আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৫৮

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৫৮
সালমা খাতুন

এই কিছুক্ষণ হলো অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছে আয়ান। যদিও অন্য দিন এতো তাড়াতাড়ি ফিরে না, তবে আজ আরমান মায়াকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর ও আর আবিরও চলে এসেছে। মাত্র শাওয়ার নিয়ে মাথার ভেজা চুল গুলো একটা তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে বের হচ্ছে ওয়াশরুম থেকে। পরনে একটা ট্রাউজার আর টিশার্ট । ঠিক তখনি ধরাম করে আওয়াজ তুলে ওর ঘরের দরজাটা খুলে গেলো। আয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালো সেই দিকে, মাইশা অগ্নিমূর্তি রুপ ধারণ করে গটগট পায়ে প্রবেশ করছে রুমে।

মাইশা সোজা আয়ানের কাছে এসে ওর টিশার্ট এর গলার কাছটা দুই হাতে মুঠো করে ধরে, রাগী গলায় চিৎকার করে বলল, “কেনো করছেন এমন? কি ক্ষতি করেছি আপনার?”
আয়ান শান্ত ভঙ্গিতে মাইশার হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, “টিশার্ট ছাড়ো!”
মাইশা রাগ দুঃখে টিশার্ট ধরে ঝাঁকয়ে বলে উঠল, “ছাড়বো না! ছাড়বো না আমি! আগে বলুন, কেনো করছেন এমন? কেনো? কেনো?”
আয়ান শান্ত ও গম্ভীর গলায়, “কি করেছি আমি?”
মাইশা:- “কেনো? জানেন না বুঝি? নাটক করছেন? নাটক করছেন আমার সাথে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আয়ান তাচ্ছিল্য হেসে বলল, “নাটক? সেটা তো তুমি ভালো পারো। তাই এতো চাকরির জন্য দৌড়াদৌড়ি না করে কোনো প্রোডাকশন হাউস জয়েন করলেই তো পারো। চাইলে আমায় বলতে পারো আমার চেনা জানা ভালো ভালো অনেক প্রোডাকশন হাউস আছে, যোগাযোগ করিয়ে দেবো। আমি সিউর! তুমি সিনেমা সিরিয়ালে অভিনয় করলে দারুন হিট হবে।”
আয়ানের এমন তাচ্ছিল্য মিশানো কথায়, অপমানে দুই চোখ ভরে উঠলো মাইশার। ছলছল ও অসহায় চোখে তাকালো আয়ানের দিকে। হাতের মুঠো আলগা হয়ে গেলো। আয়ান আবারো তাচ্ছিল্য হেসে মাইশার হাত নিজের টিশার্ট থেকে ছাড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো।

মাইশা অসহায় গলায় বলল, “আর কতো? আর কতো ভাবে কষ্ট দিবেন আমায়? মন থেকে ক্ষমা চাইলে আল্লাহর কাছেও সাত খুনেরও মাফ আছে, আপনার কাছে কি নেই? চলেই তো গিয়েছিলাম আপনার জীবন থেকে। ছেড়ে দিয়েছি আপনাকে আপনার মতো, তাহলে আমাকে কেনো আমার মতো করে ছেড়ে দিচ্ছেন না? অনেক দিন থেকে চাকরির জন্য অ্যাপ্লাই করছি, তারা সিলেক্ট ও করছে আমাকে, সবই ঠিক আছে, কিন্তু যখনি জয়েন করতে যাচ্ছি, জানতে পারছি কি? আমাকে চাকরিটাও দিয়েও নিয়ে নেওয়া হয়েছে। কেড়ে নেওয়া হয়েছে আমার চাকরিটা, হ্যাঁ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তুমি! তুমি কেড়ে নিয়েছো। কেনো? কেনো? কেনো করছো এমন? প্রথমে বুঝতে পারিনি, প্রতিটা কম্পানি কেনো এমন করছে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, এই সব কিছুর পিছনে তুমি আছো।”
মাইশা খেয়ালই করলো না যে ও অতিরিক্ত ভেঙে পড়ার ফলে, কখন আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছে। আগে তো তুমিই বলতো ও আয়ানকে। আপনি আপনি করলে খুব রেগে যেতো আয়ান, বলতো আপনি বললে কেমন যেনো পর পর লাগে।

