আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৫০
সালমা খাতুন
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে মায়া দৃষ্টি বাইরে রেখে। নিজের জীবনের হিসাব মিলাতে ব্যাস্ত। ঠিক তখনি পিছনে থেকে আরমান মায়ার পেটে দুই হাত দিয়ে কোমর পেঁচিয়ে ধরলো। থুতনি রাখলো মায়ার কাঁধে। সাথে সাথে ভয়ে চমকে উঠলো। পুরো শরীর দিয়ে একটা ঠান্ডা শীতল স্রোত বয়ে গেলো যেনো।
আরমান মায়াকে ভয় পেতে দেখে বলল, “হেই রিল্যাক্স। কি ভাবছিলে যে এই ভাবে চমকে উঠলে?”
মায়া উদাস গলায় বলল, “কিছু না এমনি।”
আরমান মায়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নরম গলায় বলল, “কিছু না তো মন খারাপ কেনো? তোমার কি এখনো কোনো সন্দেহ আছে? কি ভাবছো বলো আমায়।”
মায়া:- “আরে আপনার প্রতি কোনো সন্দেহ নেই। আমি তো শুধু আমার বাবার মুখ টা মনে করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না।”
কথটা বলতে বলতেই এক ফোঁটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো মায়ার চোখ বেয়ে। আরমান মায়াকে নিজের বুকে টেনে নিল। কিন্তু মুখে শান্তনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পেলো না। আরমান মায়াকে এক হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে আরেক হাত দিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো। তারপর ফোনে কিছু ঘাঁটাঘাঁটি করে মায়াকে দেখিয়ে বলল, “এই দেখো এটা তোমার বাবা। ব্রেনে চাপ দিয়ে মুখ মনে করার চেষ্টা করার দরকার নেই। এতে সমস্যা হতে পারে।”
মায়া তাড়াহুড়ো করে আরমানের ফোনটা ছিনিয়ে নিলো। তারপর দুই চোখ ভরে দেখতে থাকলো ছবিটাকে। এই ছবিটাও আরমান আর মায়ার বিয়ের দিনেই তোলা হয়েছিল। যেখানে মায়ার বাবা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মায়াও তার বাবার বুকে আদুরে বিড়াল ছানার মতো লেপ্টে আছে। ছবিটা দেখে মায়া চোখের বাঁধ ভাঙলো। ঝরঝর করে পানি পড়তে শুরু করলো। অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো, “পাপা!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরমান মায়ার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিলো।
মায়া উদগ্রীব হয়ে বলল, “কি হলো? ফোনটা দিন। এভাবে কেড়ে নিলেন কেনো?”
আরমান:- “জানো না মৃত্যু মানুষের ছবি দেখে এইভাবে কান্না করতে নেই তাও আবার এই রাতের বেলা।”
মায়া:- “আর কাঁদবো না, প্লিজ ফোনটা দিন। আমি আমার পাপাকে আরো কিছুক্ষন দেখতে চাই।”
আরমান:- “না আর এখন আর দেখতে হবে না। পরে দেখবে আবার। রাত শেষ হতে চলল, ঘুমাবে চলো। না হলে শরীর খারাপ করবে তোমার।”
মায়া:- “কিছু হবে না। আচ্ছা আপনি আমাকে আগে কথা দিন ওই ছবিটা বাঁধিয়ে এনে দেবেন। ওই ছবিটা আমি আমার বাবার শেষ চিহ্ন হিসাবে রাখতে চাই।”
আরমান, “আচ্ছা দেবো” বলেই মায়াকে কোলে তুলে নিলো। মায়া হকচকিয়ে উঠলো।
“আরে আরে কি করছেন? নামান বলছি।”
আরমান:- “অনেক হয়েছে এখন ঘুমাবে চলো। সেই কখন রুমে এসেছো তুমি আর এখনো ঘুমানোর নাম নেই।”
মায়া:- “নামিয়ে দিন, নিজের পায়ে যেতে পারবো আমি। লজ্জা শরম নেই নাকি? এভাবে কোলে তুলে নিলেন কেনো?”
