আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৪৭
সালমা খাতুন
আরমানের এমন অসহায় গলায় বলা কথা গুলো শুনে মায়ার ভিতর টা কেমন যেনো করে উঠলো। কেনো এতো কষ্ট পাচ্ছে মানুষ টা? ও ভুলে গেছে সবকিছু, কিন্তু কেনো আর কিভাবে? আরমানের সাথে কিসের সম্পর্ক ওর?
আরমানের বলা প্রতেকটা কথা মায়ার কানে বার বার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো? দুই হাতে মাথার দুই পাশ চেপে ধরলো মায়া, মাথার ভিতর টা প্রচন্ড যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে যেনো। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। এক গুচ্ছ প্রশ্ন মায়ার মাথার ভিতরটা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর একমাত্র আরমানই দিতে পারবে। হ্যাঁ। আরমানই দিতে পারবে ওর এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর।
মায়া বিছানায় উঠে বসলো। তাকালো ওয়াশরুমের দরজার দিকে, দরজা তো বাইরে থেকে লক করা তাহলে আরমান কোথায় গেলো। আরমান বিছানা থেকে উঠতেই মায়া ভেবেছিল আরমান ওয়াশরুমেই যাবে, কিন্তু কোই ওয়াশরুমে তো নেই। মায়া ভাবলো আরমান হয়তো কোনো কারণে নিচে গেছে, তাই মায়া নিজের চোখের পানি মুছে নিজেকে পরিপাটি করে নিয়ে পা বাড়ালো নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
মায়া নিচে গিয়ে কাউকেই দেখতে পেলো না। পুরো ড্রয়িংরুম ফাঁকা। রান্না ঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। তাই মায়া রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। দুই জন সেফ রান্না করছে, রুবিও আছে। রুবি মায়াকে দেখেই তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলো ওর দিকে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ম্যাম এতো তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছেন আজ? কিছু লাগবে?”
মায়া:- “না আমার কিছু লাগবে না। তোমার স্যারকে দেখেছো? কোথায় গেলেন উনি?”
রুবি:- “স্যার তো এই মাত্র বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। আমাকে উনার ব্রেকফাস্ট ও রেডি করতে মানা করে গেলো।”
মায়া চিন্তিত গলায় বলল, “কোথায় গেলেন উনি? কাল রাতের পোশাক টাও তো পাল্টায়নি।”
রুবি:- “হুম অমন এলোমেলো অবস্থাতেই বেরিয়ে গেলেন উনি।”
মায়া চিন্তিত হলো আরমানের জন্য, সাথে মায়ার নিজের উপরেই প্রচন্ড রাগ লাগলো। ও আগে কেনো আটকালো না আরমানকে? আচ্ছা আরমান কি ওর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ভয়েই আবারও পালিয়েছে? কেনো বলতে চাইছে না কিছু ওকে? মানুষটা তো নিজেও কষ্ট পাচ্ছে আর ওকেও কষ্ট দিচ্ছে। ওর মনে বলে আরমানের সাথে ওর নিবিড় কোনো সম্পর্ক রয়েছে। একটা গভীর টান অনুভব করে ও ওই মানুষ টার প্রতি। আর এই বাড়িটা, ভীষণ চেনা চেনা লাগে ওর। বাড়ির মানুষ গুলো কেও প্রচন্ড আপন লাগে। কিন্তু কি সম্পর্ক ওদের সাথে ওর? কেনো ওকে কেউ কিছু বলতে চাই না?