আয়ান নিজের শরীরে পারফিউম স্প্রে করতে করতে ভাবলেশহীন ভাবে বলল, “কি ভেবেছিলে? এতো তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবো তোমায়? এতো সহজে মুক্তি দেবো তোমায়? কক্ষনো না। এই আয়ানকে ছেড়ে দিয়েছিলে না? কেনো যেনো, হ্যাঁ আয়ানের ক্ষমতা নেই, টাকা নেই, নাম, খ্যাতি, যশ কিচ্ছু নেই। তাই দেখিয়ে দিলাম এই আয়ান শাহরিয়ার এর পাওয়ার, এই আয়ান শাহরিয়ার ও চাইলে সবকিছু পারে।”
মাইশা:- “এতোই যখন ঘৃণা করো, তাহলে কেনো এই বিয়েতে মানা করে দিচ্ছো না? কেনো রাজি হলে এই বিয়েতে?”

আয়ান:- “ঘৃণা? যাকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলাম তাকে এতো সহজেই কি ঘৃণা করা যায়? কিন্তু সেই কোমল হৃদয়টা না এখন আর কোমল নেই, সময়ের আঘাতে তা শক্ত পাথরে পরিণত হয়ে গেছে। আরো! আরো কষ্ট পেতে হবে তোমায়। তাই ভেবো না এত সহজে মুক্তি পাবে। নিজের কাছে রেখে তিলে তিলে শেষ করবো তোমায়, ঠিক যেমনটা আমার সাথে করেছো তুমি।”

কথা গুলো বলেই আয়ান রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মাইশা অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল ওর চলে যাওয়ার দিকে। যখন ও এই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তখন থেকে বিভিন্ন কম্পানিতে ইন্টারভিউ দিয়েছে ও চাকরির জন্য। সিলেক্ট ও হয়েছে ও, কিন্তু জয়েন করার সময় জানতে পারে চাকরি টা ওকে দেওয়া হয়নি। ক্যান্সেল করে দেওয়া হয়েছে। এভাবেই চলতে থাকে। প্রথমে এর কারণ ও বুঝতে পারে না, তবে আজ? আজও একটা কম্পানিতে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল ও। কিন্তু সেখানে গিয়েও জানতে পারে, ওকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে সেই লিস্ট থেকে। অনেক কান্নাকাটি করে ও, কেনো এমন করা হয়েছে জানার জন্য। চাকরি চাই না, শুধু কারণ টা জানতে চাই। মাইশার কান্না কাটি দেখে ওই কম্পানির একজন বড়ো পজিশনে থাকা ফিমেল স্টাফ জানায় আয়ান শাহরিয়ার কথায় ওর নাম বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রচন্ড অবাক হয়েছিল মাইশা। কেনো জানি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি ও, এরপর অপেক্ষা করছিল আয়ানের বাড়ি ফিরে আসার। আর এখন আয়ানের কথায় সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেলো।

বিদ্ধস্ত চেহারায় এলোমেলো পায়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করলো মাইশা। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে ওর। আর সহ্য করতে পারছে না আয়ানের এতো অবহেলা।‌ মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে…এই দুনিয়ায় মায়া ত্যাগ করতে। কিন্তু বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পারে না। ও না থাকলে ওর বাবা মাকে দেখার মতো এই দুনিয়ায় যে আর কেউ নেই।
মাইশা বেডে বসেছিল, হঠাৎই ওর চোখ গেলো বেড সাইড টেবিলে। সেখানে একটা খাম রাখা। ভ্রু কুঁচকে তাকালো মাইশা সেইদিকে। এটা কে রাখলো এখানে, রুম থেকে বেরোনোর আগে তো ছিল না ওটা। মাইশা কৌতুহল বশত হাতে তুলে নিলো খামটা। কি মনে করে খুলে দেখলো। ভিতরে থাকা কাগজটা দেখে কিছুটা অবাক হলো ও। এটা একটা, চাকরির জয়েনিং লেটার। যেটা ওর জন্যই পাঠানো হয়েছে। ওর যেদিন ইচ্ছে সেদিনই জয়েন করতে পারে। অবাক হওয়ার কারণ, কম্পানির নামের জায়গায় বড়ো বড়ো করে লেখা, ‘শাহরিয়ার ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যান্ড ফ্যাশন হাউস।’

