আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৮
সালমা খাতুন
মিস্টার ড্যানিয়েল ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বলল, “হুনি কি ভলতে ছাই হামি তা শুনতে ছাই মিস্টার হারমান।” (উনি কি বলতে চাই আমি তা শুনতে চাই মিস্টার আরমান)।
এটা শুনে মায়া মুখ তুলে তাকালো সবার দিকে। আরমানের চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। আবির চোখের ইশারায় আশ্বাস দিয়ে মুখে বলে উঠলো, “কি বলতে চাও বলো মায়া।”
মায়া:- “আসলে এই শাড়ির ডিজাইন টা একটু চেঞ্জ করলে আরো ভালো লাগতো।”
আরমানের হেড ডিজাইনার দিশা রেগে গিয়ে বলল, “ওই মেয়ে তোমার সাহস তো কম না, একজন সার্ভেন্ট হয়ে আমার ডিজাইনকে খারাপ বলো।”
দিশার কথা শুনে মায়া আবারও মাথা নিচু করে নেয়। আর আবির রেগে গিয়ে বলে, “মুখ সামলে কথা বলবেন মিস দিশা, মায়া তোমার স্যারের সার্ভেন্ট হলেও আমার বোন। তাই ওকে কিছু বলার আগে ভেবে বলবেন।”
আরমান এবার রেগে বলল, “এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে ঝগড়ার কম্পিটিশন নয়।”
মিস্টার ড্যানিয়েল মায়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “What’s your name.”
মায়া:- “মায়া তালুকদার”
মিস্টার ড্যানিয়েল:- “ হাচ্ছা মায়হা ঠুমি বলো ডিজাইনঠাতে কি চেঞ্জ খরলে ভালো লাঘবে।”
মায়া অভিজ্ঞদের মতো করে বলে উঠলো, “এই শাড়িটা হলুদ রঙের উপড়ে কালো রঙের কাজ করা। আবার পাড়ের লেসটাও একই সেম কালার। শুধু কাজটা আলাদা। ব্লাউজটাতেও সেম কাজ করা আবার একই রঙের। এটা দুইরকম ভাবে চেঞ্জ করলে ভালো লাগবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এক নাম্বার, এই যে লেসটা আছে এটার ডিজাইন একই রেখে যদি কালারটা চেঞ্জ করা যেত, মানে লেসের মেঝেটা হবে কালো আর ডিজাইন টা হবে হলুদ রঙের। আর ব্লাউজটা হবে একদম প্লেইন। কোনো ডিজাইন হবে না। শুধু শাড়িতে যেই লেসটা আছে ওটা ব্লাউজের হাতেও থাকবে। আর গলাতে হালকা ডিজাইন থাকবে।
আর দুই নাম্বার, আমি যেমন বললাম শাড়িটা তেমনি থাকবে শুধু লেসটাতে একটু চেঞ্জ হবে। কালো রঙের লেসটাতে হলুদ রঙের পাইপিং দিয়ে যদি ব্লাউজের কালার টা কালো রঙের হয়। তাহলে শাড়িটা পড়লে প্রথমে কালো রঙের ব্লাউজ থাকবে তারপর শাড়ির পাড়ের হলুদ রঙের সরু পাইপিং এরপর শাড়ি।”
মিস্টার ড্যানিয়েল খুশি হয়ে বলে উঠলেন, “Excellent, এখদম ঠিক ভলেছেন মিস মাইহা। হাচ্ছা হাফনি কি এই ডিজাইনঠা ভানাতে পারবেন।”
মায়া:- “জী পারবো।”
মায়ার যুক্তিটা আরমান, আবির সবারই পছন্দ হয়েছে শুধু মিস দিশার বাদে। ও কিছু বলতেও পারছেনা। কিন্তু রাগে ফুঁসছে।
আরমান:- “আচ্ছা ঠিক আছে, মিস মায়া আপনাকে আধাঘন্টা সময় দেওয়া হলো। পারলে এর মধ্যে ডিজাইনটা করে দেখান”
মায়া আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে উঠলো, “আচ্ছা ঠিক আছে।”
আরমান একটা ল্যাপটপ এগিয়ে দিলে মায়ার দিকে। আবির নিজের চেয়ার ছেড়ে দিয়ে মায়াকে বসার ইশারা দিলো। এরপর আরমান মিস্টার ড্যানিয়েল এর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, “চলুন মিস্টার ড্যানিয়েল আমরা আমাদের লাঞ্চ টা সেরে নিই। ততক্ষণ উনি ডিজাইন টা করুক।”
মিস্টার ড্যানিয়েল:- “ইয়েস মিস্টার হারমান, হাফনি এখদম ঠিক ভলেছেন।”
এরপর আরমান সবার জন্য লাঞ্চ অর্ডার করলো। মায়া ততক্ষণে নিজের কাজ শুরু করে দিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুইজন এসে ওদের লাঞ্চ দিয়ে গেলো। আবির আগে আগে গিয়ে মায়ার আনা লাঞ্চ এর ব্যাগটা খুললো। আরমানের অফিস রুমের বড়ো সোফায় ওরা পাঁচজনই গোল হয়ে বসে গেলো। মায়ার আনা খাবারের বক্স গুলো খুলতেই মিস্টার ড্যানিয়েল বলে উঠলেন, “ Wow Bengali foods? Can I try these?”