আরমান মায়াকে এইভাবে হঠাৎ করে কোলে তুলে নেওয়ায় মায়া প্রচন্ড লজ্জা পাচ্ছে। যেটা ওর মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে কিন্তু তবুও মায়া নিজের মুখে রাগী ভাব রাখার চেষ্টা করছে যেটা ওর দাঁড়ায় সম্ভব না। আরমান নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “নিজের বউকে বন্ধ চার দেওয়ালের মাঝে কোলে তুলেছি, এতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে? আর তুমি যে তখন ড্রয়িংরুমে সবার সামনে জড়িয়ে ধরলে?”
আরমান মায়াকে বারান্দা থেকে নিয়ে আসতে আসতে, মায়াকে লজ্জা দিতে কথটা বলে উঠলো। আর হলেও তাই। মায়া আর নিজের মুখের রাগী ভাব ধরে রাখতে পারলো না। লজ্জায় মুখ লুকালো আরমানের বুকে। যা দেখে আরমান নিঃশব্দে মুচকি হাসলো।
আরমান মায়াকে রুমে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দিল। মায়া এখনো লজ্জায় আরমানের মুখের দিকে তাকাতে পারছে না, চোখ বন্ধ করে উল্টো দিকে ঘুরে গেলো। আরমান মুচকি হেসে বিছানায় মায়ার পাশেই শুয়ে পড়লো। এরপর মায়ার শরীর ঘেঁষে মায়ার কোমর জড়িয়ে ধরে, মায়ার উন্মুক্ত পিঠে নাক ঘষতে ঘষতে বলল, “এইভাবে মায়াবতী যদি তার লাজে রাঙা মুখ, তৃষ্ণার্ত গম্ভীর সাহেবকে দেখায় তাহলে নিজেকে কিভাবে কন্ট্রোল করবে সে?”
মায়ার তো অবস্থা নাজেহাল। মনে মনে দোয়া করছে এই ঘরের মেঝেটা দুই ভাগ হয়ে যাক আর ও তার মাঝে টুক করে ঢুকে পড়ুক। হঠাৎই মায়া কি মনে করে ধরফর করে উঠে বসলো বিছানায় আরমানের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে।
আরমান মায়াকে এভাবে উঠতে দেখে নিজেও ভয় পেয়ে উঠে বসলো। জিজ্ঞেসা করলো, “কি হলো মায়া? কোনো অসুবিধা হচ্ছে? মাথায় ব্যাথা করছে?”
মায়া:- “না আমি ঠিক আছি। কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু আপনি এখানে কেনো শুয়েছেন?”
আরমান বোকা বোকা চোখে তাকালো মায়ার দিকে, “তো কোথায় শুবো?”
মায়া:- “অন্য রুমে যান।”
আরমান:- “অন্য রুমে কেনো যাবো। এটাই তো তোমার আর আমার রুম। স্পেশাল ভাবে সাজিয়েছি রুম টাকে, সুন্দর না?”
মায়া:- “হুম সুন্দর, আমার তো খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আপনি আমার সাথে এক রুমে থাকতে পারবেন না।”
আরমান ভ্রু কুঁচকে বলল, “তিন কবুল বলে বিয়ে করা বউ তুমি আমার। তাহলে কেনো তোমার সাথে এক রুমে ঘুমাতে পারবো না।”
মায়া:- “তিন কবুল বলে বিয়া করা বউ? কই আমার তো মনে নেই যে আমাদের বিয়ে হয়েছে।”
আরমান মায়ার বলা কথাটা শুনে পুরোই বোকা বনে গেলো যেনো। কি উত্তর দেবে ভেবে পেলো না। কিছুক্ষণ বোকা বোকা চোখে মায়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমার তো আগের কোনো কথায় মনে নেই তাহলে বিয়ের কথা কিভাবে মনে থাকবে?”
মায়া:- “হুম সেটাই তো বলছি। যেহেতু আপনার সাথে আমার বিয়ের কথা মনে নেই তাই আপনি আমার সাথে এক রুমে থাকতে পারবেন না।”
আরমান:- “আরে এটা কোনো কথা? তাহলে কোথায় থাকবো আমি?”
মায়া:- “যেখানে ইচ্ছা থাকুন তবে আমার সাথে এক রুমে নয়।”
আরমান মায়াকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলল, “প্লিজ মায়াবতী। একটু বোঝার চেষ্টা করো। এতো রাতে কোথায় যাবো আমি? আর আমারা স্বামী স্ত্রী হয়েও কতদিন আর এভাবে আলাদা থাকবো?”