উদাস মনে কেটে গেল মায়ার সারাটা দিন। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এসেছে, তবুও আরমানের দেখা নেই। আজও চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় প্রহর গুনছে মায়া—আরমান ফিরে আসবে, সেই আশায়। ওর হৃদয়ে জমে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়তো আজ পাওয়া যাবে—এই প্রত্যাশায়।
আজ মায়া সবার সাথে নিচে গিয়ে ডাইনিং এ খেয়েছে। আজ আরমান লাঞ্চেও বাড়ি আসেনি। মায়া বুঝতে পারছে, আরমান হয়তো ওর প্রশ্ন গুলোর উত্তর দেওয়া থেকে বাঁচতে এইভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কেন? হঠাৎই মায়া কি মনে করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো মায়া। এরপর সোজা আরমানের রুমে।
আরমানের রুমে গিয়ে চারিদিকে নজর বুলালো। বেডের পাশে ছোটো টেবিল টার উপড় একটা ল্যাপটপ রাখা। কি মনে করে ও ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ওই দিকেই। টেবিলের ড্রয়ার খুললো, উলটপালট করে কি যেন খুঁজে চলেছে ও কিন্তু ওর কাজে লাগার মতো কিছুই পেলো না। এরপর প্রথম ড্রয়ার টা বন্ধ করে খুলল মাঝের ড্রয়ার টা। মাঝের ড্রয়ার খুলেই দেখতে পেলো ওখানে একটা হালকা গোলাপি রঙের একটা খাম রাখা। আর কিছুই নেই ওখানে এই খাম ব্যাতিত। কি মনে করে ওটাকেই হাতে তুলে নিলো মায়া। খাম টার এক কোনে একটা কালো রঙের গোলাপ লাগানো। অদ্ভুত রকমের সৌন্দর্য খেলা করছে যেনো ওই খামটার মাধ্যে।
একটা অদৃশ্য টান অনুভব করলো মায়া ওটার প্রতি, আর ওই অদৃশ্য টানেই একটা ঘোরের মধ্যে থেকে খামটা খুব যত্ন সহকারে খুলল। ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা কালো রঙের ভাঁজ করা কাগজ। কাগজ টা কোনো সাধারণ কাগজের মতো দেখতে নয়, অনেক টা আলাদা। কাগজ টা বের করতেই একটা খুব সুন্দর ও ঘ্রাণ মায়ার নাকে এসে বারি খেলো। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো ও। ওই কাজগটা থেকেই ভেসে আসছে ওই সুন্দর ঘ্রাণ টা। আচ্ছা কোনো কাগজেও কি এতো সুন্দর ঘ্রাণ থাকে? নাকি এটাতে কোনো পারফিউম লাগানো হয়েছে? বুঝতে পারলো না মায়া। তাই কাগজ টা নিয়ে নাকের কাছে নিয়ে এসে শ্বাস টানলো, বুঝলো এটাতে আলগা কোনো পারফিউম ব্যবহার করা হয়নি বরং এই কাজটার ঘ্রাণ টাই এমন।
একটা ঘোরের মধ্যে থেকে ধীরে কাগজ টার ভাঁজ খুলল মায়া। আর খুলতেই আরো কিছুটা মুগ্ধতা গ্রাস করলো ওকে। কালো কাগজটার উপর সোনালী রঙের চিকচিক করা কালী দিয়ে কিছু লেখা আছে। কেমন যেনো অদ্ভুত লাগলো মায়ার কাছে, কালো রঙের কাগজের উপর লেখা বেশ কিছু লাইন—দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা একটা চিঠি। কিন্তু এমন কালো রঙের কাগজে লেখা কোনো চিঠি এই প্রথম বার দেখলো মায়া।
প্রথমেই ওর যেটা চোখে পড়লো, “প্রিয় মায়াবতী” বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো ও। লেখাটা পড়তেই ওর বুকটা কেঁপে উঠলো কি? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো হ্যাঁ।
পুরো লেখাটা পড়ার আগ্রহ ধরে রাখতে পারলো না তাই পড়তে শুরু করলো মায়া…
প্রিয় মায়াবতী,
তুমি হয়তো এখন জানো না—আমি কে।