বেশ কিছুক্ষণ পর আরমান গাড়ি থামালো। মায়া জানালা দিয়ে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, ওরা ঠিক কোথায় এসেছে। ছোটো বড়ো বেশ কিছু বাড়ি, আবাসিক এলাকা।
আরমান গাড়ি থেকে নেমে মায়ার দিকের দরজা টা খুলে দিলো। মায়া চারিদিক অবাক চোখে দেখছে, গাড়িতে বসে থেকেই।
আরমান:- “কি হলো? কি ভাবছো? নেমে এসো?”

মায়া হঠাৎ অদ্ভুতভাবে শান্ত হয়ে গেছে। আরমানের বাড়ানো হাতটি ধরে ধীরে গাড়ি থেকে নামল সে। এরপর আরমান মায়ার হাত শক্ত করে ধরে নিয়ে এগোল এক অচেনা বাড়ির দিকে। মায়া চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল, সবকিছু যেন আগেও দেখেছে—চেনা চেনা লাগছে ভীষন ভাবে। বাড়িটা অনেক পুরোনো, তবুও বোঝা যায়, অচিরেই নষ্ট হয়ে যাওয়া অংশগুলো হয়তো কিছুদিন হলো নতুন করে মেরামত করা হয়েছে। ভিতরে যেতেই একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে, আরমানকে উদ্দেশ্য করে বলল,“এই অসময়ে এলে যে? কোনো দরকার ছিল স্যার?”

আরমান:- “না আন্টি, এমনিই এলাম। ও মায়া! আমার ওয়াইফ আর এই বাড়ির মালকিন।”
এই বাড়ির মালকিন কথটা শুনে মায়া ফ্যাল ফ্যাল চোখ চাইলো আরমানের দিকে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল মায়া, “এ..এটা..এটা আমার বাড়ি? আ..আমার পাপার বাড়ি?”
আরমান মুখে কিছু না বল মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। মায়া চোখ বন্ধ করে নিলো, এবং সাথে সাথে মায়ার চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।

মহিলাটি:- “অনেক সুন্দর দেখতে তোমার বউ। এই সন্ধ্যার সময় কান্না করতে নেই মা। এসো! ভিতরে এসো।”
মায়া চোখ খুলে দুই চোখের পানি মুছে নিলো। আরমানের হাত ছেড়ে এগিয়ে গেলো ও। উঠোন পেরিয়ে বারান্দার কাছে যেতেই, হঠাৎই মায়া থমকে গেলো। একটা দৃশ্য ফুটে উঠলো ওর চোখের সামনে, একটা মেয়ে বসে আছে বারান্দার মেঝেতে, আর একটা লোক মোড়ায় বসে সেই মেয়ের মাথায় হয়তো তেল মালিশ করে দিচ্ছে। কিন্তু মুখ গুলো অস্পষ্ট, বোঝা যাচ্ছে না। সব কেমন যেনো অন্ধকার আর কালো কালো লাগছে। এরপরই দৃশ্য চেঞ্জ হলো, এখন লোকটির জায়গায় আছে মেয়েটি, আর মেয়েটির জায়গায় আছে লোকটি।
মায়া সেই দিকে এগিয়ে যেতেই দৃশ্য টি কোথায় যেনো মিলে গেলো। এরপর মায়া হঠাৎই বাড়ির ভিতর একটা বাচ্চা মেয়ের হাসির শব্দ শুনতে পেলো যেনো। ও চমকে উঠে তাকালো সেই দিকে, এরপর ছুটে প্রবেশ করলো বাড়ির ভিতর।