মায়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল, “যতোদিন না আপনার সাথে আমার বিয়ের কথা মনে পড়বে ততোদিন।”
আরমান:- “আর যদি কোনোদিন মনে না পড়ে তাহলে?”
মায়া:- “তাহলে জানি না। এই আপনি যান তো। অনেক ঘুম পেয়েছে আমার। আর বিরক্ত করবেন না।”
কথটা বলেই মায়া উঠে দাঁড়িয়ে আরমানকে টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে একেবারে সোজা দরজার বাইরে বের করে দিলো। তারপর দরজা লক করে দিলো।
আরমান দরজায় ঠকঠক আওয়াজ করে মায়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, “মায়াবতী! বউ আমার এতো রাতে কি পাগলামো শুরু করলে? কোথায় যাবো আমি?”
মায়া:- “কেনো এই এতো বড়ো বাড়িতে রুমের অভাব আছে নাকি? অন্য রুমে যান।”
আরমান:- “সত্যিই রুমের অভাব বউ। উপরে এই তিনটে রুম ই আছে। একটা এটা আর একটাতে সামিরা রুবি মাইশা আছে আর একটাতে আয়ান আর আবির। নিচের রুম গুলোতে এখোনো কিছুটা কাজ বাকি।”
মায়া:- “আমি জানি না যেখানে ইচ্ছা যান।
হঠাৎই আরমান গেয়ে উঠলো…
(গান)
জানলে আগে এমন মাইয়া করতাম না বিয়া..
সর্বনাশ কইরাছি পায়ে কুড়াল মারিয়া..
জানলে আগে এমন মাইয়া করতাম না বিয়া..
সর্বনাশ কইরাছি পায়ে কুড়াল মারিয়া..
সুখে কত আদরে..রাখি ভাত কাপড়ে..
আমার সাথে টেক্কা মারে আমারি ঘরে..
আরমানের গান শুনে মায়া কিছুক্ষণ হাসলো। গান থামাতেই ভিতর থেকে মায়া বলে উঠলো, “এতো সহজে এই মায়াবতীর মন গলবে না মিস্টার আরমান শাহরিয়ার।”
আরমান:- “হুম মায়াবতীর মন কিভাবে গলাতে হয় সেটা আমার খুব ভালো করেই জানা আছে মিসেস আরমান শাহরিয়ার।”
মায়া বিরক্ত গলায় বলল, “এই আপনি যান তো।”
আরমান:- “সত্যিই চলে যাচ্ছি। আর কাছে ডাকলে আসবো না কিন্তু।”
মায়া:- “হুম যান। ডাকবো না কাছে।”
এটা বলেই মায়া মুখ বেঁকিয়ে বিড়বিড় করে উঠলো, “কই একবারও তো বলছে না, যে তোমার বিয়ের কথা মনে নেই তো কি হয়েছে? আমারা আবারও একবার বিয়ে করবো। আগের বিয়েতে তো রাজিই ছিল না, ছবিতেও মুখ দেখলে বোঝা যায়, যে জোড় করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে উনাকে। এতো সহজে তো আপনাকে এই মায়াকে পেতে দেবো না মিস্টার আরমান শাহরিয়ার। অনেক কষ্ট দিয়েছেন আমাকে, যদিও আমার কিছু মনে নেই। কিন্তু তবুও এই মায়ার কাছে আসতে হলে আপনাকে আমাকে সবার সামনে স্বীকৃতি দিতে হবে। আবারও বিয়ে করতে হবে আমাকে তবে আমি সেটা নিজের মুখে বলবো না। দেখি আপনার ভাবনা কতদূর যায় আমাকে নিয়ে।”
আরমান বাইরে থেকে বলল, “যতোই তুমি আমাকে দূরে সরাতে চাও না কেনো, আমি ততোই তোমার কাছে আসবো মায়াবতী। আমার থেকে তোমার নিস্তার নেই। আমার এই আমিতেই আবদ্ধ থাকতে হবে তোমায়।”
মায়া:- “নির্লজ্জ পুরুষ মানুষ।”
আরমান:- “হুম। বউয়ের জন্য নির্লজ্জ হতেও রাজি।”
ভিতর থেকে আর কোনো সাড়া শব্দ এলো না। আরমানের আর কি করার, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাঁটা দিলো আবিররা যেই রুমে আছে সেই রুমের উদ্দেশ্যে।
ওদের রুমে গিয়ে দেখলো আবির আর আয়ান দুজনে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। ও একবার সেইদিকে তাকিয়ে অসহায় চোখে তাকালো সোফার দিকে। এই টুকু সোফায় ওর এতো বড়ো শরীর টার কিছুতেই জায়গা হবে না। ও কি যেনো ভেবে আবিরের কাছে গিয়ে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ধীর আওয়াজে বলল, “আবির! তোকে রুবি ডাকছে। বাইরে অপেক্ষা করছে তোর জন্য। কি যেনো বলতে চাই।”
কথাটা আবিরের কানে যেতেই ধরফর করে বিছানায় উঠে বসলো ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে। আয়ান আর ও একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকায়, আবির এভাবে উঠতেই আয়ান বিছানা থেকে ধপ করে পড়ে গেলো। ওরা দুজন বিছানার একদম ধারেই শুয়েছিল।
আয়ান আর্তনাদ করে উঠলো, “ওহ মাগো। আমি শেষ।
এদিকে আবির ঘুম ঘুম চোখে, “কোই কোথায় রুবি? কোথায় ডাকছে? কোথায় যেতে হবে?”