আবির:- “কেন নয় মিস্টার ড্যানিয়েল। এগুলো মায়া রান্না করেছে। ওর হাতের রান্না অনেক টেস্টি, খেয়ে দেখুন।”
দিশা মুখে কিছু বলতে না পারলেও নাক সিঁটকালো। এদিকে মায়ার কোনো দিকে ধ্যান নেই ও একমনে ডিজাইন করতে ব্যস্ত। দিশা বাদে সবাই মায়ার আনা খাবার দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিলো। আর মিস্টার ড্যানিয়েল তো মায়ার রান্নার এতো এতো প্রশংসা করলো যে আরমান বিরক্ত হয়ে গেলো। হ্যাঁ ও মানছে মায়ার রান্না টা ভালোই হয়েছে তাই বলে এতো প্রশংসা করার কি আছে। আরমানের মনে হচ্ছে মিস্টার ড্যানিয়েল মায়াকে নিয়ে একটু একটু বেশি বেশি করছে। ওদের খাওয়া শেষ হতে হতে মায়ার ডিজাইন করাও শেষ হয়ে গেলো। ওরা সকলে হাত মুখ ধুয়ে এসে আবারো বসে গেলো যে যার চেয়ারে শুধু মাত্র আবির বাদে কারণ ওর চেয়ারে মায়া বসে আছে। মায়া বলে উঠলো,
“ডিজাইন রেডি।”
এটা বলেই ও মিস্টার ড্যানিয়েল এর দিকে ল্যাপটপ এগিয়ে দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। তারপর আবিরকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তুমি বসো ভাইয়া।”
আবির:- “আরে না ঠিক আছে তুমিই বসো।”
মায়া:- “না ভাইয়া আমার কাজ শেষ তুমি বসো।”
আবির আর কিছু না বলে বসে পড়লো। আর এদিকে মিস্টার ড্যানিয়েল মায়ার বানানো ডিজাইন দেখে উনার মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো। মায়া যেই বর্ণনা দিয়েছিল সেই অনুযায়ী দুটো ডিজাইন বানিয়েছে। হেড ডিজাইনার দিশা অনেক ভারী ডিজাইন করেছিল, কিন্তু মায়া একই থিম রেখে হালকা ডিজাইন দিয়েছে। যা দেখে মিস্টার ড্যানিয়েল পুরোই মুগ্ধ।
মিস্টার ড্যানিয়েল:- “হারে কি ভানিয়েছেন মিস মাইহা। যাস্ট হসাধারণ। মিস্টার হারমান হামার এই ডিজাইনারেরি ডিজাইন ছাই। হাফনি থার ভ্যাবস্থা করুন।”
আরমান:- “কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব মিস্টার ড্যানিয়েল? হ্যাঁ মানছি উনি এই ডিজাইনটা সুন্দর বানিয়েছেন, তাই বলে উনাকে কিভাবে এই কাজের দায়িত্ব দিই? উনি তো কোনো প্রফেশনাল ডিজাইনার নয়। আর না তো উনি কোনো ডিজাইন এর কোর্স করেছে।”
মিস্টার ড্যানিয়েল:- “হারে এতে হসম্ভবের কি হাছে? হুনাকে তো দেখেই ভোঝা যাচ্ছে যে হুনি এখজন ডিজাইনার। না হলে এতো সুন্ধর ডিজাইন খিবাবে ভানালো?”
