুপচাপ মায়াকে খাবার খাইয়ে দিয়ে চলে যায়।

মায়া ওর রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, বাইরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। নিজের জীবনের হিসাব নিকাশ কষে চলেছে, কিন্তু সেই হিসাব মিলেও যেনো মিলছে না।
“ম্যাম! স্যার অপেক্ষা করছে রুমে, উনি আপনাকে খাইয়ে আবার অফিস যাবেন।”
রুবির ডাকে মায়া ঘুরে তাকালো। বিরক্ত গলায় বলল, “রুবি তোমায় কত বার বলেছি আমাকে ম্যাম বলবে না। ভালো লাগে না শুনতে।”
রুবি:- “অভ্যাস হয়ে গেছে ম্যাম।”
মায়া:- “আবার?”

বিরক্ত হয়ে মায়া চলে গেলো। রুবি মনে মনে বলল, “সামান্য একজন কর্মচারী হয়ে এই বাড়ির বড়ো বউকে নাম ধরে কি করে ডাকবো ম্যাম? আপনি ভুলে গেলেও আপনার পরিচয় টা তো আর মিথ্যা হয়ে যাবে না।”
মনে মনে কথা গুলো ভেবে রুবি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

আর মায়া রুমে এসে দেখলো, আরমান সোফায় বসে আছে গম্ভীর মুখে, ফোনে কিছু কাজ করছে হয়তো। পরনে এখনো অফিসের ড্রেস আপ।
দুপুর তিনটে বাজতে চলল, মায়াকে দুপুরের খাবার ঘরে দিয়ে গেলেও ও খাইনি। মিসেস সাবিনা বেগমও অনেক জোড় করেও খাওয়াতে পারেনি মায়াকে। বলেছে এখন খিদে নেই, কিন্তু আসল কারণ তো অন্য কিছু।
প্রতিদিন আরমান লাঞ্চ টাইমে বাড়ি আসে, মায়াকে খাইয়ে নিজেও খেয়ে আবারও অফিসে যাই। এটাই এখন ওদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আজ একটু কাজের চাপ থাকায় বাড়ি আসতে পারেনি আরমান, তাই রুবিকে বলেছিল মায়াকে খাইয়ে দিতো। কিন্তু মায়া খাইনি, সেই খবর পেয়ে নিজের কাজ ফেলে এখন ছুটে এসেছে ওকে খাওয়াতে।
মায়া চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মতো সোফায় গিয়ে বসলো আরমানের পাশে, তবে দূরত্ব বজায় রেখে। আরমান মায়াকে নিজের পাশে বসতে দেখে, ফোন পকেটে ভরে নিঃশব্দে খাবারের প্লেট হাতে তুলে নিলো। এরপর চুপচাপ খাওয়াতে শুরু করলো।

আরমান খাওয়াচ্ছে, কিন্তু একবারও মায়ার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না আর মায়া সে তো এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে আরমানের দিকে। এই মানুষটা, এই মানুষটার ছোট ছোট যত্ন গুলো, বড্ড আপন লাগে। মনে হয় মানুষ টা ওর খুব কাছের কেউ, অনেক দিনের চেনা, এই মানুষটার সাথে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে ওর। কিন্তু কি সেটা? কেনো এতো আপন মনে হয়?
মাথার ভিতর টাতে জেনো একটা গোলক ধাঁধার সৃষ্টি হয়েছে। নিজের মনের এই প্রশ্নের উত্তর হাতড়াতে থাকে মায়া কিন্তু উত্তর মিলে না, এর ফল স্বরূপ চোখ থেকে টুপটাপ করে ঝড়ে পড়ে অশ্রু।