আরমান:- “বাইরে অপেক্ষা করছে তোর জন্য।”
আয়ান মেঝেতে বসে থেকেই কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “প্লিজ ব্রো দয়া করে আমাকে একটু ঘুমাতে দাও। এতোটা রাত অবধি কোনো দিনও জেগে থাকিনি। চোখ গুলো প্রচন্ড জ্বালা করেছে।”
কথাটা বলেই আয়ান নিজের সাথে পড়ে যাওয়া বালিস টাকে নিয়ে, মাথার নিচে দিয়ে মেঝেতেই শুয়ে পড়লো।
আর আবির তো ঘুম ঘুম চোখেই বেরিয়ে গেছে তার রুবি ডার্লিং এর কথা শুনে। আরমানের রাস্তা ক্লিয়ার। ও বিছানাটা ঠিক করে ধপাস করে শুয়ে পড়লো। এদিকে আবির কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দেখলো আরমান শান্তি করে বিছানায় ঘুমাচ্ছে।
আবির:- “ওই ব্যাটা? কোথায় রুবি? এই এই তুই রুমে কি করছিস?”
আরমান ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলল, “রুবি নিজের রুমে আছে। ঘুমাতে দে আবির ডিস্টার্ব করিস না।”
আবির:- “রুবি নিজের রুমে কিন্তু তুই যে বললি…এই এক মিনিট। তোকে নিশ্চয় মায়া রুম থেকে বের করে দিয়েছে তাই না? আর তাই তুই মিথ্যে বলে আমাকে উঠালি বিছানা দখল করার জন্য।”
আরমানের তরফ থেকে কোনো উত্তর এলো না। ও ঘুমাতে ব্যাস্ত। আবির বিরক্ত হয়ে বলল, “এই আমি কোথায় ঘুমাবো তাহলে?”
আরমান ঘুম ঘুম কন্ঠ তেই উত্তর দিলো, “আজকের মতো সোফায় অ্যাডজাস্ট করে নে আর নয় তো আয়ানের মতো ফ্লোরে।”
আবির:- “ওই টুকু সোফায় শোয়ার অভ্যাস নেই আমার। বিছানা টা তো অনেক বড়ো, ভালো ভাবে দুই জনার জায়গা হয়ে যাবে।”
আরমান:- “ভুলেও ওই চিন্তা মাথাতে আনিস না। আমি কারোর সাথে বেড শেয়ার করতে পারি না।”
আবির:- “ওই তাই বুঝি? নাচতে নাচতে তো চলে গেলি মায়ার সাথে ঘুমানোর জন্য। তাহলে বউয়ের সাথে কিভাবে বেড শেয়ার করতিস?”