এতোক্ষণ আবির চুপচাপ ওদের কথা শুনছিল। এবার ও বলে উঠলো, “একদম ঠিক বলেছেন মিস্টার ড্যানিয়েল। মায়া একজন ড্রেস ডিজাইনার। এর আগে একটা ছোটো কম্পানিতে হেড ডিজাইনার হিসাবে কাজ করতো। ওর ডিজাইনের জন্য সেই কম্পানি কিছুটা উপরেও উঠেছে। আর মায়া ডিজাইন এর কোর্স ও করেছে। সেটা আমাদের স্যার জানে না।”
এগুলো শুনে আরমান তো অবাক হয়ে গেলো। ও অনেক আগে শুনেছিল মায়া একটা ছোটো কম্পানিতে জব করে। কিন্তু কিসের কাজ সেটা জানতো না। ও অবাক হয়ে তাকালো মায়ার দিকে।
এদিকে দিশা তো রাগে ফুঁসছে। ও বলল, “কিন্তু উনি তো স্যারের সার্ভেন্ট। উনি কিভাবে…..”
দিশাকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই মিস্টার ড্যানিয়েল ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বলে উঠলেন, “হাপনি থামুন মিস ডিসা। হাপনি এখন যেথে ফারেন। হাফনাকে দরখার হলে ঢাকা হুবে।”
আবিরও সাই জানিয়ে বলল, “হ্যাঁ আপনি এখন যান দিশা। আপনাকে দরকার হলে ডেকে নিবো।”
দিশা রাগে অপমানে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেলো। দিশা চলে যেতেই আবির মায়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, “মায়া তোমার ফোনে তোমার নিজে আরো বানানো কোনো ডিজাইন এর ছবি আছে? থাকলে দেখাও।”
মায়া মাথা নাড়িয়ে ব্যাগ থেকে ওর ফোন বের করে ওর আগে বানানো ডিজাইনগুলো দেখালো। যা দেখে মিস্টার ড্যানিয়েল তো পুরোই মুগ্ধ হয়ে গেলেন। অনেক প্রশংসা করলেন। আর জানালেন মায়া যদি ডিজাইনার হিসাবে কাজ করে তাহলে উনি এই ডিল ফাইনাল করবেন।
আরমানও দেখলো মায়ার ডিজাইন গুলো। যা দেখে ও নিজেও মুগ্ধ। এতো সুন্দর ডিজাইন দেখে ও নিজের মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। মায়া যে এতো ভালো ডিজাইনার তা ও সত্যিই জানতো না। আরমান মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি আমাদের কম্পানিতে জয়েন করবে?”
মায়া এর কি উত্তর দেবে ভেবে পেলো না। ও যদি কম্পানিতে জয়েন করে তাহলে মিস্টার আরমানের সার্ভেন্ট এর কাজ কি হবে। ও যে পুরো একমাসের টাকা নিয়ে নিয়েছে। আর সেই কন্ট্রাক্ট টার কি হবে? মায়া কনফিউজড হয়ে একবার আরমানের দিকে তাকালো তো আর একবার আবিরের দিকে তাকালো। ও কি করবে বুঝতে পারছে না। আবির ওর মনের কথা বুঝতে পেরে আরমানকে বলল, “ও তো তোর সার্ভেন্ট হয়ে জয়েন করেছে। অ্যাডভান্সও নাকি নিয়েছে, তাহলে সেটার কি হবে??”
আরমান স্বাভাবিক ভাবেই বলল, “আমি যখন বাড়িতে থাকবো তখন ও আমার কাজ করবে। আর আমি যখন অফিসে চলে আসবো তখন মায়াও অফিসে এসে অফিসের কাজ করবে। সিম্পল। আর অফিসের কাজের জন্য ওকে আলাদা করে মাইনে দেওয়া হবে।”
মিস্টার ড্যানিয়েল ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, “হাফনারা থালে হাফনাদের মতো কোথা ভলে নিন। হামি থালে আজ উঠি। হাবার এখ সপ্তাহ ফর দিখা হবে। তখন হামি এসে ডিজাইন ফাইনাল খরে যাবো। হেই এখ সপ্তাহের মধ্যে হান্ড্রেড ডিজাইন রেডি রাখবেন।”
কথা গুলো বলেই উঠে দাঁড়ালেন মিস্টার ড্যানিয়েল। সাথে তার পিএ ও। উনাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে আরমান আর আবির ও উঠে দাঁড়ালো। আরমান হাত বাড়িয়ে দিলো, হ্যান্ডশেক করার জন্য। মুখে বলল, “Okay, Mr. Daniel. See you soon.