আরমান গম্ভীর গলায় বলল, “খাওয়ার সময় কাঁদতে নেই। খাওয়া হয়ে গেলে যতো ইচ্ছা কাঁদবে কিচ্ছু বলবো না।”
আরমানের এমন নিষ্ঠুর কথা শুনে মায়ার কষ্ট দ্বিগুণ হারে বেড়ে গেলো। জোড়ে জোড়ে শব্দ করে কান্না করতে শুরু করলো ও। আরমানের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা দীর্ঘশ্বাস। খাবারের প্লেট টা নামিয়ে রেখে মায়াকে এক হাত দিয়ে নিজের কাছে টেনে নিলো। মায়া আরমানের আদুরে স্পর্শ পেয়ে আরো ভেঙে পড়লো যেনো। আরমানের বুকে মুখ গুঁজে কান্না করেই চলেছে। আরমান মায়াকে কাঁদতে দিলো কিছুক্ষণ। যদিও ওর বুকের ভিতর টা মুচড়ে উঠছে বারবার, কিন্তু কিচ্ছু করার নেই, পরিস্থিতি এখন ওর হাতের বাইরে।
মায়া কাঁদতে কাঁদতেই অসহায় গলায় প্রশ্ন করলো, “কেনো বলছেন না আমাকে আমার বিষয়ে? আমার নাম মায়া এটা ছাড়া আমি আর কিচ্ছু জানি না। আ..আমার পরিবার কোথায়? সবার মা বাবা আছে আমার কই? সবার জীবন সাজানো গোছানো আমার কেন ছন্নছাড়া?”
আরমান:- “এটাই তো তোমার পরিবার।”

মায়া এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলো আরমানের কাছ থেকে নিজেকে। চিৎকার করে বলল, “নাহ!! নাহ!! মিথ্যা বলছেন আপনি আমায়। এটা আমার পরিবার নয়। আমি জানি, আমি এই বাড়ির আশ্রিতা।”
কথা টা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লো মায়া। আর মায়ার বলা আশ্রিতা কথা টা শুনে আরমানের বুকের ভিতর টা মুচড়ে উঠলো। আশ্রিতা? আরে ও তো আরমানের রাজ্যের রানী, সেটা কিভাবে বোঝাবে আরমান ওকে?
আরমান গম্ভীর গলায় বলল, “আশ্রিতা? কে বলল তোমায় এই কথা?”
মায়া ঝাঁঝ মেশানো গলায় বলল, “কেউ বলেনি, নিজে নিজে বোঝার মতো যথেষ্ট জ্ঞান আছে আমার।”
মায়ার বলা প্রতিটা কথা যেন শাণিত ছুরির মতো বিঁধে যাচ্ছে আরমানের অন্তরে। এই মেয়েটা কি আদৌ জানে, ওর একটা শব্দ কতটা গভীর ক্ষত তৈরি করে? কীভাবে ওকে সবকিছু বোঝাবে? বোঝাতে গেলে তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব খুলে বলতে হবে—সেই প্রথম দিন থেকে, সেই তিক্ত শুরু থেকে।

কিন্তু ওদের গল্পের শুরুটা তো মোটেও সুন্দর নয়। অন্ধকার, ভুল বোঝাবুঝি, অবহেলা—সব মিলিয়ে এক বিষণ্ন অতীত। মায়া যদি সবটা জেনে ফেলে, তাহলে কি ও ভুল বুঝবে না? এখন যেটুকু বিশ্বাস আর টুকরো টুকরো অনুভবের বন্ধনে ওরা একসাথে আছে, সেটাও হয়তো আর থাকবে না।
আর মায়ার মানসিক অবস্থা—সেটাও তো আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতো নয়। অতটা ভার একসাথে সে কি নিতে পারবে? এসব ভেবেই ভেতরটা হঠাৎ প্রচণ্ড অসহায় লাগল আরমানের।
আরমান:- “আর কখনো যেনো তোমার মুখ থেকে ওই কথাটা শুনতে না পাই। এখন তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো, তোমার জন্য নিজের কাজ ফেলে এসেছি আমি। আমাকে আবার অফিস যেতে হবে।”
মায়া জেদি গলায় বলল, “খাবো না, খাবো না আমি। কে বলেছে আমার জন্য আপনাকে কাজ ফেলে আসতে? চলে যান, চলে যান আপনি।”