এদিকে আরমান অবাক চোখে দেখছে সবকিছু, মায়াকে কেমন যেনো অস্বাভাবিক লাগছে। ও নিজেও মায়ার পিছনে ছুটে গেলো, মায়া চার চেয়ারের মাঝারি সাইজের ডাইনিং টেবিল টার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, অবাক চোখে চোখে চেয়ে একটা খালি চেয়ারের দিকে।
মায়ার দৃশ্যপটে ভেসে উঠছে, একটা বাচ্চা মেয়ে গাল ফুলিয়ে বসে আছে চেয়ারে, আর একটা লোক তার রাগ ভাঙ্গিয়ে তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আগের মতোই মুখ গুলো অস্পষ্ট, অন্ধকার। এভাবেই এক এক জায়গায় এক এক রকম দৃশ্য ফুটে উঠেছে মায়ার চোখের সামনে, মায়া একবার এদিকে ছুটে যাচ্ছে তো আর একবার ওই দিকে ছুটে যাচ্ছে। কেমন যেনো পাগলের মতো ব্যবহার করছে ও, নিজেই নিজের মাথার চুল খামচে ধরছে।

আরমান সবকিছু দেখে চলছে শান্ত চোখে। হঠাৎই মায়া ছুটে বাইরে চলে গেলো, সাথে সাথে আরমানও ছুটে এলো। মায়া চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, “নিও যেও না!! নিও যেও না তোমরা আমার পাপাকে! গম্ভীর সাহেব! গম্ভীর সাহেব ওদেরকে আটকান, ওরা…ওরা আমার পাপাকে নিয়ে যাচ্ছে। না..না..নিও যেও না! নিয়ে যে….”
আর বলতে পারলো না মায়া। ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে পড়ে যেতে নিলো, কিন্তু তার আগেই ছুটে এসে ধরে ফেললো আরমান মায়াকে। মায়া আরমানের উপর ঢলে পড়লো, জ্ঞান হারিয়ে। আরমান অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল মায়ার দিকে।

রাত পেরিয়ে ভোর হয়েছে….
আরমান হসপিটালের করিডোরে একটা কেবিনের সামনে চেয়ারে বসে আছে, পিছনের দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে, চোখ বন্ধ। মুখে ক্লান্তির ছাপ, মাথার চুল গুলোও এলোমেলো। ডক্টরের কথা অনুযায়ী মায়ার স্মৃতি ফিরে এসেছে, উপরওয়ালার ইচ্ছাই অসম্ভব জিনিসটাই সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এতে আরমান খুশি হবে কিনা বুঝতে পারছে না। মায়ার জ্ঞান ফিরলেও এখন ওষুধ ইনজেকশন এর প্রভাবে ঘুমাচ্ছে। মায়ার সাথে এখনো কারোর কথা হয়নি। ডক্টর বলেছেন, স্মৃতি ফিরলেও এই যে মাঝের দুই মাসের ঘটনা না গুলো মনে থাকবে কিনা বলতে পারছে না। অনেক সময় এমন হয় যে, পেসেন্ট এর আগের স্মৃতি ফিরে এলে, মাঝের স্মৃতি গুলো আবারো হারিয়ে যায়। ভুলে যায় সব ঘটনা। আবার কারোর ক্ষেত্রে এটা হয় না, সব ঘটনাই মনে থাকে। এখন মায়ার ক্ষেত্রে কোনটা হয়েছে সেটা মায়ার সাথে কথা না বলা পর্যন্ত জানা যাবে না।

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৫৭

আরমান ভীষণ ভাবে চিন্তিত। যদি মায়া এই দুই মাসের ঘটনা গুলো ভুলে যায়, তাহলে ওদের সম্পর্ক টা ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? মায়া কি ওকে মেনে নিতে পারবে? মায়া তো স্মৃতি হারানোর আগে চলে যেতে চেয়েছিল, মুক্তি পেতে চেয়েছিল ওর থেকে। তখন তো মায়া কিছুই জানতো না। কিছুই বুঝতে পারছে না আরমান, প্রচন্ড ভয় লাগছে ওর। ও কি আবারও ওর মায়াবতী কে হারিয়ে ফেলবে? আচ্ছা মায়া যদি ওকে মেনে না নেয়, তাহলে কি করবে ও? ও কি মায়া কে ছাড়া থাকতে পারবে? সহ্য করতে পারবে ওর আর মায়ার দূরত্ব? ও কি কোনোদিনও মায়াকে নিয়ে সুখী হতে পারবে না? এভাবেই কেটে যাবে সারাজীবন? কিভাবে সহ্য করবে মায়ার অবহেলা?
হাজারো ভাবনা আরমানের মাথার ভিতরে কিলবিল করে বেড়াচ্ছে। আবারও জ্বলছে বুকের ভিতরটা।

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৫৯