মিস্টার ড্যানিয়েল আরমানের সাথে হ্যান্ডশেক করে মায়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, “বাই মায়া। হাবার ধেখা হবে। বালো তেকো।”
মায়া হালকা হেসে বলল, “বাই মিস্টার ড্যানিয়েল। আপনিও ভালো থাকবেন।”
এরপর মিস্টার ড্যানিয়েল ও তার পিএ বেরিয়ে গেলো আরমানের কেবিন থেকে। আবির গেলো উনাদের এগিয়ে দিতে।
আরমান মায়ার কাছে এসে বলল, “কি মিস মায়া, কি ভাবছো? এতো বড়ো একটা কাজের দায়িত্ব নিতে পারবে তো?”
মায়া:- “একদম মিস্টার আরমান। আপনি তো বললেন এই কাজের জন্য আমাকে মাইনে দেওয়া হবে আর আপনি তো জানেনই আমি টাকার জন্য সব করতে পারি।”
আরমান তাচ্ছিল্য হেসে বলল, “হ্যাঁ সে তো জানিই। তাই তো কিভাবে জানি মিস্টার ড্যানিয়েল কেও পটিয়ে ফেললে। তবে এটা আমার কোটি টাকার প্রজেক্ট। এতে একটুও ভুল চাই না।”
মায়া:- “কোনো ভুল হবে না মিস্টার আরমান। বিশ্বাস রাখতে পারেন।”
আরমান:- “ঠিক আছে রাখলাম বিশ্বাস। তাহলে কালকেই জয়েন হয়ে যেও। আর হ্যাঁ তোমার সব প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট নিয়ে আসবে। আর কাল থেকেই কাজ শুরু করতে হবে।”
মায়া:- “ঠিক আছে স্যার।”
তখনি রুমে আবির প্রবেশ করে।
আবির:- “সব কথা হয়ে গেলো তোদের। তাহলে জয়েন করছো তো মিস মায়া তালুকদার??”
মায়া:- “হ্যাঁ ভাইয়া, এতো বড়ো একটা অফার ছাড়া যাই?”
আবির:- “হ্যাঁ একদম। আচ্ছা আরমান তুই এবার বাড়ি যাবি তো। আমিও যাবো। চলো মায়া তুমি আমার সাথে। তোমার এখনো লাঞ্চ করা হয়নি।”
মায়া:- “আরে না না ভাইয়া ঠিক আছে। আমি চলে যেতে পারবো। আর ওই বাড়ি যাওয়ার আগে আমাকে একবার আমার বাড়িও যেতে হবে। আমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে হবে সাথে জামাকাপড়ও।”
আবির:- “আরে তো কি হয়েছে। আমার গাড়ি আছে। প্রথমে আমরা রেস্টুরেন্টে যাবো সেখানে তুমি লাঞ্চ করবে তারপর তোমাকে নিয়ে তোমার বাড়ি যাবো। তোমার যা যা লাগবে তুমি নিয়ে নেবে। তারপর আমরা শাহরিয়ার ম্যানশন চলে যাবো। সিম্পল। ঠিক বলিনি আরমান।”
আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৭
আবিরের শেষের বলা কথার উত্তরে আরমান গম্ভীর গলায় বলে উঠলো, “সেটা তো তোরাই ভালো জানবি।”
কথাটা বলেই আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না আরমান। গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। কেন জানি আবিরের সাথে এতোটা ফ্রি ভাবে মায়ার কথা বলা আরমানের পছন্দ হচ্ছে না। এমন ভাবে কথা বলছে যেনো কতকালের চেনা। প্রচন্ড রাগ এবং বিরক্ত লাগছে ওর ওদের দুজনকে একসাথে দেখে।