আরমান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মায়া আবারও উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। এভাবে হবে না ওকে নরম গলায় বোঝাতে হবে। আরমান হাত রাখলো মায়ার মাথার উপর। নরম সুরে বলল,‌ “আচ্ছা তুমি যা যা জানতে চাও, সব বলবো আজ রাতে। এখন খাবার টা খেয়ে নাও। আমার লেট হচ্ছে তো, অফিসে ইম্পর্টেন্ট মিটিং আছে একটা।”
মায়া ছলছল চোখে তাকালো আরমানের দিকে, অসহায় গালায় বলল, “সত্যি বলবেন তো? কথা দিন আগে।”
আরমান:- “আচ্ছা কথা দিচ্ছি বলবো। এখন খেয়ে নাও।”
মায়ার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আরমান মায়ার চোখের পানি মুছে দিলো যত্ন সহকারে। এরপর ধীরে আবারও খাওয়াতে শুরু করলো। মায়াও আর জেদ দেখালো না চুপচাপ খেয়ে নিলো। এরপর মায়ার খাওয়া হয়ে গেলে ওই একই প্লেটে খাবার তুলে নিয়ে খেতে শুরু করলো আরমান। আর মায়া এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো আরমানের দিকে।

আরমানের নিজেরও খাওয়া হয়ে গেলে, মায়াকে ওর মেডিসিন গুলো খাইয়ে দিলো। এরপর মায়ার হাত ধরে ওকে নিয়ে আসলো বিছানার কাছে, বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল, “এখন একটু ঘুমাও।‌ ভালো লাগবে।”
মায়া:- “আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন একটু? প্রচন্ড ব্যাথা করছে, আমি না আর এতো চাপ সহ্য করতে পারছি না।”
মায়ার নিঃসংকোচ আবদার আরমানের হৃদয়ে প্রশান্তি ঢেউ বয়ে গেলো। আরমান তাকালো তার হাত থাকা ঘড়ির দিকে, কিছুক্ষণ পরেই ওর একটা ইম্পর্টেন্ট মিটিং আছে, কিন্তু ওর মায়াবতীর থেকে ইম্পর্টেন্ট অন্য কিছু নয়। পকেট থেকে ফোন বের করে ম্যাসেজ দিলো আবিরকে, মিটিং একঘন্টা পিছিয়ে দিতে বলল।
এরই মধ্যে মায়া বিছানায় নিজের শরীর এলিয়ে দিয়েছে। আরমান বসলো মায়ার ঠিক মাথার পাশে, মায়ার মাথায় হাত রাখতেই মায়ার কি হলো কে জানে? ওর মাথাটা তুলে দিলো আরমানের কোলের উপর। দুই হাত দিয়ে আরমানের কোমর জড়িয়ে ধরলো।

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৪৪

আরমান অবাক, একইসাথে বিস্মিত। ওর মনে এক আশ্চর্য রকমের ভালোলাগার ঢেউ বয়ে গেল। নিঃশব্দে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল মায়ার মাথায়, কোমল আর স্নেহভরা স্পর্শে।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আরমানের স্পর্শে ঘুমের দেশে হারিয়ে গেল মায়া। নিঃশ্বাসের ছন্দে ছন্দে মুখে ফুটে উঠল এক প্রশান্তির ছায়া। আরমান স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
কে বলবে—এই মেয়েটাই কিছুক্ষণ আগে রাগে, জেদে অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠেছিল? এখন তো যেন এক আদুরে বাচ্চার মতো লাগছে ওকে… আরমানের চোখে যেন সে এক নিষ্পাপ স্বপ্নের কন্যা।

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৪৬