হয়তো তোমার চোখে আমি শুধুই এক অপরিচিত ছায়া, যার পাশে দাঁড়ালেই তোমার বুক ধুকপুক করে ওঠে, হয়তো ভয়ে… হয়তো অকারণ আতঙ্কে।
কিন্তু আমি তো তোমারই গল্পের ছায়া,
তোমার রাত জাগা নিঃশ্বাসের অপেক্ষা,
অচেনা আলোয় জেগে থাকা এক অভিমানি স্বপ্ন,
যার শুরু ছিলে তুমি, শেষটাও কেবল তোমারই আশ্রয়।
তোমার দোলনচাঁপার মতো হাসি আর
শিউলির মতো বিষাদ মুখ—সবটাই আমি দেখেছি, ভালোবেসেছি।
তোমাকে দেখার মধ্যে যে শান্তি আমি পাই, সেটা কখনোই তোমাকে বোঝাতে পারবোনা…
হাজার টা অশান্তির মাঝেও তুমি আমার একমাত্র মানসিক শান্তির কারণ…
সেই পিচ্চি মায়াবতী, যাকে খুঁজতে গিয়ে জীবনের অর্ধেক টা পাড় হয়ে গেলো, অথচ সে আমার সামনেই ছিল— আমার হালাল সঙ্গীনি হয়ে। কিন্তু আমার খুব কাছাকাছি থাকার সত্ত্বেও চিনে নিতে পারিনি আমার হৃদয় আমার পিচ্চি মায়াবতীকে…
যখন বুঝলাম, তুমিই সেই হারানো মায়াবতী— স্মৃতির পাতায় গেঁথে থাকা একটা পবিত্র ছায়া। তখন মনে হয়েছিল, হয়তো এবার তোমায় ফিরিয়ে নিতে পারবো নিজের কাছে—তখন তুমি আমার থেকে দূরে সরে গেলে, অনেকটা দূরে। এতোটাই দূরে যে চোখের সামনে দেখেও ছুঁতে পারছি না। এও এক অভিশপ্ত প্রাপ্তি…
এখন তোমার মনে আমি নেই,
তবুও আমার মনে, প্রতিটি ঘুমে
শুধু তুমিই আছো—এক অনন্ত অপেক্ষা হয়ে।
তুমি আমাকে ভুলে গেছো…কোনো অভিযোগ নেই। তবুও মনটা তো আর পাথর নয়,
তাই প্রতিদিন ভাঙে, আবার গুছিয়ে তোলে আশার ধুলো জমে থাকা সেই স্মৃতিগুলো।
তাই ভেবে নিয়েছি—পুরোনো সব ব্যথা, ভুল বোঝাবুঝি, অপূর্ণতা… সব পেছনে ফেলে এবার আবার শুরু করবো।
একটা নতুন অধ্যায়, যেখানে কষ্টের নয়, শুধুই ভালোবাসার ছাপ থাকবে।
এই বারের শুরু টা হবে নুতন ভাবে, যেখানে থাকবে না কোনো নিষ্ঠুরতা— থাকবে না কোনো তাচ্ছিল্য,
আমার ভালোবাসা এবার আর ক্ষত নয়, মলম হবে।
আমার ভালোবাসা এখন আর কাঁটা নয়, বরং নরম ছোঁয়া।
এবারের ভালোবাসা আর শাসন নয়, শুধু নীরব সঙ্গী হওয়া।
আগের ভালোবাসা ছিল দাবির, এবার শুধু দেবার।
যে হাত একদিন ছুঁয়েও ব্যথা দিয়েছিল,
সেই হাত এবার শুধু আশ্রয় হবে—
ভরসার, নির্ভরতার, নিঃশব্দ স্নেহের অঙ্গীকার।
যে চোখ অবহেলা করেছিল তোমার কান্না,
সেই চোখ এবার তোমার প্রতিটি অভিমান পড়ে ফেলবে— তোমার ঠোঁট না কাঁপলেও।
‘আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা’ এবার হবে ‘আমার যত্নময় ভালোবাসা’।”
ইতি তোমার
অপ্রিয় গম্ভীর সাহেব….
মায়া নিজের মুখের ভাষা হারিয়ে ফেললো চিঠিতে থাকা লাইন গুলো পড়ে। প্রতিটা লাইনে যেন ফুটে উঠেছে মনের গহীনে থাকা গভীর আবেগ, নিঃশর্ত ভালোবাসা আর কিছুটা আক্ষেপ, কিছু দীর্ঘশ্বাস, আর কোনো কিছু পেয়েও হারিয়ে ফেলার হাহাকার।
আচ্ছা, এই চিঠিটা কি সত্যিই ওকে উদ্দেশ্য করেই লেখা?”—প্রশ্নটা হঠাৎই ভেসে উঠল মায়ার মনে।
শেষ লাইনের ‘ইতি, তোমার অপ্রিয় গম্ভীর সাহেব’—এই সম্বোধনটা যেন অচেনা কিছু নয়। এটা তো ওই ই ডাকে “গম্ভীর সাহেব”—এই ডাকটাই তো ওর মনেই এসেছিল প্রথম দিন থেকে। কারণ আরমানকে ও যখনি নিজের সামনে দেখেছে, তখনই দেখেছে গম্ভীর, নির্লিপ্ত এক মুখ। যেন কথার চেয়ে নীরবতাই তার প্রধান ভাষা। তাই নিজের অজান্তেই এই ডাকটাই মনের কোণে গেঁথে গিয়েছিল।
তবু প্রশ্নটা থেকেই যায়—চিঠিটা কি সত্যিই ওর জন্যেই লেখা?