আরমান বিরক্ত হয়ে বলল, “ধ্যাত! বউ আর তোরা এক নাকি? বউ মানেই, বউকে বুকে নিয়ে প্রশান্তির ঘুম দেওয়া। বেশি বকবক করিস না, ঘুমাতে দে।”
বলেই আরমান একটা বালিশ নিয়ে কানে চাপা দিলো। আবিরের আর কি করার? একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাকালো মেঝেতে শুয়ে থাকা আয়ানের দিকে। ওই শক্ত মেঝের থেকে ছোটো সোফাটাই বেটার। তাই কোনো রকমে গুটিশুটি মেরে সোফাতেই শুয়ে পড়লো ও।
পরের দিন দুপুর ১২ টার দিকে…
বাড়ির ছেলেরা এখোনো ঘুমে বিভোর। রুবি গিয়েছিল একবার ওই রুমে। তবে ওদের অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে শেষ। মায়া মাইশা ওদেরকেও ডেকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছে। আয়ান মেঝেতে মাথার বালিশ বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। আর আবির বেচারা সোফা থেকে পড়ে গিয়ে মেঝেতেই ঘুমাচ্ছে। এক পা তখনো সোফায়। আবির এবং আয়ানের শোয়ার ভঙ্গি ভীষণ হাস্যকর। আর আরমান? সে বাবু তো বিছানায় আরাম করে ঘুমাচ্ছে। ওদেরকে অনেক ডেকেও উঠাতে পারেনি।
তাই মায়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজকের দিনটা মায়া কুঞ্জেই কাটাবে। পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখেছে ও। এই পুরো বাড়িটা ওর ভাবতেই খুশি খুশি লাগছে। ও শুনেছে কাগজে কলমেও নাকি এই বাড়ি মায়ার নামে আছে। অনেক আগেই আরমান এই ডুপ্লেক্স বাড়ি বানিয়েছিল ওর জন্য।
সত্যি মানুষটা পারেও বটে। পুরো বাগান টাও খুব সুন্দর করে সাজানো বিভিন্ন দেশি বিদেশি গাছ দিয়ে। আর সবথেকে আকর্ষনীয় বিষয় হলো এই সুন্দর বাগানে একটা কাঁচের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছোট্ট কুঁড়ে ঘরের মতো বাড়ি। ঘরটির মধ্যে একটা সিঙ্গেল বেড রাখা। আর অনেক আর্টিফিশিয়াল ফুল পাতা গাছ দিয়ে সাজানো পুরো রুমটি। একেবারে মায়ার মনের মতো। ঘরটি বাগানে হওয়াই, জানালার কাঁচ সরালেই খুব সুন্দর বাতাস আসে।
মায়া রুবির মুখে শুনলো, ও যখন অসুস্থ ছিল তখন শাহরিয়ার ম্যানশনের বাগানে এমন একটা ঘরের জন্য বায়না ধরেছিল। আর সেই বায়না রাখতেই হয়তো মায়া কুঞ্জে এমন ঘর বানিয়েছে।
মায়া মাইশা রুবি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজকে এই মায়া কুঞ্জের বাগানে রান্না করবে। ছোটো খাটো একটা পিকনিক এর মতো। এমনিতেই ওরা আজ অনেক দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে, ছেলেগুলো তো এখনো উঠেইনি।
ওরাও সকালের ব্রেকফাস্ট দুপুর বারোটায় করে এখন বাগানে, বিরিয়ানি রান্নার জন্য জোগাড় করতে ব্যাস্ত।
মায়া আলু কাটতে কাটতে জিজ্ঞাসা করলো, “আপু সামিরা এখনো উঠেনি তাই না?”
রুবি:- “না ভাবী মনি, এখনো উঠেনি। ও হচ্ছে আর এক কুম্ভকর্ণের নাতনি। এমনিতেই অনেক বেলাতে ঘুম থেকে উঠে, তার উপর আবার কাল সারারাত জেগেছে।”
মায়া উদাশ গলায় বলল, “হুম! কাল তোমাদের সকলকে অনেক জ্বালিয়েছি আমি তাই না?”
মাইশা মায়ার মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, “হুম তা তো একটু জ্বালিয়েছিসই বটে। কিন্তু আমাদের থেকে বেশি আরমানকে জ্বালিয়েছিস। বাব্বাহ মেয়ের কি সাহস! আরমান শাহরিয়ার এর গলায় ছুরি ধরে!”