চিঠির কিছু লাইন স্পষ্ট, স্পর্শকাতর—ওর হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। কিন্তু কিছু শব্দ, কিছু বাক্য, একেবারেই দুর্বোধ্য।
‘হালাল সঙ্গিনী’, ‘না চিনতে পারা’, ‘অভিশপ্ত প্রাপ্তি’—এই শব্দগুলোর মানে কী? ওর সঙ্গে এই লোকটার সম্পর্কটাই বা কী? কেন এত কষ্টে ভেঙে পড়ছে আরমান? এত যন্ত্রণা, এত না বলা কথা—সব কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে?
মায়া তো উত্তর খুঁজতেই এসেছিল এই ঘরে। কিন্তু উত্তর তো দূরে থাক, বরং নতুন করে কিছু প্রশ্ন তার ভেতর জমা হতে লাগল।
মাথার ভেতর যেন গোলকধাঁধা—যেটা খুলে যাওয়ার বদলে আরও জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরল মায়া। অসহায়ত্ব চারদিক থেকে তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। সবকিছু আবছা, দিশেহীন। নিজেকে কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে ওর।
এরপর কি যেন ভেবে, ধীরে চিঠিটা পাশে রেখে মায়া চোখ মেলে তাকালো টেবিলের উপরে দিকে।
আরমানের ল্যাপটপটা পড়ে আছে সেখানে, মায়ার মনে হলো— নীরব, তবুও যেন তার মাঝেই লুকিয়ে আছে বহু অজানা প্রশ্নের উত্তর।
নির্বাক পায়ে এগিয়ে গিয়ে ল্যাপটপটা হাতে তুলে আনল মায়া। বিছানায় বসে, কিছুটা দ্বিধা আর কৌতূহলে চাপা নিঃশ্বাস ফেলে আলতো হাতে ওপেন করলো। এর পর চাপ দিলো পাওয়ার বাটনে। ল্যাপটপ স্ক্রিনে ফুটে উঠল পাসওয়ার্ড চাওয়ার বার্তা।
প্রথমে টাইপ করল—‘আরমান’।
না, ভুল।
পুনরায় চেষ্টা—‘আরমান শাহরিয়ার’।
তাতেও কিছু হলো না।
একবার, দু’বার, তিনবার… একে একে চেষ্টা করেও কিছুতেই খুলছে না।
শেষবারের মতো একটি সুযোগ বাকি।
আর একবার যদি ভুল হয়, ল্যাপটপ পুরোপুরি লক হয়ে যাবে।
মায়া হতাশায় মাথা চেপে ধরল।
“কি হতে পারে পাসওয়ার্ড? আরমান এমন কী শব্দ লিখেছে, যা সবার থেকে লুকিয়ে রাখে?”
হঠাৎই মাথা তুলল ও। চোখে এক ঝলক কিছু এসে ভেসে উঠল।
‘পাসওয়ার্ড যদি এমন কিছু হয়, যা কেবল ওর হৃদয়ের খুব গহীনে থাকে?’
ধীরে, কাঁপা কাঁপা হাতে টাইপ করল—
‘Mayaboti’
এক মুহূর্ত স্তব্ধতা…
তারপরেই ল্যাপটপ টি লগইন হয়ে গেলো। হোম স্ক্রিনে পৌঁছে গেল মায়া। হ্যাঁ, খুলেছে।
কিন্তু হঠাৎই ল্যাপটপের স্ক্রিনে ওয়েলপেপারে থাকা ছবিটা দেখে থমকে গেলো মায়ার হৃদয়, পুরো শরীর দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো। অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেলো ও।
স্ক্রিন জুড়ে ভেসে উঠেছে এক ছবি— বিয়ের সাজে সজ্জিত এক দম্পতি পাশাপাশি বসে আছে। মেয়েটির পরনে লাল রঙের বেনারসি, তাতে গোল্ডেন এর কাজ করা। গায়ে স্বর্ণের অলংকার। মাথায় সুন্দর কাজের গোল্ডেন ওরনা। মুখে হালকা মেকআপের ছোঁয়া। চোখে লাজুক দৃষ্টি। মুখে মিষ্টি হাসি। আর তার ঠিক পাশেই বসে থাকা লোকটি—আরমান। শেরওয়ানিতে গম্ভীর মুখ, ঠোঁটে অস্পষ্ট একটা বিরক্তির রেখা।
চমকে উঠলো মায়া, চোখে ফুটে উঠলো একরাশ বিস্ময়, ভ্রু কুঁচকে উঠল।
“এই মেয়েটা… এটা আ..আমি? আমার বিয়ে? আর… আরমান?”