মাইশার শেষের কথায় মায়া একটু লজ্জা পেলো, “ওটা তো উনাকে ভয় দেখানোর জন্য ধরেছিলাম।”
রুবি:- “হ্যাঁ প্রথমে না হয় স্যারকে ভয় দেখানোর জন্য ধরেছিল। কিন্তু তারপর নিজের গলায় যে ধরেছিলে? সেটা কিন্তু একদম ঠিক করোনি ভাবী মনি।”
মাইশা:- “হ্যাঁ রুবি ঠিক বলেছে। এমন কেউ করে? আর একটু হলে জান বের হয়ে যেতো আমাদের।”
মায়া দাঁত বের করে বলল, “একটা সিক্রেট বলি তোমাদের? নিজের গলাতেও ছুঁড়ি আমি উনাকে ব্লাকমেইল করার জন্যই ধরেছিলাম।”
মাইশা মৃদু রাগ দেখিয়ে বলল, “হ্যাঁ ব্লাকমেইল করার জন্য, তাহলে গলা টা এভাবে কাটলি কেন।”
মায়া কাঁদো কাঁদো হয়ে গলায় কাটা জায়গা টাই হাত দিয়ে বলল, “সত্যি আপু ওটাও ও ভয় দেখানোর জন্যই একটু চাপ দিয়েছিলাম কিন্তু বুঝতে পারেনি যে সত্যি সত্যি এতোটা কেটে যাবে। প্রচন্ড ব্যাথা পেয়েছি কিন্তু।”
মাইশা:- “আর যাই করিস কখনো সুইসাইড করা নিয়ে ব্লাকমেইল করিস না আরমান ভাইয়াকে। মানুষটার প্রাণ ভোমরা হচ্ছিস তুই।”
মায়া মুখে কিচ্ছু বলল না শুধু মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।
রুবি:- “দাঁড়াও আমি সামিরাকে উঠিয়ে নিয়ে আসি। ও তো বিরিয়ানি খেতে ভীষণ ভালো বাসে।”
বলেই রুবি উঠে গেলো সামিরাকে ডাকতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সামিরাকে নিয়ে এলো রুবি। মাথার চুল এলোমেলো, পরনে একটা টিশার্ট আর প্লাজো। গলায় একটা ওরনা ঝুলছে। এখনো চোখ বন্ধ করে আছে ও। রুবি ওকে একহাতে ধরে আছে। কারণ এখনো ঘুম ছাড়েনি ওর পা টলমল করছে।
সামিরা এক বার চোখ খুলেই আবার বন্ধ করে নিয়ে ঘুম ঘুম কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো, “তোমরা কি করছো ভাবী মনি?”
মায়া হাসি মুখে বলল, “তোমার ফেভারিট বিরিয়ানি রান্না।”
সামিরা:- “ওহ আচ্ছা করো তাহলে আমি দোলানাটাতে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিই। বিরিয়ানি হয়ে গেলে উঠিয়ে দিও কিন্তু।”
বলেই সামিরা ঘুমু ঘুমু চোখে এগিয়ে গেলো বাগানে থাকা দোলনাটার দিকে। কিন্তু দোলনা আর সামিরার মাঝে আছে চুলা, যার মধ্যে ভাত রান্নার জন্য পানি গরম করতে দেওয়া হয়েছে। সামিরা চোখ বন্ধ করেই হাঁটছে। আর একটু গেলেই জলন্ত চুলা আর হাঁড়ির সাথে ধাক্কা খাবে। মায়া রুবি মাইশা আঁতকে উঠলো।
মায়া:- “সামিরা!! চুলার সাথে ধাক্কা খাবে তো দেখো হাঁটো।”
রুবি ছুটে গিয়ে সামিরাকে ধরলো। আর একটু হলেই ধাক্কা খেতো ও। আর ধাক্কা খেলেই গরম পানি সহ চুলার আগুন সামিরার গায়ে লাগতো।
আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৪৯
সামিরা কিউট ফেস করে বলল, “সঅঅরি। দেখিনি। আর একটু হলে তোমরা বিরিয়ানির জায়গায় সামিরা রোস্ট খেতে।”
কথাটা বলেই দাঁত বের করে হাসলো সামিরা। মায়ারা সবাই কপাল চাপড়ালো। এই মেয়ে জীবনেও শুধরাবে না।
ঠিক তখনি গাড়ির হর্নের আওয়াজ শুনে সবাই ঘুরে তাকালো। একটা বিএমডব্লিউ কার মায়া কুঞ্জে প্রবেশ করছে। বাগান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গাড়ি ঠিক বাগানের কাছে এসেই থেমে গেল। তবে গাড়ি থেকে নেমে আসা অপ্রত্যাশিত ব্যাক্তিটিকে এই অসময়ে এখানে দেখে ওরা সবাই অবাক হলো।