জানা-অজানা এক ঝড় বইতে লাগল তার বুকের ভিতর। চোখ আটকে গেল ছবির লাল বেনারসি পরা সেই মেয়েটির মুখে। নিজেকেই যেন অপরিচিত মনে হতে লাগল।
মায়ার গলা শুকিয়ে কাঠ, ঠোঁট কাঁপছে। সেই কাঁপা কাঁপা ঠোঁট দিয়ে উচ্চারন করলো একটাই বাক্য, “আমার কাছে কী লুকোচ্ছে সবাই?”
কিছুতেই থামাতে পারছে না নিজের ভেতরের সেই তোলপাড়। কী হচ্ছে ওর সঙ্গে? কেনই বা এমন লাগছে? আর কী করলে পুরোটা সত্যি জানতে পারবে ও, যা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মাথায়।
ল্যাপটপটা সেভাবেই খোলা রেখে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো মায়া। পা টেনে এগিয়ে গেল আরমানের রুমের ওয়ার্ডরোবের দিকে। দরজাটা ছিল না লক করা—তাই সহজেই খুলে গেল। ভিতরে সাজানো ছিল আরমানের জামাকাপড়, পরিপাটি, সুবিন্যস্ত। অথচ মায়ার চোখে তখন কেবল একটাই খোঁজ—কোনো উত্তর, যা ওর ভেতরের ঝড়কে থামাতে পারবে।
অস্থির হাতে এলোমেলো করে ফেললো একের পর এক পোশাক। কী খুঁজছে—তা জানে না নিজেও। নিঃশব্দে গুমরে ওঠে ওর বুকে জমে থাকা দ্বন্দ্ব। অবশেষে হঠাৎ চোখে পড়লো ওয়ার্ডরোবের একপাশে থাকা একটা লকার। সেই মুহূর্তে ওর মনে পড়লো—বেডের পাশে থাকা ড্রয়ারটায় একটা চাবি দেখেছিল ও। মুহূর্ত দেরি না করে ছুটে গিয়ে সেটা নিয়ে এল।
চাবি ঘুরাতেই লকার খুলে গেল। ভিতরে রাখা কয়েকটা ফাইল চোখে পড়লো। কাঁপা হাতে সেগুলো একে একে বের করে আনলো মায়া। প্রথমেই চোখে পড়লো কিছু মেডিকেল রিপোর্ট। পড়তে পড়তে ওর চোখ স্থির হয়ে এলো—পেশেন্টের জায়গায় লেখা ওর নিজের নাম! কিছু মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলো ও, তারপর ফাইলের পাতাগুলো ওল্টাতে থাকলো।
বুঝে নিতে সময় লাগলো না—মাথায় আঘাত লেগে স্মৃতি হারিয়েছে ও। জীবনের সমস্ত পাতা মুছে গেছে মগজের ক্যানভাস থেকে।
হঠাৎ এক অজানা স্রোত বইতে শুরু করলো বুকের ভিতর। চোখ থেকে ঝরে পড়লো দু’ফোঁটা পানি, নীরব, ব্যথাতুর। আরো কি কি বাকি আছে ওর জানার জন্য? কে জানে!
মেডিকেল রিপোর্টের ফাইল ছেড়ে আরেকটা ফাইল হাতে তুলে নিলো ও। খুলে ফেলতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো মায়ার। ধপ করে বসে পড়লো ফ্লোরে। হাত থেকে ফাইলটা পড়ে যায়নি ঠিকই, কিন্তু ওর বুকের ভিতর ভেঙে গিয়েছে বহুদিনের স্তব্ধ একটা প্রাচীর।
সাদা কাগজের উপর কালো কালি দিয়ে লেখা দুটো নাম—
“আরমান শাহরিয়ার” ও “মায়া তালুকদার”—
একটি কাবিননামায় এক হয়ে জ্বলজ্বল করছে দুটো নাম।
আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৪৬
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন মানুষ—চোখেমুখে অসহায় ও বিস্ময়ের ছাপ। কেউ জানে না, ঠিক কী ঘটতে চলেছে এখন। মায়া কি সবকিছু মেনে নেবে? নাকি ভিন্ন অর্থ খুঁজে নেবে পরিস্থিতির? যদি মায়া ভুল বুঝে ফেলে, তবে আরমানের অবস্থাটা কেমন হবে? সত্যিই কি সে সামলে উঠতে পারবে সেই ভুল বোঝাবুঝির ভার?
